ঊনচল্লিশ
রাজ্যসভায় প্রথম বছরটি অন্তত তত খারাপ লাগেনি। মন্ত্রী-সদস্যদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই পূর্বপরিচয় ছিল, অন্য অনেকে আমাকে নামে জানতেন। রাজ্যসভা চালনা করতেন তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি, পরে রাষ্ট্রপতি, কে. আর. নারায়ণন, তাঁকেও পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে চিনি, তিনি তখন বৈদেশিক মন্ত্রকে ডেপুটি সেক্রেটারি, তাঁর ব্রহ্মদেশজাতিকা স্ত্রী উষা সমভিব্যহারে মাঝে-মাঝে দাতরজির বাড়ির আড্ডায় জমায়েত হতেন। আমি কোনওদিনই হাতে নোট নিয়ে বক্তৃতা দিতে পারি না, যা বলবার মনে-মনে গুছিয়ে বলবার চেষ্টা করি, আমার ধারণা তাতে বক্তব্যকে অনেক তরতাজা করে পরিবেশন করা সম্ভব। বক্তৃতা দিয়ে কিছু সদস্যের কাছ থেকে তারিফ পেতেও শুরু করেছিলাম। প্রথম কয়েক মাস নিবিড় আস্তিকের মতো প্রশ্ন পেশ করতাম, দৃষ্টি আকর্ষণী বিষয়ের উপর নোটিস জমা দিতাম, প্রধানত অর্থনীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে। পুরনো সহকর্মী একদা-সুহৃদ মনমোহন সিংহ, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, আর্থিক সংস্কারের হোতা হিশেবে তাঁর নাম তখন ঘরে-ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমিও বৃত্তিতে অর্থনীতিবিদ, তিনিও অর্থনীতিবিদ, গোড়ার দিকে ধরে নিয়েছিলাম যদিও আমাদের পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গির দুস্তর পার্থক্য, অর্থশাস্ত্রের যুক্তি-ব্যাকরণের ভিত্তিতেই আমাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলবে। অল্প দিনেই ভুল ভাঙলো। ততদিনে মনমোহন ঝানু রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিগত কোনও সমস্যার প্রসঙ্গ তুললে জবাবে তা এড়িয়ে গিয়ে তাঁর রাজনৈতিক ঝোঁক প্রকট থেকে প্রকটতর। সৌজন্যে ভেসে গিয়ে কী লাভ, বিবমিষা উদ্রেক করতো তাঁর স্বভাবভীরুতা, যাকে অনেকে বিনয় বলে ভুল করতেন। মনমোহন যখন যোজনা কমিশনে, তখন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম নেহরু পরিবার সম্পর্কে তাঁর অন্ধ বিদূষণার প্রবণতা, সর্ববিধ জাগতিক সাফল্যেও তাঁর সেই অপগুণে মরচে পড়েনি। তবে, এতদিনের চেনা-জানা, প্রথম বছরটিতে তাই রাজনীতি-অর্থনীতির আড়াআড়ি সত্ত্বেও আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে চিড় ধরেনি। কিন্তু তাঁর সংকল্প, সংস্কারের রথ অপ্রতিহত গতিতে চালিয়ে যাওয়া, তাই একটির পর-আর একটি বিরাষ্ট্রীয়করণের খসড়া আইন অর্থমন্ত্রী কর্তৃক সংসদে পেশ করা হচ্ছে, স্টেট ব্যাংক সংক্রান্ত আইন, অন্যান্য ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত আইন, বিমা বিজাতীয়করণ বিল, বাজেট বিবৃতি, বিদেশী বিনিয়োগ ভিক্ষা ইত্যাদি। মনমোহনের কার্যাবলীর বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদের স্বর ক্রমশ ধৈবত থেকে আরও উচ্চগ্রাম হলো। কাছের মানুষ ছিলাম, দূরে সরে এলাম।
মনমোহনের একটি বিশেষ আচরণ অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। ওজনদার শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে দেদার ঋণ গ্রহণ করেন, কিন্তু ফেরত দেবার নামটি নেই, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁদের দহরম-মহরম, ব্যাংককর্তাদের ঘাড়ে ক’টা মাথা যে তাঁদের উপর হম্বিতম্বি চালায়। ইতিমধ্যে রিজার্ভ ব্যাংক থেকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল; তথ্যে টইটম্বুর: বিভিন্ন ব্যাংকে এক-কোটি-টাকার-উপর-ঋণবদ্ধ ব্যক্তি ও সংস্থার বিশদ তালিকা; তাদের অদেয় ঋণের সামগ্রিক পরিমাণ, দেখা গেল, পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে (যা হালে এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশিতে দাঁড়িয়েছে)। কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রতিবেদনটির অনুলিপি পৌঁছে গেছে, অথচ সংসদ সদস্যরা তার টিকিটিও দেখেননি। অর্থমন্ত্রকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কনসালটেটিভ কমিটির বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করলাম, বৈঠক চলাকালীনই অর্থ সচিবের সঙ্গে ক্ষণিক পরামর্শ-অন্তে প্রতিবেদনটি সংসদসদস্যদের কাছে পেশ করতে অর্থমন্ত্রীর সম্মতি জ্ঞাপন। কমিটির সভায় ধন্যি-ধন্যি পড়লো, মন্ত্রী অনেক বাহবা কুড়োলেন, কিন্তু দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, ওই দলিলটি আর আমরা হাতে পাই না। অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিলাম, জবাব নেই। ফের চিঠি দিলাম, এবার কনসালটেটিভ কমিটির অন্য সদস্যদের কাছে সেই চিঠির প্রতিলিপি পাঠালাম। অর্থমন্ত্রীর নিঃশব্দতা অটুট রইলো। কমিটির পরের বৈঠকে অর্থমন্ত্রীকে চেপে ধরলাম। মনমোহনের যেন আকাশ থেকে পড়া: ‘কই, আমি এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম নাকি? মনে তো পড়ে না; হয়তো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।’ আমি স্তম্ভিত, সেদিনই বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে মনমোহনকে তুলোধোনা করেছিলাম। যে-অসাধু বড়োলোকরা এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ব্যাংকগুলি থেকে ধার নিয়ে ফেরত দেয়নি, তাদের নাম প্রকাশ করতেও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর অনীহা, শ্ৰেণীস্বার্থ। অথচ এই টাকার অর্ধেক ফেরত এলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির আর্থিক সচ্ছলতায় প্রত্যাবর্তন ঘটতো, এবং তেমনটা হলে আর হাজার-হাজার ব্যাংক কর্মচারীকে ছাঁটাই করার অজুহাত অনুপস্থিত থাকতো।
সংসদের হালচাল, কেন্দ্রীয় সরকারের আচার-আচরণ, নতুন দিল্লির আবহাওয়ার সঙ্গে লেপ্টে-থাকা মসৃণ পরিতৃপ্তির পরিবেশ: সব-কিছু নিয়েই আমার অনীহাবোধ গভীর থেকে গভীরতর। তা হলেও অস্বীকার তো করতে পারি না, এই নিরানন্দের মধ্যেও কয়েকজন সাংসদকে ব্যক্তিগত স্তরে পছন্দ করতাম। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে প্রয়াত প্রগাদা কোটাইয়াকে: কংগ্রেস দলের শেষ বেঞ্চিতে বসতেন, সারাটা জীবন গরিব তন্তুবায়দের হাল ফেরাবার লক্ষ্যে নিমগ্ন থেকেছেন, দলে কেউ তাঁর কথা শোনে না, গরিবদের জন্য তো আর ভাবার প্রয়োজন নেই সংস্কার-উত্তর যুগে। কোটাইয়া তবু অদমনীয়, একা লড়াই করে যাচ্ছেন, যে-জীবনদর্শনে বিশ্বাস করেন, তার তাগিদে। সম্ভবত পৃথিবীময়ই এমন সাচ্চা মানুষদের সংখ্যা কমে-কমে আসছে।
জনতা দলের কমলা সিংহের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক ছিল: বঙ্গললনা, বিয়ে করেছিলেন রামমনোহর লোহিয়া-ভক্ত বাসোয়ান সিংহকে, স্বামীর মৃত্যুর পর বিহারেই জন-আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। কেউ-কেউ অবাক হবেন, ভারতীয় জনতা পার্টির কয়েকজনের সঙ্গেও সৌহার্দ্যসম্পর্ক অস্বীকার করতে পারি না। সিকান্দর বখ্তের মতো সজ্জন প্রবীণ পুরনো কংগ্রেসি কোন্ পাকচক্রে হিন্দুত্বওলাদের খপ্পরে পড়েছিলেন, তা নিয়ে এখনও আমার বিস্ময়। আমার একদা ছাত্র, বইয়ের পোকা, ত্রিলোকীনাথ চতুর্বেদী, একসময়ে কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্রসচিব, কম্পট্রোলর অ্যান্ড অডিটর জেনারেল হিশেবে অবসর নিয়ে সংসদে সদস্য, জনতা দল প্রার্থী করলো না বলেই বোধহয় ভাজপা-তে, কিন্তু ঘোর বেমানান; এখন সে কর্ণাটকের রাজ্যপাল। উল্লেখ করবো আইনজীবী প্রয়াত সতীশ অগ্রওয়ালের কথাও: জয়পুরের আইনজীবী, জনতা সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকে রাষ্ট্রমন্ত্রী, ভদ্রতার সঙ্গে সততার মিশেল চরিত্রে। নারায়ণনের পর যিনি উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়ে এলেন, কৃষ্ণকান্ত, তাঁর কাছ থেকেও সুন্দর ব্যবহার পেয়েছি, বক্তৃতা ভালো লাগলে ডেকে প্রশংসা করতেন, এখানে-ওখানে আমার লেখা পড়ে পছন্দ হলে তারও উল্লেখ করতেন। তিনিও এখন প্রয়াত, যেমন প্রয়াতা সুশীলাদি, সুশীলা গোপালন, এ কে, গোপালনের জীবনসঙ্গিনী, আদর্শনিষ্ঠার সঙ্গে ভাললাত্বের এমন সমাবেশ অতি বিরল। আরও দু’জনের কথা যোগ করি: গান্ধিবাদী নির্মলা দেশপাণ্ডের মতো সৎ স্পষ্টবাদিনী মহিলা কংগ্রেস দলে এখনও টিকে আছেন কী করে কে জানে, কী করেই বা ইন্দিরা গান্ধির স্বেচ্ছাচারিণী ভূমিকার তারিফ করতেন একদা! রাজ্য সভায় মণিপুর থেকে নির্বাচিত সদস্য কুলবিধু সিংহর দেশপ্রেম ও ন্যায়নিষ্ঠা মুগ্ধ করতো। সমান পছন্দ করতাম বাবাসাহেব অম্বেদকরের নাতি প্রকাশ অম্বেডকরকে; সুন্দর বলিয়ে, সুভদ্র আচরণ। তরুণতর বামপন্থী সাংসদদের মধ্যে সবচেয়ে পরিশ্রমী, সবচেয়ে আদর্শ-অবিচল, ইংরেজি-হিন্দি-বাংলা সব ভাষাতেই বলতে তুখোড়, সচ্ছল কাজের মোহ ছেড়ে সক্রিয়ভাবে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে যোগ দেওয়া দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়কে; তার প্রতিভা ও অধ্যবসায় তাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।
বামপন্থী মহলের বাইরে ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলছি, আকাট আদর্শহীনতা। আদর্শের প্রতি, ন্যূনতম আনুগত্য নেই, আসলে আদর্শ বলেই কিছু নেই, সকালে এক দল, বিকেলে আর এক দল, অবলীলার সঙ্গে কংগ্রেস থেকে ভাজপা-তে, নয়তো ভাজপা থেকে কংগ্রেসে, জনতা থেকে ভাজপা বা কংগ্রেসে, স্বচ্ছন্দে এধরনের স্বৈরবিহার। জাতীয় পর্যায়ে সবাই যেন মেনে নিয়েছেন এই আদর্শহীন বিবেকশূন্যতা, যেন এটাই নিয়ম। পরিণামে রাজনীতির সংজ্ঞা এখন নিছক ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিশেবে দাঁড়িয়ে গেছে: কোন দলে গেলে মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে, কী করে আরও একটু বড়ো বাংলোয় বাস করা যায়, ওর ছ’টা নিরাপত্তারক্ষী, আমার মাত্র চারটে কেন ইত্যাদি ব্যাপারে সংহত মনোনিবেশ, কাকে খুশি করলে সরকারি পয়সায় ঘন-ঘন বিদেশসফরে যাওয়া যায় তা নিয়ে বিচিন্তা; রাষ্ট্রের সার্বিক মঙ্গল নিয়ে মাথা ঘামানোর আর প্রয়োজন নেই, রাজনীতিবিদের আধুনিকতম পরিশব্দ: ধান্দাবাজ বা ফন্দিবাজ।
অসুখী বোধ করার সামান্য অন্য কারণও ছিল। ছিয়াশি সাল থেকে পার্টির আর সভ্য নই, অথচ দলের হয়ে রাজ্যসভায় সদস্য হয়েছি। যেটা আমার আগে খেয়াল করা উচিত ছিল, দেরিতে বোধোদয় হলো, সংসদে দলের কোনও দায়িত্বের পদাধিকারী হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, নেতা-উপনেতা-প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ইত্যাদি পদে বৃত হওয়া আমার এখতিয়ারের বাইরে, ব্যাকবেঞ্চার হিশেবেই থেকে যেতে হবে আমাকে। তাতে একটু সমস্যা। সভাধ্যক্ষ ও সহ-উপাধ্যক্ষদের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ-আলোচনায় কিংবা কার্যসূচি নির্ধারক কমিটিতে থাকতে পারছি না, অন্যান্য দলের সঙ্গে কথাবার্তার সময়ও উপস্থিত থাকার সুযোগ নেই। আমার চেয়ে বয়সে-অভিজ্ঞতায় পর্যাপ্ত খাটো এমন অনেকে, যেহেতু তারা পার্টির সদস্য, তারা পদাধিকারবলে সংসদে পার্টির নীতি-আচরণকৌশল কী হবে, তার নিয়ামক, আমাকে তা মেনে নিতে হয়। সে বেচারিদের অপরাধ নেই, পার্টি তাদের যে-দায়িত্ব দিয়েছে, তারা পালন করছে মাত্র। ব্যক্তিগত অস্বস্তি তাতে অবশ্য কমবার নয়। অর্থনীতি-সংক্রান্ত বিষয়াবলী নিয়ে বক্তৃতা দিই, যখন বলি মোটামুটি সভাস্থ সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনেন, কিন্তু আমার যে-মানসিক গঠন, শুধু অর্থনীতি কপচানোয় আনন্দ পাই না, ঈষৎ একঘেয়ে লাগে, একঘেয়েমি থেকে অবসাদ, অবসাদ থেকে অন্যমনস্কতা। ধনবিজ্ঞানের বাইরেও আমার যে আরও অনেক দিকে আগ্রহ আছে, তা রাজ্যসভায় বিস্মৃত হয়ে থাকতে হয়। মাঝে-মাঝে সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিল, আমার তো তেমন সুনাম নেই, পার্টি লাইনের বাইরে ইতিউতি মন্তব্য করবার নজির অতীতে স্থাপন করেছি, পার্টি নেতৃত্ব তাই হয়তো রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনা থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছেন। বাড়তি মুশকিল দেখা দিল, যখন অর্থনীতি-সংক্রান্ত বিষয়েও আমার বরাদ্দ সময়ের উপর কনিষ্ঠতর কারও-কারও থাবা উদ্যত হলো।
তবে অন্য কথাও বলতে হয়। আমাকে যে-প্রদেয় মর্যাদা, তা রীতিগত অসুবিধাহেতু পার্টি নেতৃত্ব দিতে পারছিলেন না কিন্তু যথেষ্ট আকর্ষণীয় বিকল্প ব্যবস্থা করে দিলেন। যে ছ’বছর রাজ্যসভায় ছিলাম, পার্টির সুপারিশে প্রায় সাড়ে চার বছর সংসদের শিল্প-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলাম, শেষের বছরটা বাণিজ্য-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। লোকসভা-রাজ্যসভা মিলিয়ে স্থায়ী কমিটিগুলি সংগঠিত, বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের যুক্ত করে; কমিটিগুলির সভাপতির পদ বিভিন্ন দলের মধ্যে বণ্টন করা হয় আনুপাতিক হিশেবে। কোনও সরকারি আইনের খসড়া যথোপযুক্ত কমিটির কাছে অনেক ক্ষেত্রে প্রাগালোচনার জন্য পাঠানো হয়। অধিকন্তু কমিটিগুলির দায়িত্ব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের আওতা-ভুক্ত যে-কোনও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে প্রতিবেদন দাখিল করা। সেদিক থেকে দেখলে কমিটিগুলির সার্বভৌম অস্তিত্ব: মন্ত্রকের রাজপুরুষদের আলোচনার জন্য তাঁরা ডেকে পাঠাতে পারেন, যেমন ডাকতে পারেন যে-কোনও সাধারণ নাগরিককে, অথবা শিল্প সংস্থা, বাণিজ্য সংস্থা, কৃষক সভা তথা শ্রমজীবী সঙ্ঘের প্রতিনিধিদের। প্রতিবেদন উভয় কক্ষে পেশ হওয়ার পর কমিটির সুপারিশসমূহ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক মতামত জানাতে দায়বদ্ধ। কোনও সুপারিশ গ্রহণে সরকারের অসুবিধা থাকলে তার কারণ দর্শানোও মন্ত্রকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তবে শেষ পর্যন্ত ইত্যাকার কমিটির প্রতিবেদন থেকে বিশেষ লাভ হয় বলে আমার অন্তত মনে হয় না। কারণ বহুবিধ। অধিকাংশ সদস্য কমিটির কাজে তেমন গুরুত্বসহকারে মনোনিবেশ করেন না। কমিটি ভালো কিংবা কড়া-কড়া কথা যা-ই বলুক না কেন, সরকার দায়সারা জবাব দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে, কারণ কমিটির সুপারিশ মানা-না-মানা সরকারের মর্জির উপর নির্ভরশীল; সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার ক্ষমতা কমিটির নেই, তারা একটু-আধটু চিমটি কাটতে পারে মাত্র। বিশেষত প্রথা দাঁড়িয়ে গেছে কমিটির প্রতিবেদন সর্বসম্মত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেহেতু উভয় কক্ষে আনুপাতিক সদস্যসংখ্যার ভিত্তিতে কমিটির সভ্য বাছাই করা হয়, প্রতিটি কমিটিতে সরকার পক্ষের অবধারিত সংখ্যাধিক্য, কমিটির সভাপতি যদি বিরোধী-পক্ষীয় হোন, তা হলেও। সভাপতিকে তাই সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হয়, দেখতে হয় যে-প্রতিবেদন তৈরি হবে, তা যেন যথাসম্ভব প্রত্যেক সদস্যের মন জুগিয়ে চলে। সরকার সম্পর্কে কড়া কথা বলতে হলেও একটু ঘুরিয়ে বলা শ্রেয়; সরকারপক্ষীয় কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আগে থেকে আলাপ করে প্রতিবেদনের খসড়া তৈরি করলে খটাখটির আশঙ্কা কম। এমন নয় যে সরকারি কাজকর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য সংযোজন কদাচ সম্ভব নয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই মন্ত্রীদের বাঁচিয়ে বক্তব্য রাখা সমীচীন, নইলে সরকারপক্ষীয় সদস্যদের তাঁদের দলের কাছে জবাবদিহি দিতে হতে পারে। অবশ্য সরকার পক্ষ থেকে এমন কোনও-কোনও সদস্য যদি কমিটিতে থাকেন, যাঁদের মন্ত্রী হওয়ার সাধ অথচ হতে পারছেন না, কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত রেষারেষি চলছে, তবে অন্য কথা। তা হলেও সব মিলিয়ে অধিকাংশ কমিটির রিপোর্টই সাধারণত তেমন গভীরে পৌঁছয় না, কিছু লোকরঞ্জন কথাবার্তা থাকে, আসল বক্তব্য ঘোরানো-প্যাঁচানো অরণ্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে। পর-পর যে দুই স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলাম, শিল্প এবং বাণিজ্য মন্ত্রক-সংক্রান্ত, উভয়েরই বিষয়পরিধি একানব্বুই সালে ঢাকঢোল-পিটিয়ে-শুরু-করা আর্থিক সংস্কারের নীতি, সিদ্ধান্ত ও গতিপ্রকৃতি জড়িয়ে। সংস্কার কর্মসূচি শুরু হওয়ার পরবর্তী প্রথম পাঁচ বছর কেন্দ্রে কংগ্রেস দল ক্ষমতাসীন, দেশের-জাতির সর্বনাশ ঘটুক না-ঘটুক, আর্থিক সংস্কারের বিরূপ সমালোচনা সে-সময় করা কংগ্রেসিদের পক্ষে প্রায় বিধর্মী আচরণ। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দ্বিরাচারিতা। তাঁরা স্বনির্ভর অর্থব্যবস্থা ভাসা-ভাসা সমর্থন করেন, কিন্তু বেসরকারি মালিকানাও তাঁদের অপছন্দ নয়। এই দলভুক্ত কিছু সদস্য সংস্কারের কোনও বিশেষ প্রণালী বা নীতিতে অসুখী, প্রকাশ্যে তা বলতেও তাঁরা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, অন্য পক্ষে দলে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের যাঁরা খোদ প্রতিনিধি, তাঁরা সংস্কারের প্রেমে মুখর। ক্ষেত্রে শ্রেণীগত বিচারে কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে তফাত টানা সত্যিই দুরূহ। একটু আগে যা বলেছি, প্রায় প্রতি ঋতুতেই দেখা যায় গোসা করে কেউ-কেউ কংগ্রেসে ঢুকলেন ভাজপা ছেড়ে, আবার উল্টোও ঘটেছে। ধনী কৃষক-শিল্পপতি-ব্যবসাদারদের ভিড়ে ঠাসা কংগ্রেস দল, অনুরূপ ভিড়ে ঠাসা ভারতীয় জনতা পার্টিও। তবে যেহেতু এক দল সরকারে, অন্য দল বিরোধী আসন অলঙ্কৃত করে আছে, সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্তের খানিক-খানিক সমালোচনা শেষোক্তদের করতে হয়, করতে হয় ব্যাকরণের স্বার্থে, বিশ্বাসহেতু নয়। ভারতীয় জনতা পার্টির এই দ্বৈত অবস্থানের প্রমাণ মিলতো কংগ্রেস দল সংস্কারের প্রয়োজনে কোনও সংশোধনী আইন উপস্থাপন করলে, তার উপর ভোটাভুটির মুহূর্তে। ভাজপা সদস্যরা হয়তো বামপন্থীদের সুরে খানিকটা সুর মিলিয়ে বক্তৃতা দিলেন, সংশোধনী আইনে অনেক গলদ, এটির প্রয়োগ ঘটলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে, গরিবরা মারা পড়বেন, বিদেশীরা আমাদের মাথায় চড়ে বসবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ যখন ঘণ্টা বাজলো, ভোটগণনার পালা শুরু, তাঁরা গুটি-গুটি সভাকক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত।
কংগ্রেস দল তো তখন সরকারি দল, তাঁরা সংস্কারের ধ্বজা উড়িয়ে চলেছেন, একটা-দুটো বছর অতিক্রান্ত হলেই দেশ সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়া যাবে, কোনও স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে ভিন্ন কিছু থাকবে, তা সে-দলের সদস্যদের পক্ষে হজম করা শক্ত। শিল্প-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনগুলিতে তা হলেও আমি প্রতীপ মত প্রকাশের প্রয়াসে মোটামুটি সফল হয়েছি, অনেক সময় হয়তো ব্যাজোক্তির আড়ালে, সব সদস্যের সম্মতিও সংগ্রহ করতে সফল হয়েছি সেই সঙ্গে। মাত্র একবার জনৈক মহারাষ্ট্রবাসিনী মাননীয়া কংগ্রেসি সদস্যা কিছুতেই মানতে চাইলেন না যে আশির দশকের তুলনায় নব্বুইয়ের দশকে শিল্পোন্নয়নের হার অনেকটাই কমেছে, শিল্পে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হারও। যাঁরা জেগে ঘুমোন, কিংবা অ-তথ্যকে তথ্য বলে স্থাপন করতে বদ্ধপরিকর, তাঁদের নিয়ে কী আর করা। গত কয়েক বছর ধরে কংগ্রেস বিরোধী দল, যে-কোনও ছুতোয় এখন সরকারকে দুয়ো দিতে হবে, নেহরু-গান্ধি পরিবারের দল অতএব মস্ত উভয়সংকটে; ভাজপা সরকারের নিন্দায় মুখর হতে হবে, কিন্তু আর্থিক সংস্কারের সূচিকে গালমন্দ করা চলবে না।
অতীত কংগ্রেস দলকে তাড়া করে ফিরবেই। একানব্বুই সালের সিদ্ধান্তবলীতে ওই মুহূর্তে দেশের সম্পন্ন ঘরের মানুষেরা দারুণ খুশি, পুঁজিপতিরা খুব খুশি, জমিদার-জোতদাররাও আনন্দে মশগুল, কৃষিসংস্কার নিয়ে কংগ্রেস দল আর মুখ খোলে না। ব্যবসাদারদের পোয়া বারো, অবাধ বাণিজ্যের ঋতু শুরু হলো বলে। দশ বছর আগে ইন্দিরা গান্ধির জমানায় যিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন এবং পশ্চিম বাংলার যথাসাধ্য শত্রুতা সাধনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন, তাঁকে এবার নরসিংহ রাও বাণিজ্য মন্ত্রী হিশেবে নিয়োগ করেছিলেন, চুরানব্বুই সালের এপ্রিল মাসে মরক্কেশ শহরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-সংক্রান্ত চুক্তি দেশের হয়ে তিনি স্বাক্ষর করে এলেন, পশ্চিমের ধনী দেশগুলির কাছে পুরোপুরি দাসখত লিখে দিয়ে। তখনও ভারতীয় জনতা পার্টি মন স্থির করে উঠতে পারছে না চুক্তিটিকে সমর্থন করবে কি করবে না। তাদের দলেও অনেকের আশঙ্কা, মরক্কেশ চুক্তির ফলে দেশে কৃষি-শিল্পে মড়ক লাগবে, কর্মসংস্থানও ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। বাণিজ্যমন্ত্রী মরক্কেশ-ফেরত সংসদের উভয় কক্ষে চুক্তির সাফাই গেয়ে বিবৃতি পেশ করলেন। রঙ্গ দেখা দিল। রাজ্যসভায় কংগ্রেস দলের সংখ্যাধিক্য নেই, বামপন্থীদের সঙ্গে ভাজপা হাত মেলালে ভোটে শাসক দলকে কুপোকাৎ হতে হবে। মন্ত্রী নিয়মাবলীর যে ধারায় বিবৃতি দিলেন, তা যদি কোনও সদ্য-ঘটা জরুরি বিষয় নিয়ে হয়, ভোটে তা গ্রহণ বা নাকচ করবার অধিকার সভার আছে। উঠে দাঁড়িয়ে ভোট দাবি করলাম, ভাজপা-র পক্ষ থেকে আমাকে সমর্থন জানানো হলো, সমাজবাদী দল, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, জনতা দল সকলেই সোচ্চার: ভোট হোক, ভোটে শাসক দলের পরাজয় নিশ্চিত। উপাধ্যক্ষ সভা পরিচালনা করছিলেন, শাসক দলের সঙ্গে তাঁর বহু বছরের যোগাযোগ, ভোট নেওয়া বিধিসম্মত হবে কিনা তা নিয়ে তাঁর মত জানাতে সময় চাইলেন, অতএব আলোচনা ও ভোটাভুটি মুলতুবি হয়ে গেল। যে-ঋতু যায় তা আর ফিরে আসে না, কয়েক দিন বাদে মাননীয়া উপাধ্যক্ষ জানালেন, আমাদের ভোটের আবেদন প্রত্যাখ্যাত, সভানায়কের রায় নিয়ে তর্ক চলে না।
ততদিনে অবশ্য কিছুটা রোখ চেপে গেছে, সংসদের প্রায় সব ক’টি দল মিলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিদানাদির, বিশেষ করে পেটেন্ট আইন আমূল পরিশোধনের, খেয়ালখুশির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংহততর করার উদ্দেশ্যে একটি বেসরকারি সংসদীয় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলো। ভাজপা থেকে মুরলীমনোহর যোশী, জনতা দলের জয়পাল রেড্ডি, সমতা দল থেকে জর্জ ফার্নান্ডেজ, সি পি আই থেকে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (পরে অর্ধেন্দু বর্ধন), এবং আমাকে নিয়ে কমিটি। সবচেয়ে বেশি উৎসাহ যোশীর, অধিকাংশ বৈঠক হতো তাঁর বাড়িতে, আতিথেয়তার অভাব ছিল না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশানুযায়ী দেশের পেটেন্ট আইন পাল্টানো হলে কী-কী সর্বনাশ হবে তা নিয়ে আমরা সরব; রকমসকম দেখে মনে না হয়ে পারলো না, মুরলীমনোহর যোশীর বিশ্বায়ন-বিরোধী পরাক্রম অন্য সকলকে ছাপিয়ে। কয়েক মাস বাদে নতুন দিল্লিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-বিরোধী এক আন্তর্জাতিক কর্মশালার পর্যন্ত ব্যবস্থা হলো, যোশী স্বঘোষিত আহ্বায়ক। রাজ্যসভায় ভাজপা সাংসদরা আমাদের সঙ্গে সমানে চেঁচাচ্ছেন, বিমা বিরাষ্ট্রীয়করণের খসড়া আইন আটকে গেল। হঠাৎ আটানব্বুই সালে পট পরিবর্তন। জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা ক্ষমতার মঞ্চে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-বিরোধী কমিটির দুই মহারথী, মুরলীমনোহর যোশী ও জর্জ ফার্নান্ডেজ, নতুন সরকারে মাননীয় মন্ত্রী, রাতারাতি তাঁদের ভোল বদল। কমিটি থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি ও সমতা দল অন্তর্হিত, পরিবর্তে এবার এলেন কংগ্রেস দলের এক তরুণ সাংসদ। প্রথম দিকে কারও-কারও ক্ষীণ আশা ছিল যোশী ও ফার্নান্ডেজ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ক্রিয়াকর্মের বিরুদ্ধে এতদিন ধরে এত লাফিয়েছেন-তড়পিয়েছেন, সামান্য চক্ষুলজ্জার ব্যাপারও তো আছে, একটু-আধটু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে সবাক হবেন। আশা কুহকিনী, তাঁদের নিশ্চিন্ত বক্তব্য, তাঁরা তো অর্থনৈতিক মন্ত্ৰকাদির সঙ্গে যুক্ত নন, তা ছাড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁরা তো কোণঠাসা হতে বাধ্য। দুরাত্মাদের ছলের অভাব হয় না, মহাত্মাদেরও হয় না।
আমি ততদিনে সংসদের বাণিজ্য-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও পেটেন্ট আইন সংশোধনের বিভিন্ন শর্তাবলীর বিশদ আলোচনা করে, অনেক অবশ্যপ্রয়োজন পরিশোধন ও বর্জনের উল্লেখ-সহ কমিটিতে সর্বসম্মত প্রতিবেদন মঞ্জুর করানো হলো। কমিটির কাজে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন ডি এম কে-র মুরোসোলি মারান ও কংগ্রেস দলের ভায়লার রবি। ওই মুহূর্তে বাণিজ্যমন্ত্রী আমার পুরনো বন্ধু রামকৃষ্ণ হেগড়ে, সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, স্থায়ী কমিটি খুব ভালো কাজ করেছে, প্রতিবেদনটি সরকারের প্রভূত উপকারে আসবে।
সমস্তই মামুলি বচন। কয়েক সপ্তাহ বাদে মুরোসোলি মারান নিজেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী বনে গেলেন, পেটেন্ট আইন বিল আগেই লোকসভায় মঞ্জুর হয়েছিল, ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে তা রাজ্যসভায় উত্থাপিত হলো। ভারতীয় জনতা পার্টি এখন সরকার চালাচ্ছে, কংগ্রেস দল বিরোধী আসনে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্তাবলী মানবার ক্ষেত্রে, সেই সঙ্গে পেটেন্ট আইন সংশোধনের ব্যাপারে, আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান পরিস্থিতি। যুক্তি ও আবেগের মশলা মিশিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের বক্তৃতা ফাঁদলাম রাজ্যসভায়, দলমত নির্বিশেষে হাততালির বন্যা বইলো, কিন্তু ভোটের সময় কংগ্রেস, ভাজপা ও তার সঙ্গে মিতালি করে সরকারে ঢোকা অন্য দলগুলি এককাট্টা, পেটেন্ট আইন সংশোধনী প্রস্তাব রাজ্যসভাতেও মঞ্জুর হয়ে গেল। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের অবসান, পরদিন সন্ধ্যাবেলা কলকাতাগামী বিমান ধরার জন্য পালামে অপেক্ষাগারে সস্ত্রীক বসে আছি, কর্ণাটক থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত সদস্য, কংগ্রেস দলের অন্যতম সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, আমাকে দেখে আসন ছেড়ে উঠে এসে দু’হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ইট ওয়াজ আ গ্রেট স্পিচ।’ দারুণ বক্তৃতা, কিন্তু তিনি ভোটটা উল্টোদিকেই দিয়েছেন।
এরকমই হয়। সংসদে ছ’বছর থাকাকালীন চোখের সামনে বহু ব্যক্তির লজ্জার শেষ যবনিকা খসে পড়তে দেখেছি। দুর্নীতি নিয়ে আর কেউই ভাবিত নন যেন, সরকারে যিনি গেলেন তাঁর আশেপাশের মানুষজন চুরিধাড়ি করবেন, সরকারি প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের আখের গোছাবেন, তা প্রায় সাধারণ নিয়মে এখন দাঁড়িয়ে গেছে। দাতোল বিদ্যুৎ কারখানা নিয়ে এনরন সংস্থার সঙ্গে যে-কলঙ্কজনক চুক্তি চুরানব্বুই সালে সই করা হয়েছিল, যে-বিবরণ এখন পৃথিবীসুন্ধু সবারই জানা, তা নিয়ে বামপন্থীরা চুক্তিস্বাক্ষরের অব্যবহিত পরেই সংসদে প্রতিবাদমুখর হয়েছিলাম: মহারাষ্ট্র সরকার এনরনের সঙ্গে দেশের-পক্ষে-অভাবনীয়-ক্ষতিকারক বোঝাপড়ায় এসেছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার তাতে সমর্থন জুগিয়েছিলেন, এনরনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত তখন-পর্যন্ত-গোপন শর্তগুলি আমরা সংসদে খোলসা করেছিলাম। কেন্দ্রে তৎকালীন কংগ্রেসি বিদ্যুৎমন্ত্রীও মহারাষ্ট্রের মানুষ, এনরনের সঙ্গে বোঝাপড়া যে-কত মহান তা নিয়ে সংসদে সহস্রবাক হলেন। এখন তো তথ্য উন্মোচিত, দাড়োল বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য এনরন সংস্থার তরফ থেকে ঢালাও অর্থ বিলোনোর ব্যবস্থা হয়েছিল, যার প্রসাদ থেকে মন্ত্রী-শাস্ত্রী কেউ-ই বাদ পড়েননি। ছিয়ানব্বুই সালে ভাজপার তেরোদিন আয়ু যে-কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা, ওই ডামাডোল অবস্থার মধ্যেও দাভোল প্রকল্পের প্রতি তাঁরা পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করার সময় পেলেন, অনুমান করা অন্যায় নয় যে এনরনের শিক্ষাদানের প্রসাদ ইতিমধ্যে ভাজপাকেও পরিতৃপ্ত করেছিল।
হলফ করেই বলা যায়, কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রতি বছর চার লক্ষ কোটি টাকার মত ব্যয়ের পরিমাণ, তা থেকে অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা উৎকোচে-উপঢৌকনে-দস্তুরির ফল্গুধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। যতদিন না রাজনীতির কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঘটছে, এরকমই চলবে, আরও বেশ কয়েক ঋতু কংগ্রেস ও ভাজপা ভাগাভাগি করে কেন্দ্রে পালা করে শাসনক্ষমতা করায়ত্ত রাখবে, একই বিভঙ্গে: এ বলবে আমাকে দেখো, ও-ও বলবে তাই। একটি-দুটি বফর্স বা তহেলকা কেলেঙ্কারি বেতারে-টেলিভিশনে-সংবাদপত্রে মুখরোচনের উপাদান পরিবেশন করবে, কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে কারও হৃদয়ই কম্পিত হবে না: এটাই ভারতভাগ্যবিধাতার আসল চেহারা।
কাশ্মীর সমস্যার ক্ষেত্রেও অনুরূপ উক্তি না-করে উপায় নেই। এখন যা অবস্থা, সংসদের মধ্যে বুকের পাটা খুব কম সাংসদের আছে যাঁরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারবেন, এ শুধু অলস খেলা, এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে কাশ্মীর নিয়ে অসংখ্য মারাত্মক ভুল করা হয়েছে; কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই নামতা আওড়ানোর সঙ্গে রূঢ় বাস্তবের এখন আর কোনও সম্পর্ক নেই। ফৌজের বর্মে ঘিরে, অত্যাচার-পীড়ন চালিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল আমরা দখল করে রেখেছি, কিন্তু ওখানকার মানুষদের মন জয় করতে পারিনি। রাজত্ব কায়েম রাখতে অর্ধশতাব্দী ধরে যে-পরিমাণ অর্থ জাতীয় তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়েছে, যদি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে তা ব্যয়িত হতো, গোটা ভারতবর্ষের আর্থিক উন্নয়নের হার, মোটা হিশেবে বলছি, প্রতি বছর অন্তত শতকরা তিন-চার ভাগ বাড়ানো যেত। আমরা মুখ গুঁজে আছি বলে পৃথিবীর মানুষ সোজাসাপ্টা অভিমতে উত্তীর্ণ হওয়া থেকে তো বিরত থাকবেন না। একটু শান্ত চিত্তে সব দিক বিবেচনা করে যদি এগোনো যেত, যদি এখনও এগোনো যায়, কাশ্মীরের যে-সব ভারতবিরোধী সংগঠন, তাদের মধ্যে কারও-কারওকে তা হলে কাছে টানা হয়তো সম্ভব হতো, হয়তো এখনও তা সম্ভব। তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আমাদের একগুঁয়েমি বিসর্জন দেওয়া। সে ধরনের সাহসিকতা, হায়, এখন শূন্যতে গিয়ে ঠেকেছে। যতটুকু সাহস দৃষ্টান্তিত হচ্ছে তা কিছু স্বাধীনচেতা উদারমনা ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে। আর সর্বশেষ যে-পরিস্থিতি, হিন্দুত্বওলারা কাশ্মীর প্রসঙ্গ বিশ্লেষণে সর্বপ্রকার যুক্তির বাইরে।
মাঝে-মাঝে কানাঘুষোয় শোনা যায়, সংসদীয় ক্ষেত্রে মান-অবনমনের জন্য প্রধানত দায়ী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ: তিনি যদি মণ্ডল কমিশনের প্রতিবেদন কার্যকর করার জন্য অতটা উঠে-পড়ে না লাগতেন, তা হলে দেশের এত দ্রুত সর্বনাশ ঘটতো না; তাঁর অনুন্নতবর্গ-প্রেমের জন্যই নাকি নব্বুই সালে জনতা সরকারের দ্রুত পতন ঘটলো, কেন যে তিনি অবিমৃষ্যকারিতার শিকার হলেন! অভিযোগকারীরা আরও বলবেন, এখন অনুন্নত শ্ৰেণীবর্গাদি থেকে উদ্ভূত যে-কেউই সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াতে পারছেন, স্বচ্ছন্দে ঢুকে যেতে পারছেন সংসদে স্রেফ ভোটের জোরে, তাঁর অন্যান্য গুণাবলী থাকুক বা না থাকুক; নিরক্ষররা যেমন পারছেন, ফেরেবাবাজরাও তেমনি।
সবিনয়ে বলবো, ধারণা বা প্রমাণহীন অভিমতের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে লাভ নেই। ন্যূনতম গবেষণাতেই ধরা পড়বে, কেন্দ্রীয় সরকারকে কেন্দ্র করে যত আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেছে, সব ক’টিরই কলকাঠি নেড়েছেন উচ্চবিত্ত শ্রেণীভুক্ত মানুষেরা। যাদের অনেক আছে, ছল-চাতুরি করে ধনৈশ্বর্য বাড়াবার তাগিদ তাদের মধ্যেই সর্বাধিক। অন্য পক্ষে, যদি মেনেও নেওয়া যায়, নিম্ন বর্ণ বা বর্গের যাঁরা সংসদ সদস্য হচ্ছেন গত দশ-বারো বছর ধরে, তাঁরা কথাবার্তায় তেমন সড়গড় নন, সেই সঙ্গে কিন্তু মানতে হবে, ছলচাতুরিতেও তাঁরা দড় নন। তাঁরা অনেকেই নিজেদের বক্তব্য অন্তত, মাতৃভাষায়, চমৎকার প্রকাশ করতে পারেন; যে-ভাষায় তাঁরা বলছেন তা আমার কাছে অবোধ্য বলেই কেন তাঁদের ভাষণকে সম্মান জানানো থেকে বিরত থাকবো?
নিরানব্বুই সালের অগস্টে আমার মেয়াদ ফুরোবার কথা, তবে বছরের গোড়াতেই মনস্থির করেছিলাম, পার্টি থেকে অনুরুদ্ধ হলেও আর রাজ্যসভায় ফিরবো না। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না, অযথা সময়ক্ষেপণ, সংসদের বাইরেও তেমন দলের কাজে আসতে পারছিলাম না। একটু সংকোচের সঙ্গে অন্য একটি কথাও কবুল করি। পার্টির আনুকূল্যে এমন একজন-দু’জন হঠাৎ রাজ্যসভার সদস্য হয়ে আসতে লাগলেন, যাঁদের কদাচ কেউ বামপন্থী বলে অপবাদ দেবেন না, তাঁরা অতীতে কমিউনিস্টদের কোনওদিন ভোট দিয়েছিলেন কিনা সন্দেহ, ভবিষ্যতেও দেবেন না। খবর শুনলাম, পার্টির সমর্থনে আর একজন রাজ্যসভায় আসছেন, যিনি কারগিল সংঘর্ষের সময় গলা ফাটিয়ে দাবি করেছিলেন, অবিলম্বে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে লাহোর দখল করা হোক। হংসমধ্যে বক কিংবা বকমধ্যে হংস হয়ে থাকার আমার কোনও অভিপ্রায় ছিল না। সামনে লোকসভার নির্বাচন, রাজ্যসভার অধিবেশন মুলতুবি হয়ে গেছে, নিরানব্বুই সালের এপ্রিল মাসে তল্পিতল্পা গুটিয়ে কলকাতায় ফিরে এলাম। সামান্য মন খারাপ হলো কয়েকজনের সান্নিধ্য ছেড়ে আসতে হলো বলে। রাজনীতিবৃত্তের মানুষ প্রকাশ ও বৃন্দা কারাত, কিন্তু এই দম্পতির বুদ্ধির উজ্জ্বল্য, সৌজন্য ও অন্যান্য বহু মানবিক মূল্যবোেধ ভুলে থাকা অসম্ভব। সান্নিধ্য ছেড়ে আসতে হলো দাতরজির ভাগিনেয়ী, তার কিশোরী বয়স থেকে আমার চেনা, মানিককেও। মানিক, পোশাকি নাম কালিন্দী দেশপাণ্ডে, মহিলা আন্দোলনের নেত্রী হিশেবে অধিক পরিচিত, তার স্বামী বিখ্যাত মরাঠি নাট্যকার ও চীন বিশেষজ্ঞ গোবিন্দ দেশপাণ্ডে। তাঁদের কন্যা অশ্বিনী ও পুত্র সুধম্ব-র মধ্যেও প্রতিভার দীপ্ত বিকিরণ।