ছত্রিশ
হেরে ভাবলাম, ফাঁড়া কাটলো, পশ্চিম বঙ্গের প্রশাসনিক সমস্যাদির সঙ্গে আর জড়িত হতে হবে না, নতুন করে ঝগড়াঝাঁটিতেও লিপ্ত হতে হবে না। পুরোপুরি ছাড়া পেলাম না। জ্যোতিবাবু সম্ভবত ভাবলেন, রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেক বিরূপ কথাবার্তা হচ্ছে, একটি কমিশন গঠন করে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা-বিশ্লেষণের ব্যবস্থা করলে মন্দ হয় না, তা ছাড়া এই ছাড়া গরুটি একেবারে তো নিরক্ষর নয়, ওঁকেই কমিশনের সভাপতি করে দেওয়া যাক। আমার অসম্মতি জানানোর বিশেষ সুযোগ ছিল না। এটাও তখন ভেবেছিলাম, কমিশনে কাজের সুত্রে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার যে অসম্পূর্ণতাগুলি আমাকে বহু বছর ধরে পীড়িত করছিল, রাইটার্স বিল্ডিং ছেড়ে আসার যা অন্যতম বড় কারণ, সে-সব নিয়ে ফের বিস্তৃত হবার সুযোগ পাবো।
প্রচুর পরিশ্রম করে মস্ত রিপোর্ট তৈরি করেছিলাম, প্রায় পুরোটাই নিজের লেখা, তবে প্রতিটি অধ্যায়ের প্রতিটি পঙ্ক্তি সদস্যদের দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া। কমিশনের কাজ চলাকালীন মাস-খানেকের জন্য অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, তা হলেও সব মিলিয়ে সাত-আট মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হয়েছিল। একশো দশ কিংবা তারও কিছু বেশি সুপারিশে ঠাসা রিপোর্ট। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হলো, একটি-দু’টি বাদ দিয়ে সব ক’টি সুপারিশই গ্রহণ করা হলো, যথাবিহিত কার্যকর করা হবে। কিন্তু দয়িতের প্রতীক্ষা। কী উচ্চশিক্ষা, কী মধ্যশিক্ষা, কী প্রাথমিক শিক্ষা কিংবা প্রযুক্তিগত শিক্ষা বা সার্বজনীন শিক্ষা, কোনও ক্ষেত্রেই কমিশনের সুপারিশগুলির প্রতি যথেষ্ট মনঃসংযোগ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এবংবিধ বীতস্পৃহা, আমার কাছে অন্তত, মস্ত হেঁয়ালির মতো। রিপোর্ট দাখিল করবার আগে যথেষ্ট ভেবে-চিন্তেই সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বিশদ আলোচনা করে নিয়েছিলাম, প্রস্তাবিত সুপারিশগুলির বিবরণ শুনে তাঁদের তো খুশি-খুশিই লাগছিল তখন। প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পর সরকারের তরফে কেন এই ভাবগম্ভীর নীরবতা, ভেবে নির্ণয় করতে হিমশিম খেয়ে গেছি। রিপোর্টটি নিয়ে ভারতবর্ষের অন্যত্র নানা জায়গায় আলোচনা হয়েছে, জ্ঞানবান পত্র-পত্রিকাদিতেও হয়েছে, একমাত্র পশ্চিম বাংলাতেই সাড়াশব্দ নেই। কী উপলক্ষ্যে তিরুবনন্তপুরম গিয়েছি, ওখানকার এক পার্টি নেতা, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, অস্বস্তিকর প্রশ্ন করলেন: ‘তোমার রিপোর্টটি তো পড়ে দেখেছি, আমাদের কাছে অতি উৎকৃষ্ট মনে হয়েছে। তবে বাংলা পার্টি ওটিকে চেপে রেখেছে কেন? কয়েকটি কপি পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছি, সাড়া নেই।’ পশ্চিম বঙ্গ শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ওঁদের পছন্দ হয়েছিল বলে আমাকে কেরল থেকে আমন্ত্রণ জানানো হলো, ওঁরাও একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করছেন, আমি যদি অনুগ্রহ করে তার সভাপতির আসন গ্রহণ করতে সম্মত হই। হলাম, ওখানে গিয়েও রিপোর্ট লিখলাম, অভ্যর্থনা পেলাম। কিন্তু স্বভূমিতে স্তব্ধতা অব্যাহত, আজ পর্যন্ত।
কিছু-কিছু সমস্যা আঁচ করতে পারি। বশ্যতা বনাম দক্ষতার প্রশ্নে কমিশনে তীব্র, স্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছিল, তা সম্ভবত কারও-কারও অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণ। স্কলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নির্বাচনে উৎকর্ষের বিচার থেকে সরে আসা চলবে না, নির্বাচকমণ্ডলীর পছন্দ-অপছন্দ সর্ব ক্ষেত্রে মানতে হবে, মানদণ্ড প্রয়োগে যে কোনও প্রকার শ্লথতা অমার্জনীয়, ছাত্রদেরও শিক্ষকদের পড়ানোর মান নিয়ে অভিমত প্রকাশের অধিকার থাকবে, এরকম কিছু-কিছু সুপারিশ হয়তো অপছন্দের উদ্রেক করেছিল। এখন ভেবে দেখছি, তেমন মন খারাপ করবার বিশেষ অর্থ হয় না। গড়িয়ে-গড়িয়ে চলে আমাদের দেশ, সমাজ, গড়িয়ে-গড়িয়ে চলে রাজনৈতিক আন্দোলন, এমনকি বিপ্লবে-শপথ-নেওয়া রাজনৈতিক আন্দোলন পর্যন্ত। সবুরে মেওয়া ফলে, কিছু-কিছু বিষয়, যাদের প্রতি কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম, এই এতগুলি বছর বাদে সম্প্রতি নতুন করে আলোচিত হচ্ছে, সরকার একটু নড়েচড়ে বসেছেন। মণীশ ঘটকের বিখ্যাত পঙ্ক্তি, ‘অপেক্ষায় আছি বজ্ৰপাণি’: সেই প্রতীক্ষার ঋতু যদি এই এতগুলি বছরের ব্যবধানে অবসিত হয়, তা হলে তো আমার চরিতার্থ বোধ করা উচিত। সার্বজনীন শিক্ষার বিষয়ে অথবা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নির্বাচনে যোগ্যতার মাপকাঠিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যে-কথা দশ বছর আগে বলেছিলাম, তা যদি এখন রূপায়িত হতে শুরু হয়, আমার তো না রেখে-ঢেকেই আনন্দ প্রকাশ কর্তব্য।
কমিশনের প্রতিবেদনে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষাবিস্তারের সাংগঠনিক সমস্যাগুলির উপর। মনে পড়ে সাতাত্তর সালে সরকারে ঢুকে এক প্রকাশ্য সভায় শিক্ষামন্ত্রীদের উদ্দেশ করে বলেছিলাম, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা অনুগ্রহ করে বাড়িয়ে চলুন; চুরি করে থোক, ডাকাতি করে হোক, টাকার ব্যবস্থা করে দেবো। কিন্তু প্রশ্ন তো শুধু বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোরই না, বিদ্যালয়গুলিতে যথার্থ পঠন-পাঠন হয় কি না তা নিয়েও। যে-পার্টি সংগঠক কৃষক সভা করেন, পঞ্চায়েতের সঙ্গেও যুক্ত আছেন, আরও অসংখ্য দায়িত্বে হিমসিম খাচ্ছেন, তাঁকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ানোর দায়িত্ব দিলে কাজের কাজ কিছু না হবারই আশঙ্কা। শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে এক কাঁড়ি সুপারিশ দাখিল করা আছে। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কৃত্যের অগ্রাধিকার নির্ণয়ের সমস্যা কিন্তু এখনও ঝুলেই।
কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বাঙালি সমাজে প্রচুর ভাসা-ভাসা কথা হয়েছে, হচ্ছে। কমিশনের প্রতিবেদনে বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী থেকে কারিগরি শিক্ষার জন্য একটি আলাদা ধারা শুরু করার কথা বলা হয়েছিল। কেউ কান পেতেছেন বলে মনে হয় না।
দ্রুত শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার যে ব্যবস্থা দশ-পনেরো বছর আগে শুরু করা হয়েছিল, তাকে নীতিগত সমর্থন জানিয়েও কমিশন থেকে বলা হলো, সর্ব স্তরেই অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারভুক্ত সন্তানদের সেই সুবিধার বাইরে রাখা অনুচিত নয়, বিশেষ করে রাজ্য সরকারের যেহেতু ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না। সুপারিশটি এতদিনে কার্যকর করা হচ্ছে সেটা সুলক্ষণ। অন্য পক্ষে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারি মূলধন অনুপ্রবেশের কার্যকারিতা নিয়ে কমিশনের তরফ থেকে কিছু নাস্তিকতা প্রকাশ করা হয়েছিল; কর্তাব্যক্তিরা তা তেমন আমল দিয়েছেন বলে মনে হয় না, সম্ভবত দুটো কারণে: সরকারি তহবিলে অর্থাভাব, ও বিশ্বায়নের ঘোর।
একটি ছোটো ও একটি বড়ো আক্ষেপের কথাও বলতে হয়। কমিশনের সদস্যরা সবাই সহমত পোষণ করেননি, কিন্তু সংখ্যাধিক্যের বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনও স্তরে সংস্কৃত, বিকল্পে আরবি অথবা ফারসি, কয়েক বছরের জন্য অবশ্যপাঠ্য করা উচিত, মাধ্যমিক পরীক্ষাতেও অন্তত একটি ধ্রুপদী ভাষার জন্য কিছু নম্বর আলাদা বরাদ্দ রাখা শ্রেয়: আমাদের এই সিদ্ধান্তের প্রধান যুক্তি, বাংলা ভাষা যেমন তৎসম-তদ্ভব ক্ষেত্রে সংস্কৃতনির্ভর, আরবি-ফারসির প্রভাবও আমাদের ভাষায় কম পরিব্যাপ্ত নয়, ভাষার গহনে প্রবেশ করতে হলে এ ধরনের ধ্রুপদাঙ্গ শিক্ষা জরুরি। অভিমত আমি বদলাইনি, কিন্তু হিন্দুত্বওলাদের ক্রমবর্ধমান আস্ফালনের প্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার এই বিশেষ সুপারিশটি গ্রহণ করতে সম্মত হননি, মনে হয় আপাতত ভালোই হয়েছে।
আমার বৃহত্তর কাতরতা অন্যত্র। বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হবার বছর দেড়েকের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি পঠন বন্ধ করে তা যষ্ঠ শ্রেণী থেকে শুরু করবার নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। সিদ্ধান্তটিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তো বটেই, বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি অনতিতুচ্ছ অংশও, রেগে কাঁই। এত বড়ো আস্পর্ধা, বিদ্যালয়শিক্ষা অবৈতনিক করা হচ্ছে, অথচ আমাদের ঘরের ছেলেরা সরকারের পয়সায় একেবারে গোড়া থেকে ইংরেজি শেখার সুযোগ পাবে না, তা কি হয় নাকি? কলকাতা জুড়ে আন্দোলনের তোড়, ইংরেজি ভাষা সংকোচন-না সংকুচন-বিরোধী বহু সমিতির উদ্ভব; সমাজের নিচুতলার মানুষ বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাবেন, উচ্চতর শ্রেণীভুক্তদের অসুবিধা ঘটিয়েই পাবেন, এটা যাঁরা কিছুমাত্র পছন্দ করেন না, তাঁদের ঘোঁট-জোট-মহাজোট। কোনও-কোনও বামপন্থী মহলে পর্যন্ত ঈষৎ ঘাবড়ে যাওয়া অবস্থা। বাড়তি সমস্যা দেখা দিল, নতুন ব্যবস্থায় ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ভালোভাবে ইংরেজি শেখানোর জন্য যে সমস্ত পাঠ্যবই তৈরি হলো, তারা অতি বিদঘুটে। বৃটিশ সরকারের অর্থানুকূল্যে বিলেতে-ভাষা-পড়ানোর-পদ্ধতিতে-তালিম-নেওয়া কতিপয় বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দেওয়া হলো শিক্ষকদের ইংরেজি ভাষায় প্রণালী-পদ্ধতি শেখাবার, বাঙালিদের কলোনি-মুগ্ধতা তো চট করে ঘোচবার নয়। এই বিলিতি উটকো পদ্ধতি আমদানির ফলে হিতে বিপরীত হলো, শিক্ষকদের যথাযোগ্য শিক্ষণব্যবস্থার ক্ষেত্রে আরো বেশি ত্রুটি-দুর্বলতার অনুপ্রবেশ ঘটলো।
বিশদ আলোচনা করে কমিশনের অধিকাংশ সদস্য মত দিলেন, ষষ্ঠ শ্রেণীর বদলে পঞ্চম শ্রেণী থেকে ইংরেজি পড়ানো শুরু করা যেতে পারে, তবে সেই সঙ্গে প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তক নতুন করে রচনা এবং ইংরেজি ভাষা শিক্ষণ পদ্ধতির আমূল সংশোধন। রাজ্য সরকার প্রস্তাবটি আপাত দৃষ্টিতে মানলেন, সেই অনুযায়ী কিছু-কিছু প্রাথমিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হলো, কিন্তু স্বার্থান্বেষী সম্প্রদায় রণে ভঙ্গ দিলেন না, আক্রমণের অস্ত্র শানিয়ে যেতে লাগলেন। এক যুগেরও অধিক আগে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে নিষ্কান্ত হয়েছি, সুতরাং সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ-বর্জনের কলালিপির সঙ্গে এখন আর পরিচিত নই। বিভিন্ন কারণে বামফ্রন্ট আশি ও নব্বুইয়ের দশকে কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে জনসমর্থন কিছু হারিয়েছেন, পরিণামে আত্মবিশ্বাসও খুইয়েছেন খানিকটা। হঠাৎ নব্বুই দশকের উপান্তে ইংরেজি শিক্ষার ধারাক্রম পুনর্বিবেচনার জন্য এক-সদস্যের একটি কমিটি গড়া হলো, কমিটির পক্ষ থেকে নমুনা সমীক্ষার আয়োজন, প্রধানত শহুরে অভিভাবক ও মাস্টারমশাইদের মতামত যাচাইয়ের জন্য। মস্ত তাড়াহুড়ো করে নতুন ফরমান জারি হলো, এখন থেকে তৃতীয় শ্রেণীতে ইংরেজি পঠন শুরু। একবার চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে চাপ বাড়তেই থাকে; এখন শুনতে পাচ্ছি, প্রথম শ্রেণী থেকেই ইংরেজি ফিরিয়ে আনা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে, হয়তো ফের একটি কমিটি বসবে।
আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এর চেয়ে শোকান্তিক সিদ্ধান্ত কিছু হতে পারে না। যদিও হালে অবস্থার কিছু মোড় ফিরেছে, তা হলেও পশ্চিম বাংলায় এখনও জেঁকে-বসা নিরক্ষরতা সমস্যা, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে। সার্বিক সাক্ষরতা নিয়ে কিছুদিন ধরে দেশ জুড়ে, এবং পশ্চিম বাংলায়, প্রচুর শোরগোল হচ্ছে, তবে কাজের কাজ তেমন এগোচ্ছে বলে মনে হয় না। এই জেলায়-ওই জেলায় কোনওক্রমে ‘বর্ণপরিচয়’ শিখিয়ে বিরাটসংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে সাক্ষর করে তোলা হয়েছে বলে দাবি করা হয়, কিন্তু যাঁদের তালিম দেওয়া হলো, নিয়মিত ধারাবাহিক চর্চার অভাবে তাঁরা সহজেই ভুলে মেরে দেন। শিশুদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও ব্যাপক। প্রাথমিক স্তরে যে বালকবালিকারা বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে, তাদের বিপুল অংশ আসে শহর-শহরতলি-গ্রামের দরিদ্রতম পরিবারসমূহ থেকে। তাদের পিতামাতা বেশির ভাগই অক্ষরবিহীন, দৈন্যের পীড়নে তারা দীর্ণ, লেখাপড়ার পরিবেশ তাদের কাছে সুদূরবর্তী মরীচিকা। এই অবোধ শিশুদের উপর প্রাথমিক স্তর থেকে দু’টি ভাষার— মাতৃভাষা ও ইংরেজির—ভার চাপালে তারা তা বহন করতে পারবে না। তারা ভ্যাবাচ্যাকা খাবে, দু’টি ভাষার কোনওটিই কাজ-চালানো গোছেরও শিখে উঠতে পারবে না। তথ্য এমনিতেই বলে, পশ্চিম বাংলায় যে প্রায় নব্বুই লক্ষ ছেলেমেয়ে প্রতি বছর প্রাথমিক শ্রেণীতে ভর্তি হয়, মাধ্যমিক পরীক্ষার লগ্নে তাদের সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় মাত্র পাঁচ-ছয় লক্ষে, অধিকাংশের বিদ্যোদম মরুপথে হারিয়ে যায়। এই ভয়ংকর অবস্থার একাধিক কারণ উল্লেখ সম্ভব। তবে দারিদ্র্যই সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রাথমিক স্তরে ফের জমিয়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন ঘটলে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যাস্থলে অবস্থানের পিরামিড সংকীর্ণতর হতে বাধ্য।
যে-কথা ইতিপূর্বে বহু প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি, বাঙালি মধ্যবিত্ত আষ্টেপৃষ্ঠে সামন্ততান্ত্রিক লক্ষণে বাঁধা। গরিবরা দুটো ভাষা সামলাতে পারবে না, তাতে কী, আমাদের ছেলেমেয়েরা তো পারবে; একেবারে গোড়া থেকে তারা ইংরেজিতে তালিম না-পেলে বিভিন্ন সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না, বিশ্বায়নের দৌড়েও পিছিয়ে পড়বে। প্রধান-প্রধান সংবাদপত্রগুলিরও একই রা। এঁদের যদি বলা হয়, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন না, ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যে কী ব্যবস্থা, তাঁরা পাশ কাটিয়ে যাবেন। শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলি দেওয়া হয়েছে, নব্বুই দশকের প্রথম দিকে একমাত্র তামিলনাড়ু ব্যতীত অন্য কোনও বড়ো-সড়ো রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি পড়ানো হতো না; গুজরাটে আবশ্যিক ইংরেজি পড়ানো শুরু মাত্র নবম শ্রেণী থেকে। তবে এ-সমস্তই অরণ্যে রোদন। যাঁরা শ্ৰেণীস্বার্থান্ধ, এবং যাঁরা শ্রেণীস্বার্থান্ধদের ভয়ে ভীত, তাঁদের অবিমৃষ্যকারিতা কে ঠেকাবে?
প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া প্রয়োজন, তবে তার আগে অন্য একটি ক্ষুদ্র মন্তব্য সংযোজনের লোভ সংবরণ করতে পারছি না। শিক্ষা কমিশনের সূত্রে একজন-দু’ জন ব্যক্তির সংস্রবে আসতে হয়েছিল, যাঁদের মানসিকতা অতি বিচিত্র, তাঁরা গাছেরটাও পাড়বেন, তলারটাও কুড়োবেন। কে জানে, হয়তো এটাই যথার্থ সমাজদর্পণ।