দশ
দ্বিতীয়বার দিল্লি। সব মিলিয়ে এই দফায়ও ছিলাম উনিশ-কুড়ি মাস, অধিকাংশ সময়ই পতৌদি হাউসে। আমার লখনউর বন্ধু অংশু দাশগুপ্ত ইতিমধ্যে বৈদেশিক মন্ত্রকে কাজ নিয়ে দিল্লি চলে এসেছে, তার সঙ্গে ভাগাভাগি করে পতৌদি হাউসে একটি ঘরে। তবে আড্ডা দেওয়ার প্রধান জায়গা পাণ্ডারা রোডে আমাদের বরিষ্ঠ বন্ধু বলবন্ত দাতর-এর ফ্ল্যাটে, নয়তো কনস্টিটিউশন হাউসে। নতুন দিল্লিতে সে এক অদ্ভুত সময়, হাওয়াতে উন্মাদনা, সদ্য স্বাধীন দেশ, আমাদের মতো যুবকদের মনে দেশের দ্রুত আর্থিক উন্নতি নিয়ে অনেক আশার বালুচর গড়া। শাসকদলের কর্তাব্যক্তিরা সবাই উচ্চবিত্ত শ্রেণীভুক্ত, ব্যবসাদার, পুঁজিপতি, জমিদার-জোতদারদের প্রতিনিধি, কিন্তু অন্তত জওহরলাল নেহরু সমাজতন্ত্রের মন্ত্র নামতার মতো করে সকাল-বিকেল উচ্চারণ করছেন, মহা উৎসাহে যোজনা কমিশন গঠন করেছেন, অনেক তরুণ অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকে যোগ দিচ্ছেন। সোভিয়েট দেশের সঙ্গে সম্প্রীতির সম্পর্ক আগে থেকেই তো ছিল, এখন চীনের সঙ্গে সৌভ্রাত্রের ঋতু শুরু হলো বলে অনেকেই ধরে নিয়েছেন। চু এন লী চুয়ান্ন সালের মাঝামাঝি খর গ্রীষ্মে নতুন দিল্লি সফর করে গেলেন, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতির উচ্ছ্বাস-ভরা বাণীর বন্যা। আমার সমবয়সী যাঁরা নতুন দিল্লিতে এসে জড়ো হয়েছিলাম, নিজ-নিজ ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাস যা-ই থাকুক না কেন, সবাই ধরে নিয়েছিলাম দেশটা এবার এগোবে, ভূমি সংস্কার ঘটবে, কৃষি ও শিল্পের দ্রুত বিকাশ প্রায় অপ্রতিরোধ্য, যুগ-যুগ ধরে লাঞ্ছিত-শোষিত-অপমানিত দরিদ্রশ্রেণীর এখন থেকে একটু হিল্লে হবে।
দাতরজীর ফ্ল্যাটে আমরা যারা আড্ডা দিতাম, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সমাগত ভিড়—মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কেরল, অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, পশ্চিম বাংলা এ-সমস্ত রাজ্য থেকে—, বয়সোচিত হুল্লোড় করতাম, ঠাট্টাবিদ্রুপ-অট্টহাসিতে মাতোয়ারা হতাম, বয়োজ্যষ্ঠদের স্বভাবমুদ্রাদোষ নিয়ে অবশ্যই একটু-আধটু বিজ্ঞ বা নাস্তিক মন্তব্যের ঝুড়িঝুড়ি। তবে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর মাত্র ছ’-সাত বছর গত হয়েছে, বিশ্বাসে ভরপুর আমরা, ভারতবর্ষ যে ঝটপট এগিয়ে যাবে তা নিয়ে কারওরই ন্যূনতম সংশয় ছিল না। সে জন্যই হয়তো, আপাততারল্য সত্ত্বেও, কর্তব্যকর্মে ভীষণরকম নিষ্ঠানিমগ্ন ছিলাম; ভারতবর্ষের প্রগতি সমাজতান্ত্রিক পথ ধরে ঘটবে, সরকারের ভূমিকা তাই মস্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেই ভূমিকা পরিপালনে আমাদের অপরিসীম দায়িত্ব। দশটা-পাঁচটা ব্যাকরণে তাই আমরা নিজেদের আবদ্ধ রাখিনি, সকাল-সকাল দপ্তরে চলে যেতাম, আলোচনায়-তর্কে-লেখায়-সভায় প্রহরের পর প্রহর অতিবাহিত হতো, ডেরায় ফিরতাম প্রায় প্রত্যেক দিনই সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের গভীরে পৌঁছুলে। অথবা আদৌ ফিরতাম না, হয় দাতরজীর ওখানে চলে যেতাম দঙ্গল বেঁধে, ওখানেই নৈশাহার, নৈশাহারের সঙ্গে অনবচ্ছিন্ন দেশচর্চা। কোনও-কোনও দিন হয়তো বা কনস্টিটিউশন হাউসে ধাওয়া করা, আমাদের মধ্যে কেউ সেখানে ঘর পেয়েছে, তা ছাড়া আরও বিভিন্ন স্তরের অনেক সরকারি কর্মচারী, যাঁরা ওই মুহূর্তে বাংলো কিংবা ফ্ল্যাট পাননি, তাঁরা অবস্থান করছেন, বেশ-কিছু সংসদ সদস্যও সেই সঙ্গে। সুতরাং নতুন-নতুন আলাপ-পরিচয়ের অধ্যায়, দেশের নানা সমস্যা নিয়ে গাঢ় থেকে গাঢ়তর মত বিনিময়-প্রতিবিনিময়, পাশাপাশি যথারীতি হুল্লোড়-আড্ডা। জাতীয় সংহতিতে সেই মুহূর্তে নিশ্চয়ই গভীর আস্থা রাখতাম, ওরকম আস্তিক সময় জীবনে আর আসেনি।
দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে আমার সমবয়সি কিংবা বয়সে সামান্য-একটু বড়ো তীক্ষ্ণবুদ্ধি অর্থনীতিবিদদের ভিড়, তদ্রপ ভিড় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকে। তখনও দিল্লি-নতুন দিল্লি মিলিয়ে জনসংখ্যা তেমন ভয়ংকর আকার ধারণ করেনি। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঈষৎ ভৌগোলিক দূরত্ব সত্ত্বেও, আমাদের মেলামেশায় আদৌ অসুবিধা হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রকে যারা ছিলাম, সপ্তাহে অন্তত একদিন দিল্লি স্কুলে যেতাম, দিল্লি স্কুলে যাঁরা ছিলেন তাঁরাও আমাদের সামীপ্যে চলে আসতেন। প্রায় সবাই-ই এদেশের-ওদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাটকা গবেষণা সেরে জড়ো হয়েছি; ধনবিজ্ঞান পৃথিবীকে, এবং আমাদের দেশের চেহারাকে, আমূল পাল্টে দিতে পারে, সেই বিশ্বাস মনের গহনে প্রোথিত।
অথচ সামান্য একটু প্রতিযোগিতার পরিবেশও ছিল। যেমন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা শ্ৰীযুক্ত আঞ্জারিয়া, যুগপৎ অর্থমন্ত্রক ও যোজনা কমিশনে পরামর্শদাতা, তাঁর সহকর্মী আমরা প্রায় সবাই-ই অর্থমন্ত্রকে। অন্যদিকে যোজনা পরিষদে ইতিমধ্যেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রধান সংখ্যাতাত্ত্বিক পরামর্শদাতা হিশেবে যোগ দিয়েছেন। খানিক বাদে তিনি পরিষদের খোদ সদস্যও মনোনীত হলেন, যার মানে মন্ত্রী পর্যায়ে স্থিত হলেন। এমনিতেই তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, তার উপর প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে অতি নিবিড় সম্পর্ক। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা তথা অবিসংবাদী প্রধান পুরুষ, তিনি ইনস্টিটিউটের একটি শাখা খুললেন নতুন দিল্লিতে। তরুণ অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনাবিদদের ঢালাও জড়ো করলেন কলকাতা ও নতুন দিল্লির দুই শাখায়, পরিকল্পনার রূপরেখা নিয়ে প্রধান মন্ত্রীকে প্রায় প্রত্যহ শরবর্ষণ। আঞ্জারিয়া কিছুদিনের মধ্যেই একপাশে পড়ে রইলেন। তাঁর মাথার উপর তখন অর্থমন্ত্রী চিন্তামন দেশমুখ, ব্রিটিশ আমলের সিভিলিয়ান, সব বিষয়েই যথেষ্ট রক্ষণশীল, মহলানবিশ যতই এগিয়ে যেতে চাইছেন, দেশমুখের ততই রাশ ধরবার প্রয়াস। আঞ্জারিয়াকে প্রধানত অর্থ মন্ত্রীর বচন-উপদেশই শুনতে হতো, পরিকল্পনা পরিষদেও তিনি অর্থমন্ত্রকের মতামতই জ্ঞাপন করতেন, তদুপরি তিনি লণ্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে পাশ-করা ধনবিজ্ঞানী; ব্রিটিশ ঐতিহ্যে ধীরে-চলা নীতি মজ্জাগত, তা-ও আঞ্জারিয়ার মানসিক গঠনকে অনেকটা প্রভাবিত করেছিল। তবে, তাঁর রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও, ভদ্রলোক অতি চমৎকার মানুষ, তাঁর স্ত্রীও অতি করুণাবতী। আমরা যাঁরা আঞ্জারিয়ার সঙ্গে কাজ করতাম, তাঁর ঘরের মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। তবু মহলানবিশ তাঁর উদ্ধত সাহসিকতা দিয়ে আমাদের অন্যদিকে টানলেন।
দুশো বছর ধরে বিদেশীদের দ্বারা শোষিত হয়েছি, কৃষিতে-শিল্পে-বাণিজ্যে আমাদের কোনওভাবে উন্নত হতে দেওয়া হয়নি, অথচ দেশে খনিজ-বনজ-জলজ সম্পদের অভাব নেই। একটা হিশেব অনুযায়ী, মার্কিন দেশের পর ভারতবর্ষেই বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, আমরা কেন তা হলে স্বনির্ভরতার ভিত্তিতে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবো না? প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, যা দিল্লিতে আমার হাজির হওয়ার আগেই আঞ্জারিয়া মশাই আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে রচনা করেছিলেন, তাতে আর্থিক বিকাশের হার বড্ড ঢিমে তাল, ওই হারে এগোলে আমরা যুগযুগান্ত ধরে পিছিয়েই থাকবো। আমাদের যা চমৎকৃত করলো, অধ্যাপক মহলানবিশ সসাভিয়েট রাষ্ট্রে গিয়ে গসপ্ল্যান-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশদ আলোচনা সেরে এসেছেন, তাঁদের ধাঁচে একটি স্বয়ম্ভর অর্থব্যবস্থার গাণিতিক মডেল দাঁড় করিয়েছেন, যার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে আমরা মুগ্ধ। অন্য একটি ব্যাপারও ছিল, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সম্মান তখন তুঙ্গে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে কৃষ্ণ মেনন বক্তৃতা দিয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছেন। ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোজে শান্তি স্থাপনে ভারতীয় কূটনীতিকদের অগ্রণী ভূমিকা গোটা পৃথিবী মেনে নিয়েছে। সন্নিকট সময়ে বাণ্ডুঙে আফ্রো-এশীয় সম্মেলন, চু এন লী-টিটো-নাসের-এর সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর সমপর্যায় স্তবস্তুতি, জাতীয় আত্মবিশ্বাস শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছুনো। এই অবস্থায় সাহসী পরিকল্পনার সপক্ষে জনসমর্থন এবং বিজ্ঞজনসমর্থন দুই-ই স্বতঃসিদ্ধ বলে বিবেচিত হলো, রক্ষণশীলরা পিছু হটলেন। প্রধানত অধ্যাপক মহলানবিশের অনুপ্রেরণায় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাঠামো রচনা, তাতে বহির্বাণিজ্যের প্রসঙ্গ তুচ্ছাতিতুচ্ছ, স্বয়ম্ভর অর্থব্যবস্থাভিত্তিক মডেলের সূত্র ধরে বিভিন্ন আর্থিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ, গড় বৃদ্ধির হার ও গড় কর্মসংস্থানের হার নিরূপণ। যোজনা পরিষদের মঞ্জুরী পাওয়ার পর দেশের একুশ জন গণ্যমান্য অর্থনীতিবিদ্দের কাছে সেই খসড়া পেশ করা হলো। আমাদের দেশের ধনবিজ্ঞানীরা বড়ো বেশি সরকারের কাঁধ-শোঁকা, সরকার যদি বলে জল উঁচু, তাঁরাও বলেন জল উঁচু, সরকার যদি বলে জল নিচু, ওঁরাও বলেন জল নিচু। সুতরাং এই সাক্ষীগোপাল অর্থনীতিবিদ্দের দ্বারা স্বয়ংভর অর্থব্যবস্থার রূপরেখা অনুমোদন করিয়ে নিতে কোনও বেগই পেতে হলো না।
হঠাৎ সারা দেশ পরিকল্পনা নিয়ে বাঙ্ময়, যোজনা পরিষদ থেকে অনুদান পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে-কলেজে-স্কুলে উত্তম-মধ্যম-অধম ব্যক্তিবর্গ দ্বারা পরিকল্পনা সংক্রান্ত গবেষণা-রচনাদি লেখা শুরু হলো।
গভীর তৃপ্তির দিন ছিল দিল্লিতে সেই কয়েক মাস, গভীর আনন্দের দিন। সমবয়সী বন্ধুবান্ধব, দাতরজীর ফ্ল্যাটে জড়ো হওয়া সুহৃদসম্প্রদায়, সেই সঙ্গে আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে সাযুজ্যসম্পন্ন অজিত দাশগুপ্ত, মোহিত সেন প্রমুখ বন্ধুরা। সবাই মিলে বড়ে গোলাম আলির গান শুনতে যেতাম, কিংবা সদ্য-উদিত রবিশঙ্করের সেতার বা আলি আকবরের সরোদ, অথবা বালাসরস্বতীর নৃত্য। কিংবা ‘বহুরূপী’-র রোমাঞ্চ-জাগানো ‘রক্তকরবী’ স হাউসের মঞ্চে। পূর্ব ইওরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে আমাদের তখন প্রচণ্ড মাখামাখি, সে-সব দেশ অথবা চীন থেকে প্রায়ই ব্যালে অপেরা দলের আগমন ঘটততা, দিনের বেলা অর্থনীতির চর্চায় আবদ্ধ, তবে সন্ধ্যা হলেই দল বেঁধে এ-সমস্ত অনুষ্ঠানে জমাট হওয়া। সে-সব বন্ধুদের অনেকে এখনও আছেন, অনেকে বিগত, যাঁরা আছেন তাঁরাও নানাদিকে ছড়িয়ে, নানা দেশে, নানা শহরে তাঁদের জীবনের গতি ও প্রকৃতি বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে, মনের গড়নও অনেকের বদলে গেছে হয়তো। দাতরজী কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন, তাঁকে বাদ দিলে যাঁদের কথা বারবার মনে পড়ে, তাঁদের মধ্যে অবশ্য উল্লেখনীয় ইন্দ্রপ্রসাদ (আই.জি.) প্যাটেল, কাক্কড় নন্দনাথ রাজ, কাদুর শামান্না কৃষ্ণস্বামী, হিতেন ভায়া ও তাঁর স্ত্রী অ্যাঞ্জেলা, অরুণ ঘোষ ও তাঁর পত্নী হাটখোলার দত্তদুহিতা ডালিয়া, রামদাস হোনাভার ও তাঁর একদা-ব্যাডমিন্টনে-পটীয়সী স্ত্রী চন্দ্রা উল্লাল, ধর্মা কুমার ও তাঁর স্বামী লবরাজ কুমার, মুরলী ও উমা রাও, লতিকা ও চঞ্চল সরকার, নীলাঞ্জনা ও সুভাষ ধর, মোহিত সেন ও বনজা আয়েঙ্গার। এঁদের মধ্যে কেউ-কেউ বেসরকারি দফতরে কর্মরত ছিলেন, আর মোহিত তো কমিউনিস্ট পার্টিতে সর্বক্ষণের কর্মী।
ঘোর-লাগা সময়, আমরা বন্ধুরা সৌরমণ্ডলের নিয়ামক, পরস্পরে জড়িয়ে আছি, আমরাই সৃষ্টি-প্রলয় উপভোগ-অনুভবের মধ্যবিন্দুতে, অন্য সব-কিছু অবান্তর, প্রক্ষিপ্ত। এই অহংবোধ এক সায়ংসমাবেশে প্রচণ্ড ধাক্কা খেল। আঞ্জারিয়া তাঁর বাড়িতে কোনও ছুটির দিনে আমাদের সবাইকে নৈশাহারে ডেকেছিলেন। হুল্লোড়, চিৎকার, মস্করা, হাসি-ঠাট্টা, রাত গভীরের দিকে, পল্লী কাঁপিয়ে আমাদের যুথবদ্ধ আত্মরতিবিলাস। হঠাৎ খেয়াল হলো আঞ্জারিয়ার অশীতিপর বৃদ্ধ পিতৃদেব ঘরের এক কোণে চুপচাপ বসে আছেন। কাছে গিয়ে একটি-দু’টি সৌজন্যসূচক কথা ওঁর সঙ্গে বলা ন্যূনতম কর্তব্য বলে মনে হলো। চমৎকার মানুষ, আলাপ জমলো। ভদ্রলোক সহসা আমার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘ইয়ং ম্যান। আমার একটা উপদেশ শোনো, আমার মতো বেশি বয়স পর্যন্ত বেঁচে থেকো না। বার্ধক্যের চেয়ে বড়ো অভিশাপ নেই।’ বিনয়ে গলে গিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে আমার উক্তি: ‘কেন এ কথা বলছেন? এই তো আপনি আমাদের মধ্যে আছেন, আমাদের কত আনন্দ হচ্ছে।’‘—ইয়ং ম্যান, তা হলে শোনো। আজ তো ছুটির দিন ছিল, ভোরবেলা আমার ছেলে তার স্ত্রীকে নিয়ে কোনও সভায় গিয়েছিল, আমার নাতিও বাবা-মা’র সঙ্গে গেল। বেলা এগারোটা নাগাদ সাইকেলে চেপে এক ছোকরা এসে বেল বাজালো। “সাব হ্যায়?” বললাম বাড়ি নেই। “মেমসাব যায়?” না, মেমসাবও নেই। “বাবা হ্যায়?” না, বাবাও নেই। ছোকরাটির কাতর আর্তনাদের মতো প্রশ্ন, “কোই ভি নেহি হ্যায়?” এই যে আমি জলজ্যান্ত ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমি কেউ না। তাই বলছি, ইয়ং ম্যান, বেশি বয়স পর্যন্ত বাঁচতে নেই।’
তবে আমরা তখন মধ্যযৌবনের গর্বিত কেন্দ্রে এ ধরনের হঠাৎ-থমকে-যাওয়ার অবকাশ বা বিনয় বা ধৈর্য তেমন ছিল না।
আমার দিল্লি পৌঁছুবার কয়েক মাসের মধ্যে অংশু ভিয়েতনাম চলে গেল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শান্তিসালিশি সংক্রান্ত কাজে, পতৌদি হাউসের ঘরটি আমার পুরোপুরি দখলে এলো। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থায় একটু অসুবিধা দেখা দিচ্ছিল, কিন্তু তখন থেকেই তো সব মুশকিলের অবসানকর্তা অরুণ ঘোষের অভিভাবকত্বে আমার জীবনধারণ। অমন প্রাণোচ্ছল স্বভাবপরোপকারী মানুষ গণ্ডায়-গণ্ডায় জন্মগ্রহণ করেন না। স্নেহের ফরমান হলো, পতৌদি হাউসের মূল দালানে ওঁদের ফ্ল্যাট, ওখানে গিয়ে প্রতিদিন আমাকে অনুগ্রহণ করতে হবে, আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা সেই হুকুম অগ্রাহ্য করি।
নতুন করে সামান্য সমস্যা দেখা দিল যখন ডালিয়া ও অরুণ ঘোষ কিছুদিনের জন্য ফ্ল্যাট বন্ধ করে ব্যাংকক চলে গেলেন। তবে ওই বয়সের যুবকদের পরিত্রাতা-ত্রাত্রী স্বতই জুটে যায়। ঠিক উল্টোদিকে থাকতেন সুভাষচন্দ্র বসুর ভ্রাতুষ্পুত্রী শীলা ও তাঁর ছোটো ভাই প্রদীপ, সুভাষচন্দ্রের মধ্যম অগ্রজ সুরেশচন্দ্র বসুর সন্তান। শীলা কোনও সরকারি দপ্তরে কাজ করতেন, যা ছিল আমার দপ্তরের লাগোয়া: পুরনো জঙ্গি ব্যারাক, রাষ্ট্রপতি ভবন ও নর্থ ব্লকের প্রায় গা ঘেঁষে, বলা হতো পি-ব্লক। সেই ঘরগুলির এখন আর অস্তিত্ব নেই, সেখানে সংসদ-সদস্যদের জন্য গাড়ি রাখার ব্যবস্থা হয়েছে।
শীলা বুঝতে পারছিলেন, আমার ভোজনং যত্রতত্রং সমস্যা, একদিন ফতোয়া জারি করলেন, এখন থেকে ওঁদের সঙ্গে আমাকে খেতে হবে। সেই আদেশ পালন করতে আমার কোনও অসুবিধাই হয়নি, এবং ওই কয়েক মাস প্রচুর আরামে ছিলাম। শীলা গল্প-পরচর্চায় চৌখশ ছিলেন, বিশেষ করে নিজেদের পরিবার নিয়ে কেচ্ছাবিবরণে। প্রদীপ তখন থেকেই রাজনৈতিক তত্ত্বাদি নিয়ে যুগপৎ আগ্রহী ও মনোেযোগী, সব দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে বেড়াতেন, পরে বেশ কিছুদিন ভিয়েনাতে সোস্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ওখানেই কর্মরতা এক ইংরেজ মহিলার সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। এখন দিল্লিতে, যদিও বহুদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। শীলাও ইতিমধ্যে পদবী বদলেছেন, সংসার রচনা করেছেন, তিনিও দিল্লিতে।
দুটো কথা যোগ করার তাগিদ অনুভব করছি। প্রথম, আমি ক্ষীণাহারী মানুষ, শীলা আহারান্তে প্রায়ই অনুযোগ করতেন, ‘আপনাকে খাইয়ে সুখ নেই’। দ্বিতীয় যে-কথা উল্লেখ করতে হয়, শীলা বাংলার বিখ্যাততম রাজনৈতিক পরিবারের দুহিতা, কিন্তু পুরোপুরি নাক-সিঁটকোনো ভাববর্জিত। ভদ্রমহিলা ওই মাসগুলিতে আমাকে অনেক কাহিনী শুনিয়েছিলেন, একটি তাঁর এক নিকটাত্মীয়াকে নিয়ে, তা এখনও মনে গেঁথে আছে। ওই আত্মীয়ার প্রসঙ্গ উঠতে শীলার অতি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য: ‘ওর তো বিয়ে হবে না।’ তারপর একটু থেমে তাঁর সংযোজন, ‘মাত্র বাইশ গজ পর্যন্ত পৌঁছুনো গেছে, তাতে কী আর বিয়ে হয়’। হেঁয়ালি বুঝতে পারলাম না, আমার দিক থেকে প্রশ্নবোধক চিহ্ণ, এবার শীলার উচ্ছাসে ভেঙে পড়ার পালা: ‘তবে শুনুন, ওর (অর্থাৎ আত্মীয়াটির) ধনুর্ভঙ্গপণ, যে-বাড়িতে বিয়ে করবে তার দেউড়ি থেকে দরদালান কমপক্ষে যেন একশো তিপ্পান্ন গজ দূরবর্তী হয়; গত পাঁচ বছরের চেষ্টায় সবচেয়ে খাশা যে-বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে তার দেউড়ি-দরদালানের মধ্যে দূরত্ব মাত্র বাইশ গজ, সুতরাং ওর বিবাহ-সম্ভাবনা দূর অস্ত্’।
পতৌদি হাউসের অনতিদূরে ফিরোজশাহ রোডে সংসদ-সদস্যদের জন্য নির্ধারিত কুঠুরিতে ভূপেশ গুপ্ত থাকতেন, তাঁর বাসগৃহের কমিউনে অজিত দাশগুপ্ত ও তাঁর সদ্য-পরিণীতা স্ত্রী শিপ্রা, আর থাকতেন দ্বিজেন নন্দী, যিনি ভারত-চীন মৈত্রী সঙ্ঘের সম্পাদক হিশেবে একদা বিখ্যাত ছিলেন, পরে বিখ্যাততর হয়েছিলেন অন্য-একটি কারণে যা যথাস্থানে উল্লেখিত হবে। (দ্বিজেন নন্দী শেষের দিকে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন, এতটাই যে ‘পরিচয়’ পত্রিকার স্বত্ত্বাধিকারীদের মধ্যে যাঁদের মূলধন ন্যূনতম এক শতাংশ, নিয়মমোতাবেক তাঁদের তালিকা বছরে একবার প্রকাশ করতে হয়, গত বছর দশেক তিনি সেখানে ‘প্রয়াত’ বলে চিহ্নিত হয়ে এসেছেন, যদিও ভদ্রলোক মারা গেছেন অতি হালে, বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে।) আরও থাকতেন হুগলি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য তুষার চট্টোপাধ্যায়, নির্ভেজাল ভালো মানুষ, আদর্শে স্থির, স্বভাববিনয়ে মুগ্ধ করতেন সবাইকে। বেশ কিছুদিন হলো তিনিও প্রয়াত।
কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ আরও গভীর হয়ে উঠলো। ভূপেশবাবুর আগ্রহে এবং মোহিত ও অজিতের উৎসাহে মাসিক ও সাপ্তাহিক নিউ এজ-এ অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আমার লেখা শুরু হলো। সরকারি কাজ করছি, কমিউনিস্ট পত্রিকায় স্বনামে লেখায় অনেক সমস্যা, ভূপেশবাবু আমার জন্য একটি ছদ্মনাম বাছাই করে দিলেন: চারণ গুপ্ত। সেই নামে আমি এক যুগ বাদে ‘নাউ’ ও ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকায় দেদার লিখেছি।
ভূপেশবাবুর কমিউন সব অর্থে কমিউনিস্ট ধর্মশালা, কলকাতা ও অন্যত্র থেকে নেতা ও কর্মীরা আসছেন-যাচ্ছেন, ওখানেই অজয় ঘোষ, ই এম এস নাম্বুদিরিপদ ও অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ, যদিও জ্যোতি বসু-প্রমোদ দাশগুপ্তের সঙ্গে না। কলকাতা থেকে কখনও বিদেশগামী কোনও প্রতিনিধিদল দিল্লিতে এসে ওই কমিউনে উঠতেন, একবার চীনযাত্রী কোনও প্রতিনিধি গোষ্ঠীতে জর্জ বিশ্বাস ছিলেন, আমাদের এন্তার গান শুনিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গান থেকে শুরু করে গণনাট্যের গান পর্যন্ত। মেজাজে থাকলে জর্জ বিশ্বাসের, প্রতিবারই লক্ষ করেছি, উৎসাহে ভাটা পড়তো না, গানের প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে যেতেন। তবে খেয়ালি মানুষ, অভিমানী মানুষ, আত্মসম্মানবোধ তীব্র, অন্যমনস্কতাহেতুও কারও তাঁর প্রতি দৃষ্টিক্ষেপে সামান্যতম ঘাটতি ঘটলেই তিনি রেগে কাঁই, অবশ্য শান্ত হতেও সময় নিতেন না। চু এন লী-র সঙ্গে চীনে তাঁর ভালো আলাপ হয়েছিল, তাঁকে চীনের প্রধানমন্ত্রী বিশেষ পছন্দ করতেন, জর্জ বিশ্বাস বারবার একথা জানাতেন। আরও জানাতেন, একবার নাকি চু এন লী কলকাতা সফরে এসেছেন, নাগরিক অভ্যর্থনা, তিনি মঞ্চে উপবিষ্ট, জর্জ বিশ্বাস শ্রোতৃমণ্ডলের মধ্যে মাঝামাঝি সারিতে, হঠাৎ চু এন লী-র নজর পড়লো, মঞ্চ থেকে সোজা নেমে এসে জর্জ বিশ্বাসকে জড়িয়ে ধরলেন: ‘সিঙ্গার, তুমি এখানে!’ দেবব্রত বিশ্বাসের উত্তর: ‘মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, এটাই আমার শহর।’ কোথায় কার দুর্বলতা থাকে, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। জর্জ বিশ্বাস লজের মতো প্রতিবার কাহিনীটি বিবৃত করতেন।
কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিলেন ই এম এস। বরাবরই তাঁর কথায় জড়তা, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, বুদ্ধির দীপ্তি, চিন্তার প্রাথর্য, আদর্শের গভীরতা, সব দিক দিয়েই তিনি আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন। অথচ তাঁর রসবোধও সমান অসামান্য, তাঁর ব্যঙ্গোক্তির প্লাবনে প্রায়ই আমরা হেসে কুটোপাটি হতাম। ই এম এস-এর রসিকতাবোধের একটি অতি সামান্য উদাহরণ মনে পড়ছে। ১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাস, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জিতে কমিউনিস্ট পার্টি কেরলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম, কাতারে-কাতারে দেশ-বিদেশ থেকে সাংবাদিকরা নতুন দিল্লি-তিরুবনন্তপুরমে জড়ো হয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী নাম্বদিরিপদকে চাক্ষুষ দেখতে, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। নতুন দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক চলছে, এক বিদেশী সাংবাদিক উঠে দাঁড়িয়ে ই এম এস-কে প্রায়-নির্বোধ প্রশ্ন ছুঁড়লেন: ‘মহাশয়, আপনার বাক্-জড়তা লক্ষ্য করছি, আপনি কি সব সময়ই তোতলান?’ ই এম এস-এর সহাস্য ক্ষিপ্র জবাব: ‘আজ্ঞে না। আমি তোতলাই একমাত্র যখন কথা বলি।’ আরও যা যোগ করতে চাই, তাঁর চেয়ে অধিকতর গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব কমই দেখেছি: বয়সে প্রায় কুড়ি বছরের বড়ো, কিন্তু আলাপ-আলোচনা-তর্ক করতেন সমবয়সী বন্ধুর মতো, আমাদের মতামতকে প্রভূত সম্মান জানিয়ে।
কমিউনিস্ট আন্দোলন গোটা দেশে তখন প্রচণ্ড আশার মগডালে। রণদিভে সাধারণ সম্পাদক থাকবার সময় দেশ জুড়ে যে-সশস্ত্র বিদ্রোহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা অবশ্য অসফল, ততদিনে নির্বাপিত। তা হলেও তার পরবর্তী কয়েক বছর কমিউনিস্ট পার্টির সম্মান ও সম্ভ্রম তুঙ্গেই থেকে গেছে। জাতীয় কংগ্রেসের পর দেশে কমিউনিস্ট পার্টি অবিসংবাদী দ্বিতীয় দল, লোকসভায় গোপালন, দাঙ্গে, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়রা তাঁদের স্বদেশপ্রেম, লোকপ্রেম, আন্তরিকতা ও বচনবৈদগ্ধ্যে সকলের দৃষ্টি কাড়ছেন, রাজ্যসভায় ভূপেশ গুপ্তরও সমান দাপাদাপি। লোকসভায় জওহরলাল নেহরু কমিউনিস্ট নেতাদের প্রতি খানিকটা অনুকম্পায়ী, রাজ্যসভার সভাপতি রাধাকৃষ্ণন অনুরূপ প্রশ্রয়দাতা। তা ছাড়া ভারত-সোভিয়েট মৈত্রী উচ্চারণের পাশাপাশি হিন্দি-চীন ভাই-ভাইয়েরও মরশুম সেটা। তেলেঙ্গানার সংগ্রাম কোনও অর্থেই বিফলে যায়নি, প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তেলেঙ্গানা অঞ্চল থেকে কমিউনিস্ট প্রার্থীরা বহু সংখ্যায় নির্বাচিত হয়েছেন, কেউ-কেউ প্রদত্ত ভোটের এমনকি শতকরা নব্বই ভাগ পেয়ে। পশ্চিম বাংলায় তেভাগা আন্দোলন গ্রামাঞ্চলে তার অম্লান সাক্ষ্য রেখে গেছে, কৃষক সভার শক্তি ক্রমশ দ্রুত বাড়ছে প্রতিটি জেলায়। এটাও না মেনে উপায় নেই, উনবিংশ শতকের রামমোহন-মাইকেল-বঙ্কিম-বিদ্যাসাগর-কেশবচন্দ্র-কেন্দ্রিক প্রথম বাঙালি উজ্জীবনের ষাট-সত্তর বছর পর, কমিউনিস্ট পার্টির অনুপ্রেরণায়, বিংশ শতাব্দীর মধ্যঋতুতে, চমকে দেওয়ার মতো দ্বিতীয় বাঙালি উজ্জীবন, গানে, কবিতায়, নাট্যে, সাহিত্যে, শিল্পে, স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পর্বে তারাশঙ্কর কমিউনিস্টদের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে গেছেন, কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পার্টিতে যোগদান সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘পরিচয়’ পত্রিকা তাঁর কমিউনিস্ট একদা-সখাদের হাতে অর্পণ করে নিজের নাস্তিকতা নিয়ে অপসৃত হয়েছেন, তবে রবীন্দ্রনাথকে ধুইয়ে দেওয়ার অসহিষ্ণু একাগ্রতা-জড়ানো ‘পরিচয়’-এর বালখিল্যতার ঋতুও উত্তীর্ণ; সবচেয়ে প্রতিভাবান নবীন লেখক সমরেশ বসু, তখনও পর্যন্ত পার্টির প্রতি আনুগত্যে অটুট। ‘পরিচয়’-এর পাশাপাশি ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকাও কয়েক বছর বামপন্থী সাহিত্য আন্দোলনকে উচ্চকিত করে রাখলো। এবং এখানেই তো শেষ নয়। একদিকে গণনাট্য সঙ্ঘ-শম্ভু মিত্র-বিজন ভট্টাচার্য-উৎপল দত্তদের উদ্দাম সৃষ্টির বন্যা, অন্যদিকে নিমাই ঘোষ, ঋত্বিক ঘটক, খানিক বাদে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, এঁদের সবাইকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্রে সামাজিক বাস্তবতার অপ্রচ্ছন্ন প্রকাশ, পাশাপাশি লোকসংস্কৃতির উৎসসন্ধানে নিরন্তর অধ্যবসায়, সেই সঙ্গে জর্জ বিশ্বাস-সুচিত্রা মিত্রদের দ্বারা রবীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতনের সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠ থেকে বাইরে টেনে এনে বাংলার গ্রাম-শহরময় আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া, তাপস সেনের আলো নিয়ে পরীক্ষা, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘নবজীবনের গান’-‘মধুবংশীর গলি’, ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে সুনীল জানার বাংলার পল্লীতে-অরণ্যে খাঁটি নারী-পুরুষের অন্বেষণ, খালেদ চৌধুরীর মঞ্চসজ্জা, এক দঙ্গল নবীন শিল্পীর ছবি আঁকায়-পাথর খোদাইয়ে মেতে ওঠা। এঁরা সবাই-ই, হয় প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে নয় তো তির্যক প্রেরণার ছোঁওয়ায়, কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বারা কম বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। সামান্য উৎক্ষিপ্ত মনে হলেও মন্তব্য করতে ইচ্ছা হয়, কাকতালীয় হোক না হোক, ঠিক সেই ঋতুতেই দিলীপ গুপ্ত বাংলার প্রকাশন ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। ভুলেই যাচ্ছিলাম বলতে, গণনাট্য সঙঘ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে সেতার-সাধনায়-নিমগ্ন রবিশঙ্কর পরাকাষ্ঠার পর উচ্চতর পরাকাষ্ঠার শীর্ষে নিজেকে তখন উত্তীর্ণ করছিলেন, এমনকি, লোকপ্রবাদ যাই-ই হোক না কেন, উদয়শঙ্করও ফুরিয়ে যাননি, কয়েক বছর আগে চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর আশ্চর্য নিরীক্ষা ‘কল্পনা’-র পর ছায়ানৃত্যের আঙ্গিক নিখুত করতে তিনি ব্যস্ত।
অথচ, এই মস্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পটভূমিতেই, দেশভাগের তমিস্রা, পূর্ববঙ্গ থেকে লক্ষ-লক্ষ উদ্বাস্তুর শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে, তা ছাপিয়ে কলকাতার নানা উপকণ্ঠে, তা-ও ছাপিয়ে বিভিন্ন জেলায়, তাঁদের বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়া। উদ্বাস্তুদের সঞ্চিত অভিমান, অপমান ও নিঃস্বতাবোধের জ্বালা থেকে সারা রাজ্য জুড়ে আগুন জ্বলতে পারতো, কিন্তু এখানেও কমিউনিস্ট পার্টির প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব অসাধ্য সাধন করলেন, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের হলাহল থেকে উদ্ধার করে শরণার্থীদের কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীরা জনগণের আন্দোলনের প্রাঙ্গণে নিয়ে এলেন: ছাত্রদের, যুবাদের, মহিলাদের, সরকারি-সদাগরি কর্মীদের, ভূমিহীন কৃষক-ভাগচাষীদের, কারখানার শ্রমিকদের, ব্যাপ্ত-বিশাল-গভীরতর-হতে-থাকা জনচেতনার অবয়বে লীন হয়ে গেল উদ্বাস্তুদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। ভোটের নিরিখে পঞ্চাশের দশকে পশ্চিম বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি তখনও ঠিক সাবালক অবস্থায় পৌঁছয়নি, কিন্তু সূচনার নান্দীমুখ অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে।
দিনের বেলা নতুন দিল্লিতে অর্থমন্ত্রক কিংবা পরিকল্পনা কমিশনে আড্ডা দিই, তর্ক জুড়ি, ঘুরে বেড়াই। সকাল-বিকেল কখনও নিখাদ বাঙালি আচ্ছা, কখনও কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী-সখাদের সাহচর্যে প্রহরযাপন। মাঝে-মাঝে ছুতো পেলেই কলকাতা ঘুরে যাই। দাতরজীর বাড়ির মশগুল মজলিসে আরও ঘন হয়ে আসি৷ যাদের প্রসঙ্গে বিশেষ করে বলতে চাই তাদের সর্বাগ্রে হিতেন ভায়া ও তাঁদের সর্বাগ্রে গোয়া-জাতা স্ত্রী অ্যাঞ্জেলা। আঞ্জুর গোয়ার পূর্বসূরিত্ব প্রায় লুপ্ত; বাঙালি সামাজিকতা, বাঙালি গৃহবধুর দায়িত্বের সঙ্গে সে নিজেকে আশ্চর্য মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তা বলে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি, যার সঙ্গে মিশ্রিত একটি চিমটি-কাটা কৌতুকপ্রিয়তা, আদৌ অনুচ্চারিত নয়।
সাহিত্যিক আড্ডা অব্যাহত, কিন্তু এখানেও নতুন-নতুন সখ্য বিস্তার, পার্টির কাছাকাছি মানুষদের সঙ্গে। কলকাতায় কবিতাভবনে গিয়ে আর তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না, বুদ্ধদেব বসু ক্রমশ মার্কিন মুগ্ধতার মৌতাতে স্থবির, কিছু সমধর্মী বয়স্যও তাঁর জুটেছে ইতিমধ্যে। তাঁর সঙ্গে সোচ্চারে তর্ক করি, তবে তাঁকে তেমন আঘাত দিয়ে কথা বলতেও ঈষৎ জড়তাবোধ। যদিও একটু-আধটু শখের কবিতা মকশো তখনও চলছিল, ততদিনে ভালো করেই বুঝে গেছি আমার কবি-ভবিষ্যৎ কিছুই নেই। বুদ্ধদেব কিন্তু আমার গদ্যভঙ্গির তারিফ করেন, প্রায়ই অনুযোগ করেন, আরও বেশি গদ্য লিখি না কেন। সেই লগ্নে আমি যুগপৎ অর্থশাস্ত্র কপচাচ্ছি ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্যে একনিষ্ঠ হচ্ছি। এই অবস্থায় সুকান্তর অনুকরণ করেই বলতে পারতাম, কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি’।
জীবনানন্দের সঙ্গেও কলকাতায় এলে নিয়মিত দেখা হতো, তিনি ক্রমশ উদ্ভ্রান্ত, ক্রমশ আত্মবিশ্বাসরহিত। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র, যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন, তাঁর ধারণা বুদ্ধদেব বসু-বিষ্ণু দে প্রভৃতিও দেখেছেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রসঙ্গ না হয় উহ্যই রইলো, অথচ তিনি নিজে একটি ভদ্রগোছের অধ্যাপনার কাজ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারছেন না। পরিচিত এঁকে-তাঁকে ধরেও কোনও ফল হচ্ছে না, আমরা যাঁরা তাঁর অনুরক্ত শুভানুধ্যায়ী তাঁরাও কিছু করে উঠতে পারছি না। একদিন, বর্ষার স্নান সন্ধ্যা, রাসবিহারী এভিনিউর প্রায় মোড়ে ল্যান্সডাউন রোডের গলিতে তাঁর একতলার ফ্ল্যাটের বহির্দুয়ার দিয়ে সদ্য ঢুকেছি, হঠাৎ আমাকে টেনে এক কোণে, নিচু নিমগাছের ডালের আড়ালে, নিয়ে গেলেন, কানে-কানে তাঁর অস্ফুট প্রশ্ন: ‘আচ্ছা, আপনি কি জানেন, বুদ্ধদেববাবুর নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকার ফিক্সড ডিপোজিট আছে?’ বুদ্ধদেবের আর্থিক অবস্থা তখন কিন্তু আদৌ ভালো নয়, কিন্তু জীবনানন্দ এতটাই তিমিরে অবগাহিত, যে অলীক লোকপ্রবাদও তাঁর কাছে ধ্রুব সত্য বলে প্রতিভাত। যেখানে তিনি নিজে কোনওদিন পৌঁছতে পারবেন না, সেখানে তাঁর বন্ধু ও পরিচিতরা কীরকম অমোঘ নিয়মে পৌঁছে গেছেন; তখনকার নিরিখে কোনও সাহিত্যিকের পক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকার সঞ্চয় অবশ্যই বিস্ময়ে অবাক করার মতো।
জীবনানন্দের তৎকালীন বিষন্নতার ঈষৎ আলাদা এক আজব কারণ ছিল। অর্থাভাব, দিলীপ গুপ্ত সিগনেট প্রেস থেকে প্রচুর আগ্রহভরে ‘বনলতা সেন’-এর নতুন সংস্করণ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন, বেশ কিছু টাকা জীবনানন্দকে আগাম দিয়েছেন, কলেবর বৃদ্ধির প্রয়োজনে ‘পূবৰ্বাশা’ থেকে পূর্ব-প্রকাশিত ‘মহাপৃথিবী’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত অনেকগুলি কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর সিগনেট সংস্করণে জীবনানন্দ ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তা নিয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে সামান্য মন-কষাকষি, কিন্তু তা ছাপিয়ে আরও বড়ো বিরক্তি-বিষণ্ণতা: দিলীপ গুপ্ত সত্যজিৎ রায়ের উপর চড়াও হয়ে তাঁকে দিয়ে ‘বনলতা সেন’-এর সিগনেট সংস্করণের প্রচ্ছদ আঁকিয়েছেন, যা জীবনানন্দের আদৌ পছন্দ হয়নি, কিন্তু তা মুখ ফুটে দিলীপ গুপ্তকে বলতে পারছেন না, শুধু আমাদের কয়েকজনকে সন্তর্পণে কাছে ডেকে এনে নালিশ জানাচ্ছেন : ‘এ কোন বনলতা সেন, এটা তো কৈকেয়ী বুড়ি!’ ‘বনলতা সেন’-এর ‘কবিতাভবন’ সংস্করণের প্রচ্ছদের ছবি এঁকেছিলেন শম্ভু সাহা, ভারি মায়ালু দেখতে ছিল সেই প্রচ্ছদ, যার শোক জীবনানন্দ ভুলতে পারছিলেন না।
কমাস বাদেই সেই ভয়ংকর ট্রাম দুর্ঘটনা, যা আমাদের অনেকের কাছে কেন যেন প্রায় অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হয়েছিল, যে-আশঙ্কার উৎসে তাঁর চকিত চাহনি, সতর্ক-ঘাবড়ানো-অতর্কিত পদক্ষেপ, তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিকেই যা মনে করিয়ে দিত, ‘সতত সতর্ক থেকে তবু/কেউ যেন ভয়াবহভাবে পড়ে গেছে জলে।’ জীবনানন্দ জলে পড়ে যাননি, পড়লেন ট্রামের তলায়, তবে সর্বনাশের এই বিকচনটি সম্বন্ধে তিনি যেন আগে থেকেই জ্ঞাত ছিলেন। যেদিন তিনি প্রয়াত হলেন সেদিনই সন্ধ্যায় আমি কলকাতা পৌঁছুলাম, স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে কী একটা কাজে। কয়েক ঘণ্টা আগে এসে কেন পৌঁছুলাম না, তা নিয়ে এক বছর-দুই বছর মনোকষ্টে ভুগেছিলাম, তবে তা তো নেহাতই বাষ্পতুরতা।
এখন অর্ধশতাব্দী গত, তাঁর জীবদ্দশায় যে-প্রাপ্য তিনি সমাজ থেকে পাননি, তা হাজার-লক্ষ গুণ অধিক মাত্রায় অর্পণ করা হচ্ছে তাঁকে, সেই জীবনানন্দ দাশকে, যিনি পঞ্চাশের দশকের প্রারম্ভিক বছরগুলিতে দু’শো-আড়াইশো টাকা মাস মাইনের একটি কাজ পেলে বর্তে যেতেন। এখন সম্মান ও প্রাপ্তির জলপ্রপাত উন্মত্ত গতিতে প্রবহমান, জীবনানন্দ নেই, তাঁর স্ত্রীও জীবিত নেই, পুত্র-কন্যাও না, এখন যা হচ্ছে তা নেপোয় মারে দই। আমি একাধিক জায়গায় উল্লেখ করেছি, আরও একবার করতে কোনও দ্বিধা নেই, বর্তমান পরিস্থিতি নিরীক্ষণ করে জীবনানন্দের সেই নিকষ পঙ্ক্তিটি মনে পড়ে যায় আমার: ‘মানুষটা মরে গেলে যদি তাঁকে ওষুধের শিশি/ কেউ দেয়, বিনি দামে, তাতে কার লাভ, এই নিয়ে ভীষণ সালিশি’। আমার অধৈর্যকে হয়তো অন্য কেউ-কেউ যুক্তিহীন বলে বর্ণনা করবেন; তাঁরা বলবেন, ইতিহাসের এটাই তো নিয়ম, কবিদের মহত্ত্ব যুগ ও কালের পরিধি অতিক্রম করে, আমার মতো মান্ধাতা আমলের মানুষদের তো বরঞ্চ কৃতার্থ বোধ করা উচিত, তাঁর সমসাময়িক প্রজন্ম তাঁকে যে স্বীকৃতি দিতে প্রত্যাখ্যান করেছিল, পরবর্তী প্রজন্মসমুহ তা সুদে-আসলে পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণতর করেছে। খোলা বাজারের সুযোগ নিয়ে কিছু ধড়িবাজ মানুষ তাকে নিয়ে যদিও ব্যবসা করছে, কিন্তু, কী আর করা, জীবনানন্দ নিজেই তো বলে গেছেন: ‘পৃথিবীতে নেই কোনও বিশুদ্ধ চাকরি’। তবে এটা যুক্তির ব্যাপার নয়, ইতিহাসের অবিচার যুক্তিগ্রাহ্য হলেও তা অবিচার-ই থেকে যায়।