কুড়ি
দিল্লিতে আমার অবস্থানেও ইতিমধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে। সত্তর সালের গোড়ার দিকে কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনের সভাপতিত্ব ছেড়ে ভারত সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিশেবে যোগ দিয়েছি। পশ্চিম বাংলায় যুক্ত ফ্রন্টকে ভদ্রমহিলার উত্ত্যক্ত করা সত্ত্বেও, তখনও বামপন্থীরা ইন্দিরা গান্ধি সম্পর্কে আশা পোষণ করে যাচ্ছিলেন। ঊনসত্তর সালের মাঝামাঝি কংগ্রেস দু’ভাগ হলো, লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে ইন্দিরা বামপন্থীদের দ্বারস্থ হলেন, কয়েক মাস বাদে রাজন্যভাতা বিলোপ, ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থার জাতীয়করণ ঘোষণা, সারা দেশে উত্তেজনা, হুলুস্থুল। এই পরিস্থিতিতে শুভানুধ্যায়ীদের তথা রাজনৈতিক বন্ধুদের উপদেশ-অনুরোধ-উপরোধ: মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদগ্রহণের যে-আহ্বান আমার কাছে এসেছে, তা যেন প্রত্যাখ্যান না করি। তাঁদের যুক্তি, সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অর্থমন্ত্রকে বসেন, সেই মন্ত্রক প্রতিক্রিয়াশীল আমলাবৃন্দে সমাচ্ছন্ন, আমি ঢুকতে পারলে গেলে সম্ভবত ভিতর থেকে কলকাঠি নেড়ে দক্ষিণপন্থীদের চক্রান্ত অন্তত খানিকটা ব্যর্থ করতে পারবো। ইন্দিরা গান্ধি মোরারজী দেশাইকে অর্থমন্ত্রীর আসন থেকে বিচ্যুত করেছেন, নিজে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, যাঁরা আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন, সমাজবিপ্লবের তেমন আর দেরি নেই, বিশেষ করে একদা হ্যারি পলিট-রজনী পালমা দত্ত-ভক্ত পরমেশ্বর হাকসার যেহেতু প্রধান মন্ত্রীর দফতরে সর্বেসর্বা।
অবস্থানভিত্তিক কুহেলিকায় আমার মতো নিকষ নাস্তিকও কিছুটা বিলাসকল্পনায় তখন মজে গিয়েছিলাম। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হলো, এবার গরিবদের, বেকার ছেলেদের, ছোটো চাষী-ভাগচাষীদের ব্যাঙ্ক থেকে নামমাত্র সুদে টাকা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, এমন সব ফন্দি আঁটছিলাম; নতুন বছরের বাজেটে কুলককুলসুদ্ধু ধনী পরিবারের উপর কড়া হারে সম্পত্তিকর বসানোর প্রস্তাবও ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। তবে কোনওই লাভ হলো না, স্বতন্ত্র পার্টির কথা ছেড়েই দিলাম, কংগ্রেস দলের মধ্যেই ভূস্বামী সম্প্রদায়ের রাঘব-বোয়াল প্রতিনিধি, তাঁরা সরোষ প্রতিবাদ জানালেন, এমনকি, আমাকে যা ভীষণ আশ্চর্য করলো, সি পি আই-এর পক্ষ থেকেও প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বিবৃতি। ক’দিন বাদে কী কাজে অচ্যুত মেনন নর্থ ব্লকে আমার ঘরে এলেন, তিনি তখন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী কিনা মনে আনতে পারছি না , তাঁকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁর দল থেকে এমন বিবৃতি বেরোলো কেন, আমরা খুব অসহায় বোধ করছি। অচ্যুত মেননের সততার-সাধুতার তুলনা নেই, ঈষৎ বিব্রতবোধ করে একটু ক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন: ‘বিহার ও অন্ধ্র প্রদেশের কমরেডদের প্রবল আপত্তি ছিল’। সহজেই বুঝে নিলাম, দলের প্রতি অনুগত মধ্যচাষীরা অনেকেই ইতিমধ্যে ধনী কৃষকে রূপান্তরিত হয়েছেন।
নতুন পদে আমার যোগ দেওয়ার চার মাসের মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব যশোবন্ত রাও চ্যবনকে ছেড়ে দিলেন, তবু অন্তত ওই ক’মাস তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ছেষট্টি সালে উনি প্রধান মন্ত্রী হিশেবে শপথ নেওয়ার পর প্রথম দিকে বেশ কয়েকবার ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়েছি। উনি নিমন্ত্রণ জানাতেন, বিভিন্ন বিষয়ে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা থেকে জ্ঞানান্বিত হবার জন্য। আমার ধারণা, তখন যাঁরা তাঁর আশেপাশে প্রধান পরামর্শদাতা রূপে বিরাজ করতেন, তাঁদেরই উৎসাহে এ-সমস্ত বৈঠক ডাকা হতো, প্রধান মন্ত্রীর জনসংযোগ যাতে উন্নত স্তরে পৌঁছয়, সেই লক্ষ্যে। ইন্দিরা গান্ধিকে তখন হালকা মেজাজের চঞ্চলা হরিণী বলেই মনে হতো: সভায় বসে সর্বক্ষণ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, পাশে উপবিষ্ট আমলামশাইয়ের সঙ্গে অহরহ ফিসফাস কথা বলছেন, আলোচনার বিষয়ে আদৌ যেন আগ্রহ নেই। সত্তর সালে মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিশেবে যখন ফের তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো, দেখলাম সম্পূর্ণ অন্য মানুষী। প্রচুর পরিশ্রম করতে শিখেছেন, এক ধরনের জেদ সমস্ত চেতনা অধিকার করে, প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কেও তাঁর আগ্রহ, শুধু নিজেই খাটছেন না, তাঁর চারপাশে যাঁরা আছেন, তাঁদেরও খাটাচ্ছেন। তাঁর একাগ্রচিত্ততার দু’টি উদাহরণ পেশ করছি। সংসদের অধিবেশন চলাকালীন প্রতিটি মন্ত্রীকে সপ্তাহে একদিন লোকসভায় ও একদিন রাজ্যসভায় এক ঘণ্টা ধরে সদস্যদের পেশ-করা ‘তারকাখচিত’ প্রশ্নের মৌখিক উত্তর দিতে হয়, লিখিত উত্তরের সংযোজন-পরিপূরণ হিশেবে। সংসদের বৈঠক বসে সকাল এগারোটায়, ইন্দিরা গান্ধি আমাদের মতো চার-পাঁচজন সচিব-পরামর্শদাতাদের নিয়ে দু’দিনই সকাল সাড়ে ন’টা থেকে শুরু করে এগারোটা পর্যন্ত বৈঠক করতেন। আমাদের দিকে সম্ভাব্য ‘অতিরিক্ত’ প্রশ্ন ছুঁড়তেন, আমরা তার জবাব দেবো, হয়তো আমাদের কারও দেওয়া উত্তরই তাঁর পছন্দ হলো না, কিংবা আমার উত্তর পছন্দ হলো না, আমার পাশে বসা রাজপুরুষকে তাঁর মতো করে উত্তর দিতে বললেন, হয়তো সেই উত্তরের সূত্র ধরে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন, তার উত্তর পছন্দ না হলে ফের প্রশ্ন, প্রশ্নবাণে আমরা জর্জর, কিন্তু এই পদ্ধতিতে প্রতি সপ্তাহে তাঁর সঙ্গে দু’দিন নিয়মিত বৈঠক করার ফলে, তাঁরও যেমন সংসদে সদস্যদের মৌখিক প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব দিতে সপ্রতিভতা এলো, অনুরূপ আমাদেরও জ্ঞানের প্রসার ঘটলো। তাঁর বর্ধমান মনোযোগের আর একটি দৃষ্টান্ত: বাৎসরিক কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে, তা নিয়ে সংসদে বিতর্ক চলছে, বিতর্কের জবাব দেবেন প্রধান মন্ত্রী, কয়েকটি কর প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংশোধনী প্রস্তাব-সহ তাঁর জবাবি বক্তৃতার খসড়া প্রস্তুত, তাতে একটি বিশেষ কর-সংশোধনী উল্লেখ করা হয়নি, আমাদের কাছে সেটা তেমন জরুরি বলে ঠেকেনি, যেহেতু পণ্যদ্রব্যটির রাজস্বসংগ্রহের দিক থেকে তত গুরুত্ব নেই, যদিও সঙ্গে-পেশ-করা কাগজপত্রে তার উল্লেখ ছিল। যেদিন জবাবি ভাষণের তারিখ, পূর্ববর্তী সন্ধ্যায় বক্তৃতার খসড়া প্রধান মন্ত্রীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, সাতসকালে টেলিফোনে তলব: প্রধান মন্ত্রী যথাশীঘ্র যেতে বলেছেন। আমাদের ওই বাদ দেওয়ার ব্যাপারটি তাঁর সতর্ক দৃষ্টি এড়ায়নি, তাঁকে বুঝিয়ে বলতে হলো।
উদ্ধত ইন্দিরা গান্ধি, অত্যাচারিণী ইন্দিরা গান্ধি, স্বৈরাচারিণী ইন্দিরা গান্ধি তখনও যবনিকার আড়ালে, আমাদের সঙ্গে খুব খোলামেলা আলাপ করতেন। এখন যা অবিশ্বাস্য ঠেকবে, মাঝে-মাঝে রাতের শো’তে চলচ্চিত্র দেখতে যেতেন পর্যন্ত, প্রধানত রিভোলি সিনেমাঘরে, কোনও সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত ছবি সম্বন্ধে আমাদের মতামত জানতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে বক্র-মন্তব্যে তাঁর উৎসাহ অন্তহীন। এক নেতা, যিনি পরে কিছুদিনের জন্য প্রধান মন্ত্রীও হয়েছিলেন, তাঁর বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধির প্রবল বিতৃষ্ণা, আমাকে দু’-একদিন ঠাট্টা করে বলেছেন: ‘ওর মধ্যে তুমি কী এমন মহামূল্য গুণাবলী দেখতে পাও? জানো না, ও অমুক ব্যবসাদারের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পায়’।
তবে, স্বীকার করতেই হয়, অত্যন্ত দ্রুত তিনি কূটকচালিও শিখছিলেন। সেই বছরের বাজেটে আমরা তালাচাবি-সিন্দুক-আলমারির উপর খুব কড়া হারে অন্তঃশুল্ক চাপাবার প্রস্তাব রেখেছিলাম। হয়তো গোদরেজ গোষ্ঠীর কেউ, বা অন্য-কোনও শিল্পপতি, তাঁর কাছে এসে দরবার করে গেছেন, আমাদের ডেকে পাঠিয়ে ইন্দিরা গান্ধি, প্রতিভাধারিণী, গল্প ফাঁদলেন, ‘জানো, আমাদের বাড়ির সিন্দুক-দেরাজ-আলমারির সব চাবি আমার কাছে গচ্ছিত থাকতো, একবার হলো কী, বাড়িতে এক বিয়ে, বিয়ের সমস্ত শাড়িগয়না আলমারিতে পোরা, চাবি আমার কাছে, আমার বাচ্চা ছোটো ছেলে চাবির গোছা নিয়ে খেলতে গিয়ে কোথায় হারিয়ে ফেললো, অনেক মিস্ত্রি ডেকেও আলমারি খোলা গেল না, শেষ পর্যন্ত মুম্বই থেকে গোদরেজের লোক এসে সেই আলমারি খুললো। ওরা এত ভালো-ভালো, এত চমৎকার-চমৎকার জিনিশপত্র তৈরি করছে, ওদের উপর করের বোঝা একটু কমিয়ে দাও না কেন?’
যেটা দুঃখের, তাঁর এই মানসিকতা কিংবা আচরণিক মাধুর্য তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; তার কারণ, হেঁয়ালির মতো ঠেকলেও আমি বলবো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ব্যাংক জাতীয়করণ, অপেক্ষাকৃত হাল্কা ধরনের বাজেট, রাজন্যভাতা বিলোপ, গরিবি হঠাও সামগান ইত্যাদি তাঁকে ও তাঁর নবগঠিত কংগ্রেস দলকে একাত্তর সালের লোকসভা নির্বাচনে জিততে প্রভূত সাহায্য করেছিল। ওই সচ্ছল সংখ্যাধিক্য সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধি হয়তো এমনিতে বেপরোয়া হয়ে যেতেন না। সত্তর সালের শেষের দিকেই যদিও কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল, শিল্পপতিদের উপর চাপ দিয়ে তিনি পয়সাকড়ি সংগ্রহ করছেন, তবে তা তো প্রথাগতভাবে সব প্রধান মন্ত্রীই করে থাকেন। দৃষ্টিকটু পটপরিবর্তন একাত্তর সালের নির্বাচনের পর। তাঁর কাছে বামপন্থীদের প্রয়োজন ততদিনে ফুরিয়েছে, কিন্তু সেই মুহূর্তেও তাঁর মাথা ততটা ঘুরে যায়নি। ঘুরলো খানিক বাদে; বাংলাদেশের যুদ্ধবিজয়, এবং পাকিস্তানকে সেই যুদ্ধে নাস্তানাবুদ করা, থেকেই পরবর্তী ভয়ংকর ইতিহাসের সূচনা। সত্তর সালের প্রথমার্ধ থেকে বামপন্থীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শিথিল হতে থাকে, খানিকটা আঁচ করতে পারছিলাম হাকসারের ছুটকো-ছাটকা মন্তব্য থেকে। লন্ডনে ছাত্রাবস্থায় জ্যোতি বসু ও হাকসার কাছাকাছি ছিলেন, দু’জনেরই চোখে ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। তিন-চার দশকে পরস্পরের ব্যক্তিগত অবস্থান আমূল পাল্টে গেছে, জ্যোতি বসু জননেতা, হাকসার দেশের সর্বোত্তম রাজপুরুষ হলেও তিনি আমলাই। যতদূর মনে আনতে পারি, দুর্গাপুরে ইস্পাত কারখানায় শ্রমিক অশান্তি নিয়ে তাঁদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়, কোনও বিরক্ত মুহূর্তে জ্যোতি বসু নাকি মন্তব্য করেন, ‘এটা রাজনৈতিক ব্যাপার, আমি রাজনৈতিক স্তরেই আলোচনা করবো।’ পরের দিন হাকসার আমাকে তির্যক ইঙ্গিতে বললেন, ‘আমি তো ব্লাডি সিভিল সার্ভেন্ট, কারণে-অকারণে জ্যোতি তা হলে আমাকে টেলিফোন করে কেন?’ অবশ্য আজ পর্যন্ত এই ব্যাপারে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা করিনি।
অবস্থার যে মোড় ফিরছে তার ছুটকো-ছাটকা ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে আসছিল। আমি প্রস্তাব উত্থাপন করলাম, ব্যাংক জাতীয়করণ হয়েছে, এবার ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়ার হারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো হোক: বড়ো পুঁজিপতি-ব্যবসাদার-ধনী চাষীদের উপর ঋণের হার বাড়িয়ে পঁচিশ-তিরিশ শতাংশ করা হোক, অন্য পক্ষে দরিদ্র কৃষক-খেতমজুর-ভূমিহীন কৃষক-ব্যবসাদার-কারিগর-বেকার যুবক ইত্যাদির জন্য ঋণের হার অনেকটাই কমানো হোক, এমনকি কোনো-কোনো ক্ষেত্রে বিনা সুদে যোগ্য পাত্র-পাত্রীদের টাকা ধার দেওয়া হোক। (এটাও যোগ করেছিলাম, প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকদের বই ছাপাবার জন্য নামমাত্র সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা হোক, কিংবা নাট্যদলকে নাটক করার জন্য।) ব্যাংকের কেষ্ট-বিষ্টুদের মাথায় হাত। আমার প্রস্তাব বিবেচনার জন্য কমিটি গঠন করা হলো, উদ্দেশ্য সময়কে গড়াতে দেওয়া, ইতিমধ্যে ইন্দিরা গান্ধির পূর্ববঙ্গ বিজয়; গরিবদের কথা ভাববার আর দরকার নেই, কমিটির প্রতিবেদন বেরোলো, তাতে কার্যত প্রস্তাবের নিধন ঘোষণা।
অন্য কারণেও বুঝতে পারছিলাম হাওয়া ক্রমশ ঘুরছে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়-সম্প্রদায় ইন্দিরা গান্ধিকে ঊনসত্তর সালে এক দফা বুঝিয়েছিলেন পশ্চিম বাংলার নতুন বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ভালোভাবে জিতবে, তাঁদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী খাটেনি, কিন্তু একাত্তর সালের নির্বাচনে অজয় মুখোপাধ্যায় সি পি আই-ফরোয়ার্ড ব্লক ইত্যাদিকে কংগ্রেসের সঙ্গে মেলাতে পেরেছিলেন, সুতরাং তাঁরা এবার প্রায় নিশ্চিন্ত। নিশ্চিন্ততার আরও হেতু অবশ্যই কলকাতায় ও পশ্চিম বাংলার অন্যত্র মাকর্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও সমর্থকদের সঙ্গে নকশালপন্থীদের ক্রমবর্ধমান সশস্ত্র হানাহানি। তখনই কিছু-কিছু অনুমান করা যাচ্ছিল, পরে তার নানা সাক্ষ্য পাওয়া যায়, নকশালপন্থীদের ভিড়ে পুলিশের অনেকরকম লোক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল; এ ব্যাপারে প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন পুলিশের এক বড় কর্তা, যিনি নিজেও ঢাকা শহরের ছেলে, পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে সুশোভন সরকারের কাছে পড়েছেন, একসময় ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে ঈষৎ মাখামাখি ছিল, মাঝে-মাঝে তাঁকে সমরবাবুর আড্ডাতেও দেখতে পেতাম, সদ্য-প্রকাশিত বহু বিদেশি বইয়ের নাম আওড়াতেন।
এই ভদ্রলোককে তারিফ করতে হয়, পরস্পরকে গুপ্তহত্যার বীজ বামপন্থীদের মধ্যে অনেক গভীরে ছড়িয়ে দিতে সফল হয়েছিলেন। কিছু আদর্শবাদী খাঁটি নকশালপন্থী যুবক, আবার কিছু নকশাল বকলমে ছদ্ম-কংগ্রেসী, কিছু বা নকশাল বকলমে ছদ্ম-পুলিশ: সব যেন ওই এলেবেলে ঋতুতে একাকার হয়ে গেল। খুনোখুনি বাড়তেই থাকলো। কয়েক মাস বাদে কলকাতায় নানা কিসিমের মিলিটারি পুলিশ নামানো হলো, পাড়া ধরে-ধরে চিরুনি আক্রমণ, হাজার-হাজার ছেলেমেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়া, এদের মধ্যে কেউ-কেউ নিকষ নকশালপন্থী, কেউ-কেউ মার্কসবাদী কমিউনিস্ট কর্মী। আরও একটি পুলিশি প্রকরণের গল্প লোকের মুখে ছড়িয়ে পড়লো। গভীর নিশীথে পুলিশ ভ্যানে করে কতিপয় বন্দীকে শহরের বাইরে অনেক দূরে লোকালয়হীন অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে বলা হতো, এখন ছেড়ে দিচ্ছি, এখন থেকে সহবত মেনে চলবে, তোমাদের তো যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, বাড়ি ফিরে সুবোধ বালকের মতো থেকো, অন্যথা কিন্তু ভালো হবে না। ছেলেরা ভ্যান থেকে নেমে কয়েক পা এগোতেই পিছন থেকে তাদের গুলি করে মারা হতো, ভোরবেলা মানুষ দেখতে পেতেন খুন-হওয়া কয়েকটি ছেলের শব এখানে-ওখানে ছড়িয়ে পড়ে আছে।
এসব ঘটনার কিছুদিন আগেই নকশালপন্থীদের একটি বড়ো অংশ সংঘবদ্ধ হয়ে কলকাতার ময়দানে সরকারিভাবে তাঁদের দল-গঠনের কথা বিজ্ঞাপিত করেন। তবে সেই দলীয় সংহতি বেশিদিন টেকেনি। বিপ্লবের পদ্ধতি ও প্রণালী নিয়ে, বিপ্লব শহরে শুরু করা হবে কিংবা গ্রামে, মধ্যবিত্ত দুর্বলচিত্ততা ঘোচাবার লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর প্রমুখ নেতা-মনীষীদের মূর্তির শিরচ্ছেদ করা হবে কি হবে না, ট্র্যাফিক কনস্টেবলদের কোতল করা কতটা যুক্তিসঙ্গত, বিপ্লবের পূর্বসূরী হিশেবে সন্ত্রাস কতটা ছড়িয়ে দেওয়া উচিত, এলোমেলো একে-ওকে-তাকে হত্যার সার্থকতা কী: সমস্ত-কিছু নিয়েই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে তুমুল বাগবিতণ্ডার শুরু। কিছু-কিছু নকশালপন্থী চারু মজুমদারের প্রতি একনিষ্ঠ থাকলেন, অন্যরা তাঁকে পাগল ঠাউরে বিকল্প সংগ্রামপদ্ধতি নিয়ে চিন্তা শুরু করলেন। এই অবস্থায় আমার হঠাৎ জ্যোতি বসুর একটি কথা মনে পড়লো, চারু মজুমদার সম্পর্কে, বছর তিনেক আগে যা আমাকে বলেছিলেন, ‘বহু বছর থেকে প্রমোদবাবুকে বলে আসছিলাম, এই কমরেডটি বদ্ধ উন্মাদ, যথাশীঘ্র দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিন। তখন শুনলেন না কথা, এখন বুঝুন ঠ্যালা’।
দিল্লিতে বসে কলকাতা ও পশ্চিম বাংলার হানাহানির প্রাত্যহিক বিবরণ পড়ি: সন্ধ্যার পর এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় যেতে গা ছমছম, এক অঞ্চলে পুলিশ খুন হয়েছে, সমস্ত ঘরবাড়ির জানালাদরজা বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন স্তব্ধ, অন্য-এক অঞ্চলে হয়তো একদল বামপন্থী আর একদল বামপন্থীর উপর চড়াও হয়েছে, তাদের কাছে তা সশস্ত্র বিপ্লবের প্রথম পর্ব, অথবা সেই বিপ্লবযুদ্ধে হাতেখড়ির মহড়া। কলকারখানাতেও ঘেরাও-বন্ধ-হরতালের ফুলঝুরি, গ্রামাঞ্চলে জোতদারনিধনের পালা। একটি বিপ্লবী পত্রিকায় তখন এক লোমহর্ষক বিবরণ পড়েছিলাম, মনে করলে এখনও গা শিউরে ওঠে: ‘বিপ্লবী কমরেডরা অন্য অস্ত্রের অভাবে কয়েকটি রাম দা নিয়ে এক জোতদারের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেন। তারপর, যদিও সেই রামদাগুলি যথেষ্ট ভোঁতা ছিল, নিপুণতার সঙ্গে সেগুলিই ব্যবহার করে শ্রেণীশত্রু নিধনের পবিত্র কর্তব্য সম্পন্ন করা হয়।’ যে জবাই হলো, আর যে জবাই করলো, উভয়েই আসলে নিরেট ছাপোষা, শ্ৰেণীদ্বন্দ্বের বোঝা তাদের উপর চাপানো শোচনীয় পণ্ডশ্রম।
জাতীয় পরিস্থিতির ভুল বিশ্লেষণ, কে আসল শত্রু কে নিরীহ পথচারী, তা বুঝতে করুণ অসফলতা, যেন নৈরাজ্যসৃষ্টির জন্যই নৈরাজ্য। এখন বুঝতে পারি বিশের-তিরিশের দশকের দেশপ্রেমান্ধ বোমা-পিস্তলের দুর্মর ঐতিহ্য, এবং সেই ঐতিহ্যসঞ্জাত প্রেরণা, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বাদেও বাঙালি মধ্যবিত্ত ধমনী ও রক্তে সমান প্রবহমান ছিল। যে ছেলেগুলি মারা পড়লো, আর যারা মারলো, তাদের কারওরই আদর্শে ন্যূনতম ঘাটতি ছিল না, তাদের সাহস অতুলনীয়, তাদের কাছে সত্যিই জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন। তারা ভুল কারণে একদা-বন্ধুদের মেরেছে, তারা নিজেরাও ভুলের শিকার হয়েছে, সেই সঙ্গে কুচক্রী পুলিশের শিকারও, এখন ইতিহাস অনেক দূর গড়িয়ে গেছে, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-হতদরিদ্র পরিবারের এসব ছেলেমেয়েদের আত্মত্যাগের স্মৃতি তবু এখনও মন ভারাক্রান্ত করে তোলে।
ভয়ংকর কাণ্ডকারখানার খবরাখবর দিল্লিতে প্রতিদিন পাই। প্রতি মাসে একবার-দু’বার কলকাতা আসাও হয়, চেনাজানা অনেক ছেলেমেয়ের সম্পর্কে দুঃসংবাদ পাই, কিন্তু সেই মুহূর্তে শুভ ও অশুভর মধ্যে তফাত খুঁজতে কেউ রাজি নন, শুভবুদ্ধি ও অশুভবুদ্ধির মধ্যেও পৃথগীকরণ সমান সুকঠিন।
এরই মধ্যে খবর পেলাম রবি সেনগুপ্তকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে নকশাল বিবেচনা করে। আমার সন্দেহ, কোনও প্রকাশ্য জায়গায় গিয়ে বৈপ্লবিক রাজা-উজির মারছিলেন, পুলিশ পাকড়েছে। কলকাতা থেকে উৎকণ্ঠার নানা বার্তা। প্রধান মন্ত্রীর দফতরে গিয়ে জানালাম, ঘনিষ্ঠ বন্ধুর উপর হেনস্তা হয়েছে, এরকম পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে কাজকর্মে মনঃসংযোগ করা মুশকিল। তার আগের সপ্তাহেই অনুযোগ জানিয়েছিলাম, মানিকতলা হাউসিং এস্টেটে জঙ্গি পুলিশ ঢুকে বীভৎস অত্যাচার চালিয়েছে, এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। যাই-ই হোক, হাসারের দফতর থেকে কলকাতায় কড়া নির্দেশ পাঠানো হলো, অশোক মিত্রর শ্যালককে পুলিশ পরম অবিবেচনার সঙ্গে গ্রেপ্তার করেছে, তাঁকে অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়া হোক। আসলে সেই সপ্তাহে আমার স্ত্রীর একটি সম্পর্কিত ভাইও ধরা পড়েছিল, তা-ও বোধহয় কোনও সূত্রে হাকসার বা পৃথ্বীনাথ ধর জানতে পেরেছিলেন। রবি সেনগুপ্ত অচিরেই ছাড়া পেলেন, তাঁকে কেউ-কেউ অতঃপর রঙ্গ করে মাঝে-মধ্যে নেপথ্যে ‘শালাবাবু’ বলে ডাকতেন।
পরের ঘটনা অর্থনীতিবিদ পরেশ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। তাঁকে উত্তর বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাকড়ে এনে ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে ঢোকানো হয়েছিল। বিপ্লবের তাত্ত্বিক বিষয়াবলী ও কূটকৌশল নিয়ে লম্বা-লম্বা প্রবন্ধ লিখতে পরেশের জুড়ি নেই, বাকি সব-কিন্তু শাদামাটা। তিন মাসের জন্য দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে অতিথি অধ্যাপক হিশেবে একবার দেশের রাজধানীতে এসেছিলেন, আমাদের সঙ্গেই ছিলেন, তখনও তিনি বিবাহ করেননি, আমার স্ত্রীকে ব্যাখ্যা করে বলতেন, তাঁর যিনি সহধর্মিণী হবেন তাঁর এক হাতে রাইফেল থাকবে, অন্য হাতে একই সঙ্গে বোমা ও মাওয়ের-চিন্তাধারা সংবলিত রক্ত-পুস্তিকা। পরে তিনি সাবিত্রী আয়েঙ্গার নামে এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপিকার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। সেই তামিল মহিলাকে নিজের অনুজার মতোই স্নেহ করতাম। তাঁদের উত্তর-বিবাহ জীবনের কাহিনী অত্যন্ত মর্মন্তুদ, পরে হয়তো বলার সুযোগ ঘটবে।
দিল্লিতে খবর পৌঁছুলো, পরেশ চট্টোপাধ্যায়কেও গ্রেফতার করা হয়েছে। কলকাতায় যিনি রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব, দিল্লি থেকে ফোন করে তাঁকে জানালাম, নিরীহ অধ্যাপক, তাঁকে জেলখানায় পুরে আপনাদের কোনও স্বার্থসিদ্ধি হবে না। তিনি একটু কায়দা করে জবাব দিলেন, ‘খোঁজখবর নিয়েছি, ইনি ভীষণ ব্যক্তি, বিপ্লবের তত্ত্ব কষেন, সুতরাং মাফ করবেন আমাকে, আগুনে যখন ভদ্রলোক হাত দিয়েছেন, হাত পুড়বেই’। বাধ্য হয়ে অন্য কলকাঠি নাড়তে হলো, পরেশকেও ছাড়িয়ে আনা গেল।
তবে এরই মধ্যে দুঃসহ বিবেকপীড়ন। যেহেতু সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছি, নিকটজনদের কিংবা বন্ধুদের কারাকক্ষ থেকে বের করে আনতে পারছি, কিন্তু আমার এই আচরণ কি যুগপৎ স্বার্থপরতা ও কাপুরুষতার চূড়ান্ত নিদর্শন নয়? হাজার-হাজার কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, প্রবীণ-বৃদ্ধ পুলিশের জালে ধরা পড়ছেন, প্রশাসনের খামখেয়ালে অত্যাচারিত হচ্ছেন, তাঁদের জন্য একটু মন খারাপ করা ছাড়া আর তো কিছুই করতে পারছি না। সরকারের নীতি-আচরণ-ব্যবহার বরদাস্ত করা সম্ভব হচ্ছে না, ইন্দিরা গান্ধির বামপন্থী ঝোঁক সম্বন্ধে যাবতীয় প্রত্যাশা মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেছে, পশ্চিম বঙ্গে যা চালু হয়েছে তা যথার্থই বর্গীর শাসন। তা হলে কেন এখনও দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে বেহায়ার মতো ঝুলে থাকা? কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যুক্ত আছি বলে একজন-দু’জনকে অত্যাচার-অনাচারের খপ্পর থেকে মুক্ত করতে পারছি, সুতরাং থাকা যাক, এর চেয়ে হাস্যকর অজুহাত কিছু হতে পারে না, এভাবে মনকে চোখ ঠারার চেয়ে অধিকতর নিন্দনীয় কিছু নেই। যদি নিজের কাছে বুজরুক বলে প্রমাণিত না হতে চাই, আমার উচিত অবিলম্বে সম্মানীয় সরকারি পদের মোহ ছুঁড়ে ফেলে কলকাতায় ফিরে যাওয়া।
মানসিক অবস্থা কিছুতে-কেন-যে-মন লাগে না, ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করবো কিনা অহরহ ভাবছি। হেমন্ত বসু-হত্যার-জন্য-দায়ী এই প্রত্যক্ষ অভিযোগ ও দিল্লি থেকে আরো অনেক কারসাজি সত্ত্বেও একাত্তর সালের নির্বাচনেও মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি পশ্চিম বাংলার প্রধান দল হিশেবে আত্মপ্রকাশ করলো। কিন্তু নতুন দিল্লি থেকে নির্দেশ, কংগ্রেস ও তার সঙ্গে জোড়াতালি দেওয়া আর যে-ক’টি দলের সম্মিলিত গোষ্ঠী, তাদেরই মন্ত্রিসভা গঠন করতে অতএব রাজ্যপালের তরফ থেকে আহ্বান। মুখ্যমন্ত্রী এবারও অজয় মুখোপাধ্যায়, কিন্তু সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় দিল্লি থেকে প্রকৃতপক্ষে কর্তালি করছেন, এবার পুরোদমে বামপন্থী সংহারে পুলিশ, সৈন্যবাহিনী ও কংগ্রেস-আশ্রিত সমাজবিরোধী সম্প্রদায় এক সঙ্গে নেমে পড়ল।
একাত্তর সালের বসন্ত ঋতু, মনস্থ করে ফেলেছি কলকাতায় ফিরবো, এমন সময় পূর্ব পাকিস্তান উথাল-পাতাল, শেখ মুজিবুর রহমানের সত্তা-কাঁপানো ভাষণ, ‘এবারকার যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ, এবারকার লড়াই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াই’। চব্বিশে-পঁচিশে মার্চ মধ্যরাত্রে তাকে কয়েদ করে করাচি না লাহোরে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো, যেই সন্ধ্যার অন্ধকার নামলো, গোটা পূর্ববঙ্গ জুড়ে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সক্রিয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলি আক্রমণ করে শত শত ছেলেদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা। আরও কয়েক হাজার ছেলেকে বন্দী করা হলো, অধ্যাপকনিবাসগুলি, একটির পর একটি, প্রচুর পরিকল্পনা-সহযোগে আক্রান্ত। অধ্যাপকদের সম্পর্কে প্রচণ্ড আক্রোশ, তাঁরাই নাকি পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে বিপথগামী করেছেন। যাঁরা-যাঁরা পালাতে পারলেন না, তারা খুন হয়ে গেলেন। এই ধরনের হত্যালীলা পূর্ববঙ্গের প্রতিটি শহরেই অনুষ্ঠিত হলো। অনেকে আত্মগোপন করতে পারলেন, আবার অনেকে পারলেন না। যাঁরা সফল হলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ ত্রিপুরার সীমান্ত দিয়ে ভারতবর্ষে ঢুকলেন, নয়তো পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষীদের প্রহরা এড়িয়ে বনগাঁ দিয়ে। গোটা দেশ জুড়ে মানুষের মনে আতঙ্ক, হাহাকার, বিক্ষোভ, প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞা।
দিল্লিতে খানিকটা-খানিকটা খবর পাচ্ছিলাম, তবে খবর ছাপিয়ে নানা গোছের গুজব। কলকাতায় খাঁটি খবর সামান্য একটু বেশি করে আসছিল, কিন্তু সেখানেও গুজবের ঘাটতি নেই। চেতনা জুড়ে অস্বস্তি, কী হচ্ছে সীমান্তের ওপারে, আমাদের কী করণীয় তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, মানসিক দোলাচলের মধ্যে আছি।
তারিখটা বোধহয় দোসরা এপ্রিল, নর্থ ব্লকে অর্থমন্ত্রকে নিজের ঘরে বসে কাজকর্ম করছি, সকাল এগারোটা হবে, হঠাৎ একটি টেলিফোন এলো অমর্ত্যর কাছ থেকে। অমর্ত্য তখন দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসে অধ্যাপনা করছে, কিন্তু ফোন করছে লোদি এস্টেটে আমার বাড়ি থেকে, ‘অশোকদা, আমার সঙ্গে এই মুহূর্তে আমাদের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছেন, জরুরি সমস্যা, দয়া করে আধ ঘণ্টার জন্য একটু আসবেন?’ নতুন দিল্লির মসৃণ পথ, লোদি এস্টেটে পৌঁছুতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগে না, গিয়ে দেখি অমর্ত্যর সঙ্গে আনিসুর রহমান ও রেহমান সোভান, পূর্ব পাকিস্তানের দুই খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। এঁদের সঙ্গে আমার পুরনো হৃদ্যতা। সে এক বিচিত্র, কৌতুককর কাহিনী। অর্থনীতিবিদদের আন্তর্জাতিক সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক অ্যাসোসিয়েশন অনেকদিন ধরে বলে আসছিলেন ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানের মধ্যে এই যে প্রথম থেকেই অপ্রীতিকর সম্পর্ক, তাতে আর্থিক উন্নতি দু’ দেশেই ব্যাহত হচ্ছে, উভয় দেশের অর্থনীতিবিদদের কর্তব্য এই ব্যাপারে অগ্রণী হওয়া, পরস্পরের সঙ্গে আলোচনায় বসা, আলোচনায় বসে অন্তত আর্থিক বিকাশের ক্ষেত্রে মূল সমস্যাদি সম্পর্কে কতগুলি ঐক্যমতের সূত্র খুঁজে বের করা, যা থেকে রাজনৈতিক বোঝাপড়ারও একটি পটভূমিকা তৈরি হতে পারে। অনেক কথাবার্তার পর স্থির হলো ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক অ্যাসোসিয়েশন ঊনসত্তর সালের মাঝামাঝি সময়ে সিংহলে— সিংহল তখনও শ্রীলঙ্কা হয়নি—শৈল শহর কান্ডিতে এক বৈঠকের ব্যবস্থা করবে, আলোচ্য বিষয় বলা হবে দক্ষিণ এশিয়ার আর্থিক বিকাশের সমস্যা। ভারত-পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি জনা তিনেক সিংহলি বন্ধুদেরও আমন্ত্রণ জানানো হবে, তবে সেটা নামকাওয়াস্তে, আসলে সম্মেলনের উদ্দেশ্য ভারতীয় ও পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদদের পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সূত্র অন্বেষণ। যথা সময়ে। রমণীয় কাণ্ডি শহরে আমরা হাজির দিন দশেকের বৈঠকে। এগারোজন ভারতীয়, এগারোজন পাকিস্তানি, কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবিষ্কার করে চমকৃত হলাম, একাদশ ভারতীয়ের মধ্যে আমরা চারজন বাঙালি, আর ওই সংখ্যক পাকিস্তানিদের মধ্যে সাতজনই বঙ্গভাষী। সুতরাং প্রকৃতির নিয়মে ত্রি-ধারা তৈরি হয়ে গেল, সাতজন ভারতীয়, চারজন পাকিস্তানি, এগারোজন বাঙালি। সম্মেলনের আয়োজকদের মাথায় হাত। চুলোয় যাক ভারত-পাকিস্তান সমস্যা, চুলোয় যাক আগের থেকে ছক-করা সম্মেলনের বিষয়-তালিকা, আমরা এগারোজন বাঙালি আড্ডার স্রোতে ভেসে গেলাম, বিশেষ করে যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অনেকেরই বন্ধনের ঐতিহ্য। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালিদের মধ্যে রেহমান সোভান কী কারণে যেন ছিল না, তবে তাকে আমি কেমব্রিজে দেখেছি, ছাত্রাবস্থায় অমর্ত্যর সমসাময়িক, ঢাকার ‘হলিডে’ সাপ্তাহিকে ঘোর জঙ্গি রচনা লিখনরত। কাণ্ডিতে আনিসুর রহমানের উপস্থিতিতে আমি উৎফুল্ল। আনিসুর অত্যন্ত বুদ্ধিমান, বিশ্লেষণপ্রিয় ধনবিজ্ঞানী, স্বপ্নালু চোখ, নীতিনিষ্ঠ, স্বল্পবাক্, আশ্চর্য গানের গলা, রবীন্দ্রনাথের গানে সব সময়েই বিভোর, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি-এইচ. ডি করেছে, ললিতা-সুখময় চক্রবর্তীদের কাছে ওর কথা অনেক শুনেছি। রেহমান-আনিস দু’জনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক। লোকপ্রবাদ যা-ই হোক, বাঙালি উদ্যমের তুলনা নেই, অচিরে কান্ডির সেই হোটলে একটি হারমোনিয়ম-গোছের বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করতে সফল হলাম, তারপর এক মস্ত ঘরে সারাদিন জুড়ে রবীন্দ্রনাথের গানের ঢেউয়ের পরে ঢেউ। অন্য ভারতীয় বন্ধুরা চটে লাল, পাকিস্তানিরাও তথৈবচ, সম্মেলনের সংগঠকদের তো কথাই নেই।
দিল্লিতে আনিস ও রেহমানকে দেখে আমার খুশি ধরে না, কিন্তু ওরা তো মস্ত বিপর্যয় মাথায় করে এসেছে। সমস্ত বিবরণ শুনলাম। চব্বিশে-পঁচিশে মার্চ মধ্যরাত্রিতে মুজিবর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেওয়ার পর সারা দেশ জুড়ে অত্যাচার-হত্যালীলা। পঁচিশ তারিখের সূর্যাস্তমুহূর্ত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলি এবং অধ্যাপকনিবাসসমূহ পাকিস্তানি ফৌজ দ্বারা আক্রান্ত। এক হাজার-দেড় হাজার ছাত্র সেই রাত্রে খুন হয়ে যান, সেই সঙ্গে দশ-পনেরোজন অধ্যাপক, অনেকেই আমার চেনা। আনিস ও রেহমান কোনওক্রমে ঢাকা থেকে পালিয়ে কুমিল্লা জেলার সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলা পৌঁছয়, পথে অনেক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, তাদের ছেঁড়াখোড়া মলিন জামাকাপড়, রেহমানের চশমার বাঁদিকের কাচ আড়াআড়ি ফাটা, কোথায় দেওয়াল টপকাতে গিয়ে নাকি আঘাত পেয়েছিল। আগরতলায় ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের সৌজন্যে তাঁরা কলকাতায় বিমান পাল্টে সোজা দিল্লি পৌঁছেছে পয়লা এপ্রিল গভীর রাতে। কলকাতায় ওদের তেমন জানাচেনা নেই, দিল্লিতে আমরা আছি, অথচ দিল্লিতে আমাদের ঠিকানা আদৌ জানা ছিল। পালম বিমান বন্দরে পৌঁছে ভারতীয় রক্ষীবাহিনীকে অনুরোধ জানানোয় তাদের বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া হয়। অমর্ত্যর বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি, সেখানে রাত্রিযাপন করেছে, পরদিন ভোরে ওদের নিয়ে অমর্ত্য আমার লোদি এস্টেটের বাড়িতে। প্রাথমিক কোলাকুলির পালা সাঙ্গ হলে মন্ত্রণা সভা বসলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের পরিচিত বেশ কয়েকজন আছেন, পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে তা নিয়ে কোনও নিশ্চয়তা নেই, সুতরাং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো ওরা আপাতত আমার বাড়িতে থাকবে, গা-ঢাকা দিয়ে, ছদ্ম নাম গ্রহণ করে। আমার স্ত্রী ওদের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ। করলেন, ওদের জন্য বাড়ির একটি সামান্য-বিশ্লিষ্ট অংশ ছেড়ে দেওয়া হলো, তবে খাওয়া-দাওয়া আমাদের সঙ্গেই, অতি সাধারণ ভাত-ডাল। রেহমান আদতে কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত, কিন্তু মানসিকতা ও সত্তার নিরিখে পুরোপুরি বাঙালি, যদিও বাংলা বলে আর্যাবর্তের ঢঙে। সে সর্বদা উৎসাহে টগবগ করছে, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাযুদ্ধে সে নিজেকে ইতিমধ্যেই সেনাপতি ঠাউরেছে, সগর্বে তাঁর ঘোষণা, এখন থেকে সে মোহনলাল, পলাশি যুদ্ধের মোহনলাল! আনিসও নিজের নামের ইংরেজি আদ্যাক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে অশোক রায় নাম গ্রহণ করলো। পরে এ নিয়ে সামান্য বিপদ হয়েছিল। দিন দশেক বাদে প্যারিস থেকে লোকনাথের স্ত্রী, ফ্রাঁস, আমাদের সঙ্গে থাকতে এলো। একই টেবিলে বসে খানা খেতে হয়, মোহনলাল ও অশোক রায় হিশেবে ফ্রাঁসের কাছে তাঁরা পরিচিত হলো। কিন্তু গোল বাধালো ফ্রাঁস। বাংলা সাহিত্য-পুরাণ-সমাজ-ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর অদম্য আগ্রহ, কলকল করে বাংলা বলে। একদিন সন্ধ্যায় আমি ও আমার স্ত্রী বাড়ি নেই, আনিসকে সে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে শুরু করলো, ‘আপনি তো রায়, কিন্তু ব্রাহ্মণ না কায়স্থ না বৈদ্য সন্তান?’ আনিসের তোতলানো ছাড়া গতি ছিল না। ফ্রাঁস বুদ্ধিমতী মেয়ে, অনুমানে-অনুভবে কিছুটা আঁচ করেছিল, আমাদের কাছেও তা ভাঙেনি।
যেদিন ওরা আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিল, সন্ধ্যাবেলা রেহমান ও আনিসকে রেসকোর্স রোডে হাকসারের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। এই ইতিহাস বাইরে কারও আদৌ জানা নেই: সেই সন্ধ্যা থেকেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সহায়তায় ভারত সরকারের সংগোপন প্রত্যক্ষ ভূমিকার শুরু, আমাদের বন্ধুদ্বয়ের মারফত হাসারের আওয়ামি লিগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগে যার সূচনা।