পনেরো
কলকাতায় স্থিত হওয়ার প্রধান একটি আগ্রহ ছিল কবি-সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে বেশি করে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে বলে, সেই সঙ্গে বামপন্থী রাজনীতিক্রিয়াকর্মের সঙ্গে নিজেকে একটু-একটু সংযুক্ত করার। এখানেও এক ধরনের স্ববিরোধিতায় আমি বহুদিন ধরে আক্রান্ত। প্রথম জীবনে যে-সাহিত্যিক সুহৃদ্দের সঙ্গে সময় কাটাতাম, আড্ডা দিতাম, কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় উন্মুখর হতাম, তাঁদের মানসিকতায় তেমন বামপন্থী ছাপ ছিল না। এই পর্বে আমার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাঁর কথা ইতিমধ্যেই একাধিকবার বলেছি, আতোয়ার রহমান, ১৯৬৩ সাল থেকে পরের কয়েক বছর, ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব বলতে গেলে প্রধানত আমার উপর ছেড়ে দিলেন; বলা চলে ধাপে-ধাপে অবরোহণ, হুমায়ুন কবির থেকে আতোয়ার, আতোয়ার থেকে আমি। নতুন অনেক লেখককে ‘চতুরঙ্গ’-এ হাজির করেছিলাম। অমলেন্দু বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ইংরেজি সাহিত্যের প্রধান অধ্যাপক, বাংলা কবিতা ও চিত্রকলা নিয়ে অনেকগুলি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন চতুরঙ্গ’-এর পাতায়। সততঅস্থির অশোক রুদ্র নিজেকে সত্যিই সর্বকলাপারঙ্গম ভাবতো, হয়তো সেরকম ভাববার তার অধিকারও ছিল। সংখ্যাতত্ত্ব-অর্থশাস্ত্র পেরিয়ে ‘চতুরঙ্গ’-এ সে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান নিয়ে প্রবন্ধ থেকে শুরু করে বিপ্লবের বারুদ-ছোঁয়া ইস্তাহার পর্যন্ত ছাপিয়েছে। লোকনাথ ভট্টাচার্যকে তাগিদ দিয়ে-দিয়ে ওর একরাশ প্রতীকী কবিতা, সেই সঙ্গে একটি গোটা উপন্যাসও, ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় প্রকাশ করতে পেরেছিলাম। আমার গুরু অমিয় দাশগুপ্ত মশাই প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে মাতৃভাষার আবশ্যকতা নিয়ে অতি প্রাঞ্জল একটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন, ‘চতুরঙ্গ’-এর তা মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল।
অন্তরঙ্গ সুহৃদ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গভীর বিশ্বাসে, প্রগাঢ় অনুকম্পায়, সেই সঙ্গে বল্গাহীন অপব্যয়িতায়, নানা ক্ষুদে পত্রিকায় কবিতা দান করে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁকে পাকড়ে ‘চতুরঙ্গ’-এর জন্য বেশ কয়েকবার জোর করে লিখিয়ে নিয়েছিলাম। সেই বছরগুলিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতার মরশুম। মনে পড়ে গীতার একটি লম্বা নাটক ছাপিয়েছিলাম, তাতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সুন্দর একটি গীতিকবিতা, নিখাদ রোমান্টিক, অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে তখনই ঠাহর করতে পারছিলাম দক্ষিণায়ন শুরু হয়েছে। অন্তত একটি কবিতার কথা মনে পড়ে, যা সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘চতুরঙ্গ’-এর জন্য দিয়েছিলেন, যা হাতে পেয়ে তাঁর মুখের উপর বলেছিলাম, নিকষ প্রতিক্রিয়াপন্থী। আমার অভিমত জেনে গীতা-সুভাষ দু’জনেই দৃশ্যত মর্মাহত। তাদের কন্যা পুপে-কে খুব পছন্দ করতাম: কনিষ্ঠ-কনিষ্ঠারা অনেকে তো এখন নিজেরাই অপরাহ্ণ ছুঁই-ছুঁই।
পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই ‘চতুরঙ্গ’-এর বাঁধা আড্ডাবাজ হয়ে গিয়েছিলাম। লখনউ থেকে এসে মাঝে-মাঝে আতোতায়ারের ফ্ল্যাটে থাকতাম, সুরঞ্জন সরকারের সঙ্গে ঘর ভাগ করে নিয়ে, আতিকুল্লার তৈরি খাঁটি বাঙাল রান্না তারিফ করে খাওয়া। অবিবাহিত যুবকদের প্রায়-উচ্ছৃঙ্খল ডেরা, নরক গুলজার। বৈশাখ মাসের গুমোট-গরম রাত, হাওয়ার মৃদু সঞ্চালনে একটু স্নিগ্ধ হওয়ার আশায় শোবার ঘর ছেড়ে বাইরের ব্যাল্কনিতে আতোয়ারের নিদ্রাগমন, খালি গা, ভোরের দিকে লুঙ্গিতে গিঁট সামান্য শ্লথ হয়ে গেছে, সুরঞ্জনের হঠাৎ চোখে পড়েছে। প্রাতঃকালীন চায়ের টেবিলে সুরঞ্জনের সোচ্চার কাব্য-আস্ফালন: ‘আতোয়ার শুয়ে আছে রেনোয়ার ন্যুডের মতন’। এমন আরও কত কাহিনী। ক্ষীরকদম্ব সম্পর্কে আমার ঈষৎ দুর্বলতা জেনে আতোয়ার প্রতিদিন এক বাক্স সেই মিষ্টি এনে হাজির করতেন। ভরদুপুরে আর এক দফা চায়ের আড্ডা, ওই পাড়ার সুস্বাদু টিকিয়া সহযোগে। এই পুরো সময়টা জুড়ে কমল মজুমদার গণেশ অ্যাভিনিউতে নিয়মিত হাজির থাকতেন, ফরাশি বাকচাতুর্যে আমাদের জবাই করতেন, মাঝে-মাঝে তাঁর রচিত বা রচিতব্য গল্প বর্ণনা করে শোনাতেন, আমরা রুদ্ধশ্বাস, বিমুগ্ধ। এমনই এক গ্রীষ্মের অপরাহ্ণ তিনি ‘মল্লিকাবাহার’ গল্পের কাহিনীটি অনুপুঙ্খ শুনিয়েছিলেন। কোথায় যেন লিখেছিলাম, কাহিনীর, ও কমলদার বচনভঙ্গির, উৎকর্ষে আমরা এতটা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম যে একটি অশ্লীল শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারিনি। টুকরো-টুকরো করে কমলদা ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র বেশির ভাগ অংশও পড়ে শুনিয়েছিলেন। খেয়ালি মানুষ; যতদিন রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-তে ছিলেন, ওঁর নাগাল পাওয়া মুশকিল হতো না, প্রায়ই বাড়ি থেকে বাইরে ডেকে এনে মধ্যরাত্রি উত্তীর্ণ হয়ে গেলে ত্রিকোণ পার্কের পাশে ট্রাম লাইনের উপর বসে আজ্ঞা জুড়তাম আমরা। কমলদা ফরাশিতে যেমন চোস্ত ছিলেন, খিস্তি আওড়াতেও ততটাই। যাঁদের পছন্দ হতো না তাঁদের প্রতি মিহিন ভাষায় মিষ্টি করে এমন খিস্তি ঝাড়তেন, সেই ব্যক্তিবর্গ পালাবার পথ পেতেন না, আর এ-মুখো হতেন না। তখন মেরিডিথ স্ট্রিটের কফি হাউস সত্যজিৎ-প্রসাধিত, জমজমাট। কমলদা সাধারণত ‘চতুরঙ্গ’-এ পৌঁছুতেন কফিহাউস থেকেই, ভর দুপুরবেলা। তাঁর প্রথম করণীয়, ঢ্যাঙাবাবুকে কায়দা করে কী ধোলাই দিয়ে এসেছেন, তার সবিস্তার বিবরণ প্রদান।
একষট্টি সালে যখন ওয়াশিংটন থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছিলাম, আতোয়ার রহমানের তখন বিবাহ-অনুষ্ঠান। আমার চেয়ে বয়সে দশ বছরের বড়ো হলেও, তাঁর বিয়েটা ঘটে আমার নিজের বিয়ের পাঁচ বছর বাদে। তাঁর ক্ষেত্রে কিছু-কিছু হৃদয়বিদারক কাহিনী বিবাহলগ্নকে পিছিয়ে দেয়, যা আমার ক্ষেত্রে অঘটিত ছিল। এ বিষয়ে অধিক কিছু না বলাই সম্ভবত নিরাপদ। তেষট্টি সালে যখন পাকাপাকি কলকাতায় বাসা বাঁধলাম, বিবাহিত আতোয়ারের আবাস ‘চতুরঙ্গ’-র আস্তানা থেকে উঠে গেছে। তিনি স্ত্রী ও শিশুপুত্র টিটোকে নিয়ে শামসুল হুদা রোডে এক ফ্ল্যাটবাড়িতে ঘর গুছিয়েছেন; কিছুদিন বাদে কলকাকলিময়ী কন্যা বুড়ির আগমন। ৮এ শামসুল হুদা রোড হঠাৎ কলকাতার খুব গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানায় রূপান্তরিত হলো; দোতলার যে-ফ্ল্যাটে আতোয়ার রহমান থাকতেন, তার ঠিক উপরেই উৎপল দত্ত-শোভা সেনও তখন উঠে এসেছেন। অন্য দিকে গণেশ অ্যাভিনিউর ফ্ল্যাটবাড়িতে আরতি ও সুভো ঠাকুর, সঙ্গে তাঁদের ফুটফুটে কন্যা, যারও নাম পুপে, যতিপূরণ করলেন।
‘চতুরঙ্গ’-এর আড্ডার স্বভাবতই একটু চরিত্র পরিবর্তন ঘটলো। দপ্তর এখন থেকে নিছকই দপ্তর, ঈষৎ অফিস-অফিস গন্ধ। ততদিনে সঞ্জয় ভট্টাচার্য-সত্যপ্রসন্ন দত্তও পাশের ফ্ল্যাট ছেড়ে এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করে শেষ পর্যন্ত সুদূর সেলিমপুর রোডে চলে গেছেন, যেখান থেকে নব পর্যায়ে ‘পূর্ব্বাশা প্রকাশ করবার জন্য সত্যপ্রসন্নবাবুর উদয়াস্ত প্রয়াস। অবর্ণনীয় কঠিন সময় তাঁকে তখন অতিক্রম করতে হয়েছে। হাতে পয়সাকড়ি নেই, সংসার-খরচের সংস্থান জোগাতেই প্রাণান্ত, তার উপর সঞ্জয়দা মাঝে-মাঝে গভীর বিষাদে ডুবে যান, তাঁর আশৈশব সুহৃদ সত্যপ্রসন্নবাবুকেই সেই সংকটের মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধ করে যেতে হয়, পয়সা বাঁচানোর জন্য এমনকি নিজের হাতে ছাপার টাইপে লেখা সাজাতে হয় পর্যন্ত। ‘চতুরঙ্গ’ অবশ্য, মোটামুটি নিয়মিতভাবেই, বছরে চারটি সংখ্যা, প্রকাশিত হতে থাকে। কয়েক বছর বাদে, হুমায়ুন কবিরের মৃত্যুর পর, আতোয়ার দিলীপকুমার গুপ্তকে রাজি করিয়েছিলেন সম্পাদনার ভার গ্রহণ করবার জন্য। ইতিমধ্যে সিগনেট প্রেসের। ভগ্নদশা, ডি কে-র শরীর-মন ভেঙে পড়েছে। দু’তিন বছরের মধ্যে তিনিও প্রয়াত হলেন, তারপর কয়েক বছর আমাদের পুরনো দিনের বন্ধু বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য ‘চতুরঙ্গ’-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক হিশেবে ঠেকা দিয়ে গেলেন, যদিও বেশির ভাগ দায়িত্বই, সম্পাদনার কাজ সুদ্ধু, আতোয়ারকে সামলাতে হতো। একটি পর্বে আতোয়ার আমাকে সম্পাদক হবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, অনেক ভেবে সম্মত হইনি। ওই পর্যায়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে রাজনীতির আড়াআড়ি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। হুমায়ুন কবির-প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতে থাকলে অবশ্যই খানিকটা দৃষ্টিকটু দেখাতো। তবে প্রত্যক্ষ দায়িত্বের বাইরেও অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল, যথাসম্ভব তা করবার চেষ্টা করেছি।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি মুহূর্তে চীনে যুদ্ধের ঘোর সাধারণ মানুষের মানসিকতা থেকে কেটে গেছে, বাঙালিদের মধ্যে আরও বিশেষ করে। বহু মহিলা পর্যন্ত অনুশোচনার সঙ্গে বলতে শুরু করেছেন, কী ভুলই তাঁরা করেছেন, তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের তাড়নায় গয়নাগাঁটি-পয়সাকড়ি সরকারের হাতে সমর্পণ করে, ‘উত্তুরে দুশমনদের’ প্রতিরোধ করবার লক্ষ্যে। অধ্যাপনা করি, ‘চতুরঙ্গ’-এর সঙ্গে যুক্ত থেকে একটু-আধটু সাহিত্যিক উদ্যম। কিন্তু সব ছাপিয়ে ততদিনে আমাকে ছেয়ে ফেলেছে রাজনীতিমনস্কতা। গোড়া থেকেই কি কট্টর ছিলাম আমি, না কি পরিবেশ আমাকে কট্টর করে তুলেছিল? কমিউনিস্ট পার্টিতে আমার পুরনো পরিচিতরা অধিকাংশই দক্ষিণপন্থী। কলকাতায় ফিরে আমার যে-দিব্যজ্ঞান হলো, তাঁদেরই হাজার-হাজার পার্টি কমরেড বিনা বিচারে কারারুদ্ধ, অথচ তা নিয়ে তাঁদের কোনও হেলদোল নেই, যেন এটাই পৃথিবীর নিয়ম: কমরেডদের বড়ো অংশ জেলখানায় পচবেন, সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা ভোগ করবেন, আর যাঁরা বাইরে থাকবেন তাঁরা কংগ্রেসিদের সঙ্গে মিশে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কী উপায়ে আরও মজবুত করা যায় তা নিয়ে চিন্তাশীল হবেন, কিংবা লোকসভার সেই মাননীয়া সদস্যার মতো স্পষ্ট বলবেন, কমরেড বন্দীদের মুক্তি দাবি করার চেয়ে বড়ো হঠকারিতা কিছু হতে পারে না।
অবস্থা থমথমে। অনাবৃষ্টিহেতু খাদ্যশস্য ও সেই সঙ্গে অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের দাম চড়ছে, রাষ্ট্রীয় খাদ্যসরবরাহ ব্যবস্থা নড়বড়ে, গ্রামাঞ্চলে তো র্যাশনের ব্যাপারই নেই, চীনে যুদ্ধের দোহাই দিয়ে কারখানায় ন্যায়সঙ্গত মজুরিবৃদ্ধি আটকে রাখা হয়েছে। নেতারা কারান্তরালে, শ্রমিকরা যথেষ্ট দিশেহারা। তবে এই কুজ্বাটিকার রেশ অচিরেই কাটলো, পরিস্থিতির চাপে নতুন-নতুন নেতা বেরিয়ে এলেন। তাঁদের আনুগত্য বামপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের প্রতি। তেষট্টি সালের শেষের দিকে, চৌষট্টি সালের শুরুতে, কয়েকজন নেতা ছাড়া পেলেন। বর্ধমানের মহারানীর মৃত্যুহেতু বর্ধমান শহরের একটি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন। বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী তখনও আত্মগোপন করে আছেন। জেলা কমিটির চাপে তাঁকেই রাজ্যের তখনকার নেতৃত্ব পার্টির প্রার্থীরূপে মনোনয়ন দিতে বাধ্য হলেন, বিনয়দা বহু ভোটে জিতলেন। সেই উপনির্বাচনের ফল যেন কোনও দুর্দম আবেগমুক্তির মতো। পুলিশের চোখ-রাঙানোর তোয়াক্কা না করে কলকাতায়, শহরতলিতে, বিভিন্ন মফস্বল শহরে, গ্রামে, ফের সংগঠন প্রকাশ্যে মাথা উঁচিয়ে উঠলো। প্রতিদিন ছোটো-মাঝারি-বড়ো অজস্র প্রতিবাদের মিছিল। খবরকাগজগুলি অবশ্য সবচেয়ে রক্ষণশীল, সবচেয়ে ধামাধরা। তবে কাগজগুলির সম্পাদকবৃন্দ কল্পনাবিলাসে ভুগছিলেন। তাঁদের মতামত, তাঁদের সংবাদ নির্বাচন, সেই সংবাদ-বিন্যাস নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে গভীর বিবমিষাবোধ আদৌ তাঁরা টের পাচ্ছিলেন না। শিক্ষক এবং ছাত্র আন্দোলন, মহিলাদের আন্দোলন, সরকারি-সদাগরি কর্মীদের আন্দোলন, উদ্বাস্তুদের আন্দোলন; কৃষক সভা ও ট্রেড ইউনিয়নের শাখাপ্রশাখায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন করে ব্যূহ গড়বার, ব্যূহ আরও শক্তিশালী করবার, জোয়ার। যাঁরা শাসনব্যবস্থার হাল ধরে ছিলেন, তাঁরা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না কী ঘটছে চারপাশে।
অধ্যাপক সুশোভন সরকারের তত্ত্বাবধানে প্রতি সপ্তাহে যে ‘জনশিক্ষা পরিষদ’-এর বৈঠক বসতো, অধিকাংশ সময় চিন্মোহন সেহানবিশের বাড়িতে, তাতে আমি তখনও পর্যন্ত নিয়মিত হাজির থেকেছি। যেসব আলোচনা-কথাবার্তা হতো, অধিকাংশই আমার পছন্দ নয়, তর্ক করতাম, প্রশ্ন তুলতাম, অথচ সুশোভনবাবু সম্পর্কে প্রচুর শ্রদ্ধা থাকায় বৈঠকে যাওয়া বন্ধ করিনি। সে রকম অবস্থা ঘটলো মাস ছয়েক বাদে, তেষট্টি সালের সেপ্টেম্বর মাসে। পার্টির সরকারি কাগজগুলি রাজ্য কমিটির অস্থায়ী নেতাদের দখলে। বামপন্থীরা হাওড়ার একটি অবলুপ্ত পত্রিকা ‘দেশহিতৈষী’-র স্বত্ত্বাধিকার সংগ্রহ করে বিকল্প সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন; কোনও নতুন নামে পত্রিকা বের করতে চাইলে অনুমতি না মেলবার আশঙ্কা। যতদূর মনে পড়ে, এই নবারব্ধ পত্রিকার উদ্যোগে ফের বহু মাস বাদে ময়দানে মনুমেন্টের পাদদেশে মস্ত সভার আয়োজন করা হলো, বন্দীমুক্তির দাবি জানিয়ে। পশ্চিম বাংলার নেতারা তখনও অনেকেই ছাড়া পাননি, কেরল থেকে এ. কে. গোপালন এলেন সভায় বক্তৃতা দিতে। সভা ভঙ্গ হলে মশাল জ্বালিয়ে প্রকাণ্ড মিছিল বেরোলো। সেই সন্ধ্যায় ‘জনশিক্ষা পরিষদ’-এরও বৈঠক বসবার কথা, আমি তাই বক্তৃতার শেষে মিছিলে যোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি ডক্টর শরৎ বাঁড়ুজ্যে রোডে হাজির। আরও যাঁদের আসবার কথা, অনেকেই এসে পৌঁছুতে পারেননি, মিছিলে আটকা পড়েছেন, সভা শুরু হতে পারছে না। আমরা যে-ক’জন উপস্থিত ছিলাম, এটা-ওটা-সেটা গল্পগুজব করছি, এমন সময় আরও একজন এলেন, সবিনয়ে জানালেন, মিছিলের জন্য দেরি হলো। হঠাৎ আলোচনাসভার উদ্যোক্তাদের একজন উচ্চ নিনাদে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কাদের মিছিল, ওই গোপালন-গ্যাঙের বুঝি?’ শোনামাত্র সভাস্থল ত্যাগ করে বেরিয়ে এলাম, তারপর আর কোনওদিন ‘জনশিক্ষা পরিষদ’-এর সভায় যাইনি।
কয়েক সপ্তাহ বাদে সুশোভনবাবুর ফোন পেলাম, আমি যদি একটু কষ্ট করে কোনও সন্ধ্যায় ওঁর নাকতলার বাড়িতে যাই। গেলাম। সুশোভনবাবু ও তাঁর স্ত্রী সাদরে বসালেন, শোভন-সুন্দর আলাপ-আপ্যায়ন। তবে একটু বাদে মূল প্রসঙ্গ উত্থাপন। সুশোভনবাবু স্নেহভরেই বললেন, তিনি শুনতে পেয়েছেন আদর্শগত প্রশ্নে আমি একটু বিহ্বল, উগ্র বামাচারীদের দিকে ঝুঁকেছি, এটা যে কত ভুল অনেকক্ষণ ধরে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। সম্মাননীয় বয়োজ্যষ্ঠদের সঙ্গে আমি তেমন তর্কে পটু নই, বেশির ভাগ সময়ই প্রায় নীরবে তাঁর কথা শুনলাম, মাঝে-মাঝে একটু-আধটু মৃদু অন্য মত প্রকাশ। যখন বিদায় নেওয়ার সময় হলো, বিনয়ের সঙ্গে হেসে বললাম, নিবিড় শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর বক্তব্য শুনেছি, কিন্তু আমি নিরুপায়, আমাকে বিপথগামী হতেই হবে। সুশোভনবাবু স্পষ্টতই হতাশ। তার পর আর তাঁর সঙ্গে বিশেষ দেখা হয়নি, তবে শিক্ষক ও ভাবুক হিশেবে দেশের বামপন্থী আন্দোলনে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা কী করে অস্বীকার করি।
মাঝে-মাঝে কর্মসূত্রে দিল্লি গমন। হয় ওখানে, নয় বিমানে যাতায়াতের সময়, প্রায়ই ভূপেশ গুপ্তের সঙ্গে দেখা হতো। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে মনে না হয়ে উপায় ছিল না যে তিনিও পার্টির আভ্যন্তরীণ বিতর্কে, অন্তত আদর্শের দিক থেকে, বামপন্থার দিকে ঝুঁকছেন। প্রায়ই দাঙ্গে-বিরোধী কথাবার্তা বলতেন, এটাও জানাতেন, দাঙ্গেকে তিনি বলে দিয়েছেন, তুমি দলের চেয়ারম্যান হতে পারো, কিন্তু পার্লামেন্ট-সংক্রান্ত ব্যাপারে তোমাকে আমি নাক গলাতে দেবো না, নিজের বিচার-বিবেচনা মতো চলবো। এই সময়েই সম্ভবত তিনি দু’শো পৃষ্ঠার একটি দাঙ্গে-বিরোধী দলিলও তৈরি করেছিলেন, তাঁর উইন্ডসর প্লেসের বাড়িতে যাঁরাই হাজির হতেন, তাঁদের ধরে সেই বৈকুণ্ঠের খাতাটি পড়ে শোনাতেন। আমার বন্ধু মোহিত সেন ঘোরতর দক্ষিণপন্থী, সে তখনই সশ্লেষে আমাকে বলেছিল, হ্যাঁ, পার্টি তো ভাগ হবেই, কিন্তু দেখো, ভূপেশবাবুর স্থূলে ভুল নেই, মস্কো যেদিকে ঝুঁকবে, তিনিও সেদিকেই থাকবেন। মোহিতের বিবেচনাশক্তিতে আমার তেমন আস্থা কোনওদিনই ছিল না, এখন আরও নেই, কিন্তু অন্তত এই ক্ষেত্রে তার ভবিষ্যদ্বাণী খাঁজে-খাঁজে মিলে গিয়েছিল।
ওই বছর অন্য-একটি অভিজ্ঞতা সামান্য কৌতুককর। একদিন এক ভদ্রলোক ফোন করলেন, নাম জানালেন সুকুমার দত্ত, বললেন, দিল্লির অশোক মিত্রের কাছ থেকে আমার ফোন নম্বর পেয়েছেন। সন্ধ্যাবেলা ভদ্রলোক আমাদের ফ্ল্যাটে এলেন। সঙ্গে-সঙ্গে বুঝলাম ইনি ‘হুগলী গ্রুপ’-এর সুকুমার দত্ত। কিশোর বয়স থেকেই নামটি জানতাম, ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার বিধান সভায় শ্রীরামপুর কেন্দ্র থেকে বিধান সভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। কংগ্রেস দলে ‘হুগলী গ্রুপ’ খুব প্রভাবশালী গোষ্ঠী, ওই মুহূর্তে অতুল্য ঘোষ যার প্রধান পুরুষ, মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন তাঁর ছায়াসঙ্গী। পরিধানে হাত-কাটা ফতুয়া, ডবল-ব্রেস্ট কোটের মতো আঁটো করে আড়াআড়ি আটকানো, ঈর্ষণীয় স্বাস্থ্য, সুকুমারবাবুকে অতি চমৎকার লাগলো। প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতাপুরুষদের সম্বন্ধে সাধারণভাবে যা ধ্যানধারণা, তাঁর কথাবার্তা-আচার-আচরণের সঙ্গে আদৌ মেলানো সম্ভব নয়। অনেকরকম খোঁজখবর রাখেন, রাজনীতির বাইরে ইতিহাস-দর্শন-শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে সুচারু সুগঠিত মতামত, কোনো ব্যাপারেই মনে হলো তাঁর মধ্যে ছুৎমার্গের বালাই নেই। একটু আপ্লুত হয়ে বিনীত প্রশ্ন করলাম কেন তিনি কষ্ট করে এসেছেন, আমি তাঁর কী প্রয়োজনে আসতে পারি। তাঁর উত্তর শুনে প্রায় আঁৎকে উঠলাম: তিনি এসেছেন অতুল্য ঘোষের দৌত্য নিয়ে, অতুল্যবাবু-সুকুমারবাবুরা চান আমার মতো কিছু-কিছু নবীন ‘জ্ঞানপ্রাপ্ত’ বাঙালি কংগ্রেসে যোগ দিয়ে এই রাজ্যে দলের পুনর্জীবনে সাহায্য করি। বিনম্র কণ্ঠে জানালাম, ওঁরা বড্ড ভুল করছেন, আমি শুধু কট্টর বামপন্থী নই, আরও কিছু বেশি। স্পষ্টতই হতাশ হয়ে সুকুমারবাবু সম্ভাষণ জানিয়ে বিদায় নিলেন, ওঁর সঙ্গে পরে আর কোনোদিন দেখা হয়নি।
আসলে পশ্চিম বাংলার দুঃসাহসী তথা স্বপ্নবিডোর যে-ঐতিহ্য ছিল, তা কোনওদিনই হারিয়ে যায়নি। চীনের সঙ্গে প্রায় গলা চুলকে ঝগড়া বাধাবার পরিণামে দেশকে যে-অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন কর্তাব্যক্তিরা, তা থেকে বিরক্তি ও ক্রোধের দাবানল গোটা সমাজ জুড়ে জ্বলে উঠছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত তরুণ-তরুণী যুবক-যুবতী কিশোর-কিশোরীরা সমাজ-বিপ্লবের প্রসঙ্গ, তখনও অন্তত, অবাস্তব অথবা অপ্রাসঙ্গিক বলে ভাবতে শেখেননি। ঠিক সেই মুহূর্তেই, চীনদেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রাক-মুহূর্তে, যে-ধরনের ভাবনা কেন্দ্র করে চিন্তা ও মননের উথালপাথাল চলছিল, তার ঢেউ পশ্চিম বাংলাকেও ছুঁয়ে গেল। তখনও দেশে পোশাকি ভাষায় জরুরি অবস্থা, কিন্তু কে আমল দেয় তাকে? গ্রামে-শহরে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ দিনের পর দিন ক্রমশ বর্ধমান। কৃষক সভার মেজাজ প্রচণ্ড জঙ্গি, তার প্রতিফলন গ্রামে-গ্রামে, জমি দখলের দুর্বার বন্যার দৈনিক পূর্বাভাস। লাঙল যার জমি তার পেরিয়ে শ্রম যার জমি তার, ফসলও তার, এই ধুয়োর আলোড়ন। কল-কারখানাতেও কর্মকর্তারা আর শ্রমিক নেতাদের দাবিয়ে রাখতে পারছেন না, দাবিয়ে রাখতে পারছেন না শ্রমিক শ্রেণীকেও। যুদ্ধের ভণিতা আর কাজ দিচ্ছে না, খেটে-খাওয়া মানুষ মজুরিবৃদ্ধি চায়, মূল্যমানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। পুঁজিপতিদের কাছে, সরকারের কাছে, অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের দাবিও তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ার উপক্রম। সরকারি তথা সদাগরি দফতরের করণিককুলও জরুরি অবস্থার পরোয়া না-করে রাস্তায় নেমে এসেছেন, তাঁদের মুখে বুলি, রাস্তাই একমাত্র রাস্তা। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেরই মনে তখন ভাবনার কণা পুঞ্জীভূত হচ্ছিল যে গোটা ভারতবর্ষে যাই-ই হোক না কেন, অন্তত পশ্চিম বাংলায় বিপ্লবের প্রারম্ভমুহূর্ত শুরু হয়ে গেছে। কারও পক্ষে আশঙ্কা, কারও বিশ্বাস: এমনকি সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্তরাও এরকম ধারণার দ্রুত শিকার হচ্ছিলেন।
ঠিক এই ঋতুতেই আমার সঙ্গে সমর সেনের যোগাযোগ। ছাত্রাবস্থায় তাঁর কবিতার অন্ধ ভক্ত ছিলাম; ‘কয়েকটি কবিতা’ থেকে শুরু করে ‘গ্রহণ’ পেরিয়ে ‘নানা কথা’ পর্যন্ত, প্রতিটি গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা আমার কণ্ঠস্থ। পরবর্তী সময়ে ‘কবিতা’ পত্রিকায় ও অন্যত্র তাঁর যে-যে কবিতা বেরিয়েছে, সেগুলিও দুরন্ত আগ্রহে সংগ্রহ করে পড়েছি। ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় বা অন্যত্র মাঝে-মাঝে তাঁর যে-সব নাস্তিকভাবাক্রান্ত প্রবন্ধ বেরোতো, তাদের নিহিত বক্তব্যও আমার রপ্ত। এর পর উনি মস্কোয় চলে গেলেন, সেখান থেকে ‘ইকনমিক উইকলি-’র জন্য প্রায়ই আধা-রাজনৈতিক, আধা-অর্থনৈতিক মন্তব্য পাঠাতেন, সোৎসাহে পড়তাম। ধরে নিচ্ছি আমার যে-সব লেখা শচীনদা ছাপতেন, সমরবাবুও সেগুলি পড়তেন। তাঁর দুই প্রধান বামপন্থী কলমচির মধ্যে অথচ চাক্ষুষ পরিচয় পর্যন্ত নেই জেনে শচীনদার কৌতুকান্বিত বিস্ময়।
তেষট্টি সালে যখন দেশে ফিরলাম, সমর সেনও মস্কো থেকে ফিরে এসে আনন্দবাজার সংস্থার ইংরেজি দৈনিক ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক হিশেবে যোগ দিয়েছেন; নিরঞ্জন মজুমদার হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড ছেড়ে ‘ক্যাপিটাল’ সাপ্তাহিকের সম্পাদক হয়েছেন, খুব সম্ভব সেই জায়গায়। ‘চতুরঙ্গ’-এর আড্ডায় আমার বহুদিনের পরিচিত অগ্রজ বান্ধব ইন্দ্রদত্ত সেন, তিনিও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত, তাঁর সঙ্গে একদিন দেখা করতে গেছি, তিনি নিয়ে গিয়ে সমরবাবুর সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ করিয়ে দিলেন। বরাবরই সমর সেন স্বল্পবাক মানুষ, প্রথম আলাপে একটি-দু’টি শিষ্টাচারযুক্ত বাক্য ছাড়া আর তেমন কিছু বিনিময়-প্রতিবিনিময় হলো না। আনন্দবাজারের প্রতিক্রিয়াদীর্ণ শ্বাসরোধকারী পরিবেশে কী করে টিকে আছেন, আমার এই কৌতূহলের জবাবে শুধু বললেন, কয়েক মাস আগে অবস্থা আরও ঢের বেশি খারাপ ছিল।
শচীনদার পরের ভাই দেবুদাও ততদিনে বিদেশী কোম্পানির চাকরি ছেড়ে স্বাধীন ব্যবসার উদ্দেশ্যে সপরিবারে কলকাতা চলে এসেছেন, তাঁর বড়ো দুই ছেলে—খোকন ও ছোট্টু— মুম্বইতে শচীনদার কাছে থেকে স্কুলের পাঠ সাঙ্গ করছে। সমাজে বিচরণ করলে আস্তে-আস্তে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। দু’দিন বাদেই আবিষ্কার করলাম, দেবুদা, সমরবাবু, নিরঞ্জন মজুমদার, সমরবাবুর দুই অগ্রজ—অমলদা ও গাবুদা—সবাই একই সান্ধ্য আড্ডার শরিক, যে-আড্ডায় এসে মাঝে-মধ্যে যোগ দেন কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রাধামোহন ভট্টাচার্য এঁরা। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ততদিনে লোকায়ত দর্শনে পুরোপুরি মজে গেছেন, তাঁকে এই আড্ডায় দেখিনি। আর এক নিত্য অতিথি বিজয় বসু নামে ছেলেবেলায় অমলদার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে দোস্তি-পাতানো এক অন্ধ্রদেশীয় ভদ্রলোক, শিকারপাগল, তাঁর একটি হাত একদা এক বাঘ খুবলে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অন্য হাতটি দিয়েই তিনি সমস্ত ক্রিয়া-কর্ম স্বচ্ছন্দে সম্পন্ন করতে পারতেন। এই সান্ধ্য বৈঠকের বাঁধা খদ্দের আরও যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ্য পশ্চিম বঙ্গ সরকারে তখন কর্মরত সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রদ্যোৎ গুহঠাকুরতা, এবং কখনও-কখনও দিল্লি থেকে এসে হঠাৎ খানিকটা সময় কাটিয়ে যাওয়া অন্য অশোক মিত্র, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সমরবাবুর সহপাঠী ছিলেন, তাঁদের পারস্পরিক সৌহার্দ পরে গাভীর্যে গিয়ে পৌঁছয়। এক রবিবার সন্ধ্যায় অমলদার বাড়িতে গোনাগুণতি করেছিলাম, একুনে সতেরোজন উপস্থিত আছেন, আমাকে বাদ দিয়ে প্রায় প্রত্যেকেই জলপথে বিহার করতে অতি অভিজ্ঞ। একজন আসতেন, দেবুদার ঢাকাস্থ বাল্যবন্ধু, সুবোধ বসু, বাঙাল ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করতেন। একবার এই বিখ্যাত আড্ডায় লন্ডন থেকে সুনীল জানা ও শোভা দত্ত এসে হাজির, নিরঞ্জন মজুমদারের মতোই এঁরা দু’জন ইংরেজিতে অনর্গল কথাবার্তা বলে আরাম পেতেন, অথচ পানের ব্যাপারে খাঁটি স্বদেশী, খালাশিটোলা-আসক্ত। তাঁদের অভ্যাস-আচরণ পর্যবেক্ষণ করে সুবোধদার প্রায়-হতভম্ব উক্তি: ‘অরা কয় ইংরাজি, আর খায় বাংলা’।
পানসাগরের বিবরণে যেহেতু ভাসছি, সমরবাবু-সংক্রান্ত অন্য তিনটি গল্পও এই সুযোগে বলে ভারমুক্ত হই। কাহিনী এক: সেন-ভ্রাতাদের রাবিবারিক আচ্ছা পালা করে অমলদা-গাবুদা-সমরবাবুর বাড়িতে হতো। কোনো এক রবিবার সন্ধ্যা, সমরবাবুর বাড়িতে আড্ডা জমেছে, পরম উৎসাহভরে সমরবাবু বোতল থেকে গেলাসে পানীয় ঢালছেন, অসতর্ক মুহূর্তে কিছুটা তরল পদার্থ মেঝেতে ছল্কে পড়লো, সুলেখা সেন মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা না করে স্বামীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘এবার উবু হয়ে বসে চাটো’। কাহিনী দুই: ‘নাউ’ পত্রিকায় কিছুদিন একটি বুদ্ধিমান ছেলে সম্পাদনার কাজে সাহায্য করেছিল। বুদ্ধিমান, তবে হৃদয়ঘটিত কোনও কাণ্ডে বেপথুমান, একটু বেশি পানাসক্ত। একদিন সমরবাবুর বাড়িতে সামান্য বেসামাল হয়ে পড়ে, ওর প্রস্থানের পর সুলেখা সেন নিন্দাব্যঞ্জক একটি মন্তব্য করেন। সমরবাবু হাসিমুখে বললেন, ‘আহা, ওঁর মনে ব্যথা জমে আছে’। ভদ্রমহিলার ঝটিতি মুখঝাম্টা, ‘ঝাঁটা মারি অমন ব্যথার মুখে’। এবার তৃতীয় কাহিনী: তখন নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে টালমাটাল, কোনও সন্ধ্যায় স্নেহাংশু আচার্যের বাড়িতে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে সমরবাবুর সরোষ তর্কাতর্কি, হঠাৎ জ্যোতিবাবু সমরবাবুর দিকে তাকিয়ে তাঁর একান্ত নিজস্ব কাটা-কাটা ভঙ্গিতে বললেন, ‘মশাই, হাতে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে রাজনীতিচর্চা হয় না। রাত্তিরে ভালো করে ঘুমিয়ে সকালে সুস্থ হয়ে আসবেন, তখন কথা বলবো আপনার সঙ্গে’। বন্ধুর বাড়িতে জ্যোতিবাবু অতিথি, তিনিও, কী ভেবে সমর সেন নিঃশব্দ হয়ে গেলেন।
মিশ্র ভিড়। প্রায় প্রতি জনেরই রুচি-পছন্দ-অপছন্দ আলাদা। একমাত্র একই পানসাগরে ঝাঁপ দিতে যুথবদ্ধ উৎসাহ। অথচ, সকলেই মধ্যশ্রেণীভুক্ত; কেউ একটু বেশি পয়সা কামাচ্ছেন, কেউ একটু কম। কিন্তু সামাজিক সংকটের হল্কা তাঁদের মনন ও চিন্তাকে প্রায় সমানভাবে ছুঁতে শুরু করেছে। প্রত্যেকেই বামপন্থার দিকে ঝুঁকতে উদ্যত। আড্ডার একটা বড়ো সময় জুড়ে কংগ্রেস দলের নিন্দাকীর্তন, কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন প্রসঙ্গ। সমরবাবুদের বেহালার বাড়িতে একদা রাধারমণ মিত্র অতিথি ছিলেন বহুদিন, রাধারমণবাবুর সূত্রে বঙ্কিম মুখুজ্যে মশাইয়ের সঙ্গেও সমরবাবুদের পারিবারিক পরিচয়, তাঁদের মারফতই হয়তো সমরবাবুর মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে আলাপ৷ কে আর এখন মনে রেখেছে, সমরবাবু তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কয়েকটি কবিতা’ মুজফ্ফর আহমদকে উৎসর্গ করেছিলেন।
আমি পানাভ্যাসের ব্যাপারে নিকষ শাকাহারী। তবে আড্ডাতে যোগ দিতে তো বাধা নেই! ক্রমশ এই আড্ডার মধ্য দিয়েই সমরবাবুকে এবং তাঁর ভাইদের ভালো করে জানলাম, তাঁরা জানলেন আমাকে। হঠাৎ কলকাতার সাহিত্যিক-সাংবাদিক মহলে হুলস্থুল, উনিশ শো চৌষট্টি সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস, পূর্ব পাকিস্তানে ফের দাঙ্গা, ওখানকার ঘটনাবলীর যথাযোগ্য জবাব দিতে আনন্দবাজার পত্রিকা কলকাতার বুকে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধাবার জন্য প্রতিদিন সব ক’টি পাতা উজাড় করে বিষ ঢালছে। কর্তৃপক্ষের না কি ইচ্ছা, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডেও অনুরূপ নীতি গ্রহণ করা হোক। কার্যত সমরবাবুই পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন, যদিও স্বত্ত্বাধিকারীদের একজনের নাম সম্পাদক হিশেবে মুদ্রিত হয়। একদিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রচুর কথা কাটাকাটি, আধঘণ্টা কাটতে না কাটতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে সমরবাবু সুতারকিন স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে ধর্মতলার মোড়ে বালিগঞ্জের ট্রামে চাপলেন, আর কোনওদিন ফিরে গেলেন না। ‘স্বাধীন সাহিত্য সংঘ’ নামে যে কবি-সাহিত্যিক- সাংবাদিকের দল কমিউনিস্ট-বিরোধী জিগির তুলছিলেন, তাঁরা একটু বিব্রত হলেন, পরিচালকপক্ষ ও সম্পাদকের পারস্পরিক বাক্স্বাধীনতার লড়াইতে তাঁদের তো কর্তাব্যক্তিদের স্বাধীনতা সমর্থন না-করে উপায় ছিল না।
কাকতালীয়, কিন্তু কাছাকাছি সময়ে অন্য একটি ঘটনা। হুমায়ুন কবির তখন কেন্দ্রে মন্ত্রী, তবে পশ্চিম বাংলায় অতুল্য ঘোষ-প্রফুল্ল সেনদের যে-গোষ্ঠী কংগ্রেস দলকে কব্জা করে ছিল, তাদের সঙ্গে তাঁর আদৌ মাখামাখি নেই। মন্ত্রী হলেই পয়সাকড়ির ব্যবস্থা করা বোধহয় অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। দিল্লি-উত্তর প্রদেশ-মুম্বই অঞ্চলের অর্থবান পরিচিতজনদের কাছ থেকে হুমায়ুন কবির অর্থসংগ্রহান্তে কলকাতায় সদর দপ্তর স্থাপন করে একটি ট্রাস্ট গঠন করলেন, ট্রাস্ট থেকে ‘নাউ’ নাম দিয়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। দৈনিক পত্রিকা ব্যয়সাপেক্ষ, আপাতত সাপ্তাহিক পত্রিকা দিয়েই অতুল্য ঘোষ-প্রফুল্ল সেনদের ঢিট করা যাবে এমন ধারা ভেবে নিয়েছিলেন হুমায়ুন কবির। জনশ্রুতি, আনন্দবাজার সংস্থার উগ্র সাম্প্রদায়িকতাহেতু সমরবাবু ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ ছেড়েছেন, আর এই সংস্থা অতুল্যবাবুদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, সুতরাং অগ্রপশ্চাৎ তেমন খতিয়ে না দেখেই হুমায়ুন কবির তাঁর প্রাক্তন ছাত্র সমরবাবুকে ‘নাউ’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করবার আমন্ত্রণ জানালেন; এ ব্যাপারে আমার বন্ধু আতোয়ার রহমানেরও যথেষ্ট হাত ছিল। সমরবাবুকে দু’মাসের বেশি কর্মহীন থাকতে হলো না। ‘চতুরঙ্গ’ দফতরেই সমরবাবুর জন্য আলাদা ঘর বরাদ্দ হলো, তাই ‘চতুরঙ্গ’-এর আড্ডা কিছুটা ঢলে পড়লো ‘নাউ’-এর আড্ডার শরীরে, এবং, স্বভাবতই, ‘নাউ’-এর আড্ডার খানিকটাও ‘চতুরঙ্গ’-এর আড্ডার অবয়বে মিশে গেল। আতোয়ার প্রথম পর্বে কার্যত ‘নাউ’-এরও প্রকাশক, আর লেখক হিশেবে জুটে গেলেন সমরবাবুর বাছাই সাংবাদিক বন্ধুরা: নিরঞ্জন মজুমদার, অমলেন্দু দাশগুপ্ত, ততটা কাছের বন্ধু না-হলেও সমরবাবুর মতামতের প্রতি অনুকম্পাশীল শঙ্কর ঘোষ, সব শেষে সাংবাদিক না হয়েও উৎপল দত্ত ও আমি। প্রায় প্রত্যেকেরই অন্যত্র পাকা কাজ, ‘নাউ’-এর জন্য আমরা স্রেফ শখের লেখাই লিখতাম, যদিও সাপ্তাহিকটির সচ্ছলতার অভাব যেহেতু ছিল না, সব লেখার জন্যই সম্মানদক্ষিণা দেওয়া হতো আমাদের। মাসিক ব্যবস্থা ছিল একমাত্র উৎপল দত্তের সঙ্গে। উৎপল সকাল ন’টার মধ্যে দফতরে পৌঁছে যেতেন, ঘণ্টা দেড়-দুয়েকের মধ্যে নিজের কাজ সম্পন্ন করে বেরিয়ে পড়তেন অন্য ভূমিকার পশ্চাদ্ধাবনে, তাঁর তো বহুমুখী প্রতিভা, বহুমুখী অন্বেষণ। উৎপল ঝড়ের বেগে লেখা তৈরি করতেন, তাঁর নানা চরিত্রের লেখার প্লাবনে ‘নাউ’-এর ভেসে যাওয়ার উপক্রম: কখনও নিজের নাম ব্যবহার করছেন, কখনও ইউ ডট ডি ডট, কখনও খোদ ইয়াগো, কখনও বা রফিকুল ইসলাম।
প্রাথমিক প্রস্তুতির পর চৌষট্টি সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ‘নাউ’-এর আত্মপ্রকাশ। পঁয়ষট্টি সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম তিন-চার মাসের সংখ্যাগুলি এখন যদি কেউ সংগ্রহ করতে পারেন, আবিষ্কার করবেন রাজনীতির প্রসঙ্গ গৌণ, চলচ্চিত্র-নাটক-সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা, চিত্র প্রদর্শনীর বিবরণ, পুস্তক সমালোচনা, সামাজিক সমস্যা জড়িয়ে প্রবন্ধ, অতুল্য ঘোষ-প্রফুল্ল সেন সম্পর্কে একটি-দুটি বক্রোক্তি, তাতেও তেমন ধার ছিল না। আসলে সেই প্রথম পর্বে ‘নাউ’-এর সম্পাদকীয় চিন্তাভাবনার উপর নিরঞ্জন মজুমদারদের মতামতের খুব বেশি প্রভাব ছিল। নিরঞ্জন কায়দা করে ইংরেজি বলতেন, ইংরেজি লিখতেন, একটু হালকা হাওয়ায় ভেসে বেড়ানোর দিকে তাঁর প্রবণতা; কে বলবে এই ভদ্রলোকই একদা ‘শীতে উপেক্ষিতা’ নামে চমৎকার বাংলা বই লিখেছিলেন শৈলশহর দার্জিলিং নিয়ে, তবে ওই বইতেও ছত্রে-ছত্রে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ চতুরালি। সমরবাবু বরাবরই বন্ধুভক্ত মানুষ, সুতরাং নিরঞ্জনের মতো অন্তরঙ্গস্থানীয়রা পত্রিকাটির যে-চরিত্র দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, ঈষৎ-একটু সামাজিক প্রজাপতি মেজাজের, তাতে তাঁর তেমন আপত্তি ছিল না। উৎপলের লেখায় হয়তো খানিকটা উগ্রতা প্রকাশ পেত, কিন্তু ওঁর রচনা তো প্রধানত নাট্যচিন্তা বা পুস্তক সমালোচনা, সে-সব নিয়ে কে মাথা ঘামায়। হুমায়ুন কবিরের বোধহয় এই আপাত-রাজনীতি- বিবর্জিত প্রথমদিকের চেহারাটি পছন্দ ছিল, সাধারণ নির্বাচনের আরও দু’বছর বাকি, ধীরে-ধীরে মেজাজের পর্দা চড়ালেই চলবে, হয়তো মনে-মনে এমন ছক কষে রেখেছিলেন।