আপিলা-চাপিলা – ১৪

চোদ্দো

যদিও শচীনদার পাশাপাশি দেবুদা ও হিতুবাবুর প্রসঙ্গ ইতিমধ্যে উত্থাপন করেছি, চতুর্থ ভ্রাতা স্বনামখ্যাত ভাস্কর শঙ্খ চৌধুরীর কথা এই বৃত্তান্তে এখন পর্যন্ত অনুচ্চারিত। নরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী তাঁর ছোটো ছেলের নাম কী ভেবে নরনারায়ণ রেখেছিলেন তা নির্ণয় করা মুশকিল, তবে সন্তানটি স্বয়ং নিশ্চয়ই গোড়া থেকেই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন, তাই প্রথম সুযোগেই নিজের ডাকনামটি পোশাকি নামে রূপান্তরিত করে নেন। প্রথম এবং তৃতীয় ভ্রাতার মতো শঙ্খ চৌধুরীরও অসম্ভব খেয়ালি চরিত্র, যা পুরোপুরি শিল্পীজনোচিত। শচীনদা যেমন খেয়ালের বশে তীর্থ থেকে তীর্থান্তরে, বৃত্ত থেকে বৃত্তান্তরে, এক বৃত্তি থেকে অন্য বৃত্তিতে, এক আড্ডা থেকে অন্যতর আড্ডায় সতত বিহার করে বেড়িয়েছেন, হিতুবাবু যেমন একটি ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসার ছক কেটেছেন, পরমুহূর্তে দ্বিতীয়টি ছেড়ে তৃতীয় উদ্যোগের আবর্তে ভিড়ে গিয়েছেন, কিংবা চলচ্চিত্রের এই নায়িকাকে তাঁর স্বপ্নালু চোখের ইশারায় ডুবিয়ে চকিত মুহূর্ত অতিক্রান্ত হলে দ্বিতীয়া কোনও নায়িকার মনোহরণ করেছেন, শঙ্খবাবুও তেমনই ছুটোছুটিতে সদা মত্ত। প্রতিভা বহুমুখী ধারায় উপচে পড়ছে, অনেক বছর পর্যন্ত, ভদ্রলোক এমনকি স্থির করতে পারেননি গান গাইবেন কি ছবি আঁকবেন কি স্থাপত্য গড়বেন। তাঁর বহুগুণবতী স্ত্রী ইরা, খাঁটি পার্শি পরিবারের মেয়ে, তবে শান্তিনিকেতনে বেড়ে-ওঠার ফলে ও চৌধুরীদের সঙ্গে সংশ্লেষণে তাঁর জাতিকাকাহিনী প্রায় পাথর-চাপা পড়েছে। ইরা শক্ত করে রাশ না-ধরলে শঙ্খবাবু, আমার সন্দেহ, বরাবরই হায়-গৃহহীন-হায়-পথহারা অবস্থায় পড়ে থাকতেন। শান্তিনিকেতনে ছাত্রাবস্থায় তাঁর উড়নচণ্ডী কাহিনী এখনও কিংবদন্তীর অঙ্গ হয়ে আছে। প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ, এই তিন ভাইয়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বরাবরই আলাদা করে নিরূপণ করা যেত, তা হলেও কোথাও তিনজনেরই প্রকৃতিতে একটু সন্ন্যাসী-মনস্কতার সাযুজ্য। একমাত্র দ্বিতীয় ভ্রাতা, দেবুদা, সমান স্নেহশীল, সমান আড্ডাপ্রিয়, অথচ স্থিতধী, কোনওদিনই পাগলাটেপনায় ভোগেননি। সেজন্যই হয়তো ব্যবসায় সফল হতে পেরেছিলেন।

তাঁদের চার বোনের কথাও এখানে সামান্য উল্লেখ করি, নইলে পরে হয়তো আর সুযোগ ঘটবে না। বড় বোন শান্তি, শচীনদার ঠিক পরে, কিশোরী বয়সে গয়া শহরের সুপ্রাচীন বারেন্দ্র পরিবারে, পদবী খাঁ, বিবাহিতা, তারপর তিনি আর বাংলাদেশে তেমন ফেরেননি, গয়াতেই জমাটি সংসার। ভাইয়েরা-বোনেরা তাঁর কাছে মাঝে-মাঝে গিয়ে থেকে এসেছেন, তিনি নিজে খুব কমই ভাইদের বা বোনেদের সংসারে বিহার করে গেছেন। মাত্র একবার-দু’বারই তাঁকে মুম্বইতে চার্চিল চেম্বার্সে অথবা কলকাতায় সামান্য কিছুদিন কাটাতে দেখেছি। তাঁর নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই, শান্তিদি যেখানেই থাকুন শান্তি-আমন ছড়াতেন-ছিটোতেন, সেই সঙ্গে স্নেহের ফল্গুধারাও। দ্বিতীয় বোন ধরিত্রী, আমরা কমলাদি ডাকতাম, মণীশ ঘটকের সহধর্মিণী, ঋত্বিক ঘটকের বউদি, মহাশ্বেতা দেবীদের জননী, ছোটোখাটো মহিলাটি মৃদুভাষী, সর্বংসহা। জীবনে কত শোকতাপ সহ্য করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এক খেয়ালকুঞ্জ থেকে বিয়ের পর অধিকতর খেয়ালি, কিন্তু একই গ্রামের, ঘটককুলে তিনি নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। ঘটকদের প্রতিভার পরিসীমা নেই, তবে তাঁদের উদ্‌ভ্রান্তিউন্মুখতাও সীমাহীন। কমলাদি নিজেও এক সময়ে একটু-আধটু লিখতেন, সংসারের তাড়নায় সেই প্রবণতা উবে যায়, তারপর সারাজীবন একটির পর আর একটি সংকট ও শোকের মধ্য দিয়ে দিনাতিক্রম করেছেন। শেষের কয়েকটি বছর দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন, পৃথিবী সম্পর্কে তবু তাঁর কোনও দিন ন্যূনতম ক্ষোভ ছিল না, সমস্ত সত্তা থেকে করুণা উপচে পড়তো। অ হলেও একটি কৌতুকস্মৃতির কথা বলি। মাত্র একবারই কমলাদিকে সামান্য ধৈর্য হারাতে দেখেছি। শচীনদাকে সঙ্গ দিতে কয়েক সপ্তাহ মুম্বইতে চার্চিল চেম্বার্‌সে কাটাচ্ছেন, আমরাও তখন ওখানে। একদিন, সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে, ইকনমিক উইকলি-র দফতর থেকে শচীনদা আদরের বোনকে টেলিফোন করলেন, ঘণ্টা দেড়েক বাদে বাড়ি ফিরবেন, সঙ্গে আট-ন’জন থাকবেন, তাঁদের সকলের নৈশাহারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কমলাদি নিঃশব্দে শুনলেন, ফোনটা জায়গামতে রেখে দিলেন, আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘থাকতো বাড়িতে বউ, মজা বুঝিয়ে দিত’। তবে কমলাদি জাদুকরী মহিলা, দেড়ঘণ্টা-দু’ঘণ্টার মধ্যেই বোড়শোপচার তৈরি করে অতিথিদের সামনে সাজিয়ে দিলেন।

তৃতীয় ভগ্নী, শকুন্তলাদি, বৃটিশ আমলের সিভিলিয়ান রঞ্জিত রায়ের স্ত্রী। মানুষের জীবনের মোড় হঠাৎ কীরকম ঘুরে যায়, শকুন্তলাদি, প্রথম জীবনে লীলা রায়ের অন্ধ ভক্ত ছিলেন, দীপালি সঙঘ-শ্রীসঙেঘ তদ্‌গতপ্রাণা, লীলাদি যখন কারান্তরালে, অত্যন্ত সুষ্ঠুতার সঙ্গে ‘জয়শ্রী’ পত্রিকা পরিচালনা করেছেন, কোনও উপলক্ষ্যে রঞ্জিতবাবুর সঙ্গে দেখা হলো, পরিচয় থেকে অনুরাগ, অনুরাগ থেকে বিবাহ। আমার এখনও মাঝে-মাঝে প্রশ্ন জাগে, শকুন্তলাদি কি মেনে নিতে পেরেছিলেন এই পট-পরিবর্তন, তিনি কি সুখী হয়েছিলেন: বাইরে থেকে তো বোঝবার কোনও উপায় ছিল না। শকুন্তলাদির জ্যেষ্ঠা কন্যা, শাওন, ভালো নাম ইন্দ্রাণী, ইতিহাসের অত্যন্ত প্রতিভাময়ী ছাত্রী। ওরকম সুন্দরী, শান্তস্বভাবা, বিনতবাক্‌ নারী আমি কদাচ দেখেছি, হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ তাকে উজাড় করে দিয়েছিলাম। প্রায় কুড়ি বছর হতে চললো, সে মৃতা।

শচীনদাদের সর্বকনিষ্ঠা বোন স্বপ্নময়ী, কুচিদি, অন্য তিন বোনের মতো তিনিও এখন বিগতা, শিল্পনিপুণা, নৃত্যকুশলা ও বাক্‌বিদগ্ধা হিশেবে শান্তিনিকেতনে তাঁর খ্যাতি উপচে পড়তো। জনশ্রুতি, কোনও ঋতুতে রামকিঙ্কর বেইজ তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে এখানেও তো যা হবার নয় তা হয় না। কুচিদির কন্যারাও আমাকে অনেক আনন্দের দিনে সঙ্গ দিয়েছে, যেমন দিয়েছে তাঁদের মামাতো-মাসতুতো ভাই-বোনেরা। আমার সংজ্ঞায় যা বৃহৎবৃত্ত চৌধুরী পরিবার, তার প্রসাদ না-পেলে আমি যা হয়েছি তা অনেকটাই হতে পারতাম না।

যেবার শচীনদা সানফ্রান্সিসকোয় সেই সম্মেলনে এলেন, বৈঠকান্তে কিছুদিন মার্কিন দেশের নানা প্রান্ত চষে বেড়ালেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিক উইকলি ও তাঁর অনুরাগীর ইয়ত্তা নেই, সত্যি-সত্যিই সব ঠাঁই তাঁর ঘর আছে, ঘরগুলিকে খুঁজতেও হলো না, বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপকরা তাঁকে সাদর আমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতে লাগলেন। সাংবাদিক ও কূটনৈতিক মহলেও শচীনদার কদরের সীমা নেই, সে-সব জায়গা থেকেও তাঁর আহ্বান এলো। বাঁধছাড়া প্রাণীর মতো তাঁর দিনযাপন, এই অমিত এলোমেলো বিহারের ফলে যা হবার তাই-ই ঘটলো, ফিলাডেলফিয়া শহরে, কয়েক অনুচ্ছেদ আগে উল্লেখ করেছি, খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলো, কিছুদিন বিশ্রামে থেকে শরীর ঈষৎ সারিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে তাঁর ওয়াশিংটনে চলে আসা, আমাদের একশয্যাকক্ষ অ্যাপার্টমেন্টে তাঁকে বন্দী করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা আমাদের তরফ থেকে। তবে তাঁকে শাসনে রাখতে পারি সেরকম প্রতিভা যথার্থই আমার স্ত্রী ও আমার আয়ত্তে ছিল না। নিজে বেরোতে না পারেন তাতে কী, অনুরাগীর দল সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ছেঁকে আসতো, বিশ্রামের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, শচীনদা বিরাট অট্টহাস্যে আমাদের অনুযোগ উড়িয়ে দিতেন। তাঁর জীবনদর্শনও এই সুযোগে খানিকটা বুঝিয়ে দিলেন আমাদের: ‘তোমাদের দু’জনেরই বাবা-মা চাকরিজীবী ছিলেন, মাসান্তে মাইনে পেতেন, জীবনে তাই শৃঙ্খলার নিগড় ছিল। আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমি অল্পবিস্তর জমিজমাওলা উকিল পরিবারের ছেলে, মাঝে-মাঝে হঠাৎ-হঠাৎ জমিদারি ও ওকালতি থেকে আহৃত উপার্জনের অর্থ আসতো, আবার হয়তো কয়েক মাস কোনও অর্থাগমই নেই, সুতরাং আমাদের বাড়িতে বেনিয়মই ছিল নিয়ম। আমরা ভাইয়েরাও সেরকম প্রকৃতির হয়েছি, শুধু দেবুর কথা ছেড়ে দাও, ও ওর গিন্নির ভয়ে গৃহী হতে বাধ্য হয়েছে’। এই দুরন্ত ব্যাখ্যার কাছে আমাদের পরাভূত হতেই হতো, সুতরাং যে-কয়েক সপ্তাহ ওয়াশিংটনে ছিলেন, আড্ডার দুর্ধর্ষ শ্রোতধারা অনবচ্ছিন্ন বয়ে গিয়েছিল। আসলে শচীনদা নিজেই হেনাদির ভয়ে তটস্থ থাকতেন। হেনাদি কোমলহৃদয় তথাচ জেদি মানুষ, সকলের অতি আদরের ভ্রাতৃজায়া, অনেকদিন পর্যন্ত চৌধুরী পরিবারে একমাত্র বধূ, ব্যক্তিত্বে প্রখর। সারা জীবন শচীনদাকে সহবৎ শেখাতে বদ্ধপরিকর, শেষটায় বোধহয় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।

মার্কিনবাসের তিন বছর গড়িয়ে গেছে, বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই, তা হলেও দেশে ফেরার জন্য মন উড়ু-উড়ু। ভিয়েতনামের বীভৎস কলঙ্কময় যুদ্ধ তখনও ঠিক শুরু হয়নি, যুদ্ধের পূর্বরাগ চলছে, তবে অন্য একটি অতি-তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি আজও মনে গেঁথে আছে। বাষট্টি সালের অক্টোবর মাস, ছাত্রদের নিয়ে আমরা ইনস্টিটিউটের কয়েকজন অধ্যাপক টেনিসি উপত্যকা অঞ্চলে ‘শিক্ষামূলক’ ভ্রমণে গেছি, হঠাৎ কিউবা নিয়ে সংকট, জন কেনেডি সম্মুখসমরে আপাতপ্রস্তুত, সোভিয়েট নেতৃবৃন্দও অনড়। দু’পক্ষের দাত-কিড়মিড়, অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেসামরিক বিমান চলাচল সম্পূর্ণ স্তব্ধ। আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য নক্সভিল শহরে আটকা পড়েছি, আমাদের ডেরা শহরের সম্ভ্রান্ততম এ্যান্ড্রু জনসন হোটেল। কিন্তু বর্ণবৈষম্যের ভূত দূর হয়নি, আমাদের সঙ্গে গুটিকয় আফ্রিকা মহাদেশীয় ছাত্র, হোটেলের ঘরে তাঁদের থাকতে বাধা নেই, কিন্তু ভোজনকক্ষে নাকি ঢোকা চলবে না। সমস্ত যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ, অন্যত্র যাওয়ার উপায় লুপ্ত, বাধ্য হয়ে ওই হোটেলেই রইলাম, তবে যেহেতু ছাত্রদের প্রবেশের অধিকার নেই, কেউ-ই ওখানে অন্নগ্রহণ করলাম না, অদূরবর্তী একটি স্টেক হাউসে গিয়ে দু’বেলা সস্তায় মস্ত বড়ো রসালো টি-বোন স্টেক খেয়ে চারদিনে নিজেদের ওজন প্রচুর বাড়িয়ে নিলাম। ঘটনাটির কথা আরও বিশেষ করে মনে আছে আমাদের থাকাকালীন এক ঝাঁক হলিউড অভিনেতা-অভিনেত্রীও ওই হোটেলে, জেম্‌স অ্যালবি-র ‘এ ডেথ ইন দি ফ্যামিলি’-র চলচ্চিত্রায়ন উপলক্ষ্যে তাঁরা নক্সভিলে। পরিস্থিতি-হেতু তাঁদের কাজকর্মও বন্ধ, আমাদের মতো তাঁরাও, উদ্দেশ্যহীন, লিফ্‌ট দিয়ে নিচে নামছেন, খানিক বাদে উঠছেন, ফের নামছেন, ফের উঠছেন। হঠাৎ নিজে থেকে এগিয়ে এসে নায়িকা ইংরেজ অভিনেত্রী জিন সিমন্‌স আলাপ করলেন, তারপর প্রতিবার করিভোরে লিফটে দেখা হলে মুচকি হাসির বিনিময়।

ওই সংকটের অবসান, কিন্তু কয়েক সপ্তাহ বাদে গভীরতর সংকট। ভিয়েতনামে তাঁদের ক্রমশ-উদঘাটিত নীতির ন্যায়হীনতা নিয়ে মার্কিন পরিচিতদের সঙ্গে একটু পিঠ-চাপড়ানো ভঙ্গিতে অহরহ উপদেশাদি বর্ষণ করছি, অথচ আমরা ভারতবর্ষের মানুষজনই হঠাৎ যুদ্ধোন্মাদনায় মেতে উঠলাম। বেশ কয়েক মাস ধরেই চীন সরকারের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে মন কষাকষি চলছিল, উত্তর-পূর্ব সীমান্তে একটি ছোটোখাটো সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে যায়, তবে তা বেশিদূর তখন গড়ায়নি; বাষট্টি সালে পুরো ব্যাপারটি অন্য চেহারা নিল। ভারতবর্ষের সংসদে স্বতন্ত্র পার্টির ছাপে বেশ কয়েকজন ধারওয়ালা ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে এলেন। তাঁরা ঘোর নেহরু-বিরোধী, ঘোরতর প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন-বিরোধী, ঘোরতম চীন-তথা কমিউনিস্ট আদর্শবিশ্বাস-বিরোধী। সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে বিন্দুতম বোঝাপড়াও যাতে না হয়, তার জন্য তাঁরা মুখিয়ে। একটা সময়ে জওহরলাল নেহরুও অবিবেচনার শিকার হলেন। তাঁকে খুব বেশি দোষ হয়তো দেওয়া যায় না, নিরপেক্ষ দেশগুলির অন্যতম প্রধান নেতা হিশেবে পৃথিবী জুড়ে স্বীকৃতি লাভ করেছেন, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বৈঠকে কৃষ্ণ মেননের ভয়ে সবাই তটস্থ, বিশ্বময় ভারতবন্দনা। এই বন্দনার সারাবত্তা নিয়ে কোনও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ভারতীয়দের পক্ষ থেকে করতে হয়নি, অধিকাংশ ভারতীয়ই এটা ধরাধার্য জ্ঞান করতেন যে গোটা পৃথিবী তাঁদের পায়ে লুটিয়ে পড়তে উদ্‌গ্রীব, তাঁরা যে-ফতোয়া দেবেন তা-ই সবাই মেনে নিতে বাধ্য। নেতারাও ঠিক এমনটি ভাবতে শুরু করলেন, নিজেদের এবং নিজেদের দেশের ওজন ভালো করে না বুঝে নিয়ে।

ইংরেজ প্রভুরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে সর্বশক্তিমান, ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছেন, আফিম খাইয়ে-খাইয়ে দুর্বল ছত্রভঙ্গ চীনে জাতিকে দুর্বলতর করেছেন, তারপর গায়ের জোরে চীনের ঘাড়ে একটি সীমান্তরেখা, ম্যাকমাহোন না কী যেন নাম, চাপিয়ে দিয়েছেন। নেহরু ও তাঁর পারিষদবর্গ স্থির করলেন, সাম্রাজ্যশাসিত সীমারেখা বিপ্লবোত্তর চীনকেও মেনে নিতে হবে। চীনের নেতারা ভারতবর্ষের সঙ্গে সৌহার্দ্যের স্বার্থে তা-ও মানতে সম্মত ছিলেন, কিন্তু একটি শর্তে: উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে, আকসাই চীন এলাকায়, দেশের দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে গমনাগমনের প্রয়োজনে যে-রাস্তা আবহমান কাল ধরে আছে, সেটা যদি আমরা তাঁদের দখলে ছেড়ে দিই, জনমানবহীন ওই অঞ্চল, শস্যসম্ভাবনাহীনও। চীনের প্রস্তাবে রাজি হলে আমাদের ব্যবহারিক কোনও ক্ষতি হতো না, কিন্তু সামন্ততান্ত্রিকতা-সমাচ্ছন্ন চেতনা, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা, ইংরেজরা চলে গিয়েছে তাতে কী, আমরা তো আছি, ইংরেজদের দ্বারা নির্দেশিত সীমানাই বলবৎ থাকবে, কোনও যুক্তির ঘ্যানঘ্যানানি আমরা কানে তুলবো না। এই পরিস্থিতিতে এক সময় চীনের সঙ্গে আলোচনা ভেঙে গেল, আমাদের প্রধান মন্ত্রী কড়া বক্তৃতা দিলেন, তাঁর সৈন্যদের তিনি হুকুম করেছেন চীনে অনুপ্রবেশকারীদের ঘাড়ে ধরে ম্যাকমাহোন লাইনের ওপারে পৌঁছে দিতে। এবংবিধ কড়া বিঘোষণা করে জওহরলাল নেহরু সিংহলে বেড়াতে চলে গেলেন।

ভারতীয় কর্তাব্যক্তিরা ভেবেছিলেন ইংরেজদের কাছে প্রত্যক্ষ সামরিক শিক্ষা নিয়েছি আমরা, ওই চ্যাপ্টা নাকওলারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না। যুদ্ধ বাধলো, পরিণাম ভয়াবহ। চীনেরা আমাদের দু’গালে চপেটাঘাত করে অরুণাচল-অসম ধরে অনেকটা এগিয়ে এলো, তারপর তাদের একপাক্ষিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা। আমাদের অবস্থা ভগ্নজানু, ভগ্নউরু, কুরুক্ষেত্র-ফেরত কৌরবকুলের মতো। দু’-ধরনের প্রতিক্রিয়া দেশময় ছড়িয়ে পড়লো। প্রথম, হিন্দি-চীনি ভাই-ভাই চুলোয় গেল, পরিবর্তে চীনেদের সম্পর্কে ‘হীন’ শব্দটি প্রধান প্রযোজ্য বিশেষণরূপে পরিগণিত হলো, চীনে মানেই নচ্ছার, ঘৃণ্য জীব। দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া, কৃষ্ণ মেনন তথা জওহরলাল নেহরু সম্পর্কে ব্যাপক ক্ষোভ, যা সামাল দিতে কয়েকদিনের মধ্যেই প্রধান মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে কৃষ্ণ মেননের পদত্যাগ ঘোষণা করতে হলো। দেশ জুড়ে অভিযোগ-বিসংবাদ: কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের অবহেলা ও ষড়যন্ত্রে আমাদের জওয়ানরা ঠিক মতো লড়তে পারেনি, তাই এই পরাজয়। তবে আমাদের মহান আর্য সভ্যতা, পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন বীর্য-শৌর্য-ঐতিহ্য, চীনের ঘৃণ্য আক্রমণের আমরা সমুচিত জবাব অতি সত্বর দেবো। প্রতিরক্ষা খাতে বেপরোয়া খরচের হার এখন থেকে আরও বাড়িয়ে যেতে হবে, তা হলেই নাকি অভীষ্ট সিদ্ধ হবে। চীনেদের তরফ থেকে যে-সংঘর্ষ অতি সামান্য সীমান্তবিরোধ বলে বর্ণিত, আমাদের পরিভাষায় তা আখ্যাত হলো মহা আক্রমণ, ভারতের বিভিন্ন ভাষায় যা লব্জ হয়ে দাঁড়ালো। পরিমিতিজ্ঞানের অভাবের জন্য ভারতবর্ষীয়রা বরাবরই বিখ্যাত, অতিনাটকীয়তা আমাদের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষের জের তাই গোটা জাতিকে দশকের পর দশক ধরে আচ্ছন্ন করে থেকেছে। পশ্চিম বাংলায়, কলকাতায় তথা মফস্বলে, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দাঁত-কিড়মিড়-করা সমরসংগীত, ‘অরাতি রক্তে করিব পান’, তাঁর পুত্রের গাওয়া সেই গানের রেকর্ড, দাপাদাপি করে কিছুদিন বাজানো হলো, নির্বাচনে-উপনির্বাচনে দেওয়ালে ছড়া কাটা হলো, ‘গড়তে দেশ রুখতে চীন, কংগ্রেসকে ভোট দিন’। কয়েক বছর বাদে জয়পুরে, মহারাজাদের পুরনো প্রাসাদ, যাত্রীশালায় রূপান্তরিত, রামগড় প্যালেস হোটেলে কী কাজে যেন গিয়েছি, হোটেল ম্যানেজার ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে পরম সমাদরে আমাকে আদ্যোপান্ত দেখাচ্ছেন, একটি মস্ত স্যুইটে নিয়ে গেলেন, দেওয়ালে চীনে চিত্র, দরজায়-জানালায় ঝুলন্ত ভারি চীনে রেশমের পর্দা, চীনে স্থাপত্যের বিবিধ নমুনা, কিন্তু, কুছ পরোয়া নেই, অকম্পিতচিত্ত ম্যানেজার সগর্বে জানালেন, ‘এই স্যুইটকে আমরা আগে বলতাম চীনে কক্ষ, এখন বলি দূরপ্রাচ্য কক্ষ।’

চীনের সঙ্গে হামলা বাঁধার পর মাত্র মাস তিনেকই আমেরিকায় ছিলাম, কিন্তু কিছু মুশকিলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। এগারো হাজার মাইল দূরে মাতৃভূমি, তা বিদেশী দুশমন দ্বারা আক্রান্ত’, ওয়াশিংটনস্থ ভারতীয় বন্ধুবান্ধব রাতারাতি উগ্ৰ-অন্ধ দেশপ্রেমিক বনে গেলেন। যুদ্ধ নিয়ে সামান্য ঠাট্টা-মস্করা করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গেই মন-কষাকষি, কেউ-কেউ সাময়িক কথা বন্ধ করে দিলেন। ইতিমধ্যে দেশ থেকে খবর পাচ্ছি, পরিচিত অনেকেই বিনা বিচারে আটক হয়েছেন, আমার মন খারাপ: দেশ জুড়ে অতি ভয়ংকর জাত্যান্ধতা।

একদিন পরিচিতদের মধ্যে কে কে ধরা পড়েছেন তার ফিরিস্তি জানবার চেষ্টা করছি, এক দয়াবতী মহিলা আমার পাশে এসে বসে সান্ত্বনা জানালেন, ‘তুমি মনখারাপ কোরো না, ভালোই হয়েছে ওঁরা গ্রেফতার হয়েছেন, প্রাণে বেঁচে গেলেন, তা না হলে ওই কমিউনিস্টদের লোকেরা ছিঁড়ে-ফেঁড়ে খেত’। অবশ্য এই পর্বেই কমিউনিস্ট পার্টির দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার উদ্যোগ শুরু।

ওয়াশিংটন থেকে যেবার জ্যামাইকা গিয়েছিলাম, ক্রিকেটে আমার দুরন্ত আগ্রহ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে ইনিংস-শুরু-করিয়ে অ্যালান রে-র সঙ্গে পরিচয় হলো, তিনি আমাকে খুব যত্ন করে কিংসটন ক্রিকেট মাঠ তথা প্যাভিলিয়ান ঘুরিয়ে দেখালেন। আমি তখন থেকেই সি. এল. আর. জেমস-এ নিমজ্জিত, তাঁর রচনাদি ছেনে ক্রিকেটের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ ও সাম্যবাদের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আবিষ্কার করে মোহিত হচ্ছি, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল নিয়ে আগ্রহ গভীর থেকে গভীরতর। ওয়াশিংটনে থাকাকালীনই গায়নার জননায়ক ছেদি জগন একবার ঘুরে গেলেন। কিছুদিন আগে তিনি গায়নায় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, ইংরেজরা তাঁদের চিরাচরিত প্রথায় ভাগ-করে-শাসন-করো নীতি প্রয়োগ করে ওই রাষ্ট্রে, সাময়িকভাবে হলেও, ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সঙ্গে কৃষ্ণবর্ণ সম্প্রদায়ের বিসংবাদ খুঁচিয়ে তুলতে সাফল্য অর্জন করেছে। ছেদি জগন আপাতত ক্ষমতাচ্যুত, তাঁর দল দ্বিখণ্ডিত, আমাদের ছাত্র গায়নার এক বড়ো আমলার সঙ্গে এসে ঢালাও আড্ডা দিয়ে গেলেন, পৃথিবীর সর্বত্র শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত জনগণের সমস্যা নিয়ে অনেক কথা হলো, সামগ্রিকভাবে লাতিন আমেরিকার সমস্যা নিয়েও। বেশ কয়েক বছর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল।

চীনের সঙ্গে গোলমাল ঘটার অনেক আগেই মনস্থির করে ফেলেছি, দেশে ফিরবো, ফিরবোই। কলকাতায় ফেরার জন্য একটি আলাদা মনোবাঞ্ছা পুঞ্জিত ছিল। হঠাৎ দেশ থেকে কে টি চণ্ডী নামে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এলেন। নামে চিনতাম, হিন্দুস্থান লিভারের প্রথম ভারতীয় ডিরেক্টরদের অন্যতম, আইন বিশেষজ্ঞ, তাঁর ব্যক্তিগত প্রাচীন ইতিহাসের খানিকটাও আমার জানা ছিল। ভদ্রলোক লন্ডনে ছাত্রাবস্থায় ঘোর কমিউনিস্ট ছিলেন, কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে ইন্ডিয়া লিগ করতেন, পাশাপাশি হ্যারি পলিট-রজনী পালমা দত্তদেরও শিষ্য, ভারতীয় ছাত্রদের কত দ্রুত লালে লাল করে ফেলা যায় তা নিয়ে চণ্ডীর উদয়াস্ত শ্রমসাধনা। হয় পরমেশ্বর হাকসার নয় জ্যোতি বসুর মুখে শুনেছি, লন্ডনে তখন যাঁরা সাম্যবাদসাধনা করতেন, তাঁদের মধ্যে চণ্ডীর গলার টাই সব চেয়ে উগ্র লাল।

সব পাখিই ঘরে ফেরে, চণ্ডীর মতো বেশ কয়েকজনও দেশে ফিরে গৃহপালিত শাবক বনে যান, লিভারের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে উঁচু পদের কাজ সংগ্রহ করে সুখী, সম্ভ্রান্ত জীবনযাপন। তবে ঈষৎ বিবেক দংশন, চণ্ডী মুম্বই শহরে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন, তাঁদের পয়সা-কড়িও জোগাড় করে দিতেন, যে-বন্ধুরা কমিউনিস্ট থেকে গেছেন তাঁদের সঙ্গে, অন্তত প্রথম দিকে, তাঁর মেলামেশা অব্যাহত ছিল। দু’-দু’বার কৃষ্ণ মেনন মুম্বই থেকে লোকসভার নির্বাচনে জিতেছিলেন, চণ্ডী তাঁর বয়স্যদের নিয়ে প্রাক্তন গুরুর হয়ে প্রচুর খেটেছিলেন।

হিন্দুস্থান লিভার থেকে শিগগিরই অবসর গ্রহণ করছেন, কেন্দ্রীয় সরকার আহমেদাবাদ ও কলকাতায় দুটো ভারতীয় ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করবার উদ্যোগ নিচ্ছেন, কলকাতাস্থ ইনস্টিটিউটের জন্য চণ্ডী ডিরেক্টর মনোনীত হয়েছেন, তিনি মার্কিন দেশ সফরে এসেছেন নানা বিশ্ববিদ্যালয়-উচ্চ বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে তাঁর ইনস্টিটিউটের জন্য শিক্ষক সংগ্রহের তাগিদে। ছাত্রাবস্থায় লন্ডনে থাকাকালীন ড্যানিয়েল থর্নারের সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব, যা আজীবন অটুট ছিল, হয়তো থর্নারের কাছেই আমার কথা শুনেছেন, নয়তো অন্য কারও সূত্রে, ওঁর ভীষণ আগ্রহ আমার সঙ্গে দেখা করার। ক’দিন ধরে আমার শরীরে জলবসন্তের গুটি বেরিয়েছে—মার্কিন দেশটা মাটির, সেখানেও জলবসন্ত হয়—, আমি ওঁকে আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসা থেকে নিরস্ত করার অনেক চেষ্টা করলাম, চণ্ডী আসবেনই। দীর্ঘক্ষণ কথা হলো, অনেক সুবিধাদির আশ্বাস দিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ম্যানেজমেন্ট তত্ত্বে আমার আদৌ বিশ্বাস বা আগ্রহ নেই, কিন্তু আমরা কলকাতায় স্থিত হতে ব্যগ্র, স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরীক্ষা করে দেখাই যাক না দু’-এক বছরের জন্য। চণ্ডী জলবসন্তের গুটিকার ছোঁয়া এড়িয়ে প্রসন্ন চিত্তে ফিরে গেলেন কলকাতায়, বরানগরের মরকতকুঞ্জে সদ্যস্থাপিত ইনস্টিটিউটে। পরের বছর পয়লা মার্চ যোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ রইলাম।

জানুয়ারির মাঝামাঝি মার্কিন দেশ ছেড়ে ঢিমে-তালে দেশে প্রত্যাবর্তন, বিলেতে সপ্তাহখানেক, ফরাশি দেশে দিন দশেক, সুইৎজারল্যান্ডে কয়েকটা দিন, ইতালিতে আরও কয়েকটা, তারপর জেনোয়া থেকে লয়েড-ট্রিস্টিনোর জাহাজে চেপে মুম্বইমুখো। থর্নাররা ততদিনে প্যারিস চলে এসেছেন, ড্যানিয়েলের উপরোধে সরবনে একটা-দুটো ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা; সব জায়গাতেই প্রচুর বন্ধুবান্ধব ছড়ানো, দেশে ফেরার আগে দেড়মাস নিরবচ্ছিন্ন আড্ডার প্রবাহ। জেনোয়া থেকে মুম্বই যাত্রাপথে ‘ভিক্টোরিয়া’ জাহাজের এক রাত্রির জন্য করাচি বন্দরে অবস্থান। খুরশীদ করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকা, ওঁর বাবা শহরে মস্ত বাড়ি তুলেছেন, বাবা-মা-ভাই-বোনে গমগম সুখী সংসার। আমাদের বন্দর থেকে গ্রেফতার করে বাড়ি নিয়ে গেল, বাবা-মা-ভাই-বোনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। খুরশীদের বাবা-মা দুজনেরই স্নেহ ও সৌজন্যের নির্ঝরে আমরা অভিভূত। ব্যবসাদার সপ্রতিভ এক ভদ্রলোককে খুরশীদের ফাইফরমাস খাটতে দেখলাম। দু’মাস বাদে কলকাতায় ওর চিঠি পেয়ে জানলাম, সেই রাজা হায়দারকেই সে শাদি করছে।

মুম্বইতে অবতরণ, চার্চিল চেম্বারস, ইকনমিক উইকলি-র আড্ডা, শচীনদার সম্মোহ। আতিথ্যে-স্নেহবিলোনোয় ন্যূনতম ত্রুটি নেই, কিন্তু খাজনা দিতে হতো, প্রায় প্রতিদিন ইকনমিক উইকলি-র জন্য বসবার ঘরের এক কোণে বসে সম্পাদকীয় রচনা তৈরি করা; এখন বুঝতে পারি সেরকম লেখা-লেখা খেলাতে মজানো হয়েছিল বলেই শেষ পর্যন্ত লেখকবৃত্তিতে খানিকটা উত্তীর্ণ হতে পেরেছি।

অবশেষে কলকাতা, চীনকে যুদ্ধে আহ্বানের জের তখনও চলছে, কেন্দ্রীয় বাজেটে বিস্ফারিত ঘাটতি, সমস্ত জিনিশপত্রের মূল্যমান ঊর্ধ্বগামী, প্রধান বিরোধী দল কমিউনিস্ট পার্টির বহু নেতাই যেহেতু কারারুদ্ধ, প্রতিবাদ-আন্দোলন স্তব্ধ, যে-কমিউনিস্টরা বাইরে আছেন তাঁরা অনেকেই সরকারকে তোয়াজ করতে সদা ব্যস্ত। দেশে ফেরার মাস দুয়েকের মধ্যে কী কাজে দিল্লি যেতে হয়েছিল, রাতের বিমানে কলকাতা ফিরছি। তখন নিশীথ বিমানডাকের পত্তন হয়ে গিয়েছে: দিল্লি-মুম্বই কলকাতা-মাদ্রাজ থেকে চারটি বিমান ডাক নিয়ে মধ্যরাতে নাগপুর পৌঁছুতো, নাগপুরে চার শহরের ডাক বিনিময়-প্রতিবিনিময় করে যথাযথ বিমানে বস্তাবন্দী করা হতো, প্রত্যুষে বিমানগুলি নির্দিষ্ট শহরে ফিরতে। দিল্লি থেকে আমার সহযাত্রী এক বিখ্যাত সাংবাদিক, একদা-অধ্যাপক ও কমিউনিস্ট, তাঁর স্ত্রী সে সময় সংসদে পশ্চিম বাংলা থেকে নির্বাচিত সদস্যা, ভদ্রমহিলাও মুম্বই না মাদ্রাজ থেকে কলকাতা ফিরছিলেন, নাগপুর থেকে তাই আমরা এক সঙ্গে দমদম পৌঁছুলাম, গাড়ি করে তাঁদের বালিগঞ্জের বাড়িতে পৌঁছে দিলাম। তাঁরা দু’জনেই কট্টর দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট, কয়েক সপ্তাহ আগে বাঁকুড়া জেলায় বিধানসভার একটি উপনির্বাচন হয়েছে, তাতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল, ভূপেশ গুপ্ত নির্বাচনপ্রচারে গিয়েছিলেন। অনেক ভোটে কমিউনিস্ট প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন, সাংসদ মহিলা আমাকে সুতীব্র কষ্ঠে জানালেন, এই বিপর্যয়ের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী ভূপেশবাবু, তিনি প্রচারে গিয়ে প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন, এর চেয়ে বড়ো অবিমৃষ্যকারিতা কিছু হতে পারে না। আমি নির্বাক হয়ে শুনলাম, কমরেডদের বন্দিত্ব থেকে মুক্তির দাবি জানানো কমিউনিস্ট নেতার পক্ষে মস্ত অকর্তব্য, এই প্রজ্ঞালাভের সঙ্গে আরও নানা দিকেও জ্ঞানের শলাকা উদ্দীপিত হলো।

বেকার সমস্যা ক্রমবর্ধমান, মূল্যমান চড়ছে, আন্দোলন স্তব্ধ, হাজার-হাজার রাজনৈতিক কর্মী বন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, আর আমি কচিকাঁচাদের ‘বাক্সওয়ালা’ জীবনে পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়ে মাস্টারিতে যোগ দিয়েছি। এরকম স্ববিরোধিতা নিয়েই আমাদের ভারতবর্ষ। উঠতি ম্যানেজারদের পড়ানোর গ্লানি থেকে সামান্য রেহাই পেতে সপ্তাহে একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে, মরকতকুঞ্জের প্রায় লাগোয়া যার অবস্থান, পড়াতে যেতাম, তাতে চিত্ত ভরতো না। স্বীকার করতে হয়, চণ্ডী কথার খামতি করেননি। পর্যাপ্ত বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করেছেন আমার জন্য, সেই সঙ্গে মধ্য-দক্ষিণ কলকাতায়, হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটে, মিন্টো পার্কের গা-ছোঁয়া চমৎকার বিশাল সরকারি ফ্ল্যাটের উপচার: অনেকগুলি ঘর, দক্ষিণে পার্কের পুকুর, গাছপালা, লিফট নেই, হেঁটে উঠতে হয়, কিন্তু চারতলাই শেষতলা বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছাতটার পুরো অধিকারও আমাদের।

ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রে আমার বরাবরই প্রবল অনীহা, যতই বছর গড়িয়ে গেছে, অর্থশাস্ত্র সম্পর্কেও প্রায় সমান বীতরাগ জন্মেছে। যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, পড়াতে আমার ভালোই লাগতো, এবং পাঠ্য বিষয় সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ সঞ্চার করতে মোটামুটি সফল হতাম, তবে অর্থনীতিবিজ্ঞান এত দ্রুত গত পঞ্চাশ বছরে চেহারা-চরিত্র পাল্‌টেছে, এবং এত বেশি গণিতভিত্তিক হয়েছে, যা আমাকে ক্রমশ তিতিবিরক্ত করে তুলছিল। একটি কিম্ভূত সূত্র কল্পনা করে, তার অবয়বে আরও আজব শাখাপ্রশাখা জড়িয়ে, প্রচুর অঙ্কের কণ্ডূয়ন সম্ভব, অনেক উদ্ভট সিদ্ধান্তেও পৌঁছুনো সম্ভব, কিন্তু আসল পৃথিবীর সমস্যাদির সঙ্গে এ ধরনের চর্চার সম্পর্ক অতীব ক্ষীণ। একটু-একটু করে আমার সন্দেহ গাঢ়তর হয়েছে, অসফল পদার্থবিজ্ঞানী বা গাণিতিকরা নতুন রোমাঞ্চের সন্ধানে অর্থনীতির প্রাঙ্গণে ইদানীং বেশি করে উপনীত হচ্ছেন, কোনও ছুতো ধরে পৃষ্ঠার-পর-পৃষ্ঠা জুড়ে অঙ্ক কষছেন, বাহবা কুড়োচ্ছন, কম্পিউটার যন্ত্রের প্রসারের ফলে এধরনের ব্যসনে এখন ডাল-ভাতের মতো। কিন্তু এই গোছের অঙ্ককেলির সামাজিক সার্থকতা, জোর গলাতেই বলবো, প্রায় শূন্য। আরও যা সমস্যা দেখা দিয়েছে, অর্থনীতিবিদরা অনেকে একটি বিশেষ মুদ্রাদোষের শিকার হয়েছেন, তাঁরা জানেন বাস্তব জগতের সমস্যাদি গাণিতিক উপপাদ্যের মতো একমাত্রিক বা সহজ নয়, যে কোনও দেশের আভ্যন্তরীণ অর্থব্যবস্থায় তথা বহির্বাণিজ্যে নানা জটিলতা ও অসামঞ্জস্য জড়ানো। যেহেতু অর্থনীতিবিদরা এই অনিশ্চিত অর্থব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না, ধরে নেন আসল পৃথিবীর চেহারা যাই-ই হোক না কেন, তাঁরা কতিপয় অদ্ভুত-কিম্ভুত শর্তের উপর নির্ভর করে বিবিধ সিদ্ধান্তে পৌঁছুবেন: বাস্তবকে উপেক্ষা না করলে পণ্ডিতি ঠিক ফলানো যায় না। বরাবরই মনে হয়েছে এটা ছেলেখেলা, মেধা ও সময়ের অপচয়, শুধু তা-ই নয়, সমাজসুদ্ধু সবাইকে বিপথে পরিচালনা। তবে সেই যে মার্কস কবে মন্তব্য করে গিয়েছিলেন, সমাজব্যবস্থার চুড়োয় যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের মতামতই সর্ব মুহূর্তে গোটা সমাজের নিদান বলে মেনে না-নিয়ে উপায় নেই। গত দশ-বারো বছরের ঘটনাবলীর পরিণামে এখন মার্কিন প্রভুরা গোটা পৃথিবীর উপর মোড়লি করছেন, তাঁরা ভাণ করেন মুক্ত না কি অবাধ প্রতিযোগিতাই বসুন্ধরার সার সত্য, যদিও বাস্তবে আদৌ তা নয়। এই ভাণ নিষ্কাম সাধনা নয়, তা থেকে আখেরে পুঁজিপতি-ব্যবসাদারদের অঢেল সুবিধা। মার্কিন প্রভুরা তাঁদের তত্ত্ব আমাদের উপর চাপাচ্ছেন, দেশোয়ালি কর্তাব্যক্তিরা বিগলিত, সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

ষাটের দশকের গোড়া থেকেই, মুক্ত প্রতিযোগিতা তথা অবাধ বাণিজ্যতত্ত্ব সম্পর্কে আমি মোহমুক্ত! প্রথম পর্বে কয়েক বছর যদিও প্রচুর গণিতচর্চার প্রয়াস করেছি, এবং অধ্যাপক টিনবার্গেনের অনুপ্রেরণায় ভেবেছি যে অঙ্কের মধ্যবর্তিতাতেই অর্থব্যবস্থার খোল-নল্‌চে পরিবর্তন সম্ভব, নেশা কাটাতে তেমন সময় লাগেনি। ম্যানেজমেন্ট ইনস্টটিটিউটে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের প্রথাগত অর্থনীতিতে রপ্ত করাবার চেষ্টা করতাম, অথচ সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতাম, এক ধরনের অসাধুতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করছি। এই উপলব্ধিহেতুই সম্ভবত নিজেকে খুব বেশিদিন অর্থশাস্ত্র অধ্যাপনার গণ্ডিতে টিকিয়ে রাখতে পারিনি।

ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে ঢোকবার অন্যতম সুফল বা কুফল, কার্যসূত্রে এন্তার শিল্পপতি-ব্যবসাদারদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, বেসরকারি মালিকানায় ম্যানেজাররূপে বৃত আছেন এমন অনেকের সঙ্গেও। কলকাতার ইনস্টিটিউটে তো পড়াতে হতোই, তা ছাড়া নানা সময়ে মুম্বই বাঙ্গালোর-চেন্নাই-দিল্লি-শ্রীনগর ইত্যাদি শহরে শৌখিন পাঁচতারা হোটেলে স্বল্পমেয়াদি পাঠক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাক্সওলাদের কাছে বক্তৃতা দেওয়া। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা যাঁদের কব্জায়, তাঁদের মতামত-মানসিকতা চাল-চলনের আঁটঘাট একটুতেই জানা হয়ে গেল। আমার শ্রদ্ধা বাড়লো না, বরং কমলো। এঁরা অবাধ প্রতিযোগিতার মন্ত্রে গভীর আস্থা রাখেন, কিন্তু তা তোতাপাখির চিরাচরিত বয়ানের অভ্যাস। আসলে এঁরা সর্বদাই চান সরকার তাঁদের সব-কিছু যুগিয়ে দেবেন, তারপর তাঁরা তেড়ে-মেরে ডাণ্ডা যাবতীয় বাধাবিঘ্ন করে দেবেন ঠান্ডা। ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন পাঠক্রমে কিছু-কিছু সরকারি শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থার ম্যানেজাররাও যোগ দিতেন, সুতরাং দুই শরিকের ম্যানেজারদের গুণাবলীর তুলনামূলক বিশ্লেষণের যথেষ্ট সুযোগ ঘটেছিল। যে-সিদ্ধান্তে সে সময় পৌঁছেছিলাম, তা পরিশোধনের আর দরকার হয়নি। এই চার দশক বাদেও প্রত্যয়শীল আছি, সরকারি সংস্থার ম্যানেজাররা বুদ্ধিতে, প্রতিভায় ও কর্মকুশলতায় কোনও অংশে বেসরকারি ম্যানেজারদের চেয়ে অপকৃষ্ট নন, তবে, হ্যাঁ, বেসরকারি মালিকানার ছত্ৰতলবর্তী ম্যানেজাররা মদ গিলতে অনেক বেশি ওস্তাদ, বেচারি সরকারি সংস্থার ম্যানেজাররা হয়তো তেমনধারা সুযোগ পেতেন না, এখনও পান না। আগেও যা ছিল, এখনও তাই, সরকার-পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে পয়সাকড়ি না-ঢাললে, সরকার থেকে বরাত না-দিলে, বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগ অবরুদ্ধগতি হতে বাধ্য, পুঁজিপতি হিশেবে বড়াই করেন যাঁরা, তাঁদের তো মুখ্য ভূমিকা পরের ধনে পোদ্দারির।

এখন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটু বিবেকদংশনে ভুগছি, বাক্সওলাদের পড়াতে ওই ক’বছর কী পরিমাণ সময় আজেবাজে কাজে নষ্ট করেছি, শিল্পপতি-গোছের ব্যক্তিবৃন্দের সঙ্গে অলস গল্পে, অর্থহীন খাওয়ায়-আলোচনায়, কখনও-কখনও স্রেফ তাস পিটিয়ে। তাসের নেশা বোধহয় বংশগত, নিজের বাবাকে পেশেন্স খেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহন করতে দেখেছি; আমার মধ্যেও কিছুদিন কন্ট্রাক্ট ব্রিজের নেশা চেপেছিল। ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে পড়ানোর চাপ থেকে অপব্যয়ের সময় অনেক বেশি, তাই সহযোগীদের সঙ্গে সকাল-দুপুর-সন্ধে তাসের আসর নিত্যকর্মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। শিল্পব্যবসায়ী মহলের কেষ্টবিষ্টদের সঙ্গেও প্রচুর খেলেছি কয়েকটা বছর, যেমন চরতরাম সম্প্রদায়ের সঙ্গে, কিংবা শান্তিপ্রসাদ জৈন ও তাঁর স্ত্রী, রামকৃষ্ণ ডালমিয়া-দুহিতা, রমা জৈনের সঙ্গে। ব্রিজের প্রতিভা দিয়ে যদি বিচার করতে হয়, ডালমিয়া-দুহিতা অতি সহজেই নিজের স্বামীকে এক হাটে কিনে আর এক হাটে বিক্রি করে আসতে পারতেন। একবার শ্রীনগরে কী পাঠক্রমে পড়াতে গিয়ে কর্ণ সিংহের সঙ্গে আলাপ, তিনি তখন ওখানকার রাজ্যপাল। ওঁর শখ হলো আমাদের কয়েকজনের সঙ্গে ব্রিজ খেলবেন বাজি ধরে। আমরা পুরনো পাপী, কর্ণ সিংহ বেচারি মানুষ: অনেক টাকা ওঁর কাছ থেকে জিতে এনেছিলাম, এতটুকু বিবেকদংশন হয়নি। তবে কর্ণ সিংহ নিপাট ভদ্রলোক; তখন থেকেই দাদা বলে সম্ভাষণ করেন, রাজ্যসভাতেও সেই অভ্যাস তাঁর বজায় ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *