বারো
শচীনদার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভ্রাতার জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে শচীনদার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলি অনেকটাই জড়িয়ে আছে। দেবনারায়ণ, আমাদের কাছে দেবুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় অত্যন্ত ভালো ফল করেছিলেন, এম. এসসি-তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, কিন্তু অধ্যাপনা বা গবেষণায় আর নিজেকে নিবিষ্ট করেননি। বিদেশী সংস্থায় উঁচু মাইনের কাজে মুম্বই চলে যান। হিতেন্দ্রনারায়ণ, হিতুবাবু, পড়াশুনোয় কোনওদিনই আগ্রহবান ছিলেন না। অনিন্দ্যকান্তি, স্বপ্নালু চোখ, একটু বেঁটে, কিন্তু তাতে কী, পৃথিবীর যেখানেই গেছেন, নারীহৃদয় চিরকাল তাঁর দখলীকৃত। ঢাকাতে নাটক করে-সিনেমা দেখে বেড়াতেন, লীলা রায়ের শ্রীসঙ্ঘের সঙ্গেও যোগ ছিল হয়তো বা, কিন্তু আই. এ. পরীক্ষায় বসতে নারাজ, দাদার পথ ধরে তিনিও একদিন ঝটিতি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। ঘুরতে-ঘুরতে মুম্বই, দেবুদার আগেই। মুম্বইতে ওখানকার চাঁই-চাঁই রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ, গণ্যমান্য আরও অনেকেরই সঙ্গে, সরোজিনী নাইডু মুম্বই এলেই হিতুবাবুকে ডেকে পাঠাতেন, কোথায় প্রথম আলাপ হয়েছিল আমার জানা নেই। হিতুবাবু গণ্যমান্য ব্যবসাদারদের পরামর্শদাতা, স্বদেশীর জন্য তাঁদের কাছ থেকে টাকা তুলছেন, ক্ৰমে চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা। কোনও এক সময়ে হিমাংশু রায়ের সঙ্গে সখ্য, যার সুবাদে, একটু আগে যা বলেছি, কয়েক বছর বাদে শচীনদার বম্বে টকিজের বড়ো কর্তা বনে যাওয়া। পৃথ্বীরাজ কাপুর, পৃথ্বীরাজের ছেলেরা, দিলীপকুমার, সবাইই হিতুবাবুর ভক্ত, আর সাধনা বসুর অভিনয়জীবন যখন ঘোর সংকটের মুখোমুখি, হিতুবাবু মাঝে-মাঝে গিয়ে তাঁকে অভয় দিতেন, প্রবোধ দিতেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক সঙ্গে কাটাতেন। মুম্বই শহরে পঞ্চাশের দশকে হিতুবাবুর সঙ্গে কামিনী কৌশলের নাম জড়িয়ে বেশকিছু মুখরোচক গল্প চালু হয়েছিল। অনেক রাজস্থানী-গুজরাটি শিল্পপতি-পুঁজিপতির সঙ্গে মাখামাখির সূত্রে হিতুবাবু ব্যবসাপত্তরে ঢুকে গিয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় টাকার মুখ দেখলেন। সেই টাকার বড়ো অংশ চলচ্চিত্রে খাটালেন, প্রচুর লাভ করলেন, প্রচুর ক্ষতিও। ওঁর মতো সহৃদয় উদার মানুষ পৃথিবীতে যে-কোনও যুগে বিরল, সারাজীবন অঢেল পয়সা উপার্জন করেছেন, বিন্দুতম হিশেব নাকরে অঢেল খরচ করেছেন, সম্ভবত সেজন্যই শেষ জীবনে কিছুটা আর্থিক অসুবিধার মধ্যে পড়েছিলেন।
দুই কনিষ্ঠ ভ্রাতা মুম্বইতে জমিয়ে বসেছেন, একজন চাকরিতে, অন্যজন ব্যবসায়ে, শচীনদা দুই ভাইয়ের গৃহে পালা করে থাকতেন, বেশির ভাগ সময়ই দেবুদার ওখানে, কারণ অবিবাহিত হিতুবাবুর কিছুটা অগোছালো জীবনযাপন।
নিজের প্রতিভার প্রাখর্যে শচীনদা সর্বত্র সম্মানিত, সংবর্ধিত, কেতাবি কৃতিত্ব না থাকলেও অর্থশাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য উচ্চপ্রশংসিত, লেখার মুনশিয়ানা জনে-জনে তারিফ কুড়িয়েছে। তা হলেও, উদ্দেশ্যহীন, এক বৃত্তি থেকে তাঁর অন্য বৃত্তিতে বিচরণ, অনিশ্চিত উপার্জন। এমন লগ্নে জীবনের ধারা একটি প্রায়-অবিশ্বাস্য বাঁক নিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক মাস পরে হিতুবাবু একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মার্কিন দেশে ঘুরতে গেলেন, ভারতীয় রফতানির সম্ভাবনা সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখবার উদ্দেশ্যে। পূর্বোল্লিখিত সেই প্রবীণ তামিল অর্থনীতিবিদ, যিনি ব্যাংককে আমার কর্তা ছিলেন, দিল্লিতেও আমার ঘাড়ে চেপেছিলেন, তিনিও দলভুক্ত। প্রায় দু’-তিন মাস তাঁরা এক সঙ্গে মার্কিন দেশ চষে বেড়িয়েছেন, ওই অর্থনীতিবিদকে হিতুবাবু কাছ থেকে খুব ভালো করে দেখেছেন, ওঁর কথাবার্তা ও আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন, দেশে ফিরেই শচীনদাকে উদ্বস্ত করে তুললেন, ‘দাদা, এই গোছের ওঁছা অর্থনীতিবিদরা দেশে কল্কে পাচ্ছেন, বিদেশেও পাচ্ছেন, এই অবস্থা সহ্য করা যায় না। আপনি একটা অর্থনীতিবিষয়ক কাগজ বের করুন, আমি ব্যবসায়ীদের ধরে-পড়ে টাকার ব্যবস্থা করে দেবো, আপনার সম্পাদিত পত্রিকা দু’দিনেই গোটা দেশে স্বীকৃতি পাবে’। বলা উচিত তাঁর পরের তিন ভাই, এবং বোনেরাও, শচীনদাকে বরাবর ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, পুরনো জমিদারি প্রথা আনুযায়ী ।
হিতুবাবু লেগে থাকলেন, দেবুদাও সমান উৎসাহ দিলেন, কাশী থেকে বন্ধু অমিয় দাশগুপ্তও লিখে অভিমত ব্যক্ত করলেন, এর চেয়ে ভালো কিছু শুধু শচীন চৌধুরীর ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেই নয়, দেশের অর্থশাস্ত্রের পক্ষেও হতে পারে না। টাকার ব্যবস্থা হলো, দফতরের ব্যবস্থা হলো, সাংবাদিক মহলে শচীনদার অনেক চেনাজানা, মানুষ, তাঁদের কেউ-কেউ বিনা পারিশ্রমিকে কিংবা নামমাত্র দক্ষিণায় লিখতে সম্মত হলেন, তা ছাড়া, যেটা শচীনদার এবং ইকনমিক উইকলির মস্ত সৌভাগ্য, পত্রিকার একেবারে গোড়া থেকেই মুম্বইয়ের অসংখ্য তরুণ অর্থনীতিবিদ, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত, কিংবা অতি সদ্য অধ্যাপনায় ব্রতী হয়েছেন, অথবা রিজার্ভ ব্যাংকে গবেষকের কাজ নিয়ে ঢুকেছেন, একেবারে গোড়া থেকেই ইকনমিক উইকলি-র আত্মীয় হয়ে গেলেন। শচীনদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁরা সম্পাদকীয় লিখতেন, কাঁচা হাতের খসড়া লেখা মেরামতি করতেন, প্রুফ দেখতেন, বিজ্ঞাপন সংগ্রহের ব্যাপারেও তাঁদের অখণ্ড নিমগ্নতা। দেবুদা-হিতুবাবু দু’জনেরই ব্যবসায়ী ও সরকারি-বেসরকারি মহলের সঙ্গে যোগাযোগ, সুতরাং কিছু-কিছু বিজ্ঞাপন প্রায় প্রথম থেকেই আসছিল। তবু সাপ্তাহিক পত্রিকা, যার শুভ বা অশুভ আরম্ভ ১৯৪৯ সালের প্রথম দিবসে, বরাবরই দীন-দরিদ্র কুটিরশিল্প থেকে গেছে। দিন আনি-দিন খাই পরিবেশ, বেশির ভাগ লেখককেই টাকা দেওয়ার প্রশ্ন নেই, আর যাঁরা বাঁধা মাইনেতে কাজ করতেন তাঁরা পেতেন অতি সামান্য, তা-ও মাঝে-মাঝে বাকি পড়তো। এঁদের মধ্যে অনেকে পাকা চাকরি করতেন অন্যত্র, সপ্তাহে দু’-তিন দিন ইকনমিক উইকলি-র দফতরে এসে প্রয়োজনীয় কাজ করে তরিয়ে দিতেন। এক দিনের কথা বিশেষ করে মনে পড়ছে, কোন সাল ঠিক মনে নেই, হঠাৎ মুম্বই গেছি, ইকনমিক উইকলি-র দফতরে হাজির হয়েছি, শচীনদা কোনও কথাবার্তা না বলে আমার পকেট হাড়াতে শুরু করলেন, একটি সুন্দরপানা মার্কিন মহিলাকে লাঞ্চ খাওয়াতে নিয়ে যাবেন বলে তিনি প্রতিশ্রুত, অথচ তাঁর কোনও রেস্ত নেই, ইকনমিক উইকলি-র খাজাঞ্চিখানা পর্যন্ত ঠনঠন।
আগেই বলেছি, ঢাকায় আমাদের বাড়ির লাগোয়া গলিতে শচীনদারা একদা থাকতেন, এর পরে কিছুদিন আর্মেনিটোলা-সংলগ্ন জিন্দাবাহার অঞ্চলে চৌধুরী পরিবার বসবাস করেছেন, কিন্তু আমি তখন নিতান্তই বালক। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ অর্থমন্ত্রকে যোগ দেওয়ার খানিক বাদে, মহলানবিশ মশাইয়ের খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে মশগুল আলোচনার মধ্যমুহূর্তে। অবশ্য শচীনদার কথা জানতাম অনেক আগে থেকেই, তিনিও আমার কথা শুনেছেন অমিয় দাশগুপ্ত ও অন্যদের কাছে। তারপর সেই চুয়ান্ন সাল থেকে শুরু করে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের অজস্র দেখাশোনা, অফুরন্ত তর্ক, ইকনমিক উইকলি নিয়ে এলোমলো অফুরন্ত স্বপ্ন বোনা, সেই সব স্বপ্নের, হয়তো যথা নিয়মে, ঝরে যাওয়া। তাঁর মুম্বইয়ের আস্তানা, তাজমহল হোটেলের ঠিক পিছনে মেরেওয়েদার রোডে অবস্থিত চার্চিল চেম্বারস, যে কারও সেখানে অবারিত আনাগোনা। দেশের অন্যত্র থেকে, কিংবা বিদেশ থেকে, কেউ হাজির হলেই, তিনি সমাজবিজ্ঞানীই হোন, বা অন্য কোনও জ্ঞানবৃত্তের অন্তর্ভুক্ত, এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধতার মতো ছিল, বিনা নোটিসে চার্চিল চেম্বারসে প্রবেশ করার তাঁর অধিকার আছে, যত খুশি ততদিন অতিথি থাকবেন, একমাত্র দক্ষিণা যা দেয়, তা শচীনদার সঙ্গে অহোরাত্র আলাপ, তর্ক, ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে, তারিখের দিকে না তাকিয়ে। চার্চিল চেম্বারসের সেই ফ্ল্যাট তেমন-কিছু প্রশস্ত ছিল না, তার উপর দেবুদার দুই পুত্র, খোকন, অরূপ, ও ছোট্ট, স্বরূপ, ওখানে থেকে ইস্কুলে পড়তো। তবে শচীনদার চিরন্তন দর্শন, যদি হয় সুজন, তেঁতুলপাতায় ন’জন: পরিচিত, অর্ধ-পরিচিত, প্রায়-সম্পূর্ণ-অপরিচিত অতিথির নিত্য সমারোহ, তাঁরা রাত্রিবেলা ওই অপরিসর ফ্ল্যাটে কেথায় শোবেন, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও, শচীনদার সব-সময়ের কাজের-লোক পরেশ রান্না করছে, খাবার দিচ্ছে, চা যোগাচ্ছে, উষ্ণতর পানীয়ের ব্যবস্থা করছে এক হাতে।
পরেশ মেদিনীপুর-সন্তান, তারও প্রতিভা বহুব্যাপ্ত। রোমান্টিক চরিত্রলক্ষণ: জনশ্রুতি, গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া অঞ্চলে পরিচারিকা মহলে তার অনুরাগিণীরা,তার একক দখলদারির জন্য, পরস্পরে সহিংস কলহে সদালিপ্ত। ষাটের দশকের গোড়ায় বিদ্যাধর নাইপাল একবার চার্চিল চেম্বার্সে গ্যাঁট হয়ে বসে কিছুদিন কাটিয়ে ছিলেন, পরেশের পরিচর্যায় মুগ্ধ হয়ে ফিরে গিয়ে ওকে নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলেন, যা তাকে বিখ্যাত করে দেয়। শেষ খবর যা শুনেছি, পরেশ এখন লস এঞ্জেল্স্ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁর মালিক, তার বহুবল্লভপ্রসিদ্ধিও নাকি অটুট।
চার্চিল চেম্বারসের ভাড়াটেদের সঙ্গে মালিকদের অনেকদিন ধরেই মন কষাকষি, কেউই ভাড়া বাড়াতে চান না, সুতরাং মালিকপক্ষেরও ফ্ল্যাটগুলির প্রয়োজনীয় সংস্কারে বা সৌকর্যসাধনে কোনও গা নেই, লিফটটিও, প্রথম থেকেই যা নড়বড়ে ছিল, ক্রমে একটা সময়ে একেবারে অচল হয়ে যায়। (দেবিকারানী স্বয়ং কোথায় যেন লিপিবদ্ধ করেছেন, চার্চিল চেম্বারসের সেই লিফটে তিনি একবার শচীনদার সঙ্গে নামা বা ওঠার অর্ধপথে আটকা পড়েছিলেন। শচীনদা ওই অসাধারণ সুন্দরী মহিলাকে সে সময় কী মনোমোহিনী বাক্যাবলী শুনিয়েছিলেন, কিংবা মহিলা নিজেই অস্ফুট উচ্চারণে শচীনদাকে কোন অনুরাগবাক্যে মোহিত করেছিলেন, তা অবশ্য দেবিকারানী খুলে জানাননি।)
চার্চিল চেম্বারসের ফ্ল্যাটে একটি ছোট্ট চানের ঘর, তার তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে মস্ত টব। মুম্বইতে বরাবরই প্রচণ্ড জলাভাব, ওই চারতলার ফ্ল্যাটে একেবারেই জল উঠতো না, চানের ঘরের তাই অবর্ণনীয় অবস্থা। আমি অবশ্য তাজমহল হোটেলের কিছু বেয়ারার সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম, যে ক’দিন মুম্বইতে থাকা হতো, ভোরবেলা হোটেলে গিয়ে নিত্যকৃত্যাদি সম্পন্ন করে আসতাম, অন্যরা কী ব্যবস্থা করতেন জানি না। তা হলেও শচীনদার ফ্ল্যাট সর্বক্ষণই ভিড়াক্রান্ত। ঢুকেই যে-স্বল্পায়তন বসবার ঘর, তাতে সদ্যপরিচিতরা এসে জড়ো হচ্ছেন, অথবা রামমনোহর লোহিয়া কিংবা ইউসুফ মেহেরালি, নয়তো শান্তি সাদিক আলি, নয়তো অচ্যুত পট্টবর্ধন, নয়তো অরুণা আসফ আলি। কিংবা ওই ভিড়েই জড়সড় হয়ে এক কোণে মুখ নিচু করে বসে কোনও দেহাতি-কলেজ-থেকে-আসা অর্থশাস্ত্রবিদ-যশোপ্রার্থ , সে হয়তো শচীনদাকে একটি মস্ত লেখা পাঠিয়েছে ইকনমিক উইকলি-তে ছাপা হবে এই আশা নিয়ে, শচীনদা হয়তো তার একটি অনুচ্ছেদে কিয়ৎ পরিমাণ প্রতিভার সন্ধান পেলেন, তাকে উৎসাহ দিয়ে দু’টো কথা লিখলেন, যদিও প্রবন্ধটি ছাপালেন না, কিন্তু তাতেই ছেলেটির-দেখা পৃথিবীর রং পাল্টে গেল, কোনও উপলক্ষ্যে মুম্বাই পৌঁছে সে ঠিকানার হদিশ করে সোজা চার্চিল চেম্বারসে হাজির।
পরের অপেক্ষাকৃত বড়ো ঘরটায়, যা শচীনদার শয়নকক্ষও, আমার মতো তিন-চার জন ছেলেছোকরা বসে হয়তো পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখছি, কিংবা কোনও কপি সংশোধন করছি, কারখানার মতো কাজ চলছে, মাঝে-মধ্যে উঠে এসে বাইরের খুপরি ঘরটাতে আড্ডায় যোগ দিচ্ছি, পরেশ-পরিবেশিত চায়ের আস্বাদ নিচ্ছি। পাশে আরও একটি ঘর, কিন্তু তার কোনও জানালা নেই, সারাদিন নিকষ অন্ধকার। মুম্বইতে কাজ নিয়ে এসে খোকনদের বড়োমামা কিছুদিন ওই ঘরে ছিলেন, তবে আমাদের দাপটের সামনে তিনি ভয়ে কেঁচো, চোরের মতো ঢুকতেন, চোরের মতো বেরিয়ে যেতেন। ওই ঘরে শচীনদা একবার দু’জন বিলিতি সমাজবিজ্ঞানীকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, যাঁদের বিশেষ কোনও ব্যক্তিগত কলহ হেতু পারস্পরিক কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অথচ, উপায় নেই, শচীনদার নিদান, ওই ঘরেই তাঁদের দিনের পর দিন এক সঙ্গে থাকতে হবে, রাতের পর রাত, এবং উভয়কেই ইকনমিক উইকলি-র জন্য বিজ্ঞ প্রবন্ধ রচনা করতে হবে।
শচীনদা জওহরলাল নেহরুর উৎসাহী ভক্ত, সেই সঙ্গে গান্ধিজীরও, তাঁদের যুগে যা অস্বাভাবিক ছিল না। তাঁর লেখালেখিতে গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র নিয়ে অনেক উচ্ছাস, যে-উচ্ছাসের উৎসে গভীর বিশ্বাস, অথচ আমাদের মত উচ্চিংড়েদের প্রতীপ মতামত সম্পর্কে অফুরান সহনশীলতা তাঁর। স্বভাব মাধুর্যে ঠাসা, স্নেহপ্রবণ, অতিথিপরায়ণ, ঘর-বাহির তাঁর পক্ষে সদাসর্বদা একাকার। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও বলতে হয়, তাঁর রক্তে-ধমনীতে ভারেঙ্গা গ্রামের জমিদারি আভিজাত্য, চলনে, বলনে, খদ্দরের ভূষণে। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে প্রথম যেবার মুম্বই গেলাম, চার্চিল চেম্বারসে প্রায় উৎসবের পরিবেশ, নববধূবরণ। শচীনদা টেলিফোনে এঁকে-ওঁকে-তাঁকে খবর দিচ্ছেন, এঁকে-ওঁকে-তাঁকে জড়ো করছেন, এখানে-ওখানে খেতে নিয়ে যাচ্ছেন, নববধূর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এঁকে-ওঁকে-তাঁকে নেমন্তন্ন করে আনছেন, জমিদারবাড়ির কর্তামশাই যেমনধারা করে থাকেন। নববধুকে মুম্বই শহর ঘুরিয়ে দেখাতে হবে, কাকে যেন টেলিফোন করলেন, একটু বাদে এক মস্ত মার্কিন গাড়ি, ক্যাডিলাক বা অন্য-কিছু, দুয়ারে উপস্থিত, সঙ্গে চালক, তাঁর নাম গোবিন্দ। শচীনদার সামনে গোবিন্দ এত সন্ত্রস্ত, এত শশব্যস্ত, আমি ধরে নিলাম গাড়িটি শচীনদার কোনও পরিচিতজনের, এবং গোবিন্দটি তাঁর মাইনে-করা ভৃত্য। আমাদের দু’জনকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে শচীনদা নিখুঁত জমিদারি ঢঙে গোবিন্দকে বকতে শুরু করে দিলেন, এলিফ্যান্টা গার্ডেনসে প্রথম নিয়ে গেলে না কেন, এই বাজে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছো কেন, বান্দ্রা পৌঁছুতে দু’ঘণ্টা লাগিয়ে দিলে, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না, ইত্যাদি। কয়েকদিন পরে আবিষ্কার করলাম গাড়িটি স্বয়ং গোবিন্দেরই, যে গোবিন্দ শচীনদাদের আত্মীয়, যাঁর ভালো নাম অভি ভট্টাচার্য, বিখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্পী। (নিয়তির অমোঘ লিখন, চিত্রতারকাদের বিষয়ে আমার ও আমার স্ত্রীর অজ্ঞতার জবাব পরের প্রজন্ম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দিয়েছে। কয়েক মাস বাদে কলকাতায়, একদিন কবিতাভবনে গেছি, রুমি-সম্প্রদায় উত্তেজিত-উল্লসিত-উচ্ছ্বসিত। কী ব্যাপার? কোনও সিনেমা পত্রিকায় অভি ভট্টাচার্যের আস্ত ছবি বেরিয়েছে, প্রচ্ছদচিত্র, তিনি কুর্সিতে হেলান দিয়ে কবিতাভবন-প্রকাশিত গ্রীষ্মবার্ষিকী ‘বৈশাখী’-র পাতা ওল্টাচ্ছেন। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য কবিতাভবন-ললনাদের আর কী হতে পারে, ওই নায়ক যেন কবিতাভবনকে ধন্য করে দিয়েছেন। বুদ্ধদেব আস্তে বললেন, ‘হয়তো হিতুর কাছ থেকে কপি পেয়েছে’। বাবা বুদ্ধদেব বসু কী বললেন তা ফ্যালনা, জয়তু অভি ভট্টাচার্য।)।
অবশ্য শচীনদা শুধু বিখ্যাত গোবিন্দকে কেন, কাউকে ছেড়ে কথা কইবার মানুষ নন, এমন কি নববধূদেরও না। আমার স্ত্রীর রুটি খাওয়ার ধরনটা একটু অদ্ভুত, টেবিলে টোস্ট পৌঁছুলে শক্ত চারদিক তিনি নির্মম ছেঁটে ফেলে মধ্যিখানের জায়গাটুকু মাখন মেখে খান। শচীনদা একদিন নজর করলেন, দু’দিন নজর করলেন, তৃতীয় দিন আর ছাড়ান নেই। তাঁর নাকি গলায় নববধূর দিকে মন্তব্য ছুঁড়লেন: ‘তোমার রুটি খাওয়া তো বড়ো রাজসিক’। কেউ-কেউ অনুদ্ধারণীয়, উক্ত ভদ্রমহিলার সেই রাজসিক অভ্যাস এখনও অব্যাহত।
একটু পিছিয়ে যাই, শচীনদার সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হলো, তাঁর ও ইকনমিক উইকলি-র প্রতিষ্ঠা তখন তুঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই পত্রিকাটি পড়েন, তাঁরা পড়েন বলে প্রধান-প্রধান আমলারাও পত্রিকাটি পৃষ্ঠপোষকতা করতে বাধ্য বোধ করেন, একটু-একটু করে বিজ্ঞাপনের কুঁড়ি ফুটছে, সরকারি-বেসরকারি অর্থনীতিবিদরা সবাই নিয়মিত লিখছেন, সরকারকে গাল পাড়বার ইচ্ছা অনুভব করলে সরকারি অর্থনীতিবিদরা কোনও ছদ্মনামের আড়ালে লিখছেন, সেই সঙ্গে লিখছেন সমাজবিজ্ঞানীরা, রাষ্ট্রনীতিবিদরা, ঐতিহাসিকরা, এমন কি আইনবিদরা পর্যন্ত: শচীনদা নিজে উদারচরিত, পত্রিকাটিও তাই। উজ্জ্বল রচনা হলেই হলো, মতামত নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই, ইকনমিক উইকলি-তে তা জায়গা পাবেই। একদা ড্যানিয়েল থরনার-এর উৎসাহ ও তত্ত্বাবধানে নিয়মিত এন্তার কার্টুন ছাপা হলো, সমররঞ্জন সেন ও আমি রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদদের চিমটি কেটে ছড়াও ছাপিয়েছি বেশ কয়েকবার।
সব মিলিয়ে সে এক আশ্চর্য সময়, প্রশান্ত মহলানবিশ ও তাঁর সহচর পীতাম্বর পন্থ মিলে দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সাহসিকতা দিয়ে সরকারি দালানকোঠা কাঁপিয়ে তুলছেন, শচীনদা ইকনমিক উইকলি-র মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে অনুরূপ নাড়া দিচ্ছেন। দীর্ঘ সুঠাম শরীর, চশমার আড়ালে টেরচা চোখের দৃষ্টি, আপাদমস্তক খদ্দরের আচ্ছাদন, নতুন দিল্লির যে-কোনও মহলে তিনি ঢুকলেই চাপরাশি ও করণিককুল সসম্ভ্রমে তড়াক করে উঠে দণ্ডায়মান, মস্ত কোনও নেতাজী নিশ্চয়ই এসেছেন, শচীনদা কোনওদিন তাঁদের ভুল ভাঙাবার চেষ্টা করেননি, আমরাও করিনি।
ওই সময়ে মহলানবিশ মহাশয়ের প্রাণপ্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে কলকাতায়, এবং সদ্য-খোলা দিল্লি শাখায়, উৎসাহে-টগবগ এক গাদা নবীন অর্থনীতিবিদ ও সংখ্যাতাত্ত্বিক যোগ দিয়েছেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকেও আমরা অনেকে আছি। দৃষ্টিবিভ্রম, কিংবা অন্য যে-বর্ণনাতেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, আমরা সত্যি-সত্যি আস্থাশীল ছিলাম, ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও ছিলাম, এখন থেকে দেশের অর্থব্যবস্থা অন্যদিকে মোড় নেবে, নেবেই, এতজনের তদগত সাধনা ব্যর্থ হতে পারে না। আমলাকুল নিশ্চয়ই অদৃশ্যে হেসেছিলেন।
যাদের-যাদের সঙ্গে তখন নতুন আলাপ হয়েছিল, তাদের মধ্যে অবশ্যই একজন অশোক রুদ্র। মনে পড়ে অজিত দাশগুপ্ত তাঁকে একদিন কনৌট প্লেসের ইউনাইটেড কফি হাউসে হাজির করেছিল। তারপর প্রায় চল্লিশ বছর তার কথার খইতে আমাদের মনঃসংযোগ না-করে উপায় ছিল না। অশোক রুদ্রের ধরনটি ছিল স্বভাব-তার্কিকের। প্রথম ধাক্কাতে মনে হওয়া অবধারিত যে লোকটা ঝগড়া করার জন্য মুখিয়ে আছে। কথা বলতো অতি দ্রুত তোড়ে, এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে ঝট করে তার প্রস্থান, পৃথিবীতে এমন-কোনও বিষয় ছিল না যা নিয়ে অশোকের আগ্রহ ঈষৎ স্তিমিত। সে সংখ্যাতত্ত্বের ছাত্র, প্রথাগত অর্থনীতির পাঠ কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়নি, কিন্তু তাতে কী, সব ব্যাপারেই তাঁর মতামত চূড়ান্ত বলে মানতে হবে, এবংবিধ তাঁর প্রাথমিক মানসিকতা, না মানলে সে প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে, তারপর কথার মধ্যবর্তিতায় মারামারি-কাটাকাটি; কত লোকের সঙ্গে অশোক ঝগড়া করেছে, মৌখিক গাল পেড়ে, লিখিতভাবে, তার ইয়ত্তা নেই। সংখ্যাতত্ত্ব থেকে অর্থবিজ্ঞান, অর্থবিজ্ঞান থেকে ইতিহাস, ইতিহাস থেকে গণিত, গণিত থেকে সমাজতত্ত্ব, সমকালীন রাজনীতি, সমর সেনের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের গান, চলচ্চিত্র থেকে রন্ধনশিল্প, অশোক রুদ্রের বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমণের পরিধি। সে বিভিন্ন গোষ্ঠীর নকশালপন্থীদের সঙ্গে আছে, নারীবাদীদের সঙ্গেও আছে, আশির দশকে একবার ইকনমিক উইকলি-র পাতায় সিমন দ্য বোভোয়া সম্পর্কে একটু ঠেসে দিয়ে কী যেন লিখেছিলাম বলে অশোক দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সম্পাদকের কাছে কুপিত চিঠি পাঠিয়েছিল, আমাকে চরম ভাষায় গালিগালাজ করে, সম্পাদকের ঘাড়ে ক’টা মাথা চিঠিখানা ছাপাতে অস্বীকার করবেন। অথচ অশোকের মতো নরম হৃদয়ের মানুষ সত্যিই বিরল। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রচণ্ড ভালোবাসতো, যাদের সঙ্গে ঝগড়া-তর্ক করতো, তাদের সম্বন্ধেও তার অন্তরের কন্দরে গভীর মমতাবোধ। একটি প্রশ্ন তবু থেকেই যায়। সে যখন ফরাশি দেশে পড়তে যায়, পঞ্চাশের দশকের গোড়ায়, অস্তিত্ববাদীদের তখন যশের পরাকাষ্ঠা। আমার নিজের ধারণা, অশোকের চরিত্রে তার রেশ বরাবর লেগে ছিল। যে তাকে নিবিড় ভালোবাসে, যে তাকে স্নেহে-প্রেমে-ভক্তিতে সর্বদা ঘিরে রাখতে চায়, তাকে সে ছাড়িয়ে যাবে, ছেড়ে যাবে। তার অস্তিত্ব কারও বশ্যতা স্বীকার করবে না, যে তার প্রতি মমতাময় বা মমতাময়ী, তাকে সে কশাঘাত করবে। আমার সন্দেহ, এই কারণেই ফরাশি স্ত্রীর সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদ, এবং পরবর্তীকালে যারাই তার সান্নিধ্যে এসে তাকে প্রীতি দিয়ে, স্নেহের ঔদার্যে আচ্ছন্ন করতে চেয়েছে, সে সদর্পে, কোনও-না-কোনও ছুতোয়, বা ছুতো ছাড়াই, সেই ব্যক্তিকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। বরাবরই সে চরমের ভক্ত তাপস। যে-কোনও দেশের সাবেক কমিউনিস্ট দল সম্পর্কে তার পুঞ্জিত ঘৃণা, অথচ এই ক্ষেত্রেও সে ভীষণ আঘাত পেয়েছে, তার একমাত্র সন্তানের কাছ থেকে। কয়েকদিনও হয়নি আমাকে গাল পেড়ে ভূত ভাগিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাতে কী, তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনে আমার কাঁধে হাত রেখে খোয়াইয়ের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দুঃখের মর্মান্তিক কাহিনী অশোক ব্যক্ত করলো: তার ছেলে, অশোক রুদ্রের ছেলে, ফরাশি দেশে পড়াশুনো করছে, সে কিনা সাবেক ফরাশি কমিউনিস্ট পার্টিতে নাম লিখিয়েছে, এই দুঃখ অশোক কোথায় রাখবে?
অশোকের সেই সন্তান, অলোক, এখন নিশ্চয়ই প্রায় প্রবীণ্যে পৌঁছনো ফরাশি যুবক, বাংলা ভাষা, ধরে নিচ্ছি, ভুলে গেছে। তার বাচ্চা বয়সের একটি কাহিনীর মাধুর্য এখনও মনে গেঁথে আছে। দিল্লিতে আমাদের বাড়িতে স-পুত্র অশোক-কোলে ক’দিনের জন্য থাকতে এসেছে, সন্ধ্যাবেলা বাড়ির মাঠে বেতের চেয়ারে সবাই গোল হয়ে বসে আছি, আমার স্ত্রী সস্নেহে অলোককে আহ্বান জানালেন, ‘এসো, আমার কোলে এসে বোসো না একটুক্ষণ’। অশোক-নন্দনের, তার বয়স হয়তো তখন পাঁচ বছর, সঙ্গে-সঙ্গে শর্তসাপেক্ষ উত্তর: ‘হ্যাঁ, তোমার কোলে গিয়ে বসবো, কিন্তু রাত্তিরে মুরগির ঠ্যাংটা আমাকে খেতে দিতে হবে’। খাদ্য প্রসঙ্গ যখন উঠলো, বলেই ফেলি, আমাদের ওখানে একদিন বিদ্যাচূড়ামণি অশোক রুদ্র ভাত দিয়ে পরিপাটি করে দই মাছ খেয়ে পরিতৃপ্তিসূচক প্রগাঢ় উক্তি করলো, ‘ইলিশ মাছের ভাপে সেদ্ধটা খুব ভালো খেলাম’।
শচীনদার হঠাৎ-বিয়োগের ঠিক দুদিন আগে কোনও কাজে মুম্বই গেছি, অশোক রুদ্র তখন ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক, রবিবার সকালে আমরা দুই অশোক মিলে পালি হিলে হিতুবাবুর বাড়িতে; শচীনদার কিছুদিন আগে হৃদরোগ দেখা দিয়েছে, তিনি ওখানে বিশ্রামে আছেন। সারাদিন আড্ডাগল্পগুজব, বিকেলে দিল্লিগামী বিমান ধরতে হবে আমাকে, ট্যাক্সি এসে গেছে, শচীনদা আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে নিম্ন স্বরে বললেন: ‘আমার শরীরের যা অবস্থা, তাতে অশোক রুদ্রের সঙ্গে তর্ক করবার মতো আর সামর্থ্য নেই, তুমি মাসে অন্তত একবার এসো’। আটচল্লিশ ঘণ্টা না-যেতেই শচীনদা প্রয়াত হলেন।
তা তো পরের বৃত্তান্ত। বরঞ্চ এই মুহূর্তে বলি, মধ্য-পঞ্চাশের সেই কয়েকটা বছর আমাদের পক্ষে, ইকনমিক উইকলি-র প্রসাদে, অভাবনীয় আনন্দ ও চরিতার্থতার ঋতু। যারা তখনও বিভিন্ন মন্ত্রকে কর্মরত আছি, তারা নাম গোপন করে ইকনমিক উইকলি-র জন্য লিখতাম, অনেকেই লিখতাম, পরে ছাপা হয়ে বেরোলে নিজেদের মধ্যে আন্দাজ-অনুমানের পালা শুরু, কে কোনটা লিখেছে। এটা তো অম্লানবদনে পৌনঃপুনিকতার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়, শচীনদা ওরকম লেখার স্বাধীনতা না দিলে আমরা কেউই লেখক হিশেবে পরিগণিত হতে পারতাম না; তাঁর কাগজে লেখার বউনি করেছি, তাঁর কাগজে অনেক দায়িত্বজ্ঞানহীন রচনা ছাপিয়েছি, কিন্তু তাঁর মনে কোনও দ্বিধা নেই, মতামত যা-ই হোক না কেন, লেখাটায় বুদ্ধি ও চতুরালির স্বাক্ষর থাকলেই হলো। সুখময়-অমর্ত্যরও প্রথম কয়েক বছরের অধিকাংশ রচনা ইকনমিক উইকলি-তেই জায়গা পেয়েছিল; সেই আরম্ভ থেকেই ক্রমশ তাদের লেখার বিভঙ্গ পরিপক্ক হলো, চিন্তায় ধূতি আসল।
ব্যাংককে যাওয়ার আগে, এবং ব্যাংককের পালা চুকিয়ে সেই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দিল্লিতে ফের জড়ো হওয়ার পরে, শচীনদার পত্রিকার পাতায়, তার ঔদার্যের সুযোগ নিয়ে, কখনও-কখনও, অল্প বয়স তখন, চরম হঠকারিতার পরিচয় দিয়েছি, যা তখন কৌতুক বলে ভাবতাম। অর্থমন্ত্রকে কাজ করবার সময়কার একটি ঘটনা বলি: আমাদের কর্তাব্যক্তি আঞ্জারিয়া মহাশয় সতর্ক স্বভাবের মানুষ, দেশের আর্থিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে, বা মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কে এখন ঠিক মনে নেই, কোনও উদ্ধত তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে একটি নোট তাঁকে পাঠিয়েছি, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে সেটা তাঁর সেক্রেটারিয়েট টেবলের ড্রয়ারে পাচার করেছেন, যেন ওটা পক্ক অবস্থায় পৌঁছুলেই তবে তার স্বাদ গ্রহণ করবেন। সপ্তাহ গড়িয়ে যায়, মাস গড়িয়ে যায়, আঞ্জারিয়া নির্বাক, আমার সঙ্গে আলোচনায় বসতে তিনি তখনও তৈরি নন। ধ্যাত্তোর বলে নোটটির একটি কপি শচীনদাকে মুম্বইতে পাঠিয়ে দিলাম, সঙ্গে-সঙ্গে তা সেই সপ্তাহের ইকনমিক উইকলি-তে প্রথম সম্পাদকীয় হিশেবে ছাপা হলো। দফতরে নিজের ঘরে বসে আছি, হঠাৎ আঞ্জারিয়ার উদ্ভ্রান্ত টেলিফোন: আরে ভাই, এক্ষুনি চলে এসো’। গেলাম। আঞ্জারিয়া ভীষণ বিচলিত, ‘শচীন কী যেন লিখেছে। অর্থমন্ত্রী, দ্রুত আমাদের মতামত চেয়েছেন। এসো, লেগে পড়ি, আঁটঘাঁট বেঁধে শচীনকে যথাযোগ্য জবাব দিতে হবে’।