আপিলা-চাপিলা – ২৮

আটাশ

মহা উৎসাহে কাজে ডুবছি, প্রশাসনের কলকাঠি কব্‌জা করছি, বিধানসভায় গরম-গরম বক্তৃতা দিয়ে খ্যাতি-অখ্যাতি দুই-ই কুড়োচ্ছি, বহু পার্টি কমরেডের সঙ্গে পরিচয় নিবিড়তর হচ্ছে। সাতাত্তর সালে নির্বাচিত বিধানসভায় কাছাকাছি এসেছিলাম অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়—গদাদা—, বিজয় পাল, মাধবেন্দু মহান্ত, গোপাল বসু, তরুণ সেনগুপ্ত, দেবীপ্রসাদ বসু, হারাধন রায়, যামিনীভুষণ সাহা, সুনীল বসুরায়, পান্নালাল মাজি, বামাপদ মুখোপাধ্যায়, আবুল হাসান, হরমোহন সিংহ, যামিনী মজুমদার, এমন অনেকের সঙ্গে। এঁদের নাম জানতাম, এবার কাছাকাছি পৌঁছুবার সুযোগ ঘটলো। গদাদা, যিনি পশুপালন মন্ত্রী হিশেবে শপথ নিলেন বিনয়দাদের সঙ্গে, দীর্ঘদিন নদীয়ায় পার্টির হাল ধরে ছিলেন, কৃষ্ণনগরের বনেদি বংশের সন্তান, অন্য অনেকের ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছে, তিনিও প্রথম যৌবনে অগ্নিযুগের অকুতোভয় সৈনিক হিশেবে আন্দামানে গিয়েছিলেন, সেখানে মার্কসবাদে দীক্ষা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় গদাদা নাকি সোভিয়েট সেনাধ্যক্ষ বুদেনির ধাঁচে ইয়া লম্বা গোঁফ জাহির করতেন, তবে আমরা দেখিনি। অকৃতদার, কমিউনিস্ট পার্টি ধ্যান-জ্ঞান, অথচ বাড়িতে মাতৃসমা বউদির প্রতি ভক্তিতে অটল। সমর সেন চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে বিশেষ হৃদয়দৌর্বল্য-জনিত কারণে প্রায়ই কৃষ্ণনগর যেতেন। জনশ্রুতি, গদাদা উদ্যোগ নিয়ে সমরবাবুকে পার্টির প্রার্থী-সদস্যের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। গোল বাধলো এক সন্ধ্যায় জনসভার আয়োজন ঘিরে: গদাদার নির্দেশ, সেই সভায় সমরবাবুকে বক্তৃতা দিতে হবে, শুনে সমর সেন কৃষ্ণনগর থেকে সারারাত পায়ে হেঁটে কলকাতা পালিয়ে এলেন, আর কোনওদিন পার্টিমুখো হননি।

বিজয় পালকে যত দেখেছি, মুগ্ধতর হয়েছি, এক সঙ্গে কঠিন ও কোমল, আদর্শ ও কর্তব্যপালনে অনড়, অথচ হৃদয় উপচে স্নেহবর্ষণেও অপ্রতিম। এই চাল-চুলোহীন মানুষটির কাছে আসানসোল-রানীগঞ্জ অঞ্চলের জনগণ কেন আনুগত্যে অনড়, বুঝতে কোনওই অসুবিধা হতো না। হারাধন রায়ের অতি সম্প্রতি প্রকাশিত স্মৃতিকথা রানীগঞ্জ-আসানসোল অঞ্চলে শ্রমজীবী মানুষজনের আন্দোলন ত্যাগ ও তিতিক্ষার ভিত্তিতে কী করে শক্তিশালী থেকে ক্রমশ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলো, তার উজ্জ্বল বিবরণে ঠাসা বৃত্তান্তটি ব্যক্তি হারাধন রায়ের মতো সর্ব অর্থে খাঁটি। মাধবেন্দু মহান্তের নাম ছেলেবেলা থেকেই শোনা: বিপ্লবী রাজবন্দী, মাঝে-মাঝে খবরের কাগজে উল্লেখ থাকতো এই জেল থেকে অন্য জেলে চালান হয়েছেন; বিনয় ও নিঃশব্দ মাধুর্যের স্ফুরণ তাঁর ব্যক্তিত্ব থেকে। দেবী বসুকে বরাবর খুব চেনা মানুষ মনে হতো, বাঙালি কমিউনিস্ট বলতে মনে-মনে যে ছক কাটা ছিল, যেন তার আদর্শ সংস্করণ: নবদ্বীপসম্মত বিনয়ে সিক্ত, সাহিত্যরসে ভরপুর। গোপাল বসুর রাজনৈতিক বিশ্বাসে বাঙাল গোঁর প্রলেপ, তবে কাছে-টানার আশ্চর্য জাদু তাঁর ব্যক্তিত্ব জুড়ে। তরুণ সেনগুপ্ত পার্টিতে এসেছিলেন কংগ্রেস ত্যাগ করে, বুদ্ধিদীপ্ত প্রাজ্ঞ পুরুষ, অতি অকালে চলে গেলেন। ইছাপুর-নোয়াপাড়া অঞ্চলের বলিষ্ঠ চেহারার জঙ্গি শ্রমিক নেতা যামিনী সাহা একসময়ে যে কাব্যচর্চা করতেন, ক’জনই বা তা এখন মনে রেখেছেন? আবুল হাসান একটি ব্যাপারে বিবেচনায় ভুল করেছিলেন, পার্টি থেকে তাই তাঁকে শাস্তি পেতে হয়েছে, তা হলেও শ্রমজীবী মানুষদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে, ও পার্টির বেড়ে ওঠার ইতিহাসে, তাঁর ভূমিকা আদৌ নগণ্য নয়, সাহস করেই বলা চলে, খাঁটি কমরেড। আরও-একজনের কথা মনে পড়ছে, যিনিও এখন দল থেকে অপসৃত, ময়ূরেশ্বরের পঞ্চানন লেট, খেতমজুর আন্দোলনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে-জড়ানো, আগাগোড়া সততায় মোড়া। এরকম আরও কয়েকজনের কথা বলি: কিষাণগঞ্জ-চোপড়া অঞ্চলের কৃষক নেতা, ছোটোখাটো মানুষটি, সততা ও আদর্শের প্রতিমূর্তি, বাচ্চা মুন্সী, ও হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া-বাওড়িয়ার রাজকুমার মণ্ডল। ট্রেড ইউনিয়ান নেতাদের মধ্যে উল্লেখ করবো দুর্গাপুরের দিলীপ মজুমদার ও উত্তরপাড়ার শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের; দু’জনের মধ্যে প্রকৃতিগত তফাত আছে, কিন্তু নিজেদের মতো করে উভয়েই রাজ্যে শ্রমিক আন্দোলনে জোয়ার আনতে অঢেল পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের নিদর্শন রেখেছেন। আসানসোলের সুনীল বসুরায় ও বামাপদ মুখোপাধ্যায়ের মতো নিশ্ছিদ্র ভালোমানুষেরা কী করে দুঁদে ট্রেড ইউনিয়ন নেতার ভূমিকা পালন করেন তা নিয়ে আমার বিস্ময়বোধ অব্যাহত। চণ্ডীতলার মলিন ঘোষ, চেঁচাতে যাঁর জুড়ি ছিল না, কলকাতায় সদাগরি দপ্তরে করণিক, নিজের এলাকায় কৃষক নেতা, তাঁকেও ভোলা অসম্ভব।

ব্যস্ততা ও সখ্যের অনুভবে দিন কাটছিল, হঠাৎ পরিবেশ একটু উত্তপ্ত। ভারত সরকারের সঙ্গে আমাদের গুরুতর বাগবিতণ্ডা বেধে যায় ১৯৭৮ সালের বন্যাত্রাণে কেন্দ্রীয় সাহায্য নিয়ে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের দু’মাসের মধ্যে রাজ্য জুড়ে ব্যাপক বন্যা, আমি দিল্লিতে গিয়ে বলেছিলাম বঙ্গোপসাগর যেন দুশো মাইল উত্তরে উঠে এসেছে, জলের দানবীয় তোড়ে হাজার-হাজার মানুষের ভেসে যাওয়া, লক্ষ-লক্ষ গৃহহীন, গবাদি পশুও সেই সঙ্গে, সর্বাগ্রে ত্রাণের ব্যবস্থা করে সবাইকে বাঁচাতে হবে। পঞ্চায়েতের বন্ধুরা, পঞ্চায়েতের কাজে তখনও তাঁরা অনভিজ্ঞ, কিন্তু কৃষক সভার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লালিত হয়েছেন, অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী, অহোরাত্র জান কবুল করে বন্যার্ত মানুষদের রক্ষা করেছেন, বানভাসি এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন, খাদ্য পৌঁছে দিয়েছেন, কলেরা-টাইফয়েড-ম্যালেরিয়ার প্রতিশেধক ওষুধ বিতরণ করেছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সর্বস্তরের সরকারি কর্মচারীরা: রাজ্য কর্মচারীবৃন্দের নেতা অরবিন্দু ঘোষ ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের কথা এই প্রসঙ্গে বার-বার মনে পড়ে। এতটা সুশৃঙ্খল সাহায্যের ব্যবস্থা সম্ভব হবে তা নিজেরাও ভাবতে পারিনি। অর্থ দফতরের দায়িত্বে আমি, সর্বস্তরের রাজপুরুষদের ও পঞ্চায়েত সভ্যদের খবর পাঠানো হলো, টাকার জন্য ত্রাণের কাজ যেন ঠেকে না থাকে। কলকাতা থেকে টেলিফোন-টেলিগ্রামে প্রতিটি ট্রেজারি দফতরে নির্দেশ গেল, টাকা না-পেলে যেন সঙ্গে-সঙ্গে কলকাতায় জানানো হয়। হঠাৎ একদিন রিজার্ভ ব্যাংক থেকে একটি প্রেস নোট বের হলো, তাঁরা চিন্তিত, পশ্চিম বাংলা বড়ো বেশি ওভারড্রাফট নিচ্ছে, নিয়ম ছাড়িয়ে গিয়ে। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বললাম, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে রিজার্ভ ব্যাংকের কর্তারা হয়তো ভারতবর্ষে অবস্থান করছেন না, তাঁরা কি জানেন না পশ্চিম বাংলা ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছে, নিয়মকানুন রক্ষার চেয়ে বন্যার্ত মানুষদের রক্ষা করাই এখন বড়ো কর্তব্য।’ পরদিন রিজার্ভ ব্যাংকের গর্ভনর টেলিফোনযোগে দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চাইলেন।

যাঁরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁদের গাত্রদাহ হলো। এমনিতেই সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁরা হেরে ঢোল, তার উপর এমন ঢালাও ত্রাণ সাহায্য পাওয়ার পর গ্রামবাংলার মানুষ কমিউনিস্টদের ছেড়ে আর ওঁদের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। প্রতিপক্ষীয়দের মধ্যে কংগ্রেসিরা যেমন ছিলেন, মোরারজীর নিজের দলের লোকরাও; মোরারজী বরাবরই একটু কানপাতলা মানুষ। আমাদের টাকার দরকার, ওভারড্রাফ্‌ট বেড়ে যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল ঘুরে গেছেন, এক কিস্তি কেন্দ্রীয় সাহায্য এসে পৌঁছেছে বন্যাত্ৰাণ বাবদ, তারপর বন্ধ। এই অবস্থায় আমাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের সংঘাত চরমে উঠলো। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী রাজপুরুষ হিশেবে অতীতে বহুদিন মোরারজীর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁর কথায় ওঠেন, তাঁর কথায় বসেন। টাকা আটকে গেছে, আমাদের অসুবিধা হচ্ছে, এরই মধ্যে প্রধান মন্ত্রী সরেজমিনে বন্যা দেখতে এলেন, বিমান থেকে পরিদর্শন, মামুলি, দায়সারা ব্যাপার। সন্ধ্যাবেলা আমাদের সঙ্গে বৈঠক রাজভবনে, একপ্রস্থ প্রকাশ্য ঝগড়া হলো। প্রধান মন্ত্রী জানালেন, ত্রাণ সাহায্যে প্রথম কিস্তি যে-টাকা দেওয়া হয়েছে, তার খরচের হিশেব না-পেলে বাদবাকি টাকা ছাড়া হবে না। প্রধান মন্ত্রীকে মুখের উপর বলতে হলো, হিশেব দেওয়ার দায় আমাদের নয়, অডিটার অ্যান্ড কম্‌প্‌ট্রোলার জেনারেলের। ঝগড়া আরও গড়াতে পারতো, সে সময় যিনি রাজ্যপাল ছিলেন, ত্রিভুবননারায়ণ সিংহ, মধ্যস্থ হয়ে ব্যাপারটি মিটিয়ে দিলেন।

রাজ্যপালের প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল, ত্রিভুবননারায়ণ সিংহের কথা সামান্য বলি, না বললে তাঁর স্মৃতির প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে। উত্তর প্রদেশের মানুষ, স্বাধীনতা আন্দোলনের কালে নেহরু পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ। জওহরলাল নেহরু-প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রিকা ন্যাশনাল হেরাল্ড-এর কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন বহু বছর। ইন্দিরা গান্ধির প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম পর্বে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন, কী কারণে ইন্দিরার বিরাগভাজন হওয়াতে পত্রপাঠ তাঁর চাকরি যায়। ব্যথিতচিত্তে তিনি মোরারজী দেশাইদের সংগঠন কংগ্রেস দলে যোগ দিয়েছিলেন; জরুরি অবস্থার সময় তাঁকেও কয়েদ করা হয়। সাতাত্তর সালের জুন মাসে আমরা যখন শপথ গ্রহণ করলাম, তখন, আগেই বলেছি, রাজ্যপাল ছিলেন অ্যান্টনি ডায়াস। এমনিতে নির্বিবাদী মানুষ, তবে দুর্বলচিত্ত, স্ত্রীকে ভীষণ ভয় পান বলে বাজারে গুজব, তা ছাড়া ইন্দিরা গান্ধির পরম বশংবদ, যে কারণে জ্যোতিবাবু রাজ্যপাল হিশেবে তাঁর অবস্থান খুব একটা পছন্দ করছিলেন না। তখনও তো আমাদের সঙ্গে রাজনৈতিক নৈকট্য, জ্যোতিবাবুর মনোভাব জানতে পেরে কেন্দ্রীয় সরকার ডায়াসের মেয়াদ ফুরোলে তাঁর জায়গায় ত্রিভুবননারায়ণকে পশ্চিম বাংলায় রাজ্যপাল করে পাঠালেন; মোরারজীর সঙ্গে সেই মুহূর্তে জ্যোতির্ময় বসুর বেশ ভাব, তাঁরও খানিকটা হাত ছিল এই ব্যাপারে। ত্রিভুবননারায়ণ মাটির মানুষ, পড়াশুনোয় আগ্রহী, লেখাপড়া-জানা ব্যক্তিদের সম্মান দিতে জানতেন, আমাদের সরকারের মস্ত অনুরাগী ছিলেন। কী কারণে জানি না, আমাকে ঈষৎ পছন্দ করতেন, প্রায়ই নৈশাহারে আমাদের নিমন্ত্রণ জানাতেন, তাঁর শাদামাটা স্ত্রীও যোগ দিতেন। যে দুই বছর রাজ্যপাল ছিলেন, সরকারের সঙ্গে কোনও কিছু নিয়ে সমস্যা দেখা যায়নি। শুধু একবার কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনয়নের প্রশ্নে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে বলেছিলেন, ‘রাজ্য সরকার যাঁকে সুপারিশ করেছেন তিনি অভিজ্ঞতায় খাটো’। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সম্মতি দিয়ে দেন।

ত্রিভুবননারায়ণ চুপি-চুপি একটি মজার কথা বলেছিলেন, এত বছর বাদে তা প্রকাশ করতে বাধা নেই বলেই মনে হয়। ডায়াস স্পষ্টত যেমন দুর্বল, তাঁর স্ত্রী তেমনই জাঁদরেল। মহিলার পিতৃদেব বিশের দশকে বাংলা দেশে খুব কড়া আই সি এস অফিসার ছিলেন, মহিলার আচার-আচরণেও কেমন কলোনিয়াল-কলোনিয়াল গন্ধ। ত্রিভুবননারায়ণ সংগোপনে আমাকে যা বলেছিলেন, কলকাতার রাজভবনে পুরোনো মদের অত্যন্ত উৎকৃষ্ট একটি সেলার ছিল, প্রচুর দামি বিলিতি পানীয়ের সম্ভার, ডায়াস-সহধর্মিণী কলকাতা থেকে বিদায় নেওয়ার কালে সেই সেলার নাকি পুরোটা মস্ত কাঠের বাক্সে বোঝাই করে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। গল্পটির সত্য-মিথ্যা অবশ্য আমার জানা নেই। (অনুরূপ একটি গল্প শুনেছিলাম বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত সম্পর্কে। উনি ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিশেবে ছিলেন বছর দুয়েক; মেয়াদ শেষ হলে প্রস্থান করলেন, নতুন রাষ্ট্রদূত কাজে যোগ দিয়ে আবিষ্কার করলেন বিজয়লক্ষ্মী অনেক মূল্যবান কার্পেট-বস্তুসামগ্রী-অলঙ্কার কিনে সঙ্গে নিয়ে গেছেন, দাম মেটাননি। বেচারা নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে তা মেটাতে হলো।)

দ্বিতীয় পর্বে ক্ষমতায় ফেরার পর ইন্দিরা গান্ধি রাজ্যে-রাজ্যে বিশ্বস্ত, অনুগত রাজ্যপাল নিয়োগে মনোনিবেশ করলেন, ত্রিভুবননারায়ণ সিংহকেও সরিয়ে দিলেন। কলকাতার মানুষ তাঁকে যে বিদায়-সম্বর্ধনা জানালো, তা অন্য কোনও রাজ্যপালের ভাগ্যে ঘটেনি, আমার ধারণা ঘটবেও না। তারপরেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল; একবার কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন, খবর পাঠিয়েছিলেন, সস্ত্রীক গিয়ে দেখা করে এসেছিলাম; কয়েক বছর বাদে গত হন। তাঁর পরিবর্তে যিনি রাজ্যপাল হয়ে এলেন, ভৈরবদত্ত পাণ্ডে, দিল্লির অর্থমন্ত্রকে একসঙ্গে কাজ করেছি, তারও আগে থেকে আমাদের পরিচয়। তাঁকে নিয়ে প্রমোদবাবু-জ্যোতিবাবুর অনেক সংশয় ছিল, আমার আদৌ ছিল না, ওঁকে ভালো করে জানতাম বলে। ইন্দিরা গান্ধির তরফ থেকে মাঝে-মাঝে চাপ এলেও তিনি যে ক’বছর কলকাতায় ছিলেন, তা অগ্রাহ্য করেছেন, আমাদের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। তাঁর প্রস্থানের পর যে-দু’জন পর-পর এলেন, তাঁদের সম্পর্কে অনুরূপ কথা অবশ্য কিছুতেই বলা চলে না।

কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি; প্রত্যাবর্তন প্রয়োজন। বাংলা সাংবাদিকতার সৌজন্যে আমাদের শোরগোল তোলার কাহিনীকে কেন্দ্রের ‘বিমাতৃসুলভ’ আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বলে অভিহিত করা হচ্ছিল। এমন কুৎসিত শব্দটি বাংলা ভাষায় কী করে জায়গা দখল করে নিতে পেরেছে তা নিয়ে এখনও আমার বিস্ময়বোধ। আসলে আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল কেন্দ্র বনাম রাজ্যসমূহের স্বার্থের ক্রমশ-বাড়তে-থাকা বৈপরীত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ। কোনও ক্ষেত্রেই আলাদা করে পশ্চিম বাংলার হয়ে তদ্বির করার প্রশ্ন নেই, সমস্ত রাজ্যগুলিকে জড়িয়ে, সংঘবদ্ধ আন্দোলন করে, প্রতিটি রাজ্যের স্বার্থ প্রসারিত করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের স্বার্থে রফতানিব্য পণ্যাদির উপর বিক্রয়কর আরোপে রাজ্যের অধিকারের ক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে কিছু বিধিনিষেধ চাপানোর চেষ্টা চলছিল, তার বিরুদ্ধে লড়াই। রফতানি থেকে সংগৃহীত বিদেশী মুদ্রার কানাকড়িও রাজ্যগুলির জন্য বরাদ্দ হয় না, তা হলে নিজেদের রাজস্ব সংগ্রহ- সম্ভাবনা বিসর্জন দিয়ে কেন্দ্রকে কেন আমরা খুশি করতে যাবো? এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পণ্যপরিবহনের উপরও বিক্রয় কর আরোপের ক্ষেত্রে নানা বাধা, তাই-ই বা থাকবে কেন? আয়কর ও অন্তঃশুল্ক থেকে সংগৃহীত রাজস্বের একটি বড়ো অংশ রাজ্যগুলির প্রাপ্য, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই করের হার কী হবে সেই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকারে থাকবে কেন? অনন্তকাল ধরে আয়করের উপর কেন্দ্রীয় সরকার একটি অভিভার, সারচার্জ, চাপিয়ে রাখছে, সংবিধানের পাতা খুলে দেখানো হতো এই অভিভার থেকে আদায়-করা পয়সাকড়িতে রাজ্যগুলির কোনও অধিকার নেই। কিন্তু করের হার না বাড়িয়ে সারচার্জ চাপানো তো এক ধরনের কারচুপি। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, সংবিধানের নিদান-অনুযায়ী পাঁচ বছর অন্তর-অন্তর রাষ্ট্রপতি-কর্তৃক যে অর্থ কমিশন নিয়োগ করা হয়, যে-কমিশনের প্রধান কৃত্য কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে আয়কর ও অন্তঃশুল্ক থেকে সংগৃহীত রাজস্বের বিভাজন নির্ণয়, তার নিয়োগ ও নির্দেশাবলী নির্ধারণে কেন্দ্র কেন একাই ছডি ঘোরাবে, রাজ্যগুলির মতামতের কোনও তোয়াক্কা না করে? এ সমস্ত বিষয় ঘাঁটতে গিয়ে সংবিধানের অন্ধিসন্ধি প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, সব সময় পাঞ্জাবির ঝোলায় সংবিধানের একটি ক্ষুদ্রাকৃতি সংস্করণ থাকতো, কোনও বিতর্ক উঠলেই সেটা বের করে সংবিধানের বিশেষ-বিশেষ ধারা পড়ে প্রতিপক্ষকে জব্দ করবার চেষ্টা করতাম।

কেন্দ্রে জনতা দলের সরকারকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে মোটামুটি তবু কব্‌জা করে আনা যাচ্ছিল, এখানে-ওখানে খিটিমিটি চলছিল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের মধ্যে একজন-দু’জন কিছুটা সহানুভূতিশীল, অন্য কেউ-কেউ হয়তো নন। সব মিলিয়ে তা হলেও আমাদের কাজকর্ম চালিয়ে যেতে তেমন অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটলো। আর্যাবর্তের রাজনৈতিক লীলাখেলার ঐতিহ্যে, বলতেই হয়, প্রধান স্থান দখল করে চিরদিনই আদর্শহীন সুবিধাবাদ। ইন্দিরা গান্ধির অনাচারের প্রতিবাদে, জয়প্রকাশ নারায়ণের প্রয়াসে, রক্ষণশীল ধাঁচের প্রাচীনপন্থী কংগ্রেস থেকে শুরু করে ঘোর জনসংঘী, চরম প্রতিক্রিয়াপন্থী কুলক সম্প্রদায় থেকে শুরু করে লোহিয়া-ধাঁচের বাক্যবাগীশ সমাজতান্ত্রিক পর্যন্ত, জনতা দলের ছত্রতলে সকলের সমাবেশ। জোড়াতালি-দেওয়া দল, জোড়াতালি-দেওয়া সরকার, দু’বছরও টিকলো না, মোরারজী দেশাইকে সরিয়ে দিয়ে প্রধান মন্ত্রীর গদি দখলের জন্য চরণ সিংহ উঠে-পড়ে লাগলেন, কেউ-কেউ তত্ত্ব দাঁড় করাতে চেষ্টা করলেন মোরারজীর তুলনায় চরণ সিংহ ঢের বেশি প্রগতিশীল। যা-ই হোক, দিল্লিতে সরকার পড়লো। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষকতায় কুলককুলপতি প্রধান মন্ত্রীর আসনে বসে জীবনের সাধ পূর্ণ করলেন। যা অবধারিত ছিল, চরণ সিংহকে মগডালে চড়িয়ে দু’দিন বাদে ইন্দিরা গান্ধি মইটা সরিয়ে নিলেন। ফের লোকসভা নির্বাচন। তিতিবিরক্ত দেশসুদ্ধ সাধারণ মানুষ, জরুরি অবস্থার বিভীষিকার স্মৃতি দ্রুত বিলীয়মান, ইন্দিরা গান্ধিকে ফের বরণ করে নিলেন। পশ্চিম বাংলায় অবশ্য বামফ্রন্টের দুর্গ অটল রইলো।

জনতা দল ভেঙে খান খান, হিন্দুত্ববাদীরা ভারতীয় জনতা পার্টিতে জোটবদ্ধ, তবে ইন্দিরা গান্ধির দ্বিতীয় আবির্ভাব-প্রসূত হিংস্রতা প্রতিহত করতেই সেই মুহূর্তে আমাদের অধিকতর ব্যতিব্যস্ততা। মোরারজীর প্রধানমন্ত্রিত্বে যতটুকু অসুবিধা হচ্ছিল, কংগ্রেস কেন্দ্রে ফিরে আসায় পশ্চিম বাংলায় বামফ্রন্টের সমস্যা তার বহুগুণ বাড়লো। ইন্দিরা গান্ধির রন্ধ্রে-রন্ধ্রে এখন স্বৈরাচারী মানসিকতা, দলকে যেমন সামন্ততন্ত্রের পরাকাষ্ঠায় পরিণত করেছেন, প্রশাসনেও সেরকম পরিবর্তন সাধনে তাঁর ষোলো-আনা অঙ্গীকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তিনি এক এবং অদ্বিতীয়া, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিন্যাসের প্রশ্নেও তাঁর দৃঢ় সংকল্প, রাজ্যগুলিকে তাঁর পদতললীনা হয়ে স্বর্ণবীণা বাজাতে বাধ্য করবেন। যেহেতু বিকেন্দ্রিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের আন্দোলনে আমরা পশ্চিম বঙ্গ থেকে নায়কত্ব দিচ্ছিলাম, অচিরে তাঁর স্বভাবশত্রুতে পরিণত হলাম। আর এই সম্মুখসমরে মোরারজীর তুলনায় ইন্দিরার আক্রমণ অনেক বেশি ক্ষিপ্রতর, তীব্রতর।

ইতিমধ্যে আমাদের দিক থেকেও প্রতি-আক্রমণের তুণগুলি শাণিততর হয়েছে। আমরা সর্বদা ভূমিসংস্কারের কথা বলছি, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ঢেলে সাজাবার কথা বলছি, দেশের মুদ্রাব্যবস্থা পরিচালনায় কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যগুলির সমান অধিকার স্থাপনের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি, ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক সংস্থাদির নীতিনির্ধারণে রাজ্যগুলির ভূমিকার স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিরন্তর কথা বলছি। যে অর্থ কমিশন প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কেন্দ্র ও রাজ্যসমূহের মধ্যে রাজস্ব বিভাজনের প্রশ্নে সুপারিশ পেশ করে, তাতে কারা-কারা থাকবেন, তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির ন্যায্য অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছি। যোজনা কমিশনের উপর গোটা দেশের পরিকল্পনা রচনার দায়িত্ব ন্যস্ত; জাতির আর্থিক-সামাজিক প্রগতির রূপরেখা কেমনধারা হবে সেই সিদ্ধান্ত তো শুধু কেন্দ্রের খেয়ালখুশিমতো হওয়া শ্রেয় নয়, তা নিয়ে রাজ্যগুলিরও পরামর্শ দেওয়ার অধিকার আছে। অথচ যোজনা কমিশনকে তার ধারে-কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না, সংস্থাটিকে আর-একটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রকে পরিণত করা হয়েছে, এর চেয়ে অন্যায় কিছু হতে পারে না। আশির দশকে ইন্দিরা গান্ধির জমানায় এমন অবস্থা দাঁড়ালো যে কেন্দ্রে শিল্পমন্ত্রী নারায়ণদত্ত তেওয়ারি, অথচ সেই সঙ্গে তিনি যোজনা কমিশনের কার্যকরী সভাপতিও। একদিন তেওয়ারিকে হেসে-হেসে বলেছিলাম, তিনি, জনৈক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, যোজনা কমিশনেও মোড়লি করছেন, এটা ভয়ংকর কেলেঙ্কারি: যোজনা কমিশনের বড়ো কর্তাকে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে অপক্ষপাতিত্ব বজায় রাখতে হবে, যা তাঁর পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়, সুতরাং তাঁর উচিত হয় কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অবিলম্বে পদত্যাগ, নয় তো যোজনা কমিশন থেকে সরে যাওয়া। আমার বাক্যাঘাতে তেওয়ারিও সেদিন মিটিমিটি হেসেছিলেন, কিন্তু বিষয়টি তো আদৌ রসিকতার বস্তু নয়।

একটু আগে যে-উক্তি করেছি, যতদিন জনতা দলের সরকার কেন্দ্রে বহাল ছিল, আশা জেগেছিল কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক সম্পর্কের ব্যাপারে হয়তো কোনও মৌলিক সংস্কার সাধন সম্ভব হবে। বিহারের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুর, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ভৈঁরো সিংহ শেখাওয়াত, কেরলের অকংগ্রেসি প্রত্যেকটি মুখ্যমন্ত্রী, কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী দেবরাজ উর্‌স, এঁরা অনেকেই কেন্দ্রের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় আমাদের সোচ্চার সমর্থন করতেন। মুশকিল দেখা দিল আশি সালে ইন্দিরা গান্ধির প্রত্যাবর্তনের পর। লড়াই করে সব বিরোধীদের হটিয়ে তিনি হৃত সিংহাসন পুনর্বার দখল করেছেন; তার উপর ততদিনে তিনি সম্পূর্ণ স্বৈরাচারবিহারিণী, অদূর অতীত থেকে তেমন শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তাঁর আচরণ থেকে তা মোটেই মনে হতো না, রাজ্যগুলিকে ঢিট করার লক্ষ্যে সংবিধানে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ তাঁর পরম ধর্ম, বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীও রাজ্যগুলিকে তিনি ছাড়বেন না। এই পর্বে প্রথমে তাঁর অর্থমন্ত্রী ছিলেন তামিলনাড়ুর পুরনো কংগ্রেস নেতা ভেঙ্কটরামন, পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তাঁর রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও যুক্তির কথামালা সাজিয়ে ধরলে বেঙ্কটরামন অন্তত মন দিয়ে শুনতেন। কিন্তু কিছুদিন বাদে জনৈক বাঙালি ভদ্রলোক অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন, নিজের রাজ্যে বা অন্যত্র কোথাও তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না, ইন্দিরাজীর প্রসাদেই তাঁর অস্তিত্ব নির্ভর। সব রাজ্যকেই ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করতে তিনি একরোখা ছিলেন, তবে পশ্চিম বাংলার বাড়তি সর্বনাশ সাধনের ব্যাপারে সত্যিই তাঁর জুড়ি ছিল না। আমরা বারবার করে যে-কথাগুলি বলতে চাইছিলাম, সংবিধানের প্রাসঙ্গিক ধারাসমূহের সঠিক প্রয়োগও ঘটছে না, ধারাগুলির সংস্কারও হচ্ছে না, রাজ্যগুলির আর্থিক বরাদ্দ তাই বাড়ছে না; অথচ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব তাদের, উন্নয়নের ক্রমশ বিস্তীর্ণতর কর্মসূচি রূপায়ন তাদেরই দেখতে হয়; কেন্দ্রীয় সরকার তো দূরের আকাশ, এক হাজার-দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে তার অবস্থান, কিন্তু রাজ্য প্রশাসন এই এখানে, জনগণের অতি সামীপ্যে, রাজ্যমন্ত্রীদের চেনেন-জানেন সাধারণ মানুষ, এই মন্ত্রীদের কাছে তাঁরা আর্জি নিয়ে আসেন, তাঁদের সন্তুষ্টিবিধান করতে না-পারলে মন্ত্রীদের একটা চড় কষিয়ে দিতেও বোধহয় পিছুপা হন না তাঁরা। এই অবস্থায় রাজ্যগুলি কী করবে? আমরা তো নোট ছাপাতে পারি না, বাড়তি কর সংগ্রহের সুযোগ আমাদের সীমিত, বাজার থেকে ঋণপত্র ছেড়ে অতিরিক্ত অর্থ তুলতে হলেও কেন্দ্রের পূর্বানুমতি প্রয়োজন। নিছক কৌশলগত কারণে নয়, নীতিগত কারণেও রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ওভারড্রাফট নেওয়া আমি অতএব প্রায় নিয়মের পর্যায়ে উন্নীত করে ফেললাম। একটু চড়া হারে সুদ দিতে হয়, তা ঠিক, তবে তা তো পরের ব্যাপার, রাজ্যের উপার্জন ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে সুদের বোঝা তেমন অসহনীয় ঠেকবে না, আপাতত তাই ওভারড্রাফট মারফত ঋণের পন্থা ধরা যাক না কেন। তা ছাড়া, কেন্দ্র-রাজ্য লড়াইয়ে রাজ্যগুলির জয় হলে ঋণের পুঞ্জীভূত বোঝা নিয়েও ভবিষ্যতে আলোচনা করে তা লাঘবের জল্পনা তেমন অযৌক্তিক নয়।

এই সমস্ত কিছু নিয়েই কেন্দ্রের সঙ্গে মহা গোল বাধলো৷ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে প্রতি সপ্তাহে পশ্চিম বাংলার বর্ধমান ওভারড্রাফট সম্বন্ধে বিস্তৃত তথ্য প্রেস নোট দিয়ে মহা উল্লাসে প্রকাশ করা রিজার্ভ ব্যাংকের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। আমার বিবেচনায় এটা ঘোর বেনিয়ম: ধনী পুঁজিপতিরা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা ফেরত দেন না, তাঁদের ঋণের মাত্রা উপস্থিত কত তা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রক থেকে এখনও বলা হয়, ওটা গোপন ব্যাপার, বাইরে জানানো আইনত সম্ভব নয়; অথচ রাজ্যগুলির ওভারড্রাফটের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার প্রশ্ন যেন কিছুই নেই, সপ্তাহে-সপ্তাহে তা সাধারণ্যে জানিয়ে রাজ্যগুলিকে বিব্রত করতে কেন্দ্রের সীমাহীন উৎসাহ। ফতোয়া জারি করে এরই মধ্যে একবার কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী, যাঁর মাতৃভাষা বাংলা, আমাদের ওভারড্রাফট নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। একটু চিমটি কাটলেন আর কী; ক’দিন পশ্চিম বাংলার জনসাধারণকে বাড়তি দুর্ভোগে পড়তে হলো, আমাদের যুদ্ধে বিরতি ঘটলো না তাতে। (আমি রাইটার্স বিল্ডিং থেকে চলে আসার পর নজরে এলো, পশ্চিম বঙ্গ সরকার হঠাৎ ভীষণ ভালো ছেলে বনে গেছে, ওভারড্রাফট নেই, আয়ের চৌহদ্দির মধ্যে ব্যয়ের অবস্থান, ‘শূন্য ঘাটতি’র বাজেট। আমার দ্বিধাহীন অভিমত, এই ভোল-পাল্টানো ভূমিকা রাজ্য সরকারের চিন্তাধারার সঙ্গে বিশ্রীরকম সামঞ্জস্যবিহীন। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের উচ্চাবচতাহেতু রাজ্যগুলি ধুঁকছে, সেই জীর্ণ অবস্থারই জানান দিত স্ফীতকায় ওভারড্রাফট; তা নেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ হলো পৃথিবীর কাছে ঢাক পিটে ঘোষণা করা সব সমস্যা মিটে গেছে, রাজ্যে আর্থিক অনটন আর নেই, পাশ-বালিশে ভর দিয়ে ঘুমোনো যায় এবার।)

যে ক’বছর রাজ্য সরকারে অর্থ দফতরের হাল ধরে ছিলাম, জ্যোতিবাবু কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের যুদ্ধে আমাকে অকুণ্ঠ সাহায্য করেছেন। তিনি বোধহয় সামান্য মজাই পেতেন, কেন্দ্রের মন্ত্রী-শান্ত্রীদের পরোয়া না করে চেঁচিয়ে যাচ্ছি, তাঁর এক মন্ত্রীর হট্টগোলে ধরণী সচকিত হচ্ছে। অন্যান্য মন্ত্রীদের—যেমন গদাদা, পরিবহন মন্ত্রী প্রবীণ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা রবীন মুখোপাধ্যায়, প্রভাসদা, মহম্মদ আমিন, প্রশান্ত শূর, সবাইর—কাছ থেকেও প্রচুর উৎসাহ পেয়েছি। তবে সর্বাগ্রে কবুল করতে হয় পার্টির কাছ থেকে পরিপূর্ণ সহযোগিতার কথা। প্রশাসনের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রমোদবাবু প্রবেশ করতে চাইতেন না, কিন্ত কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের রাজনৈতিক গুরুত্ব তিনি বহুদিন ধরেই অনুধাবন করছিলেন, অন্তত বছর দশেক আগে থেকেই পার্টিতে সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা চলেছে। এবার রাজ্য সরকারে থেকে আমাদের আন্দোলন সোচ্চার থেকে সোচ্চারতর হয়ে সেই আলোচনাকেই যেন অন্য একটি স্তরে উত্তীর্ণ করলো। সর্বত্র রাজ্যকে অধিক ক্ষমতা দেওয়ার দাবি ছড়িয়ে পড়লো, কলকাতা, মফস্বল, শহর-শহরতলি, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও, যত্রতত্র প্রাচীরগাত্রে, গাছের বাকলের উপরেও, দাবির ধ্বনি-প্রতিধ্বনি: রাজ্যকে অধিক ক্ষমতা দিতে হবে। রাজ্য সরকারের অর্থসঞ্চয় যথেষ্ট বাড়লে পঞ্চায়েত ব্যবস্থারও প্রসার যে সহজতর হবে, বুঝতে কারও তেমন অসুবিধা হলো না। রাজ্যে যাঁরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তাঁরা একটু বিপদে পড়লেন। রাজ্যের হাতে বাড়তি ক্ষমতা ও অর্থপ্রদান অন্যায়, তা তাঁরা মুখ ফুটে বলতে পারছেন না, অথচ বামফ্রন্ট সরকার বেশি টাকা পেলে তাঁদের সর্বনাশ। তা হলেও যার যা প্রাপ্য, তা তাকে দিতে হয়। তারিফ করবো প্রতিপক্ষীয়দের একটি একান্ত বাঙালি রসিকতার: তখনও চরম বিদ্যুৎ সংকট চলছে, গাড়িতে যাচ্ছি, হঠাৎ কাটোয়া না কালনা কোন শহরে, জ্বলজ্বল করে দেয়ালে লেখা দেখলাম, ‘রাজ্যের হাতে অধিক মোমবাতি দিতে হবে’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *