আপিলা-চাপিলা – ৭

সাত

অস্ট্রিয়া থেকে হিটলার দ্বারা যে-রাষ্ট্রপ্রধান বিতাড়িত হয়েছিলেন ১৯৩৭ সালে, সুরঞ্জনের সঙ্গে তাঁর মুখাবয়বের অনেকটা মিল। অনেক সময় সুরঞ্জনকে তাই চিঠি পাঠাতাম: শুজনিগ, প্রযত্নে সু.স.। বরাবরই হুল্লোড়-হুজ্জোতি সুরঞ্জনের দ্বিতীয় প্রকৃতি। অন্য পক্ষে অরুণকুমার সরকার নম্র, মৃদুভাষী, সপ্রতিভ, সন্নত নাসিকা, উজ্জ্বল চোখ, চশমার আড়ালে তা স্তিমিত না হয়ে আরও অনেক উজ্জ্বল, প্রশস্ত কপাল। মুড়ি-মুড়কির মতো সে সময় ওঁর কবিতা লেখা চলছে, যে কোনও ছুতোয় বা ছুতোহীনতায়।

গৌর তখন পুরোপুরি বেকার। বড় জোর একটা-দুটো টিউশানি করতো। চরম আর্থিক দুরবস্থা, তবে তেমন ভাঙতো না আমাদের কাছে। শয়নং হট্টমন্দিরে আর ভোজনং অনেকদিনই অনিশ্চিত। চশমার বাঁ চোখের কাচটি আড়াআড়ি ফাটা। সেই ফাটা চশমা নিয়েই গৌর ঘুরে-ফিরে বেড়ায়, পাল্টাবার পয়সা নেই। বিকেল সাড়ে তিনটে-চারটে নাগাদ, প্রায় সময় বেঁধে, গৌর আমার ওয়াই. এম. সি. এ-র ঘরে ঢুকতো, বলা চলে বিকেলের আড্ডার ও-ই বউনি করত। একে-একে অন্যরা আসতেন। বেশির ভাগ দিনই নিতাইকে মুরুব্বি পাকড়ে লাগোয়া রেস্তোরাঁ থেকে চা এবং হালকা খাবার আনাতাম, আমাদের ভাগটা গৌরের দিকেই ঠেলে দিতাম। তারপর কফি হাউস, হয়তো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, হয়তো বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কিংবা আতোয়ার রহমান, অথবা নরেশ গুহ বা মুরারি সাহা বা ত্রিদিব ঘোষ, সবাই-ই এক সঙ্গে এক টেবিলে। মাঝে-মাঝে আরেকজন যোগ দিতেন, দেশশরণ দাশগুপ্ত, ষাটের দশকের পর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। স’-আটটা সাড়ে-আটটা নাগাদ উঠে পড়ে বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিট-কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে হল্লা করে পৌঁছে যাওয়া, আমাদের ঘিরেই তো পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে। প্রতিদিন নতুন কারও সঙ্গে আলাপ, নতুন কারও কাছ থেকে টাটকা-লেখা কবিতা শোনা, কোনও নতুন পত্রিকার গুজবে কান পাতা, নয় তো রাজনীতি নিয়ে সর্বশেষ বুলেটিন। কমিউনিস্ট পার্টি ইতিমধ্যে বেআইনি ঘোষিত, নেতারা অনেকেই আত্মগোপন করেছেন, তবে তখনও কলেজ স্কয়্যার পাড়া জুড়ে বিপ্লবের মহড়া, কী কারণে যেন, শুরু হয়ে যায়নি। তার জন্য আরও মাস ছয়েকের প্রতীক্ষা। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রী মহলে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব উঠতি, অন্য সকলের পড়তি। একদিন আশুতোষ বিল্ডিঙের তেতলার করিডোরে ঘোরাফেরা করছি। একজন এসে উত্তেজিত খবর দিল, সোসাইটি না কোন সিনেমা ঘরে একটি সোভিয়েট-বিরোধী ছবি দেখানোর চেষ্টা চলছে, সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে হবে। অবিলম্বে ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিলে জড়ো হয়ে মাইলখানেক পথ হেটে সেই সিনেমা ঘরে চড়াও হওয়া, সিনেমার ম্যানেজার মশাই ভয়ে জবুথবু; আমাদের আদেশ অবশ্যই তিনি শিরোধার্য করবেন।

কলকাতায় ভর্তি হতে পারবো কি পারবো না, তা তখনও জানি না, অনিশ্চয়তার দ্বিধাথরোথরো চূড়ায়, এঁকে ধরছি, তাঁকে ধরছি, কর্তৃপক্ষজনের মন যদি ভেজাতে পারি। অপেক্ষমাণ এরকম মাস দেড়েক সময় অর্থনীতির ষষ্ঠ বর্ষের ক্লাসে যাওয়া শুরু করেছিলাম। একশো পঁচিশ-তিরিশ জনের ভিড় ওই ক্লাসে, কে আমাকে আলাদা করে শনাক্ত করবেন, শনাক্ত করে অনধিকার প্রবেশের অপরাধে বহিষ্কার করবেন? ওই সময়েই, মনে পড়ে, তাপস মজুমদার-অশোক সেনের মতো কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। দু’ জনেই তখন শাণিত যুবক। অশোক সেন প্রতিভার দীপ্তিতে অন্য সবাইকে ছাপিয়ে, অন্য দিকে তাপস মিচকে বুদ্ধিতে; পরবর্তী জীবনে প্রাজ্ঞ অধ্যাপকের ভূমিকার আড়ালে তাপসের সেই মিচকেপনা যেন আড়াল পড়ে গেছে, তবে ‘বারোমাস’ সম্পাদক অশোক সেন শাণিতই আছেন; তাঁর কন্যা রুশতী, আমার কাছে অন্তত, উজ্জ্বলতার ঈশ্বরী।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে-পড়া বন্ধুদের মনখারাপ হবে, কিন্তু কবুল করতে বাধ্য হচ্ছি, যাঁদের বক্তৃতা তখন কয়েক সপ্তাহ ধরে শুনেছি, একমাত্র অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকারের কথা বাদ দিলে, তাঁরা সবাই পর্যাপ্ত পরিমাণে বিস্মরণীয়। ঢাকায় যাঁদের কাছে পড়েছি, বুক চিতিয়েই বলবো, এঁরা কেউই তাঁদের সমগোত্রীয় নন। সব কিছুই কেমন ঢিলেঢালা, ভিড়-ভাড়াক্কা পরিবেশ, অধ্যাপকদের যথেষ্ট দেরি করে ক্লাসে ঢোকা, আরও দশ-বারো মিনিট নাম ডাকতেই ব্যয়, লেকচারগুলি না শুনলেও মহাভারত অশুদ্ধ হতো না।

মস্ত ব্যতিক্রম অবশ্যই বিনয় সরকার মশাই। পাগলাটে, কিন্তু এক আজব জাদু-মাখানো পাগলামি। ঘণ্টা পড়বার সঙ্গে-সঙ্গে আসতেন। নাম ডাকা নিয়ে ভ্রূক্ষেপ ছিল না। পঞ্চাশ মিনিটের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি আমাদের জ্ঞানের-কৌতুকের প্রবাহে ভাসিয়ে নিয়ে যেতেন। ওঁর অধ্যাপনার বিষয় ইংল্যান্ড ও ভারতবর্ষের আর্থিক ইতিহাস। তা তো উপলক্ষ্য মাত্র। প্রতিদিন মৌলিক খেয়ালে তিনি নিজে মাততেন, আমাদের মাতাতেন। কথায় ধার, চোখে বিদ্যুৎ, মাঝে-মাঝে চেয়ার ছেড়ে কপট ক্রোধে আস্তিন গুটিয়ে ছাত্রদের দিকে তাঁর ধাবমান হওয়া। তিনি যা পড়াতেন, তা থেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের জবাব দিতে কতটা সুরাহা হতো, আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু কল্পনার অনেকগুলি দিক তিনি কেমন সহজ করে খুলে দিতেন। অন্তত দু’টি বিষয় বা তত্ত্ব যা তিনি উল্লেখ করেছিলেন, উদ্ভট বা অনুদ্ভট যা-ই হোক, এখনও মনে গেঁথে আছে। এক, তাঁর ঈষৎ-পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে: ‘চুরিবিদ্যা বড়ো বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা; বিনয় সরকার বলে, চুরিবিদ্যা বড়ো বিদ্যা যদিও পড়ে ধরা’। তাঁর ব্যাখ্যা: ইংরেজরা সারা পৃথিবী থেকে অসাধু উপায়ে কাঁচামাল চুরি করে প্রযুক্তি গড়ে নিজেদের শিল্পোদ্যমে সফল হতে পেরেছিল; তাদের ভূমিকা তস্করের, তবু তাদের ভূমিকা সাফল্যেরও, সুতরাং চৌর্য ধরা পড়লেই বা কী! আকর্ষণীয় অন্য যা বলতেন বিনয় সরকার মশাই, প্রায় প্রতি-পিরিয়ডেই বলতেন, ইংরেজি ভাষার উপর ভর করে: ‘দ্য ব্যাটল অফ ইম্ফল ইজ সারপ্লাস ভ্যালু’। আমরা ধন্ধে, জলবৎ তরল করে বুঝিয়ে দিতেন তিনি। সুভাষচন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকদের কাছ থেকে পাঠ্যবিষয়গত শিক্ষার বাইরেও অনেক-কিছু পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন একটি প্রেরণা, আহরণ করেছিলেন একটি প্রতিজ্ঞার গর্ব। সেই প্রতিজ্ঞা ও প্রেরণার ফলেই সুভাষ আই সি এস হলেন, আই সি এস ছাড়লেন, কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান কর্মকর্তা হলেন, গ্রেপ্তার হয়ে মান্দালয়ে, সেখান থেকে ফিরে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, কলকাতার মেয়র হলেন, ইওরোপে গিয়ে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন অব্যাহত রাখলেন, ‘ভারতীয় সংগ্রাম’ বইটি লিখলেন, হরিপুরায় জাতীয় কংগ্রেসে সভাপতি, গান্ধিজীর বিরুদ্ধে লড়াই করে ত্রিপুরী কংগ্রেসে ফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন, কিছু লোকের ষড়যন্ত্রে তাঁকে পদত্যাগ করতে হলো, ফরোয়ার্ড ব্লক গড়লেন, হলওয়েল মনুমেন্ট আন্দোলন হলো, বিদেশে নিষ্ক্রমণ, তারপর আজাদ হিন্দ ফৌজ: এ-সমস্ত কিছুই ওই প্রেসিডেন্সি কলেজে পঠন থেকে আহৃত সারপ্লাস ভ্যালু, ‘দ্য ব্যাটল অফ ইম্ফল ইজ সারপ্লাস ভ্যালু’। আমরা যারা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সুযোগ পাইনি, তাদের কাছে উদ্বৃত্ত মূল্য, কবুল না করে উপায় কী, আমৃত্যু অধরাই থেকে যাবে।

আমার দিন ফুরোললা, ব্যাকুল বাদল সাঁঝে না হলেও ফুরোলো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জবাব পেয়ে গেলাম, অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি, অতঃ কিম্‌। হঠাৎ অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্তের কথা মনে পড়ে গেল, তিনি ততদিনে কটকের র‍্যাভেনশ কলেজের কাজ ছেড়ে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রধান অধ্যাপক। কী আশ্চর্য, এক সপ্তাহও সময় লাগলো না, তিনি ওখানকার উপাচার্য অমরনাথ ঝার সঙ্গে কথা বললেন, আমি বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে কাশীতে অমিয়বাবুর বাড়িতে হাজির, কোনও বছরের ক্ষতি হলো না আমার। অন্তত সেই মরশুমে, উদ্বাস্তু ছাত্রদের সম্পর্কে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বেশি সহানুভূতি দেখিয়েছিল, অন্য নানা প্রশ্নচিহ্ণ সত্ত্বেও।

মফস্বলের বাঙাল, মফস্বলের বাঙালই থেকে গেলাম, শুধু স্থান পরিবর্তন, ঢাকার বদলে কাশী। সনাতন হিন্দু ধর্মের যত অপগুণ তা ওই চল্লিশের দশকের উপান্তেই কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পুঞ্জীভূত। প্রাদেশিকতাবোধ, পরধর্মঅসহিষ্ণুতা, কূপমণ্ডুকতা, কূটকচালি—কিছুরই অভাব ছিল না কাশীতে, এখনও নেই। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কার্পণ্য নেই আমার, তা হলেও, ভাগ্যি ভালো, এক বছরের তেমন বেশি সময় আমাকে সেখানে থাকতে হয়নি। অমিয়বাবুর বাড়িতে ক’দিন থেকে গিয়ে উঠলাম হিন্দু কলেজের ছাত্রাবাস বিড়লা হস্টেলে। বিড়লাবাবুরা নিদান দিয়েছিলেন, তাঁদের টাকায় প্রতিষ্ঠিত ছাত্রাবাসে আমিষের প্রবেশ ঘটতে পারবে না, সুতরাং পার্শ্ববতী ব্রোচা হস্টেলের বাঙালি মেসে দু’বেলা খেতে যেতাম। আমাকে বাদ দিয়ে ওখানে সবাই বিজ্ঞানের ছাত্র। অবশ্য মাছ-মাংস প্রত্যহ খাদ্যের তালিকাভুক্ত ছিল না, শুধু সপ্তাহান্তে, শনি ও রবিবার, আমিষচর্চা। বাকি দিন ফুলকো চাপাটি, ডাল, ঢ্যাঁড়শ কিংবা অন্য কোনও শুকনো সবজি সহযোগে তরকারি, যাকে বলা হত সুখা, সব শেষে আলুর সঙ্গে পটোল কিংবা মটরশুঁটি, কিংবা ফুলকপির মিশেল, ঝোল-ঝোল, ব্যাকরণগত নাম নাকি রসদার, একবার অভ্যাস হয়ে গেলে খেতে অসুবিধা হতো না, পুষ্টিকর। মাস দুয়েকের মধ্যেই আমার লিকলিকে শরীরে মাংস যুক্ত হলো।

কয়েক মাস বাদে আমার বাবা-মাও ঢাকা থেকে চলে এলেন, ওখানে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা তাই সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেল। ঢাকায় ফিরে যেতে না-পারার জন্য স্বভাবতই একটু মন খারাপ। সেই প্রসঙ্গ পাশে সরিয়ে রাখলে কাশীর অধ্যায়টি আমার পক্ষে যুগপৎ পরম সৌভাগ্যের ও চরম বিরক্তির। বিরক্তি এই কারণে যে, স্বাধীন ভারতের সংকীর্ণতম মানসিকতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় এখানে। আর মস্ত সৌভাগ্যের হেতু, প্রায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই, অর্থনীতি বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষক পাতে দেওয়ার যোগ্য ছিলেন না। শাপে বর সেজন্যই। অমিয় দাশগুপ্ত নিজেই প্রচুর পরিশ্রম করে অনেক কিছু পড়াতেন, অর্থশাস্ত্রের ইতিহাস, অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব, বৈদেশিক বাণিজ্যের তত্ত্ব, মুদ্রা ব্যবস্থার তত্ত্ব। উনি ক্লাসে যা পড়াতেন, তা প্রায় গীতিকবিতার মতো মর্মে প্রবেশ করতো। প্রতিটি লেকচারের প্রতিটি বাক্য নিজের বিশেষ সাংকেতিক ভাষায় টুকে নিতাম, হস্টেলে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় সংকেত থেকে সম্প্রসারণের পর স্পষ্ট করে লিপিবদ্ধ করা। তা-ই যথেষ্ট, আমার আর বাড়তি পড়াশুনোর দরকার হতো না। তবে বারবার করে যে-কথা বলতে হয়, আরও বেশি করে অর্থনীতির ভিতরে প্রবেশ করতে পেরেছিলাম রবিবার কিংবা অন্যান্য ছুটির দিনে অমিয়বাবুর বাড়ি হাজির হতাম বলে। ভিতরের বারান্দায় তিনি একটি বেতের চেয়ারে বসতেন, আমি সামনে দাঁড়াতাম, হয়তো কোনও দেওয়ালের গা ঘেঁষে। তিনি একটির পর একটি অর্থনীতির সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন: হয়তো তত্ত্বগত সমস্যা, হয়তো কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা, যার বিশেষ অর্থনীতিগত ব্যঞ্জনা আছে, কিংবা কোনও সমসাময়িক দিশি কিংবা আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে। তিনি বলতেন, আমি শুনতাম, কোনও প্রশ্ন করার দরকার হতো না, তিনি প্রতিটি বিষয়েই প্রাঞ্জলতম। মাঝে-মাঝে চা-জলখাবার আসত, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই খেতাম। আমি খুব কম বই পড়েছি, খুব কম বইয়েরই নাম জানতাম। অমিয়বাবু কোনও ব্যাপারেই নামাবলী আস্ফালন পছন্দ করতেন না। বাড়তি বই পড়লেই, তিনি বলতেন, বাড়তি বিষয় জানা হয় না, বরঞ্চ একটি বিশেষ বই ভালো করে পড়তে উপদেশ দিতেন, তাঁর ছাত্রাবস্থায় তিনি যেমন অ্যালফ্রেড মার্শালের ‘প্রিন্সিপিলস্‌ অফ ইকনমিক্স’ আদ্যোপান্ত পড়েছিলেন প্রতিটি পাদটীকাসহ। এ ব্যাপারে কলকাতার অধ্যয়নসংস্কৃতি নিয়ে তাঁর বিশেষ আপত্তি ছিল: ‘ওঁরা ফুলঝুরির মতো ক্লাসে নামের তালিকা ছড়ান। এক ধরনের অস্বাস্থ্যকর আদিখ্যেতা, ছেলেমেয়েরা উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে এই-বই ওই-বইয়ের খোঁজ করে, এই-নাম ওই-নাম মুখস্থ করে, বিষয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবার সুযোগ পায় না। কলকাতার ছাত্র-ছাত্রীদের মতো দুর্ভাগা কেউ নেই, তবে অপরাধটা ওদের নয়, ওদের মাস্টারমশাইদের’।

তা হলেও দিন গুনতাম কবে গ্রীষ্মবকাশ বা শীতাবকাশ বা শারদাবকাশ শুরু হবে। সঙ্গে-সঙ্গে পঞ্জাব মেলে চড়ে কলকাতায়, ভেসে যাওয়া কলকাতার কাঙিক্ষত আড্ডায়। কাশীতে নতুন করে কারও সঙ্গে তেমন পরিচয় হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি সমিতি খুব সক্রিয়, মাঝে-মাঝেই চড়ুইভাতি অথবা নাটক অথবা সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন। এ সমস্ত অনুষ্ঠানে মাস্টারমশাইদের সদ্যোদ্ভিন্নিযৌবনা কন্যা বা ভ্রাতুস্পুত্রীরাও যোগ দিতেন, ছাত্রদের চাঞ্চল্য স্বভাবতই একটু বাড়তো।

পুনরুক্তি করছি, কাশীতে ওই কয়েকটা মাস থাকার সবচেয়ে বড়ো লাভ, অমিয় দাশগুপ্ত মশাইয়ের কাছে অর্থশাস্ত্রে হাতেখড়ি, যা সারাজীবন আমার পাথেয় জুগিয়েছে। অন্য যে-লাভের কথা সেই সঙ্গে বলতে হয়, তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী শান্তি মাসিমার কাছ থেকে অপত্য স্নেহপ্রাপ্তি। ঘরের ছেলে হয়েই গিয়েছিলাম, ঘরের ছেলে হয়েই থেকেছি পরবর্তী চল্লিশটিরও বেশি বছর। সুখে-দুঃখে আপদে-বিপদে আমাকে অভয় জুগিয়েছেন তাঁরা, উপদেশ বর্ষণ করেছেন, ভর্ৎসনা করেছেন। আমার জীবন যে-আদল পেয়েছে তার জন্য অনেকাংশেই তাঁরা দায়ী। কখনও-কখনও আমার অবিমৃষ্যকারিতা তাঁদের আহতও করেছে। এ বিষয়ে বেশি কিছু লিখতে যাওয়া আমার পক্ষে ধৃষ্টতা হবে বলে মনে হয়।

কাশীবাসে অন্যতর লাভ হয়েছিল ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত ঠেসে শোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রধান আকর্ষণ সংগীত কলেজ, পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ তার অধ্যক্ষ। অনেক প্রথিতযশা সংগীতজ্ঞ কলাবিশারদ অতিথি হিশেবে আসতেন। সংগীত কলেজের প্রাঙ্গণ ঢেকে মস্ত সামিয়ানা টাঙানো হতো। ভোর রাত্রিতে আকাশে যখন ফিকে রঙের ছোপ লাগতো, ততক্ষণ পর্যন্ত সংগীতে অবগাহন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে। তবে এখন যেন কেমন খটকা লাগছে, বছরজোড়া যাঁদের সংগীত শুনে ধন্য হয়েছি, তাঁদের মধ্যে মুসলমান ওস্তাদদের তালিকা ধু-ধু শাদা। সেই অভাব অবশ্য দু’বছর লখনউ থাকাকালীন পরে পুরো মিটিয়ে নিতে পেরেছিলাম।

বরাবরই বন্ধুসর্বস্ব দিনাতিপাত আমার, কিন্তু কাশীতে তেমন কোনও সখাসংগ্রহের সৌভাগ্য ছিল না। তবু, বলতেই হয়, কী করে যেন মরভি হস্টেলের এক দঙ্গল ফার্মেকোলজি পাঠরত বাঙালি ছাত্রের সঙ্গে ভীষণ দোস্তি হয়ে যায়। দু’জনের কথা একট বেশিভাবে মনে পড়ে: মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ও অনিল সেনগুপ্ত। তারা আমাকে প্রায়ই নেমন্তন্ন করে তাদের মেসে খাওয়াতো, প্রচুর অশ্লীল বাংলা গানে, এমনকি রবীন্দ্রনাথের নানা গানের কথা বদলে নিয়ে পর্যন্ত, সুধাসিঞ্চিত করতো। তাদের কাছে একটি বিশেষ ঋণের কথা আমৃত্যু ভুলতে পারবো না। এম.এ পরীক্ষায় বসেছি, পরীক্ষা চলছে, হঠাৎ অসতর্কতার কারণে কানের কোণ পেকে উঠে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়লো। সারা মুখ ফুলে ডোল, অসম্ভব ব্যথা, শরীরে জ্বর। সাতসকালে পরীক্ষা দিতে বসবো; দুঃসহ ব্যথায় কাতর আমি, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মাঝরাত্রে প্রায় এক মাইল হেঁটে মরভি হস্টেলে পৌঁছুলাম। বন্ধুরা সেঁকের ব্যবস্থা করলো, কেউ সাইকেল চেপে কোনও অজ্ঞাত পাড়া থেকে এক হাতুড়ে ডাক্তার ডেকে নিয়ে এলো, তিনি কড়া পেনিসিলিন ছুঁচ দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দিলেন, ভোরবেলা জ্বরমুক্ত, বেদনামুক্ত হয়ে পরীক্ষা দিতে বসলাম।

এই পরীক্ষার ঋতুরই অন্য তিনটি স্মৃতি। তখনও আপেক্ষিক সস্তা গণ্ডার দিন। বিড়লা হস্টেলে টানা বারান্দার পাশে আমার ঘরের জানালা, তা ঘেঁষে পড়ার টেবিল, বিকেল থেকে শুরু করে অনেক রাত্রি পর্যন্ত পরীক্ষার পড়া চলতো। একটি চিনেবাদামওলাকে মাসের গোড়ায় দশ টাকা আগাম দিয়ে রেখেছিলাম। সে প্রতি বিকেলে টেবিল উজাড় করে চিনেবাদাম ছড়িয়ে দিয়ে যেত, বাদাম ভেঙে নুন সহকারে চিবোতাম, রাজকীয় সুখ, বিকেল কেটে গাঢ় রাত্রির সমাগম। আর যা মনে পড়ছে, অনিল সেনগুপ্ত, বিশ্বনাথ পাড়া থেকে সাইকেলে তার হস্টেলে ফেরবার পথে, পাঠরত আমার সঙ্গে মসকরা করবার উদ্দেশ্যে বিড়লা হস্টেলের পাশ দিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমার প্রিয়তম রবীন্দ্রনাথের গান উঁচু গলায় গাইতে-গাইতে যেত, যেন মনে করাবার জন্য, অর্থনীতিতে পরীক্ষায় বসা তুচ্ছাতিতুচ্ছ, রবীন্দ্রনাথের গানের মোহ এড়িয়ে আমি অযথা কেন অন্ধ নরকে নিজেকে বন্দী করে রাখছি। পরীক্ষা-সংক্রান্ত শেষ স্মৃতি: ভোরবেলা পরীক্ষা, একটি মাঠের মধ্য দিয়ে পরীক্ষার হলের দিকে যাচ্ছি। একগাদা ইটের পাঁজা জড়ো করা এক জায়গায়, সদ্য-উদিত রোদের কিরণচ্ছটার আভায় রক্তলাল হয়ে যাচ্ছে। এখনও, কাশীতে পরীক্ষায় বসার কথা মনে এলেই, আমাকে আওড়াতে হয়: রোদে রাঙা ইটের পাঁজা, তার উপরে বসলো রাজা, ঠোঙা ভরা বাদামভাজা, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না।

একটু আগে যা বলেছি, কাশী থেকে প্রতি ছুটিতে কলকাতা। প্রথমবার এসেই দেখি কলকাতার চেহারা পালটে গেছে। বারুদের গন্ধ। দুপুরে-বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে, তার বাইরে কলেজ স্ট্রিটে, ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের নিত্যনৈমিত্তিক সংঘর্ষ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকেও পুলিশ কর্তৃক ছাত্রদের তাড়া করা। একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছিলাম একদিন। পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে সঙিন বাগিয়ে একতলা থেকে দোতলায়, দোতলা থেকে তেতলায় আশুতোষ বিল্ডিং-এ পেটো-নিক্ষেপকারী ছাত্রদের হন্যে হয়ে খুঁজছে, অথচ এরই মধ্যে, কলকাতায় তখনও গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়নি, কোনও ক্লাসঘরে ছাত্রছাত্রীরা নিরুদ্বিগ্নে ইতিহাস বা ইংরেজি সাহিত্যের উপর অধ্যাপকের বক্তৃতা নিবিষ্ট চিত্তে শুনছে, বাইরে বোমা-বন্দুকের দুন্দুভি। চোরাগোপ্তা ইটপাথর বা বোমা ছুঁড়ে ছাত্রদের এ গলিতে-ও গলিতে অহরহ ঢুকে যাওয়া, কখনও পুলিশের গুলি, কখনও একজন-দু’জন হতাহত। ফুটপাথে-সাজানো বইয়ের দোকানগুলির পাশে রক্তের দাগ না-মেলানোর আগেই ছিটকাপড়, খেলনা কিংবা অন্য কোনও সামগ্রীর সম্ভার ছড়িয়ে ফেরিওয়ালাদের জীবিকা-নিষ্ঠা, যেন সব কিছুই অতি সাধারণ। কলকাতার ছাত্রসমাজ আরও বেশি বামপন্থার দিকে ঝোঁকা, মধ্যবিত্তদের বড়ো অংশও। তখন থেকেই কলকাতার লালদুর্গ হিশেবে খ্যাতির শুরু, যদিও কমিউনিস্ট পার্টি তখনও বেআইনি।

কলকাতায় বন্ধুদের ঢল, কবিদের ভিড়, পাশাপাশি রাজনীতির মাতোয়ারাও। দেশটাকে আমূল নতুন করে গড়তে হলে মার্কসীয় ভাবাদর্শের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই: প্রতিদিন এই প্রতীতিতে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে আসা। অথচ, পার্টির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ, আমার তখনও হয়নি। হয়নি আরও প্রায় বছর পনেরো। তাতে আনুগত্যে ঘাটতি ঘটেনি, রক্ত পতাকায় তখন থেকেই আমার ঘোর-লাগা অনুরাগ।

এম.এ পরীক্ষার ফল বেরোলো, কলকাতায় ফল বেরোবার আগেই কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল প্রকাশিত, একটু চিমটি কেটে কলকাতাস্থ সহপাঠীদের সঙ্গে আমার রসিকতা বিনিময়। কিন্তু সমস্যা, এখন তো সরকারি তকমা-আঁটা বেকার, বেশ কয়েক মাস ধরেই বেকার। ইতিমধ্যে আমার কাকা কলকাতায় চলে এসেছেন, পিসির বাড়ির কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া করেছেন। ওখানেই আমার আস্তানা। প্রতিদিন টালা পার্ক থেকে কলেজ স্ট্রিট কি বালিগঞ্জ বাসে চেপে চলে আসি। কখনও দুপুরে কাকিমার আশ্রয়ে ফিরি, দ্বিপ্রহরিক আহারের উদ্দেশ্যে, কখনও তা-ও না, একেবারে রাত দশটা বাজিয়ে তবে ফেরা। এখন ভাবতে অবাক লাগে, কত বাসের ছড়াছড়ি ছিল কলকাতায় তখন; নাকি ভুল বললাম, আসলে বাসের তুলনায় জনসংখ্যার হ্রস্বতাহেতুই ওরকম মনে হত। একটু বেশি রাত্রে দু-নম্বর বাসে চেপে ফিরতে হবে, এই বাসটা পছন্দ হলো না, অস্যার্থ বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ আরও একটু প্রলম্বিত করা। পাঁচ মিনিট বাদে যে-খালি বাসটা এল, তাতে লাফিয়ে চড়ে বসা, কিংবা তাতেও না, কারণ ইতিমধ্যে আতোয়ার রহমান জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ প্রকাশ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের আঁকা উগ্র নীল প্রচ্ছদ-সহ। সুরঞ্জন হঠাৎ এসে-যাওয়া পরের বাসটির সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলো, ‘অই বাসে যেয়ো নাকো তুমি’।

হাওয়া বদলের পালা। আমি মার্কসবাদে ও কমিউনিস্ট পার্টির দিকে ঝুঁকছি, বুদ্ধদেব বসু বিপরীতমুখো হচ্ছেন, উগ্র থেকে উগ্রতর, উগ্রতর থেকে উগ্রতম৷ কবিতাভবনের প্রাক্তন বন্ধুরা আসা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, আমরা কচিকাঁচারাই শুধু যাই। আমি কিন্তু গিয়ে প্রায়ই ঝগড়া করি। ঢাকা থাকাকালীনই আমাকে বুদ্ধদেব যেসব চিঠি লিখতেন, তা থেকে আমার একটা মস্ত উপকার হয়েছিল। তিনি ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আমার কাব্যপ্রতিভা প্রায় শূন্যের কোঠায়, অথচ সঙ্গে-সঙ্গে গভীর মমতার সঙ্গে জানাতেন, আমার গদ্যের হাত ভালো, খুব ভালো, খুবই ভালো। উদ্ধত অর্বাচীন বয়স, তখন ঠিক মানতে চাইতাম না তাঁর এই মহামূল্য উপদেশ। তবে সেটা গৌণ, আমার সঙ্গে বুদ্ধদেবের তখন বিতণ্ডা রাজনৈতিক আদর্শের প্রেক্ষিতে। পুরনো ‘চতুরঙ্গ’ ঘেঁটে, কিংবা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের তরফে প্রচারিত, বুদ্ধদেবের ফ্যাসিবিরোধী আদি রচনাগুলি পড়ছি, সসামেন চন্দ-র হত্যা নিয়ে ক্রোধ-ও আবেগ-মিশ্রিত তাঁর দীর্ঘ কবিতা, কিংবা ‘ফ্যাসিবাদ ও সভ্যতা’ নামে লম্বা প্রবন্ধ। মনে পড়ছে প্রতিভা বসু পর্যন্ত ‘ফ্যাসিবাদ ও নারী’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের পুস্তিকা লিখেছিলেন একদা, সম্ভবত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উপরোধে। তাঁদের কাছে সে-সব এখন বাতিল।

রিপন কলেজের কাজ বুদ্ধদেব বসু তখন বেশ কয়েক বছর হলো ছেড়ে দিয়েছেন। কলেজ তেমন-একটা সুখের সময় ছিল না তাঁর কাছে। স্বভাবলাজুক, চ্যাংড়া ছাত্ৰকুল সামলাতে ঘোর অপটু তিনি। ছাত্রদের ভয়ই পেতেন বোধহয়, ছুতো পেলেই কলেজ কামাই করতেন। গল্পটি বুদ্ধদেব নিজেই আমাকে বলেছিলেন। অধ্যক্ষের ঘরে টেলিফোন, একদিন কাউকে ফোন করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, শুনতে পেলেন এক ছাত্র আর একজনকে বলছে, ‘জানিস, শালা জাহানারাকে ফোন করে এলো’। জাহানারা চৌধুরী তিরিশের দশকের এক চলবলে বহুগুণবতী উত্তেজক মহিলা, ‘স্কুলের মেয়ে’ নামে একটি বই লিখে নাম কুড়িয়েছিলেন, বুদ্ধদেব বসু সে-বইয়ের এক গদোগদো আলোচনাও করেছিলেন কোনও পত্রিকায়, সম্ভবত ‘মৌচাক’-এ। হয়তো, কবিতাভবন থেকে পুস্তক প্রকাশ করতে গিয়ে, অনভিজ্ঞতার কারণেই, প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তাঁর; নতুন প্রজন্মের রুচি পাল্‌টেছে, বুদ্ধদেবের গল্প-উপন্যাসের কাটতি ভীষণ কমে গেছে। স্পষ্ট বোঝা যেত, সপরিবার ঈষৎ অনটনের মধ্যে আছেন। আমার সঙ্গে মতের মিল নেই, আমাকে উপেক্ষা করে নরেশ গুহ-অরুণকুমার সরকারের কবিতার দিকে তাঁর পক্ষপাত। অথচ মুগ্ধ হয়ে যেতাম বুদ্ধদেবের নিষ্ঠা ও তিতিক্ষা লক্ষ্য করে। প্রতিদিন নিয়ম ধরে লিখছেন, নিয়ম ধরে পড়ছেন, সংস্কৃত ভালো জানতেন না, কোনও পণ্ডিতপ্রবরের কাছ থেকে শিখতে শুরু করেছেন। আমাদের মতো ফিচকের দল অসময়ে এসে বিরক্ত করছি, কিন্তু তাঁর অভ্যর্থনায় কোনও যতিমুহূর্ত নেই। আমাকে ‘সাতটি তারার তিমির’ সমালোচনার জন্য দিয়েছিলেন। গায়ে আমার তখনও ‘বৌদ্ধ’ গন্ধ। ‘কবিতা’ পত্রিকায় যে-সমালোচনা বেরোলো, তা যথেষ্ট বিরূপ। জীবনানন্দের পছন্দ হয়নি, পরে আমাকে তিনি বলেওছিলেন তা। তবে জীবনানন্দের সেই ক্ষোভের ঋতু নিশ্চয়ই খুব সংক্ষিপ্ত ছিল।

কিছুদিন বাদে বুদ্ধদেব এক কপি ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ হাতে ধরিয়ে দিলেন, ‘কবিতা’র জন্য সমালোচনা চাই। আমি ঠোঁটকাটা লম্বা বহরের আলোচনা লিখলাম, এবার বুদ্ধদেবের অসন্তোষ, লেখাটি ‘কবিতা’-য় অন্তর্ভুক্ত হলো না। ততদিনে আতোয়ার রহমানের সঙ্গে আমার নিবিড় বন্ধুত্ব। তিনি উঁচিয়েই ছিলেন, তবে ‘কবিতা’-য় প্রত্যাখ্যাত সমালোচনা সঙ্গে-সঙ্গে ‘চতুরঙ্গ’-এ বের করতে আমার বিবেকে বাধলো, সৌজন্যে বাধলো। আতোয়ারকে রাজি করাতে পারলাম যে, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে কৌতুকেরও দাঁড়ি টানতে হয়।

এই বেকার মাসগুলিতেই নরেশ গুহর সঙ্গে সখ্য পল্লবিত হওয়া। আমার চেয়ে অন্তত চার বছরের বড়ো নরেশ, সাত বছরের বড়ো অরুণকুমার সরকার ও সুরঞ্জন দু’জনেই। তবে ওরকম কবিতার-প্রেমে-উচ্ছন্নে-যাওয়া যুবক সম্প্রদায়ের কাছে এমনধারা বয়সের ফারাক আদৌ ধর্তব্য নয়, অন্তত আমাদের ক্ষেত্রে ধর্তব্য ছিল না। নরেশ তখন সদ্য চারুচন্দ্র কলেজে অধ্যাপনা গ্রহণ করেছেন, সত্যেন দত্ত রোডে নতুন ফ্ল্যাট নিয়েছেন, আনকোরা নতুন বাড়িতে, দোতলায়, উত্তর দিকে অপরিসর ব্যালকনি সমেত। ওই ফ্ল্যাটে আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আড্ডা, লেখালেখিও। নিরুপম চট্টোপাধ্যায় ঘোর বুদ্ধদেবপ্রেমিক, চাইবাসা না বিহারের অন্য কোথাও থেকে কলকাতায় জড়ো হয়েছে, তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কিন্তু আসল এঁচোড়ে পাকা। আলাপের প্রথম দিনেই আমাকে অনুপ্রাসবিন্যাসে শিক্ষা দিল, ‘অশোক তোশকে শুয়ে মশক মারিল’।

নরেশ অতি ভদ্র অতি সংস্কৃত মানুষ; খানিকটা বুদ্ধদেবকে অনুসরণ করতে গিয়ে, খানিকটা অমিয় চক্রবর্তীকে, দুই কবি তথা শ্রদ্ধাবান শিক্ষকের দোটানায় পড়ে ঈষৎ বিচলিত। সেই দ্বৈত দেবভক্তির পর্ব ওঁর একটু কাটলো বছর পনেরো-ষোলো বাদে যখন অমিয় চক্রবর্তী মার্কিনিদের ভিয়েতনাম লীলাকেলির ঘোর বিরোধী হয়ে গেলেন, মার্কিনদের চাবকে প্রবন্ধ লিখলেন।

আমরা অন্যরা আজন্ম নাস্তিক, যাঁরা ভক্তির ছুৎমার্গ-বিলাসী তাঁদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে-আক্রমণে ঢিট করতে ভালোবাসি। সুতরাং প্রতিদিন নরেশরূপী অভিমন্যু বধের পালা। কিন্তু ওঁর ভালোত্বের তুলনা নেই, এই এতগুলি দশক, স-চিনু, আমাদের অত্যাচার সহ্য করে আছেন। এখন তো সবাই জীবনের উপান্তে, অরুণ-সুরঞ্জনের মতো কেউ-কেউ ইতিমধ্যেই অন্তর্হিত।

ওই বছরগুলিতে, সুরঞ্জন ও অরুণকে যেমন, নরেশকেও আমি রাশি-রাশি চিঠি লিখেছি, ক্ষণিকের মস্তিষ্কবিকৃতিহেতু কোনও মাসে প্রতিদিনই। ক্যাম্বিসের দুটো বিরাট ঝোলায় সংরক্ষিত ছিল আমার কাছে লেখা সে-সব চিঠি। বন্ধুদের লেখা চিঠি, জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব-সুধীন্দ্রনাথের চিঠি, পুরনো মাস্টারমশাইদের চিঠি, দু’-একজন বান্ধবীর চিঠি, সবই এখন হারিয়ে গেছে কোথায়। প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে, আমি তখন বিদেশে, কলকাতার বাড়িতে যে-তোরঙ্গের মধ্যে চিঠিগুলি রাখা ছিল, তা কোন জাদুবলে অদৃশ্য হয়ে যায়। জীবনে এর চেয়ে বড়ো শোক পাইনি। অথচ কী ভয়ংকর বিপদ, কয়েকদিন আগে নরেশ হঠাৎ জানালেন, তাঁকে লেখা আমার সমস্ত চিঠি তাঁর জিন্মায় এখনও অটুট অবস্থায় আছে, সেগুলি প্রকাশ করবার জন্য অনুমতি প্রার্থনীয়। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে ওঁর উপর যে-অত্যাচার চালিয়েছি, তা নিয়ে অভিযোগবোধ হয়তো নরেশের হৃদয়ে সুপ্ত ছিল, এবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একেই বোধহয় বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ।

মজার ব্যাপার, যদিও আতোয়ার রহমানের সঙ্গে ময়মনসিংহের সেই ছাত্র সম্মেলনের সময় থেকেই সামান্য আলাপ ছিল, পাকাপাকি পরিচয় হলো নরেশেরই সূত্রে ১৯৪৯ সালে, কফি হাউসে। আমার সঙ্গে আতোয়ার রহমানের চরিত্রগত কোনও মিলই নেই। তিনি শৌখিন, আমি আটপৌরে। তিনি দুর্দান্ত ট্রটস্কিপন্থী; আমি, বাজারে গুজব, নিকষ স্টালিনবাদী। ছাত্রাবস্থা থেকেই আতোয়ারের পয়সাকড়ির অভাব ছিল না। জনশ্রুতি, একবার ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনের প্রাক্কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্রীদের নিজের পয়সায় লাইটহাউসে সিনেমা দেখিয়েছিলেন; নির্বাচনে তাঁর জয় আটকায় কে। অন্যদিকে আমাদের পরিবারে তখন প্রচণ্ড আর্থিক দুর্গতি। শিয়ালদহে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তু না-হলেও, খুব একটা রকমফের নেই। এ এক অদ্ভুত রসায়ন, পঞ্চাশ বছর ধরে আতোয়ারের সংসার ও আমার সংসার একাকার হয়ে আছে। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে আতোয়ারের অকস্মাৎ মৃত্যু সত্ত্বেও সেই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেনি। নরেশকে পেরিয়ে, প্রায় নরেশকে এড়িয়েই, আমি ‘চতুরঙ্গ’-এর বাঁধা লেখক হয়ে গেলাম, ‘চতুরঙ্গ’-এর আড্ডার বাঁধা খদ্দের! তা ছাড়া, ‘চতুরঙ্গ’ মানেই তো তখন পাশের ফ্ল্যাটের ‘পূৰ্ব্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও প্রকাশক সত্যপ্রসন্ন দত্তর নিত্য সাহচর্য। অথচ যাঁরা এখানে নিয়মিত জড়ো হতেন, তাঁদের অধিকাংশেরই রাজনৈতিক বিশ্বাস আমার মতের ঘোর পরিপন্থী।

সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও সত্যপ্রসন্ন দত্ত তাঁদের উঠতি-বাঙালি ধনতান্ত্রিক মানসিকতার অঙ্গে ভাসা-ভাসা ট্রটস্কিবাদের অঙ্গরাগ ছড়িয়েছিলেন। গণেশচন্দ্র এভিনিউর ওই দালানেই পাশের অন্য-একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন শিলু পেরেরা, শ্রীলঙ্কার একদা ডাকসাইটে ট্রটস্কিপন্থী নেতা এন এম পেরেরার একদা-সহধর্মিণী, এন এম পেরেরা একটা সময় সিরিমাভো বন্দরনায়েকের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। শিলু পেরেরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পুলিশ এড়িয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন, যুদ্ধ শেষ হলেও কলকাতাতেই থেকে গেলেন, হয়তো কলম্বোর খেয়ালি মেজাজের সঙ্গে কলকাতার কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই। পাশের অন্য একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন অজিত রায় মুখুজ্যে এবং তাঁর জর্মান সহধর্মিণী; এঁরাও নাম-লেখানো ট্রটস্কিপন্থী। ‘চতুরঙ্গ’-এর আড্ডায় আর হাজির থাকতেন ঘনিষ্ঠ সুহৃদ নৃপেন্দ্র সান্যাল, এবং নিকষ ট্রটস্কিপন্থী ইন্দ্র দত্ত সেন, যাঁকে আমরা সবাই ‘বড়দা’ বলতাম; সত্যপ্রসন্ন দত্তকে ডাকতাম ‘বড়োবাবু’। হংস মধ্যে বক অথবা বকের ভিড়ে হাঁস হয়ে আমি উপস্থিত। যে-সমস্ত গোঁড়া কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে পরে পরিচয় হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে একমাত্র রবীন সেনেরই ট্রটস্কীয় আদর্শে কিছুদিন পথ চলা ছিল, গণেশ এভিনিউর ফ্ল্যাটে চল্লিশের দশকের শেষের দিকে তাঁকেও দু’-একদিন দেখেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ তো ‘শেষের কবিতা’র সর্বশেষ কবিতায় বলেই গেছেন, ‘তোমারে ছাড়িয়ে যেতে হবে’; রবীন সেন কয়েক বছরের ব্যবধানে কমিউনিস্ট পার্টিতে ফিরে আসেন।

এম. এ. পরীক্ষার ফল প্রকাশিত, ছাত্র নই আর, এরপর কী করবো জানি না। চিরকাল তো বেকার থাকা চলে না, কাশীতে মাস্টারমশাই অমিয় দাশগুপ্ত উদ্বিগ্ন। অবশেষে কলকাতার কুহকিনী আম্মা আমাকে ছাড়তেই হলো। কাকতালীয়, একই দিনে তিনটি বেকারত্ব ঘোচাবার মতো চিঠি পেলাম: পশ্চিম বাংলায় সরকারি কলেজে অধ্যাপনার কাজ, দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স-এ রাণাডে গবেষক হওয়ার আমন্ত্রণ, এবং, যা সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক, বঙ্গীয় কায়স্থ মহাসভা না ওরকম নামের কোনও সংস্থা থেকে মাসিক একশো টাকা মাইনেতে গবেষণা কর্মযোগে আহ্বান, গবেষণার নির্দিষ্ট বিষয় ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সত্যই ব্রাহ্মণ ছিলেন কি না’। তৃতীয় সম্ভাব্য চাকরিটি সুরঞ্জন সরকারের কীর্তি; সে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেছিল বিডন স্ট্রিট বা অন্য কোথাও দপ্তর-খোলা সংগঠনটি এক কায়স্থসন্তান খুঁজছে গবেষণা কাজের জন্য। গবেষণার বিষয় ও সিদ্ধান্ত পূর্ব থেকেই স্থিরীকৃত, মাসিক একশো টাকার বিনিময়ে তা ঝটপট লিখে দিতে হবে। ওঁদের নাকি মূল বক্তব্য, পিরেলি-ফিরেলি বাজে কথা, দ্বারকানাথ ঠাকুরের পূর্বসূরিরা আসলে ভাগলপুরে বসবাসকারী কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ, ওখান থেকে উত্তরবঙ্গে পৌঁছে ব্যবসাবাণিজ্যে পয়সাকড়ি করেছিলেন, অতঃপর কলকাতায় এসে চিৎপুর অঞ্চলে বসবাস। চিৎপুর পাড়াময় ছুতোর-মুচি-চামাররা ছড়ানো; হঠাৎ আগত পয়সাওয়ালা লোকদের তারা ‘ঠাকুর’ বলে সম্মানীয় সম্বোধন করতে শুরু করলো, তা থেকে ঠাকুর বংশপরিচয়। এই প্রতিপাদ্যটি গুছিয়ে লিখে দিলেই নাকি তিন মাসের কড়ারে মাসে একশো টাকা প্রাপ্য। সুরঞ্জন কালবিলম্ব না-করে আমার নামে এক দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছিল, অবশ্যই আমাকে না-জানিয়ে।

নিকট গুরুজনদের কথা অমান্য করে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা গ্রহণ করলাম না, কায়স্থ মহাসভার হাতছানিও ফিরিয়ে দিলাম, ভি কে আর ভি রাওয়ের উৎসাহ-ভরা লম্বা চিঠি পেয়ে ট্রেনে চেপে দিল্লিমুখো।

দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স-এর সেটা প্রথম কি দ্বিতীয় বছর। তখনও নিজস্ব দালান তৈরি হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগের একটি অংশে বিজয়েন্দ্র কস্তুরি রঙ্গ বরদারাজা রাওয়ের সাম্রাজ্য। রাও মহাশয়ের সঙ্গে সহকারী অধ্যক্ষ হিশেবে বীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়: মাটির মানুষ, অর্থনীতিতে কৃতিত্বের পাশাপাশি সাহিত্যে ও সংগীতে রুচিবান, রাধাকুমুদ-রাধাকমল মুখোপাধ্যায়দের ভাগিনেয়। আমার বাল্যকালে উনি কিছুদিন অমিয়বাবুদের সহকর্মীরূপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। মা’র মুখে শুনেছি, একদিন আমাদের বাড়িতে এসে নাকি অর্গান বাজিয়ে ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ গেয়েছিলেন। রাও মহাশয় বরাবরই উচ্চনাদ, হম্বিতম্বি করা তাঁর পছন্দ। যতক্ষণ স্কুলের পরিখার মধ্যে থাকেন, চেঁচিয়ে পাড়া মাত। অন্যদিকে বীরেনবাবুন নম্র, স্বল্পবাক, সুমিষ্ট নিচু কণ্ঠস্বর, মুখ তুলে কথা বলতেও যেন ঈষৎ জড়তা।

ঢাকায় আমার অন্যতম মাস্টারমশাই পরিমল রায় পুরনো দিল্লির যমুনাবর্তী মেটকাফ হাউসে আই এ এস শিক্ষানবিশদের জন্য যে-বিদ্যালয় খোলা হয়েছিল, তার অধ্যাপক হয়ে এসেছেন। তিনিও সপ্তাহে একদিন দিল্লি স্কুলে পড়াতে আসতেন। আর যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য ঘোর কাশ্মিরী পৃথ্বীনাথ ধর, যিনি পরে ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রণালয়ের সচিবরূপে, এবং তারও পরে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অন্যতম প্রধান রাজপুরুষ হিশেবে, খ্যাতিমান। আমার চেয়ে বয়সে অনেকটা বড়ো। পৃথ্বীনাথ ধর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরমহলের ছাত্রদের জন্য সদ্য-নির্মিত আবাসনস্থল গয়্যার হলেরও প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। গয়্যার হলেই আমার থাকবার জায়গা নির্দিষ্ট: দোতলায় বিলিতি প্রথায় বড়ো স্যুইট, একদিকে বসার জায়গা, সোফা-কোচ সমেত, অন্যদিকে শয়নকক্ষ, লাগোয়া ব্যালকনি, যা থেকে দিল্লির নিচু-নিচু পাহাড়-বনরাজি দেখা যায়। স্নানের জায়গা একটু দূরে, কিন্তু তা-ও ঝকঝকে। এক তলায় মস্ত খাবার ঘর, পাশে প্যান্ট্রি, প্যান্ট্রির ওধারে দরাজ রান্নাঘর, তিন-চারটে কী তারও বেশি চুল্লি জ্বলছে, সম্ভ্রান্ত হোটেলের কেতামাফিক শুভ্র পোশাক ও তেকোণা শাদা টুপি-পরা পাচকের দল। নানা প্রদেশ থেকে গবেষক-ছাত্রদের ভিড়, বেশ কিছু বিদেশী ছাত্রও, এমনকি খোদ মার্কিন দেশ থেকে পর্যন্ত। সদ্য স্বাধীন দেশ, প্রধান মন্ত্রীর নাম জওহরলাল নেহরু, প্রশাসনের পীঠস্থান নতুন দিল্লি, সেই পীঠস্থানে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়, যে-বিশ্ববিদ্যালয়ের এতদিন তেমন নামডাক ছিল না, কিন্তু এখন থেকে অন্যরকম হতে বাধ্য। ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার মরিস গয়্যার স্বাধীনতার মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তাঁরই নামাঙ্কিত আমাদের বাসকুঞ্জ।

ঠাঁট-ঠমকের অভাব নেই, তবে বাংলা প্রবচন তো বহুদিন আগে থেকেই শিক্ষা দান করে এসেছে, বাহির বাড়িতে লণ্ঠন, ভিতর বাড়িতে ঠনঠন। রাও উদ্যোগী পুরুষ, যত না স্কুলের গণ্ডির মধ্যে থেকে অধ্যয়নচর্চায় নিজেকে নিযুক্ত করছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করছেন সদ্যগঠিত স্কুল অফ ইকনমিক্স-এর জন্য টাকা তোলার ব্যাপারে। এখানে যাচ্ছেন, ওখানে যাচ্ছেন, এঁকে ধরছেন, তাঁকে ধরছেন, টাটা গোষ্ঠীকে ধরে অর্থ আদায় করে লেডি রতন টাটার নামে স্কুলের গ্রন্থাগারের দ্বারোদ্ঘাটন করছেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের বিবিধ কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, দেশময়, তথা বিদেশময়, বক্তৃতা দিচ্ছেন, নানা কমিটির সদস্য হিশেবে কাজ করছেন। সদা ব্যস্ত, সহকর্মীদের উপর, ছাত্রদের উপর চোটপাট করে বেড়াচ্ছেন, অথচ তাঁর মধ্যে একটি ছেলেমানুষও লুকিয়েছিল। কোনও অভ্যাগত এসেছেন, স্কুলে বক্তৃতা দেবেন, রাও মহাশয় তাঁর পরিচয় দিতে ওঠার ভণিতায় ছেলেমেয়েদের অবধারিত শোনাতেন, ‘জানো, আমি গত তিন বছরে এগারোবার মার্কিন দেশে গিয়েছি, এই ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলার সঙ্গে ওখানেই প্রথম পরিচয়।’ তাঁর শিশুসুলভ আচরণের অন্য একটি নমুনা: করিডোর দিয়ে যাচ্ছি, ওঁর সঙ্গে দেখা, আমাকে ধরে হাত দুলিয়ে তাঁর সহাস্য উক্তি, ‘জানো অশোক, এই সপ্তাহে আমাদের লাইব্রেরিতে চার টন বই আসছে।’

কেমব্রিজের অতি মেধাবী ছাত্র, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা নিয়ে চমৎকার গবেষণা করেছেন। বিবেকানন্দ-ভক্ত, পরোপকারী, কিন্তু তাঁর আচরণে-বিচরণে, ছেলেমানুষির গা ঘেঁষে, কোথাও এক ধরনের সামন্ততান্ত্রিক অহমিকাও। সামাজিক বিচারে তাঁর চেয়ে যিনি একটু খাটো, তাঁকে প্রায় অকারণে আঘাত দিয়ে কথা বলবার প্রবণতা রাও সাহেবের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এটা বোধহয় স্বাধীনতা-উত্তর যুগের প্রথম অধ্যায়ের সমাজচূড়ামণিদের বৈশিষ্ট্য। আরও অনেককেই, যাঁদের সঙ্গে আমার পরে পরিচয় হয়েছে, এই গোত্রভুক্ত করতে পারি।

অধ্যাপক রাওয়ের ঘোর অশিষ্টাচারের একটি স্মৃতি এখনও মনে দাগ কেটে আছে। আজকের পরিভাষায় যাঁদের বলা হয় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, তাঁদের অন্যতম, জন হিকস, এবং তাঁর স্ত্রী উরসুলা হিকস—তিনিও অর্থনীতিবিদ—সে বছর দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সে মাস তিনেকের জন্য পড়াতে এসেছিলেন। তাঁদের চলে যাওয়া উপলক্ষ্যে স্কুলের তরফ থেকে বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন, সবাইকে নিয়ে গ্রুপ ফোটো তোলা হবে। দেশে যা সাংস্কৃতিক নিয়ম, ছাত্রছাত্রীরা নিচে শতরঞ্চির উপর বসলো, নয়তো পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মধ্য সারণিতে চেয়ারের সারি, শিক্ষকবৃন্দ বসবেন, মধ্যমণি অবশ্যই রাও সাহেব, তাঁর এক পাশে হিকস, অন্য পাশে মিসেস হিকস। বীরেন গাঙ্গুলি মশাই কী কারণে যেন একটু দেরি করে এলেন, ততক্ষণে চেয়ারগুলি সব ভরাট হয়ে গেছে, তাঁর জন্য বসবার জায়গা নেই। ডক্টর রাও তড়াক করে উঠে এদিক-ওদিক তাকালেন, তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো চেয়ারের সারির একপ্রান্তে উপবিষ্ট শ্রম-অর্থনীতি বিষয় নিয়ে পড়ানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত সদ্য-নিযুক্ত এক অতিনিরীহ গাড়োয়াল-সন্তানের উপর। যুবক শিক্ষকটির নাম নলিনীকান্ত পন্থ। রাও সাহেবের চড়া গলায় হুকুম, ‘নলিনী, তুমি উঠে পিছনে গিয়ে দাঁড়াও, হাজার হলেও তুমি এখনও অস্থায়ী লেকচারার’। আমি অন্তত, মনে-মনে বললাম, ধরণী দ্বিধা হও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *