আপিলা-চাপিলা – ২১

একুশ

ঘটনাক্রম অতি দ্রুত এগিয়ে গেল। কয়েকদিনের মধ্যে আওয়ামি লিগের সবচেয়ে স্থিতধী নেতা, তাজউদ্দিন আহমেদ, দিল্লি পৌঁছে গেলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে আপাতত লিপ্ত না হয়েও ভারতবর্ষ কোন ধরনের কী পরিমাণ সাহায্য করতে পারে, তার বিশদ ফিরিস্তি তৈরি হলো। আমার দিল্লিস্থ সুহৃদ, অতি চমৎকার ব্যক্তি, বিশ্বনাথ সরকার, তখন সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল, কিন্তু একেবারেই জঙ্গিপনা নেই, আমার লেখার ভক্ত, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করতেন, ঘন-ঘন আমার বাড়িতে তাঁর যাতায়াত, ভারত সরকার থেকে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হলো পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের সহায়তার স্বার্থে গুপ্তবাহিনী তৈরির উদ্যোগ সংগঠনের। তিনি কলকাতা চলে গেলেন, ততদিনে কাতারে-কাতারে বাঙালি সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করে মুক্তিবাহিনী গঠিত হলো, তাঁদের অস্ত্রশিক্ষা প্রদান, তাঁরা অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হলেন, তাঁদের পালা করে বিভিন্ন জেলার সীমান্ত দিয়ে পূর্ববঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, যুদ্ধ।

অচিরে আমাদের লোদি এস্টেটের বাড়ি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত অর্থনীতিবিদ ও অন্য অতিথিদের ডেরা হয়ে উঠলো, বাড়ি ঘিরে রক্ষীবাহিনীর পরিখা, অপরিচিত কেউ ঢুকলেই সঙ্গে-সঙ্গে প্রধান মন্ত্রীর দফতরে খবর পৌঁছয়, মিনিট কয়েকের মধ্যে হাসারের টেলিফোন, ‘ওই অচেনা লোকটা কে? কেন তোমার বাড়িতে ঢুকেছে?’ মুশকিল হতো রেহমান সোভানকে নিয়ে। সে চঞ্চল, সে বহির্মুখী, তার ক্লান্তিহীন উৎসাহ, পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি বিভীষিকার কথা সে পৃথিবীকে জানাতে অদম্য উৎসাহী, তাই নিষেধ না-মেনে একে-ওকে-তাকে টেলিফোন করে বসত। একদিন নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিক, সামান্য দাড়ি ছিল, নামটা ভুলে গেছি, বাড়িতে ঢুকে পড়লো রেহমানের আমন্ত্রণে। হাকসার রেগে কাঁই, তখনও কৌশলগত কারণে সব-কিছু চেপে রাখতে ভারত সরকারের আগ্রহ।

মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার কাজকর্ম মাথায় চড়লো, স্থগিত রইলো মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার বাসনা, পরের কয়েক মাস প্রায় পুরো সময়টাই পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমস্যায় নিয়োজিত। আনিস-রেহমান তো ছিলই, ক্রমে-ক্রমে পূর্ববঙ্গ থেকে আরও অনেকে এলো, যেমন ওয়াহিদুল হক, যে পরে কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছিল, যেমন, খুব কম সময়ের জন্য হলেও, আজিজুর রহমান খান, যার বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য ও স্বভাবের মাধুর্যের তুলনা হয় না। তার মতো চৌকস অর্থনীতিবিদ যে কোনও দেশেই খুঁজে পাওয়া ভার, তবে আমাকে আজ পর্যন্ত মুগ্ধ করে রেখেছে তার মুক্তোর মতো বাংলা হস্তাক্ষর, সেই সঙ্গে তার বাংলা গদ্যরচনায় সহজ স্বাচ্ছন্দ্য। ওদের মধ্যে সবচেয়ে নামী অর্থনীতিবিদ, নুরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ক্লাস নিচে পড়তো, বাংলাদেশে স্বাধীনতালাভের পর রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা পরিষদের প্রধান হয়েছিল, বেশ কয়েক দিন সে-ও লোদি এস্টেটের বাড়িতে তখন থেকে গেছে। এসেছিল হাসান ইমাম-ও, যে এখন ওয়াশিংটনে নির্লিপ্ত জীবনযাপন করছে, মস্ত প্রাসাদ বানিয়েছে মেরিল্যান্ড উপকণ্ঠে, প্রতি ঘরে বিদ্যুত্যন্ত্রের সাহায্যে প্রতিনিয়ত রবীন্দ্র সংগীতের মূৰ্ছনা। হাসান ইমামের ছদ্মনাম মনে পড়ে না, তবে ওয়াহিদুল হক পরিচিত হয়েছিল বাদল হালদার নামে, আর নুরুল ইসলামের বিকল্প নাম নির্মল সেন। একদিন নুরুল দিল্লি থেকে কাকে যেন কলকাতায় টেলিফোন করছিল, হঠাৎ, উদ্‌ভ্রান্ত, আমার দিকে তাকিয়ে কাতর প্রশ্ন: ‘আমার নামটা কী যেন, নামটা কী যেন?’

হাকসার-পৃথ্বীনাথ ধরদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, এই অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের পশ্চিম ইওরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্বজ্জন মহলে অনেক চেনাজানা আছে, দিল্লিতে গা-ঢাকা দিয়ে থাকার বিশেষ সার্থকতা নেই, কয়েক সপ্তাহ বাদে-বাদে বেনামি ভারতীয় পাসপোর্ট ও যথেষ্ট বিদেশী মুদ্রা সঙ্গে দিয়ে তাদের সবাইকে পছন্দমতো দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, মার্কিন মুলুকে কিংবা নরওয়ে, সুইডেন, ইংল্যান্ড, জর্মানি, ফ্রান্স, নয়তো কানাডা-তে, সেখানে পৌঁছে তারা পাকিস্তানের অনাচারের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সপক্ষে, প্রচার করবে, সমর্থন সংগ্রহ করবে, এখানে-ওখানে বক্তৃতা দেবে, প্রবন্ধ লিখবে। রেহমান সোভান, আনিসুর রহমান, নুরুল ইসলাম, এদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এই ব্যবস্থা হলো। ইওরোপের বিমানগুলি দিল্লি থেকে সাধারণত শেষ রাত্তিরে ছাড়ে। প্রায় নিয়ম দাড়িয়ে গেল, মধ্যনিশীথে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর কেউ আসবেন, আমার অতিথিকে টিকিট ও পয়সা-কড়ি বুঝিয়ে দেবেন, নিঃশব্দে গাড়িতে তুলবেন, ইওরোপ বা আমেরিকাগামী বিমানে তুলে দেবেন, বিমান নির্বিঘ্নে ছেড়েছে জেনে বাড়ি ফিরে ঘুমোবেন।

কাহিনীর মধ্যেও কাহিনী। একটু পিছিয়ে যেতে হয়। কাণ্ডির সেই বৈঠকে পাকিস্তান থেকে যে সাত বাঙালি উপস্থিত ছিল, তাদের একজনের সম্মেলন শেষ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে দিল্লির পাকিস্তানি দূতাবাসে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হয়ে আগমন। আমার বাড়িতে তার আনাগোনা শুরু হলো, তার সঙ্গীরূপে আরও দুই-একজন দূতাবাসে-কর্মরত বাঙালি। সবাই বাচ্চা ছেলে, অনেকেই অবিবাহিত, সুতরাং আমার স্ত্রী তাদের পরম স্নেহের সঙ্গে আপ্যায়ন করতেন, প্রায়ই খাওয়ার নেমন্তন্নও, গানের জলসা তো অফুরান! কিছুদিন বাদে, আমি তখনও কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনের সভাপতি, দফতরে এক পুলিশকর্তা দেখা করতে এলেন। আমার খানিকটা বিস্ময়বোধ, ওঁরও একটু জড়োসড়ো অবস্থা, সরকারের সচিব পর্যায়ের একজনের কাছে এসেছেন, কথা প্রায় জড়িয়ে যাচ্ছে, ভদ্রলোক বাঙালি। এটা-ওটা ভণিতার পর হাত কচলে হঠাৎ তাঁর আকুল জিজ্ঞাসা, ‘স্যার, যদি অপরাধ না নেন, একটা প্রশ্ন করতে পারি? পাকিস্তানি দূতাবাসের লোকজনেরা এত ঘন ঘন কেন আপনার বাড়িতে আসে?’ হেসে ফেললাম। হেসে-হেসেই বললাম, ‘এরা অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কেউ-কেউ আমার পরিচিতজনের পুত্র বা ভ্রাতুষ্পুত্র, রবীন্দ্রনাথের গান ভালবাসে, বাঙালি রান্না ভালবাসে। আপনাদের আপত্তির কারণ কী?’ ভদ্রলোক মুখ নিচু করে চলে গেলেন, ওই অধ্যায়ের ওখানেই ইতি।

তবে যা বলছিলাম, কাহিনীর মধ্যেও কাহিনী। পূর্ববঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, লোদি এস্টেটের বাড়ি পূর্ববঙ্গীয় অতিথিবৃন্দে বোঝাই। একদিন মধ্যরাতে ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনীর নিঃশব্দ গাড়ি আমার বাড়িতে এসে থামলো। ওয়াহিদুল হককে কানাডাগামী বিমানে তুলে দিতে পুলিশের লোক এসেছেন, টিকিট ও অন্যান্য আনুষঙ্গিকসুদ্ধু। হঠাৎ ওয়াহিদকে-বিমানে-পৌঁছুতে-আসা পুলিশ অফিসারটি দুই জুতো জুড়ে শব্দ করে আমাকে স্যালুট জানালেন, তাকিয়ে দেখি কৃষি ভবনে তদন্তে-আসা সেই অফিসারটি। মজা করে তাঁকে বললাম, ‘এবার তো বুঝতে পারছেন, পাকিস্তানি দূতাবাসের লোকজনেরা কেন আমার বাড়ি আসা-যাওয়া করতো?’

সবচেয়ে বেশিদিন ছিল মঈদুল হাসান। এক সংবাদপত্রের স্বত্ত্বাধিকারীর জামাতা হওয়ার সুবাদে সে সম্ভবত পত্রিকাটির কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিল, পরে অবশ্য তার বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যায়। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে, কথাবার্তায় আলাপ-আপ্যায়নে তুখোড়, দেশ-বিদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাজউদ্দিনের খুব কাছের মানুষ। ততদিনে বনগাঁ সীমান্তে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সংগঠিত হয়ে গেছে, রাষ্ট্রপতি পূর্ব পাকিস্তানে বন্দী শেখ মুজিব, উপ-রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমসাময়িক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। প্রায় প্রতি সপ্তাহে, দুর্গাপ্রসাদ (ডি. পি.) ধর ও হাকসারের সঙ্গে পরামর্শের উদ্দেশ্যে তাজউদ্দিনের দূত হিশেবে মঈদলের দিল্লি আগমন; থাকতো আমাদের সঙ্গে, আনিস-রেহমানের মতোই আমাদের ঘরের লোক হয়ে গিয়েছিল। চমৎকার ছেলে, বিশেষ করে মহিলাদের আকর্ষণ করবার মতো অনেক গুণ ওর ছিল। আমাদের পক্ষে একটি দুঃখজনক ঘটনা, এই ডামাডোলের সময়ে সে আমার এক বন্ধুপুত্রের স্ত্রীর সঙ্গে মায়ায় জড়িয়ে পড়ে, পরে তাকে বিয়েও করে, বন্ধুপুত্রটির জীবন তার পরই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।

উনিশশো একাত্তর সাল প্রায় পুরোটাই এভাবে কাটলো: বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ, কয়েক মাস গড়ালে ভারত বাহিনীর প্রকাশ্য সক্রিয় সমর্থন, ভারতীয় সেনাদের পূর্ববঙ্গ অভিযান, ইন্দিরা গান্ধির সমর বিজয়, তাঁর প্রখ্যাতি দিগ্‌দিগন্তে ব্যাপ্ত, মার্কিনদের নাক ঘষে দিয়েছেন তিনি, তাঁর সাহস, প্রতিজ্ঞা ও কল্পনাশক্তিকে হেলা করার আর কোনও কারণই নেই। তবে, ইতিহাসে যে-কথা লেখা থাকবে না, পাকিস্তানকে পরাভূত করার জন্য প্রধান কৃতিত্ব আসলে বর্তায় পরমেশ্বরনারায়ণ হাকসারের অগাধ বুদ্ধি ও কলাকুশলতার উপর।

ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলো, ইন্দিরা গান্ধির জয়যাত্রার রথ অপ্রতিরোধ্য। মাত্র কয়েক মাস আগে ‘গরিবি হটাও’-এর উপর ভর করে লোকসভায় পর্যাপ্ত সংখ্যাধিক্য পেয়েছেন, তারও কিছুদিন আগে বুড়ো-বুড়ো কংগ্রেসিদের কুপোকাৎ করেছেন, বামপন্থী সাহায্যেরও তাঁর আর এখন থেকে দরকার নেই। পশ্চিম বাংলা থেকে কমিউনিস্টদের নিশ্চিহ্ণ করতে এখন তিনি প্রচণ্ড আগ্রহী। হাকসারের মনোভাব ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে স্নেহাংশু আচার্য একবার দিল্লি এসেছিলেন, তখন ইন্দিরার দুই প্রধান পরামর্শদাতা দুর্গাপ্রসাদ ও পৃথ্বীনাথ ধরকে আমার বাড়িতে আহ্বান করে তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসিয়ে দিয়েছিলাম। স্নেহাংশুবাবু ধরদের যা বলেছিলেন তার সারাৎসার, ‘আপনারা শত চেষ্টা করেও মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে পশ্চিম বাংলা থেকে উৎখাত করতে পারবেন না, সুতরাং মহিলাকে নিবৃত্ত হতে বলুন।’ পরে বোঝাই তো গেল এ সব কথায় কোনও কাজ হয়নি, ইন্দিরা গান্ধি সেই ঋতুতে পুরোপুরি সিদ্ধার্থশঙ্করময়। নকশালপন্থীদের মধ্যে ঢুকে গিয়ে পুলিশ কর্তৃক গুপ্তহত্যার বহর ক্রমশই বিকট আকার ধারণ করছিল। বোধহয় পূর্ব পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল, যে করেই হোক মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের আর পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতায় ফিরতে দেওয়া হবে না; পুলিশবাহিনী, গুপ্তচরবাহিনী ও সমাজবিরোধীদের সম্মিলিত আক্রমণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছিল, যার সামান্যতম খবরও বামপন্থীদের কাছে পৌঁছুচ্ছিল না।

বাংলাদেশ যুদ্ধ সমাপ্তির মাসখানেক বাদে বাহাত্তর সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি একটি ভারতীয় অর্থনৈতিক প্রতিনিধিদলের নেতা হিশেবে ঢাকা গেলাম। গেলাম অনেক বছর বাদে, পুরনো ঢাকাকে আর চেনা যায় না, শহরের চেহারা আমূল বদলে গেছে, বিমানবন্দরে স্নেহাকুল অভ্যর্থনা, আনিস এবং রেহমান দু’জনেই উপস্থিত, ওরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পরিকল্পনা পরিষদের সদস্য মনোনীত হয়েছে, মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মান, নুরুল ইসলাম পরিষদ-প্রধান। তা ছাড়া অন্যান্য বন্ধুরা, নূরজাহান ও স্বদেশ বসু, আমার স্কুলসহচর ওয়াসেক হক, এনায়েত ও হোস্না। প্রথম সন্ধ্যাতেই আমার স্কুল শিক্ষক শামসুদ্দিন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে পুরানা পল্টনে পিতৃবন্ধু কাজী সাহেব, কাজী মোতাহার হোসেনকে শ্রদ্ধা জানাতে। গিয়ে দেখি কন্যা সন্জীদা বসে আছেন, কাজী সাহেব নেই। অসম্ভব দাবার নেশা, কোন্ দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে যিনি মার্চ মাসে করাচি গিয়েছিলেন, সেখানে আটকা পড়ে গেছেন।

দাওয়াতের ছড়াছড়ি, অভ্যর্থনার অত্যাচারে হাঁসফাঁস অবস্থা। তবু বুঝতে পারছিলাম এরই মধ্যে হাওয়া একটু-একটু ঘুরতে শুরু করেছে, তার জন্য বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিদের সন্দেহবাতিক যতটা দায়ী, আমাদের এদিককার মানুষজনের, এমনকি পশ্চিম বাংলার অধিবাসীদের একটি অতুচ্ছনীয় অংশের, আদেখলেপনাও কম দায়ী নয়। বাঙালি হিন্দু জমিদারদের অনাচারহেতু চল্লিশের দশকে পূর্ববঙ্গে মুসলিম লিগের হু হু করে প্রভাব বিস্তার, সেদিনের ক্লেদাক্ত রক্তাক্ত দিনের স্মৃতি চট করে মুছে যাওয়ার নয়, তার উপর তুলনাগতভাবে ভারতবর্ষ এত শক্তিশালী দেশ, পাকিস্তানকে পর্যন্ত পর্যুদস্ত করেছে। ভারতের সাহায্য নিয়েই যদিও তাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি, তা হলেও বাংলাদেশের জনগণের মনে ভয়, ভারতবর্ষ প্রায় জুজুবুড়ি। ওই সময়ে আমি ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-তে ছদ্মনামে একটি প্রবন্ধ ছাপিয়েছিলাম, তার সারাংশ নিম্নরূপ: বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, ভারতবর্ষের সহায়তাতেই স্বাধীন হয়েছে। তবু এই নতুন দেশ সম্পর্কে ভারতবর্ষের উচিত অনুকম্পায়ী অন্যমনস্কতাযুক্ত নীতি গ্রহণ করা। ইতিহাস তো চট করে ভোলা যায় না, বাংলাদেশীদের স্বাধীন হতে সাহায্য করেছি বলেই তারা আমাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে না; আমরা যদি এখন থেকে নিজেদের সন্তর্পণে সামান্য সরিয়ে রাখি, খুব বেশি ওদের ব্যাপারে নাক না-গলাই, তাতেই উভপাক্ষিক মঙ্গল।

কে শোনে কার কথা। ডি পি ধর সপ্তাহে-সপ্তাহে দিল্লি থেকে ঢাকা উড়ে যেতে লাগলেন, বিশ্বনাথ সরকার ভারতে ঢাকাস্থ দূতাবাসে সামরিক পরামর্শদাতা, ভারতবর্ষ থেকে প্রচুর আর্থিক, সামরিক ও অন্যান্য বৈষয়িক সাহায্য বাংলাদেশ পেতে শুরু করলো, কিন্তু সাহায্যের পরিমাণ যত বাড়লো, বাংলাদেশীদের সন্দেহের পরিমাণও সমান তালে। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় পূর্ববঙ্গ থেকে যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন, তাঁদের অনেকের মানসিকতা এমন দাড়ালো যেন জমিদারি ফিরে পেয়েছেন, এবার মাঠভরা ধান, নদীতে ছাওয়া ইলিশের সন্ধানে শনৈশনৈ গেলেই হয়। উনিশশো বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর সালের মধ্যে ভারত-বিদ্বেষ হঠাৎ যে উদগ্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, এ সবই তার প্রধান কারণ। আমাকে জনৈক বন্ধু একটি কাহিনী শুনিয়েছিলেন। ঢাকা বিমানবন্দরে তিনি একটি রিকশা ভাড়া করেছেন, রিকশা চলতে শুরু করতেই চালক এক কাহন অভিযোগ পেশ করলো। মধু-ঝরা বাঙাল ভাষায়, যার মর্মার্থ: ‘বসুন, ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন বুঝি? আপনাদের ইন্ডিয়ার কথা আর বলবার নয়, সৈন্য পাঠিয়েছেন, তারা লুটপাট করে, ঘরবাড়ি জবরদখল করে, মহিলাদের ইজ্জত নষ্ট করে। কিছু ধান-চাল পাঠিয়েছেন, তাতে পোকা কিলবিল করছে, তার উপর কাকরে-পাথরে ঠাসা। সামান্য কিছু শাড়ি-কাপড় পাঠিয়েছেন, সব ছেঁড়াফাঁড়া-গর্তে-ভরা। আর যা-ও একটা কবি পাঠিয়েছেন, সেটাও বদ্ধ পাগল’। ভীষণ ব্যথা পেয়েছিলাম, নজরুলকে ইঙ্গিত করে এমন উচ্চারণে, কিন্তু এটাও আমাদের কর্মফল।

বুঝতে পারছিলাম, দিল্লির পালা এবার সত্যিই ফুরিয়েছে। আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন এক বহু-অভিজ্ঞ বিচক্ষণ ব্যক্তিকে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু কলকাঠি নাড়া হতে দিল্লি থেকে। যুদ্ধজয়ের পরের দিনই সংসদে অটলবিহারী বাজপেয়ী ইন্দিরা গান্ধিকে ‘মা ভগবতী’রূপে সম্বোধন করেছেন, পল্লীতে-নগরে-বন্দরে অভিভূত প্রশস্তি গাথা। ওরকম বিবমিষা-উদ্রেককারী বিদূষণার পরিবেশে আমার মানসিক গঠন নিয়ে টিকে থাকা অসম্ভব।

প্রধান মন্ত্রী সম্মান ও ক্ষমতার মগডালে, সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে। লন্ডনের ‘ইকনমিস্ট’ পত্রিকায় খেতাব দেওয়া হলো, ভারতসম্রাজ্ঞী। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা রাতারাতি চুনোপুঁটি বনে গেলেন। একটি ঘটনার উল্লেখ করি। কয়েকজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কয়েকজন বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং একজন-দু’জন উঁচুমহলের আমলা নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল, ভূমিসংস্কারের পরবর্তী কর্মসূচী নিয়ে দিগনির্দেশের জন্য। সেটা বোধহয় বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিক। কৃষি ভবনের কমিটি কক্ষে বৈঠক বসলো। বৈঠক কয়েক মিনিট এগোতে না এগোতেই জনৈক মুখ্যমন্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন: ‘ডক্টর সাব, এত আলোচনার কী দরকার? ম্যাডাম যা চাইছেন, তাই-ই আপনি লিখে দিন না কেন?’ অন্ধ দেবীপূজার অন্য একটি উদাহরণ: রাজ্যসভা না লোকসভায় জনৈক সংসদ সদস্য প্রশ্ন করেছেন, ‘এটা কি সত্য যে, গত বছরের তুলনায় এ বছর শিল্পসংঘাত অনেক কম ও অনেক কম শ্রমদিবস নষ্ট হয়েছে? এরকম হয়ে থাকলে তার কারণ কী?’ মন্ত্রীর সহর্ষ উত্তর: ‘হ্যাঁ, মহোদয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর শিল্পসংঘাত যথেষ্ট হ্রাসপ্রাপ্ত; এই আশ্চর্য জাদু ঘটেছে মহিমাময়ী প্রধান মন্ত্রীর অনির্বচনীয় নেতৃত্বের শুভ পরিণামে।’

শুধু অভাবে স্বভাব নষ্ট হয় না, ক্ষমতাধিক্যেও হয়। দিল্লি ঘিরে তোশামোদের হাওয়া, গা ঘিনঘিন করে। খানিক বাদে নিছক গল্প নয়, অনেক যথার্থ কাহিনীও শোনা যেতে লাগলো, ইন্দিরা গান্ধি এবং তাঁর রাজনৈতিক পার্শ্বসহচররা এবার দু’-হাতে টাকা তুলছেন, একে-ওকে তাকে চোখ রাঙিয়ে; ভক্তিতে না হলেও ভয়ে-ভয়ে অনেকে স্বেচ্ছায় উপুড় করে টাকা দিচ্ছেন। আর্থিক নীতি-রীতিতে সহসা পরিবর্তনের সূচনা। বড়ো শিল্পপতি, বড়ো ব্যবসায়ী, বড়ো জমিদার-জোতদাররের কাছ থেকে টাকা তুলছেন প্রধান মন্ত্রী, সুতরাং গরিবদের বিপক্ষে, বড়োলোকদের স্বার্থে, নীতি প্রয়োগ না-করে গত্যন্তর নেই।

পশ্চিম বাংলায় আরেক দফা নির্বাচন, পুলিশ দিয়ে, গুপ্তচর বাহিনী নিয়ে, গুণ্ডা লাগিয়ে নির্বাচন। এমনকি জ্যোতি বসুকেও জিততে দেওয়া হলো না। বুথ দখলের, জাল ভোট দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভোটদাতাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার বহু কাহিনী মুখে-মুখে রটিত। এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া, সোদপুরের বাসিন্দা, বিলাপ করে জানালেন কীভাবে ছুরি দেখিয়ে তাঁকে ভোটকেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মনঃস্থির করে ফেললাম, বোধহয় গুড ফ্রাইডের ছুটি ছিল সেদিন, হাসারের কাছে গিয়ে দিল্লি ত্যাগের সিদ্ধান্ত জানালাম। পরদিন পদত্যাগপত্র দাখিল করে মালপত্ৰসুদ্ধু কলকাতায় প্রত্যাবর্তন: আপাতত লম্বা ছুটিতে, মাসখানেক বাদে একদিনের জন্য ফিরে গিয়ে পুরোপুরি। হাকসার নিজে কিছু বললেন না, নিকটস্থ-দূরস্থ অনেক পরিচিত ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা আমি এক কথায় মস্ত বড়ো কাজ ছেড়ে দিচ্ছি জেনে বাক্‌রহিত, অনেকে প্রচুর উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে যথারীতি বিফল হলেন। একমাত্র অশোক রুদ্রের আনন্দ ধরে না; সে আমার সিদ্ধান্ত পূর্ণ সমর্থন করে, যেন আমাকে শিরোপা দিতেই, দুপুরবেলা আমাদের সঙ্গে খেতে এলো।

অন্য পক্ষে, কলকাতায় ফিরে হরেকৃষ্ণ কোঙারের সঙ্গে যখন দেখা করতে গেলাম, এক প্রস্থ বকুনি খেলাম, ‘মশাই, আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে আপনি হুট করে কাজটা ছেড়ে এলেন! দিব্যি ছিলেন ওখানে, আপনার মারফৎ ভিতরের খবর পাচ্ছিলাম, আপনি কেঁচে গণ্ডূষ করে দিলেন।’ ভৎসনা মুখ বুঁজে মেনে নিতে হলো আমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *