এগারো
আপাতত জীবনানন্দ প্রসঙ্গ মুলতুবি রেখে নতুন দিল্লিতে ফিরি। ওখানে হঠাৎ একটু গোলমাল দেখা দিল, আমার চোখের দৃষ্টি বরাবরই অতি ক্ষীণ, যে কারণে লখনউ থাকাকালীন একবার স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ায় লোভনীয় কাজের প্রস্তাব পেয়েও শেষ পর্যন্ত যোগ দেওয়া হয়নি ব্যাঙ্কের স্বাস্থ্য পরীক্ষকের আপত্তি হেতু। তা অবশ্য ভালোই হয়েছিল। অর্থমন্ত্রকেও একই ফ্যাকড়া, ক্ষীণ দৃষ্টির জন্য আমাকে নাকি সরকারের পাকা কাজে যোগ দিতে অনুমতি দেওয়া যাবে না, তবে আমি বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার হিশেবে চালিয়ে যেতে পারি। সেরকমই ব্যবস্থা হলো, কিন্তু মনে যথেষ্ট চিড় ধরে গেল। ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রক থেকে সপ্তাহে এক দিন-দু’দিন, একদা যাকে ছেড়ে পালিয়েছিলাম, সেই দিল্লি স্কুলে, অধ্যাপক ভি কে আর ভি রাওয়ের আগ্রহেই, ইকনোমেট্রিক্স্ পড়াতে শুরু করেছি। পড়তে ভালোই লাগছিল, ছেলেমেয়েরা পছন্দও করছিল। এরই মধ্যে একদিন রাও সাহেব দিল্লি স্কুলে পাকাপাকি অধ্যাপক হিশেবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। অর্থমন্ত্রকে ওই আধাখ্যাঁচড়া অবস্থা, দিল্লি স্কুলে লোভনীয় জ্ঞানচর্চার পরিবেশ, প্রায় মনস্থির করে ফেলেছিলাম। হঠাৎ খটকা লাগলো। যে-ভদ্রলোকের সঙ্গে পাঁচ-ছ’ বছর আগে মনের মিল হয়নি, তাঁর সঙ্গে এবারও যে সঘন দোস্তি ঘটবে, তার ভরসা কি? মনের এমন অবস্থায় হঠাৎ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ব্যাংকক-স্থিত এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য আর্থিক কমিশন থেকে তার পেলাম, ওঁরা ওখানে আমাকে চাইছেন। ইংরেজি সাহিত্যের অনার্স ক্লাসে ভর্তি হতে গিয়ে যেমন অর্থনীতি বিভাগে নাম লিখিয়ে এসেছিলাম, এবারও তেমনই দিল্লি স্কুলকে এড়িয়ে আমার উল্লঙ্ঘনযোগ, উড়ো জাহাজে চড়ে ব্যাংকক গমন। নাম্বুদিরিপদের কাছে অনুমতি চাইলাম, পেলাম। তিনি বললেন, ‘ভালোই তো, অভিজ্ঞতার প্রসার ঘটবে’। মাসে-মাসে পার্টিকে কী পরিমাণ চাঁদা পাঠাবো, সেই অঙ্কটাও তিনি নির্দিষ্ট করে দিলেন। ব্যাংককে ঘনিষ্ঠ বন্ধু অর্থনীতিবিদ অরুণ ঘোষ সপরিবারে অধিষ্ঠিত; ওখান থেকে আমার আমন্ত্রণপত্র-ঘটিত ষড়যন্ত্রের জন্য তিনিই প্রধানত দায়ী। অরুণ ঘোষ ও ডালিয়ার কাছে আমি আজীবন বিভিন্ন ব্যাপারে যে কত প্রকারে ঋণী তা বোঝানো সম্ভব নয়। ব্যাংককে ওঁদের সঙ্গে ওঁদের বড়ো মেয়ে অদিতি, তখন তার বয়স আড়াই বছর। আমি পৌঁছুবার ঠিক আগের দিন ওঁদের দ্বিতীয়া কন্যা, জয়তী, জন্মগ্রহণ করে ব্যাংককের হাসপাতালে।
সব মিলিয়ে ব্যাংককে চোদ্দো-পনেরো মাস ছিলাম, পুরোটা সময়ই একদিক থেকে অপব্যয়িত অধ্যায়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সংগঠনে যৎসামান্য কাজ করে, কিংবা কিছুই না করে, এককাঁড়ি পয়সাকড়ি যদিও পাওয়া যায়, তার বাইরে মরুবাসপ্রতিম অভিজ্ঞতা। এশিয়া ও দূর প্রাচ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাথায় একজন ভারতীয় পণ্ডিত ছিলেন, কিন্তু ততদিনে তিনি অর্থশাস্ত্র ভুলে মেরে দিয়েছেন, প্রশাসনিক দক্ষতায় অবশ্য অতিশয় সুষ্ঠু। অর্থনীতিবিদ কিংবা অন্য বিশেষজ্ঞ আর যাঁরা ছিলেন, তাদের মধ্যে একজন-দু’জন চীনে পণ্ডিত ছাড়া বাকিরা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। চীনে ভদ্রলোকেরা এমনিতে অমায়িক, কিন্তু তাঁদের আনুগত্য চিয়াং কাইশেকের প্রতি, তাইওয়ান দ্বীপই যেন ভূমধ্যমণি: তাই তাঁদের সঙ্গে যদিও সম্প্রীতি ছিল, হৃদ্যতা ছিল না। এঁদের মধ্যে একজন আমাকে তাইওয়ানের কী একটা সমস্যা বোঝাতে গিয়ে শুরু করলেন, ‘তুমি তো জানো, চীন হচ্ছে একটি দ্বীপ।’ পালাবার পথ পাই না আমি। এই ভদ্রলোকই দক্ষ গাড়ি-চালানো বিষয়ে আমাকে মহামূল্য উপদেশ দিয়েছিলেন: ‘গাড়ি নিয়ে এক ব্যস্ততম চৌরাস্তায় এসে দেখলে, সামনে লালবাতি; কী করবে জানোনা, প্রথমে দু’-চোখ বন্ধ করবে, তারপর ডান পা দিয়ে অ্যাকসিলারেটর জোরে চেপে ধরবে, দেখবে গাড়ি পক্ষীরাজ ঘোড়ার বেগে অন্যপ্রান্তে পৌঁছে গেছে’।
ব্যাংককে গিয়েই সর্বপ্রথম বিশ্বব্যাপী মার্কিন দৌরাত্মের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো। থাইল্যান্ড, আমাদের প্রাচীন সংজ্ঞায় শ্যামদেশ, সেখানে নামকাওয়াস্তে এক রাজা আছেন; ওঁদের মতো করে ওঁরাও রামভক্ত দেশ, রাজাদের নামের তালিকা রাম এক, রাম দুই, রাম তিন ইতাদি। তবে আসলে জঙ্গি সর্বাধিনায়কত্ব। যে-সৈন্যাধ্যক্ষ শাসন চালাচ্ছিলেন তাঁর নাম বিপুলসংগ্রাম। প্রথম পর্বে শ্যামদেশের ভাষা পালির খুব কাছাকাছি ছিল, এখন মঙ্গোলিয় ভাষার অনেক মিশেল ঢুকেছে, তা হলেও ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে যেমন, একটু মাথা খাটালে নামগুলির সংস্কৃত আদিরূপ উদ্ধার করা সম্ভব। যেমন বিপুলসংগ্রাম, যেমন নকরপথন, অর্থাৎ নগর প্রথম, যেমন আয়ুথিয়া, অর্থাৎ অযযাধ্যা। আরও যা চমৎকৃত করেছিল, তা রামায়ণের শ্যামদেশীয় বয়ান: শ্ৰীমান হনুমান নির্বাসিতা রানী সীতার প্রগাঢ় প্রণয়ী। বজরঙ্গ দলওলারা যদি সঙিন উচিয়ে আসেন, আমি নিরুপায়।
রাজপ্রাসাদের সম্মুখবর্তী রাস্তার নাম ‘রাজবীথি’; যে রাস্তার উপর আমাদের দপ্তর, তার পরিচয় ‘রাজ্যদমন এভিনিউ’। ভারতীয় সংস্কৃতি, প্রধানত উদারচরিত বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে, একদা কতটা পরিব্যাপ্ত ছিল, তার প্রমাণ পেলাম ব্যাংককে থাকাকালীনই অন্য এক প্রসঙ্গে। এক আফগান সহকর্মী, হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে বিস্ময়াবিষ্ট হলাম, দেবনাগরী হরফ আমার চেয়ে অনেক দ্রুত ও অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পড়তে পারেন। আমি কৌতূহলাপন্ন হলে তিনি জানালেন, প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ওঁর সময়ে আফগানিস্তানে সংস্কৃতপাঠ বাধ্যতামূলক ছিল, যেহেতু পুস্তুর গঠনবিন্যাস সংস্কৃতের খুব কাছাকাছি।
ব্যাংককে আমার দফতরে কাজ করতেন এক মহিলা, আজও তাঁর অনাবিল সুন্দর নামটি ভুলতে পারিনি: উদমা সিন্দুসবন্ন, অর্থাৎ উত্তমা সিন্ধুস্বপ্ন; আরেক জনের সুভাব যশোধরা। এমন চমৎকার নামযুক্তা সুন্দরী মহিলাদের সান্নিধ্য, খাশা থাকা যাচ্ছে, ব্যাংকক জুড়ে প্রচুর আহার্যের বৈচিত্র্য, বিশেষত চীনে-খাবারের সম্ভার। তখনও পর্যন্ত একটি-দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতি সত্ত্বেও অথচ মনীষা বা বুদ্ধির চর্চা প্রায় শূন্যের কোঠায়। বড়ো কষ্টে দিন কাটাতে হয়েছিল ওই কয়েক মাস। অবশ্য মাঝে-মাঝে এখান-ওখান থেকে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা বক্তৃতা দিতে বা গবেষণাপত্র তৈরি করতে হাজির হতেন। যেমন, জাপানের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, শিগেতো ৎসুরু, মাস তিনেক আমাদের সঙ্গে ছিলেন, দপ্তরে আমারই ঘরসঙ্গী হয়ে। তরুণ বয়সে হার্ভার্ডে ছাত্র থাকাকালীন ঘোর বামপন্থী, পল সুইজিদের সমসাময়িক। বামপন্থী রেশ ৎসুরুর তখনও পুরো কাটেনি, আমার সঙ্গে তাই জমতো ভালো, পরে তিনি মহলানবিশ মহাশয়ের আমন্ত্রণে দিল্লি ও কলকাতা ঘুরে গেছেন। ব্যাংককে তাঁর সঙ্গে অনেকটা সময় কাটতো আমার। জাপানের সমস্যা নিয়ে, এশিয়া ও ভারতবর্ষ নিয়ে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে, সোভিয়েতে ও পূর্ব ইরোপ জড়িয়ে অনেক আলোচনা। সুরু সম্বন্ধে দুটি মজার কাহিনী এখানে না হয় ব্যক্ত করা যাক। একদিন সকালে দপ্তরে বসে লিখছি, ৎসুরু একটু দেরি করে এলেন, আমার পাশ্ববর্তী টেবিলে আসীন, কিন্তু কাজে ঠিক মনঃসংযোগ করতে পারছেন না যেন। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে তাঁর উক্তি, ‘জানো অশোক, কাল রাত্তিরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। এক রেস্তোরাঁয় জনৈকা মহিলার সঙ্গে নৈশভোজনে গিয়েছিলাম, পানাহারের পর তাঁর সঙ্গে নাচতে শুরু করলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই’। আমি কথা না বাড়ানোই বুদ্ধিমত্তা বলে বিবেচনা করলাম।
মন-মাতানো দ্বিতীয় গল্পটি নিম্নরূপ। কাল ১৯৭০ সাল, স্থান মস্কো হাওয়াই আড্ডা। সরকারি কাজে দিল্লি থেকে লন্ডন যাচ্ছি, মস্কোতে বিমান বদলানোর উদ্দেশ্যে অপেক্ষমাণ। ৎসুরু সস্ত্রীক প্যারিস বা ভিয়েনা বা অন্য কোথাও থেকে টোকিও ফিরছেন, ওঁরাও মস্কোতে বিমান পাল্টাচ্ছেন, প্রতীক্ষাশালায় দেখা। ‘কোথায় গিয়েছিলেন?’, ৎসুরুকে আমার প্রশ্ন। উনি মজা করে বললেন, ‘আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদদের সংগঠন দ্বারা আহুত এক বৈঠক ছিল, আলোচ্য বিষয়—“অর্থব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি: পাশ্চাত্য বনাম প্রাচ্য”।’ তারপর একটু মুচকি হেসে ৎসুরু যোগ করলেন, ‘পাশ্চাত্যের অর্থব্যবস্থার মাহাত্ম্য নিয়ে সবচেয়ে ওজস্বিনী বক্তৃতা দিলেন দুই ভারতীয়।’ নাম দুটো বললেন, একটু হাসাহাসি হলো আমাদের। ইঙ্গিতবিদ্ধ উভয় অর্থনীতিবিদই এখন মার্কিন দেশে পাকাপাকি বাস করছেন, মার্কিন নাগরিকও। তবে নিয়ম করে শীতের মরশুমে দু’এক সপ্তাহ ভারতভ্রমণে আসেন, বিশ্বায়ন নিয়ে আমাদের শাসকবর্গকে ঢের বাণী দিয়ে যান, শাসকবর্গ ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে শোনেন।
আমি ব্যাংককে থাকাকালীন সময় স্ত্রী ক্ল্যারিসকে নিয়ে নিকি কালডরও এসেছিলেন কয়েকদিনের জন্য। তাঁর সঙ্গে কেমব্রিজে প্রথম আলাপ, পরে দিল্লিতেও। ব্যাংককে তাঁর বিশেষ কাজ নেই, আমারও নেই, সুতরাং কটা দিন দু’জনের, জীবনানন্দীয় ভাষায়, শিশির-ভেজা আড্ডা। অর্থনীতি চর্চা যত হতো, তার চেয়ে ঢের বেশি পরিচিত অর্থনীতিবিদদের নিয়ে সকলুষ পরচর্চা, তাঁদের স্ত্রীদের নিয়েও। নিকি কালডর আদতে হাঙ্গেরির অধিবাসী, নাৎসি দৌরাত্মের সময় ইংল্যান্ডে চলে এসেছিলেন, দীর্ঘদিন বিলেতে পড়িয়েছেন, বৃটিশ নাগরিকত্ব নিয়েছেন, পরবর্তী কালে লর্ড খেতাবে ভূষিতও হয়েছেন। ব্যাংককে একটি হাঙ্গেরিয় খাদ্য পরিবেশন-করা সরাইখানা ছিল, নাম ‘নিকস্ ইন’; এক সন্ধ্যায় সেখানে কালডর ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ‘নিকস্ ইন’-এ ঢুকে কেমব্রিজের নিক মহা খুশি।
এরকম ছুটকো-ছাটকা রসালো অভিজ্ঞতার বাইরে ব্যাংককে দিনযাপন সত্যিই দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। মার্কিন প্রকোপ, প্রতিটি সরকারি দফতরে মার্কিন পরামর্শদাতারা বসে আছেন। জঙ্গি বাহিনীর বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার সঙ্গে মার্কিনিদের ঘনিষ্ঠ আদানপ্রদান, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েও মার্কিন অধ্যাপক। থাইল্যান্ড তখনও, এমনকি ভারতবর্যের সঙ্গে তুলনার বিচারে পর্যন্ত, অনুন্নত, চাল-কাঠের কিছু রফতানি, ব্যাংকক শহরের বাইরে, যেমন অযোধ্যা শহরে কিংবা অন্যত্র, এবং পল্লীঅঞ্চলে, সর্বসমাচ্ছন্ন দারিদ্র্য। গ্রাম থেকে গরিব কৃষক-ঘরের মেয়েদের লোভ দেখিয়ে ব্যাংককে এনে তাদের ম্যাসাজ পার্লারে বা অন্য কোনও ধরনের গণিকাগারে নির্বাসন, তা থেকেও দেশের শাঁসালো বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন। মার্কিন কেতা, মার্কিন পোশাক, মার্কিনিদের দ্বারা নির্দেশিত পররাষ্ট্রনীতি। পুরোপুরি ভজ মার্কিন, নমো মার্কিন, লহো মার্কিন নাম রে-গোছের অবস্থা। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে আমরা যে অবস্থানে পৌঁছুচ্ছি, থাইল্যান্ডে তার যেন পূর্বচ্ছায়া দেখেছিলাম।
এখানে আর যা সম্ভবত উল্লেখনীয়, মাঝখানে দু’তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে কলকাতায় আমার বিয়ে করে যাওয়া। সেই বিয়ের বিশেষ কোনও স্মৃতি আর অবশিষ্ট নেই, শুধু আবছা মনে পড়ে একঝাঁক কবি-সাহিত্যিক বরযাত্রী গিয়েছিলেন: অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, গৌরকিশোর ঘোষ, গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, আতোয়ার রহমান, নৃপেন্দ্র সান্ন্যাল, মুরারি সাহা, অবশ্যই সুরঞ্জন সরকার। সঞ্জয় ভট্টাচার্য যাননি, কিন্তু সত্যপ্রসন্ন দত্ত ছিলেন। কনুদা, কমলকুমার মজুমদার, বরযাত্রী গিয়েছিলেন কি না খেয়াল নেই, তবে বিয়ের ক’দিন আশেপাশে তাঁর সরব উপস্থিতি। মাস্টার মশাই অমিয়বাবু কাশী থেকে এসেছিলেন, লখনউ থেকে বিনয় দাশগুপ্ত মশাই। সবচেয়ে যা স্মরণীয়, স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু, শৌখিন সিল্কের পাঞ্জাবি-শোভিত, লাজুক-লাজুক মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, যেন তিনিই বিয়ে করতে গেছেন। পরে শুনেছি, গৌরকিশোর ঘোষের বরযাত্রীসজ্জা ছিল মাথায় তিব্বতি টুপি, চোখে কালো চশমা, গায়ে দাশু পাগলা-সদৃশ ছেঁড়া আলখাল্লা, পায়ে উঁচু বুট জুতো। গাড়ির-ভিড়-সামলাতে-আসা এক পুলিশকর্মী ওর দিকে একটু কৌতুকাপন্ন দৃষ্টিতে তাকাতে গৌর বীরদর্পে এগিয়ে ডায়লগ বললো, ‘কেয়া দেখতা হ্যায়? জানতা হ্যায় হাম জজ সাহাবকা দামাদকা দোস্ত হুঁ? সমঝে?’
যোগ করা উচিত না অনুচিত জানিনা, বিবাহের আমন্ত্রণলিপিটি রেখাচিত্রাঙ্কিত করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
থাইল্যান্ডের শেষ মাসটা জোড়া উত্তেজনার ঘোরে কাটলো: রুশ সৈন্যদলের ঝাঁকে-ঝাঁকে হাঙ্গেরিতে অনুপ্রবেশ, কয়েকদিন বাদে ইংরেজ-ফরাশিদের সুয়েজ আক্রমণ। দুটো ঘটনা যেন কাটাকুটি খেলার রূপ পরিগ্রহ করলো আরও যা মনে দাগ কেটে আছে, ব্যাংকক থেকে দিল্লির পথে যেদিন কলকাতায় নামলাম, সেদিনই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু।
কুটনিকাটিয়েরা বলেন, অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমি বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেছি: কাজে যোগ দিয়েছি, দু’দিন বাদে পদত্যাগ করেছি, ফের অন্য কাজে যোগ দিয়েছি, আর একদফা পদত্যাগ করেছি, পুনর্বার নতুন কাজে যোগদান, অতঃপর ফের পদত্যাগ, এমনি করে অসংখ্যবার। এমনধারা মন্তব্যপ্রয়োগকারী মানুষদের বিশ্বনিন্দুক বলে অভিহিত করতে পারি না। ব্যাংককে আমার প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন যে তামিল অর্থনীতিবিদ, তিনি অবসরান্তে দিল্লিতে একটি নতুন আর্থিক-গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্তা হয়ে যোগ দিচ্ছিলেন। তিনি উপরোধ জানালেন, যেহেতু আমিও দেশে ফিরে যেতে মনস্থ করেছি, তাঁর ওখানে যোগ দিতে সম্মত আছি কিনা। সৌজন্যবশতই, রাজি হয়ে গেলাম।
কয়েক মাস যেতে-না-যেতে সিদ্ধান্তের ভুল সম্যক বুঝে ওঠা গেল। উক্ত ভদ্রলোকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সামন্ততান্ত্রিক চেতনা। সেই আমলের আরও অনেক দিশি কর্তা-ব্যক্তির মতো, কোনও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে আসীন হয়েছেন যেহেতু, ধরাকে চট করে সরা জ্ঞান করে নেওয়া অভ্যাস। অতি দ্রুত উপলব্ধি করলাম এই প্রবীণ ভদ্রলোকের সঙ্গে মিলিয়ে চলা অসম্ভব। কারণ খোলসা হবে তাঁর ব্যবহার-আচরণের একটি দৃষ্টান্ত যদি পেশ করি। ভদ্রলোক পারিবারিক কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মাসখানেকের জন্য দক্ষিণে চলে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে আমাকে চিঠি, ‘প্রিয় ডক্টর মিত্র, আমি ভীষণ ব্যস্ত আছি নানা ঝামেলায়। অমুক জায়গায় আমাকে আগামী মাসে একটি বক্তৃতামালা উপস্থাপন করতে হবে, একেবারে সময় পাচ্ছি না, তুমি যদি বক্তৃতাগুলির চুম্বক দয়া করে ওদের পাঠিয়ে দাও, অনুগৃহীত বোধ করবো’। ভদ্রতাসূচক জবাব পাঠালাম, ‘চুম্বক তৈরি করে পাঠাতে আমার তেমন অসুবিধা নেই, কিন্তু তা তৈরি করতে গেলে বক্তৃতাগুলির পুরো পাঠ আমার দেখে নেওয়া প্রয়োজন। দয়া করে পাঠিয়ে দেবেন কি?’ তড়িৎগতিতে প্রত্যুত্তর এলো, ‘প্রিয় ডক্টর মিত্র, আপনি তো বুঝতেই পারছেন, আমি সময় পাচ্ছি না, দয়া করে যদি বক্তৃতাগুলিও আপনি লিখে দেন, ভারি ভালো হয়’। বলা বাহুল্য তাঁকে অনুগ্রহ করার মতো মানসিকতা ওই মুহূর্তে আমার মধ্যে উদয় হলো না। ঝামেলার শুরু সেখান থেকে; তারপর নানা খিটিমিটি লেগেই রইলো।
তবে ভুল যখন করেই ফেলেছি, চক্ষুলজ্জার খাতিরে অন্তত খানিকটা সময় তো কাটাতেই হয়। তা ছাড়া দিল্লিতে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আমার বন্ধু-বান্ধবের অভাব নেই, তাঁদের সঙ্গে আড্ডা-বিতর্ক-আলোচনা। এমনকি এই নতুন গবেষণা-প্রতিষ্ঠানেও দু’একজন মনের মতো মানুষ পাওয়া গেল। কয়েক মাস বাদে মাস্টারমশাই অমিয় দাশগুপ্তও কাশী থেকে এসে এই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ দিলেন। তাঁর বাড়িতে নিত্যক্ষণ আড্ডার জন্য যাওয়া, স্বামী-স্ত্রী আমাদের দু’জনেরই।
দিল্লির এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীন আমার অন্য যে-সৌভাগ্য, ড্যানিয়েল থর্নারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব স্থাপন। ম্যাকার্থি-ম্যাকনামারার তাড়া-খাওয়া থর্নার পরিবার ১৯৫৩ সাল থেকে ভারতবর্ষে স্থিত, এখানে তাঁদের অজস্র বন্ধু, কিন্তু না-ড্যানিয়েলের, না-অ্যালিসের, নিশ্চিত উপার্জনের ব্যবস্থা করা সহজ ছিল না। মাস ছয়েকের জন্য নতুন দিল্লির ওই গবেষণা কেন্দ্রে ড্যানিয়েল যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তামিল অর্থনীতিবিদ তাঁর সঙ্গেও সমান দুর্ব্যবহার করে যাচ্ছিলেন। পরস্পরকে সমবেদনা জ্ঞাপন দিয়ে যে নৈকট্যের সূত্রপাত, তা বরাবর অবিচ্ছেদ্য থেকেছে। পঁচিশ বছরের উপর হলো ড্যানিয়েল বিগত, কিন্তু অ্যালিস নিয়ম করে প্রতি বছর শীতে আমাদের সঙ্গে কলকাতায় অন্তত এক সপ্তাহ কাটিয়ে যায়।
ভূপেশবাবুর কমিউনের তখনও সড়গড় অবস্থা, সেখানেও আমার জড়ো হওয়া ঘনঘন। মোহিত সেন-অজিত দাশগুপ্ত দু’জনেই দিল্লিতে, কয়েক মাস না কাটতে ই এম এস পৃথিবীতে সর্বপ্রথম তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচন জিতে কমিউনিস্ট পার্টির সরকার গঠন করলেন কেরলে। ওখান থেকে তলব এলো কমিউনিস্ট সরকারের প্রথম বাজেট তৈরির কাজে সাহায্য করতে, পত্রপাঠ তিরুবনন্তপুরম্ যেতে হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নির্মল বিবেকে কলকাতায়-অমুক-গুরুজন-গুরুতর-অসুস্থ এই অনৃতভাষণ জ্ঞাপন করে কেরলের পথে পাড়ি দিলাম। বিমানে চেপে নাগপুর-মাদ্রাজ হয়ে তিরুবনন্তপুরম্ পৌঁছবার রাস্তায় যে নানা রোমহর্ষক সমস্যা তথা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম, তার বিবরণ অন্যত্র দিয়েছি।
সারা দেশে হইহই, দুশ্চিন্তা-ত্রাসের রইরই, কী সর্বনাশ, কমিউনিস্টরা অবাধ নির্বাচনে জয়লাভ করেছে একটি রাজ্যে, এবার অন্যান্য রাজ্যেও তাদের ষড়যন্ত্র বিস্তার লাভ করবে, এই ধরনের গুঞ্জন। পার্টির অভ্যন্তরেও আনন্দের সঙ্গে ঈষৎ ভ্যাবাচ্যাকা বোধ, এরা সত্যিই কি আমাদের টিকতে দেবে? এই অনুভূতি যে বাস্তবতা-বহির্ভূত ছিল না তা তো দু’বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল।
তিরুবনন্তপুরম্ পৌঁছে দেখি একটু ঢাকঢাক গুড়গুড় পরিস্থিতি। আমাকে শহরের ঘনবসতি অঞ্চলের বাইরে অপেক্ষাকৃত ঈষৎ নির্জন এক ডাকবাংলোয় তোলা হলো, যাতে আমার উপস্থিতির কথা না রটে যায়, রটলেই খবরের কাগজে বড়ো-বড়ো করে শীর্ষসংবাদ ছাপা হবার আশঙ্কা: আন্তঃরাজ্য কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রের প্রথম পর্ব। কেরলের পার্টি সম্পাদক গোবিন্দন নায়ার সেরকম ঝুঁকি নিতে একেবারেই রাজি নন।
ডাকবাংলোয় আগে থেকেই অপেক্ষমাণ অন্য এক অর্থনীতিবিদ, ইকবাল সিং গুলাটি, বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক, পাবলিক ফিনান্সে খুব পাকা মাথা, তখনও মার্কসীয় প্রজ্ঞায় তাঁর তেমন উৎসাহ বা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তাঁর অর্থশাস্ত্রীয় দক্ষতার কথা বিবেচনা করে আমাদের এক অনুকম্পায়ী বন্ধু তাঁকেও কেরলে হাজির করাবার বন্দোবস্ত করেছিলেন। সেই প্রথম সাক্ষাৎ, তারপর গত চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর সুখে-দুঃখে- বিষাদে-হরিষে জড়িয়ে থেকে আমরা আরও কাছাকাছি এসেছি। দেশের প্রথম কমিউনিস্ট সরকার, সে-সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পরমশ্রদ্ধেয় ই এম এস, আমাদের উৎসাহের অন্ত নেই। হয়তো মাত্র দিন দশেক ছিলাম, কিন্তু সেই সীমিত সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলাম বলেই মনে হয়। কেরলের অর্থব্যবস্থা-সমাজব্যবস্থার আদ্যোপান্ত হিশেবনিকেশ ঘেঁটে বামপন্থী সরকারের প্রথম বাজেট রচনা: একদিকে তা যেন বাস্তবানুগ হয়, অন্যদিকে আদর্শ থেকে সামান্য বিচ্যুতিও গ্রহণীয় নয়। ওখানকার কমরেডদের সঙ্গে আলাপ জমলো, ভারতবর্ষ কত বৈচিত্র্যে ভরপুর তার অজস্র প্রমাণ পেলাম, মালয়ালি মানুষদের সঙ্গে আমাদের বাঙালিদের দৃষ্টিভঙ্গির কত সামীপ্য তারও পরিচয় মিললো। মনে পড়লো, এই স্বল্পকালীন তিরুবন্তপুরম বাসের সময়ই সাংবাদিক ডেভিড কোহেনের সঙ্গে শেষ দেখা। আশ্চর্য মানুষ ডেভিড, কলকাতার ক্ষয়িষ্ণু বনেদি ইহুদী পরিবারের প্রায় শেষ দীপশিখা, কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর মিশে যাওয়া। ১৯৫৭ সালেও পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর কী হলো জানি না, উধাও হয়ে গেলেন। বহু বছর বাদে, টোকিও থেকে হংকং ছুঁয়ে কলকাতা আসছি, বিমানে ডেভিড কোহেন, হংকং-এ নেমে গেলেন, বিশেষ কথা হলো না।
অন্য একটি কৌতুকপ্রসঙ্গও উল্লেখ করতে হয়। ইকবাল গুলাটি তখনও শ্মশ্রুপাগড়িমণ্ডিত আপাতমস্তক শিখ, অচিরেই জানা গেল বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ-পড়ুনি এক তামিল ছাত্রীর সঙ্গে তার পূর্বরাগের পালা চলছে। সেই তরুণী প্রতিদিন দয়িতকে একটি করে চিঠি পাঠাচ্ছেন, তাতে আবার স্বরচিত ইংরেজি কবিতার ঠাসা ভিড়। বরাবরই ইকবাল অন্তত উদারমনা ব্যক্তি, মাঝে-মধ্যে আমাকে সেই চিঠিগুলির ভগ্নাংশ পড়তে দিত, ঠিক কী জবাব দেওয়া রীতিসম্মত হবে তা নিয়েও আমার পরামর্শ সোৎসাহে গ্রহণ করতো। কেরলের কমিউনিস্ট সরকারের প্রথম বাজেটের সঙ্গে ইকবাল-লীলার জমে-ওঠা প্রণয়কাহিনী আমার স্মৃতিতে তাই অঙ্গাঙ্গী মিশে আছে।
দিল্লিতে ফেরা, দিনের বেলা গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সকাল-সন্ধ্যা, গভীর রাত্রি পর্যন্ত, অন্য পরিবেশ, কমিউনিস্ট পার্টির আসফ আলি রোডের সদর দফতর, ভূপেশ গুপ্ত-কমল বসু-রেণু চক্রবর্তীদের ফ্ল্যাটে কমরেডদের কমিউন, নিউ এজ পত্রিকার জন্য হন্তদন্ত হয়ে লেখা তৈরি: এর বাইরে বাঙালি আচ্ছা তো আছেই। তখন দিল্লিতে অমিয়বাবুরা ছাড়াও দিল্লি কলেজে অধ্যাপক হিশেবে বৃত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রাক্তন শিক্ষক মন্মথবাবু, যাঁর কথা আগে লিখেছি, অংশু এবং তাঁর স্ত্রী ইন্দ্রাণীও ইতিমধ্যে দিল্লিতে। ফের পরিচয়ের পরিধি ক্রমশ বৃহত্তর, আমাকে সেই গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের বাঁধনে বেঁধে রাখবে তেমন নিগড় তখনও উদ্ভাবিত হয়নি। সে সময় দিল্লিতে বাড়তি এক প্রাপ্তি বটুকদার—জোতিরিন্দ্র মৈত্রের—স্নেহসান্নিধ্য। তাঁর নিজের মতো করে এই মানুষটিও নিখাদ কমিউনিস্ট, সারাটা জীবন জনসমুদ্রের ঠিকানা খুঁজে বেরিয়েছেন, নিজের কথা ভাবেননি। দিল্লিতে যে-আধা সরকারি সংস্কৃতি কেন্দ্রে তিনি তখন কর্মরত, তার প্রধান কর্ত্রী মহোদয়া সামন্ততান্ত্রিক শোষণের পরাকাষ্ঠায় পৌঁছুতে ব্যস্ত: বটুকদাকে উদয়াস্ত খাটিয়ে মারেন, খামখেয়ালের পর্বতমালায় সেই মহিলার বিহার করে বেড়ানো, উপহসনীয় পারিশ্রমিক বটুকদার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো। সম্ভবত ওই গোছের দিনযাপনের গ্লানির পীড়ন থেকে ক্ষণিক মুক্তি পেতে তিনি আমাদের সঙ্গে মাঝে-মাঝে খানিকটা সময় কাটিয়ে যেতেন, গানে-গল্পে-স্নেহবর্ষণে মুগ্ধ করে। একদিনের কথা বিশেষ মনে পড়ে, আমাদের নিজামুদ্দিন পাড়ার ফ্ল্যাটের ছাদে বাড়িসুষ্ঠু সবাইকে নিয়ে এসে গানের বন্যায় ভাসিয়ে সবাইকে ধন্য করে দিয়েছিলেন।
এমন নয় যে অর্থনীতিতে আমার আগ্রহ ততদিনে পর্যাপ্ত কমতে শুরু করেছে। গবেষণাপত্র ইত্যাদি যথারীতি লিখছি, সে-সব প্রচারিত হচ্ছে। অর্থমন্ত্রক থেকে আঞ্জারিয়া মহাশয় নতুন করে আমাকে তাঁর দপ্তরে পরামর্শদাতা হিশেবে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু ব্যাংকক থেকে যাঁর সঙ্গে দিল্লিতে ফিরেছিলাম, সেই মহাধ্যক্ষ মহোদয়ের সম্পত্তিচেতনা অতি প্রখর, কিছুতেই আমাকে ছাড়বেন না, আঞ্জারিয়াও খানিকবাদে ক্ষান্ত দিলেন। তবে গবেষণার গণ্ডিতে আমার মতো উড়নচণ্ডী কী করে আর বন্দী থাকে? অনেক সময় দুপুরবেলা গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির দফতরে চলে যেতাম, নয়তো অর্থমন্ত্রকে সতীর্থদের ঢালাও আড্ডায়, দিনান্তে ফিরে এসে অধ্যক্ষকে জানাতাম গবেষণার রসদ সংগ্রহ করতে গলদ্ঘর্ম হচ্ছি।
যে-কথা এতক্ষণ বলা স্থগিত রেখেছি, অথচ যা এখন না বললেই নয়: ইকনমিক উইকলি পত্রিকার সঙ্গে আমার পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে জড়িয়ে পড়ার বৃত্তান্ত। ওই পত্রিকার কথা বলতে গেলে তার আগে অবশ্য বিশ্রুতকীর্তি চৌধুরী ভ্রাতাদের কথা উল্লেখ করতে হয়। কাহিনীর প্রেক্ষাপটে কাহিনী, তার প্রেক্ষাপটে আরও কাহিনী।
পাবনা জেলার গ্রাম ভারেঙ্গা, দুই প্রধান জমিদার বংশ বহু যুগ ধরে পাশাপাশি বসবাস করেছেন। উভয় বংশই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণকুলোর্ভূত: একটি বংশ চৌধুরী, অন্যটি ঘটক। ভারেঙ্গা গিয়ে থেকে গিয়ে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে নরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ঢাকা শহরে ওকালতি বৃত্তিসূত্রে বসবাস করতে শুরু করেন। প্রথম দিকে তিনি বাড়ি ভাড়া করেছিলেন আর্মেনিটোলা পাড়ায় আমাদের বাড়ির লাগোয়া রজনী বসু লেনে। এই গলির নামকরণেও একটি কৌতুককাহিনী জড়িত। হিন্দু উচ্চমধ্যবিত্ত আইনজীবী বীরেন্দ্রনাথ বসু এই ওয়ার্ড থেকে যেবার পুরসভার নির্বাচনে জয়লাভ করতেন, সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তার নামকরণ হয়ে যেত তাঁর বাবা রজনী বসুর নামে। আর যেবার আবুল হাসনাত জিততেন, রাতারাতি ভোল পাল্টে রজনী বসু লেন নামান্তরিত হতো মীর আতার গলিতে, সাধুপুরুষ হিশেবে ঢাকায় এই সন্তের প্রসিদ্ধি ছিল। সে যা-ই হোক, নরেন্দ্রনারায়ণবাবু আর্মেনিটোলা পাড়ার পাকা বাসিন্দা হয়ে গেলেন, যদিও ভারেঙ্গা গ্রাম ও পাবনা জেলার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বরাবরই অটুট ছিল। বছর কুড়ি বাসের পর মীর আতার গলির বাড়িতে অকুলান হওয়ায়, নরেন্দ্রনারায়ণ ওই পাড়ারই অন্য প্রান্তে জিন্দাবাহার লেনে উঠে যান। নরেন্দ্রবাবুর আট সন্তান, চার পুত্র, চার কন্যা। জ্যেষ্ঠ পুত্র শচীন্দ্রনারায়ণ, দ্বিতীয় দেবনারায়ণ, তৃতীয় হিতেন্দ্রনারায়ণ, চতুর্থ নরনারায়ণ। চার কন্যার প্রথমা শান্তি, দ্বিতীয়া ধরিত্রী, তৃতীয়া শকুন্তলা, চতুর্থ স্বপ্নময়ী। এই পরিবারের সঙ্গে, বিশেষ করে ভ্রাতৃবৃন্দের সঙ্গে, আমার প্রায় গোটা জীবন জড়িয়ে গেছে। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার পরিমাণ অঙ্কের হিশেবের বাইরে। আমি যা হতে পেরেছি, হয়েছি, তার প্রধান ঋণভার যদি কোথাও অর্পণ করতে চাই, চৌধুরী ভাইদের প্রসঙ্গে বারবার ফিরে আসতেই হবে আমাকে।
ভাইবোনদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ শচীন্দ্রনারায়ণ, আমার চেয়ে পঁচিশ বছরের বড়ো, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কাকার সহপাঠী। এখানেও একটি গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না। শচীনদা এবং আমার কাকা স্নাতকস্তরে এক সঙ্গে গণিতের ক্লাস করতেন, বাকিটুকু শচীনদার জবানিতেই বলছি: ‘পরীক্ষার আগে তোমার কাকা বললেন, তুই তো গণিতে একটু কাঁচা আছিস, আয়, তোকে আমি কোচ করিয়ে দিই। তোমার কাকা এমন চমৎকার কোচ করালেন যে আমি স্বচ্ছন্দে পাশ করে গেলাম, আর তোমার কাকা ফেল করলেন’। পঞ্চাশের, অথবা ষাটের দশকে, মুম্বইতে-দিল্লিতে-কলকাতায় যখন শচীনদার সঙ্গে কোনও এঁড়ে তর্ক জুড়ে দিতাম, এবং আমার সঙ্গে উনি পেরে উঠতেন না, তখন অন্যায়ভাবে মোক্ষম গল্পটা ঝাড়তেন: ‘তুমি তো সেই কাকারই ভাইপো’।
মাস্টারমশাই অমিয়বাবুরও সহপাঠী ছিলেন শচীন্দ্রনারায়ণ, দু’জনের আমৃত্যু বন্ধুত্ব। অমিয়বাবু বহুবার আমাকে বলেছেন, শচীনদার চেয়ে উজ্জ্বলতর ছাত্র তাঁদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ ছিলেন না। দীর্ঘ অবয়ব, সুবেশ, বাক্চাতুর্যে যে-কাউকে হারিয়ে দিতে সক্ষম, সংস্কৃত-বাংলা-ইংরেজি সব ক’টি সাহিত্যে সমান দক্ষতা, ইতিহাস-দর্শনেও অফুরন্ত আগ্রহ, আর নিজের বিষয় অর্থনীতিতে তত্ত্বালোচনায় অথবা তথ্যবিবৃতিতে কেউই তাঁর সঙ্গে পেরে উঠতো না। গান্ধিজী সম্পর্কে মুগ্ধতাবোধের ঘোর দেশ জুড়ে তখন, শচীনদা সর্বদা খাদির ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন, কখনও-কখনও গায়ে মিহি চাদর জড়াতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে তাঁর বিজয়ী বীরের মতো বিচরণ। অথচ এম এ পরীক্ষার আগে হঠাৎ ঢাকা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন, দু’তিন মাস কেউ তাঁর পাত্তা পেল না। পরীক্ষার ঠিক চারদিন আগে ঢাকায় ফিরে অমিয়বাবুর কাছে কিছু নোটস যাচ্ঞা করলেন। হাজার তুখোড় হলেও ওভাবে পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না, শচীনদা কোনওক্রমে তৃতীয় শ্রেণী পেলেন, হয়তো সেই লজ্জাতেই ফের ঢাকা থেকে উধাও। তারপর থেকে অনবচ্ছিন্ন বাউন্ডুলে অতিবিচিত্র জীবনযাপন। কখনও করাচি বা এলাহাবাদে কংগ্রেস দলের স্বেচ্ছাসেবক হয়েছেন, কখনও কলকাতায় তাঁর মামাতো ভাই, অমিয় চক্রবর্তীর অনুজ, অজিত চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রাইভেট টিউশনির টোল খুলেছেন। তাঁর সেজো ভাই হিতুবাবু মুম্বইতে স্থিত হলে তাঁর পরামর্শে শচীনদা কয়েক বছর ফাটকাবাজারে হাত পুড়িয়েছেন, এখনে-ওখানে ছুটকো সাংবাদিকতা করেছেন, অমিয়বাবু মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক দ্বারকানাথ ঘোষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার পর দ্বারিকবাবুর সঙ্গে পি-এইচ. ডি ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে গবেষণায় নাম লিখিয়েছেন যৎসামান্য বৃত্তিলাভের স্বার্থে, গবেষণার কাজ আদৌ এগোয়নি। তাতে কী, বহু বছর কোনও-না-কোনও দৈনিক পত্রিকার জন্য অর্থনীতি-সংক্রান্ত, ফাটকাবাজার-সংক্রান্ত, বা চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত, চুটকি মন্তব্য লিখেছেন চুটকি রোজগারের স্বার্থে।
ইতিমধ্যে মেজো ভাই দেবনারায়ণও মুম্বইতে স্থিত। উভয় অনুজ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে আগলে থেকেছেন; বলতে তো কোনও গ্লানিবোধ নেই, তিরিশের-চল্লিশের দশকগুলির প্রধান সময় শচীনদা জীবনধারণের জন্য অনুজদ্বয়ের উপরই প্রধানত নির্ভরশীল ছিলেন। চল্লিশের দশকের শেষের দিকে তাঁর পাকা ডেরা দেবুদার ওখানে নয়তো হিতুবাবুর আস্তানায়। হিতুবাবু তখনও অকৃতদার, দেবুদার স্ত্রী, আমাদের হেনাদি, শচীনদার সমস্ত ঝক্কি সামলেছেন। নিশ্চয়ই হিতুবাবুর দৌত্যে, হিমাংশু রায় ও দেবিকারানী শচীনদাকে একটা সময়ে বম্বে টকিজের খোদ জেনারেল ম্যানেজার হিশেবে আহ্বান করে নিয়ে গিয়েছিলেন; সেই কয়েক মাস শচীনদা ধুতি-পাঞ্জাবি থেকে মোহমুক্ত হয়ে চোস্ত স্যুট-টাইয়ে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। একবার ইওরোপও তার ঘুরে আসা হয়েছিল কোনও ছুতোয়।