চব্বিশ
দেশে ফিরেছিলাম বেকার হিশেবে। বন্ধুদের পক্ষেও সেটা লজ্জাজনক ব্যাপার, সুতরাং তেমন বেশিদিন আমাকে কর্মহীন থাকতে হলো না। সুরজিৎ সিংহ তখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। কলকাতায় ফেরার এক সপ্তাহের মধ্যে সিংহমশাই এসে হাজির, আমাকে বিশ্বভারতীর অর্থনীতি বিভাগের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে। মামুলি একটি সম্মতিপত্র পাঠিয়ে দিলাম সঙ্গে-সঙ্গে, তবে দ্বিধা ঘুচলো না; কলকাতা ছেড়ে যাওয়া, শান্তিনিকেতনে গিয়ে ধাতস্থ হতে পারবো কিনা, এসব নিয়ে মনে গভীর সন্দেহ, আমার নিজের, আমার স্ত্রীরও। কয়েক দিনের মধ্যেই মুশকিল আসান হলো, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকেও অধ্যাপকপদ গ্রহণের আমন্ত্রণ পেলাম। জানুয়ারির চতুর্থ সপ্তাহে আলিপুরের নতুন ফ্ল্যাটে সংসার পাতা; ওখান থেকে বরানগর অনেকটাই দূর, তা হলেও তো কলকাতার চৌহদ্দির মধ্যে। সুরজিৎ সিংহের কাছে প্রচুর ক্ষমাপ্রার্থনা অন্তে, যতদূর মনে পড়ে, পয়লা ফেব্রুয়ারি স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে কাজে যোগ দিলাম।
স্বীকার করা ভালো, ওই বিশেষ মুহূর্তে লেখাপড়া-পড়াশুনো সম্পর্কে আমার আগ্রহ প্রায় শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে। কয়েক দিন বাদে ইন্দিরা গান্ধি জরুরি অবস্থা বাতিল করলেন, নানা গুজবের গুঞ্জন, প্রমোদবাবু-জ্যোতিবাবুর সঙ্গে ঘন-ঘন দেখাসাক্ষাৎ, স্নেহাংশুবাবুর বাড়িতে উজাড়-করা আচ্ছা, সে-আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতেও রাজনীতিচর্চা, আমি যদিও তখন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নাম-লেখানো সদস্য নই, সদস্য হওয়ার জন্য নেতৃবৃন্দ বলেনওনি, কিন্তু সব মিলিয়ে দলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছি। চেতনা জুড়ে রাজনীতির সম্মোহন, তাই একটু বিবেকদংশন থেকেও ভুগছিলাম, রাজনীতিসর্বস্ব দিনযাপন, লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পর্কহীন, অধ্যাপনার কাজে যোগ দেওয়া একটু অসাধুতা হলো না কি? বিবেককে হয়তো ওই ঋতুতে প্রধানত ঘুম পাড়িয়েই রেখেছিলাম।
গৌরকিশোর ঘোষ জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে কয়েদ হয়েছিল; ততদিনে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ইন্দিরা গান্ধির স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে, অনেক দিন বাদে ফের নিয়মিত দেখাশোনা হয়, তারই আগ্রহে আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় ‘মতান্তর’ শিরোনামে প্রধানত রাজনৈতিক, কিছুটা অর্থনীতি-মিশ্রিত, প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলাম, জ্যোতিবাবু-প্রমোদবাবুর সম্মতি নিয়েই। আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আর এক বন্ধু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ওঁদের কাগজে আমার লেখার সিদ্ধান্তে খুশি, মেরিডিথ স্ট্রিটের কফি হাউসে বসে লেখার পাণ্ডুলিপি প্রতি শুক্রবার তাঁকে দিয়ে পড়িয়ে ভাষাশৈলী মঞ্জুর করিয়ে নিতাম।
জরুরি অবস্থার অবসান, লোকসভার নির্বাচন ঘোষণা, সদ্যগঠিত জনতা দলের সঙ্গে বামফ্রন্টের নির্বাচনী আঁতাত, পশ্চিম বাংলার বিয়াল্লিশটি আসনের অর্ধেক, অর্থাৎ একুশটিতে, জনতা দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, বাকি একুশটিতে বামফ্রন্ট৷ ফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে আসন বাঁটোয়ারা করতে জ্যোতিবাবু কয়েক দিন ভীষণ ব্যস্ত। আগেও ওঁর বহু ন্যাড়াপোঁচা রসিকতার পরিচয় পেয়েছি, এই সূত্রেও পেলাম। তখনও সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার বামফ্রন্টে আছেও, নেইও। সেই দলের নেতারা অম্লানবদনে জ্যোতিবাবুকে এসে বললেন, বামফ্রন্টের জন্য বরাদ্দ ওই একুশটি সিটের অন্তত তেরোটি তাঁদের চাই। জ্যোতিবাবু, অবিকৃত মুখ, তাঁদের সবিনয়ে জানালেন: ‘দেখুন, আপনারা বরং সোজা জনগণের কাছেই চলে যান, তাঁরাই আপনাদের তেরোটি আসন পাইয়ে দেবেন’। মন ভার করে এস ইউ সি আই পুরোপুরি ফ্রন্ট পরিত্যাগ করলো, এখনও তারা সেই দূরস্থানেই আছে।
জরুরি অবস্থা উঠেছে, সাধারণ মানুষের মনে তবু অনিশ্চয়তা, ইন্দিরা গান্ধি সত্যি-সত্যিই নির্বাচন হতে দেবেন কিনা, নাকি পুরোটাই এক বৃহৎ কারসাজির অঙ্গ, তা নিয়ে ফিসফাস কথাবার্তার অন্ত নেই। বামফ্রন্টের একুশজন প্রার্থীর নাম জানিয়ে ময়দানে অনেক দিন বাদে বড়ো সভা, অথচ জনসাধারণের আড়ষ্টতা কাটে না, সকলেরই মনে প্রশ্নবোধক চিহ্ণ। প্রমোদবাবু পার্টির কর্মীদের জনে-জনে ডেকে সতর্ক করে দিলেন, নির্বাচনের জন্য পরিশ্রম করতে হবে ঠিকই, কিন্তু একটু রেখে-ঢেকে, যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে, গোপন ডেরাগুলির খবর পুলিশ যেন না জানতে পারে।
সংশয়ের বাঁধ ভাঙলো কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে জগজীবন রামের নাটকীয় পদত্যাগে এবং যুগপৎ বিরোধীদের সঙ্গে মিলে-মিশে তাঁর নির্বাচনে লড়বার অভিপ্রায় ঘোষণায়। মনের কুয়াশা কেটে গেল, ট্রামে-বাসে উচ্চকিত আলাপ-রঙ্গ-তামাশা, ইন্দিরা গান্ধি ও তাঁর পুত্রকে গালাগাল পেড়ে সাধারণ মানুষ মুখের সুখ মেটালেন। মার্চ মাসের শেষের দিকে যখন লোকসভার নির্বাচনী ফলাফল বেরোতে শুরু করলো, প্রায় অবিশ্বাস্য ঘটনাসম্পাত, ইন্দিরা গান্ধি নিজেও অনেক ভোটে কুপোকাত, গোটা আর্যাবর্তে কংগ্রেসের একটি আসনও জোটেনি, দক্ষিণে দলের ফল তুলনাগতভাবে সামান্য ভালো, কিন্তু সম্মিলিত প্রতিপক্ষের আসনসংখ্যা তিনশো ছাড়িয়ে গেছে, পশ্চিম বাংলাতেও মাত্র কয়েকটি আসন বাদ দিলে জনতা দল ও বামফ্রন্টের জয়জয়াকার; যে-ক’টি আসনে বিরোধীরা পরাজিত, প্রতিটির ক্ষেত্রেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে।
আমার যে-বন্ধু, জেনারেল বিশ্বনাথ সরকার, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, ততদিনে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় বসবাস করছেন। প্রায়ই আমার কাছে আসেন, কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত পাঠাগারে গিয়ে দেশের সর্বত্র-প্রকাশিত খবরের কাগজ খুঁটিয়ে-খুটিয়ে পড়েন। তিনিও আমাদের সকলের মতো জরুরি অবস্থার ঘোর বিরোধী ইন্দিরা-বিরোধী, আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘দেখবেন, নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধি কচুকাটা হবেন’। ঠিক তাই-ই হলো। কয়েক প্রহর চিন্তাভাবনার পর ইন্দিরা গান্ধি পদত্যাগই শ্রেয় বলে বিবেচনা করলেন, যদিও সঞ্জয়ের নাকি ঘোর আপত্তি ছিল, সে পুলিশ-মিলিটারি জড়ো করে জোর করে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জল্পনা আঁটছিল। জনতা দলে তিন জন প্রধান মন্ত্রী-পদপ্রার্থী: মোরারজী দেশাই, চরণ সিংহ ও জগজীবন রাম। পাকা সিদ্ধান্তের ভার দেওয়া হলো জয়প্রকাশ নারায়ণ ও আচার্য কৃপালনীর উপর। তাঁরা মোরারজীকেই পছন্দ করলেন। চরণ সিংহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জগজীবন রাম প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, পশ্চিম বাংলা থেকে প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র শিক্ষামন্ত্রী। জর্জ ফার্নান্ডেজ প্রথমটায় যোগাযোগ মন্ত্রী, সেটা পছন্দ না-হওয়ায় সপ্তাহ দুই বাদে শিল্পমন্ত্রী; যাঁকে সর্বপ্রথম এই মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে কী কারণে যেন মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে হলো। একদা কেন্দ্রীয় অর্থসচিব, এইচ এম প্যাটেল, অর্থমন্ত্রী মনোনীত হলেন, প্রধান মন্ত্রীর অতি কাছের লোক।
অস্থির সময়, স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন করে যাচ্ছি, কিন্তু অন্য সব মাথায় উঠেছে, সারাক্ষণ রাজনীতি নিয়ে চিন্তা, প্রত্যক্ষ রাজনীতির মাঠে পুরোপুরি নেমে পড়া। আর কোনও বাধাবন্ধ নেই, কলকাতা শহর, শহরতলি ও মফস্বল জুড়ে সভা-সমিতি, যত্রতত্র বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছি, প্রত্যহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি নিয়ে মিছিল-আন্দোলন। রাজনীতির পারদ দ্রুত উপরে চড়লো, এশিয়ার মুক্তিসূর্যটিকে বাছা-বাছা বিশেষণে বিদ্ধ করে তুলোধোনা, শহরে-গঞ্জে ঠাসা গুজব, ইন্দিরা গান্ধি ও তাঁর দুই পুত্র বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন। কয়েক সপ্তাহ গেলে জনতা সরকার রাজ্যে-রাজ্যে সরকার ভেঙে দিয়ে নতুন বিধান সভা নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। এই সিদ্ধান্তে যৌক্তিকতা নিয়ে কিছু কথা চালাচালি হয়েছে। কোনও-কোনও নীতিবাগীশ বলেছেন, লোকসভার নির্বাচন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে গেছে, তো কী হয়েছে, রাজ্য মন্ত্রিসভাগুলিকে ভেঙে দেওয়ার আদৌ কোনও কারণ ছিল না; ইন্দিরা গান্ধি যেমন স্বেচ্ছাচারী মানসিকতা প্রদর্শন করেছিলেন দু’বছর আগে, এই বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জনতা দলের সরকারও তাই করছেন। আমি অন্তত এই ধরনের যুক্তিতর্কের তেমন সার্থকতা খুঁজে পাই না। ইন্দিরা গান্ধি গায়ের জোর খাটিয়ে সংবিধান সংশোধন করে বিধানসভাগুলির পাঁচ বছরের মেয়াদ ছ’বছরে রূপান্তরিত করেছিলেন। সেটা অন্যায়, আমি বলবো সংবিধানের প্রকৃতি-বহির্ভূত, সুতরাং ওই এক বছর ছেঁটে দিয়ে জনতা সরকার ঠিক কাজই করেছিলেন। দিল্লিস্থ বহুদিনের বন্ধু রাজ ও রমেশ থাপর, একদা ইন্দিরা গান্ধির খুব কাছের মানুষ ছিলেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রতিবাদে ‘সেমিনার’ প্রকাশ বন্ধ রেখেছিলেন, ইন্দিরার পতন ঘটায় তাঁদের আনন্দ ধরে না। কী উপলক্ষ্যে দিল্লি গিয়ে তাঁদের আনন্দ-উৎসবের ভাগিদার হয়ে এলাম। ইন্দিরা-পতনমুহূর্তে ইকনমিক এ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-তে যে-প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তার প্রশংসা তাঁদের মুখে।
গোটা দেশ এমনিতেই উন্মাদনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার উপর এবার বিধান সভাগুলির নির্বাচন, উত্তেজনা আরও তুঙ্গে। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন লোকসভার নির্বাচনে বোঝাপড়ার মতো পশ্চিম বাংলায় বিধান সভা নির্বাচনেও জনতা দল ও বামফ্রন্টের মধ্যে আসন সমান-সমান ভাগাভাগি হবে, অর্থাৎ ৫০: ৫০। এটাও ধরে নেওয়া হয়েছিল, বয়য়াজ্যেষ্ঠ প্রফুল্লচন্দ্র সেনই মুখ্যমন্ত্রী হবেন, জ্যোতিবাবু উপমুখ্যমন্ত্রী। এরই মধ্যে বৃত্তিগত কারণে মুম্বই যেতে হলো, সেখান থেকে তিরুবন্তপুরমে। ওখানকার সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিসে কী একটা কাজ ছিল, ইন্ডিয়ান স্কুল অফ সোসাল সায়েন্সেস-এর স্থানীয় শাখার তরফ থেকে আমার উপস্থিতির সুযোগ নিয়ে একটি বক্তৃতার ব্যবস্থা। বক্তৃতাস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখি ইএমএস শুনতে এসেছেন। পার্টির কেন্দ্রীয় দফতর তখন কলকাতায়, তিনি সেদিনই সকালে কলকাতা থেকে এসে পৌঁছেছেন। ওঁর কাছে খোঁজ নিলাম, জনতা দলের সঙ্গে আসন বোঝাবুঝির কী অবস্থা, উনি জানালেন ৫০: ৫০-এর বদলে জনতা দল ৫৫: ৪৫ শর্তে ফ্রন্টকে রাজি হতে বলেছেন, অর্থাৎ ওদের পঞ্চান্ন ভাগ, ফ্রন্টের পয়তাল্লিশ। ফ্রন্টের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ৫২: ৪৮; ওদের বাহান্ন, ফ্রন্টের আটচল্লিশ। ইএমএস-এর বদ্ধমূল ধারণা এই অত্যন্ত উদার প্রস্তাবে জনতা দল রাজি না-হয়েই পারে না, বিশেষ করে যেহেতু প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে মুখ্যমন্ত্রী হিশেবে মেনে নেওয়া হয়েছে।
এপ্রিলের কোন তারিখ ঠিক মনে পড়ে না, পরের দিন তিরুবন্তপুরম্ থেকে রওনা হয়ে একট বেশি রাত্রিতে কলকাতা, বাড়ির থেকে কেউ নিতে আসেনি, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বাসে চেপে লোয়ার সার্কুলার রোডের এক হোটেলে, সেখানে ট্যাক্সি মেলে না, অনেক কাণ্ডকারখানা করে মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হলে আলিপুরের ফ্ল্যাটে প্রত্যাবর্তন। সঙ্গে-সঙ্গে স্ত্রীর কাছ থেকে খবর পেলাম, স্নেহাংশুবাবু টেলিফোনে রঙ্গ করে জানিয়েছেন ‘আপনাদের সর্বনাশের ব্যবস্থা করা হচ্ছে’; জ্যোতিবাবুও নাকি ফোন করেছিলেন, তিনি চাপা মানুষ, কিছু বলেননি, শুধু অনুরোধ জানিয়েছেন ফিরেই যেন ওঁর সঙ্গে একবার দেখা করি, দরকারি কথা আছে। পরদিন জ্যোতিবাবুর সঙ্গে ওঁর হিন্দুস্তান পার্কের বাড়িতে দেখা করতে গেলাম। বললেন, জনতা দল বাহান্ন: আটচল্লিশ শর্তেও রাজি হচ্ছে না, সেদিন আর এক দফা বৈঠক হবে, ওঁর ভারি আশ্চর্য লাগছে সামান্য একটা জেদের জন্য ওরা নির্বাচনী আঁতাত ভেঙে দিতে চায়। হয়তো লোকসভা নির্বাচনে এত ভালো ফল হয়েছে বলে জনতা দলের কর্তাদের মাথা ঘুরে গেছে, বামপন্থী দলগুলিকে আদৌ তার আমল দিতে চায় না; একের পিঠে শূন্য থাকলেই দশ, এক না থাকলে শূন্য যে শূন্য, ওরা বুঝতে পারছে না। জ্যোতিবাবুর তখনও আশা, শেষ পর্যন্ত একটা ফয়সালা হবে, বাহান্ন-আটচল্লিশেই মতৈক্য। তবে জনতা দল যে-সিদ্ধান্তই গ্রহণ করুক, পার্টির ইচ্ছা আমি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বিধানসভায় যাই, গিয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করি। আমার জন্য জ্যোতিবাবুরা আপাতত দুটো আসন কলকাতায় বেছে রেখেছেন, রাসবিহারী ও আলিপুর। জ্যোতিবাবুর বিবেচনায় দুটোই যথেষ্ট ভালো আসন, জিততে কোনওরকম অসুবিধা হবে না, তবে আমার যদি পছন্দ মফস্বল বা গ্রামাঞ্চল থেকে দাঁড়ানোর, তা হলে সেই ব্যবস্থাও করা সম্ভব। ওঁর অনুরোধ কী হতে পারে সে সম্পর্কে আগেই আঁচ ছিল। প্রাথমিক সম্মতি জানিয়ে স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে কর্তব্য পালন করতে গেলাম। ওখানে অনেক দিন থেকে অধ্যাপক, আমার রাজনৈতিক বন্ধু নির্মলকান্তি চট্টোপাধ্যায়কে জ্যোতিবাবুর বার্তার বিষয়ে বললাম, উনি মুচকি হেসে মন্তব্য করলেন, ‘ঘুঘু দেখেছেন, ফাঁদ তো দেখেননি। প্রার্থী হয়ে এই ভরা গ্রীষ্মে এক মাস প্রচারান্তে আপনার শরীর আদ্ধেক হয়ে যাবে’। মাত্র একটা-দুটো দিনের অপেক্ষা, জনতা দলের সঙ্গে আলোচনা ভেস্তে গেল, বামফ্রন্টের একাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার সিদ্ধান্ত। আমার জন্য রাসবিহারী কেন্দ্রই স্থির হলো, এক সন্ধ্যায় শচীন সেন-অশোক বসু এসে প্রার্থী হবার জন্য যে-প্রাথমিক সই-টই করার ব্যাপার থাকে, বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। পরদিন থেকে পার্টির স্থানীয় নেতারা জড়ো হতে থাকলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে বৈঠকের, পথসভার, মিছিলের, পোস্টার সাঁটার, দেওয়াল লিখনের আয়োজন।
নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি, কথাটা জানাজানি হবার পর ঘোর-লাগা অবস্থা, শুধু আমার নয়, পরিচিত-প্রিয়জনদেরও। দেবুদার দুই ছেলে, খোকন-ছোট্টু, তাদের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবসা, নিজেদের দোকান থেকে উজাড় করে বৈদ্যুতিক চোঙা, মাইক্রোফোন ইত্যাদি এনে হাজির করলো। কয়েকজন ব্যক্তিগত বন্ধু, যেমন শান্তি চৌধুরী, ভীষণ উৎসাহিত, তাঁরা জানালেন আলাদা করে পোস্টার ইত্যাদি ছাপবেন। যেহেতু কয়েক বছর ধরে নকশালপন্থী বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে লিখেছি, বলেছি, মিছিলে হেঁটেছি, একদল নকশালবাদী তরুণও এসে বললেন, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁদের তাত্ত্বিক ব্যবধান আছে, তাঁরা আমার জন্য আলাদা হয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক। কাউকেই নিরাশ করবার ইচ্ছা ছিল না আমার, নিরাশ হলেনও না কেউ। সমাজের সবচেয়ে ভীতিপ্রদ জন্তু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, তাঁরাও এসে জড়ো হলেন। আমার সমর্থনে অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, ভূতত্ত্ববিজ্ঞানী, দর্শনের-সাহিত্যের অধ্যাপক, সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার, এঁদের সবাইকে দিয়ে সই করানোর জন্য নিজেদের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে অনেক বুদ্ধিজীবী কলকাতাময় ঘুরে বেড়ালেন। একজন-দু’জন বুদ্ধিমান ব্যক্তি অবশ্য স্বাক্ষর দিতে রাজি হলেন না, তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার ভাব বেড়ে গেল। কঠিনতম পরীক্ষা ছিল, যখন বুদ্ধিজীবীরা কোনও শৌখিন বাড়িতে সমবেত হয়ে আমাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতেন ঘণ্টা দুয়েক ধরে, আমার জ্ঞানের পরিধি তাঁদের জ্ঞানের সীমা, পরিসীমাকে ছুঁতেও পারতো না।
আগুনের কী গুণ আছে কে জানে: খর গ্রীষ্ম, তার মধ্যে, উদ্ভ্রান্ত, নিজেকে সরেস প্রমাণ করানোর উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানো। তবে অসাধারণ অভিজ্ঞতা পাড়ায়-পাড়ায়, বস্তিতে-বস্তিতে পরিক্রমা। অতি সাধারণ মানুষ, জ্ঞান বা বুদ্ধির ভারে তাঁরা প্রপীড়িত নন, তাঁরাও জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, স্পষ্ট উপলব্ধি করেছেন স্বৈরাচার ও স্বাধীনতাহীনতার কী বিষময় পরিণাম, উপলব্ধি করেছেন গত দু’ বছরের, দু’ বছরের কেন, গত বেশ কয়েক বছরের জানা-শেখার প্রেক্ষিতে। মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা, বস্তি উন্নতির সমস্যা, পানীয় জলের সমস্যা, বর্ষায় জলনিকাশের সমস্যা, পরিবহনের সমস্যা, কাজ-কারবারের সমস্যা, সন্তানদের শিক্ষাসমস্যা, সব কিছু নিয়েই তাঁদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি আছে, তাঁরা এসব বিষয়ে নির্বাচনি প্রার্থী ও তাঁর দলের মতামত ও পরিকল্পনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে চান। সদ্য-ফোটা ভোরে শুরু করে ঘোর দুপুর পর্যন্ত ছোটো-ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে বাড়িতে-বাড়িতে ঘোরা, বস্তিতে গিয়ে সেখানকার আকীর্ণ নানা সমস্যা নিয়ে আলাপ, কোনওক্রমে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে নির্বাচনী দপ্তরে গিয়ে প্রচার কোথায় এগোলো, কতটা এগোললা, কোথায় আদৌ এগোয়নি, সে সব নিয়ে কমরেডদের সঙ্গে আলোচনা, কখনও পার্টির জেলা দফতরে যাওয়া, কখনও বা রাজ্য দফতরে। বিকেল এবং সন্ধ্যা বরাদ্দ সভা ও শোভাযাত্রার জন্য। কোনও ওয়ার্ডের কোনও পাড়া বাদ দেওয়া চলবে না, সভার ব্যবস্থা করতে হবে, গান বা পথনাটিকার জন্য স্কোয়াডের ব্যবস্থা, বক্তাদের তালিকা স্থির করতে হবে। অঞ্চলের বক্তা দিয়ে চলবে না, প্রার্থী নতুন, তাঁর পরিচয়ও তেমন ব্যাপক নয়, সুতরাং সভাদিতে দলের নেতৃবৃন্দকে চাই, কখনও ফ্রন্টের অন্য শরিকদের নেতাদের। অবশ্য প্রার্থীকেও মাঝে-মাঝে অন্য পাড়ায় গিয়ে বক্তৃতা করতে হয়, অন্যান্য কেন্দ্রেও তাঁর সম্বন্ধে ঈষৎ কৌতূহল, প্রার্থী নতুন বলেই।
ওই চার-পাঁচ সপ্তাহ খাটতে হয়েছিল প্রচুর, তা ছাড়া একেবারে গোড়ার দিকেই, একটু আগে বৃষ্টি-ঝড় হয়ে গেছে, ডোভার লেনে শচীন সেনের বাড়ির সিঁড়িতে এক সন্ধ্যায় পা পিছলে পড়ি, সারারাত ব্যথায় অসহ্য কাতর হয়ে সকালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া, তিনি এক্স-রে করে দেখলেন গোড়ালির কাছে হাড় ভেঙেছে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে এমনভাবে প্লাস্টার বেঁধে দিলেন যাতে হাতে লাঠি নিয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে অন্তত অলিগলিতে হাঁটতে পারি। বিরোধী কংগ্রেসী প্রার্থী পুরো ব্যাপারটা বুজরুকি বলে মনে করেছিলেন, বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বলেছিলেন, ‘লোকটা যে কত অসাধু, এ থেকেই তো বুঝতে পারছেন; ওঁর কিচ্ছু হয়নি, আপনাদের সহানুভূতি আদায়ের জন্য ব্যান্ডেজ বেঁধে হাতে লাঠি নিয়ে খোঁড়াচ্ছেন’।
নির্বাচনের মরশুমে সত্যিই বিচিত্র নানা ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। একদিন ভর দুপুরে কালীঘাট পাড়ায় গেছি, ওখান থেকে মিছিল বেরোবার কথা, পৌঁছে দেখি আমার তরফেরই এক স্বেচ্ছাসেবক টুলের উপর উঠে দাঁড়িয়ে তেজস্বী বক্তৃতায় রত: ‘কমরেডস, বন্ধুগণ, প্রতিপক্ষ বলে বেড়াচ্ছে আমাদের প্রার্থী নাকি মার্কিন গুপ্তচর। আমি পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে বলছি, তিনি মার্কিন গুপ্তচর নন’। বাংলা ভাষায় যাকে বলে আত্মঘাতী গোল, তাই আর কী। আরও এক কাহিনী আমার স্মৃতিতে মজুত। জনৈক প্রার্থী, তাঁর দলের বামপন্থী বলে বাজারে রটনা, তাঁর পক্ষ থেকে ছাপিয়ে কেচ্ছা বিলি করা হলো: আমার স্ত্রী বর্তমান থাকতে আমি নাকি এক জর্মান উপপত্নী গ্রহণ করেছি, পুরীর বি এন আর হোটেলে তাকে নিয়ে রগড় করতে দেখা গেছে আমাকে। কাহিনীটির উদোর-পিণ্ডি-বুধোর-ঘাড়ে গোছের মিশ্রিত-বিকৃত একটি ভিত্তি ছিল, তবে, পরম পরিতাপের কথা, আমার স্ত্রী পর্যন্ত গল্পটি বিশ্বাস করলেন না।
আমার হয়ে বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে গেলেন ই এম এস নাম্বুদিরিপদ-প্রমোদ দাশগুপ্ত-জ্যোতি বসু সবাই, অন্যান্য অনেকে তো ছিলেনই! মস্ত লাভ হলো, নির্বাচনের মাসে উদয়াস্ত নির্বাচনী কেন্দ্রে এবং কেন্দ্রের বাইরে বক্তৃতা দেওয়া ও অন্য উপলক্ষ্যে ঘুরে বেড়ানোর ফলে রাজনৈতিক অনেক ব্যক্তিত্ব, যাঁদের সঙ্গে ইতিপূর্বে সামান্য আলাপ ছিল, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় গাঢ়তর হলো, যাঁরা অপরিচিত ছিলেন তাঁদের নৈকট্যে এলাম। সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি, অতি সাধারণ মানুষ, যাঁদের আমরা গম্ভীর উচ্চারণে বলি জনগণ বা জনসাধারণ, তাঁদের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ কী করে সম্ভব, সে ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন। এমন একজনের কথা অন্যত্র লিখেছি, মন্টু ভঞ্জ, প্রতাপাদিত্য রোড এলাকায় টাইপিং শেখাবার একটি স্কুল চালাতেন, দলের সব সময়ের কর্মী নন, কারণ সাংসারিক দায়িত্ব আছে, অথচ অতীতে বিভিন্ন আন্দোলনে জেল খেটে এসেছেন, পার্টির প্রতি তদ্গতপ্রাণ; তার চেয়েও যা বড়ো কথা, নিখাদ ভালো মানুষ, এমন আদর্শবান ভালো মানুষ পশ্চিম বাংলার শহরে-গ্রামে-গঞ্জে হাজারে-হাজারে ছড়িয়ে আছেন। এঁরাই আসলে পার্টির মেরুদণ্ড। এঁদের বাদ দিয়ে আন্দোলন হয় না, নির্বাচনে সফলতাও আসে না। এঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় কোনওদিন লেখা হবে না, তা হলেও এঁরাই কিন্তু ইতিহাস রচনা করেন। পার্টির সাফল্যে এঁরা উদ্বেল হয়ে ওঠেন, অথচ কমরেডদের সঙ্গে ভাগ করে সামান্য মিষ্টান্ন ভোগের বাইরে এঁদের অন্য কোনও আকাঙক্ষা বা দাবি নেই, থাকে না। পার্টি কোনও কারণে কোথাও ধাক্কা খেলে নেতাদের চেয়েও অনেক বেশি-বেশি মুষড়ে পড়েন এঁরা। নেতারা বিবিধ উচ্চাবচতার মধ্য দিয়ে গেছেন, দার্শনিকতা তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই সুদৃঢ় বর্ম, বহু ঘা খেয়ে-খেয়ে তাঁদের সত্তার কিয়দংশ জুড়ে এক ধরনের অখণ্ড নাস্তিকতা। সাধারণ স্তরের কর্মীদের মানসিকতা নেতাদের দর্শনচিন্তার যোজন-যোজন দূরে; দলের বড়ো বিপদ সমাগত হলে সাধারণ কর্মীদের হৃদয়ই সর্বাগ্রে আপন্ন হয়। এই মানুষগুলি প্রণম্য।
অন্য যাঁদের কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে বলতে হয়, তাঁরা শহরে-গ্রামে ছিটিয়ে থাকা মাঝারি পর্যায়ের নেতা-নেত্রীবৃন্দ: অতীতে, স্বাধীনতার আগে ও পরে, তাঁরা বছরের পর বছর বিনা বিচারে কারাকক্ষে কাটিয়েছে, জেলে থাকা-কালে মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়েছেন, বিগত কয়েক দশক বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন বহু বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গেছে, কিন্তু তাঁরা বিশ্বাসে অটল থেকেছেন। অনেকেরই নিজেদের পরিবারের সঙ্গে সংযোগ বহু বছর আগে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, অনেকেই সংসার করেননি, রাজ্য কমিটি, জেলা কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি বা স্থানীয় কমিটির দপ্তরই তাঁদের পাকা ঠিকানা। রাত্রিবেলা একটি খাটিয়া পেতে ঘুমোন, সকালে কোথাও তা উঠিয়ে রাখা হয়, পার্টি দফতরে হাজার মানুষের জটলা, পার্টির কমিউনে তাঁদের স্নান-খাওয়া-বিশ্রাম, দল থেকে তাঁদের হয়তো কোনও বিশেষ শাখায় কাজের ভার দেওয়া হয়েছে, কৃষক সংগঠনের ক্ষেত্রে অথবা ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে, কিংবা শিক্ষক, ছাত্র বা কোনও কর্মচারী সংগঠনের দায়িত্বে। বহু বছর পর্যন্ত তাঁরা অতি সামান্য মাসোহারা পেতেন পার্টির কাছ থেকে, প্রতিটি পয়সা অতএব হিশেব করে ব্যয় করতে হতো, জামাকাপড় নিজেরা কাচতেন, যাঁদের কমিউনে থাকার সুবিধা ছিল না তাঁরা নিজেদের জন্য রান্না পর্যন্ত করতেন। অতি সম্প্রতি এসব নেতা-কর্মীদের মাসোহারার হার কিছুটা বেড়েছে, তবে বাজারে যে-সমস্ত কল্পকাহিনী এই প্রসঙ্গে প্রচারিত, তার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে আত্যন্তিক অভাবের মধ্যেই কমিউনিস্ট পার্টি বড়ো হয়ে উঠেছিল বলেই হয়তো, কমরেডদের মধ্যে একটি মিলিত সংসারের পরিবেশ। সবাই এক সঙ্গে কাজ করছেন, খাচ্ছেন, ঘুমোচ্ছন, গল্প করছেন, পার্টির কর্মসূচি নিয়ে চিন্তা করছেন, পরস্পরের নানা নিরন্তর সমস্যা নিয়ে ভাবিত হচ্ছেন, সমস্যা নিরসনের জন্য পরস্পরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, এমন নিষ্পাপ কলুষহীনতার মধ্যে তাঁদের দিনযাপন ঘটেছে বলেই সদাচার ও কপটতার মধ্যে, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সীমাভেদ নির্ণয় তাঁদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ। ছেলেবেলা থেকে কমিউনিস্ট দফতরের যে-ছবি আমার মনে আঁকা আছে, সেই চিত্ররূপ এই এতগুলি বছর অতিক্রান্ত হলেও বিশেষ পাল্টায়নি: কোনও প্রায় ভেঙে-পড়া বাড়ির একতলা বা দোতলার জরাজীর্ণ ঘর, দেওয়াল থেকে ঝুল নেমেছে, নিচু তক্তপোশের উপর ময়লা চাদর বিছনো, হয়তো একটা-দুটো হাতলহীন দ-আকারের কাঠের চেয়ার, একটি কিশোর এসে মাঝে-মাঝে কেতলি থেকে ঢেলে খুরি করে চা দিয়ে যাচ্ছে, বিকেলে সবাইয়ের গোল হয়ে বসে বাদাম-বা আলু-মিশ্রিত চিঁড়ে বা মুড়ি ভাজা চিবনা, পূর্ববঙ্গীয় পটভূমি থাকলে সঙ্গে কাঁচালঙ্কা। গত দুই দশকে পার্টির এই নিসর্গ বর্ণনা সামান্য বদলেছে, তবে, ফের বলি, বাজারে যে-ইতিবৃত্ত প্রচারিত তা একেবারেই বাস্তবতাহীন।
এমন কিছু-কিছু নেতা-কর্মী হয়তো নির্বাচনে জিতেছেন, দল থেকে সরকার গঠন করা হয়েছে, তাঁদের মন্ত্রী বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা অথৈ জলে পড়েছেন। অনেককে জানি, যাঁরা মন্ত্রী হওয়ার পরেও, বেশ কয়েক সপ্তাহ বা মাস, দলের কমিউনেই বসবাস চালিয়ে গেছেন, রাত্রিবেলা খাটিয়ার আশ্রয়। এক দিক থেকে দেখলে এটা বোধহয় বাংলার বিশেষ ঐতিহ্য, কংগ্রেস আমলে নানা ধরনের অনাচারের খবর বাজারে ছড়াতো, সে-সব বৃত্তান্তের ষোলো আনাই মিথ্যে ছিল না। তবে একজন-দু’জনের কথা বাদ দিলে, এমনকি কংগ্রেসি মন্ত্রীরাও তেমন-কিছু আঁকজমকের মধ্যে থাকতেন না, কেউ-কেউ খুব বেশি হলে রাজভবন-সংলগ্ন মাঝারি বা ছোটো ফ্ল্যাটে উঠে আসতেন, নয়তো শহরে কোনও ভাড়া-করা ফ্ল্যাটে। কেরল-ত্রিপুরা বাদ দিয়ে অন্য যে কোনও রাজ্যে গিয়ে দেখুন, পুরো মন্ত্রী নন, বড়ো জোর উপ-অথবা অর্ধ-মন্ত্রী, তাঁদের জন্যও সরকার থেকে বিরাট-বিরাট প্রাসাদের ব্যবস্থা। আশির দশকের গোড়ায় একবার ঢিঢিক্কার পড়ে গেল, পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ আতিথেয়তা ভাতা তিন হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে বছরে ছয় হাজার করা হয়েছে, কী লজ্জা, কী লজ্জা, জ্যোতি বসুর লজ্জাহীনতায় খবরের কাগজগুলির বিস্ময়ে বাক্রোধ হয়ে এলো। অন্যান্য রাজ্যে কী অবস্থা আমি একটু খোঁজ নিতে শুরু করলাম, জেনে চমৎকৃত হতে হলো, মহারাষ্ট্রে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ আতিথেয়তা ভাতা বছরে ছয় লক্ষ টাকা, অন্যান্য মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে চার লক্ষ।