আপিলা-চাপিলা – ৪

চার

তেতাল্লিশ সালে মান্দালয়ের অরণ্য ডিঙিয়ে আরাকান পেরিয়ে সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয় ফৌজ মণিপুর সীমান্তে; গোপন বেতারে সুভাষচন্দ্রের উদাত্ত আহ্বান, কুৰ্বানির বদলে আজাদি। এই লগ্নে লক্ষ-লক্ষ অভুক্ত মানুষ, নারী-পুরুষ-শিশু, শহরে ঢুকছে, প্রতি পাড়ায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সরকার উদাসীন। তখন আর ভাত ভিক্ষা করে পাওয়ার সম্ভাবনা পরপারে; মানুষগুলি খুদ ভিক্ষা করছে, ফান ভিক্ষা করছে। কোনও-কোনও গৃহস্থদুয়ারে হয়তো বা পাচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশ উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্তরা নিজেদের সংসার-পরিজনের সংস্থান নিয়ে ব্যস্ত। ওইরকম সময়ে যাদের সামর্থ্য আছে তারাও, স্পষ্ট বোঝা গেল, নির্দয়তার উপাসক। এখানে-ওখানে ক্কচিৎ একটি-দু’টি সরকারি লঙ্গরখানা, একটি-দু’টি বেসরকারি লঙ্গরখানা, কিন্তু যে-মানুষগুলি খিদেয় ধুঁকছে, তারা, একের পর এক, ক্রমশ রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ছে। দয়ালু কেউ-কেউ তাদের জিজ্ঞেস করছে, কী রে হাসপাতালে যাবি? সাড়া দেবার মতো শারীরিক শক্তি অধিকাংশেরই নেই। যাদের আছে, তারা কোনওক্রমে ঘাড় নেড়ে অস্ফুট উচ্চারণ করছে, না, একটু ফ্যান দাও বাবা।

এই মরা, প্রায়-মরা মানুষগুলিকে ডিঙিয়ে কলেজে যাই। এত ভয়ংকর দুর্বিপাক, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের দৈনন্দিন দিনাতিপাতের কর্মসূচি তেমন ব্যাহত হয় না। অথচ অকুণ্ঠ স্বরে বলতে হয়, কমিউনিস্ট পার্টি ও সেই দলের কর্মীদের দিনের পর দিন ধরে ত্রাণের কাজে লেগে থাকার কথা। কমিউনিস্ট পার্টি সেই মুহূর্তে খুবই একটা ভালো অবস্থানে নেই। জনযুদ্ধ নীতির ফলে সাধারণ মানুষের মনে দল সম্পর্কে দ্বিধা ছাপিয়ে সন্দেহ, সন্দেহ ছাপিয়ে বিতৃষ্ণা, ক্রোধ। মাত্র এক বছর আগে ঢাকা শহরের পূর্ব প্রান্তে তরুণ কমিউনিস্ট কর্মী, প্রতিভায় ভরপুর তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ সমাজবিরোধীদের হাতে নিহত হয়েছেন। সারা দেশ জুড়ে, শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে, তা নিয়ে গভীর বিক্ষোভ ও চিৎকৃত ধিক্কার। কিন্তু, মানতেই হয়, ঢাকা শহরে বিশেষ শোরগোল নেই। এমনও বলতে শোনা গেল, হাজার হলেও ছেলেটা বিপথগামী ছিল, কমিউনিস্ট দলে নাম লিখিয়েছিল। এই মানসিকতার মানুষগুলিরও বিতৃষ্ণাবোধ আস্তে-আস্তে উবে যেতে শুরু করলো কমিউনিস্ট কর্মীদের ত্রাণের কর্তব্যে অভাবনীয় অধ্যবসায় ও একনিষ্ঠতা দেখে। কয়েক বছর আগে বন্দীমুক্তি আন্দোলনে অবশ্য কংগ্রেস, এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন শাখার বামপন্থী গোষ্ঠী, সম্মিলিত প্রয়াস চালিয়েছিল। একটু-একটু করে বেশ কিছু রাজবন্দী ১৯৩৯ সাল থেকে শুরু করে পরের কয়েক বছর জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। তাঁদের একটি বড়ো অংশ কারাভ্যন্তরে মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়েছেন, কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্যের শপথে তাঁরা অবিচল। জনযুদ্ধনীতি ঘোষণার খানিক বাদে কমিউনিস্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত। একদা ঘোর স্বদেশী, বোমা পিস্তল নিয়ে শাসকদের উপর চড়াও হয়েছিলেন যে যুবককুল, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কমিউনিস্ট বনে যাওয়ায় এক ধরনের কুজ্ঝটিকা-সমাচ্ছন্ন মনোভাব বাঙালি মধ্যবিত্তর উপর চেপে বসলো। বেয়াল্লিশ সালে কিংবা তারও আগে যাঁরা জেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ অগস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাকক্ষে প্রত্যাবর্তন করলেন; যাঁরা কমিউনিস্ট হয়েছিলেন, তাঁরা করলেন না।

এই দোলাচলের মধ্যে মধ্যবিত্ত মানুষ দুর্ভিক্ষের করাল বিভীষিকায় অভিজ্ঞ হলেন, যা তাঁদের স্বার্থপর হতে শেখালো। সেই সঙ্গে তাঁদের মনে সুভাষচন্দ্রের আবেগে-উত্তাল-করা আহ্বানের ঘোর ও কমিউনিস্ট দল ও কর্মীদের সম্পর্কে বিতৃষ্ণার পাহাড় একটু-একটু করে উঁচু হয়ে উঠছিল। অথচ ঠিক সেই মুহূর্তে নতুন অভিজ্ঞান, মধ্যবিত্ত স্বার্থপরতাকে দুয়ো দিয়ে কমিউনিস্ট কর্মীরা দুর্গতদের-বুভুক্ষুদের-মরণাপন্নদের সাহায্যে নেমে পড়েছেন। তাঁদের উদ্যমের তুলনা নেই, তিতিক্ষার তুলনা নেই, আত্মত্যাগের তুলনা নেই। নানা সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান ত্ৰাণকার্যে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের দিকে কমিউনিস্ট কর্মীরা সহযোগিতার হাত বাড়ালেন, তাঁরাও বাড়ালেন। গোটা বাংলায় তিরিশ-চল্লিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঠেকানো গেল না। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণী কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি ঈষৎ অনুকম্পায়ী হতে শিখলেন। মজুতদারদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাঁরা নিজেরা পড়েননি, সেই লজ্জা তাঁদের। তবে তাঁদের পক্ষে যুক্তি ছিল, দুর্ভিক্ষের প্রধান হোতা বিদেশী শাসকবৃন্দ, যাঁদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা সরব হতে সেই প্রলয়ংকর মুহূর্তে আদৌ ইচ্ছুক ছিলেন না। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সে সময় দুঃসহ টানাপোড়েন: সোভিয়েট দেশকে না বাঁচালে ভবিষ্যতের সোনালি সমাজস্বপ্ন নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবে; সেই স্বপ্নকে বাঁচাতে হলে মিত্রপক্ষকে সমর্থন না করে উপায় নেই এই মহাযুদ্ধে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে এই তত্ত্ব বোঝাতে কালঘাম ছুটে যায়।

গ্রামে-গঞ্জে শহরে-বন্দরে সামাজিক দ্বন্দ্ব, যার মুক্তিস্নানে অবগাহন করে কমিউনিস্ট পার্টি, অন্তত বাংলার মাটিতে, গভীর শিকড় গাঁথলো। এই কাহিনীর মলিন দিক আছে, পাশাপাশি গৌরবের দিকও। পার্টির সাহস ও আদর্শনিষ্ঠায় প্রেরণা লাভ করে ক্রমশ বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে দলে দলে কিশোর-যুবক-তরুণ শ্রমিক-কৃষকের সমস্যা নিয়ে আলাদা করে চিন্তা করতে শিখলেন; শিখলেন কর্মী-কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-অভিনেতা-করণিক-সহ সামগ্রিক সম্প্রদায়। ঊনবিংশ শতকের বাঙালি উজ্জীবন নিয়ে অনেক চর্চা ও গবেষণা হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় গণনাট্য সংঘ-প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ ইত্যাদির নায়কত্বে যে-সাংস্কৃতিক বিপ্লব চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে তার পরের অন্তত তিরিশ বছর বাঙালি জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছিল, তা নিয়ে তেমন তন্নিষ্ঠ আলোচনা এখনও হয়নি। ‘নবান্ন’ নাটক সম্বন্ধে বহু কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ওই নাটক তো সবে সূচনা: নাটক ছাড়িয়ে লোকনৃত্য, লোকনৃত্য ছাড়িয়ে লোকগাথা, যাত্রা, মৃৎশিল্প, সাহিত্য, কাব্য, সংগীত, চিত্রাঙ্কন, স্থাপত্য, এমন কি সুনীল জানার মতো শিল্পীর ক্যামেরা নিয়ে সাধনা, তাপস সেনের আলো নিয়ে, খালেদ চৌধুরী মঞ্চসজ্জা নিয়ে। সবাই মানুন না-মানুন, এই মস্ত সাংস্কৃতিক উতরোলের উৎস দুর্ভিক্ষ-উত্তর সেই সমাজজিজ্ঞাসা থেকে।

কলিকালও অতিক্রান্ত হয়। একটা সময়ে বুভুক্ষু শিশুনারীপুরুষের ভিড় থিতিয়ে এলো, গ্রাম থেকে কেউ আর নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে না, যারা নিষ্ক্রান্ত হলো তাদের সংখ্যা নিঃশেষ, শহরের রাস্তায় কঙ্কালের জঞ্জাল অবসিত। জনমতের চাপে পড়ে সরকার খাদ্যশস্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিশপত্র সরবরাহের জন্য রাষ্ট্রীয় সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। নতুন বছরের ফসল গোলায় উঠলো। যে-তিরিশ লক্ষ মানুষ হারিয়ে গেল তাঁদের স্মৃতি ধূসর থেকে ধূসরতর, এই স্মৃতিধূসরতা ছাড়া বেঁচে-থাকা বাঙালিদের আত্মসমর্থনের হয়তো অন্য কোনও উপায় ছিল না। ১৯৪৪ সাল, খাদ্যের সমস্যা ছাড়া বস্ত্রেরও তখন প্রচুর অনটন। কিছু-কিছু মধ্যবিত্ত বাঙালি চোরাবাজারে টাকা কামাতে রপ্ত হলেন, প্রবোধকুমার সান্যালের মতো অনেকেই বাঙালি মধ্যবিত্তের বিবেকস্খলন নিয়ে গল্প-উপন্যাস রচনা করলেন। আমাকে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছিল যে-গল্প তা কিন্তু কোনও প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের রচনা নয়। সেই গল্প, ‘১৯৪৪ সাল’, লিখেছিলেন সোমনাথ লাহিড়ী। ঐ পর্যায়ে অনে বিবেক-মোচড়ানো কবিতাও লিখেছিলেন, বিষ্ণু দে-অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ। সুভাষ মুখোপাধ্যায়-বিমলচন্দ্র ঘোষ-সুকান্ত ভট্টাচার্যের নামোল্লেখ না করাও অনুচিত হবে।

কৈশোর থেকে সদ্য তারুণ্যে পৌঁছেছি। দুর্ভিক্ষ পেরিয়ে এলাম, গতানুগতিকতার মধ্যে সেঁধিয়ে গেলাম। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের দ্বিতীয় বছর, দুর্ভিক্ষের বিভীষিকা ঠিক ভুলে ওঠা যায় না। তবে তাতে কী, আমাদের যৌবন তার দাবি থেকে তো সরে আসবে না। সুতরাং একটু-একটু পড়াশুনো, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সামান্য অনুপ্রবেশ, উঁচু ধাপের গণিতে দখলদারির চেষ্টা, কিছু-কিছু বাংলা-ইংরেজি সাহিত্য পাঠ। কলেজে চমৎকার শেক্সপিয়র পড়াতেন অধ্যাপক প্রফুল্লনাথ রায়। পক্ককেশ, চোখে পুরু কাঁচ, তাঁর শাণিত ইংরেজি উচ্চারণ আমাদের ষষ্ঠাদশ শতকের মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডে পৌঁছে নিয়ে যেত। যে-ক’জন অধ্যাপক বাংলা সাহিত্য পড়াতেন, তাঁদের অন্তত একজনের কথা এখনও মনে আছে; কৌতুকের রসদ আছে সেই কাহিনীতে। কাব্যালোচনায় অধ্যাপক মশাইয়ের ‘সমান্তরাল অনুচ্ছেদ’ উল্লেখ করার ঝোঁক। সন্ন্যাসী উপগুপ্তের মধ্যরাতে মথুরাপ্রান্তে পীড়াপন্না নাগরিকাকে পরিচর্যা করবার প্রসঙ্গে তিনি হঠাৎ ‘পতিতা’ কবিতা থেকে প্রচুর ভাব দিয়ে আবৃত্তি করলেন: ‘মথুরাতে কত মুগ্ধ হৃদয় স্বর্গ মেনেছে এ দেহখানি’। দুর্বিনীত আমি, চট করে উঠে নম্র প্রতিবাদ জানালাম, স্যার, ওটা ‘মথুরাতে’ নয়, ‘মধুরাতে’। ওই অপ-উক্তির জন্য ক্লাস থেকে সেদিন বহিষ্কৃত হয়েছিলাম।

আরও একটি গল্প বলবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। জ্বর গায়ে আই.এ. পরীক্ষা দিতে বসেছি। ‘সিক রুম’, কলেজেই একটি আলাদা ঘরে আমি একা। রসায়ন বিভাগের এক কড়া অধ্যাপক পাহারা দিচ্ছিলেন: আমার পিতৃবন্ধু, অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাদুকা ব্যবহার বিসর্জন দিয়েছিলেন, কেউ কেউ তাই জনান্তিকে তাঁকে ‘গান্ধি’ বলে উল্লেখ করতো। কলেজের অধ্যক্ষ অতি অমায়িক ভালো মানুষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার তুখোড় ছাত্র, কিন্তু বাঘা যতীনের মন্ত্র শিষ্য নাম শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ। অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় লুকিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। আমেরিকায় গিয়ে ঘরসংসার পাতেন; পঁচিশ বছর বাদে দেশে প্রত্যাবর্তন। দেশে ফেরার কয়েক বছর বাদে আমাদের কলেজে অধ্যক্ষ হয়ে আসেন। মোটা থলথলে শরীর, শ্বেতশুভ্র ধুতিপাঞ্জাবি পরিহিত, ফিনফিনে শৌখিন চাদর গায়ে জড়ানো। আমাদের সদাসখাসহচরশুভানুধ্যায়ী। গণিতে স্ট্যাটিক্স-ডিনামিক্সের পরীক্ষা, আমার শরীরে জ্বর, তেমন মনঃসংযোগ হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি অঙ্কের সমাধানে পৌঁছুতে পারছি না, এমন সময় ত্রস্ত অধ্যক্ষ মহোদয়ের প্রবেশ, পাহারাদেনেওয়ালা গান্ধিবাদী অধ্যাপককে তিনি ফিসফিস করে বললেন, ‘ওকে বলে-টলে দিচ্ছেন তো?’ ওকে মানে আমাকে। অধ্যক্ষ বদান্য হলে কী হবে, সেই অধ্যাপক একে নীতিনিষ্ঠ, তায় কড়া ধাঁচের মানুষ, আমার কোনোই সুরাহা হলো না, শুধু, এখনও মনে আছে, যখন শেষ ঘণ্টা বাজলো, পরীক্ষার খাতা তাঁকে সমর্পণ করতে গেলাম, চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘তুই একটা গাধা’। আমার গাধাত্ব সম্পর্কে আমার নিজেরও কোনও সংশয় ছিল না, কারণ সেই ঋতুতে আমি, আকণ্ঠ, কবিতায় এবং বন্ধুদের প্রতি অনুরাগে মজেছিলাম। পরীক্ষার ফল তবু যে গুরুজনদের ও মাস্টারমশাইদের খুশি করতে পেরেছিল, তা নেহাতই কাকতালীয়।

জগন্নাথ কলেজের লাইব্রেরিটি প্রাচীন, কিন্তু তখনও চমৎকার গুছিয়ে রাখা। গ্রন্থাগারিক ভদ্রলোক, যামিনীরঞ্জন ধর, আমার ডাঁই-করা বই নেওয়া দেখে প্রথম দিকে একটু সন্দিগ্ধ ছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন, আমি পড়া-পড়া খেলা করছি: বই নিচ্ছি, পরের দিনই ফেরত আনছি, নতুন বই নিচ্ছি, আবার ঝটপট ফেরত দিচ্ছি। কয়েক সপ্তাহ বাদে বুঝলেন, বইয়ের প্রতি আমার আগ্রহ নিছক লোক-দেখানো নয়। নিজেই তিনি তখন কী বই পড়লে উপকৃত হবো, সেই উপদেশ দিতে শুরু করলেন। এক সঙ্গে আটটি বই বাড়ি নিয়ে যেতে দিতেন, আমার উৎসাহের শেষ নেই। ইন্টারমিডিয়েট পড়বার ওই দু’বছর সাহিত্যকাব্যইতিহাসদৰ্শন-সংক্রান্ত যত বই পড়েছি, তা বোধহয় পরবর্তী কোনও পর্যায়েই ছুঁতে পারিনি। এমন নয় যে প্রতিটি গ্রন্থই আমি সমান বুঝতে পারতাম, অথবা তা থেকে সমান আনন্দ পেতাম। কিন্তু এটুকু অন্তত হৃদয়ঙ্গম হয়েছিল, জ্ঞানের ঈশান-নৈঋতসদৃশ অনেকগুলি দিক আছে, সেগুলি প্রব্রজ্যায় অন্তত একবার করে না বের হতে পারলে মানব অস্তিত্ব ব্যর্থ। কী পড়তাম তখন? এক কাঁড়ি অল্ডাস হাস্কলি, ডি এইচ লরেন্স, বার্নাড শ, ইবসেন, হামসুন, বালজাক, শেকভ, দস্তয়ভস্কি, মেটারলিঙ্ক, এমনকি বাল্টিক ঔপন্যাসিক সিলানপা পর্যন্ত। কবিতায় প্রধান ঝোঁক অবশ্য ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’-পরবর্তী যত কিছু লেখা হচ্ছিল তাদের প্রতি। ইংরেজি ভাষার কবিদের মধ্যে পাউন্ড-এলিয়ট-স্পেন্ডার- কামিংস-অডেন তো আছেনই। ফরাশি কিংবা ইতালিয়ান কাব্য তেমন বেশি নয়, এমনকি অনুবাদেও নয়। মন কেড়ে নিয়েছিল প্রধানত শেক্সপিয়রের নাটক এবং সনেটগুচ্ছ, কিছু পরিমাণে কীটস-শেলী-ব্রাউনিং, তবে সবচেয়ে আকর্ষণ করতো তথাকথিত মেটাফিজিক্যাল কবিকুল, ডান ও হেরিক তাঁদের মধ্যে প্রধান। ইতিহাস, জীবনী ও আত্মজীবনী, ভারতবর্ষের-ইংল্যান্ডের-ইওরোপের-সোভিয়েট দেশের ইতিবৃত্ত, সেই সঙ্গে আমেরিকারও। জীবনী ও আত্মজীবনীতে আমার রুচির তেমন ছুঁতমার্গ ছিল না, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক নেতাদের জীবনী যেমন পড়তাম, তেমনই ক্রিকেট বীরদের, কিংবা চিত্রজগতের নায়ক-নায়িকাদের পর্যন্ত, নয়তো বার্বেজ অথবা বিয়ারবম ট্রী-র মতো মস্ত অভিনেতাদের।

জগাখিচুড়ি সময়, জগাখিচুড়ি সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ, পড়াশুনোও তথৈবচ। তবে যে-শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ করেছিলাম, যে-সমাজব্যবস্থার মধ্যে আবদ্ধ ছিলাম, তাতে এমন মিশ্রণ সম্ভবত অপ্রতিরোধ্য। সেই সব বই পড়ার কোনও স্মৃতি এখন আর বহন করি না, তবু কী করে অস্বীকার করি আমার মানসিক গঠন ক্রমে-ক্রমে যে-পরিণতিতে পৌঁছেছে, তার পলিমাটি সেই দুর্ভিক্ষ-সদ্যোত্তীর্ণ পরিবেশ থেকে গৃহীত, সেই এলোপাথাড়ি পড়াশুনো থেকে আহৃত।

তাই কী সব? আমার মনে অন্তত কোনও দ্বিধা নেই, ভালো হোক মন্দ হোক, কুৎসিত হোক সুন্দর হোক, মোলায়েম হোক কর্কশ হোক, যে মানসিকতায় আমি কুড়ি বছর বয়সের পর থেকে উত্তীর্ণ, তার প্রধান রস সিঞ্চিত হয়েছে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিরবচ্ছিন্ন সান্নিধ্য থেকে। প্রধান সেই বন্ধুদের কথা একটু বলি। স্কুলে বরাবর আমার সঙ্গে যে পড়েছে, যার সঙ্গে সেই বছরগুলিতে আমার সবচেয়ে বেশি সখ্য ছিল, যে আমাদের বক্সীবাজারস্থ ‘অমিতশ্রী’ বাড়ির বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সাইকেল চেপে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিত, তার নাম জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রবেশিকা পরীক্ষার পর সে চলে যায় প্রেসিডেন্সি কলেজে, কলেজ স্ট্রীট ও হ্যারিসন রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত ওভারটুন হলের ওয়াই.এম.সি.এ আবাসনে সে থাকতো। সপ্তাহে দু’ দিন-তিন দিন তার চিঠি আসতো কলকাতা থেকে, আমার চিঠি যেত ঢাকা থেকে। কৃষ্ণচূড়ার প্রচ্ছায়ায় আড্ডা দেওয়ার বিকল্প যেন এই চিঠির আদানপ্রদান। ওভারটুন হলে তার ঘরসঙ্গী কাস্টমসে কর্মরত এক যুবক, সুরঞ্জন সরকার। জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি লেখার উৎসাহ দেখে, কিংবা কবিতা-সাহিত্যপ্রসঙ্গ-ঠাসা আমার চিঠির বিভঙ্গের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, সুরঞ্জন সরকারও আমাকে চিঠি লিখতে শুরু। তবে নিজেকে খানিকটা আড়ালে রাখার জন্যই বোধহয় চিঠিতে প্রথম দিকে, তার স্বাক্ষর থাকতো সুপ্রিয় সোম। শৌখিন চিঠির কাগজ নাগালের বাইরে, আমি চিঠি লিখতাম শাদা ফুলস্ক্যাপ কাগজে, ছ’ পৃষ্ঠা থেকে বারো-চোদ্দো পৃষ্ঠা জুড়ে। জ্যোতিষের চিঠি স্বল্পায়ত কিন্তু সুপ্রিয় সোম-নামী ছদ্মবেশীর আমার সঙ্গে দৈর্ঘ্যের প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিয়ে যাওয়া। সে-সব চিঠিতে কবিতার উদ্ধৃতি, সদ্য-পাঠ-করা-উপন্যাস বা জীবনীগ্রন্থের উল্লেখ, রাজনীতির কথা, সিনেমা-নাটকের প্রসঙ্গও, পরচর্চা। তবে সব ছাপিয়ে কবিতারই উল্লেখের পর উল্লেখ। যেমন কবিতায় মজেছিলাম, পরস্পরেও সম্ভবত সমান মজেছিলাম, কাব্যসম্ভোগের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক অনুরাগে। জীবনানন্দ দাশ-বিষ্ণু দে-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-বুদ্ধদেব-অজিত দত্ত-অমিয় চক্রবর্তীদের কাব্যপ্রসঙ্গ, কার কোন কবিতা আমার বা সুরঞ্জন সরকার দ্বারা সদ্য পঠিত, তার আবেগাপ্লুত বিবরণ। সেখানেই আমাদের উৎসাহ রুদ্ধগতি হতো না। নিজেদের কবিতাচর্চার কাহিনীও চিঠিতে-চিঠিতে বিনিময় প্রতিবিনিময় হতো। পরম সৌভাগ্য, সে-সব কবিতা নিরাপদে হারিয়ে গেছে। সে বয়সে যা স্বাভাবিক, কোনও কবিতাই ঠিক নারীপ্রসঙ্গবিবর্জিত ছিল না। একটি-দু’টি চরণ এখনও মাঝে-মধ্যে স্মৃতিকে আলগোছে চিমটি কাটে। যেমন, সুরঞ্জনের কোনও চিঠিতে হঠাৎ মক্সো: ‘হাওড়া স্টেশনের মতো মেয়েদের দূর থেকে সুন্দর দেখায়।/ তারপর কাছে গেলে নানাবিধ আঁকিবুকি দাগ।/যে মেয়ের প্রোফিল ভালো তার দাঁত ভালো নয়,/বুদ্ধির উজ্জ্বল আলো নিভে গেলে বেকা বিস্ময়’। ওরই কাছাকাছি সময়েই কি আমি একটি চৌপদী লিখে পাঠিয়েছিলাম: ‘উত্তর হতে কন্‌কনে হাওয়া বয়,/শীতের শিশির আনে কোন অনুনয়?/ ট্রামে-বাসে কিছু বুনন-নিরতা মেয়ে,/ কাঁহাতক শীত এড়ানো সেদিকে চেয়ে?’

ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছি। ওটাও কিঞ্চিৎ আকস্মিকতা। গুরুজনরা চাইছিলেন আমি অর্থবিজ্ঞানের ছাত্র হই। কিন্তু আই.এ পরীক্ষায় ইংরেজিতে অবিশ্বাস্য ভালো করায়, এবং নিজের প্রগাঢ় কাব্যপ্রীতির জন্য, আমার আগ্রহ ছিল ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি। যেদিন ভর্তি হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম, ইংরেজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ রায় মশাই একটু দেরি করে এলেন; অশান্ত আমি, অধৈর্য আমি, অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডক্টর হীরেন্দ্রলাল দে-র ঘরে ঢুকে গেলাম। তারপর থেকে এই প্রায় ষাট বছর সেই জোয়াল বইছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ-মার্বেলে মোড়া অন্তহীন-প্রতীয়মান-হওয়া সুদীর্ঘ করিডোর, এ-মাথা থেকে ও-মাথা এক ঘণ্টায়ও যেন অতিক্রম করা যায় না, তার বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা, সেই গোলকধাঁধায় প্রথম-প্রথম হারিয়ে যাওয়ার ভয়। এই আশ্চর্য অট্টালিকা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে পূর্ববঙ্গ ও অসম প্রদেশের প্রশাসনিক পীঠস্থান হিশেবে ইংরেজ প্রভুরা তৈরি করিয়েছিলেন। কিন্তু দিল্লির দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদ, ওই মস্ত দালানে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহল খোলা হলো। রমনা জুড়ে বকুল-রাধাচূড়া-বট-অশ্বত্থদলের বিস্তীর্ণ প্রান্তর ও ঘন বনরাজি জুড়ে ইতস্তত-ছড়ানো যে দালানকোঠা, যা উঁচু আমলাদের জন্য প্রায় একই সময়ে তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দের আবাস হিশেবে ঘোষিত। বলা হতো কেমব্রিজ-অক্সফোর্ডের কায়দায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো, ওখানকার বিভিন্ন কলেজের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনটি আবাসিক হল, ঢাকা, জগন্নাথ আর সলিমুল্লা মুসলিম হল। প্রায় কুড়ি বছর বাদে যখন মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল, আর একটি হল সংযোজিত হলো, ফজলুল হক মুসলিম হল। তা ছাড়া প্রতিটি হলে অনাবাসিক, ঢাকা শহরে বাস-করা-ছাত্রদের ভর্তির ব্যবস্থা। মেয়েদের জন্যও একটি আলাদা হস্টেল, যাকে বিলিতি কায়দায় বলা হতো ‘চামারি’। আনুমানিক কুড়ি জন ছাত্রীর আবাসনের ব্যবস্থা ছিল সেখানে, যদিও তার দ্বিগুণ-তিনগুণ মেয়ে শহর থেকে পড়তে আসতো। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হলাম, চার হল মিলিয়ে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা অন্তত দুই হাজার, যার মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা দুশো। অনাবাসিকদের মতে, প্রত্যেকটি ছাত্রীকেও কোনও একটি হলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হতো।

বিশের দশকে সারা দেশ থেকে ছেঁকে অধ্যাপক ও অন্যান্য শিক্ষকদের আমন্ত্রণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, অনেকে এসেছিলেন খোদ বিলেত থেকে। প্রথম পর্বের বেশ কয়েকজন উপাচার্য তো খাঁটি সাহেব, অক্সফোর্ড বা কেম্‌ব্রিজের প্রখ্যাত ডন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য প্রদেশের গভর্নর। বিশ-তিরিশ-চল্লিশের দশক জুড়ে বাইরেটা টলমল, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি-পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রধানত আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, রমনার মায়াবী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে ছড়ানো-ছিটনো, সময়ের গতি ঢিমেতাল। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে অধ্যাপকদের নিবিড় সম্পর্ক। প্রথম বর্ষ থেকেই টিউটোরিয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা, যা ছাত্র-অধ্যাপকদের পারস্পরিক বন্ধন আরও দৃঢ় করে আনে। প্রতিটি হলে আলাদা বিনোদন-কক্ষ, যেখানে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় বিতর্ক কিংবা বক্তৃতা, সাহিত্যসভা কিংবা সংগীতের আসর বসে। প্রতিটি হলে বার্ষিক নাট্য-উৎসব ছাড়াও বিভিন্ন ঋতুতে আনন্দসন্ধ্যার আয়োজন, ঢাকা-জগন্নাথ হলে একটু বেশি, সলিমুল্লা হলে একটু কম। প্রতিটি হলেই ছাত্র ইউনিয়নের সুঠাম ব্যবস্থা, যার জন্য বার্ষিক নির্বাচন, দুরন্ত পার্লামেন্টারি কায়দায়। প্রতি হলে একজন করে প্রভোস্ট এবং অন্তত দু’জন করে হাউজ টিউটর, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী থেকেই মনোনীত। প্রভোস্টের তত্ত্বাবধানেই প্রতিটি হল-ইউনিয়নের পরিকাঠামো। হলের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রছাত্রীরা আট-দশ জন প্রতিনিধি নির্বাচন করতেন, তাঁদের মধ্যে একজন প্রধান প্রতিনিধি, যাঁকে অন্য দুই হলে বলা হতো সহ-সভাপতি, সভাপতি অবশ্যই প্রভোস্ট। তবে ঢাকা হলের ক্ষেত্রে প্রধান ছাত্র প্রতিনিধি প্রধান মন্ত্রী রূপে আখ্যাত হতেন। তা ছাড়া ছিলেন সাহিত্য সম্পাদক, যিনি হল-ম্যাগাজিনেরও সম্পাদক, ক্রীড়া-সমাজসেবা-সংস্কৃতি-নাট্য সম্পাদক ইত্যাদি। ঢাকা হলের প্রধান মন্ত্রীদের মধ্যে পরবর্তী যুগে যাঁরা দেশবিখ্যাত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন কেন্দ্রের প্রাক্তন আইন মন্ত্রী অশোক সেন, প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নের অধ্যাপক প্রতুলচন্দ্র রক্ষিত, এমন আরও অনেকে। তিন হলের ছাত্রছাত্রীদের যৌথ ভোটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠিত হতো, তারও আলাদা কার্যক্রম। ছাত্রীদেরও আলাদা নিজেদের ইউনিয়ন ছিল।

বহু বছর ঢাকা হলের প্রভোস্ট বা আচার্য হিশেবে সমাসীন ছিলেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ; তিনি ১৯৪০ সালে বাঙ্গালোরে চলে গেলে আচার্য নিযুক্ত হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু: তাঁর নিজের গভীর অনিচ্ছা, কিন্তু ছাত্রদের বিশেষ আগ্রহ, প্রভোস্ট হতে সম্মত হতে হলো তাঁকে। ছাত্রদের কোনও গুরুজনের কাছ থেকে কী ধরনের প্রশ্রয় পাওয়ার ব্যাকুলতা, আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাদের কেন এমন নিশ্চিন্ত প্রত্যাশা, তার একটি দৃষ্টান্তমণ্ডিত কারণ উল্লেখ করি। তিনি ঢাকা হলের প্রভোস্ট, হলের ছেলেরা কী তুচ্ছ ব্যাপারে অন্য কোন হলের ছেলেদের সঙ্গে মারামারিতে প্রবৃত্ত হয়েছে, ঘুষোঘুষি, হকি স্টিকের আস্ফালন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, তাঁর সহকারীরা, শিক্ষকবৃন্দ ও দুই হলের প্রভোস্ট ছুটে এসেছেন, ঢাকা হলের ছেলেরা একটু থমকে গিয়ে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে জটলা করছে। এমন সময় দেখা গেল প্রভোস্ট সত্যেন্দ্রনাথ বসু, বিস্রস্ত কাঁচা-পাকা চুল, পুরু কাচের চশমার আড়ালে চোখের তীব্র দৃষ্টি, জোর পায়ে ছেলেদের দিকে আসছেন। সবাই সন্ত্রস্ত, কী জানি কী প্রচণ্ড বকুনি দেবেন এবার। কাছে এসে হঠাৎ বাঁ হাত বাড়িয়ে তিনি কোমল গলায় বললেন, ‘একটা সিগারেট দিবি?’

প্রথম পর্বে জগন্নাথ হলে প্রভোস্ট ছিলেন সাহিত্যিক ও আইনবিশারদ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত; তিনি ঢাকা থেকে চলে এলে দীর্ঘ দিন ধরে রমেশচন্দ্র মজুমদার ওই পদে সমাসীন ছিলেন। ঊনিশশো বেয়াল্লিশ সালে তিনি উপাচার্য পদে বৃত হওয়ায় দর্শনের অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্য মহাশয় এবার জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের পদে। সলিমুল্লা হলে প্রায় দুই দশক ধরে প্রভোস্ট অধ্যাপক মুহম্মদ হাসান। তিনি রমেশচন্দ্র মজুমদারের পর উপাচার্য পদে বৃত হলে তাঁর পরিত্যক্ত আসন গ্রহণ করেন মাহমুদ হুসেন, ইতিহাসের অধ্যাপক, ষাটের দশকে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি ডক্টর জাকির হুসেনের অনুজ। মাহমুদ হুসেন সাহেবের মতো সজ্জন বিদ্বান মানুষ সর্ব ঋতুতেই অতি বিরল। পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর তিনি ওই দেশের বিদেশ মন্ত্রী হয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য।

বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত বিশের দশকের উপান্তে ও তিরিশের দশকের গোড়ায় জগন্নাথ হলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা হলের বার্ষিক মুখপত্র ‘শতদল’, জগন্নাথ হলের ‘বাসন্তিকা’। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও বহু বছর ওঁরা দু’জনেই ‘বাসন্তিকা’-র জন্য লেখা পাঠিয়েছেন, অধিকাংশই কবিতা। ‘শতদল’-এ যাঁরা লিখতেন তাঁদের হয়তো ততটা বাইরে পরিচিতি ছিল না। একজনের কথা মনে পড়ে, কানাইলাল মুখোপাধ্যায়, ছাত্রাবস্থায় ভালো ছোটো গল্প লিখতেন, জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে কলকাতায় ফার্মা কে এল এম নামে প্রকাশনা সংস্থা খুলেছিলেন। তাঁর প্রেমের-মদিরতা-মাখানো এক গল্প এখনো স্মৃতিতে ভাসে, একটি গানের দু’টি চরণ তাতে অন্তর্ভুক্ত, ‘অসীম হতে এলো তোমার আক্রমণ, এই কি আমার হেরে যাওয়ার ক্ষণ?’

সলিমুল্লা হলে আমার সমসাময়িক যে-ছাত্ৰকুল ছিলেন তাঁদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগরে জন্ম নেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি; তাঁর অন্যান্য সহকর্মীও অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। তবে বাঙালি সমাজের এমনই বিচিত্র লীলা, আমাদের সময়ে ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ছিলেন মুহম্মদ তোয়াহা, পরে ওই দেশের প্রধান নকশালপন্থী নেতা: কখনও জেলে যাচ্ছেন, কখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন; কয়েক বছর হলো গত হয়েছেন, মৃত্যুর পূর্বে আকর্ষণীয় একটি আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দের কয়েকজনের কথা উপরে ঈষৎ উল্লেখ করেছি, এবার একটু বিশদে যেতে হয়। প্রায় হলফ করেই বলতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পঁচিশ বছর প্রায় যে-কোনও বিভাগে শিক্ষকমণ্ডলীর জ্ঞান, মেধা ও প্রতিভার জুড়ি সারা দেশে ঢুঁড়ে পাওয়া সত্যিই মুশকিল হতো। প্রথম দিকে বাঙালি মনীষীদের মধ্যে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুশীলকুমার দে, মোহিতলাল মজুমদার, কালিকারঞ্জন কানুনগো, সুশোভন সরকার; বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের নাম পূর্বেই করেছি, যেমন করেছি দর্শনের অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের উল্লেখ। প্রথম দিকে দুই দুঁদে উপাচার্য ল্যাঙলি ও হার্টগ সাহেব, বাংলা সাহিত্য বিভাগে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও জসিমুদ্দিন, পদার্থবিজ্ঞানে কে. এস কৃষ্ণন, ওয়াল্টার জেন্‌কিনস, কেদারেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সতীশরঞ্জন খাস্তগীর, যাঁরা পরবর্তী কালে কলকাতায়, বাঙ্গালোরে ও কাশীতে প্রথিতযশা বিজ্ঞানী হিশেবে নাম কিনেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে আরও ছিলেন আমার পিতৃবন্ধু কাজী সাহেব, কাজী মোতাহার হোসেন, রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ সনজীদা খাতুনের বাবা।

সুশীলকুমার দে-র মতো সুদর্শন পুরুষ খুব কম দেখেছি। কখনও স্যুট-টাইয়ের নিখুঁত বিলিতি সাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন, কখনও নিটোল বাঙালি পোশাকে, উভয় বেশেই তিনি অনিন্দ্যকান্তি। পড়াতেন অসম্ভব ভালো; বিশেষ করে, বলেই ফেলি, ছাত্রীদের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর জুড়ি ছিল না। তিনিই সম্ভবত একমাত্র অধ্যাপক যিনি বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন: ইংরেজি থেকে স্বেচ্ছায় বাংলা সাহিত্য পড়ানোয় চলে যান, পরে বাংলা থেকে সংস্কৃতে। তাঁর ‘বাংলা প্রবাদ’ বিখ্যাত গ্রন্থ, বাংলা প্রাচীন সাহিত্য নিয়ে তাঁর গবেষণার গভীরতা কিংবদন্তী। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না, তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যের ঢঙে অনুপ্রাসের নিক্কণ-সমাচ্ছন্ন দেদার কবিতা লিখেছিলেন একদা, যা অন্তত ‘বাসন্তিকা’ ও ‘শতদল’-এ নিয়মিত মুদ্রিত হতে দেখেছি, পরে বই হয়েও বেরিয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যিনি প্রধান অধ্যাপক ছিলেন তাঁর পাণ্ডিত্য অনস্বীকার্য, তবে তাঁর রুচির সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি তখনই আমাদের পীড়া দিত। সেটা তিরিশের দশকের মাঝামাঝি সময়, এক অতিশয় বুদ্ধিমতী প্রতিভাময়ী ছাত্রীকে তিনি ক্লাস থেকে একদিন বের করে দিয়েছিলেন। ছাত্রীটির অপরাধ, তিনি হাত-কাটা ব্লাউজ, যা নাকি অধ্যাপকের বিচারে অশ্লীল, পরে ক্লাসে এসেছিলেন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বোধহয় উজ্জ্বলতমা ছাত্রী সেই মহিলা তবে ছাড়বার পাত্রী নন তিনি, প্রতিবাদের ঝড় তুললেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অধ্যাপককে তাঁর ফরমান প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন। এই শিক্ষক মহোদয়ের অধ্যয়নের ভঙ্গিতে একটি বিশেষ মুদ্রাদোষ ছিল, ডাইসি এই বলেছেন, মন্তেস্ক্যু এই মন্তব্য করেছেন, অন্য অমুকে এই বলেছেন, অন্য তমুকে যা বলেছেন তা এই: ডাঁই-করা বই নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন, সে-সব বই থেকে প্রভূত উদ্ধৃতি বের করে শোনাতেন। তিনি নিজে কী বলছেন তা জানবার সৌভাগ্য আমাদের কোনওদিন হতো না।

সাম্মানিক ‘ইংরেজি আমার পড়া হলো না, তবে সাবসিডিয়ারি বিষয় হিশেবে ইংরেজি ছিল, তাই ওই বিভাগের অধ্যাপকদের সঙ্গে পরিচিত হতে সময় লাগেনি। হাসান সাহেব উপাচার্য হওয়ার পর ইংরেজির প্রধান অধ্যাপকের পদ অলঙ্কৃত করেন সত্যেন্দ্রনাথ রায়। জ্ঞানী মানুষ, কিন্তু তার চেয়েও যা বড় কথা, অমন নিখাদ ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। টিউটোরিয়াল ক্লাসে তাঁর ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে কত যে দৌরাত্ম্য করেছি তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর উদারচেতনা সম্পর্কে একটি গল্প, তাঁর সম্পর্কে-নাতনি মালিনী ভট্টাচার্য কিছুদিন আগে আমাকে শুনিয়েছিলেন। অধ্যাপক রায়ের এক ভ্রাতুষ্পুত্র, অসম্ভব দুরন্ত, তাঁর বাড়িতে কিছুদিন ছিল। তার যন্ত্রণায় বাড়ির অন্য সবাই কাতর, একমাত্র ডক্টর রায় স্থিতধী, অবিচল। তাঁর পড়ার টেবিলে চিনে পোর্সিলিনের অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য ও দামি মস্ত একটি মৃৎপাত্র অবস্থান করছিল। ভ্রাতুষ্পত্রটি একদিন অপরাহ্ণে জ্যেঠুর কাছে আবদার জানালো, দার্শনিকসম্মত গলায়, ‘জ্যেঠু, আমার এটা ভাঙতে ইচ্ছে করছে’। জ্যেঠু সস্মিত হেসে বললেন, ‘ভাঙো। ভ্রাতুষ্পত্র সঙ্গে-সঙ্গে ভেঙে খানখান করলো মৃৎপাত্রটি।

ইংরেজি সাহিত্যের আরও কয়েকজন অধ্যাপকের কথা বলতেই হয়। অধ্যাপক রায়ের মতোই ভালো মানুষ, মৃদু স্বভাব, সুকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, পরে কলকাতাস্থ চারুচন্দ্র কলেজে সত্যেনবাবু যখন অধ্যক্ষ হন, সুকুমারবাবু সহ-অধ্যক্ষ, তাঁর উপরও আমরা প্রচুর অত্যাচার চালিয়েছি। আর ছিলেন শ্রীমতী চারূপমা বসু, হার্ডি পড়াতেন। আমাদের মতো দুরন্ত ছেলেদের সঙ্গে পেরে উঠতেন না। আমার মাতৃদেবীর সহপাঠিনী, তা হলেও তাঁকে আদৌ আমল দিতাম না। তবে তিনি মেয়েদের ‘চামারী’-র তত্ত্বাবধায়িকা ছিলেন। আমাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সাহসী কেউ-কেউ ওই আবাসিকায় গিয়ে কোনও মেয়ের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলে তাঁর অনুমতি নিতে হতো। তাই দায়ে পড়ে আমরা ক্রমে-ক্রমে সভ্যভব্য হতে শিখলাম। ইংরেজি বিভাগে আর ছিলেন বিশালবপু শ্ৰীশ দাস, বাংলা সাহিত্যেও যাঁর সমান আগ্রহ, একদা ‘আমার বই’ নামে একটি ব্যক্তিগত প্রবন্ধের বই লিখে নাম কুড়িয়েছিলেন। মজলিশি মানুষ, আমাদের সঙ্গে অঢেল আড্ডা দিতেন। দেশভাগের পর কোথায় হারিয়ে গেলেন; হয়তো আমারই দোষ, ভালো করে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। ইংরেজি বিভাগে ওই একই সময় ছিলেন ইসরাইলি অধ্যাপক অ্যালেক্স অ্যারনসন, সাহিত্যচর্চা করতেন, এক সময়ে শান্তিনিকেতনেও ছিলেন। আরো যাঁকে মনে পড়ে, ইংরেজ মহিলা, একটু উদ্ভট স্বভাবের, কিন্তু ভারি ভালো মানুষ, এ. জি. স্টক।

যে-দুই ইংরেজির অধ্যাপকের নামোল্লেখ সব শেষে করছি, তাঁরা মন্মথনাথ ঘোষ ও অমলেন্দু বসু, দু’জনেই বুদ্ধদেব বসুর ঘনিষ্ঠ, ‘প্রগতি’ পত্রিকার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন। অমলেন্দুবাবু পরে আলিগড়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ইংরেজি-বাংলায় প্রচুর পাণ্ডিত্য-ছড়ানো প্রবন্ধ লিখেছেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও শেষের দিকে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর পড়ানোয় চমক ছিল, গমক ছিল, কথনের চাতুর্যে এবং উদ্ধৃতির সমারোহে ছাত্রকুলকে মাতিয়ে রাখতে পারতেন। সর্বোপরি অত্যন্ত সুদর্শন ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। বহুদিন বাংলা লেখার চর্চা ছিল না তাঁর। ষাটের দশকে আমার উপরোধে ফের বাংলা চর্চা শুরু করলেন ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় লেখা দিয়ে, মস্ত উপকার হলো বাংলা সাহিত্যের। আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তন করে ঊনিশশো তেষট্টি সালে প্রথম যখন অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যাই, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের তিনি তখন প্রধান অধ্যাপক, সখেদে জানালেন সহকর্মীদের কেউই তেমন পড়াতে পারেন না, ‘একটা ছেলে যা-ও পারতো, তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে’। ‘ছেলেটি’ জ্যোতি ভট্টাচার্য।

মন্মথবাবু সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। প্রধানত শেক্সপিয়র ও মিল্টন পড়াতেন। হয়তো হ্যামলেটের একটি উক্তির তিনটি কি চারটি পঙ্‌ক্তিতেই প্রহর কাটিয়ে দিতেন। আমাদের যে কোর্স শেষ হচ্ছে না, নির্ধারিত পাঠ্যের অনেক কিছু যে বাকি থেকে যাচ্ছে, তাঁর উদ্বেগ যেমন ছিল না তা নিয়ে, আমাদেরও চেতনা ছিল না। কারণ তিনি যেন সৃষ্টির গভীরে আমাদের উত্তীর্ণ করতেন, একটি শব্দ বা একটি বাক্যবন্ধকে ঘিরে ট্র্যাজেডির গহনে ছুঁড়ে দিতেন নিজেকে, নিয়ে যেতেন আমাদেরও। সাহিত্য ও কাব্য আস্বাদের প্রেরণা সবচেয়ে বেশি মনে হয় তাঁর অধ্যাপনা থেকেই সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। আই. এ.-তে আমার পরীক্ষার খাতা দেখেছিলেন, অসম্ভব বেশি নম্বর দেওয়া সত্ত্বেও আমি ইংরেজিতে অনার্স নিইনি, ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হইনি, তা নিয়ে তাঁর আক্ষেপের অন্ত ছিল না। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, নাট্যকার মন্মথ রায়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাংলায় একাঙ্ক নাটিকা রচনার তিনি অগ্রদূত, এরকম একটি প্রবাদ আছে। অথচ মন্মথ রায়েরও কয়েক বছর আগে থেকে মন্মথনাথ ঘোষ একাঙ্ক নাটক লিখতে শুরু করেন, যার সাক্ষ্য বহন করছে ওই মাত্র তিন-চার বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে হঠাৎ-বন্ধ-হয়ে-যাওয়া ‘প্রগতি’ পত্রিকার পৃষ্ঠাগুলি।

বিলেত গিয়ে ডিগ্রি আনেননি মন্মথবাবু। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সোপানে তাঁর ধাপে-ধাপে উন্নতি ঘটেনি, লেকচারার হয়েই ছিলেন। দেশভাগের পর দিল্লি চলে গিয়ে ওখানে একাধিক কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। কিন্তু ততদিনে তাঁর মনের গড়ন বদলে গেছে। তাঁর সমসাময়িক বন্ধুবান্ধব, বিশেষত অর্থনীতির অধ্যাপকরা, বৃত্তির ক্ষেত্রে উন্নতি করছেন, প্রচুর উপার্জন করছেন, তিনিই একপাশে পড়ে রয়েছেন। অভিমান-আহত মন্মথবাবুর রোখ চেপে গেল। সাহিত্যচর্চা অর্থহীন, ব্যর্থ; তিনি সাহিত্য ভুলে যাবেন। তাঁর নিজের মতো করে তিনি অর্থ উপার্জন করবেন। দিল্লিতে সংসারের খরচ অসম্ভব সংকুচিত করে আনলেন। এমনকি খবর কাগজ নেওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিলেন, শুধু এমন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার গ্রাহক হলেন যাতে ফাটকা বাজার নিয়ে বিশদ সংবাদ থাকে। হ্যামলেট-ওফেলিয়ার অন্তর্বেদনার হৃদয়-মোচড়ানো বিশ্লেষণ করতেন যে-মন্মথনাথ ঘোষ, তিনি ফাটকাবাজারে মেতে উঠলেন, অচিরে দেদার টাকা করলেন। দিল্লিতে বড়ো বাড়ি তুললেন, তাঁর সাহিত্যরস কোথায় হারিয়ে গেল। আমার সম্পর্কে অথচ তাঁর অপত্যস্নেহ বরাবর অটুট ছিল, আশির দশকের উপান্তে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। শেষের দিকে দিল্লি গিয়ে দেখেছি, তাঁর বিনোদনের উপকরণ বাজি ধরে কন্ট্রাক্ট ব্রিজ খেলা, একমাত্র পাঠ্য হ্যারল্ড রবিন্স। আমার কাছে অন্তত, পৃথিবীতে এবং বিধ ট্র্যাজেডির তুলনা নেই।

সবশেষে অর্থনীতি বিভাগের প্রসঙ্গে আসি। এখানেও ডাকসাইটে শিক্ষকদের সমারোহ। ভারতজোড়া খ্যাতি-কুড়োনো অধ্যাপক পানাণ্ডিকর বেশ কয়েক বছর আগেই মুম্বই ফিরে গেছেন; যোগীশচন্দ্র সিংহ মশাইও তেমনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেছেন। কিন্তু যাঁরা ছিলেন তাঁরাই যথেষ্ট। প্রধান অধ্যাপক হীরেন্দ্রলাল দে, তখনকার দিনে লন্ডনের ডি. এসসি। তিনিও খানিক বাদে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে মুম্বই চলে গেলেন। তখন বিভাগীয় প্রধান হলেন অধ্যাপক কৃষ্ণবিনোদ সাহা, অর্থনীতির তত্ত্ব নিয়ে তাঁর মৌলিক গবেষণা ছিল। পড়াতেন চমৎকার, কিন্তু তাঁর অধ্যাপনার সঙ্গে স্বল্পবাকের অদ্ভুত সমাহার। খুব কম কথায় যা বোঝাবার বুঝিয়ে দিতেন; যারা সেটুকু সময়ের মধ্যে বুঝতে পারতো না, তাদের মহা সংকট। তার বাক্‌-মিতব্যয়িতা সম্পর্কে একটি গল্প আমাকে বলেছিলেন অর্থনীতি বিভাগে অন্যতম শিক্ষক পরিমল রায়: বাইরে যাঁর গাম্ভীর্যের মুখোশ, কিন্তু অন্তর রসে টইটম্বুর। ইনিও ‘প্রগতি’ দলের অন্তর্ভুক্ত, বুদ্ধদেব বসু-র বন্ধু। আশ্চর্য ভালো ছড়া ও ব্যক্তিগত প্রবন্ধ লিখতেন। তাঁর রসালো প্রবন্ধের একটি সংগ্রহ, ‘ইদানীং’, কিছুদিন আগেও বাজারে পাওয়া যেত। তবে তাঁর লেখা অমূল্য ছড়াগুলি সংগৃহীত হয়নি; বাংলা সাহিত্যের পক্ষে সেই ক্ষতি অপূরণীয়।

যা বলছিলাম, কৃষ্ণবিনোদবাবু টিউটোরিয়াল ক্লাসে পরিমলবাবুকে ‘ক্ষয়িষ্ণু প্রান্তিক উপযোগিতা’ নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে অনুজ্ঞা করেছিলেন। পরিমল রায় সাহিত্যসংপৃক্ত মানুষ, ওই তত্ত্বের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উদাহরণের শরণাপন্ন হলেন। লিখলেন, প্রবল তৃষ্ণার মুহুর্তে কেউ যদি এক পেয়ালা চা হাতে ধরে দেয়, তা পান করে গভীর তৃপ্তির উদ্রেক হয়; যদি তারপর দ্বিতীয় এক পেয়ালা পান করতে দেওয়া হয়, প্রাপক খুশি মনে তা-ও পান করেন; তৃতীয় পেয়ালা গ্রহণের অনুরোধ জানালে ভদ্রতাবশত কোনওক্রমে গিলে নেন, তবে ততটা তৃপ্তি হয় না; অতঃপর চতুর্থ পেয়ালা তাঁর হাতে গুঁজবার চেষ্টা হলে তিনি ধন্যবাদসহ প্রত্যাখ্যান করেন: এই ঘটনাক্রম ‘ক্ষয়িষ্ণু প্রান্তিক উপযোগিতা’র নিদর্শন। প্রবন্ধটি পাঠান্তে কৃষ্ণবিনোদবাবু নাকি মন্তব্য করেছিলেন: চতুর্থ পেয়ালাটি ধন্যবাদ-সহ অথবা বিনা ধন্যবাদে প্রত্যাখ্যাত হলো কিনা তা জানতে অর্থনীতি শাস্ত্রে আমাদের আগ্রহ নেই।

পরিমলবাবু ঢাকায় আমাদের বছর দুই হয়তো পড়িয়েছিলেন, কিংবা তারও কম, কারণ ততদিনে দেশভাগের পূর্বসংকেত শুরু হয়ে গিয়েছে। তিনিও দিল্লিগামী হন, প্রথমে রামযশ কলেজে, পরে আই. এ. এস ট্রেনিং স্কুলে অধ্যাপনা। কয়েক বছর বাদে যখন দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে যোগ দিই, পরিমলবাবুর বাড়িতে বাঁধা আড্ডা; সেই বর্ণনা পরে দেবো। দিল্লি ত্যাগ করে পরিমলবাবু পরে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে কাজ নিয়ে নিউ ইয়র্ক চলে যান। সেখান থেকে আমাকে তিনি যে-চিঠি দিয়েছিলেন, তার প্রথম বাক্য: ‘অশোক, এই দেশে গরুতেও থাকে না।’ এই মন্তব্য বর্তমানের বিশ্বায়িত যুবককুলের মধ্যে যদি প্রচার করতে যাই, তাঁরা আমার গর্দান নেবেন। নিউ ইয়র্ক পৌঁছুবার কয়েক মাসের মধ্যেই পরিমলবাবু মারা গেলেন, ওই দেশে তাঁকে খুব বেশি দিন তাই থাকতে হয়নি।

অর্থনীতি বিভাগে তরুণতম শিক্ষক ছিলেন আমার অগ্রজপ্রতিম সমররঞ্জন সেন, দেশসেবিকা আশালতা সেনের একমাত্র সন্তান। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই সমরদা বিলেত চলে গেলেন। বছর দুয়েক বাদে ফিরে এসে আমাদের আবার পড়াতে শুরু করেন। তবে অতি স্বল্প সেই অধ্যায়। কয়েক মাস গত হলেই নতুন দিল্লির কৃষি মন্ত্রক থেকে তাঁর আহ্বান এলো, চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *