আপিলা-চাপিলা – ২৫

পঁচিশ

ফিরে যেতে হয় সাতাত্তর সালের নির্বাচন-ঋতুতে। জরুরি অবস্থার কেলেঙ্কারিহেতু কংগ্রেসের অনেকটাই গুটনো অবস্থা, কিন্তু জনতা দলের রমরমা, কেন্দ্রে তাঁদের সরকার, প্রফুল্ল সেন মশাইরা এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে বিধানসভা নির্বাচনে আটচল্লিশ শতাংশ আসনও বামফ্রন্টকে ছেড়ে দিতে রাজি নন। তবে প্রচারে নেমে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে আমরা প্রায় নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম, নির্বাচনে বামফ্রন্টই জয়ী হবে, ভোট শেষ হওয়ার পরও দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই আমাদের। অথচ মাত্র তিন মাস আগে অবস্থা পুরোপুরি অন্যরকম ছিল: এখন মনে পড়লে হাসিই পায়, লোকসভা নির্বাচনের ভোটপর্ব শেষ, দু’দিন বাদে ভোট গোনা হবে, ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রের ভোট বাক্সগুলি হেস্টিংস হাউসে রাখা আছে, জ্যোর্তিময় বসুর নায়কত্বে আমরা ক’জন ওখানে, রাত একটা অথবা দুটো, নৈশপ্রহরা দিচ্ছি, ইন্দিরা গান্ধির দল যাতে কোনো ফষ্টি-নষ্টি না-করতে পারে।

বিধান সভা নির্বাচনে ভোটের ফলাফল আমাদের প্রতিপক্ষ দলগুলিকে হতভম্ব করে দিল। জনতা দল ও কংগ্রেস উভয়েই কুড়ি-পঁচিশটি করে আসন পেল, সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার তিনটি, মুসলিম লিগ ও গোরখা লিগ একটি করে, রাজ্যময় বাকি সমস্ত আসন বামফ্রন্টের দখলে। জনতা দলের গরীয়সী নেতারা যে হিশেবে কত ভুল করেছিলেন, তা নিয়ে তাঁরা আশ্চর্য হয়েছিলেন কি না জানি না, আমরা অন্তত হইনি। নির্বাচনী প্রচার শুরু হতেই পার্টি ও বামফ্রন্টের পক্ষে যেন সমর্থনের ঢল নামলো। বোেঝা গেল একটা মস্ত পরিবর্তন ঘটাতে পশ্চিম বাংলার মানুষ তৈরি। সন্ধ্যাকালীন সভাগুলিতে অকল্পনীয় ভিড়; কোনও সভায় বক্তৃতা করছি, হঠাৎ সমবেত শ্রোতাদের মধ্য থেকে কেউ চেঁচিয়ে বললেন, দু’দিন আগে হাজরা পার্কের ওই মিটিংয়ে যা বলেছিলাম তা যেন এখানে আর একবার বলি, যেন তাঁরাই ঠিক করে দেবেন কী বলবো।

মুখে-মুখে আগে থেকেই জল্পনা চলছিল, বামফ্রন্ট ও মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি জিতলে জ্যোতি বসু তো মুখ্যমন্ত্রী হবেনই, সেই সঙ্গে অশোক মিত্র অর্থমন্ত্রী। জ্যোতিবাবু এর কাছাকাছি সময়েই কৌতুক করে আমাকে বলেছিলেন: ‘আপনার-আমার পোর্টফোলিও তো জনগণই ঠিক করে দিল’। নিয়মশৃঙ্খলায় বাঁধা মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, মন্ত্রিসভার তালিকা মঞ্জুর করার অধিকার পলিটব্যুরোর, সুতরাং আগে থেকে না প্রমোদবাবু, না জ্যোতিবাবু, আমাকে কিছু জানালেন। সব ফল বেরিয়ে যাওয়ার পর জ্যোতিবাবু একদিন সকালে ডেকে বললেন, সরকার গঠনের ব্যাপারে ও ভোট অন অ্যাকাউন্ট নিয়ে আলোচনার জন্য বিকেলের দিকে রাজ্যের মুখ্যসচিব ওঁর বাড়িতে আসছেন, আমিও যেন উপস্থিত থাকি। গেলাম। মুখ্যসচিবকে অনেকদিন ধরে চিনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে কৃতী ছাত্র ছিলেন, যদিও আমার চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়ো। জ্যোতিবাবু বরাবর কম কথার মানুষ, শপথ গ্রহণের আয়োজন সম্পর্কে একটি-দু’টি বিষয় আলোচনার পর মুখ্যসচিবকে বললেন, ‘শপথ নেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই তো বিধান সভা ডেকে ভোট অন অ্যাকাউন্ট বাজেট পেশ করতে হবে। খুব সম্ভব ডক্টর মিত্রকে আমাদের অর্থমন্ত্রী মনোনীত করা হবে, আপনি বাজেটের বিশদ ব্যাপারগুলি ওঁর সঙ্গে আলোচনা করে নেবেন’। রাজ্য প্রশাসনে আমার হাতেখড়ি ঘটলো।

দু’ দিন বাদে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। তারিখটি, একুশে জুন, রাজভবনের প্রাঙ্গণে মস্ত শামিয়ানা খাটানো, তা হলেও মাত্র কয়েকশো জনের জায়গা করা সম্ভব হলো তার তলদেশে। বাইরে জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার। একশো চুয়াল্লিশ ধারা উধাও, রাজভবনের উত্তর ও পুব দ্বার থেকে শুরু করে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট ধরে বিবাদী বাগ-রাইটার্স বিল্ডিং পর্যন্ত উদ্দাম মানুষের ভিড়। আমার বাড়ির লোকেরা আলাদা করে গেলেন, আমি জ্যোতিবাবুর সঙ্গে তাঁর হিন্দুস্থান পার্কের বাড়ি থেকে। ওই তারিখে মাত্র পাঁচজন মন্ত্রী শপথ বাক্য ও মন্ত্রগুপ্তি উচ্চারণ করলেন: মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি থেকে জ্যোতি বসু, কৃষ্ণপদ ঘোষ ও আমি, ফরোয়ার্ড ব্লকের কানাইলাল ভট্টাচার্য, আর এস পি-র যতীন চক্রবর্তী। যে-চারজন সেদিন জ্যোতিবাবুর সঙ্গে শপথ নিয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে একমাত্র আমিই এখন ধরাধামে আছি।

প্রায় পরমোৎসব অনুষ্ঠান, গাম্ভীর্ষ ছাপিয়ে স্নেহাংশুবাবুর কলোচ্ছ্বাস, ভদ্রলোক নিজের জন্য নির্দিষ্ট আসনে থোড়াই বসছেন, উঠে দাঁড়িয়ে একবার এদিকে যাচ্ছেন, একবার ওদিকে, হাস্য-বিদ্রূপ-মস্করার বিনিময় এঁর-ওঁর সঙ্গে। আমরা পাঁচজন রাজ্যপালের সঙ্গে মঞ্চে সমাসীন, রাজ্যপাল অ্যান্টনি ডায়াস আমার পুরনো পরিচিত, যখন কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনের সভাপতি ছিলাম, উনি তখন কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য সচিব, যথেষ্ট হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। মঞ্চের সামনে বাঁদিকে গণ্যমান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বসে। শান্তশিষ্ট অজয় মুখোপাধ্যায়, গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরণে, অতি নিরীহ ভঙ্গিতে বসে আছেন; হঠাৎ নাটকীয়তার সঙ্গে খাঁটি বিলিতি স্যুট-টাইভূষিত হয়ে হাতে ওয়াকিং স্টিক নিয়ে অন্য এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর আবির্ভাব। যেন তিনিই নির্বাচনে জিতেছেন, সোজা মঞ্চে উঠে এলেন। জ্যোতিবাবুর সঙ্গে একটু হাসিঠাট্টা করলেন, তারপর একটু উঁচু গলায়: ‘হয়্যার ইজ অশোক মিত্র?’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও করমর্দন করতে হলো।

শপথগ্রহণ ও চা-চক্র অনুষ্ঠানান্তে কাতারে-কাতারে মানুষ জ্যোতিবাবুর গাড়ি ছেঁকে ধরে, ওরকম স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের ব্যঞ্জনা ক্বচিৎ দেখা যায়, মুখ্যমন্ত্রীকে জনতা প্রায় শোভাযাত্রা করে রাইটার্স বিল্ডিঙে পৌঁছে দিল। ভিড়ের প্রকোপে অনেকেই বিচ্ছিন্ন, কিছু পরে কার যেন গাড়ি চেপে বিমান বসু ও আমি মহাকরণে পৌঁছুলাম। জ্যোতিবাবু দোতলার অলিন্দ থেকে জড়ো-হওয়া সরকারি কর্মচারী ও জনতার উদ্দেশে ভাষণরত: ‘আমরা জনতার নির্বাচিত সরকার, জনতার অনুশাসন অনুসারে এই সরকার চলবে, রাইটার্স বিল্ডিঙে বসে নয়, জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে, জনতার নির্দেশে, জনতার প্রেরণায় এই সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিরূপিত হবে’।

মুখ্যসচিব মন্ত্রীদের স্ব-স্ব ঘর দেখিয়ে দিলেন, একটু বাদে সবাই মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে সমবেত হলাম। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক, দশ মিনিটের কিংবা তারও কম সময়ের জন্য, দু’টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো, জ্যোতিবাবুর প্রস্তাব অনুযায়ী। প্রথম, সমস্ত রাজবন্দীদের অবিলম্বে বিনাশর্তে মুক্তি; দ্বিতীয়, স্নেহাংশুকান্ত আচার্যকে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল হিশেবে মনোনয়ন।

মুখ্যমন্ত্রীর ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে করিডোরে বেরিয়ে দেখি জনকল্লোল রাইটার্স বিল্ডিঙের দোতলা পর্যন্ত ছুঁয়েছে অসংখ্য-অগণিত মানুষ, এই দিনটি তাঁদের, জনগণের, তাঁদের আনন্দ ধরে না। চেঁচাচ্ছেন, গাইছেন, নাচছেন, পরস্পরকে ঠেলছেন, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আমার এক নিকটাত্মীয়া জ্যোতিবাবুর বাড়ির লোকদের সঙ্গে পরম নিশ্চিন্তে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন: রাইটার্স বিল্ডিঙে পরিভ্রমণ তাঁর বোধহয় সেদিনই প্রথম ও শেষ।

প্রথম ক’টা দিন নিজের গাড়ি নিজেই চালিয়ে মহাকরণে গেলাম, তবে বুঝতে পারলাম সেটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা সম্ভব নয়, সরকারের গাড়ি বরাদ্দ আছে, চালক বরাদ্দ আছে, নিয়ম ভাঙতে গেলে হরেকরকম সমস্যা। সুতরাং রণে ভঙ্গ দিতে হলো। সপ্তাহ খানেক বাদে বাকি মন্ত্রীরা শপথগ্রহণ করলেন। তার আগে বিধান সভার অস্থায়ী অধ্যক্ষ হিশেবে বিনয়দা, বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী, সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করালেন। বিধান সভার প্রথম অধিবেশনও সঙ্গে-সঙ্গে বসলো, মাস শেষ হবার আগে ভোট অন অ্যাকাউন্ট মঞ্জুর করিয়ে নেওয়ার তাড়া। সৈয়দ মনসুর হবিবুল্লা সর্বসম্মতিক্রমে অধ্যক্ষ নির্বাচিত হলেন। বামফ্রন্টের সদস্যরা বিধানসভা কক্ষের তিন কূল ছাপিয়ে, ক্ষীণাবয়ব জনতা দলগোষ্ঠী, অধিকতর ক্ষীণাবয়ব কংগ্রেস দল। কংগ্রেসের হয়ে বর্ধমান জেলার ভাতার থেকে কোনওক্রমে প্রাক্তন মন্ত্রী ভোলানাথ সেন জিতে এসেছেন। তিনি প্রবেশ করা মাত্র বামফ্রন্টের আসনগুলি থেকে চিৎকৃত উল্লাস: ‘ভোলাবাবা পার করেগা।’ এই সম্ভাষণ ভোলাবাবু অবশ্য খুশি মনেই নিয়েছিলেন সেদিন।

বামফ্রন্টের সেই প্রথম মন্ত্রিসভায় উল্লেখনীয় বেশ কয়েকজন ছিলেন। তবে অন্য শরিক দলের মন্ত্রীদের মধ্যে অনেকেই একটি বিশেষ সমস্যায় ভুগতেন। তাঁরা মনে-মনে জানতেন তাঁদের মন্ত্রিত্ব প্রধানত মার্কসবাদী কমিউনিস্ট দলের দ্রুত প্রভাববিস্তারের ফলে, অথচ তা স্বীকার করতে তাঁদের অস্বাচ্ছন্দ্য। তাঁদের কারও-কারও গলা চুলকে ঝগড়া বাধাবার প্রবণতা, নিজেদের দুর্বলতা ঢাকবার জন্য। কিন্তু অতি অমায়িক ছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লকের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী শম্ভুচরণ ঘোষ, আস্তে-আস্তে কথা বলতেন, স্মিত হাসির সঙ্গে, কোনওদিন আমার সঙ্গে বাচনিক সংঘাত পর্যন্ত ঘটেনি। সমপরিমাণ শ্রদ্ধা পোষণ করে এসেছি স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের ননী ভট্টাচার্য সম্পর্কেও: অনুশীলন দলের প্রাচীন সদস্য, অকৃতদার, পার্টি দফতরেই জীবনযাপন, নিজের পার্টির প্রতি অক্ষয় আনুগত্য, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে চাপা বিক্ষোভ, তবে কোনওদিনই তাঁকে শিষ্টাচারের বাইরে যেতে দেখিনি। অন্য দলের মন্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন আর সি পি আই-র সুধীন কুমার, কফি হাউসে এক সময় একসঙ্গে প্রচুর আড্ডা দিয়েছি, আমার অনেক বন্ধু তাঁরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একদা সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিষ্যত্ব করতেন, অতি শৌখিন মানুষ, সংগীত-সাহিত্য-ক্রীড়াতে প্রবল আগ্রহ, ওঁর সঙ্গে আলাপচারী হয়ে সুখ পাওয়া যেত।

দলের মন্ত্রীদের মধ্যে বিনয়দার উপদেশ-পরামর্শের একাধিক উল্লেখ পরে আমাকে করতেই হবে, ইতিমধ্যে অন্য কয়েকজনের কথা বলি। প্রথমেই বলতে হয় তখনই অতি বৃদ্ধ-নিখাদ ভালোমানুষ প্রভাস রায়ের কথা। চব্বিশ পরগনা অঞ্চলে যাঁরা একদা তিল-তিল করে কমিউনিস্ট পার্টি গড়েছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম, তেভাগা আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ, বহু বছর কংগ্রেসে ছিলেন, প্রাদেশিক কংগ্রেসের দায়িত্বপূর্ণ পদেও, তবে তখন থেকেই মনে-প্রাণে মার্কসবাদী, বাইরে থেকে অথচ বোঝবার উপায় ছিল না। পুরনো আমলের কংগ্রেস নেতা বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর খুব কাছের মানুষ ছিলেন প্রভাসদা; প্রায়ই বলতেন, পোশাকিভাবে যেদিন কংগ্রেস দল ত্যাগ করে প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন, ওঁকে জড়িয়ে ধরে বিপিন গাঙ্গুলী নাকি কেঁদে আক্ষেপ করেছিলেন: ‘ওরে, তোরা যদি সবাই চলে গেলি, আমাকে সঙ্গে নিলি না কেন?’

সবচেয়ে বেশি সৌহার্দ্য ছিল বন ও পর্যটন মন্ত্রী পরিমল মিত্রের সঙ্গে। পার্টির প্রতি আনুগত্য ছাড়া বহির্বিচারে তাঁর সঙ্গে আমার কোনওই মিল ছিল না: তেমন বেশি দূর লেখাপড়া করেননি, স্থূলকায়, মাথায় মস্ত টাক, জলপাইগুড়ি জেলায় বহুদিন ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করেছেন, তাঁর পিতৃদেব বোধহয় জলপাইগুড়িতে রেলের স্টেশন মাস্টার ছিলেন, পরিমলবাবু ছাত্রাবস্থা থেকেই কমিউনিস্ট পার্টিতে, প্রথম জীবনে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন সংগঠন করেছেন। মজা করে বলতেন, সেই পর্বে জ্যোতিবাবু অতিশয় হতকুচ্ছিত বক্তৃতা দিতেন। পরিমলবাবু তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলার তরাই অঞ্চলে চা-শ্রমিক আন্দোলনের দায়িত্বে। সি পি আই এম-এর জন্মের প্রথমাবস্থা থেকেই ওই জেলার সামগ্রিক নেতৃত্বে ছিলেন, সুবোধ সেন ও গোবিন্দ কুণ্ডুর সঙ্গে। তিনজনই অল্পতে চটে যেতেন, কিন্তু তিনজনই নিকষ ভালোমানুষ, পার্টি-অন্ত প্রাণ। তিনজনের কেউই বিয়ে করেননি, পার্টিই সংসার। এখন এঁদের মধ্যে একমাত্র গোবিন্দ কুণ্ডুই আছেন, তা-ও অসুস্থ। পরিমলবাবু স্পষ্ট কথা বলতেন, আমার সঙ্গে তাই সহজে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। মন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্য জুড়ে বৃক্ষরোপণের যে-উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন, তার সুফল এখন পশ্চিম বঙ্গের মানুষ ভোগ করছেন।

বেশ কয়েক বছর রাইটার্স বিল্ডিঙে এটা প্রায় নিত্যনৈমিত্তিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আমি সকাল সাড়ে আটটায় মহাকরণে পৌঁছে দু’ঘণ্টার মধ্যে জমা ফাইল দেখা ও অন্যান্য বকেয়া কাজ সেরে নিতাম, সাড়ে দশটা নাগাদ মন্থর গতিতে হেলে-দুলে দরজা ঠেলে পরিমল মিত্রের প্রবেশ, প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঢুকতেন সত্যব্রত সেন। সপ্তাহে ছ’টা দিন সকাল সাড়ে দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত ত্রয়ী আমাদের নির্ভেজাল আড্ডা, যার সঙ্গে যুক্ত হতো নানা প্রসঙ্গে মতবিনিময়-প্রতিবিনিময়, চা-কফির সামান্য সমাহার।

প্রশান্ত শূরকেও সমান পছন্দ করতাম, সম্পূর্ণ অন্য কারণে। উদ্বাস্তু আন্দোলনে বহু বছর তিনি সময় উজাড় করে দিয়েছেন, সরকারি কর্মচারী আন্দোলনের সঙ্গেও একদা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন, পার্টির প্রতি নিঃশেষ অঙ্গীকার। সারাদিন, সারা রাত ধরে অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন। তাঁর সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা, যে কোনও কাজে একাগ্রতা। তিনিই বোধহয় বামফ্রন্টের একমাত্র মন্ত্রী—পশ্চিম বঙ্গের সমগ্র ইতিহাসেও একমাত্র মন্ত্রী— যিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমাজবিরোধীদের হাতে নির্দয় ভাবে প্রহৃত হয়েছেন, সেই প্রহারের ফলে তাঁর মুখের আদলে ঈষৎ বিকৃতি ঘটেছিল, এখনও পুরো মিলিয়ে যায়নি। পার্টির স্বার্থ প্রসারিত হলেই হলো, নিজের প্রতিষ্ঠার কথা তিনি কোনওদিন ভাবেননি, কর্তব্যপালনে ভয়ভীতিজড়তাদ্বিধাশূন্য। বিশেষ করে যা মনে পড়ে, তিনি নগরোন্নয়নের দায়িত্বে থাকাকালীন আমরা দু’জন একবার দিল্লিতে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করতে যাই, বিদ্যাসাগর সেতুর কাজ কিছুতেই কেন এগোচ্ছে না, তা নিয়ে আলোচনা করতে। রাজ্য থেকে হেঁদিপেঁজি মন্ত্রীরা এসেছে, কাজ কেন এগোচ্ছে না, সে-বিষয়ে কেন্দ্রের বড়ো আমলাদের ওজরের অন্ত নেই, একটা কিছু বলে এই গেঁয়ো মন্ত্রীদের যেন বিদায় দিলেই হলো। হঠাৎ প্রশান্তবাবু মেজাজের বিস্ফোরণ ঘটালেন, সচিবব্যাঘ্ররা মুহূর্তের মধ্যে মিনমিনে বেড়াল বনে গেলেন। তারপর থেকে দ্রুত কাজ এগোলো। যখন বিদ্যাসাগর সেতু সমাপ্ত, সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠান, প্রশান্তবাবু তখন আর সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী নন, ওঁকে একটি নিমন্ত্রণপত্র পাঠাতেও কারও মনে পড়লো না, তবে এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম।

মহম্মদ আমিন বরাবরই মিতবাক, এমন সাচ্চা মানুষ যে-কোনও সমাজে বিরল। উত্তর প্রদেশ থেকে চটকল কর্মী হিশেবে প্রায় কিশোর বয়সে কাঁকিনাড়া অঞ্চলে এসেছিলেন, সারাটা জীবন পার্টির কাজে তারপর থেকে উৎসর্গিত, তাঁর সঙ্গে মহাকরণে কাজ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছি। অপেক্ষাকৃত তরুণ মন্ত্রীদের মধ্যে অবশ্যই ভালো লাগতো আইন মন্ত্রী হাসিম আবদুল হালিমকে, চোখে-মুখে বুদ্ধি ও সৌজন্যের ছাপ।

মূল বৃত্তান্ত থেকে কি দূরে সরে যাচ্ছি? আদৌ না, যে-পরিবেশে রাইটার্স বিল্ডিঙে আট-ন’ বছর কাজ করেছি, তার একটি পূর্বাভাস দেওয়া প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি। তবে আমার তো আরও কিছু কথা বলার আছে মহাকরণে প্রবেশের আদি মুহূর্ত নিয়ে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সমর সেনের সঙ্গে যখন প্রথম দেখা, তিনি সর্বদা অল্প কথার মানুষ, শুধু বললেন, ‘অশোকবাবু, মস্ত ভুল করছেন’। আমি নিরুত্তরই রইলাম। অন্য পক্ষে গৌরকিশোর ঘোষের মতো কয়েকজনের মস্ত উৎসাহ, আতোয়ার রহমানেরও। আতোয়ার কোথায়-কোথায় ঢুঁড়ে নির্বাচনের রেস্ত মেটাবার জন্য প্রচুর টাকা তুলে দিলেন। রবি সেনগুপ্ত, অজিত গুপ্ত এবং ‘পানীয়ন’ আড্ডার পুরো গোষ্ঠী প্রচারে নেমে হিন্দুস্থান পার্ক চষে বেড়ালেন। অরুণকুমার সরকার রাসবিহারী এভিনিউ-র বাসিন্দা, প্রতিবেশীদের অনুরোধে-উপরোধে প্রত্যহ অস্থির করে তুললেন। মজা হলো নরেশ গুহকে নিয়ে। নরেশ সাত্ত্বিক, নৈতিক মানুষ, সত্যেন দত্ত রোডে তাঁর ফ্ল্যাটের ঠিক নিচে ও পাড়ার ভোটকেন্দ্র, নির্বাচনের দিন সকাল থেকে নরেশ দ্বন্দ্বের যন্ত্রণায় বিদীর্ণ, অশোককে তো ভোট না দিলেই নয়, অথচ ব্যক্তিস্বাধীনতায় প্রত্যয়শীল তিনি, কী করে কাস্তে-হাতুড়ি-তারাতে ছাপ দেবেন? ভোট শেষ হওয়ার আধ ঘন্টা আগে অরুণকুমার সরকারই বকে-ঝকে ধাক্কা মেরে নরেশকে বুথের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।

তখন পর্যন্ত অর্থনীতিবিদ মহলে আমার তেমন বেশি দুর্নাম রটেনি। তাঁদের মধ্যে কলকাতাস্থ অনেকে আমাকে সমর্থনের আবেদনপত্রে স্বাক্ষরদান করলেন, এমন একজন-দু’জন যাঁরা আমার নাম শুনলে পরে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন, তাঁরা পর্যন্ত। একমাত্র আমার মাস্টারমশাই অমিয় দাশগুপ্ত বরাবরই সন্দিহান থেকে গেছেন, তাঁর প্রিয় ছাত্র কোথায় পড়াশুনো করবে, তা নয়, বাজে ধান্দায় মিশে গিয়ে নিজেকে নষ্ট করছে। কিন্তু যে যা-ই বলুক, মহামতি মার্কসের বচন তো মিথ্যে হবার নয়, পরিবেশের ছাপ জীবনধারাকে কিছু-না-কিছু মাত্রায় প্রভাবিত করেই। অমিয়বাবুরা নির্বাচনী প্রচারের তুঙ্গ মুহূর্তে এক সপ্তাহ আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে গেলেন। হই রই রই রই, লোক আসছে-যাচ্ছে, টেলিফোন বাজছে, ভিড়, চেঁচামেচি, কথোপকথন, মিছিল, স্লোগান, উত্তেজনায় মাতোয়ারা: শেষের দিকে অমিয়বাবুও যেন একটু-একটু মজা পেতে শুরু করলেন। অরুণ ঘোষ-ডালিয়া ঘোষের দুই কন্যা, অদিতি-জয়তী, প্রথম জন আই এ এস পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে, দ্বিতীয় জন কেমব্রিজে গবেষণারত, তাঁরাও এসে হাজির, যেন বাড়িতে বিয়ে লেগেছে। অদিতি-জয়তীও প্রচারে নামতে বদ্ধপরিকর। গম্ভীরভাবে তাদের জানালাম, তাদের ট্যাঁস-ঘেষা বাংলা উচ্চারণ নিয়ে যদি তারা আমার জন্য প্রচারে বেরোয়, আমার ভোট বাড়বে না, কমবে। ভেবেচিন্তে তাদের চৌরঙ্গী কেন্দ্রে ঠেলে দেওয়া হলো।

নির্বাচনের ফল বেরোবার পরের দিন সকালবেলা, লঘু মুহূর্ত, নায়িকা অদিতি। কেউ নিঃস্বার্থ আনন্দে অভিনন্দন জানাতে, কেউ আগে-ভাগে খোশামোদের রাস্তা সুগম করতে; অজস্র লোকের ভিড়, টেলিফোন বাজার বিরাম নেই, ঘণ্টায় প্রায় একশো ফোন। একটা সময়ে তিতিবিরক্ত হয়ে অদিতিকে বললাম, ‘পরের বার ফোনটা যখন বাজবে, যদি তা তুলে সঙ্গে-সঙ্গে বলতে পারো, দুঃখিত, অশোক মিত্র এইমাত্র মারা গেছেন, সঙ্গে-সঙ্গে তোমাকে প্রতীকী উপঢৌকন হিশেবে দশটা টাকা দেবো’। বাজির অঙ্ক সামান্য, তবে কুছ পরোয়া নেই, অদিতির ভয় কাহারে, দিল্লিস্থ মিরান্ডা হাউসের চালু মেয়ে সে, যে-মুহূর্তে ফোন বেজে উঠলো, কলকাতার এক ডাকসাইটে নাগরিক, ‘ডক্টর মিত্রের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?’ অদিতির ঝটিতি জবাব, ‘না, পারেন না।’ ভদ্রলোকের ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া অবস্থা: ‘পারি না?’ ‘না, পারেন না, কারণ উনি একটু আগে মারা গেছেন।’ ভদ্রলোকের অবস্থা ভ্যাবাচ্যাকাতর, ‘তা হলে এখন কী হবে?’ অদিতি দমবার পাত্রী নয়, ‘কী আর হবে, আমাদের হয়তো এই বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে।’ ফোন যে-মুহূর্তে নামিয়ে রাখা হলো, আমার পকেট থেকে একটি কড়কড়ে নোট অদিতির হাতের মুঠোয়। শুনতে পেয়ে পরে অবশ্য ডালিয়া তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাকে প্রচুর বকেছিলেন।

রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢোকার প্রথম সপ্তাহে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তাঁর বাড়িতে বিশাল নৈশাহারের ব্যবস্থা করলেন। মন্ত্রীরা, পার্টির অনেকে, সবাইকে ছাড়িয়ে যথাবিহিত স্নেহাংশুবাবুর ঠাট্টা-মস্করা, আনন্দের প্রহর উপভোগে টইটম্বুর। আরও অনেক জায়গায় সে-সময় নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হয়েছিল, সবচেয়ে তৃপ্তি পেয়েছিলাম ‘পানীয়ন’ গোষ্ঠীর বন্ধুরা ওই অঞ্চলের বহুপরিচিত প্রবীণ পার্টি-সমর্থক বলবাবুর বাড়িতে যে-আনন্দসন্ধ্যার আয়োজন করেছিলেন, তাতে যোগ দিয়ে। হিন্দুস্থান পার্কের যুবসম্প্রদায়ের অতি প্রিয় ভাইদা-সহ সবাই উপস্থিত, গল্প, আড্ডা, গান, কোলাকুলি, খাওয়াদাওয়া। যাঁরা আমাকে অভিনন্দন জানালেন বিন্দুতম স্বার্থানুসন্ধানের মানসিকতা তাঁদের মধ্যে নেই, বন্ধুর কৃতিত্ব তাঁদেরও কৃতিত্ব, বন্ধুর সাফল্য তাঁদেরই যেন সাফল্য।

সঙ্গে-সঙ্গে ভোট অন অ্যাকাউন্ট নিয়ে ব্যস্ত হতে হলো, হাতে মাত্র কয়েকটা দিন। ভোট অন অ্যাকাউন্টের হিশেব, প্রায় প্রথা দাঁড়িয়ে গেছে সর্বত্র, সামান্য গোঁজামিল দিয়ে, খানিক অনুমানের ভিত্তিতে তৈরি হয়। কোনও নতুন কারিকুরি যোগ করবার সুযোগ তখন আমার ছিল না। তবে রাজপুরুষদের তৈরি মন্ত্রীর ভাষণের খসড়া পাশে সরিয়ে রেখে নিজেই তৈরি করলাম, জ্যোতিবাবুকে একবার দেখিয়ে নিয়ে, উনি খুশি। বিধানসভায় দু’দিনের বিতর্ক হলো, পার-করেগা-ভোলাবাবু আমাকে একটু ঠেসলেন, আমিও তাঁকে নিরাশ করলাম না, জ্যোতিবাবু বলতে উঠে কংগ্রেস দলকে ধুইয়ে দিলেন, তখন বোধহয় তিনি শ্লেষান্বিত ঘৃণা-প্রকাশ শক্তির তুঙ্গে।

অর্থ দফতরের দায়িত্ব, সেই সঙ্গে উন্নয়ন এবং পরিকল্পনা দফতরেরও। ফাউ হিশেবে আমাকে আবগারি বিভাগও দেখতে হতো। অন্য দুই দফতরের কাজ বুঝে নিতে কোনও অসুবিধা হয়নি, কিন্তু আবগারি দফতরের ফাইল চালাচালি করতে গিয়ে আমার ভয়াবহ অবস্থা। ফাইল আসছে, একটার উপর আর একটা ফাইল জড়ো হচ্ছে, খুলে পড়ে আমি হতভম্ব, ছত্রে-ছত্রে আই এম এফ এল এবং এফ এম এফ এল, কী গূঢ় রহস্য এই শব্দসংকেতে জড়িত তা আমার অজানা, ফাইল তাই নড়ে না। সপ্তাহখানেক বাদে এক গোপন কৌশলে মর্মোদ্ধার হলো, আই এম এফ এল হচ্ছে দেশে তৈরি বিলিতি মদ, ইন্ডিয়া-মেইড ফরেন লিকার, অন্য পক্ষে এফ এম এফ এল বিদেশে তৈরি বিদেশী মদ, ফরেন-মেইড ফরেন লিকার। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো আমার।

রাইটার্স বিল্ডিং-এ কাজের পরিবেশ নিয়ে বহু বছর ধরে সাতকাহন লেখা হয়েছে, এখনও লেখা হয়। সবিনয়ে নিবেদন করি, কলকাতার সংবাদপত্রাদির সৌজন্যে করণিকরা কর্মবিমুখ, বহুল-প্রচারিত এই অভিযোগ হয়তো আংশিক সত্য, কিন্তু একমাত্র তাঁরা দায়িত্বজ্ঞানহীন, অন্যরা নন, এই দাবি সত্যিই অসার, উঁচু পদের আমলারাও কিছু কম আয়েসি ছিলেন না অতীতে, এখনও নন।

মন্ত্রীদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, তাঁদের মন্ত্রিগিরি বৃহত্তর রাজনৈতিক দায়িত্বের একটি টুকরো মাত্র। তাঁদের ক্ষেত্রে খানিকটা পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাবের সমস্যাও থাকে। মহাকরণে কম সময় থেকেও ঝটপট অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব, যদি কোনও অনুশীলন পর্বের মধ্য দিয়ে মন্ত্রীরা এসে থাকেন, তা হলে। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলে লাভ নেই, বামফ্রন্টের অধিকাংশ মন্ত্রীরই এ ব্যাপারে খানিকটা অসুবিধা ছিল। তবে পশ্চিম বঙ্গের প্রশাসন থেকে কর্মসংস্কৃতি কিছুটা উধাও হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, আমার বিবেচনায়, ঐতিহাসিক। কংগ্রেস দলের দীর্ঘ রাজত্বে বিধান রায় মহাশয়ের অখণ্ড প্রতাপ, তাঁর সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রীদের ব্যক্তিত্বের দুস্তর তফাত। বাকি মন্ত্রীরা প্রায় সকলেই কেঁচো হয়ে থাকতেন, তাঁদের দফতরের কাজকর্ম বেশির ভাগ সময় বিধানবাবুই দেখতেন, তাঁর বিশ্বস্ত একজন-দু’জন সহচর ও রাজপুরুষদের সঙ্গে নিয়ে। ক্রমশ মন্ত্রীরা কাজ করার অভ্যাসটি ভুলে গেলেন, অধিকাংশ আমলারাও তাই। করণিকদের কাছ থেকে অন্যরকম আশা করা অর্থহীন। সেই বিশেষ ঐতিহ্য, আমার সন্দেহ, এখনও বহমান। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢোকার এক বছর-দু’বছর পরেও দেখেছি কোনও-কোনও বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বড়ো সচিব ধীরে-সুস্থে এগারোটা-সাড়ে এগারোটা নাগাদ দফতরে ঢুকছেন, দেড়টা-পৌনে দুটোয় দ্বিপ্রহরিক আহারের জন্য নির্গত হচ্ছেন, সওয়া তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ প্রত্যাবর্তন করছেন, সাড়ে চারটে বাজতে-না-বাজতে কোনও মিটিং-এর ছুতো করে দিনের মতো দফতর থেকে বিদায় নিচ্ছেন। এঁদের সম্পর্কে খবরের কাগজে আদৌ লেখালেখি হতো না, হয় না, মন্ত্রীদের সম্পর্কে হয়, আর করণিকরা তো সর্বদোষে দুষ্ট!

তা হলেও বলি, দীর্ঘসুত্রিতার এই এলিয়ে-দেওয়া ঐতিহ্যের শিকার হওয়া বামপন্থীদের পক্ষে গ্লানিকর। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বামফ্রন্ট থেকে যদি প্রথম থেকেই কড়া হাতে হাল ধরা হতো, অবস্থার আদ্যন্ত রকমফের তখনই সহজে ঘটানো যেত। ফ্রন্টের পক্ষে অভাবনীয় বিপুল জনসমর্থন, আমলাতন্ত্র ভয়ে কাঁপছে, মাঝখানে দুই দফায় এক বছর-দু’বছর বাদ দিয়ে আটাশ বছরের মৌরসিপাট্টা এবার ভাঙবে, এই আশঙ্কায় রাজপুরুষরা ঘোর উদ্বিগ্ন, তাঁদের প্রাথমিক আচরণে সেই উদ্বেগের ছায়া স্পষ্ট। কিন্তু সুযোগটি বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে ব্যবহার করা হলো না। মন্ত্রীরা প্রায় কংগ্রেসি কায়দায় যাওয়া-আসা শুরু করলেন, আমলারাও দু’দিনের মধ্যে বুঝে নিলেন চিন্তার কারণ নেই, এই মন্ত্রীদেরও বশে আনা যাবে, এবং যেমন করে তিন দশক দিন গেছে তেমনই ভবিষ্যতেও কাটানো যাবে। আমাকে বস্তুনিষ্ঠ হতেই হবে, অধিকাংশ দক্ষিণী আই এ এস অফিসাররা মন দিয়ে এবং পরিশ্রম করে কাজ করতেন, তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ এমনকি বাংলাতেও ফাইলে মন্তব্য লিখতেন। অন্য পক্ষে—সম্মানীয় ব্যতিক্রম নেই তা একেবারেই বলছি না— বাঙালি রাজপুরুষদের অনেকের মধ্যে কাজ ফেলে রাখার প্রবণতা একটু বেশি লক্ষ্য করেছি: ঈষৎ আলস্যপরায়ণ, তার উপর একজন-দু’জন হয় নাস্তিক, নয় সবজান্তা, তাঁদের কাজ শেখাতে গেলেও তাঁরা মনঃসংযোগ করবেন না, অধস্তন কর্মচারীদের গাল পাড়া তো অতি সোজা। ভরসার কথা, একেবারে হালের প্রজন্মের বাঙালি রাজপুরুষদের মধ্যে অন্য ধরনের মানসিকতা চোখে পড়ছে, তাঁরা অনেক বেশি চলবলে।

অন্য একটি বিষয়ও উল্লেখ করতে হয়। একজন-দু’জন শরিকি মন্ত্রীদের মধ্যে যেমন, মুখ্য রাজপুরুষদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন খবরের কাগজে রোজ তাঁদের নাম ছাপা হোক তা পছন্দ করতেন, সাংবাদিকদের হাতে তাঁদের খুশি রাখবার উপকরণ, বিনিময়ে সরকারের গোপন খবর তাঁদের মারফত পাওয়া সহজ। পুলিশের বড়ো আমলাদেরও সেই একই দুর্বলতা। পুলিশের রাম-শ্যাম-যদুও প্রতিদিন সংবাদপত্রে খবরের অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকতেন: বিধানবাবুর আমল থেকেই, কিংবা হয়তো ইংরেজ আমল থেকেই, এই সংস্কৃতির প্রবহমানতা। কবি নন, অধ্যাপক নন, সংস্কৃতিবান কেউই নন, কলকাতার অভিজাতমহল মানেই আমলা ও পুলিস সাহেবরা। ভারতবর্ষের অন্য কোথাও এবংবিধ কলাকৃতি ঠিক চোখে পড়ে না।

যা বলছিলাম, বামফ্রন্টের বিপুল জনসমর্থন, জ্যোতিবাবুর অসামান্য ব্যক্তিত্ব, আমলার দল ত্রাসে-ভয়ে সেই প্রথম এক মাস-দু’মাস কম্পমান, তখন ইচ্ছা করলেই প্রশাসনের চেহারা খোলনল্‌চে পাল্টে দেওয়া সম্ভব হতো, অন্তত আমার তাই তখন ধারণা ছিল, এখনও সেই ধারণা থেকে খুব বেশি সরে আসিনি। অথচ হলো অন্যরকম। বামপন্থী মন্ত্রীরাও বাঁধা- ধরা ছকে ধরা পড়ে গেলেন। একজন সতীর্থ মন্ত্রী, সারা জীবন শ্রমিক আন্দোলন করেছেন, শ্রমের মর্যাদা তো তাঁকে কেউ শেখাতে পারবে না, অথচ একদিন চোখে পড়লো, মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিতে সেই মন্ত্রী করিড়োর দিয়ে এগোচ্ছেন, সঙ্গে বেয়ারার হাতে এক চিলতে ফাইল, তাঁকে বোধহয় বোঝানো হয়েছে নিজের হাতে ফাইল বইলে মন্ত্রীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে বাধ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *