ঊনতিরিশ
বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে দু’টি ঘটনা, সংবাদপত্রাদির প্রবল উৎসাহে, আমার কুখ্যাতি ছড়াতে পর্যাপ্ত সাহায্য করেছিল। প্রথমটি কিছু ভুয়ো সঞ্চয়সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে। ইত্যাকার সংস্থা অবিশ্বাস্য বেশি সুদের লোভ দেখিয়ে অনেক পরিবারের সর্বনাশ করতে উদ্যোগী হয়েছিল। তাদের প্রচার, প্রতি মাসে এমন কি শতকরা ছত্রিশ ভাগ হারেও তারা সুদ দেবে মূলধনের উপর; গোড়ার দিকে এমনধারা সুদ দিয়েও থাকতো। কিন্তু গোটা দেশে, গোটা পৃথিবীতে এমন কোনও শিল্পবাণিজ্যের কথাই ভাবা যায় না যেখানে এমন পরিমাণ লাভ হতে পারে, এবং যে লাভ থেকে ওই উঁচু হারে সুদ দেওয়া সম্ভব। পুরো জিনিশটাই বুজরুকি: খ-র গচ্ছিত টাকা খরচ করে ক-কে সুদ পৌঁছনো, গ-র রাখা টাকা থেকে খ-কে সুদ পৌঁছনো, ঘ-র গচ্ছিত টাকা থেকে গ-কে সুদ বুঝিয়ে দেওয়া। এই ক্রমানুক্রমিক ব্যবস্থা একটা পর্যায়ে ভেঙে পড়তে বাধ্য, তখন হাজার-হাজার আমানতকারীর সর্বনাশ ঠেকানো আর সম্ভব হবে না: দুর্নীতিমূলক ব্যবসাটি যদি অবিলম্বে বন্ধ না করা যায়, হয়তো লক্ষ-লক্ষ পরিবার সর্বস্বান্ত হবে। কাগজে বেশ কয়েকদিন বিজ্ঞাপন দিয়ে জনসাধারণকে এই সর্বনেশে লোভের খপ্পরে না পড়বার জন্য সকাতর আবেদন জানানো হলো: দোহাই, জেনে-শুনে বিষ পান করবেন না। কা কস্য পরিবেদনা, বাঙালি মধ্যবিত্ত চটজল্দি উপার্জনের নেশায় মাতোয়ারা। মন ঠিক করে ফেললাম, ভীমরুলের বাসা ভাঙতে হবে। অর্থসচিব কুট্টি এবং আমার সিদ্ধান্ত, বাইরের কাউকেই জানানো হলো না। বিক্রয় বা প্রমোদ করের চুরিধাড়ি ধরবার জন্য অর্থ দফতরের আওতায় যে-পুলিশবাহিনী ছিল, শুধু তার প্রধানকে ডেকে একেবারে শেষ মুহূর্তে বুঝিয়ে বলা হলো। হেয়ার স্ট্রিট থানায় অসৎবৃত্তির মামলা রুজু করে একটি তথাকথিত সঞ্চয় প্রতিষ্ঠানের একাধিক দফতরে হানা দেওয়ার অভিযান অতি প্রত্যূষে। চারদিকে হই হই রই রই। যাঁরা টাকা জমা রেখেছিলেন সরল মনে, তাঁরা ঘাবড়ে গিয়ে মূলধন ফেরত পাওয়ার আশায় প্রতিষ্ঠানের শাখা দফতরগুলির বাইরে ভিড় জমালেন, তাঁদের দাবি মেটানোর মতো সামর্থ্য প্রতিষ্ঠানের ছিল না, থাকা সম্ভব ছিল না। প্রতিষ্ঠানের সংগঠকরা অচিরে পলাতক। বেশ কয়েক হাজার পরিবার তাঁদের সঞ্চিত মূলধন খোয়ালেন। অশোক মিত্রের নামে ঢিঢিক্কার পড়ে গেল। শুনলাম আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক বলেছেন: ‘সুদের ওই টাকা দিয়ে চিংড়ি মাছ খেতাম, অশোক মিত্র আমার চিংড়ি মাছ খাওয়া বন্ধ করে দিল’। পরে জেনে চমকিত হলাম, আমার এক ঘোর বিপ্লবী সুহৃদ, কথায়-কথায় বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিক্রিয়াশীলতাকে গাল পাড়তেন, তিনিও ওই প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রেখেছিলেন, এভাবে টাকা খোয়া যাওয়ায় তিনি বিপ্লবী থেকে বিপ্লবীতর হয়ে গেলেন। আমার সম্পর্কে এক ভাইঝি, সে নাকি সমস্ত গয়নাগাঁটি বেচে, ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদী আমানত তুলে এই প্রতিষ্ঠানে ফাটকা খাটিয়েছিল; রবীন্দ্রনাথের কবিতার সাগর-জলে-সিনান-করা কন্যার মতো, সে এখন থেকে নিরাভরণ! বেশি ঠকেছিলেন শেষের দিকে যাঁরা টাকা জমা রেখেছিলেন, তাঁরা; প্রথম দিকে যাঁরা রেখেছিলেন, তাঁরা গচ্ছিত টাকার সমপরিমাণ সুদের কিস্তি মারফত আগেই পুরো ফেরত পেয়ে গিয়েছিলেন।
প্রধান মালিক ফেরার, তার সাঙ্গোপাঙ্গরাও। বাজারে আমার কুৎসা ছড়িয়ে পড়লো: টেলিফোনে গালাগাল, শাসানো চিঠি, লাশ সাত টুকরো করে ফেলে দেওয়া হবে ইত্যাদি। তবে যে যাই বলুক, পার্টির ভিতর থেকে প্রচুর অভিনন্দন কুড়োলাম, অনেকেই বললেন জনগণের স্বার্থে বামফ্রন্ট কাজের মতো কাজ করেছে। গুজব কানে এলো, প্রতিষ্ঠানের সেই ফেরার মালিকের পক্ষ থেকে কাকে নাকি খবর পাঠানো হয়েছে, সে যদি আমার সঙ্গে একবার সেই জোচ্চোরটির দেখা করিয়ে দিতে পারে, তা হলে তাকে এক কোটি টাকা দেওয়া হবে, আর আমাকে একশো কোটি। নিজেদের মধ্যে প্রচুর হাসাহাসি। একমাত্র বিপদ যা দেখা দিল, প্রমোদবাবুর নির্দেশ, আপাতত কয়েক মাস দেহরক্ষী নিতে হবে।
ফেরার সংগঠককে কিছুতেই ধরা যাচ্ছিল না, পুলিশ কর্তাদের ডেকে প্রচুর উপরোধ করছি, বকাঝকা করছি, কোনও লাভ হয়নি। এক ঝানু আই এ এস অফিসার আমার কাছে একান্তে হাঁড়ি ভাঙলেন, ‘স্যার, যতদিন পুলিশের লোকেরা ঐ প্রতিষ্ঠানে তাদের গচ্ছিত টাকা পুরো ফেরত না পাচ্ছে, ততদিন ওই মালিক ধরা পড়বে না।’ বছর খানেক বাদে তিনি একদিন এসে জানালেন, ‘স্যার, এবার বোধহয় লোকটা ধরা পড়বে। আমার কাছে খবর, পুলিশের কেষ্টবিষ্টুরা এতদিনে তাদের সমস্ত টাকা ফেরত পেয়ে গেছে।’ হলোও তাই, সপ্তাহখানেক বাদে পুলিশের এক বড়োকর্তা সুসংবাদ দিলেন, লোকটা ধরা পড়েছে, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো আমার, এবার দক্ষভাবে মামলা চালিয়ে ওকে যথোপযুক্ত সাজা দিতে হবে। পুলিশের বড় কর্তাটিকে বারবার করে বললাম, ‘এই ব্যক্তিকে কড়া পাহারায় রাখবেন, একে জেরা করে অনেক মূল্যবান খবর বের করা সম্ভব হবে’। বৃথাই আমার সতর্কবাণী উচ্চারণ। দিন দশেক না কাটতেই সেই পুলিশ কর্তাই কাঁচুমাচু মুখ করে টাটকা খবর জানালেন, লুকনো টাকা উদ্ধারের আশায় পুলিশের লোকে প্রবঞ্চকটিকে বারো না চোদ্দো তলা বাড়ির সর্বোচ্চ তলায় নিয়ে গিয়েছিল, কী করে ঘরে ঢুকে যেন লোকটা পুলিশকে এড়িয়ে সেই বারো না চোদ্দো তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। এই রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য প্রচণ্ড তাগিদ বোধ করেছিলাম, সন্দেহ না হয়েই পারছিল না নিজেদের কুকীর্তি ঢাকবার জন্য সম্ভবত কিছু পুলিশ কর্মচারী লোকটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল, সর্ষের মধ্যেই ভুত। আমাকে বোঝানো হলো, কোনও লাভ হবে না, কিছু জল ঘোলা করা ছাড়া। গভীর অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ সত্ত্বেও ইচ্ছাকে সংবরণ করতে হলো।
অন্য অভিজ্ঞতা আমলাঘটিত। মুখ্যমন্ত্রী বিদেশে, সাময়িকভাবে আমি বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বে, পরিশ্রম করছি, প্রায়ই এটা-ওটা বিদ্যুৎ কারখানা যান্ত্রিক বা অন্য কোনও কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, গ্রীষ্মের শুরু, মানুষের দুর্দশার সীমা নেই। যেখানেই কোনও বিদ্যুৎ কারখানায় গোলমাল দেখা দেয়, রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের সভাপতির সঙ্গে কথা বলে সুজিত পোদ্দারকে সেখানে পাঠিয়ে দিই, তার উপর কড়া নির্দেশ, যতক্ষণ পর্যন্ত কারখানা চালু না হচ্ছে, বিদ্যুৎপ্রবাহ ফের সঞ্চারিত না হচ্ছে, সে ফিরতে পারবে না। সুজিত অহরহ ব্যান্ডেল যাচ্ছে, সাঁওতালডিহি যাচ্ছে, প্রযুক্তিবিদ্দের সঙ্গে কথা বলছে, শ্রমিক-প্রতিনিধিদের সঙ্গেও। বারো-চোদ্দো ঘণ্টা পর কারখানা চালু হলে আমাকে টেলিফোন করে কলকাতায় ফেরার অনুমতি চাইছে।
জ্যোতিবাবু বাইরে যাওয়ার আগে জরুরি কী-কী ব্যাপারে আমাকে দৃষ্টি দিতে হবে, তা বিশদ করে বুঝিয়ে গিয়েছিলেন। সরকারে ঢুকেই আমরা বিগত বছরগুলির স্থলন-পতন শোধরাবার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য প্রচুর টাকা বরাদ্দ করেছি, তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, টাকা বরাদ্দ করলেও নতুন কারখানা তৈরি হতে চার-পাঁচ বছর লাগে। প্রতিদিন প্রতিরাত্রি বিদ্যুতের অনটন, উৎপাদিত বিদ্যুতের একটি বড়ো অংশ বামফ্রন্ট সরকার শিল্পক্ষেত্রে বরাদ্দ করেছে বলে কলকাতার মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের মনে জমে-থাকা ক্ষোভ, অনেকে ধরেই নিচ্ছেন সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঢের ক্রটি, বেসরকারি পরিচালনায় অবস্থার উল্লেখযোগ্য হেরফের ঘটবে।
নানা মহলে বেসরকারি মালিকদের প্রতিভা ও কর্মদক্ষতা সম্বন্ধে প্রচুর প্রশংসাবাণী তখন উচ্চারিত হচ্ছিল, বেসরকারি পরামর্শ নিলেই যেন বিদ্যুৎ ঘাটতির অবসান ঘটবে। রাজ্যের প্রধান সংবাদপত্রগুলির গলা সবচেয়ে চড়া। সেই সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের নিন্দাচর্চায়ও তারা সদামুখর: রাজ্য সরকার অপদার্থ, কুচক্রী, অসাধু, এই সরকারের মন্ত্রীরা অকর্মণ্য, প্রতিদিন খবর কাগজ জুড়ে এই গোছের সংকীর্তন। সম্ভবত কাগজের মালিকেরা মনে-মনে আশা পোষণ করছিলেন, নিন্দা-মন্দ করে বামফ্রন্ট সরকারকে সরিয়ে দেওয়া যাবে, হয়তো রাজ্য প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করতে কেন্দ্রকে রাজি করানো যাবে, সুতরাং কুৎসা চালিয়ে যাওয়া যাক, বেসরকারি প্রতিভার নিরন্তর গুণকীর্তন করা যাক। বিদেশী ও বেসরকারি মালিক কিংবা পরিচালকদের প্রতিভা ও দক্ষতা সম্পর্কে আমার কিন্তু সেরকম শ্রদ্ধার ভাব কোনও কালেই ছিল না। ইন্ডিয়ান ইনিস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে ও ভারত সরকারে কর্মরত থাকাকালীন ওঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার দেখাসাক্ষাৎ-আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। সমাজের যে-স্তর থেকে এঁদের উদ্ভব, সেখান থেকেই সরকারের সঙ্গে যুক্ত রাজপুরুষ ও প্রযুক্তিবিদদেরও: মেধা এবং পারদর্শিতায় তাঁদের মধ্যে কোনও তফাত কোনওদিন ধরতে পারিনি। রঙ্গ করে আগে যা বলেছি, বেসরকারি শিল্পের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা অবশ্য মদ্যপানের কৃতিত্বে একটু এগিয়ে।
বিভিন্ন বিদ্যুৎ কারখানা সাময়িক বিকল হচ্ছে, আমি আর সুজিত বিব্রত অবস্থায় আছি, এমন সময় একদিন সকালে চা পানের মুহূর্তে কাগজে পড়লাম, বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞদের একটি বেসরকারি প্রতিনিধি দল কলকাতায় জড়ো হয়েছেন, রাজ্য বিদ্যুৎ বোর্ডের সাঁওতালডিহি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন অহরহ ব্যাহত হচ্ছে, তাঁরা নাকি গিয়ে সব ঠিকঠাক করে দেবেন, ইতিমধ্যেই তাঁরা সাঁওতালডিহির পথে রওনা হয়ে গেছেন। খবরটি পড়ে আমি হতভম্ব: আমি আপাতত বিদ্যুৎমন্ত্রী, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হলো, কারাই বা নিলেন, আমার সম্পূর্ণ অজান্তে, রাজ্য বিদ্যুৎ বোর্ডের সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনিও ঘুণাক্ষরে কিছু জানেন না। বিদ্যুৎ সচিবকে ডেকে পাঠালাম। তাঁর কাছে জানতে চাইলে ঈষৎ তাচ্ছিল্য-ভরা জবাব পেলাম: এসব ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলোচনা করা তাঁর প্রয়োজন মনে হয়নি, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আগেই আলোচনা হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই এই বেসরকারি দলকে পাঠানো হচ্ছে। আমি তাঁকে বললাম, মুখ্যমন্ত্রী এই সম্পর্কে আদৌ আমাকে কিছু জানিয়ে যাননি, এই অবস্থায় অতএব আমার সঙ্গে আলোচনা না-করে কোনও সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তথাচ বিদ্যুৎ সচিব এঁড়ে তর্ক করার চেষ্টা করলে আমি একটু কড়া করে বললাম, ‘বেশি কথা বলে লাভ নেই, আমার দায়িত্ব আমি জানি, তা ছাড়া দয়া করে মনে রাখবেন আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট; অনুগ্রহ করে অবিলম্বে এই বেসরকারি প্রতিনিধিদলকে সাঁওতালডিহি থেকে ফিরিয়ে আনুন। রাগে গজগজ করতে-করতে বিদ্যুৎ সচিব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু নির্দেশ না-মেনে তাঁর উপায় ছিল না। তিনি বেরিয়ে গিয়ে খবরের কাগজের মানুষদের—ও বেসরকারি শিল্পমহলকে— ঘটনাটি সালংকারে জানিয়ে দিলেন, অন্তত তাই আমার অনুমান।’ পশ্চিম বাংলায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্রে আমার শ্রাদ্ধ করা হলো, শিল্পমহলও সমান উত্তেজিত: বেসরকারি বিশেষজ্ঞরা গিয়ে বিদ্যুৎ কারখানার যন্ত্রপাতি সব ঠিক করে দিয়ে আসতেন, পশ্চিম বাংলার মানুষ একটু স্বস্তি পেতেন, এই হতচ্ছাড়া মন্ত্রী তা হতে দিলেন না, ধিক তাকে, ধিক ধিক ধিক। প্রমোদবাবুকে গিয়ে সব কথা খুলে বললাম, তিনি মুখ টিপে হাসলেন।
ওই সপ্তাহেই কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের সঙ্গেও একটু ভুল বোঝাবুঝি হলো। যদিও রাজ্য সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড়ো অংশই সরকারি রাজ্য বিদ্যুৎ বোর্ডের অধীনস্থ কারখানাগুলিতে উৎপাদিত হয়, কলকাতা ও হাওড়ার বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি সি. ই. এস. সি-র হাতে, রাজ্য বোর্ডের কাছ থেকে শস্তায় কিনে বেসরকারি সংস্থাটি কলকাতার নাগরিকদের বিদ্যুৎ বেচে প্রচুর লাভ করতেন, এখনও করেন বলে আমার সন্দেহ।
বিদ্যুৎ সচিবের সঙ্গে যেদিন কথা-কাটাকাটি, সম্ভবত তার দিন দশেক আগে লক্ষ্য করলাম সি. ই. এস. সি.-র তরফ থেকে কাগজে-কাগজে একটি অতি আপত্তিজনক বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হচ্ছে। অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, সি. ই. এস. সি. থেকে প্রতি মাসে খুব বেশি টাকার বিল পাঠাননা হচ্ছে, একদিকে বিদ্যুতের জোগান কমছে, অন্যদিকে বিলের পরিমাণ বর্ধমান। তিরিক্ষি মেজাজের এই বিজ্ঞাপনের বক্তব্য, বিল বাড়ছে তার জন্য সি. ই. এস. সি. দায়ী নয়, গ্রাহকরা প্রায়ই ভুল করে আলো-পাখার সংযোগ না নিভিয়ে বাইরে বেড়াতে যান, এতটুকুও দায়িত্বশীল নন তাঁরা, সেজন্যই বিলে বেশি টাকা উঠছে; যদি গ্রাহকরা সাবধানী না হন, নিজেদের শিক্ষিত না করেন, বেরোবার আগে সব সুইচ ভালো মতো দেখে বন্ধ করে না যান, তা হলে সি. ই. এস. সি-র কিছু করবার নেই।
গরমের সময় এমনিতেই লোকের কষ্টের অবধি নেই, তার উপর এমন উদ্ধত বিজ্ঞাপন সি. ই. এস. সি-র পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত তো সাধারণ মানুষের রাগটা সরকারের উপরই পড়বে, সরকারের দয়াতেই তো সংস্থাটি ব্যবসা চালাচ্ছে। সি.ই.এস.সি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে খবর পাঠালাম, ঠান্ডা মাথার মৃদুভাষী অতি সজ্জন ভদ্রলোক। তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, এরকম পরিস্থিতিতে ওই রগচটা বিজ্ঞাপনে হিতে বিপরীত হবে, জনসাধারণের আরও ক্ষিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা, তাই দয়া করে উনি যেন বিজ্ঞাপনটি অবিলম্বে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করেন। তিনি বুঝলেন, বললেন দফতরে ফিরে গিয়েই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। অথচ দিন যায়, গোটা সপ্তাহ যায়, ওই একই বিজ্ঞাপন সমানে বেরোচ্ছে, প্রত্যাহারের লক্ষণ নেই। বিদ্যুৎ সচিবের সঙ্গে খিটিমিটি হলো, মনটা খিঁচড়ে ছিল, পরের দিনই বোধ হয় সি. ই. এস. সি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে ফের ডেকে পাঠালাম। আমার মনে ইতিমধ্যে সন্দেহ ঢুকে গেছে, হয়তো বিদ্যুৎ সচিবের সঙ্গে পরামর্শ করেই আমার অনুরোধ উপেক্ষা করা হচ্ছে। ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে বললাম, তাঁকে কথা জানানো সত্ত্বেও বিজ্ঞাপনটি বেরিয়েই যাচ্ছে, প্রত্যাহারের কোনও লক্ষণ নেই, অতএব আমাকেও এবার একটু কঠোর হতে হচ্ছে; কাগজেই তো তিনি দেখেছেন, খবর বেরিয়েছে, আমি ভদ্রলোক নই, কমিউনিস্ট; তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছি, দফতরে ফিরে গিয়ে অবিলম্বে বিজ্ঞাপনটি বন্ধ করে দেবেন, সেই সঙ্গে আমাকে চিঠি দেবেন এই মর্মে যে, সরকারের অনুমতি ব্যাতিরেকে সি.ই.এস.সি এখন থেকে কোনও বিজ্ঞাপন দেবে না। ম্যানেজিং ডিরেক্টর সবিনিয়ে জানালেন তাঁদের বিজ্ঞাপন বেরোয় একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার মারফৎ। তাঁদের বিজ্ঞাপনটি বন্ধের নির্দেশ ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু নির্দেশটি পালিত হতে দেরি হচ্ছে। যা-ই হোক, তিনি দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী, এবং স্খলনটি যদিও তাঁদের গাফিলতির জন্য নয়, তা হলেও তিনি আমার অনুজ্ঞা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করবেন। তাই-ই হলো। বিজ্ঞাপনটি বন্ধ হলো, সেই সঙ্গে তিনি চিঠি দিলেন, এখন থেকে সরকারের অনুমোদন ছাড়া সি. ই. এস. সি বাজারে কোনও বিজ্ঞাপন ছাড়বে না।
এক দিনের ব্যবধানে দুই ব্যক্তির কাছে একই বাক্য উচ্চারণ সম্ভবত বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো ব্যাপার, তবে আমার চিরদিনই যা ধারণা, তাই-ই আরও বদ্ধমূল হলো, এক ধরনের রাজপুরুষ শক্তের ভক্ত, নরমের যম। ম্যানেজিং ডিরেক্টর মশাইর সঙ্গে পরে আমার সম্পূর্ণ সম্প্রীতি পুনর্স্থাপিত হয়েছিল। সি. ই. এস. সি-র চেয়ারম্যান, অতি অমায়িক বুদ্ধিমান মানুষ, ভুল বোঝাবুঝি যাতে আর না-গড়ায় সেজন্য তাঁকে অনুরোধ জানালাম, তাঁর কাছ থেকে যথোপযুক্ত সাড়া পেলাম।
জ্যোতিবাবু সবাইকে নিয়ে চলতে আগ্রহী, বিদ্যুৎ সচিবকে নিয়ে জটিলতা তাঁর হয়তো তেমন পছন্দ হয়নি। আমার অভিমত ছিল সচিবটিকে অবিলম্বে অন্য বিভাগে সরিয়ে দেওয়া হোক। জ্যোতিবাবুর তখনও তাঁর সম্পর্কে আস্থার ভাব, সম্মত হলেন না। কিন্তু মাস কয়েক না গড়াতেই অন্য একটি ঘটনা, মুখ্যমন্ত্রীকে পরোয়া না করে সচিব মহাশয়ের এক অতিশয় অন্যায় আচরণ, তাঁকে তাই শেষ পর্যন্ত সরে যেতেই হলো। সচিব রাজপুরুষটির প্রতি আমার তখনও কোনও বীতরাগভাব ছিল না, এখনও নেই, তবে প্রশাসনের কতগুলি আবশ্যিক নিয়মকানুন না মানা হলে মুশকিল।
বিদ্যুৎক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগের গর্বিত ফানুস গত কয়েক বছরে পুরোপুরি চুপসে গেছে। পশ্চিম বাংলায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আজ যে পালাবদল, তা ঘটেছে প্রাধানত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, বিদ্যুৎক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রতি বছর রাজ্য বাজেটে বাড়িয়ে-বাড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে। সারা পৃথিবী জুড়েই বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহকারী সংস্থাগুলি সম্পর্কে সম্প্রতি ব্যাপক আশাভঙ্গ। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পর্যন্ত, ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে, বিদ্যুৎক্ষেত্রে বিরাষ্ট্রীয়করণের পরিণামে মস্ত সংকট দেখা দিয়েছিল মাত্র কয়েক বছর আগে, আর এনরন করপোরেশনের দেশে-দেশে পুকুর-চুরি গোছের কার্যকলাপ তো এখন সকলেরই জানা।
তবে ‘ভদ্রলোক নই, কমিউনিস্ট’ বাক্য উচ্চারণে বোধ হয় পার্টির মধ্যে কিছু আলোড়ন ও দ্বিধা দেখা দিয়েছিল। কেউই আমাকে কিছু মুখ ফুটে বললেন না, কিন্তু পার্টির উপরমহলে মধ্যবিত্ত ধ্যানধারণার সমারোহ, আরও একটু বাড়িয়ে বলতে পারি, প্রায় প্রত্যেকেরই তিন-চার পুরুষ আগে পিতামহ-প্রপিতামহর আমলে জমিজমা ছিল, জমিদারি মানসিকতা মার্কসীয় গ্রন্থাদি পড়লেও ঠিক ঘুচতে চায় না। হালে অনেকে গাল পাড়েন, সোভিয়েট দেশ ও পূর্ব ইওরোপের অন্যত্র সাম্যবাদী আন্দোলনের দুর্দশার প্রধান কারণ লেনিন-প্রবর্তিত গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নীতি। যে-পরিস্থিতিতে গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের সার্থকতার স্বার্থে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার প্রবর্তন করেছিলেন লেনিন, বিপ্লবোত্তর সোভিয়েট রাষ্ট্রে তা কতটা প্রযোজ্য ছিল, সেই প্রয়োগ থেকে কোন ধরনের কী-কী ঘুণ বাসা বেঁধেছিল, নাকি মোটেই বাঁধেনি, এ সব নিয়ে এই পক্ষে-ওই পক্ষে এন্তার আলোচনা-প্রতিআলোচনা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আমাদের দেশেও সাম্যবাদী আন্দোলনের যাবতীয় ত্রুটি-দুর্বলতার জন্য যত-দোষ-নন্দ-ঘোষ হিশেবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা তথা জোসেফ স্টালিনের বহুরটিত স্বৈরাচারী মাসিকতাকে দায়ী করার চেষ্টা আপাতত খুব জোরদার। আমার দৃঢ় প্রতীতি, বৃথাই লেনিন বা স্টালিনের উপর দোষ চাপানো, আমাদের এখানে, বিশেষত বাঙালি পরিবেশে, বামপন্থীদের মধ্যে স্খলন-পতন যা ঘটছে, তার জন্য গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাকে অপরাধী করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আসলে দায়ী জমিদারি মনোবৃত্তি। কেউ-কেউ ভীষণ কুপিত হবেন, কিন্তু রাজ্যের কমিউনিস্ট পার্টির বহু স্তর জুড়ে এখনও জমিদারি সেরেস্তার গন্ধ। এমনিতে ঢিলেঢালা পরিবেশ, কিন্তু নেতৃস্থানীয়দের সম্বন্ধে আতিশয্যযুক্ত সম্রম, কোনও পর্যায়ে যা প্রায় খোশামুদিতে পরিণত হওয়ার উপক্রম। এই মানসিকতারই একটি প্রচ্ছন্ন ছায়া পার্টির সদস্যদের ভদ্রলোক-ভদ্রলোক আচরণে। কানা-ঘুষো শুনতে পেলাম, কারও-কারও স্বগত বিলাপ, ‘অশোক মিত্র এটা কী বললেন? আমরা নিখাদ কমিউনিস্ট, তা বলে কী সেই সঙ্গে আমরা নিখাদ ভদ্রলোকও নই?’ গুঞ্জন আরও শুনলাম, এরকম নাটুকেপনার কী প্রয়োজন ছিল? গুরুজনস্থানীয়দের মধ্যে একমাত্র হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সুতীব্র আবেগের সঙ্গে আমার সমর্থনে সোচ্চার হলেন, আমার ঘোষণার অভ্যন্তরে কী নিবিড় দার্শনিক ভাবনা লুকিয়ে আছে তাঁর লেখা পড়ে তা জেনে নিজেই চমৎকৃত হলাম।
অবশ্য বিধানসভায় আমার জঙ্গি ভূমিকা পার্টির সব মহলেই উৎসাহ সঞ্চার করছিল, তাতে ভাঁটা পড়লো না। প্রতিক্ষয়ীদের অধিকতর বিরাগভাজন হতে থাকলাম, তাতে অবশ্য আমার মাথাব্যথা ছিল না। কেন্দ্রের সঙ্গে আমার লড়াই করে যাওয়ার প্রবণতাকে বঙ্গভাষীদের অভিমানহত সত্তা, বোঝা যাচ্ছিল, অনেকটাই পছন্দ করতে শুরু করেছে।
আমলাদের সঙ্গে চেষ্টা করতাম বন্ধু কিংবা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিশেবে আচরণ করতে। কাজের বিচ্যুতি দেখলে স্পষ্ট কথা বললাম, কিন্তু সবাইকেই কড়া কথা বলি, এই সংবাদ যথেষ্ট প্রচারিত হওয়ার ফলে আমলারা আমার হাঁকডাকেও অভ্যস্ত হয়ে গেলেন, তবে আড়ালে সম্ভবত একটু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতেন। সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে দেখা করতে আসতেন, একবার হিশেব করে দেখেছিলাম আড়াইশো থেকে তিনশো সংগঠনের প্রতিনিধি ফি বছর আলোচনায় আসছেন। তাঁদের অনেককেই বলতাম, একটু ধৈর্য ধরে থাকুন, আপনাদের প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় সরকারি কাজকর্মে যথাশীঘ্র উন্নতি সাধিত হবে, প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রসার ঘটবে, তখন সরকারের সামর্থ্যও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির সঙ্গে-সঙ্গে মাইনেপত্তরের হারও আরও ঊর্ধ্বগামী হবে। এরকম যে হয়েছে তা অর্থ বিভাগের বিক্রয়কর শাখার ব্যাপ্তি থেকেই বুঝে নেওয়া যায়; গত দুই দশকে এই বিভাগের আয় অন্তত পনেরো গুণ বেড়েছে, তার সুফল সরকারের সর্বক্ষেত্রে অনুভুতও হয়েছে।
আমার সঙ্গে আলোচনায় যখন কোনও কর্মচারী সংগঠন খুশি হতে পারতেন না, তাঁদের অসন্তোষ সরবই থাকতো, হাত জোড় করে রঙ্গ মিশিয়ে তাঁদের বলতাম: ‘দেখুন, আপনাদের দাবি-দাওয়া এই মহর্তে তো আমার পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়; এক কাজ করুন, বেরোবার মুখে দরজার পাশে ওই দেখুন একটা লাঠি দাঁড় করানো আছে, লাঠিটা দিয়ে প্রত্যেকে আমার মাথায় একবার ঘা মেরে যান।’
আমাদের সরকারে প্রবেশ করার এক মাসের মধ্যেই বেতন কমিশন গঠন করা হয়েছিল; কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে অধিকাংশ সুপারিশ কার্যকর করার ব্যবস্থা। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী-সহ গোটা রাজ্যে প্রায় কুড়ি লক্ষ মানুষ রাজ্য সরকার থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন; কুড়ি লক্ষ পরিবার, অর্থাৎ এক কোটির মতো মানুষ তাই সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে প্রথম পর্যায়েই উপকৃত। কংগ্রেসি আমলে সরকারি কর্মচারী তথা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী সম্প্রদায় যে গভীর হেলাফেলায় ছিলেন, তার আমূল পরিবর্তন ঘটলো। অর্থাভাব, কিন্তু এই দায় পালন করার মধ্যে মস্ত চরিতার্থতাবোধও ছিল।
তবে বেতন কমিশনের সুপারিশ চালু করতে গিয়েও হাজার সমস্যা। বিভিন্ন সরকারি বিভাগে প্রতিটি স্তরে বহু বেতনভাতাগত অসামঞ্জস্য, কমিশন কিছু-কিছু দূরীকরণের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু করতে গিয়ে, প্রায় অসহায়, নতুন অসামঞ্জস্যের সূত্রপাত করেছেন। একাশি সাল থেকে যে-সার্বিক বেতনক্রম ঘোষিত হলো তাতে সব সমস্যার সমাধান হলো না, হওয়া সম্ভবও ছিল না। বেতন-ভাতার অসামঞ্জস্য ঘোচানোর প্রয়াস অর্থ দপ্তরের সুতরাং বারোমাস্যায় পরিণত; অর্থমন্ত্রীর ঘরে ডেপুটিশনের পালাও। পৃথিবীতে নেই কোনও বিশুদ্ধ চাকরি, বেতনক্রমও নেই।
অন্তত একটি ব্যাপারে আমার অতৃপ্তি অব্যাহত। বেতন-ভাতা পেনশনের নতুন নিয়মাবলী একাশি সাল থেকে কার্যকর হলো, তখন যাঁরা কর্মরত, তাঁরা সে-সবের সুযোগসুবিধা পাবেন, কিন্তু যাঁরা সেই তারিখের আগে অবসর নিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কী হবে? আমার খুব ইচ্ছা ছিল ইতিমধ্যে-অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ও অন্যান্যদের ক্ষেত্রে অন্তত পেনশনের পরিমাণ যাঁরা আগামী দিনে অবসর নেবেন, তাঁদের প্রাপ্যের সঙ্গে সমীকরণ করা হোক। সেই ইচ্ছা পুরোপুরি পূরণ হয়নি।
এ-সমস্ত সার্থকতা-অসার্থকতা পেরিয়ে অন্য যে লাভ হয়েছিল তা কার্যসূত্রে পশ্চিম বাংলার প্রত্যেকটি জেলায় আদ্যন্ত চষে বেড়ানোয়, স্থানভেদে মানুষজনের মুখ্য ভাষার ঈষৎ আদলফের, নানা আঞ্চলিক-ভৌগোলিক বিন্যাস, কৃষি-ক্ষুদ্র শিল্প-সংগঠিত শিল্পের হাল, রাস্তাঘাটের অবস্থা, আমলাতন্ত্রের কাঠামো, রাজনৈতিক দন্দ্ব-সমাসের ঘোর-প্যাঁচ ইত্যাদি নিয়ে বহুবিধ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জেলায় বা জেলার প্রত্যন্তে গাড়িতে চেপেই পৌঁছে যেতাম, সরকারি চালক বিজয় বড়ুয়া অতি দক্ষ গাড়ি চালানোয়, মেজাজে একটু খ্যাপাটে। খ্যাপাটে হওয়ার কারণও ছিল। রাস্তায়-ঘাটে আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা একটু কমই পেত, অন্যান্য মন্ত্রীদের মতো খানিক বাদে থেমে ঘন-ঘন চায়ের খোঁজ করতাম না, কিন্তু বড়ুয়ারও যে মাঝে-মাঝে একটু বিশ্রাম প্রয়োজন, পানীয় বা আহার্যের প্রয়োজনও অমার্জনীয়ভাবে তা ভুলে থাকতাম। আমার টনক নড়লো যখন শুনতে পেলাম কার কাছে যেন সে আমার সম্পর্কে নালিশ জানিয়েছে, তার অননুকরণীয় পূর্ববঙ্গীয় বিভঙ্গে, ‘হ্যা নিজেও খাইবো না, আমারেও খাইতে দিবো না’।