আপিলা-চাপিলা – ৩৩

তেত্রিশ

অর্থ বিভাগের দায়িত্বে আছি, সরকারি কর্মচারী কিংবা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের এতদিন ধরে-অস্বীকৃত ন্যায্য দাবিদাওয়া পরিপুরণের কর্তব্য-পালনে আমার আনন্দ ধরে না। কিন্তু, সাধ ও সাধ্যের অন্তর্দ্বন্দ্ব ব্যতীতও, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে বিবেকদংশনের প্রহার, কারণ আমি তো পরিকল্পনা বিভাগের দায়িত্বে, উন্নয়ন খাতেও ব্যয়ের মাত্রা না বাড়ালে চলবে কী করে। দ্বন্দ্রের যন্ত্রণার অতএব অহরহ পীড়ন। সাধারণভাবে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে, ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, একটি মৌখিক বোঝাপড়া ছিল, আমার কাছে যা অন্যায় বলে মনে হবে তেমন দাবি বা অনুরোধ আমি ফিরিয়ে দেবো, ফাইল তাঁর কাছে যথানিয়মে যাবে, তিনি রাজনৈতিক বিবেচনা প্রয়োগে করে যদি কোথাও দাবি মঞ্জুর করা সঙ্গত মনে করেন, কিংবা আংশিকভাবেও মেনে নেওয়া মনস্থ করেন, আমার দিক থেকে অসুবিধা হবে না। অথচ প্রায় নয় বছর অতিক্রমান্তে একটি ব্যাপারে মতভেদ প্রবল আকার ধারণ করলো। প্রায় দুই যুগ গড়িয়ে গেছে, আমি বহুদিন সরকারের বাইরে, জ্যোতিবাবুও চব্বিশ বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী হিশেবে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনান্তে অবসর গ্রহণ করেছেন, এখন সমস্যাটি নিয়ে প্রকাশ্য মন্তব্যে মনে হয় আর বাধা নেই। কংগ্রেস আমলে রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে নৈরাজ্য চলছিল, পাঠচর্চার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, পরীক্ষার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, প্রশাসনিক নৈরাজ্য। বামফ্রন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করার পর এরকম অনেকগুলি কলেজের পুরনো পরিচালক সমিতি ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। সর্বক্ষেত্রে প্রশাসকদের শিক্ষাগত মান যে যথোপযুক্ত ছিল, তা নয়। তবে প্রশাসকরা পড়াশুনোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুক্ত নন, সুতরাং তাঁদের যোগ্যতা তেমন মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠেনি। মুশকিল দেখা দিল যখন এই প্রশাসকদের মধ্য থেকেই কয়েকজনকে, বা তাঁদের সুপারিশে অন্য কাউকে, কলেজ অধ্যক্ষ হিশেবে মনোনীত করা শুরু হলো। অন্য একটি ব্যাপারও ঘটলো: প্রধানত বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের বেতনক্রমের ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে এমন সব অধ্যক্ষ বাছাই করা হয়েছে, যাঁদের বিদ্যাচর্চার পরিমাপ, শিক্ষাগত মান, শিক্ষক হিশেবে অভিজ্ঞতা, সব-কিছুই সরকারি কলেজে নিযুক্ত শিক্ষক-অধ্যক্ষদের তুলনায় অনেকাংশে নিষ্প্রভ। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার তো দানছত্র খুলে বসেছেন, শিক্ষক-অধ্যক্ষদের পুরোপুরি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অধিকার দিয়েছেন, অধ্যাপক-অধ্যক্ষরাও তো জনগণের অংশ। হঠাৎ আঠারো কি কুড়ি জনের এক অধ্যক্ষ সেল তৈরি হলো। আমাদের-দাবি-মানতে-হবে ধুয়ো তুলে তাঁরা আমার ঘরে হানা দিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর ঘরেও; দাবি অবিলম্বে মানা না হলে রাস্তায় নেমে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ভয় দেখালেন। সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ ও প্রবীণ অধ্যাপকদের বেতনক্রমে বরাবরই একটু অসামঞ্জস্য ছিল: অধ্যক্ষরা সামান্য বেশি মাইনে পেতেন, বরিষ্ঠ অধ্যাপকরা, তার কম: সুপণ্ডিত, শিক্ষক হিশেবে সুদক্ষ, এমন অনেক অধ্যাপক অধ্যক্ষ হতে চাইতেন না, প্রশাসনিক ঝুটঝামেলার বাইরে থাকা পছন্দ করতেন। মনে-মনে ভেবে রেখেছিলাম, অধ্যক্ষের দায়িত্ব বহন করতে তাঁরা রাজি হোন না-হোন, এবংবিধ জ্ঞানী প্রবীণ অধ্যাপকদের বেতনক্রম অধ্যক্ষদের বেতনক্রমের সঙ্গে একীকরণ পবিত্র সামাজিক কর্তব্য। বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের কাছ থেকে চাপ আসে আসুক, সরকারি কলেজের প্রবীণ অধাপকদের বেতনক্রম বাড়ানোই আমার অগ্ৰ দায়িত্ব, অপেক্ষারত বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের সমস্যা নিয়ে পরে মাথা ঘামানো যাবে।

অন্যমনস্ক মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী অর্থ বিভাগের সঙ্গে যথেষ্ট আলোচনা না-করে বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন, কোনও দিক থেকে রাজনৈতিক উপরোধ এসেছিল কিনা আমার জানা নেই। অপেক্ষাকৃত অযোগ্য মানুষদের অধ্যক্ষ করে দেওয়া হয়েছে, তাতে আমার হাত ছিল না, কিন্তু আমার বিবেচনায় উন্নততর বেতনক্রম পেতে তাঁদের সামান্য অপেক্ষা করতে হবে। আগের কাজ আগে; বরিষ্ঠ অধ্যাপকদের মাইনে-ভাতা বিষয়ে প্রথমে সিদ্ধান্ত নেবো, তারপর এই অধ্যক্ষদের ব্যাপারটি দেখবো; যেখানে তারকনাথ সেন-গোপীনাথ ভট্টাচার্য-সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত-সুশোভন সরকার-ভবতোষ দত্তের মতো অধ্যাপকরা বেতনের ক্ষেত্রে অধ্যক্ষদের সমপর্যায়ভুক্ত হননি, সেখানে শিক্ষা, মেধা ও বিদ্যার নিরিখে বহুগুণ নিকৃষ্টদের প্রতি দায়বদ্ধতা পূর্বাহ্নে পূরণ করতে হবে, এমন প্রস্তাবের শরিক হতে অসম্মত থাকবো, তা যত চাপই আসুক না কেন।

ইতিমধ্যে অন্যান্য ঘটনাবলী, পার্টির রাজ্য সম্মেলন, কয়েক সপ্তাহ বাদে কলকাতাতে পার্টির সর্বভারতীয় সম্মেলন। রাজ্য সম্মেলনে জ্যোতিবাবুর দো-আঁশলা শিল্পনীতির প্রস্তাব গৃহীত হলো। বি. টি. আর-এর আবেদন শোনবার পর স্বল্প এক-বাক্যের বক্তৃতায় তার সমর্থন জানাতে হলো আমাকে, তবে পার্টির নিচের তলায় প্রবল বিক্ষোভ, কমরেডরা এসে প্রতিদিন তাঁদের অসন্তোষ জানিয়ে যাচ্ছেন। সর্বভারতীয় কংগ্রেসে মূল অর্থনৈতিক প্রস্তাব পেশ করার সম্মান পার্টি থেকে আমাকে জ্ঞাপন করা হলো। তা হলেও আমি যন্ত্রণার তীব্রতায় দীর্ণ। কেন্দ্রের সঙ্গে কলহ নতুন মাত্রা নিচ্ছে, পরিকল্পনা খাতে আমাদের প্রাপ্য অর্থ আটকে দেওয়া হয়েছে, অর্থ দফতরের উপর দাবিদাওয়ার চাপ অথচ সমানে বাড়ছে। এই ডামাডোলের মধ্যে বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের বেতনক্রম আরও বাড়ানোর চাপ, যা আমার বিবেক কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। মুখ্যমন্ত্রী কথা দিয়ে ফেলেছেন; তাঁর প্রতিশ্রুতির সম্মানার্থে অবশেষে অর্থ দপ্তরের তরফ থেকে প্রস্তাব রাখা হলো, বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের যোগ্যতা-ও অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক বেতনক্রমের বিষয়টি আপাতত মুলতুবি রেখে, যাঁরা ইতিমধ্যে অধ্যক্ষ হিশেবে কাজ করছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত সম্মান-দক্ষিণা দেওয়া হোক, যাতে তাঁরা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের সম-পরিমাণ দক্ষিণা পেতে শুরু করতে পারেন। সেই প্রস্তাবও অগ্রাহ্য হলো।

আমার সঙ্গে মতানৈক্যের নিরসন ঘটাতে পার্টি থেকে এক সন্ধ্যায় বৈঠক ডাকা হলো, ওই সন্ধ্যায় ওই সময়ে আমি অন্যত্র যেতে বহুদিন থেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সুতরাং আমার অসুবিধা পার্টিকে জানালাম। পরদিন প্রভাতী সংবাদ, আমার বক্তব্য পাকাপাকি খারিজ করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে তাঁর স্বাক্ষরসহ দুপুর নাগাদ বিজ্ঞপ্তি বেরোলো, সৌজন্যবশত আমাকে তার কপি পাঠানো হলো, মুখ্যমন্ত্রী নিজের অধিকার প্রয়োগ করে বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের বেতনক্রম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের বেতনক্রমের সঙ্গে এক করে দিলেন।

সরকারি নিয়মে আছে, কোনও ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থবিভাগের মতদ্বৈধতা দেখা দিলে, সংশ্লিষ্ট বিষয়টি মন্ত্রিসভার কাছে অন্তিম সিদ্ধান্তের জন্য পেশ করতে হবে। কলহপ্রবণ হলে মুখ্যমন্ত্রীকে পাল্টা নোট পাঠাতাম, মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক পর্যন্ত তাঁর সিদ্ধান্ত-সহ বিজ্ঞপ্তিটি ঝুলিয়ে রাখা হোক। তবে তা তো ছেলেমানুষি হতো। যেখানে বিবেকের দায়, আমি অন্য কারও সঙ্গে কোনওদিনই পরামর্শ করিনি, সেদিনও করলাম না, যা নিয়ে পরে অনেক অনুযোগ শুনতে হয়েছে, আমার দায়িত্বহীনতাবোধকে দুয়ো দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার দিক থেকে কোনও অনুশোচনা নেই।

স্বীকার করতেই হয়, অনেক দিন ধরেই মনে দ্বিধা-প্রশ্ন-সমস্যার সংকট জড়ো হচ্ছিল। আমরা তো বামপন্থী, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যপরায়ণতার দৃষ্টান্ত দেখাবো সারা দেশকে, সেরকমই তো আমাদের অঙ্গীকার। দক্ষতার প্রশ্ন এড়িয়ে বশ্যতাকে বাড়তি প্রসাদ বিতরণ করলে সেই দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। প্রায় প্রতিদিন প্রতিটি ক্ষেত্রে অথচ অদ্ভুত-কিম্ভূত নানা দাবি-দাওয়ার পরাক্রম, যার ধাক্কা অর্থ দফতরেরই শুধু যেন সামলাবার দায়, যে-দায় মেটাতে গিয়ে রাজ্য সরকারের নাভিশ্বাস। কেন্দ্রের সঙ্গে লড়াই করে রাজস্বসূত্র বাড়াতে হবে, কিন্তু সেই যুদ্ধে ফল পেতে সময় লাগবে, ইতিমধ্যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া প্রধান কর্তব্য। বেতন-ভাতা তো দায় মেনে পর্যাপ্ত বাড়ানো হয়েছে, যেখানে-যেখানে প্রয়োজন আরো বাড়ানো হবে। কিন্তু স্রেফ কিছু পেটোয়া মানুষকে খুশি রাখতে গিয়ে যদি দেউলিয়া হতে হয়, তা হলে তো আখেরে দলের মুখেই চুন-কালি পড়বে। এটাও বিবেকের প্রশ্ন, নীতির প্রশ্ন। বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের জন্য দানছত্র খোলার ব্যাপারে আমার অনমনীয়তা উপলক্ষ্য মাত্র, আমি চাইছিলাম দলকে ঈষৎ ধাক্কা দিতে, এভাবে চলতে পারে না, এভাবে চললে পরিণামে সর্বনাশ হবে। বোঝাতে অসমর্থ হলাম।

মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের চিঠি পাঠালাম, বিধানসভার অধ্যক্ষের কাছে সেখান থেকে পদত্যাগের; যেহেতু দলের কানুন অনুযায়ী এ ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পার্টির পূর্বানুমতি প্রয়োজন, দলের রাজ্য সম্পাদককে অন্য দুটি চিঠির অনুলিপির সঙ্গে পার্টি ছাড়বার কথা জানিয়ে চিঠি। ভাবলাম, পার্টি যখন ছেড়েই দিচ্ছি, মন্ত্রিসভা ও বিধানসভা থেকে পদত্যাগের জন্য আগে থেকে দলের অনুমতি নেওয়ার আর দরকার নেই। মনে ভয়ও ছিল, মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের অনুমতি চাইলে, কে জানে, হয়তো নামঞ্জুর হবে, সেই ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলাম না। সামান্য একটু দুষ্টুমিও করলাম: পদত্যাগের খবরটি কলকাতাস্থ এক সংবাদপত্রের সম্পাদক, যিনি ব্যক্তিগত সুহৃদ, তাঁকে জানিয়ে দিলাম, একবার খবরটি বাইরে চাউর হয়ে গেলে ফিরে যাওয়ার জন্য আর পীড়াপিড়ি হবে না, এমন ভেবে। অবশ্য আরও দুটি কাগজও সেই রাত্তিরেই খবরটি পেয়ে গিয়েছিল, কোনও অজ্ঞাত সূত্র থেকে। পার্টিতে যে চিঠি দিলাম তাতে পদত্যাগের কারণ হিশেবে শারীরিক অসুস্থতার উল্লেখ ছিল। জ্যোতিবাবুকেও তাই-ই লিখলাম, তবে এটা যোগ করলাম যে তাঁর মতামতের সঙ্গে ক্রমশ দুস্তর ব্যবধান তৈরি হচ্ছে, আমার সরে পড়াই ভালো। উল্লেখ করতে ভুললাম যে তাঁর কাছ থেকে যত বিবেচনা ও সহৃদয়তা লাভ করেছি, তা তুলনাহীন।

অসুস্থতার প্রসঙ্গটি ঠিক বাজে ওজর ছিল না। ক’মাস ধরেই আমার দু’পাটি মাড়িতে ফুসকুড়ির মতো দেখা দিচ্ছিল। দন্তচিকিৎসক গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবিত, অনেক বই ঘেঁটে সন্দেহ প্রকাশ করলেন হয়তো বা কোনও জটিল ধরনের কর্কট রোগ। একটু-একটু করে ফুসকুড়িগুলি শরীরময় ছড়িয়ে যেতে লাগলো; কোনও-কোনওটি প্রায় পিংপং বলের মতো মস্ত আকারের, ফুলে ওঠে, মিলিয়ে যায়। রাইটার্স বিল্ডিং ছাড়বার পর এখানে-ওখানে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে দেখালাম, তাঁরা নিশ্চিন্ত করলেন তেমন কিছু নয় পরে কলকাতায় জনৈক চিকিৎসক পা মচকে যাওয়ার জন্য কী একটা সুঁচ ফোড়ালেন, তা থেকে, কী আশ্চর্য, ফুসকুড়িগুলি চিরতরে মিলিয়ে গেল। গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই বলেছিলেন, কৌতুক করে কিনা জানি না, সমস্যাটির সূত্রপাত মানসিক পীড়নহেতু। রাইটার্স বিল্ডিং ছাড়লাম, মানসিক উদ্বেগের অবসান ঘটলো, ব্যাধিটিও বিদায় নিল।

ফের বলি, পেটোয়া অধ্যক্ষরা ধরে পড়েছেন, উপযুক্ত যোগ্যতা-গুণাবলী থাকুক না-থাকুক, তাঁদের দাবি পূরণ করতে হবে, এটা তো কোনও আলাদা সমস্যা নয়, মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন, দক্ষতা বনাম বশ্যতার প্রচলিত দ্বন্দ্ব। কংগ্রেস আমলে কমিউনিস্টদের সরকারি কাজে ও অন্যত্র আদৌ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো না, তিরিশ বছর ধরে যোগ্য বামপন্থীরা ধারবাহিকভাবে অন্যায়ের শিকার হয়ে এসেছেন, এখন আমরা ক্ষমতায় ঢুকেছি, অতীতে কৃত অন্যায় খানিকটা সংশোধন তো অবশ্যই করতে হবে, আমরা তো যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বদ্ধপরিকর। মুশকিল দেখা দেয় যখন চাপ সৃষ্টি হয় যাঁরা যোগ্যতাহীন, তাঁদেরও সুযোগ পাইয়ে দিতে হবে, যোগ্য ব্যক্তিরা যদি থাকেন কোনও পদের প্রার্থী রূপে, তা হলেও। কংগ্রেস আমলে যে-অবিচার হয়েছে তার জবাব হিশেবে আমাদের পাল্টা অবিচার করতে হবে, আমার কাছে এই প্রস্তাব কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছিল না। অথচ রোগ ক্রমশ সংক্রামক। একটু-আগে-উল্লিখিত রাষ্ট্রমন্ত্রীটির শত অপরাধ যে-নিরিখে মাফ করা হচ্ছিল, সেই একই নিরিখে প্রচুর অতি-অযোগ্যকে এখানে-ওখানে ঢোকানোর উৎসাহে অন্ত নেই, শিক্ষায়, পরিবহনে, স্বাস্থ্য বিভাগে, সংস্কৃতি দপ্তরে, আরও নানা জায়গায়। সবচেয়ে অসুখী বোধ করছিলাম শিক্ষাক্ষেত্রে প্রায় পুকুরচুরির মতো ব্যাপার ঘটছিল বলে: শিক্ষক নিয়োগে প্রতিভাবান, মেধাবী, পরীক্ষায়-চমৎকার-ফল-দেখানো প্রার্থীদের দূরে সরিয়ে পার্টির-প্রতি-বিশ্বস্ত মানুষজনকে ঢুকিয়ে দেওয়া, নির্বাচকমণ্ডলীতে পছন্দমতো লোক মনোনয়ন করে তাঁদের দিয়ে পছন্দের প্রার্থী বাছাই। কখনও-কখনও নির্বাচকমণ্ডলীর রায় পছন্দ না-হলে নিয়োগের ব্যাপারটি মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখা, পুরনো নির্বাচকমণ্ডলীর মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে নির্বাচনবৃন্দ বাছাই, তাঁদের সাহায্যে পছন্দের মানুষকে এবার কাজ পাইয়ে দেওয়া। কংগ্রেস আমলে যে-জিনিশ আকছার হতো বলে আমাদেরও তা অনুসরণ করতে হবে, কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। এই গোছর অপকর্মে যে পার্টির বা আন্দোলনের আখেরে কোনও লাভ হয় না, বরং ক্ষতি, সে বিষয়েও আমি নিশ্চিত ছিলাম।

বেশ কয়েক বছর বাদে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে দুপুরে বোলপুর থেকে কলকাতা ফিরছি। গুসকরা স্টেশনে বছর সতেরোর একটি অজাতশ্মশ্রু, নিরীহ চেহারার ছেলে পাশে এসে বসলো। গুসকরা কলেজে পড়ে, বর্ধমানে কোনও কাজে যাচ্ছে, না কি বর্ধমানে কলেজে পড়ে, কী একটি কারণে গুসকরা এসেছিল, এখন আর মনে আনতে পারি না। বাচ্চা ছেলে, একটু আলাপ করলাম। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান অধ্যয়নরত, পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ আগ্রহ। ছেলেটি আমাকে চেনে না, নামও শোনেনি কোনওদিন। জিজ্ঞাসা করলাম, কলেজে কেমন পড়ানো হয় পদার্থবিজ্ঞান। ম্লান মুখে, পৃথিবীর সঞ্চিত বিষণ্ণতা নিয়ে সে জানালো, এতদিন অমুকদা পড়াতেন, ওঁর প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি, বোঝান-ও চমৎকার, কিন্তু উনি তো পার্টির সদস্য নন, পাকা চাকরি পাবেন না, পাকা কাজে যিনি আসছেন তাঁকেও তারা চেনে—তমুকদা—কিছু পড়াতে পারেন না, ছাত্রও ভাল ছিলেন না। কাহিনীটি আমি জ্যোতিবাবুকে বলেছিলাম, উনিও শুনে আতঙ্কিত। তবে ততদিনে ঘুণ অনেকদূর ছড়িয়ে গেছে। নেতারা তো বহুদিন ধরে বলে আসছিলেন, পার্টিতে প্রচুর বাজে লোক ঢুকেছে, অবিলম্বে তাড়াতে হবে, কিন্তু, বছরের পর বছর গড়ায়, যে কে সেই। শিক্ষাক্ষেত্রে যেমনধারা নব ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়ে গেছে, প্রায় অন্য সর্বত্রও তাই: যারা বিশ্বস্ত, পেটোয়া, তাদের বাছতে হবে, ষাচ্ছেতাই বা অপদার্থ হলেও যায় আসে না। কে আর ভাববেন কোনও একটি শিক্ষক পদে ভুল নির্বাচন হলে পুরো বিভাগটি বা বিদ্যালয়টি ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা; অপকৃষ্টরা অপকৃষ্টদেরই হাতছানি দেয়, উৎকৃষ্টরা টিকতে পারে না সেই পরিবেশে। গত কুড়ি বছরের ইতিহাস থেকে এন্তার উদাহরণ দেওয়া সম্ভব।

অস্বস্তিবোধের গভীরতর কারণও ছিল—এবং আছে। আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে উজ্জ্বল ঝকঝকে মেধাসম্পন্ন অধ্যাপকেরা প্রায় সকলেই কমিউনিস্ট পার্টির কাছাকাছি ছিলেন, তাঁদের আদর্শের প্রেরণাতেই বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন সেই পর্বে এত জোর ধরেছিল। তুলনায় হালের ছাত্র-যুব আন্দোলনে বামপন্থী ঝোঁক অনেকটাই স্তিমিত। মানছি, এই অবক্ষয়ের বিবিধ অন্য কারণ আছে, তা হলেও বলবো, মাস্টারমশাইরা ভোঁতা হলে ছাত্র-ছাত্রীরাও খানিকটা ভোঁতা না হয়ে পারে না। কলেজে-কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন নির্বাচনে জয়যুক্ত হচ্ছে তা কিছু প্রমাণ করে না; ছাত্র আন্দোলন এখন বহুলাংশে উজ্জ্বলতারহিত। দক্ষতা বনাম বশ্যতার টানাপোড়েনে বশ্যতা ক্রমশ জয়ী হয়েছে, দক্ষতা পিছু হটেছে।

আদর্শের শুদ্ধতা যে-রক্ষা পেয়েছে তা-ও নয়। অনেক ক্ষেত্রেই নীতির অবৈকল্যের সঙ্গে বশ্যতার আদা-কাঁচকলা সম্পর্ক। যদি খোশামুদি করলে ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছুনো যায় এই ডামাডোলের বাজারে, সুযোগসন্ধানীদের সক্রিয় হয়ে উঠতে বাধা নেই। কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে যাঁরা ঘোর বামবিরোধী ছিলেন, তাঁদের অনেককেই এখন দেখি ঘোর মার্কসবাদী বনে গেছেন। বোঝানো হয়, তাঁদের ‘হৃদয় পরিবর্তন’ হয়েছে; সরলতর ব্যাখ্যা, তাঁরা সরেস খোশামোদচূড়ামণি তথা সুবিধাবাদবিশারদ।

আসলে জমিদারি মানসিকতার সঙ্গে খোশামোদ সংস্কৃতির অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। একটি কাহিনী বিবৃত করি। সরকার-ঘেঁষা এক কলেজ শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের জনৈক চাঁই, মস্ত ক্ষমতাবান, অহমিকায় মাটিতে পা পড়ে না। কোনো সন্ধ্যায় বই মেলায় গেছি, চোখে পড়লো ভদ্রলোকটিও গেছেন, স্টলে-স্টলে বিহার করে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের বিপণিতে এঁর পদধূলি পড়েছে, প্রকাশক-পুস্তকবিক্রেতারা কৃতার্থ তথা সন্ত্রস্ত: ইনি প্রভাব খাটিয়ে সরকার থেকে বই কেনার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, সুতরাং এঁকে উপচার সাজিয়ে দিতে হয়। বিভিন্ন স্টলে ইনি বুড়ি ছুঁয়ে যাচ্ছেন, ঢুকছেন, বেরোচ্ছেন। প্রতিটি স্টলে ভদ্রলোককে ডাঁই-করা বই উপহার দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মাননীয় ইনি তো নিজে বয়ে বেড়াবেন না; সঙ্গে এক অনুচর, অল্পবয়সী কোনও শিক্ষক, হাতে বিরাট ঝোলা, মহৎ ব্যক্তির হাত থেকে সসম্রমে উপহার-পাওয়া বইগুলি নিয়ে ঝোলাতে পুরছেন। পঞ্চাশের দশকে ব্যাংককে যে চমৎকার মজার দৃশ্য দেখেছিলাম, মনে পড়ে গেল। থাইল্যান্ড গোঁড়া বৌদ্ধ দেশ, মস্ত বড়োললাকের বাড়ির ছেলেদেরও অন্তত একবার গেরুয়া বসন ধারণ করে রাস্তায় নেমে পদব্রজে ভিক্ষা করতে হয়; তবে এই অভিজাত ভিক্ষুদের সঙ্গে ভৃত্যদল থাকে, ভিক্ষালব্ধ অন্ন তারা ঝোলাতে বয়ে নেয়।

সর্বক্ষেত্রে এবংবিধ ব্যাপার ঘটতে থাকলে সামগ্রিক প্রশাসনেও তার অপছায়া দীর্ঘতর হয়। আশা পোষণ করেছিলাম, আমার পদত্যাগ নিয়ে পার্টিতে কিছু আলোচনা-বিতর্ক হবে: অন্তত কেউ-কেউ প্রশ্ন তুলবেন, বা আমার ক্ষোভের কারণ জানতে চাইবেন। সেরকম কিছুই হলো না। অনেকে আমাকে তখন জানিয়েছিলেন, দল থেকে পদত্যাগ করেই মারাত্মক ভুল করেছি; যদি দলে থেকে লড়াইটা চালিয়ে যেতাম, খানিক শুভফল প্রত্যাশা করা যেত। সেরকম আচরণ আমার রুচিতে বাধছিল। দলে থেকে ঝগড়াঝাঁটি করতে গেলে দলাদলি না করে গত্যন্তর থাকতো না, এবং দলাদলি অবধারিতভাবে খানিকটা গোপনীয়তার আকার নিত, যা পার্টির নিয়মবহির্ভূত। পদত্যাগের কয়েক মাস পর হাসপাতালে একদিন অসুস্থ কৃষ্ণপদ ঘোষকে দেখতে গিয়েছিলাম। তিনিও ততদিনে মন্ত্রী নেই, মনে হলো মানসিক অবসাদে ভুগছেন। প্রশ্ন করলেন, পার্টি কেন ছেড়ে দিলাম; অকপটে বললাম ঘোট পাকানো অপছন্দ করি বলে। তখন এ-ও মনে হয়েছিল, যদি প্রমোদবাবু থাকতেন, তা হলে তাঁকে সব খুলে বললে বোধ হয় একটি সুরাহা করতেন, জ্যোতিবাবুকে যা বলা যায় না তাঁকে বলা যেত, হয়তো আমাকে ছেড়ে আসতে হতো না।

যেদিন রাইটার্স বিল্ডিং ছাড়লাম, সেদিন সন্ধ্যাবেলা পার্টির নেতৃস্থানীয় দু’জন বাড়িতে দেখা করতে এলেন, সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানালেন, সবিনয়ে নিজের বক্তব্য ব্যাখ্যা করে ক্ষমা চাইলাম। এটাও যোগ করলাম, অবস্থার গতিকে যদিও পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি, দলের প্রতি কখনও নেমকহারামি করবো না, আমার মুখ থেকে কেউই পার্টি সম্বন্ধে একটি অপ্রিয় বাক্যও বের করতে পারবে না। আমার বিশ্বাস, সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। এখন যা লিখছি, তা পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে বলে, এবং ঘটেছে বলেই, আমার ধারণা, উপরের বক্তব্যগুলি এখন আর পার্টির বিরক্তি উৎপাদন করবে না। ষোলো-সতেরো বছর আগে দক্ষ, স্বচ্ছ প্রশাসনের স্বার্থে যা-যা বলতে শুরু করেছিলাম, এখন তো মোটামুটি সবাই-ই পার্টির মধ্যেও সে সব কথাবার্তা বলছেন।

তবু খানিকটা তিক্ততার রেশ। আমার পদত্যাগের দু’ সপ্তাহের মধ্যে সম্মানীয় বন্ধু অরুণ ঘোষকে রাজ্য যোজনা বোর্ডের সহ-সভাপতির পদ থেকে সরে যেতে হলো; পার্টির পেয়ারের একজন-দু’জন তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ শুরু করলেন যে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। আরও ব্যথিত হলাম যখন দলের তরফ থেকে সাংবাদিকদের বলা হলো, উনি তো যাবেনই, উনি ‘অশোক মিত্রের লোকে’। সামন্ত্ৰতান্ত্রিক মানসিকতার এর চেয়ে যথাযথ উদাহরণ কিছু হতে পারে না। জমিদারপ্রতিমরা ভাবতেই পারেন না দুই ব্যক্তির, যে-কোনও দুই ব্যক্তির, পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যের ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে মূলে প্রোথিত বলেই এখন বামপন্থী মন্ত্রীদের মুখেও অহরহ শুনতে পাই, ‘আমার সরকার’, ‘আমার দপ্তর’, ‘আমার পুলিশ’, ‘আমার অফিসার’।

ধরে নিচ্ছি অরুণ ঘোষ সম্পর্কে পার্টির বীতরাগ দূর হয়েছে। একবিংশ শতকের গোড়ায় তাঁর প্রয়াণের পর দল থেকে স্মরণ সভা ও স্মারক বক্তৃতার ব্যবস্থা চমকিত করেছিল, যদিও ঘুরে-ফিরে বার-বার জীবনানন্দের পংক্তিটিও মনে আসছিল: ‘মানুষটা মরে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি / কেউ দেয়, বিনি দামে, তাতে কার লাভ’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *