আপিলা-চাপিলা – ৩২

বত্রিশ

কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের বৈরিতা সত্ত্বেও ইতিমধ্যে রাজ্য সরকারের অর্থবিভাগের কাজকর্মে কিছু সজীবতা এসেছে, রাজস্ব সংগ্রহের প্রয়াসে একটু-একটু করে সফল হচ্ছি। সত্যব্রতবাবু রাজ্য যোজনা পরিষদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে কথা বলে দিল্লি থেকে অরুণ ঘোষকে পরিষদের কার্যকরী প্রধান হিশেবে কলকাতায় নিয়ে আসতে সফল হলাম। অরুণ ঘোষের অফুরন্ত উৎসাহ, অত্যাশ্চর্য পরিশ্রম করবার ক্ষমতা, এবং, কারও-কারও বিচারে আমার মধ্যে যার একান্ত অভাব, সকলকে নিয়ে মিলে-জুলে কাজ করার নিপুণ দক্ষতা। অরুণ ঘোষ অচিরে আমাদের সঙ্গে একমত; রাজ্য পরিকল্পনার মূল ঝোঁক গ্রামকেন্দ্রিক ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থানির্ভর করতে হবে; পরিকল্পনার একটি সর্বাঙ্গীণ কাঠামো অবশ্যই থাকবে, শিল্পবিস্তার ও কর্মসংস্থান নিয়ে সংহত নানা প্রকল্প জড়িয়েই সে-সব ব্যবস্থা। শিল্পে অভিজ্ঞ, বিজ্ঞানে ঋদ্ধ, এমন কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করে পরিষদের সদস্য করা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে অরুণ ঘোষের চমৎকার বোঝাবুঝি, আমি তাই অন্যান্য বিষয়ে মনোনিবেশ করবার ফুরসত পেলাম।

বামফ্রন্ট সরকারের সাত-আট বছর প্রায় অতিক্রান্ত। মন্ত্রিসভায় পার্টি থেকে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন, কোনও অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিলে পরামর্শ দান করেছেন। বিনয়দার কাছে কারণে-অকারণে সব সময়ই ছুটে যেতাম, কখনও তাঁর উপদেশ পেতে, তাঁর বিচিত্র বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা শুনতে, তত্ত্ব থেকে কী করে প্রজ্ঞায় উপনীত হওয়া যায় সেই শিক্ষা লাভ করতে। মন্ত্রীদের মধ্যে তিনি বোধহয় সবচেয়ে বেশি পড়াশুনো করতেন, তাঁর টেবিলে এমন কি ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি-র সর্বশেষ সংখ্যাটিও সর্বদা চোখে পড়তো। তাঁর কাছ থেকে অতীত দিনের কাহিনী শোনা দুর্লভ সৌভাগ্য: বিপ্লবী যুগে পিস্তল হাতে তাঁর ঘোরাফেরার বিবরণ, দামোদর উপত্যকায় কৃষক আন্দোলনের কথা, রানীগঞ্জ-আসানসোল অঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের প্রথম পর্বের বৃত্তান্ত, এমন অনেক কিছু।

তবে অপ্রিয় সিদ্ধান্তের সমস্যা থেকেই যায়। সমাজব্যবস্থাকে এড়ানো তো সম্ভব নয়, বামপন্থী জোট, সব ক’টি দলই সমাজতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, অথচ পার্শ্বপরিবেশের প্রভাব তো উপেক্ষা করা সম্ভব নয়! বিভিন্ন নির্বাচনে উপর্যুপরি সাফল্য, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গ্রামাঞ্চলে আগাপাশতলা পরিবর্তনের সূচনা, শালকিয়া প্লেনামের সিদ্ধান্ত-অনুযায়ী দলের শাখাপ্রশাখা যথাশীঘ্র বিস্তারের উন্মুখতা। পার্টির সদস্য সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে, যে ধরনের আদর্শ, নিষ্ঠা ও পরিচিকীর্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই করে পার্টির সভ্যপদ একদা বিতরণ করা হতো, সেই নিয়ম-নিগড়ে আস্তে-আস্তে শিথিলতার অনুপ্রবেশ; তা ছাড়া, বরাবরই যেটা আমার বদ্ধমূল ধারণা, যদিও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নীতির ভিত্তিতে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাসংরক্ষণে জোর দেওয়া মার্কসপন্থী-লেনিনপন্থীরা পছন্দ করেন, ভারতবর্ষের, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার, প্রেক্ষিতে তা ছাপিয়ে, অধিকতর জায়গা জুড়ে, একটু আগে যা বলেছি, সামন্ততান্ত্রিক মনস্কতা। কথাটা কর্কশ শোনায়, কিন্তু জীবনের উপান্তে এসে একটু স্পষ্ট কথা যদি এখন না বলি, পরে হয়তো আর সুযোগ ঘটবে না। পশ্চিম বাংলায় স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে প্রায় প্রতিটি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের যাঁরা হাল ধরে থেকেছেন, এখনও আছেন, তাঁরা অনেকেই বড়ো, মাঝারি, ছোটো জমিদার বংশের পৌত্র বা প্রপৌত্র। আদর্শের দিক দিয়ে তাঁরা সামন্ততন্ত্র থেকে বহুদুর সরে এসেছেন, বৃত্তির দিক থেকেও তাঁদের জীবনচর্যায় জমিদারির ধ্বংসাবশেষের প্রলেপও আর লেগে নেই, অথচ অভ্যাসে-আচরণে-ব্যবহারে এখনও সামন্ততন্ত্রের অভিশাপ। দল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হোক, বড় হোক, যায় আসে না, অনেক নেতারই স্বভাবে, তাঁদের অন্য সহস্র গুণাবলী সত্ত্বেও, বংশপরাম্পরার বিষণ্ণ ছায়া। পাটি কঠিন অনুশাসনে বাঁধা, নিয়ম-শৃঙ্খলার সামান্যতম বিচ্যুতি হবার উপায় নেই, সব স্তরে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত একবার গৃহীত হলে তা প্রয়োগ করবার দায় সর্বোচ্চ নেতৃত্বের, কোনও স্তরে কেউই তখন তার বিরুদ্ধাচারণ করতে পারবেন না: তত্ত্ব হিশেবে এই গণতান্ত্রিক আচরণবিধি চমৎকার, অথচ প্রয়োগে বিচ্যুতি ঘটে, গণতান্ত্রিকতা উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, জমিদারি সেরেস্তার ধরন-ধারণই শেষ পর্যন্ত প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, উপর থেকে নিচে প্রতিটি স্তরে নির্দেশ মানার কথা হুকুম তালিমের সমগোত্রীয় হয়ে। দাঁড়ায়। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার অন্য যে-প্রাথমিক শর্ত, নিচের থেকে উপর পর্যন্ত আলোচনার আবশ্যকতা, তা জমিদারি সেরেস্তার ক্ষেত্রে অভাবনীয়: তাঁরা চান বা না চান, অনেক স্তরেই নেতারা, হয়তো অন্যমনস্কতাহেতুই, জমিদারপ্রতিম বনে যান।

মন খারাপ- করা সমস্যা, কিন্তু অস্বীকার করি কী করে, জমিদারি প্রথায় যা অবধারিত, খোশামোদের ঘুণ এসে বাসা বাঁধে, বামপন্থী দলগুলিতেও এই উপদ্রবের উপস্থিতি। অনিবার্য পরিণামে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নেতাদের সঙ্গে কমরেডদের সামাজিক দূরত্ব বাড়ে, খোশামোদের মোহজালে কোনও-কোনও নেতা আটকে যান; খোশামোদবৃত্তির যা অপফল, উপরতলাকে খুশি করে কাজ হাসিল করার চেষ্টা বেড়ে চলে। সুযোগ গ্রহণ করে ইতস্তত বেনো জল, এমনকি কঠিন শৃঙ্খলে-মোড়া কমিউনিস্ট পার্টিতেও, ঢুকতে থাকে। আরও যা মারাত্মক, বিদূষণার মোহজাল উপর থেকে ক্রমশ নিচে ছড়িয়ে পড়ে, মাঝারি-ছোটো নেতাদের মধ্যেও কর্তাভজা গোষ্ঠী অচিরে গজিয়ে ওঠে। কু-আদর্শ সৃষ্টির কিছুটা কৌতুকজনক, অনেকটাই বিষাদ-উদ্রেককারী, যাকে আমি বলবো দৃষ্টান্ত, টেলিফোন সংস্কৃতি। বড় নেতারা নিজেরা টেলিফোন ধরেন না, তাঁরা ব্যস্ত মানুষ। কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে হলে কোনও শিষ্য বা অনুগত ফোনের বোতাম টেপেন, ওদিক থেকে সাড়া পেলে যন্ত্রটি নেতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই বিশেষ আদর্শটি এখন সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত: উঠতি ছাত্র বা যুব নেতা কোনও অশীতিপর প্রাক্তন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন, এক বয়স্য সেই বৃদ্ধকে ফোনে পাকড়ালেন: ‘ধরুন, অমুক কমরেড দাদা কথা বলবেন’। বৃদ্ধ ভদ্রলোক আড়াই-তিন মিনিট যন্ত্রটি ধরে রইলেন, কিন্তু জবরদস্ত ছাত্র বা যুব নেতা, ব্যস্ত মানুষ, তাঁর ফোনের কাছে আসার সময় হয় না।

স্খলমান আদর্শহীনতা ও নীতিবিচ্যুতি সম্পর্কে বিশেষ একটি ঘটনা উল্লেখ করার তাগিদ বোধ করছি। পঁচাশি সালের মধ্যগ্রীষ্ম, বিধানসভার একটি খালি আসনের জন্য কলকাতার উত্তর প্রান্তে উপনির্বাচন। পার্টির প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, আমরা মন্ত্রীরা সন্ধ্যাবেলা মহাকরণ-ফেরত প্রচারে যাচ্ছি। পার্টির কড়া নির্দেশ, রাইটার্স বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে কলকাতা জেলা কমিটির দফতরে পৌঁছে সরকারি গাড়ি ছেড়ে দেবো, সেখান থেকে পার্টির পরিবহনে প্রচারে যাবো। এক পাড়ায় সভা সেরে মঞ্চ থেকে নামছি, হঠাৎ দেখি এক রাষ্ট্রমন্ত্রী, অনতি-অতীতে ছাত্র ও যুব নেতা, সরকারি গাড়ি চেপে, আলো জ্বেলে, হুটারে শব্দ ছড়িয়ে উপস্থিত। তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করলাম, ‘পার্টির নিয়ম কি তোমার জানা নেই? এভাবে সরকারি গাড়ি নিয়ে দলীয় প্রচারে এসেছো কেন?’ তার নিশ্চিন্ত উত্তর, ‘ওরা যে করে’। ওরা মানে কংগ্রেসিরা। বলতে উদ্যত হয়েও নিজেকে সংযত করলাম, ‘তা হলে ওদের দলেই তো যোগ দিতে পারতে, কমিউনিস্ট পার্টিতে এলে কেন?’

পার্টির কাছে ব্যাপারটি জানিয়ে কোনও ফল হলো না, শ্রীমান রাষ্ট্রমন্ত্রী কোনও-কোনও সর্বোচ্চ স্তরের নেতার অনুগত অনুচর। এই তখনো-উঠতি নেতাটি সত্যিই বিশ্রুতকীর্তি, কিছুদিন বাদে তার অন্য একটি অপকর্ম আমাকে বিব্রত করলো। তার দপ্তরে জনৈক উপ-সচিবের অবসরের বয়স পেরিয়ে গেছে, ইতিমধ্যে দু’-তিনবার চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, কোনও নিয়মেই আর বাড়ানো সম্ভব নয়। অর্থ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিশেবে আমাকে নিয়ম-কানুনগুলি মেনে ও মানিয়ে চলার দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। রাষ্ট্রমন্ত্রীটির তরফে ওই উপ-সচিবের কাজের মেয়াদ পুনর্বার বাড়ানোর জন্য ফাইল চালু হলো, অর্থ বিভাগ ও মুখ্যমন্ত্রীর অসম্মতি জ্ঞাপন করে ফিরিয়ে দেওয়া হলো সেই ফাইল, দিন পনেরো বাদে আবিষ্কার করলাম রাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে সেই ভদ্রলোককে তবু বহাল রাখা হচ্ছে সম্পূর্ণ নীতিবিরুদ্ধ উপায়ে। পার্টিকে জানালাম, বিহিত করুন; আমাদের নিজেদের মন্ত্রীরাই যদি নিয়ম না মানেন, শরিক দলের বেনিয়ম ঠেকাব কী উপায়ে? আমাকে বলা হলো, যেন একটু ক্ষমাক্ষেন্নো করি, ও, মানে রাষ্ট্রমন্ত্রীটি, নাকি খুব দক্ষ কেজো ছেলে, অনেকভাবে পার্টিকে সাহায্য করে। শুনে তড়িদাহত হলাম।

সমস্যাটির বীজ আসলে আরও অনেক গভীরে। রাষ্ট্রমন্ত্রীটির পার্টির বিভিন্ন স্তরে পৃষ্ঠপোষক আছে; সামন্তভিত্তিক প্রথায় যা অনিবার্য, কোনও বড়ো নেতার আদরের। নেতা হয় তো বুঝতেও পারেন না তাঁকে স্তাবকতা করা হয়, তাঁর ধারণা ছেলেটি অশেষ গুণের অধিকারী, যখনই যে কাজটা তাকে করতে বলেন, সঙ্গে-সঙ্গে তা পালিত হয়। যার উপর কৃপাবর্ষণ করি, তার দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করার প্রবণতা একটু-একটু করে বাড়ে। সামন্ততন্ত্রের পাশাপাশি স্তাবকতন্ত্র তৈরি হয়, দুর্নীতির বিষ-বাষ্পও সেই সঙ্গে ছড়াতে শুরু করে। তরুণ নেতাটি, চোখের সামনে অনুরাগ-বীতরাগের একটি আদর্শকে লতামঞ্জরীসহ বিস্তারিত হতে দেখে, নিজেও তা অনুকরণে প্রবৃত্ত হয়, অচিরে তারও এক ঝাঁক বিদূষক জুটে যায়। গুন গুন রবে মধুপান করার উৎসাহ উপ-স্তাবকদের মধ্যে মাথাচাড়া দেয়, একটু-আধটু নীতিস্খলনও শুরু হয় সেই সঙ্গে। শাস্ত্রেই তো বলে, নাস্তে সুখমস্তি; ছোটোখাটো দুর্নীতি থেকে বৃহত্তর দুর্নীতির দিকে ছুটতে মন ক্রমশ উচাটন হয়।

আরও একটি তথ্য জরুরি, অন্তত জরুরি বলে মনে হয় আমার। ঊনিশশো পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকে কমিউনিস্ট পার্টিতে অনেক ছেলে-মেয়ে জড়ো হয়, যারা পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থী পরিবারভুক্ত। উদ্বাস্তু আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির সুদৃঢ় নেতৃত্ব তাদের মুগ্ধ করেছে, মোহাবিষ্ট হয়ে তারা পার্টির ছত্রতলে ভিড় করেছে। পূর্ববঙ্গের গ্রামে-শহরে শৈশব-কৈশোর অতিবাহনকালে তারা পাড়াতো কলহ-দঙ্গলে জড়িয়ে পড়তো, দাদারা তাদের পাড়ার বা গোষ্ঠীর স্বার্থে লাঠিসোঁটা-হকিস্টিক চালানো শেখাতেন, কখনও ছুরি চালানোও: চিন্তা করার বালাই নেই, দাদাদের হুকুম পালন করলেই হলো। শরণার্থী হয়ে এই বাংলার জনারণ্যে মিশে পার্টির উৎসাহী সমর্থক হতে তাদের তেমন অসুবিধা দেখা দিল না। তারা রাজনৈতিক পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে বিশেষ যায়নি, অনেকের স্কুলের গণ্ডি পর্যন্ত অতিক্রম করা হয়নি। কিন্তু তারা বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে অকুতোভয়ে, পার্টির নেতৃবর্গের প্রতি তাদের আনুগত্য অসীম, নেতাদেরও তাই তাদের সম্পর্কে গভীর অনুরাগ পোষণ। (তবে আগুনে পুড়ে সোনা যে তৈরি হয় না তা-ও তো নয়। তরুণ নেতাদের ভিড়ে যাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতাম, দীনেশ মজুমদার, উদ্বাস্তু আন্দোলনের মধ্য দিয়েই উঠে এসেছিল। ওরকম নম্রস্বভাব, বুদ্ধিমান, ঠান্ডা-মাথার ব্যক্তিত্ব খুব কম চোখে পড়ে। তার অকালমৃত্যুতে, বার-বার বলবো, পার্টির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।) ।

বাংলার ঐতিহাসিক ধারাক্রমে রাজনৈতিক বশ্যতার দু’টি পাশাপাশি ধারা আসলে বহুদিন থেকে বহমান। চিত্তরঞ্জন দাশের উক্তি, অন্তত তাঁর উক্তি বলে প্রচারিত, একটি মন্তব্য ছেলেবেলায় প্রায়ই শুনেছি: ‘আমার দু’-ধরণের শিষ্য দরকার। আমার যেমন যতীন-সুভাষকে চাই, শ্রীশ-বসন্তকেও চাই’। যতীন অবশ্যই যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সুভাষ খোদ সুভাষচন্দ্র বসু, শ্ৰীশ ঢাকার উকিল, বহুদিন জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আর বসন্তকুমার মজুমদার দেশসেবিকা হেমপ্রভা মজুমদারের স্বামী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা সুশীল মজুমদারের পিতা। জনশ্রুতি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন আলোচনা-পরামর্শের জন্য যেমন যতীন্দ্রমোহন ও সুভাষচন্দ্রের উপর সর্বদা নির্ভর করতেন, সভাসমিতিতে শত্রুপক্ষীয়দের হাঙ্গামা সামাল দিতে শক্তপোক্ত চেহারার শ্রীশবাবু ও বসন্তবাবুর উপরও তেমনই নির্ভরশীল ছিলেন, একটু ক্ষমাসুন্দর চক্ষে দেখতেন শেষোক্ত দু’জনকে। সেই ঐতিহ্যের অবলুপ্তি এখনও ঘটেনি। ছেলেটা একটু-আধটু নিয়মকানুন মেনে চলে না, তাতে কী, ওর কাছ থেকে তো নানা ধরনের উপকার পাওয়া যায়।

বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে অনেক পরম সম্মানীয় নেতারও হয়তো খানিকটা মানসিক দৌর্বল্য দেখা দেয়, আশে-পাশে এমন কেউ থাকুক যে একটু খুশি করবার মততা, মন ভরাবার মতো, কথাবার্তা বলবে, দুরূহ কোনও কাজ শত অসুবিধা ডিঙিয়ে সম্পন্ন করে দেবে। সত্যব্রত সেনের সঙ্গে প্রায়ই আলোচনা করতাম, কী করে এই প্রবণতার অপফলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া যায়। তা করতে গেলে মাঝে-মাঝে অপ্রিয় কথা যে বলা প্রয়োজন, তা নিয়ে আমাদের মনে কোনও সংশয় ছিল না। পার্টির প্রতি আনুগত্য অটুট থাকবে, থাকবেই, তা হলেও যে সব দুর্বলতা অনুপ্রবেশ করছে, তাদের সম্পর্কেও প্রতিবাদে মুখর হতে হবে। দলের অনুশাসন ভাঙা চলবে না, পার্টি কর্তৃক যথাযথই-ভসিত উপদলবাজি করা চলবে না, অথচ যে-যে লক্ষণগুলি অপছন্দ হচ্ছে, কোন পদ্ধতিতে তাদের নিরসন সম্ভব, তা নিয়ে আমাদের নিরন্তর আলোচনা। বেড়ালের গলায় ঘন্টা কে বাঁধবে তা নিয়ে জটিলতা। একটি-দু’টি এমনধারা ব্যাপারে বিনয় কোঙারের উপদেশ ভিক্ষা করেছি কখনও-কখনও, তিনি সহানুভূতি-সহ শুনতেন, কিন্তু তাঁর মধ্যেও ঈষৎ দ্বিধা-জড়তা, বিব্রত বোধ করে একদিন আমাকে বললেন, ‘আপনি ভুল করছেন, আমি আমার দাদা নই’।

এমনি করেই দিন কাটছিল, হঠাৎ অন্য একটি সমস্যা দেখা দিল। আমরা সরকারে ঢুকেই বামপন্থী নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে একটি খসড়া শিল্পনীতি তৈরি করেছিলাম, কলকাতার শিল্পমহলের সঙ্গে আলোচনা করে তা পরিশোধন করা হয়েছিল, যেমন হয়েছিল রাজনৈতিক নেতৃকূল ও ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের সঙ্গেও আলোচনা করে। এ সব বিষয়ে আমার নাস্তিকতা বহুদিনের। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে আমি বহু পূর্বেই প্রত্যয়ে পৌঁছেছিলাম মাশুল সমীকরণ ও লাইসেন্স বিতরণের সমস্যা শুধু নয়, কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্র-অনুশাসিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানাদির বিনিয়োগ নিয়মনীতির উপরই শিল্পক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ মূলত নির্ভরশীল; কেন্দ্রীয় সরকারের, এবং সেই সঙ্গে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানাদির বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেই বেসরকারি মালিকরা বিনিয়োগে মনঃসংযোগ করেন, অন্যথা নয়: রেল দফতর থেকে এঞ্জিন, ওয়াগন, কোচ, স্লিপার ইত্যাদি কেনবার বরাত দিলেই এ-ধরনের পণ্য-প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি তাদের বিনিয়োগ বাড়ায়; পূর্তমন্ত্রক থেকে রাস্তাঘাট-সেতু নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব গ্রহণ করলেই সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলি যন্ত্রপাতি-সিমেন্ট-রোড রোলার-পাথরকুচি-আলকাতরা তৈরি শুরু করে, তাদের উৎপাদনের বিস্তার ঘটে। সুতরাং অগ্রাধিকারের প্রশ্নে আমি নির্দ্ধিধ, শিল্পপ্রসারের স্বার্থেও কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করে রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা দানের দাবির উপরই, আমার বিবেচনায়, শতকরা নব্বুই ভাগ দৃষ্টি নিয়োগ প্রয়োজন। জ্যোতিবাবু বরাবরই, আমার বিশ্বাস, অন্যরকম ভাবতেন। উনি এটা মানতেন, কেন্দ্রীয় সরকার বিমুখ থাকলে শিল্পোদ্যোগের সম্ভাবনা পরাহত। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে এটাও বলতেন, আমাদের শত্রুর অভাব নেই, নানা দিক থেকে আক্রমণ আসছে, আসবে। বামপন্থী হলেও তো, কিংবা বামপন্থী বলেই তো, আমরা অকপট বাস্তববাদী: আমাদের সরকারকে ঘিরে, গোটা কলকাতা ও পশ্চিম বাংলা জুড়ে, বড়ো-মাঝারি-ছোটো পুঁজিপতি, তাঁরা দুষ্টুমি শুরু করলে অশেষ দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হবে আমাদের। বিশেষ করে কেন্দ্র যেহেতু মুখ ফিরিয়ে আছে, স্থানীয় শিল্পপতিদেরই বাবা-বাছা বলে বাড়তি শিল্পোদ্যোগের ব্যবস্থা করতে হবে, কোথাও-কোথাও সরকারি ও বেসরকারি মালিকানা যুক্ত করে মিশ্র চরিত্রের শিল্প-ব্যবস্থা প্রণয়নে উদ্যোগ নিতে হবে।

আমার মতামত ততদিনে জ্যোতিবাবু ভালোই জেনে গেছেন, আমাকে আদৌ আর ঘঁটাতেন না। আঁচ করতে পারছিলাম তিনি কলকাতাস্থ শিল্পপতিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন, প্রায়ই এই চেম্বার অফ কমার্স, ওই চেম্বার অফ কমার্সে, আলোচনার জন্য যেতেন, ঘরোয়া কথাবার্তাও নিশ্চয়ই বলতেন নানা শিল্পপতিদের সঙ্গে। পঁচাশি সালের শেষের দিকে রাজ্যের জন্য অনেকটা উদার ধাঁচের সংশোধিত শিল্পনীতির কথা তিনি ঘোষণা করলেন। বেসরকারি মালিকদেরই হরেকরকম ভরসা-আশ্বাস দিয়ে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানানো হলো, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে বিদেশী পুঁজির অনুপ্রবেশও মেনে নেওয়া হলো। জ্যোতিবাবুর যুক্তি অতিশয় প্রাঞ্জল, বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না: আমরা বলছি আমাদের এখানে বিদেশী পুঁজি ঢুকতে দেবো না, তাই ওরা অন্যত্র যাচ্ছে, গুজরাটে, মহারাষ্ট্রে, কর্ণাটকে, তামিলনাড়ুতে, অন্ধ্র প্রদেশে, পশ্চিম বাংলার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে না। পশ্চিম বাংলা কি তা হলে মরুভূমি হয়ে যাবে, অন্য রাজ্যগুলি বিনিয়োগের প্রাচুর্যে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আর্থিক সাফল্যের মগডালে চড়ে বসবে? তার চেয়ে এটা বলি না কেন, আমরা স্বদেশী-বিদেশী পুঁজিওলাদের সঙ্গে কথা বলবো, আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে সৌষাম্য বর্ধন করে, অভাব-অভিযোগের সমাধানে সাহায্য করে এমন ধরনের বিনিয়োগ ঘটাতে তাঁরা যদি সম্মত থাকেন, আমাদের তরফ থেকে সহযোগিতার অভাব ঘটবে না। শুধু দুটো শর্ত: এক, শ্রমজীবী শ্রেণীকে কোনও ছুতোতেই শিল্পপতিরা ঠকাতে পারবেন না; দুই, পণ্যবিক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনও প্রক্রিয়াতেই ক্রেতাদের উপর অন্যায্য দামের বোঝা চাপানো চলবে না। কেন্দ্রে বামপন্থীরা যখন ক্ষমতা দখল করবে, তখন অবশ্যই শিল্পনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে, কিন্তু তা তো এই মুহূর্তে পরাহত, সংবিধানের বর্তমান চৌহদ্দির মধ্যে থেকে আপাতত অন্যরকম ভাবনা তাই একান্ত প্রয়োজন। পার্টির প্রচুর বিরূপ আলোচনা হলো, জ্যোতিবাবু অবিচল। দিল্লি থেকে কমরেড বি টি আর-কে তলব করে আনা হলো। সবাইকে নিয়ে পার্টিকে চলতে হয়; তা ছাড়া জ্যোতিবাবু যে-পদক্ষেপ নিতে চলেছেন, তার বিরুদ্ধাচরণ কারও-কারও কাছে অযৌক্তিক, অন্য কারও-কারও মতে আদৌ অযৌক্তিকও নয়। দলের রাজ্য সম্মেলনে রণদিভে প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা করলেন শিল্পক্ষেত্রে পার্টিকর্মীদের কী দায়িত্ব; তাঁর জোরালো সুপারিশে অন্তঃস্থিত দ্বিধাদ্বন্দ্ব মূক হয়ে এলো, পার্টির মধ্যে অসুখী প্রতিবাদের চোরাস্রোত যদিও বইতেই লাগলো।

এরকম সময়ে আমার শরীরে একটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন দেখা দিল। স্বাস্থ্য দুর্বল, বহু বছর কোনও অবকাশের সুযোগ নেই; হঠাৎ নরওয়ে থেকে এক পুরনো বন্ধুর চিঠি: যদি রাজনীতির আবর্ত থেকে একমাস-দু’মাস একটু সরে থাকতে চাই, তাঁদের গবেষণাসংস্থায় স্বচ্ছন্দে চলে আসতে পারি; ওঁরা ঘরবাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন, সস্ত্রীক সম্মানিত অতিথি হয়ে থাকতে পারবো, যদিও বেতন-ভাতার কোনও প্রশ্ন নেই, বিমানযাত্ৰাৰ্থ ভাড়ার ব্যবস্থাও আমাকেই করতে হবে।

জ্যোতিবাবু এ সব ব্যাপারে মস্ত উদার, সোৎসাহে অনুমতি দিলেন। পরক্ষণে আর এক কৌতুককাহিনী। তখন ইন্দিরা গান্ধির জ্যেষ্ঠ তনয় প্রধান মন্ত্রী, উত্তরাধিকার সূত্রে, এবং এই উত্তরাধিকারের দাবি ছাড়া তাঁর প্রধান মন্ত্রী হওয়ার মতো অন্য কোনও গুণাবলী নেই। সরকারি নিয়ম, কেন্দ্র ও রাজ্যের মন্ত্রীরা যদি বিদেশে বিহারে যেতে চান, স্বয়ং প্রধান মন্ত্রীর অনুমতি প্রয়োজন। আমার ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, এহেন প্রায়-নিরক্ষর প্রধান মন্ত্রীর স্বাক্ষর সাপেক্ষে বিদেশ ভ্রমণ করবো না। জ্যোতিবাবুকে গিয়ে বললাম আমি দু’-মাসের জন্য পদত্যাগ করে যেতে চাই, ফিরে এসে ফের মন্ত্রী হবো। প্রত্যেকের প্রশ্ন ও কৌতূহল, কেন এমনটা করছি। কারণটা জ্যোতিবাবুকেও খোলসা করে বললাম না। তবে কলকাতার কিছু-কিছু মহলে গবেষণা শুরু হলো, দুই মাসে আমি কয় কাঁড়ি ডলার উপার্জন করতে যাচ্ছি, তা নিয়ে। জ্যোতিবাবুকে নিমন্ত্রণ পত্রটি দেখালাম, বেতন-ভাতা শূন্য। আমার বন্ধু টোলন অধিকারী তখন ইন্ডিয়ান স্টাস্টিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ, জানালো ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক পদ যদি ত্যাগ করি, তা হলে সে সঙ্গে-সঙ্গে আমার সামান্য জমা-হওয়া প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটুকু বের করে দিতে পারে, তাতে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর নরওয়ে যাওয়া-আসার খরচ প্রায় উঠে আসবে; সেরকম ব্যবস্থাই করা হলো।

মাস দুই বাদে ফিরে পুনরায় মহাকরণের জোয়ালে, বিদেশের শিথিল অলস দিনযাপনের পর আবার গরিব দেশের রূঢ় বাস্তবতা। অর্থ দফতরের উপর চাপ ক্রমশ বাড়ছে। নতুন দিল্লির সরকারের সঙ্গে বাদানুবাদ বহাল, রিজার্ভ ব্যাংক কর্তৃক ওভারড্রাফট-এর ক্ষেত্রে টানাটানি, অথচ রাজ্য সরকারের এই দফতর-ওই দফতর থেকে আরও অর্থ বরাদ্দের আর্ত দাবি। মন্ত্রীদের দোষ দেওয়া যায় না, বামফ্রন্ট সরকার তো, সবাই ভেবে নিয়েছেন, কল্পতরুসদৃশ: লোকায়ত সরকার, জনগণের অভাব-অভিযোগে মেটানোর প্রয়াসই তো তার প্রধান দায়িত্ব। অথচ অর্থ দফতরকে হিশেব রাখতে হয়, বাজেটে বরাদ্দ টাকাপয়সার গণ্ডির মধ্যে প্রত্যেকটি বিভাগের খরচপাতি আবদ্ধ থাকছে কিনা দেখতে হয়। বিভাগীয় মন্ত্রীদের আয়-ব্যয় মেলানোর দায় নেই, সেই দায়িত্ব অর্থ বিভাগের, খরচের বহর নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে গেলে সংকট। যদি বাড়তি খরচপাতি প্রতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের তাগিদে হতো, দুশ্চিন্তা খানিকটা সামলানো যেত। কিন্তু দ্বন্দ্বের যন্ত্রণা বিভিন্নভাবে প্রকট হচ্ছিল।

সাধারণ গোছের সমস্যা, অথচ সেই সমস্যাগুলিই পুঞ্জ-পুঞ্জ জড়ো হয়ে স্ফীতকায় দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা যেমনটি আছে, তেমনটিই থাকবে কিনা, এ বছর বাড়ানো হবে, বিদ্যালয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা কি পুরুলিয়ার জন্য কুচবিহারের জন্য; অথবা বিদ্যালয়ের সংখ্যা না বাড়িয়ে বিদ্যালয়ের জন্য গৃহ-নির্মাণ, চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চি-গোলক-মানচিত্র-পাঠাগারের উন্নতি ইত্যাদির দিকে অধিকতর নজরদান, নাকি শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের মাইনে-ভাতার আরও উন্নতিসাধন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বা মান যেখানে আছে সেখানেই কোনওক্রমে ধরে রাখার জন্য কেউ-কেউ হয়তো বলছেন, অন্য কেউ-কেউ বলছেন মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর কথা। যে-সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক, কোন জেলায় কী পরিমাণে বাড়ানো, কোন ধরনে বাড়ানো? হয়তো কোনও বিধায়ক বা সাংসদ এসে ধরে পড়লেন, তাঁর কেন্দ্রে একটি কলেজ খোলার অনুমতি না দিলেই নয়, স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে চাপ আসছে, তাঁদের নিরাশ করলে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা। পাশাপাশি হয়তো অন্য এক দাবি সোচ্চার: শিক্ষাকে সার্বজনীন করার ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলা বেশ কয়েকটি রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে, তা নিয়ে ক্রমশই বিরুদ্ধপক্ষীয়রা জল ঘোলা করছেন, অর্থমন্ত্রীকে ব্যাপারটি তাই ভালো করে ভাবতে হবে। মাথাব্যথার অন্ত নেই, চার-পাঁচটি বিদ্যুৎপ্রকল্পের কাজ চলছে, কিন্তু চলতি বছর আরও একটির কাজ শুরু করলে ভালো হতো, সংক্রান্ত ফাইলটি অর্থবিভাগ যথাসত্বর বিবেচনা করে দেখবেন কি? আমরা তো লড়াই করে বাঁচতে চাই, কিন্তু সংগ্রাম করতে গেলে প্রতিটি মফস্বল শহরে একটি করে স্টেডিয়াম তৈরি না করলেই নয়, সেরকম স্টেডিয়াম, ষা তরুণ যুবকদের লড়াই করতে বাড়তি উদ্বুদ্ধ করবে। জেলায়-জেলায় বইমেলা অথবা যুব উৎসবের ব্যবস্থাও তো করা দরকার। প্রতিটি জেলায় রাস্তাঘাট বেহাল, পূর্ত দফতরের অনুরোধ-উপরোধ, অর্থ দফতর থেকে বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা না করলে বলো মা তারা পূর্তমন্ত্রী দাঁড়ান কোথায়?

অনুরূপ সহস্র প্রশ্ন, যাদের উত্তর জোগানো অনেক সময়ই অর্থমন্ত্রীর সাধ্যের বাইরে, কারণ তাঁকে এক সঙ্গে দুশো-তিনশো গদা ঘোরাতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলি রাজ্যে তাদের ঋণের পরিমাণ বাড়াবে না, রাজ্য সরকারকে নিজস্ব ব্যাংকও খোলবার অনুমতি দেওয়া হবে না, যদিও অন্য একটি রাজ্যের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে; এসব সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের সঙ্গে চিঠিচাপাটি। রাজ্য যোজনা পরিষদকে পরিকল্পনা বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য পরামর্শ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরকে ফোন করে উপরোধ জ্ঞাপন: এই সপ্তাহে রাজ্য সরকারের ওভারড্রাফটের মাত্রা সামান্য বাড়বার সম্ভাবনা, তিনি যেন একটু ক্ষমাঘেন্না করেন; এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পণ্য পরিবহনের উপর রাজ্যগুলির কর আরোপের সংবিধানগত অধিকার কেন্দ্রীয় সরকার মানতে চাইছেন না, অন্য রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে মিলে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ; গোপন খবর এসেছে এক আন্তর্জাতিক সিগারেট বিক্রয় সংস্থা পণ্য প্রবেশ কর এড়ানোর জন্য অতি নিন্দনীয় উপায় গ্রহণ করেছে, পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাদের একটু শিক্ষা দান। উদাহরণ বাড়িয়ে যাওয়া যায়, তার বোধ হয় তেমন দরকার নেই। সবচেয়ে বেশি চাপ মাইনে-ভাতা বাড়াবার ব্যাপারে। সরকারি কর্মচারীদের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের এবং সরকার থেকে বেতন বা ভাতা পেয়ে থাকেন এমন আরও নানা জনের দুরবস্থার দিক থেকে কংগ্রেস আমলে মুখ ঘুরিয়ে রাখা হতো, যারা কমিউনিস্টদের ভোট দেয় তাদের প্রতি দয়াশীল হওয়ার কোনও মানে হয় না, এমনই ছিল মনোভাব। এখন বামফ্রন্ট সরকার, জনগণের সরকার, সেই ঐতিহাসিক অন্যায়ের নিরসন ঘটাতে হবে, সর্বস্তরে জনগণের জীবনযাপনের মান, উপার্জনের মান, বাড়াতেই হবে। সরকারে ঢুকেই বেতন কমিশন নিয়োগ করা হয়েছিল, তার বিভিন্ন সুপারিশ না মানলেই নয়। কিছু-কিছু সুপারিশের ক্ষেত্রে বহুবিধ অন্তর্গত অসামঞ্জস্য আছে, সেগুলি খতিয়ে দেখাও অর্থ বিভাগের দায়। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করার মধ্যবর্তিতায় সামাজিক কল্যাণ সাধনের যে পুণ্য সুযোগ, বামফ্রন্ট সরকার তা না গ্রহণ করেই পারে না; অর্থ দপ্তরকেই এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। এ সমস্তের বাইরেও, এঁর-ওঁর-তাঁর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধাবর্ধনের জন্য সতত উচ্চগ্রামের দাবি। কিংবা হয়তো অন্যান্য মন্ত্রীরা এসে টেবিলে আছড়ে পড়ছেন, মশাই, ওই বিভাগের কর্মচারীদের আপনি গত মাসে এই-এই বিশেষ সুবিধা মঞ্জুর করেছেন, আমার বিভাগের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *