আপিলা-চাপিলা – ৩৪

চৌতিরিশ

ছিয়াশি সালের জানুয়ারিতে ফেরা যাক। মুক্ত পুরুষ, কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে শারীরিক অসুস্থতা থেকেও রেহাই পেলাম। আগের বছর ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপনার পদ ছেড়ে দিয়েছি, এই বুড়ো বয়সে আর কে কাজ দেবে! আমার সম্বন্ধে পাড়ায়-পাড়ায় কিছু আতঙ্কও তো সৃষ্টি হয়েছে: এঁকে সহযোগী করলে সংসৰ্গদোষের ঠেলায় পড়তে হতে পারে। অন্য দিকে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির বন্ধুরা উল্লসিত, কলকাতা ডায়েরি ফের শুরু করবো বলে। অতি স্নেহাস্পদ এক দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক এসে ধরে পড়লেন, তাঁর কাগজে আগেও লিখেছি, এখন যদি ফের একটি পাক্ষিক কোলাম লিখতে রাজি হই। রাজি হলাম, কিন্তু জানালাম, শুধু ওঁর জন্য নয়, কোলামটি দেশের অন্যান্য কিছু পত্রিকায় ব্যবহৃত হলে ভালো হয়, অনেক বেশি মানুষ তা হলে পড়বার সুযোগ পাবেন। সেরকমই ব্যবস্থা হলো। এখানে-ওখানে ছুটকো-ছাটকা লেখার ব্যাপার তো ছিলই। মন্ত্রী থাকাকালীন প্রায় ন’বছর আমার স্ত্রী কীভাবে পুরনো সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালিয়েছেন তার খোঁজ রাখবার মতো দায়িত্বশীলতা আমার এতদিন ছিল না, কিন্তু এখন থেকে ন্যূনতম সংস্থানের কথা ভাবতেই হলো। তিরুবনন্তপুরমের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যক্ষ, অনুজপ্রতিম বন্ধু কৃষ্ণন, ওখানে একটি গবেষণার কাজে আহ্বান জানালেন, কলকাতা থেকেই গবেষণা করতে পারবো। জীবিকার সমস্যা অনেকটাই মিটলো।

বন্ধুবান্ধবদের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। তাঁরাই তো বরাবর আমার জীবনযাপনের অন্যতম প্রধান অবলম্বন তথা হেতু। আলিপুরের ফ্ল্যাটে রবিবারের সাপ্তাহিক আজ্ঞা বহাল রইলো, যদিও জনসংখ্যা কমের দিকে। যাঁরা কিঞ্চিৎ সুবিধা অন্বেষণের আকাশকুসুম তাগিদে নিয়মিত আসতেন, তাঁরা আস্তে-আস্তে ঝরে পড়লেন, তবে অপেক্ষাকৃত দুর্দিনে প্রকৃত বন্ধুদের হদিশ পেতে তেমন দেরি হয় না। কিরণময় রাহা-রবি সেনগুপ্তরা তো ছিলেনই, নির্মল ও রুমাও যথাসম্ভব সঙ্গ দান করতে শুরু করলো, যেমন করলো একই-দালানে-থাকা রঞ্জিত সাউ ও তাঁর স্ত্রী মীরা। মানব, মালিনী-মিহির, অমিয় ও যশোধরা, এদেরই বা ভুলি কী করে! সুজিত আসা-যাওয়া অব্যাহত রাখলো; কলকাতাস্থ অনেক পার্টি সুহৃদও, সত্যব্রত সেন যাঁদের পুরোধা, প্রত্যক্ষ হাজির হয়ে, বা টেলিফোনের মারফত, যোগাযোগ জারি রাখলেন। নেতারা যখন দেখলেন, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি, রাগান্বিত বেফাঁস কথাবার্তা প্রকাশ্যে কোথাও বলিনি, তাঁরাও ধাতস্থ হলেন। অবশ্য পার্টি দফতরে যিনি অন্তরঙ্গতম ছিলেন, সুবোধ রায়, কোনওদিনই কারও পরোয়া করেন না, মান-অভিমানের ঋতুতেও তিনি দেখা করতে আসতেন। আশ্চর্য মানুষ সুবোধবাবু, চট্টগ্রাম বিদ্রোহে গভীরভাবে লিপ্ত ছিলেন, সতেরো বছর বয়সে আন্দামানে নির্বাসন, ওখানেই মার্কসবাদে দীক্ষা। পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী। তাঁর কর্তব্যপালনে কোনও ফাঁকিঝুঁকি নেই, নিবিড় অধ্যবসায়ের সঙ্গে পার্টির পুরনো দলিল-দস্তাবেজ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন, রাজ্য দপ্তরের অজস্র ঝামেলা সামলান। আদর্শে অবিচল, এখনও নিজের হাতে রান্না করেন, কাপড় কাচেন, কোনও ব্যাপারেই কারও মুখাপেক্ষী নন। স্পষ্টবাদিতায় সুবোধবাবুর জুড়ি নেই, দলের ভালো-মন্দ নিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলে সর্বদা চরিতার্থতাবোধ। অনেক সময় এমন হয়েছে প্রমোদ দাশগুপ্তর সঙ্গে কথা শেষ করে উঠে পড়ে তাঁকে বলতাম, ‘এবার একটু লিডার অফ দ্য অপজিশনের ঘরে যাচ্ছি’। প্রমোদবাব হকচকিয়ে গেলে পাশ থেকে সরোজ মুখোপাধ্যায় ব্যাখ্যা করে দিতেন, ‘বুঝলেন না, সুবোধের কাছে যাচ্ছে’। কল্পনা দত্তের মাসতুতো ভাই সুবোধবাবু, কল্পনাদিকে পার্টিতে নিয়েও এসেছিলেন তিনিই, দল ভাগাভাগি হওয়ার পর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যথেষ্ট আড়াআড়ি ছিল, অথচ, সাংসারিক ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত হয়েও, সুবোধবাবু আত্মীয়তার কতগুলি দায় বরাবর পালন করে গেছেন।

দলের নৈকট্যে এসে এত বিচিত্রস্বভাবের নিখাদ ভালোমানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, ভেবে মাঝে-মাঝে অবাক হই। সুরুল জমিদার বাড়ির সন্তান, সর্বস্বত্যাগী শ্রমিক নেতা, কমল সরকার, অসামান্য চরিত্রবল ও আদর্শনিষ্ঠা। হাওড়ার জয়কেশ মুখোপাধ্যায় ও পতিতপাবন পাঠক; হুগলির প্রবাদপ্রতিম সংগঠক বিজয় মোক; বীরভূম জেলা কমিটির বহুদিনের সম্পাদক, একটু খেয়ালি, কিন্তু পার্টির আদর্শে তদাত-প্রাণ, সুরেন বাড়ুজ্যে; মেদিনীপুর জেলায় পার্টি ভাগ হওয়ার পর দলকে যিনি তিলেতিলে গড়েছেন, মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হত্যার মামলায় যাঁর দ্বীপান্তর হয়েছিল, সুকুমার সেনগুপ্ত, দেখলে মনে হতো এমন দয়ালু মানুষ ঠিক যেন এই পৃথিবীর নন। আবদুল্লা রসুল কিংবা মটরদা, সৈয়দ শহীদুল্লা, দু’জনেই অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞায় নন্দিত মানুষ, বিরল বিনয়ে ভরপুর, সেই সঙ্গে সমান স্নেহশীল। অন্য মটরদা, নদীয়ার সমরেন্দ্রনাথ সান্যাল: তাঁর কাছ থেকেও তো কম স্নেহ ও প্রশ্রয় পাইনি। এঁরা সবাই এখন প্রয়াত।

এখানেই মুশকিল, কাকে ছেড়ে কার নাম করবো? তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা গুণধর মাইতি, আদর্শের ব্রত উদ্‌যাপনে তুলনা নেই, কিন্তু নম্র, নিঃশব্দ, এখনও তাই। প্রয়াত কৃষকনেতা হেমন্তকুমার রায়, গরিবদের অভয় জোটাতে, জোট বাঁধা শেখাতে নিজেকে যিনি, সচ্ছল জীবনের মায়া কাটিয়ে, পুরোপুরি বিলিয়ে দিলেন। পলাশ প্রামাণিকও এখন গত: জঙ্গি কৃষক নেতা বলে বাইরে পরিচিতি, কিন্তু দর্শন ও সাহিত্যে তাঁর আগ্রহ ও অন্তর্দৃষ্টি অবাক করে দিত। অহরহ মনে পড়ে শ্রীহট্টের একদা লোকসংগীত-রচয়িতা-হিশেবে-বিখ্যাত সুরথ পাল চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী অপর্ণাদির কথা, যাঁরা নীরব সংকেতে বুঝিয়ে গেছেন, পার্টিকে শুধু দিতে হয়, পার্টি থেকে কিছু প্রাপ্তির কথা দুর্বলতম মুহূর্তেও ভাবতে নেই। সমান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি পোড়-খাওয়া প্রাক্তন বিপ্লবী, উদ্বাস্তু আন্দোলনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা, তখনই আশি বছর বয়স পেরোনো প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তীকে। ছোটোখাটো মানুষ শান্তি ঘটক, বহু বছর রোগক্লিষ্ট, অতি সম্প্রতি প্রয়াত, এই মানুষটি বরানগর-বেলঘরিয়া-কামারহাটি অঞ্চলে অতীতে প্রাণপাত করে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন ও সেই সঙ্গে পার্টি সংগঠন মজবুত থেকে মজবুততর করেছেন।

হঠাৎ খেয়াল হলো, এতটা লিখেছি, কিন্তু গণেশদার কথা ভুলেই থেকেছি। নব্বুই-উত্তীর্ণ গণেশ ঘোষকে দেখলে বিশ্বাস করতে মুশকিল হতো এই মানুষটিই আমাদের শৈশবের-কৈশোরের প্রেরণা পুরুষ, সূর্য সেনের সহযোদ্ধা, দলের অকুতোভয় সৈনিক, এক সময়ে পার্টি কমরেডদের গেরিলা যুদ্ধে তালিম দিয়েছিলেন। দয়াতে-সৌজন্যে সদা আপ্লুত থাকা গণেশদার হৃদয়, পাত্র-অপাত্র বিচার নেই, অবিশ্রান্ত এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে পরোপকার সাধছেন। অবিশ্বাস্য তাঁর নম্রতাবোধ; সাম্যবাদী অঙ্গীকার, ছোটো-বড়ো সবাইকে সন্নত নমস্কার জানাচ্ছেন, বিনয়ে নুয়ে পড়ে। সত্যব্রত সেনের মুখে গণেশদার বিশ্রুত বিনয়ের একটি দুষ্টু গল্প শুনেছিলাম। গণেশদা কোনো উদ্বাস্তু পাড়ায় গেছেন, পুকুর পাড়ে কাঁখে-শিশু এক কিশোরীর সঙ্গে দেখা। গণেশদার সম্ভাষণ, ‘এই যে দিদি, নমস্কার হই, ভালো আছেন তো?’ কিশোরীর লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া: ‘এ কী, আমাকে আপনি বলছেন কেন গণেশদা, আমার বয়েস তো সবে ষোলো’, গণেশদার নিরুদ্বিগ্ন, সহর্ষ উত্তর: ‘তাতে কী, তাতে কী? তা কোলের সুন্দর শিশুটি আপনার সন্তান বুঝি?’ কিশোরীর প্রায়-আর্তনাদ উক্তি: কী যে বলেন গণেশদা, আমার তো বিয়েই হয়নি’। গণেশদার তরফ থেকে নিশ্চিন্ত উক্তি: ‘তাতে কী, তাতে কী।’

অগুন্তি মহিলা কমরেডদের কাছ থেকে প্রচুর স্নেহ লাভ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার; অনিলা দেবী, কনক মুখোপাধ্যায়, পঙ্কজ আচার্য, মঞ্জু গুপ্ত, বয়সে আমার বড়ো, দয়াবতী তাঁরা, সমকক্ষের সম্মান জানিয়েছেন। প্রিয়জনদের গরম দুধ খাওয়াবার জন্য, আমার সন্দেহ, পার্টির মহিলাদের মধ্যে একটি স্বাভাবিক ব্যাকুলতা আছে। ভরদুপুরে মেমারিতে বিনয় কোঙারের বাড়ি গিয়েছি, ওঁকে নিয়ে কলকাতায় ফিরবো, রানীদি, মহারানী কোঙার, চোখ রাঙিয়ে বকুনি দিয়ে আম-সহযোগে গরম দুধ গলাধঃকরণে বাধ্য করলেন। অন্য একটি ঘটনা: অধিক রাত্রিতে মেদিনীপুর থেকে ফিরছি, বাগনানের কাছে অন্ধকারে-দাঁড়িয়ে-থাকা একটি ট্রাকের সঙ্গে গাড়ি ধাক্কা খেল, আমার বা চালকের তেমন লাগেনি, কিন্তু লোক জমে গেল, খবর পেয়ে বাগনান থেকে নিরুপমা চট্টোপাধ্যায় ছুটে এসে গ্রেপ্তার করে পার্টি দফতরে নিয়ে গেলেন, চিকিৎসক ডাকলেন, তারপর, কী সর্বনাশ, ফের গরম দুধ, ঢক ঢক করে গিলতে হলো। এসব মুহূর্তে আরও বেশি করে বোঝা যায় কমিউনিস্ট পার্টি মিলিত সংসার, সুগম্ভীর কবিতার মধ্য দিয়ে ছেলেবেলায় যে-নীতিশিক্ষা হয়েছিল, তারই প্রতিধ্বনি: সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।

আরও একজনের কথা বলি। সাতষট্টি সালে বিধানসভার দর্শক গ্যালারি থেকে নন্দরানী দলকে প্রথম দেখি: বিধানসভায় সদ্য নির্বাচিত, প্রায়-কিশোরী, চঞ্চলা হরিণীর মতো সভার মধ্যে, ছটফট, ছুটোছুটি করছেন। যতবার মেদিনীপুর গেছি, ওঁর আদর্শে-আচরণে মুগ্ধ হয়েছি। এখন নন্দরানী পূর্ণ মন্ত্রী, তার উপর আস্ত দিদিমাও।

নিকটজন বিয়োগের মরশুমও ছিল এই বছরগুলি। পঁচাশি সালে পরিমল মিত্রের মৃত্যু, আরও এক মস্ত ভরসাস্থলের ভূতপূর্ব হয়ে যাওয়া। ওই বছরই পারিবারিক জীবনে প্রচণ্ড ধাক্কা, দেবু চৌধুরী চলে গেলেন। অনেকদিন থেকেই অসুস্থ ছিলেন, শেষ যেদিন নার্সিং হোমে দেখা করতে গিয়েছিলাম, দেখে খুশি হলেন, তবে এটাও বুঝলাম এক অদ্ভুত নিরাসক্তিতে তাঁর চেতনা সমাচ্ছন্ন, যেন বুঝতে পারছেন বিদায়ের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। কিংবা হয়তো উনি বুঝতে পারছিলেন না, আমিই ওরকম ধারণার ঘেরাটোপে বন্দী, বিষাদে সমস্ত অন্তঃকরণ ছেয়ে এলো। অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে আমার বিশ্বাস নেই, তবু কী করে যেন অনেকেরই মুখোমুখি হয়ে হঠাৎ মৃত্যুর যবনিকা চোখের সামনে ভাসতে দেখেছি; যাঁদের ক্ষেত্রে দেখেছি, তাঁরা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গত হয়েছেন।

তেষট্টি সালে কলকাতায় স্থিত হওয়ার সময় থেকেই দেবুদার সংসারের সঙ্গে আমরা জড়ানো। দেবুদা সমর সেনের বন্ধু, একই সান্ধ্য আড্ডা, তাই অহরহ দেখা না হয়ে উপায় ছিল না, তা ছাড়া শচীনদার অনুজ, অচ্ছেদ্য যোগসূত্র। হেনাদি একটু একগুঁয়ে, কিন্তু আন্তরিকতায় ভরপুর। দেবুদাদের জ্যেষ্ঠ দুই পুত্র, খোকন, অরূপ, ও ছোট্ট, স্বরূপ, আমার অনুরক্ত, চার্চিল চেম্বার্সে থেকে মুম্বইতে ওরা যখন স্কুলে পড়তো, তখন থেকে। ওদের বোন, লালি, বালিকাবয়সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতো না আমরা স্বেচ্ছায় মার্কিন দেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করেছি; দু’ চোখ গোল করে তার বিস্ময়সূচক উক্তি এখনও কানে বাজে, ‘মেরিকা, ইটস ডিভাইন’। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘নায়ক’ ছবিতে লালিকে একটু ক্ষণের জন্য ব্যবহার করেছিলেন: বাংকের উপর থেকে বাচ্চা মেয়ে চোখ গোল করে মুগ্ধ আবেশে নিচের আসনে উপবিষ্ট নায়ক উত্তমকুমারকে দেখছে, সেই বালিকা লালি৷ পরে কিছুদিনের জন্য শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েছিল, সেখানে অশোক রুদ্রের পাল্লায় পড়ে ঘোর নকশালপন্থী বনে যায়। তবে ফাগুনের ফুল যায় ঝরিয়া ফাগুনের অবসানে, যথা-নিয়মে লালি নিজের শ্রেণীআনুগত্যে ফেরে।।

খোকন-ছোট্ট কলকাতায় আমাদের ছায়াসহচর হয়ে ছিল। যে কোনও সমস্যায় ওদের তলব করতাম, দ্রুত মুশকিল আসান হয়ে যেত। চৌধুরীরা অসম্ভব উদারমনা, সেই সঙ্গে অসম্ভব খেয়ালিও। পরিবারের দোষগুণগুলি দুই ভাইয়ে পুরোপুরি বর্তেছিল, তবে ভাইদের মধ্যে স্বভাবগত তফাতও। থোকন সতত বহির্মুখী, হইহুল্লোড়ে পাড়া মাতাতে ওস্তাদ, ছোট্ট—সে ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টে আমার ছাত্রও ছিল— তুলনায় চাপা। বাবার ব্যবসা বাড়ানোর দিকে দু’জনেরই টগবগে উৎসাহ: খোকন ঝুঁকি নিতে বেপরোয়া, ছোট্ট খানিকটা হিশেবি। বাবার মৃত্যুর পর ব্যবসা ওরা ভাগাভাগি করে নেয়, তা হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। অসতর্ক বিনিয়োগ করে দু’জনকেই প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মস্ত পরিতাপের কথা, উভয়ের সাংসারিক জীবনও তেমন সুখের হয়নি। হয়তো ব্যবসায়িক বিপর্যয়হেতুই খোকনের হৃদ্‌যন্ত্রে ব্যাপক গোলমাল দেখা দেয়, ওকে পরিপূর্ণ বিশ্রামের মধ্যে থাকতে হয় মাসের পর মাস। একটু-একটু করে সুস্থ হচ্ছিল, কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে ফের পীড়াক্রান্ত, কয়েক মাস বাদে মৃত্যু। খোকনের গত হওয়ার কয়েক মাস আগে ছোট্টও নিষ্ক্রান্ত: রহস্যজনক মৃত্যু, আমাদের সন্দেহ, অপঘাতজনিত। অনেকদিন ধরে আশা পোষণ করে আসছিলাম নিঃসন্তান আমরা, শেষ জীবনে যখন অসমর্থ হয়ে পড়বো, ভয় কী, খোকন-ছোটু ভ্রাতৃদ্বয় যথাযথ দেখাশোনা করবে। সেই আশা অচিরে মিলিয়ে গেল।

যেন মৃত্যুর মিছিল। পরম শুভানুধ্যায়ী স্নেহাংশুকান্ত আচার্যও চলে গেলেন ছিয়াশি সালের অগস্ট মাসে। দিল্লিতে বহুদিনের নিকট বান্ধবী রাজ থাপরের জীবনাবসান সাতাশি সালের এপ্রিলে, আমার জন্মদিনে। স্বামী রমেশ চিরদিনই একান্ত রাজ-নির্ভর; তার মানসিক শক্তি ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ। অগস্টের বাইশ তারিখে আমাকে লেখা রমেশের চিঠি, ‘উইদাউট হার, আই মিয়ারলি প্লড অন।’ পঁচিশ তারিখে দিল্লি থেকে টেলিফোন, রমেশ ওই দিন সকালে প্রয়াত। ঠিক দু’দিন বাদে দুপুরবেলা হাসপাতাল থেকে ফোন পেলাম, সমর সেনের জীবনায়ু শেষ, আমাকেই বাড়ি বয়ে গিয়ে সুলেখা সেনকে জানাতে হলো।

যে-রাজনৈতিক স্বপ্ন কুড়ি বছর আগে সমরবাবু দেখতে শুরু করেছিলেন, তা কুঁকড়োনো, পুরনো ভাবসখারা ইতিউতি সরে পড়েছেন। ‘ফ্রন্টিয়ার’ চালাতেন, অন্য কোনও করণীয়র অভাবেই হয়তো চালাতেন, তবে প্রতি সপ্তাহে না বেরোলেও তেমন ব্যত্যয় হতো না। আমার দিক থেকে এইটুকু সান্ত্বনা, শেষ পর্যন্ত তিনি অন্তত এই বিশ্বাসে স্থিত হয়েছিলেন, আমি, অশোক মিত্র, তাঁর কাগজের চিন্তা-আদর্শের সঙ্গে আপাত-বিশ্বাসঘাতকতা করলেও, অন্তত তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে করিনি।

জীবনে অনেক ঘাটের জল খেয়েছি, অনেক বাটে চরে বেড়িয়েছি, সমরবাবুর চেয়ে ক্ষুরধার বুদ্ধির মানুষ খুব কম চোখে পড়েছে, তাঁর মতো আদর্শবাদী মানুষও, নাস্তিকতার চাদরে নিজের প্রতিভা সর্বদা ঢেকে রেখেছেন। তাঁর অন্ত্যেষ্টিতে তেমন ভিড় ছিল না, তাঁর নিঃসঙ্গতাকে নমস্কার জানাতেই যেন ছিল না। একটি-দু’টি স্মরণসভা: যাঁরা স্মরণ করতে এলেন, তাঁদেরও অনুচ্চ, প্রায়-অর্ধমনস্ক কণ্ঠস্বর। কারও-কারও কাছে আশ্চর্য মনে হলেও সবচেয়ে আবেগজড়িত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিল পূর্বোল্লিখিত তরুণ সাংবাদিকটি তার সম্পাদিত দৈনিক পত্রিকায়। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বন্ধুবান্ধবদের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মান-জানানো একটি সঙ্কলনগ্রন্থ সমরবাবুর হাতে তুলে‌ দিতে পেরেছিলাম। সেটি হাতে নিয়ে সমরবাবুর স্বভাবসিদ্ধ তির্যক মন্তব্য: ‘এটা ছাপাতে যা খরচ পড়েছে সেই টাকাটা যদি কেউ আমার হাতে তুলে দিত!’

হঠাৎ আবিষ্কার করলাম পৃথিবী ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে, কূজনহীন কাননভূমি, দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে। যে সব মানুষদের সঙ্গে খোলস ছেড়ে আড্ডা দেওয়া যায়, গল্প করা যায়, হৃদয় নিঙ্‌ড়ে আদান-প্রদান করা যাঁদের সঙ্গে সম্ভব, তাঁদের সংখ্যা হ্রস্বমান। শচীনদা-দেবুদার পরের দুই ভাই, হিতেন চৌধুরী ও শঙ্খ চৌধুরী, একজন মুম্বইতে, অন্যজন দিল্লিতে, আরও কাছাকাছি চলে এলেন, আমিও তাঁদের অধিকতর নিকটবর্তী হলাম। ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্ছল শঙ্খ চৌধুরী, সবচেয়ে বেশি নীরবতার উপাসক হিতুবাবু। হিতুবাবুর রোমাঞ্চকর জীবনযাপন, কিন্তু শেষের দিকে ধীর লয়ে প্রবেশ। মধ্য যৌবনে অনেক মহিলার মনোহরণে সফল, অথচ বিয়ের ফাঁদে ধরা দেননি, উনি বার্ধক্য অবস্থায় পৌঁছুবার পর প্রায়ই মনে হতো খুব ঘরোয়া মন ওঁর, গুছোনো মন, যে-মন অথচ কোনও উপযুক্ত আধার পেল না। পরিণত বয়সে বিবাহবদ্ধ হলেন, তবে তা থেকে, আমাদের অনেকেরই সন্দেহ, শান্তির থেকে অশান্তির উদ্রেকই বেশি হয়েছিল। শচীনদার প্রয়াণের পর প্রায় সিকি শতাব্দী হিতুবাবু ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির হাল ধরে ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক অছি হিশেবে। নব্বুই সালে অছিদের সভা ডাকা হলো ব্যাঙ্গালোরে, আমরা জড়ো হলাম। হিতুবাবু কিছুদিন ধরে হৃদ্‌রোগের শিকার, সাবধানে থাকতে হয়, নিয়ম করে ওষুধ খেতে হয়। আমাদের চেয়ে অনেক জ্যেষ্ঠ, তা হলেও তিনিই আমাদের দেখাশোনা করলেন, তত্ত্বাবধায়ক অছির ভূমিকা। বৈঠক শেষে সবাই ফিরে এলাম, একমাত্র হিতুবাবু থেকে গেলেন। তাঁর পুরনো দিনের বান্ধবী দেবিকারানী ব্যাঙ্গালোরের কাছে এক গ্রামে মস্ত বাগানবাড়ি নিয়ে থাকেন, দেখা করে ফিরবেন। কলকাতায় পৌঁছেই মর্মান্তিক খবর, হিতুবাবুও নেই: দেবিকারানীর সঙ্গে একটি পুরো দিন কাটিয়েছেন, হইহল্লা করেছেন, পুরনো সময়ের স্মৃতিতে দু’জনে ডুবে গেছেন, কিন্তু গাড়িতে অতটা রাস্তা যাওয়া-আসার ধকল হিতুবাবু সহ্য করতে পারেননি, রাত্তিরে ব্যাঙ্গালোরে ফিরে বুকে অসহ্য ব্যথা অনুভব, চিকিৎসক এসে পৌঁছুবার আগেই জীবনান্ত।

দলের সঙ্গে মানাভিমানের পালা আমার তেমন দীর্ঘায়িত হয়নি। সাতাশি সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজীব গান্ধি, সম্ভবত তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও অবিবেচনার কারণেই, মহা উৎসাহে পশ্চিম বাংলা তোলপাড় করে বেড়ালেন, এবার নাকি জ্যোতি বাপুজীকে অবসরগ্রহণ না করিয়ে তিনি ছাড়বেন না। কী চক্রে জানি না, নির্বাচনে তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা আমার সুপরিচিত সেই দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, তাঁর পত্রিকা জুড়ে প্রধান মন্ত্রীর গদগদ স্তবসাধনা, একমাত্র আমার পাক্ষিক কলামে রাজীব গান্ধিকে নিয়মিত তুলে আছাড় মারা। সম্পাদকটি একদিন কী একটি বক্র উক্তি করেছিল এই সম্পর্কে, সঙ্গে-সঙ্গে আমি বলে দিই, তার তরফে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ হলে লেখা বন্ধ করে দেবো। খানিক বাদে মহা অনুতাপের সঙ্গে তার বাড়িতে চলে এসে ক্ষমা প্রার্থনা।

নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজীব গান্ধি সর্বত্র বলে বেড়াচ্ছিলেন তিনি পশ্চিম বাংলাকে এক হাজার কোটি টাকা সাহায্য দান করেছেন। শৈলেন দাশগুপ্তের অনুরোধে পার্টির দৈনিক পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে প্রমাণ দাখিল করলাম, পুরো ব্যাপারটাই শূন্য কুম্ভের আস্ফালন, আসলে তিনি মাত্র কুড়ি কোটি টাকার ব্যবস্থা করেছেন। নির্বাচনের ফল বেরোলো, বিধানসভায় কংগ্রেসের আসন সংখ্যা চল্লিশে গিয়ে দাঁড়ালো, জ্যোতিবাবু চরিতার্থতার হাসি হাসলেন।

অনুরুদ্ধ হয়ে ‘গণশক্তি’-তে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত লিখতে শুরু করলাম, সম্ভবত প্রতি বুধবার। দুই-একবার যখন লেখা বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, মনে পড়ে পত্রিকার তরফ থেকে বলা হয়েছিল, আমার লেখা যেদিন বেরোয়, বিক্রি নাকি কয়েক হাজার বেড়ে যায়, সুতরাং ওরকম চিন্তা যেন বিসর্জন দিই।

মহাকরণে সকাল-সন্ধে পরিশ্রম নেই, হাতে অঢেল সময়, তা আড্ডায় অপব্যয় করতে আমার কোনওদিন বিবেকদংশন ছিল না। অন্য বন্ধুদের মতো সাহিত্যিক বন্ধুদের সংখ্যাও প্রাকৃতিক নিয়মে কমছে। অরুণকুমার সরকার-আতোয়ার রহমান-সুরঞ্জন সরকাররা নেই, মাঝে-মাঝে হতোদম হয়ে পড়ি, তবে রবি সেনগুপ্ত-ধ্রুব মিত্রের মতো সুহৃদ্‌জন, আমার মন্ত্রিত্বহীনতা সত্ত্বেও, সাহচর্য দানে বিরত হননি৷ কিরণময় রাহা তো ছিলেনই, পুরনো দিনের আরও অনেক বন্ধু, যাঁরা বিলুপ্ত হননি, তাঁরাও। সত্যপ্রসন্ন দত্ত প্রায় প্রতি রবিবার শহরের পূর্ব প্রান্ত থেকে অনেক রাস্তা ঠেঙিয়ে নিয়মিত উপস্থিত। আমাদের সঙ্গে রাবিবারিক প্রাতঃরাশ তাঁর নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে অনেক এলোমেলো শিশির না-ভেজা গল্প। নানা বিষয়েই তাঁর সঙ্গে মতের অনৈক্য, ট্রটস্কিবাদের ভূত তাঁর মাথা থেকে নামেনি, কিন্তু এমন শুভাকাঙ্ক্ষী জীবনে খুব কম পেয়েছি। বোধ হয় এই সময়েই গণেশচন্দ্র অ্যাভেনিউ-র ফ্ল্যাটে একদিন শিলু পেরেরাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল; ক’দিন আগেই হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ খবর রাখেননি।

রাবিবারিক আড্ডায় তখন যাঁরা হাজির থাকতেন, তাঁরা নৃপেন্দ্র সান্যাল, অসীম সোম, ‘পানীয়ন’ গোষ্ঠীর অন্যতম প্রাণপুরুষ, আমার ঢাকাস্থ সখা, অজিত গুপ্ত, সুজিত, খোকন, ছোট্টু কখনও-কখনও। স্বার্থাস্বার্থরহিত এই আড্ডা, আড্ডার জন্যই আড্ডা। পৃথিবীর কোনও বিষয় বা গুজবই উল্লিখিত না-হয়ে যেতো না। মাঝে-মধ্যে বহু বছর ধরে সঞ্চিত রেকর্ড-টেপের স্তূপ পেড়ে গান শোনা, ঘণ্টার নিয়ম না মেনে, এক-একদিন এক-একজনের গান, কোনওদিন ইন্দুবালা-আঙুরবালা-আশ্চর্যময়ী দাসী-মিস লাইট-কৃষ্ণচন্দ্র দে-র, কোনওদিন শচীন কর্তার, কোনওদিন ভীষ্মদেব-জ্ঞান গোস্বামীর, অথবা দিলীপকুমার রায়ের, নয়তো জর্জ বিশ্বাস ও সুচিত্রা মিত্রের, নয়তো কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

বন্ধুদম্পতি ড্যানিয়েল ও অ্যালিস থর্নার কলকাতায় এলেই আমাদের ফ্ল্যাটে থাকতেন। থর্নারদের সঙ্গে আলাপ শচীনদার সূত্রে, তারপর আবিষ্কার করা গেল সংযোগের আরও অনেক সেতু। ওঁরা লন্ডনে ছাত্রাবস্থা থেকে হাকসারের বন্ধু, চণ্ডীরও; জ্যোতিবাবুর সঙ্গেও সামান্য পরিচয় ছিল। ম্যাকার্থি-পর্বে ওঁদের উপর অনেক হামলার ঘটনা ঘটেছিল আমেরিকায়। তিতিবিরক্ত হয়ে থর্নাররা সোজা ভারতবর্ষে চলে আসেন, ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এখানে, প্রধানত মুম্বইতে, তাঁদের বিদ্যাচর্চা তথা জীবিকার্জন। তারপর সরবন থেকে আমন্ত্রণ, তখন থেকে ড্যানিয়েল প্যারিসে, অ্যালিসও অবশ্য। ইওরোপে যাওয়া-আসার উপলক্ষ্যে আমরা প্যারিসে থামবোই, ওঁদের সস্নেহ আতিথ্যে। জীবনে অনেক ঝড়-ঝাপটা ওঁদের উপর দিয়ে গেছে, কিন্তু কখনও নীতিভ্রষ্ট হননি, ওঁদের ভারতপ্রেমেও কোনওদিন ভাঁটা পড়েনি। থর্নারদের জ্যেষ্ঠা কন্যা সুজি কর্কট রোগে ভুগে অসহ্য কষ্ট পেয়ে মারা যায় আজ থেকে সাঁইতিরিশ বছর আগে; এখনও তার চরিত্রমাধুর্যের স্মৃতি আমাকে উতরোল করে। তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র নিকোলাস-এর মতো বিবিধ বিষয়ে জ্ঞানমণ্ডিত মানুষ খুব কম দেখেছি, অথচ নিজেকে জাহির করা একেবারে নেই।

মেয়ের যা হয়েছিল, সেই একই রোগে ভুগে ড্যানিয়েল চুয়াত্তর সালে প্রয়াত, তবে অ্যালিসের সঙ্গে যোগাযোগ এখনও অক্ষুণ্ণ। প্রতি শীতে অ্যালিস নিয়ম করে ভারতে আসেন, দেশময় ওঁর চেনা-জানার বৃত্ত, কয়েকটা দিন আমাদের সঙ্গে কলকাতায় কাটানো। একবার অ্যালিস এসেছেন, বন্ধুবান্ধবরা মিলে যে-ঘরে সাধারণত আড্ডা দিই, সেখানে আমার পড়ার টেবিলও, তাতে অ্যালিস কিছু কাজকর্মে রত, আমরা বাইরের ঘরে নিজেদের স্থানান্তরিত করেছি। একটি-দু’টি অন্য কারও গানের রেকর্ড বাজাবার পর জর্জ বিশ্বাসে উপনীত হয়েছি, তাঁর কণ্ঠের ঐশ্বর্য ও দার্ট ফ্ল্যাটময় ঝরে-ঝরে পড়ছে। হঠাৎ দেখি অ্যালিস তাঁর পড়াশুনো ছেড়ে উঠে এসেছেন। বাংলা জানা নেই, রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যাকরণ বা বিন্যাসের সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত, কিন্তু জর্জ বিশ্বাসের প্রায়-ব্যারিটোন কণ্ঠলাবণ্যে অ্যালিস মুগ্ধ: এমন গলা, তাঁর নির্দ্বিধা ঘোষণা, কোটিতে এক। উপস্থিত সবাই আপ্লুত বোধ করলাম।

একটু অন্য বৃত্তান্ত। কেউ-কেউ কখনো-কখনো প্রশ্ন করেছেন, এই যে এতগুলি বছর মহাকরণে কাটিয়ে, ইতস্তত ছড়ি ঘুরিয়ে এলাম, কী-কী কর্তব্য পালন করে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছি। আমার জবাব শুনে তাঁরা অবধারিত আশ্চর্য হয়েছেন। না, আমার প্রধান কৃতিত্বের দাবি কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের যুদ্ধে গদা-ঘোরানোর জন্য নয়; রাজস্ব ব্যবস্থা, বিক্রয়করব্যবস্থাসুদ্ধু, সিজিল-মিছিল করে রাজ্য সরকারের উপার্জন অনেকগুণ বাড়ানোর পথ সুগম করবার জন্যও নয়; যারা জনসাধারণকে চড়া সুদের লোভ দেখিয়ে প্রবঞ্চনা করছিল, তাদের ঠান্ডা করে দেওয়ার জন্যও নয়: এসব তো অবশ্যকরণীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তাদের নিয়ে শ্লাঘাবোধ অবান্তর। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভঙ্গিতে তবু যদি নিজেকে ব্যঙ্গ করে শুধোই, ‘সাধিলাম কী সুকৃতি, হবো যার প্রসাদে অমর’, আমার ত্বরিত উত্তর: তিনটি বিষয়ে আমার অধিকতম গর্ববোধ। প্রথম উল্লেখ্য, যে লেখককে ভুলেইছিলেন সবাই, ‘রমলা’ উপন্যাস যাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছিল, যাঁর রচিত ‘মায়ের দিন’ আমার বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প, অশীতিপর মণীন্দ্রলাল বসুর সম্মানে সরকার থেকে অভিনন্দনসন্ধ্যার আয়োজন। অন্নদাশঙ্কর রায় সভাপতিত্ব করেছিলেন, অনেক আবদার-অনুরোধ করে শেষ পর্যন্ত মণীন্দ্রলাল বসুকে সভায় হাজির করাতে সমর্থ হয়েছিলাম; শেষ পর্যন্ত ভারি খুশি হয়েছিলেন তিনি।

দ্বিতীয় সফলতা, গ্রামোফোন কোম্পানিকে উপরোধ জানিয়ে কনক দাসের আটাত্তর-ঘূর্ণি রেকর্ডগুলি থেকে জড়ো করে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের রেকর্ড প্রকাশের ব্যবস্থা করা। অসম্ভব লাজুক, গুটিয়ে-থাকা মানুষ কনকদি, তিনিও খুব খুশি হয়েছিলেন। বোধহয় আরও খুশি হয়েছিলেন রেকর্ডটি বাজারে ছাড়বার দিন গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁর আদরের বোনপো সত্যজিৎ রায়কে হাজির করেছিল বলে।

তৃতীয় দফা শ্লাঘাবোধ, জর্জ বিশ্বাসকে সরকারি সংবর্ধনা জানানো। কোনও কারণে বামফ্রন্ট সরকার সম্বন্ধে সামান্য অভিমান পোষণ করতেন জর্জ বিশ্বাস। আমার ধনুর্ভঙ্গ পণ, ওঁকে সংবর্ধনা দিতেই হবে, এটা আমাদের ন্যূনতম সামাজিক কর্তব্য। কিছুতেই ওঁকে রাজি করাতে পারছিলাম না। স্নেহাংশুবাবুকে পাকড়ালাম, তিনি এক সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে রাসবিহারী অ্যাভেনিউতে উড়নচণ্ডী গায়কের একতলার ফ্ল্যাটে হাজির। ময়মনসিংহ জেলার পুরনো অনুরাগ-আনুগত্য, কুমার বাহাদুর স্বয়ং আর্জি জানাতে এসেছেন, জর্জ বিশ্বাসের সম্মতি না-দিয়ে উপায় কী! আনন্দসন্ধ্যায় যোগ দিয়ে তিনিও, আমার ধারণা, যথেষ্ট পুলকিত বোধ করেছিলেন, নিজের থেকেই অনেকগুলি গান গেয়েছিলেন।

কাহিনীর ভিতরে ফের অন্য কাহিনী না পেড়ে উপায় নেই। শান্তিনিকেতনে-পড়া নচ্ছার বন্ধুদের মুখে গল্প শুনেছিলাম, যে-যে শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে শিশুভবনে-পাঠভবনে পড়িয়েছেন, বার্ধক্যে পৌঁছেছেন, প্রায় অথর্ব হয়ে গেছেন, আদৌ আর পড়াতে পারছেন না, অথচ অবসর গ্রহণ করছেন না, ছাত্রদল একটি বিশেষ দিবস বেছে নিয়ে ঘটা করে তাঁদের সম্মান জ্ঞাপন করতো। এবং, কী আশ্চর্য, সম্মান জানানোর তিন-চার মাসের মধ্যেই সামান্য অসুখে ভুগে প্রতিটি মাননীয় শিক্ষকমহোদয় প্রয়াত হতেন। কাহিনীটি শান্তিনিকেতনে রটে যাওয়ার পর কোনও অশীতিপর শিক্ষকই সম্মানদিবসে যোগ দিতে রাজি হতেন না, ছাত্রের পাল ধেয়ে আসছে দেখলেই দ্রুত পালাতেন।

ললাটলিখন, আমার উৎসাহ-আয়োজনের ক্ষেত্রেও সেরকম দুর্বিপাক ঘটলো। কনকদি-মণীন্দ্রলাল বসু-জর্জ বিশ্বাসকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো, কনকদি তো জর্জ বিশ্বাসের বউদিও, দেবরকে সম্মান জানানোর সন্ধ্যায় তাঁর সস্নেহ উপস্থিতির কথা এখনও মনে পড়ে। সংবর্ধনাজ্ঞাপনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এঁরা তিনজনই পর-পর প্রয়াত হলেন। কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না, তবু ভীষণ দমে গেলাম। যাঁরা গেলেন, তাঁদের হয়তো যাওয়ার সময় হয়েছিল, কিন্তু আক্ষেপ তো তার জন্য কম নয়। অন্য একটি কৌতুক প্রসঙ্গও এখানে মনে পড়ছে। কনকদির মৃত্যুর পর, বিষণ্ণ আমি, একটি আবেগ-ঠাসা প্রবন্ধ লিখি, যা পত্রিকায় পড়ে কলকাতার জনৈক কট্টর কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী তরুণ বুদ্ধিজীবী রেগে অগ্নিশর্মা, ঝটপট ওই পত্রিকায় লম্বা চিঠি পাঠালেন: ‘কমিউনিস্টদের কী আস্পর্ধা! তারা কনক দাসের সম্পর্কে লিখতে সাহস পায়, তারা তো বিজাতীয়, দেশদ্রোহী, রবীন্দ্রনাথের গানের মাহাত্ম্য তারা কী বুঝবে?’

মন্ত্রী থাকাকালীন কী-কী করিনি এমন কোনও গর্ববোধের তালিকা আছে কিনা, তা যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, আদৌ ভড়কাবো না, আমার সেই তালিকাও তৈরি। কোনও সেতু বা রাস্তা বা নতুন সরকারি দালান ‘উদ্বোধন’ অনুষ্ঠানে কখনও-কখনও যদিও বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে, সারা পশ্চিম বাংলা ঢুঁড়লেও কেউ আমার নামে কোনও উদ্বোধনফলক পাবেন না। সল্ট লেক স্টেডিয়াম নির্মাণের ঋতুতে দিনের পর দিন কেন্দ্রীয় সরকার-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির সঙ্গে ঝুলোঝুলি করে যেমন অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছি, যে কেন্দ্রীয় সংস্থা স্টেডিয়াম নির্মাণের দায়িত্বে, ব্যয়ের অঙ্ক একটু কমাতে তার কর্তাব্যক্তিরা রাজি আছেন কিনা, তা নিয়েও প্রচুর ঘর্মক্ষয় করেছি; কিন্তু আজ পর্যন্ত স্টেডিয়ামে গিয়ে মাঠের চেহারা দেখিনি, দেখতে অবশ্য কেউ নেমন্তন্নও করেননি আমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *