আপিলা-চাপিলা – ৩

তিন

অপর একটি প্রসঙ্গ মুলতুবি রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। আমরা স্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠবার সঙ্গে-সঙ্গেই সোভিয়েট বিপ্লবের কথা শুনতে শুরু করেছি। বিমল সেন নামে এক লেখক-কৃত ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের সরল অনুবাদ পড়া শেষ। আর্মেনিটোলা স্কুলে আমাদের প্রবীণ শিক্ষক, প্রাণবল্লভ বসাক, যাঁকে আমি বাল্য বয়সে ‘প্রাণবল্লম স্যার’ বলে বরাবর অভিহিত করতাম, তাঁদের পারিবারিক বইয়ের দোকান ‘অ্যালবার্ট লাইব্রেরি’ নবাবপুর পাড়ায়। তাঁর সাক্ষাৎ ভাইপো গোপাল বসাক মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় সাজা পেয়ে বছর দশেক কয়েদ বাস করে কমিউনিস্ট হয়ে সদ্য ঢাকায় ফিরে এসেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির গোপন শাখা এ-পাড়ায় ও-পাড়ায়। সংগঠন গড়ে উঠছে বিভিন্ন কলেজে, কোনও- কোনও স্কুলে পর্যন্ত, একটু-একটু করে। আমরা কান পেতে শুনছি চুপি-চুপি কথা বলা বিভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে। বারো-তেরো-চোদ্দো বছরের আমাদের দলে ভেড়াবার জন্য, তা সে যে-দলেই হোক, প্রগাঢ় আগ্রহ, তালিম হিশেবে দাদারা রাজনৈতিক-কারণে-বাজেয়াপ্ত বই থেকে অনুলিখনের নির্দেশ দিচ্ছেন। এমনি করেই আমরা যেমন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’র সঙ্গে ভাব জমাচ্ছি, সেই সঙ্গে রেবতী বর্মনের কমিউনিস্ট ইস্তেহারের হাতে-লেখা বাংলা অনুবাদও এখান-ওখান থেকে চেয়েচিন্তে এনে পড়ছি, নির্জন দ্বিপ্রহরে বা গভীর রাত্রে, গুরুজনদের দৃষ্টি এড়িয়ে।

গুরুজনদের দৃষ্টি এড়িয়ে গ্রন্থপাঠের প্রসঙ্গে সাহিত্যপাঠের মহার্ঘ মুহূর্তগুলির কথাও মনে পড়ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারভুক্ত যে-কোনও সাধারণ বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ তখনও প্রধানত হয় রবিঠাকুর, নয় রবিবাবু। প্রায় প্রতি বাড়িতেই একটি করে ‘চয়নিকা’; তা থেকে, যে-কবিতা সব সময় সব চেয়ে বেশি আমাদের নির্দেশ দেওয়া হতো জোরে চেঁচিয়ে মুখস্থ করবার জন্য, তা ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর…’। ‘পশিল’ যে আসলে ‘প্রবেশ করিল’, সেটা সম্যক উপলব্ধি করতে আমি বোধহয় একটু ধন্ধে পড়ে গিয়েছিলাম, আর্ষপ্রয়োগের ব্যাপারটা মাথায় ঢুকত না বলে। তেমন অভাবের সংসার না হলে সাধারণ গৃহস্থ বাড়িতে অন্তত এক, কখনও দুটো, মাসিক পত্র-পত্রিকা রাখার চল ছিল। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা আসতো আমাদের বাড়িতে। পুরনো ‘ভারতবর্ষ’, অন্তত গোটা কুড়ি বছর জুড়ে, বাঁধানো রাখা ছিল বইয়ের আলমারিতে। আলমারিতে তালাচাবির ব্যবহার ছিল না। সুতরাং দীর্ঘ দুপুরে বড়োদের এড়িয়ে আমি এক-একটি খণ্ড বের করে এনে ডুবে যেতাম ‘ভারতবর্ষ’-তে। মজে যেতাম দিলীপকুমার রায়ের ‘রঙের পরশ মনের পরশ’-এ, শরৎবাবুর ‘শেষ প্রশ্ন’-তে ও অসমাপ্ত ‘শেষের পরিচয়’-এ, নরেন্দ্র দেব মশাইয়ের রূপকথায় কিংবা অনুবাদ কবিতায়, রাধারাণী দত্তর রবীন্দ্রনাথের-প্রভাবে-সর্বসমাচ্ছন্ন দীর্ঘ কবিতায়, শৈলজানন্দের কয়লাকুঠির গল্পে, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের প্রতিটি বাক্যান্তে অবধারিত তিনটি-চারটি ফুটকির সমারোহ-সহ, অতি চমৎকার বাঙালি ঘরোয়া গল্পে। সত্তর বছর বাদে ডট-কমের ভুবনে আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছি, কিন্তু সেই কৈশোরেই সৌরীন্দ্রমোহনের সৌজন্যে ডটের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়। বয়স বাড়ে, পুরনো ‘ভারতবর্ষ’ ঘাঁটতে ঘাঁটতে এগিয়ে যাই। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের ‘অভয়ের বিয়ে’ ও ‘তারপর’, ময়মনসিংহ জেলার বাচনে ঠাসা ‘শেষ পথ’। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর বেপাড়া নিয়ে গল্প ‘ইতি’। সেই গল্প যে-পৃষ্ঠায় শেষ হলো, সম্ভবত পাদপূরণের জন্য, সেখানে শ্রীবুদ্ধদেব বসুর কবিতা, ‘সব শেষ হলো তবে? তা-ই হোক, অশ্রু ফেলিও না। জানো নাকি অশ্রুজল ওষ্ঠপুটে ঠেকে বড়োনোনা, বিষম বিস্বাদ, যে ওষ্ঠে রেখেছো এঁটে প্রণয়ের সম্পূর্ণ সম্বাদ’। কিন্তু শুভ্রশ্মশ্রুতে-মুখাবয়ব-মণ্ডিত পরম উদারহৃদয় সম্পাদক জলধর সেনের জাদু দেখানোর এখানেই ইতি নয়। পরের সংখ্যাতেই শোভাবর্ধন, অথবা মতান্তরে কলঙ্কলিপ্ত-করা, বুদ্ধদেব বসুর আরও ভয়ংকর রচনা, এবার গল্প, ‘যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপ্পান্ন’। হীরেন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় নামে একজন রোমান্টিক বিষাদের গল্প-উপন্যাস লিখতেন, যেমন ‘বিরহ-মিলন কথা’। আর-একজন, অমিয়জীবন মুখোপাধ্যায়, স্যানিটরিয়ামে নির্বাসিত প্রেমপীড়িত যক্ষ্মারোগীদের নিয়ে। সব কিছুই আমার প্রথম পড়া ‘ভারতবর্ষ’-এ, এমনকি প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প ‘সাগর সঙ্গমে’ পর্যন্ত। সেই সঙ্গে স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘অন্ত্যেষ্টি’, সরোজকুমার রায়চৌধুরীর ‘পান্থনিবাস’ ও ‘হংসবলাকা’। সাহিত্যের আধুনিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে গেলাম যেন।

গুরুজনদের কাছে মাঝে-মাঝে ধরা পড়ে যেতাম। তখন কয়েকদিন হয়তো আমাকে চোখে-চোখে রাখা হতো। কিন্তু মন্থর সময় আবার পুরনো বৃত্তে ফিরতো। আমি বেপরোয়া, সৃষ্টিরসের সন্ধানে মেতে উঠেছি ততদিনে, জেনে গিয়েছি বুদ্ধদেব বসু ঢাকা শহরেরই ছেলে, আপাতত কলকাতাপ্রবাসী। তাঁর বাবা ভূদেবচন্দ্র বসু আমার মায়ের জ্ঞাতি; প্রায়ই আমাদের বাড়িতে ওঁর আনাগোনা। একটু পরে ক্রমশ ‘প্রগতি’, ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’ ইত্যাদির কথাও জানতে পারলাম। নবম-দশম শ্রেণীতে উঠতেই সাহিত্যপাঠের অর্গল সম্পূর্ণ উন্মুক্ত:। বাংলা বই, পত্রিকা, সেই সঙ্গে ইংরেজিও। এক টাকা দিলে পাওয়া যেত তিনটি পেঙ্গুইন।

আমি তখন সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে। বুদ্ধদেব বসুর এক অনুজ, জয়দেব, স্কুলে আমার এক ক্লাস-দুই ক্লাস নিচে পড়তো। ‘কবিতা’ পত্রিকার নাম ভাসা-ভাসা আগেই শুনেছিলাম। একদিন জয়দেব আমাকে প্রথম তিন-চার বছরের একগুচ্ছ ‘কবিতা’র সংখ্যা পড়তে ধার দিল। সহসা নতুন গ্রহলোকে পৌঁছে গেলাম। প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ইলেকট্রনের তামাশা’, সমর সেনের উদ্ধত কামনার মতো সেই মেয়ের বর্ণনা, জীবনানন্দ দাশের ‘মৃত্যুর আগে’; আমি কোন সংখ্যাটি ফেলে অন্য কোন সংখ্যাটি হাতে নেবো, মুহ্যমান, হতভম্ব, স্থির করতে পারি না। ঘোরের মধ্যে কাটলো। অথচ পাশাপাশি যে-স্মৃতিখণ্ডটি এখনও সমান উজ্জ্বল, ‘কবিতা’ উপভোগের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। ‘কবিতা’-র ওই সংখ্যাগুলি বুদ্ধদেব বসু তাঁর পিতৃদেবকে উপহার পাঠিয়েছিলেন: ‘শ্রীযুক্ত ভূদেবচন্দ্র বসুর করকমলে, বুদ্ধদেব’। বাবাকে নয়, শ্রীযুক্ত ভূদেবচন্দ্র বসুকে; ব্যাপারটি আমার কাছে আশ্চর্য তথা অভিনব মনে হয়েছিল।

অবশ্য ইতিপূর্বেই রবীন্দ্রনাথে বিভোর হওয়া। ‘চয়নিকা’ পেরিয়ে ‘সঞ্চয়িতা’, ‘সঞ্চয়িতা’ পেরিয়ে ‘খেয়া’, ‘বলাকা’ পেরিয়ে ‘পূরবী’; তারপর ‘মহুয়া’ অতিক্রম করে আমি ‘লিপিকা’ ও ‘শেষ সপ্তক’-এ জড়িয়ে গেছি। আমাদের কয়েক ক্লাস উপরে আর্মেনিটোলা স্কুলে পড়তেন দুই ভাই, সৈয়দ আলি আহসান ও সৈয়দ আলি আশরাফ। পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর তাঁরা দু’জনেই ঘোর জামাত-ই-ইসলামির অনুরক্ত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আলি আশরাফ, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক, ওখানেই থেকে যাওয়া মনস্থ করেন। আলি আহসান অবশ্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি, প্রবীণতম। কিন্তু তাঁর ধর্মীয় গোঁড়ামি, আমার সন্দেহ, প্রবলতর হয়েছে। অথচ স্কুলে দুই ভাই-ই নম্রতায়, শিষ্টতায়, প্রতিভার উজ্জ্বলতায় আমাদের আদর্শস্থানীয় ছিলেন। আলি আহসান প্রায়ই ‘লিপিকা’ থেকে ‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’ আবৃত্তি করে শোনাতেন আমাদের।

বলছিলাম, মজেছিলাম রবীন্দ্রনাথে, ডুবেছিলাম অনেকখানি। তবু, রবীন্দ্রনাথ আমার সত্তা-চেতনা ঘিরে থাকা সত্ত্বেও, ‘কবিতা’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা থেকে আধুনিক কবিতার মদিরা পানের নেশাও আমাকে পেয়ে বসলো: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, অজিত দত্ত, আর, সবচেয়ে যিনি তাঁর চাতুর্য, নাস্তিকতা এবং গদ্য- বিভঙ্গ দিয়ে মোহমুগ্ধ করে রাখলেন, তিনি সমর সেন।

ইতিমধ্যে আমরা আর্মেনিটোলা পাড়া ছেড়ে কায়েতটুলিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটি ছোটো বাড়িতে উঠে গিয়েছি। কয়েক বছর বাদে ফের আর্মেনিটোলার পুরনো বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য, তারপর আমার বাবা বক্সিবাজার পাড়ায়, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সন্নিকটে, নতুন বাড়ি তৈরি করলেন। আমার স্কুল পর্বের শেষ দুই বছর সেই বাড়িতেই কেটেছে। বাড়ির ঠিক বাইরে অর্ফ্যানেজ রোডের উপর মস্ত এক কৃষ্ণচূড়া গাছ, বছরে অন্তত চার-পাঁচ মাস যা আমার সমস্ত অন্তর রাঙিয়ে দিয়ে যেত। পলাশের লালও দেখেছি, রক্তজবার লালও, কিংবা রক্তগোলাপের; কৃষ্ণচূড়ার মহিমার সঙ্গে তুলনা হয় না তাদের। বরাবর স্কুলে আমার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়া এক বন্ধু সাইকেল চেপে ছুটির দিনে আড্ডা দিতে আসতো। বাইরে থেকে বেল বাজালে আমি বেরোতাম, সেই কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম অভিশাপ-আশীর্বাদের প্রচ্ছায়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের গল্প। ওই সময়েই হয়তো ঝোঁকের মাথায় বুদ্ধদেব বসুকে চিঠি লিখতে শুরু করেছিলাম। লেখক বুদ্ধদেব বসুকে সম্মান জানানো চিঠি, সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুকেও; কৈশোরের আবোল-তাবোল প্রলাপমাখানো চিঠি; বুদ্ধদেব প্রতিটি চিঠিরই জবাব দিতেন। তার চেয়েও যা বড়ো কথা, আমি সেই ঋতুতে কবিতায় পুরোপুরিই বখে গেলাম। আমার প্রথম কবিতাপ্রয়াস অথচ বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’-য় প্রকাশিত হয়নি, তা ছাপিয়েছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য ‘নিরুক্ত’ পত্রিকায়। সেই কবিতার নাম, আশ্চর্য হবেন না কেউ, ‘কৃষ্ণচূড়াকে নিয়ে’। আমার বয়স তখন ষোলো। পরে কলকাতায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রথম যেদিন আলাপ হলো, তাঁর প্রথম প্রশ্ন, ‘আপনিই তো সেই অশোক মিত্র, যিনি কৃষ্ণচূড়াকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন, যে-কবিতায় এমন লাইন ছিল: “উচ্ছল চোয়ালওয়ালী মেয়ের পাল?” হাত মেলান ভাই!

অনেক এগিয়ে এসেছি। আমাকে ফিরতে হবে ওই নিটোল বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়াতেই কিছুক্ষণের জন্য। কবিতায় প্লাবিত হবার দিন সেগুলি, কিন্তু সেই সঙ্গে গানেও। অনেকে এখন বিশ্বাস করতে চাইবেন না, কিন্তু তিরিশের দশকের উপান্তে, চল্লিশের দশকের প্রারম্ভে, রবীন্দ্রনাথের গান মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে-ঘরে স্বতঃসিদ্ধতার মতো উপস্থিত ছিল না। পঙ্কজ মল্লিক মশাই প্রতি রবিবার ভোরবেলা এক ঘণ্টার জন্য বেতারে রবীন্দ্রসংগীতের তালিম দিতেন। বাংলা চলচ্চিত্রে, প্রধানত কানন দেবী এবং কুন্দনলাল সায়গলের মধ্যবর্তিতায়, আমরা রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে আরও কিছুটা পরিচিত হয়েছিলাম। যাঁরা ব্যাকরণিক সংজ্ঞায় নিখুঁততম রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশক-পরিবেশিকা, কনক দাশ-সতী দেবী-শান্তিদেব ঘোয-অমিতা সেন, বাজারে কিন্তু তাঁদের রেকর্ড তেমন প্রচলিত ছিল না। রবীন্দ্রনাথের গান শান্তিনিকেতনে পড়ে থেকেছে এক পাশে, ঘরোয়া বাঙালির সঙ্গে তার যেন কোনও যোগাযোগ নেই। এরই মধ্যে আমরা বিভিন্ন স্কুলে-কলেজে ‘শারদোৎসব’ বা ‘নটীর পূজা’ মহড়া হচ্ছে শুনতে পাচ্ছিলাম; কখনও-কখনও প্রত্যক্ষ শ্রুতিদর্শনের অভিজ্ঞতাও হচ্ছিল। তা হলেও তা যেন বাঙালির মধ্যবিত্ততা থেকে বিশ্লিষ্ট, বিচ্ছিন্ন। সুতরাং খুব নির্ভয়ে এবং নির্ভাবনায় দাবি করতে পারি, আমরাই প্রথম প্রজন্ম, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানে অবগাহিত হবার অসহ্য আনন্দে ভেসে যেতে পেরেছি। আরও যা আশ্চর্য বলে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের গান হঠাৎ ছড়িয়ে পড়তে শুরু হলো তাঁর মৃত্যুর পরেই। কলকাতা, এবং মফস্বলেও, রবীন্দ্রসংগীতচর্চার বিদ্যাপীঠ খোলা শুরু হলো একটি-দু’টি করে। শান্তিনিকেতনে বা শান্তিনিকেতনের বাইরে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানে দীক্ষা নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে জর্জ বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠলাবণ্যে রবীন্দ্রসংগীত বাঙালির একান্ত উত্তরাধিকার হিশেবে অচিরেই প্রমাণিত হলো। জর্জ বিশ্বাস নিশ্চয়ই শান্তিনিকেতনে তালিম নেননি। আর আমি যে বিশেষ মুহূর্তের কথা বলছি, সুচিত্রা মিত্র তখনও সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনও কণিকা মুখোপাধ্যায়। যা যোগ করতে হয়, এই সময়বৃত্ত আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের ঐশ্বর্য তো বিলোচ্ছেনই দিলীপকুমার রায় ও সাহানা দেবীর দৌত্যে অতুলপ্রসাদ-দ্বিজেন্দ্রলাল- রজনীকান্ত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজকে মোহিত করলো। নজরুলকে ভুলে থাকি কী করে। এবং তাঁর ঐতিহ্য অনুসরণ করে, কিছুটা বাংলা চলচ্চিত্রের সম্মোহে ধরা পড়ে, হিমাংশুকুমার দত্ত-অজয় ভট্টাচার্য-প্রণব রায়-সুবোধ দাশগুপ্ত কথায়-সুরে বাংলা গানে আধুনিকতার যুগ-সুচনা করলেন, তাঁদের প্রভুত হাত বাড়ালেন বিখ্যাত ভ্রাতৃত্রয় সুবল দাশগুপ্ত-কমল দাশগুপ্ত-বিমল দাশগুপ্ত। যাঁদের এখানে নামোল্লেখ হলো, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কাব্যরচনায় সমান সুদক্ষ ছিলেন, ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁদের রচনা ছাপা হয়েছে।

এ সমস্তই হয়তো আমার স্কুলজীবনের শেষ অধ্যায় বর্ণনার প্রেক্ষিতে ঈষৎ উৎক্ষিপ্ত, কিংবা হয়তো তা নয়। যে চেতনা ও মনস্কতার স্তরে কিশোরকালের অন্তিম মুহূর্তে, তথা তারুণ্যের প্রথম প্রহরে, পোঁছেছিলাম, তাতে তো নানা বর্ণের নানা ঝোঁকের মিশেল। কবিতা পড়ছি, গান শুনছি, খেলার মাঠে হুল্লোড়ে মাতছি, পাড়াটে বিসংবাদে নিজেকে জড়াচ্ছি, একটু-আধটু রাজনৈতিক অনুভবের সংস্পর্শে আসছি। তখন থেকেই বাড়ির ঐতিহ্য মেনে ক্রিকেট সম্পর্কে অনাবিল আগ্রহ। এদেশের-বিলেতের-অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট খেলার প্রতিটি স্কোর প্রায় মুখস্থ। ১৯৩৮ সালে ওভাল টেস্টে ব্রাডম্যানের অস্ট্রেলিয়াকে ইংল্যান্ড গো-হারা হারালো, সেই সঙ্গে লেন হাটন ব্যাটিং-এ ব্রাডম্যানের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলেন। তা নিয়ে আমার কিশোরকালীন মনস্তাপ মনে করে এখনও মজা-মেশানো হাসি পায়, অথবা হাসি-মেশানো মজা! যে চেতনার উল্লেখ একটু আগে করেছি, যে চেতনায় আমি যৌবনের উন্মেষে উত্তীর্ণ হয়েছি, তার জন্য অবশ্য স্কুলের মাস্টারমশাইদের সস্নেহ সাহায্য-পরামর্শ-উপদেশের কাছে অনেকাংশে ঋণী। স্কুলের শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা আগেই বলেছি। কিন্তু শিক্ষকদের সম্বন্ধেও খানিকটা না বললে কৃতঘ্নতা হবে। ইতিহাস এবং ইংরেজি পড়াতেন যথাক্রমে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও নগেন্দ্রনাথ দাশ মশাই; ভূগোল শিক্ষক সরোজকুমার সেনগুপ্ত। বাংলা পড়াতেন, প্রথম দিকে মণীন্দ্রচন্দ্র সেন ও পরে প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞান নিয়ে আমাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কামরুদ্দিন আহমেদ স্যার আড্ডার ঢঙে কাটিয়ে দিতেন। শামসুদ্দিন আহমেদ সাহেব বেশ কয়েকবছর অঙ্ক আর ভূগোলের পাঠ নিয়েছিলেন আমাদের। সংস্কৃত পড়াতেন পণ্ডিত প্রিয়নাথ বিদ্যাভূষণ।

এঁদের সবাইয়ের কাছেই বহুভাবে ঋণী আমি। তবে সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত বোধহয় শামসুদ্দিন স্যারের কাছে। এমন ছাত্রবৎসল শিক্ষক খুব কমই দেখেছি। পড়া না পারলে, কিংবা দুষ্টুমি করলে, কড়া শাসন করতেন, জুলপির উপরের চুল টেনে ডাস্টার দিয়ে গুঁতোতেন। তথাচ ছাত্র-অন্ত প্রাণ, ছাত্রদের শুভ-অশুভ নিয়ে তাঁর অহোরাত্র চিন্তা। একটি ব্যাপারে আমাদের তিনি গভীর ত্রাসের কারণ হয়ে থাকতেন: প্রতি রবিবার, এবং ছুটির দিনে, নিজের পয়সায় রিকশায় চেপে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের জ্ঞাত করে আসতেন, আমরা কে কোন বিষয়ে ভালো, কোন বিষয়ে খাটো, কার হাতের লেখার উন্নতি দরকার কার স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিলে ভালো হয়। আমাদের দেশজ প্রবচনের বয়ান ‘অতি ঘরন্তী না পায় ঘর’। শামসুদ্দিন স্যারের বাড়িতে থেকে তাঁর ভাগ্নে গোলাম হোসেন পড়াশুনা করতেন, আমাদের কয়েক ক্লাস উপরের শ্রেণীর ছাত্র। শান্ত মানুষ, লেখাপড়ায় তেমন দড় নয়, কিন্তু খেলাধুলোয় ওস্তাদ। সেই গোলাম হোসেন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে দু’বছর আই এসসি পড়েছেন। ফুটবলে তাঁর উৎসাহের জুড়ি নেই, কুশলতায়ও। পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারবেন কি না সে সম্পর্কে তার নিজেরই হয়তো সন্দেহ ছিল; কাহিনীর বাকিটুকু শামসুদ্দিন স্যারের কথাতেই বলি, ‘বুঝলি, আমার কী কপাল। গোলাম হোসেনের পরীক্ষার তারিখ এসে গেছে। প্রতিদিন সাতসকালে দুধ-কলা-ভাত খাইয়ে রওনা করে দিতাম। বিকেলে ফিরলে জিজ্ঞাসা করতাম, কেমন পরীক্ষা দিলি? তার সংক্ষিপ্ত জবাব, ভালো। পরে আবিষ্কার করলাম হতভাগা পরীক্ষা দিতে বসেইনি, সারাদিন ফুটবল ঠেঙিয়ে বেড়িয়েছে। আমি কী করবো বল্‌। আমার দিদির একটা মাত্র সন্তান। সে উচ্ছন্নে গেল!’ তা বলে শামসুদ্দিন স্যারের অতটা আক্ষেপের কারণ ছিল না। এক-একজন মানুষের প্রতিভা এক-এক দিকে খোলে; গোলাম হোসেনের প্রতিভার ক্ষেত্র ছিল ফুটবলের বর্তুল ঘিরে।

সম্ভবত ১৯৪০ সাল সেটা! কলকাতা থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের ফুটবল দল ঢাকায় কয়েকটি প্রদর্শনী খেলা খেলতে হাজির। ডাকসাইটে দল সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের: গোলে মোহনবাগানের রাম ভট্টাচার্য, দুই ফুলব্যাক, ইন্দু কুণ্ডু ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় (দু’জনেই ভবানীপুরের); হাফব্যাকদের মধ্যে এরিয়ানের দাশু মিত্তির, মোহনবাগানের নীলু মুখার্জি: যতদূর মনে পড়ে, রাইট আউট স্বনামখ্যাত নির্মল চাটুজ্যে, এবং লেফ্‌ট আউট, তথা দলপতি, মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অধিনায়ক আব্বাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে খেলায় প্রেসিডেন্সি ড্র করলো। কিন্তু ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সঙ্গে খেলতে গিয়ে এক-শূন্য গোলে তাদের পরাজয়: গোলদাতা সেই গোলাম হোসেন। ঢাকাতে বিদেশবিভুঁয়ের দল খেলতে এলে বরাবরই একটু বিপাকে পড়তো। আরও দু’-তিন বছর পূর্বেকার কাহিনী: বিলেত থেকে আর্সেনাল-উলভারহ্যাম্পটন ইত্যাদি দুর্ধর্ষ ক্লাব থেকে বাছাই করে গঠিত ইসলিঙটন কোরিন্থিয়ান্স নামে এক ফুটবল দল ভারতবিহারে এল। তারা পেশোয়ার থেকে ত্রিবান্দ্রম, করাচি থেকে কলকাতা-মাদ্রাজ সব মিলিয়ে বিভিন্ন শহরে গোটা পঁচিশ খেলায় অংশগ্রহণ করেছিল। ভারতবর্ষের অন্য সব ক’টি খেলায় তারা অপরাজিত, একমাত্র ঢাকা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে, কী আজব ব্যাপার, তারাও এক গোলে হেরে গেল। গোলটি করেছিলেন উয়াড়ি ক্লাবের পাখি সেন, যিনি কলকাতায় রেলের টিমে খেলতেন। আই এফ এ দলে তাঁর জায়গা হতো না, কিন্তু স্বস্থান ঢাকায় বিজয়ী বীর। মনে আছে, পরের দিন ঢাকার সমস্ত স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল বিজয় উৎসবের আবেগে।

কৃষ্ণচূড়া গাছ, ‘গীতবিতান’-এ ডুবে যাওয়ার প্রথম উন্মাদনা, কবিতা আর কবিতায় ঘেরা আর্মেনিটোলা স্কুল। স্কুলের উত্তর প্রান্তে একটি মস্ত গুলঞ্চ গাছ। ‘গীতবিতান’ আসলে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাব্যের নির্যাস, এই উপলব্ধির পাশাপাশি একটু-একটু করে রবীন্দ্রসংগীতের মোহিনী মায়ায় আবিষ্ট হওয়া যদিও কবুল না করে উপায় নেই বাংলার ঘরে-ঘরে নজরুলের গানের জাদু তখনও রবীন্দ্রসংগীত ছাপিয়ে।

যেটা বলা প্রয়োজন, আমার নিজের ধারণা, সাহিত্যপ্রীতি, গানে অনুরাগ, আড্ডায় মজে যাওয়া, এ-সমস্ত কিছুরই অঙ্কুর হয়তো আমার মামাবাড়ির পরিবেশে। আমাদের নিজেদের আদি গ্রাম ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ মহকুমার প্রায় সঙ্গমস্থলে, লাঙ্গলবন্ধ গ্রাম ও বন্দরের পাশে। তা ধবলেশ্বরী ও শীতলক্ষা নদীর সম্মিলিত আক্রোশে ভেঙে-ধুয়ে-মুছে যায়। প্রপিতামহ নতুন করে বসতি স্থাপন করেছিলেন মানিকগঞ্জ মহকুমার সাভার শহর-সন্নিহিত চান্দহর গ্রামে। এমনই ললাটলিখন, সেই বসতিও নদীর গর্ভে অচিরে নিশ্চিহ্ণ হয়। আমরা তাই গ্রামের বাড়ি বলতে মামাবাড়িই বুঝতাম। বিক্রমপুর পরগনার মালখাঁনগর গ্রাম; গ্রামের সুখ্যাতি-কুখ্যাতি দুটোই অন্তত সেই তিরিশ-চল্লিশের দশকে অতি প্রকট। গাঁয়ের জমিদারদের কুলীন বলে অহংকারের অবধি নেই। প্রজাপীড়নেও তাঁরা সমান তুখোড়। প্রজাদের অধিকাংশ হয় মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত নয়তো কৈবর্ত, মাহিষ্য, নয়তো মাঝি-মেঝেন গোষ্ঠীর, মুসলমানই বেশি। এঁদের উপর জমিদারি অত্যাচারের সীমা-পরিসীমা ছিল না। একটি কাহিনী আমি অন্যত্র উল্লেখ করেছি, পুনরুক্তি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। হেমন্তের শিথিল দুপুর; জমিদারনন্দন কৰ্ষিত মাঠের আল ধরে উত্তর থেকে দক্ষিণে আসছেন; একটি তরুণ মুসলমান প্রজা, হয়তো বড়ো জোর সতেরো-আঠারো বছর বয়স হবে, সেই আল বেয়েই দক্ষিণ থেকে উত্তরবর্তী। প্রথাগত ব্যাকরণের নাকি অনুজ্ঞা, জমিদারবাড়ির কেউ উল্টো দিক থেকে আলের পথে হেঁটে এগিয়ে এলে প্রজাকুলের প্রত্যেককে সঙ্গে-সঙ্গে আল থেকে নেমে যেতে হবে। সেই অবোধ প্রজাসন্তান নিয়মটা হয়তো ভালোমতো জানতো না; জমিদারনন্দনের মুখোমুখি হয়ে সেই নির্বুদ্ধির ঢেঁকি, এত আস্পর্ধা, আল থেকে না নেমে শরীরটা একটু বেঁকিয়ে তাকে জায়গা করে দিয়েছিল। তাই নিয়ে জমিদারের মহলে ঢিঢিক্কার; তবে নিরামিষ ঢিঢিক্কার নয়। ছেলেটিকে পেয়াদা পাঠিয়ে বেঁধে নিয়ে আসা হলো তখনই। জমিদারবাড়ির প্রাঙ্গণে তার শরীরটি আছড়ে ফেলা হলো, দড়ি দিয়ে তাঁর হাত-পা বাঁধা হলো। তারপর পেরেক-ঠোকা একটি কাঠের তক্তি দিয়ে প্রহারে-প্রহারে তাকে রক্তাক্ত-জর্জরিত করা। ওই দুঃস্বপ্নস্মৃতি কোনওদিন ভুলতে পারিনি। ওই স্মৃতির অভিজ্ঞতাই আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে, পূর্ববঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায় কেন পাকিস্তানের সমর্থনে তাঁদের সম্মতি জ্ঞাপন করেছিল। কে জানে, আমার বামপন্থী মানসিকতার উৎসও হয়তো ওই স্মৃতির অসহ্য নিপীড়নে নিহিত। (তবে একটি বিশেষ বাল্যশিক্ষার প্রভাবও কী করে অস্বীকার করি? আমার নীতিবাগীশ বাবা ভর্ৎসনার সুরে প্রায়ই বলতেন: সব সময়ে উপরের দিকে তাকাতে নেই, মাঝে-মাঝে নিচের দিকেও চোখ ফিরিও।)

লতায়-পাতায় পল্লবিত মাতুলগোষ্ঠী বসু ঠাকুরদের অথচ গুণাবলীও ছিল যথেষ্ট। প্রজাকুলের উপর অত্যাচারের পাশাপাশি তাঁরা ঋতুতে-অঋতুতে দানধ্যান করতেন। অঢেল  জমিদারি সম্পত্তি, উপার্জনের জন্য আলাদা বৃত্তি অন্বেষণের তখনও প্রয়োজন দেখা দেয়নি। তাঁদের জীবনযাত্রার কথা মনে হলেই আমার একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না’ আর ‘চারু ও হারু’ গ্রন্থের সেই উদ্ধৃতি, ‘লিখিবে পড়িবে মরিবে দুখে, মৎস্য ধরিবে খাইবে সুখে’ স্মরণে এসে যায়। জমিদারতনয়দের ঘুম ভাঙতো সকাল দশটা-সাড়ে দশটায়। চা দিয়ে মুড়ি কিংবা অন্য কোনও খাদ্যবস্তু গলায় ভিজিয়ে তাঁরা প্রাতরাশ সারতেন। অতঃপর বড়শি হাতে নদীর ধারে বা দিঘির পাড়ে চলে যেতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে প্রতীক্ষার সাধনা: মাছ ধরার সফলতার শেষে, হয়তো দুপুর গড়িয়ে যখন প্রায় বিকেল বা সন্ধ্যা হয়-হয়, বাড়ি ফিরতেন। গৃহিণী বা বাড়ির রাঁধুনি উনুনে সেই মাছের স্বাদু ঝোলের রান্না বসাতেন। স্নানান্তে খেতে বসতেন জমিদারনন্দন, ভরসন্ধ্যায় বা কনে-দেখা-আলোর মুহূর্তে। তারপর বারোয়ারিতলায় নৈশ আড্ডা, নিখাদ গ্রাম্য কলহ বা ষড়যন্ত্র। নৈশ আহার মধ্যরাত্রি পেরিয়ে। এই বংশের মানুষগুলির প্রতিভা অথচ নানা দিকে ব্যাপ্ত। জমিদারদের বাড়ির ছেলেরাই ঢাকা কিংবা ময়মনসিংহ বা কলকাতায় ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলেছেন। কেউ-কেউ গ্রামের স্কুলেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে মেধাবী পণ্ডিত হয়েছেন। গ্রাম থেকে দুই-একজন আই সি এস বেরিয়েছেন। এই গ্রামের অন্তত দু’জন দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হয়েছেন পর্যন্ত: একজন বসন্তকুমার বসু, কলকাতার নামী অ্যাডভোকেট, গায়িকা উমা বসুর পিতামহ; সমাজসেবিকা ফুলরেণু গুহর মাতামহ। অন্যজন চন্দ্রকান্ত বসু ঠাকুর। শেষোক্ত ভদ্রলোক অস্তায়মান সূর্যের মতো প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রধান থেকে জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন, জেলা কংগ্রেসে পৌরোহিত্যের পর মহকুমা কংগ্রেসের সভাপতি, সব শেষে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। আমি যখন তাঁকে দেখি, আশি পেরিয়ে গেছেন, অসমর্থ শরীর, বাড়ির একটা ঘরে তাঁর চলাফেরা আবদ্ধ। অথচ মনের অস্থিরতা নির্বাপিত হবার নয়। ঘরের আসবাব সামান্যই: একটা খাট, একটা টেবিল, একটা চেয়ার, একটা নিকষ তক্তপোশ। প্রতি দশদিন অন্তর এই আসবাবগুলিই এখান থেকে ওখানে করছেন, ওখান থেকে এখানে। অতীতের হাতছানি তিনি ভুলতে পারেননি, নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। চন্দ্রকান্ত বসু ঠাকুরের অনুজ নীলকান্ত আরও বেশি আজব মানুষ ছিলেন। তিনি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করতেন, নিজের খরচে সে নাটক ছাপাতেন পল্লীর দুর্গোৎসবে পাড়ার ছেলেছোকরাদের বগলদাবা করে নাটকের তালিম দেওয়াতেন, তাঁর নজর এড়াবার জন্য উঠতি বয়সের ছেলেরা সতত সতর্ক, তবে মাঝে-মাঝেই তারা হঠাৎ ভয়াবহভাবে ধরা পড়ে যেত। নীলকান্ত যখন নাটক ফাঁদতেন না, তখন তাঁর প্রধান উপজীব্য স্বদেশী করা। চরকা কাটতেন, গ্রামে-গ্রামে গান্ধিজীর মহিমা প্রচারে যেতেন। অথচ এই গ্রাম থেকেই একজন-দু’জন অন্য আদর্শ-অবলম্বী যুবক বেরিয়েছে, তাঁরা পিস্তল-বোমায় দীক্ষিত। কেউ-কেউ, যেমন অতীন্দ্রনাথ বসু, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্দান্ত কৃতী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর জেলখানায় কাটিয়েছেন, সুভাষচন্দ্রের শিষ্য হিশেবে। গ্রামের আরেকজন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে সৈন্যদলে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা বিপ্লবের প্রস্তুতির জন্য মাদ্রাজের উপকূলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাবমেরিনে অস্ত্র পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েন, প্রভুরা তাঁকে গুলি করে মারেন। সেই দুঃসাহসী মালখাঁনগরীয় শহিদ, মানকুমার বসু, বিশেষ কেউ মনে রাখেনি তাঁকে। মালখাঁনগর জমিদার বংশের মেয়েদের সুখ্যাতির সঙ্গে প্রচুর অখ্যাতি-অপখ্যাতিও ছিল। উমা বসু বা হিমাংশুকুমার দত্তের সুরারোপিত গীতমালার প্রধানা গায়িকা সাবিত্রী ঘোষ ছাড়াও আরও অনেক সংগীতপটীয়সী মহিলা এই পরিবার থেকে বেরিয়েছেন। কলকাতা বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হওয়ার ক্ষেত্রেও মালখাঁনগর গ্রামের ললনারা বিক্রমপুর পরগনায় অগ্রবর্তিনী। আর লেখককুলের কথাই যদি বলতে হয়, বুদ্ধদেব বসু যেমন এই বংশপরম্পরা বহন করেছেন, করেছেন সুনির্মল বসুও। প্রতিভা বসু বুদ্ধদেব বসুর সহধর্মিণী, কিন্তু সেই সঙ্গে এই গ্রামের ভাগিনেয়ীও। বলতে কুণ্ঠা বোধ করা হয়তো উচিত, হয়তো বা উচিত নয়, আমার স্ত্রীও মালখাঁনগরের ভাগিনেয়ী, আমি যেমন ওই গ্রামের ভাগিনেয়।

অত্যাচারী জমিদারকুল, তথাচ সংগীতে আগ্রহী, সাহিত্যে আগ্রহী, অন্তত কয়েকজনের কথা জানি বিদ্যাচর্চা আর খেলাধুলার নামে বরাবরই প্রায় উন্মাদ। জমিদারতন্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা ও বীতরাগে আমার অন্তঃকরণ কৈশোর-তারুণ্যের সেই সেতু-মুহূর্তেই সমাচ্ছন্ন। তা বলে না মানি কী করে, বাঙালি মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির যে আদল আমার চেতনাকে প্রধানত রূপ দিয়েছে, তা মামাবাড়ির পরিবেশে বছরে অন্তত দু’-তিন মাস নিমজ্জিত থাকতাম বলেই। তা ছাড়া পূর্ববঙ্গের জল-নদী-বৃক্ষ-উদ্ভিজ্জলতাপাতাকে যতটুকু চিনেছি তা মালখাঁনগর গ্রামের আতিথেয়তাতেই। গ্রামময় পুকুরের ছড়াছড়ি, প্রতিটি বাড়ির পিছন দিকে একটি করে পুকুর, যা বর্ষার সময় খালের সঙ্গে যোগ হয়ে যেত, এবং সেই খাল মিলে যেতো মাইল খানেক দূরবর্তী ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে। গ্রামের অদূরে তালতলা বাজারে স্টিমার কিংবা লঞ্চ এসে ভিড়তো। আমরা দুড়দাড় করে জেটির উপর প্রায় আছড়ে পড়ে অবতরণ করতাম। বাচ্চার দল, বর্ষার সময় বাদ দিয়ে অন্যান্য ঋতুতে, মামাবাড়ি পর্যন্ত হেঁটেই মেরে দিতাম। মহিলারা অথবা বৃদ্ধরা পালকিতে সমাসীন হতেন, তখনও সাইকেলরিকশা চালু হয়নি। বর্ষাকালে কোনও সমস্যা নেই, স্টিমার থেকেই নৌকোয় সরাসরি উঠে যেতাম আমরা। নৌকো খালে পড়তো, একটা সময়ে পৌঁছে দিত মামাবাড়ির পুকুরঘাটে। গ্রামে কিছু-কিছু পাকা বাড়ি, সেই সঙ্গে অজস্র কাঁচা বাড়িরও মিশ্রণ: হয়তো দেওয়ালে, গঙ্গা-যমুনা গাঁথুনির উপরে করোগেটেড টিনের চালা, কিংবা টিলা বা খড়ের আচ্ছাদন। বড়ো বাড়ি, মধ্যের বাড়ি, ছোটো বাড়ি, নাজির বাড়ি, এমন ধারা শরিকদের বিভিন্ন বাড়ির পরিচয়। প্রত্যেকের আলাদা সংসার, কিন্তু এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতে কোনও পোশাকি আচারের আড়াল নেই। যে-কোনও শরিকের যে-কেউ অন্য এক শরিকের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে আড্ডা জমাতে পারতেন, অথবা গানে মজে যেতে।

প্রায়ই সকালে-দুপুরে-বিকেলে গুরুজনদের শাসন না মেনে এদিকে-ওদিকে বেরিয়ে পড়তাম। আসলে মামাবাড়িতে এলে শাসনের ফর্দ স্বভাবত একটু হ্রস্বায়িত হয়ে যেত। সুতরাং আমাদের স্বাধীন রাজা হতে, নিরুদ্দেশ যাত্রায় যেতে, বিশেষ কোনও বাধা থাকতো না। হারিয়ে যেতাম গ্রামের পথে, বাঁশঝাড়ের গহনে, কিংবা আম-কাঁঠালের জঙ্গলে। অথবা পাকা ধানের সুঘ্রাণে নিঃশ্বাস নিতে-নিতে গ্রীষ্মের দুপুরে স্বচ্ছ পুষ্করিণীতে নেমে ঝাঁপাঝাঁপির আনন্দে টইটম্বুর হতাম। কখনও তালতলা বাজার থেকে যে দীর্ঘ মেটেল পথ ইছাপুর-আউটশাহী পর্যন্ত প্রলম্বিত, তা দিয়ে হাঁটতাম, আরও হাঁটতাম, আরও। নদীর উপর দিয়ে প্রবল হাওয়া বয়ে যেতো, তার শোঁ শোঁ শব্দ। বড়ো-বড়ো বট-অশ্বত্থ গাছ, তারাও হাওয়ার ঝাপটা নিতো, তাদের ডাল-শাখা-পাতা মুখর হয়ে উঠতো। সেই সঙ্গে তাল, শুপারি বা নারকেল গাছের মন-মাতানো আন্দোলন।

দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে আমরা অনেকেই বিচ্যুত। যে শহরে আমি বেড়ে উঠেছি, সেই ঢাকা থেকে আমি নির্বাসিত। তা হলেও সেই শহরের জন্য তেমন কোনও আলাদা কাতরতা অনুভব করি না। শুধু মাঝে-মাঝে অভাব বোধ করি পূর্ববঙ্গের নদীসংকুল, হাওয়াতে দীর্ণ, বৃক্ষরাজিতে পর্যুদস্ত প্রকৃতির সংশ্লেষের। মনে-মনে একটি তত্ত্ব পোষণ করে এসেছি, খুলেই বলি এখানে। মানুষের কল্পনা জল-নির্ভর, হাওয়া-নির্ভর, প্রাকৃতিক সম্পদ-নির্ভর। এমন নয় যে রাঢ়ভূমিতে যাঁদের জন্ম তাঁরা সবাই-ই কল্পনায় কিঞ্চিৎ খাটো। তা সত্য হলে কাজী নজরুল ইসলাম অমন বেপরোয়া কবিতা লিখতে পারতেন না। তবু বিক্রমপুর পরগনাকে, এবং তার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যরাজিকে, স্বগত নমস্কার না জানিয়ে উপায় নেই। আমি আজ যা, তা অনেকটাই, জোর দিয়েই বলতে পারি, সেই প্রকৃতির করুণা, যদিও এবার-ফিরাও-মোরে নাটকীয়তায় প্রবেশ হাস্যকর হবে।

আমাকে তা হলেও ঢাকা শহরে একচল্লিশ-বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ সালের পরিবেশের স্মৃতিমেদুরতায় ফিরে আসতে হয়। খানিক আগে উপর-থেকে-চাপানো সাম্প্রদায়িক সংঘাতের উল্লেখ করেছি, যার পরিণামে ১৯৪১-এর একটা বড়ো সময় আমাদের কাছে নিরর্থক হয়ে যায়। তারপর বেয়াল্লিশের আন্দোলন, একটু-একটু করে রাজনীতির অন্ধিসন্ধিতে অনুপ্রবেশ, রাজনৈতিক দাদাদের সঙ্গ-সান্নিধ্যের জন্য বাসনা-প্রার্থনা। এ পাড়ায় একদল প্রবল, ভিন পাড়ায় অন্য এক দল। পাড়াগত কোঁদলই দিনকতক পরে রাজনীতির খোলস পরে উদয় হতো। অগস্ট আন্দোলন বলতে গেলে একমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়েরই আন্দোলন। গান্ধিজী সপারিষদ কারাভ্যন্তরে অদৃশ্য হলেন, বাংলাদেশের জমিদার-প্রধান কংগ্রেস নেতারা কেউ-কেউ শখের কারাবরণ করলেন; কেউ-কেউ ততটা প্রাগ্রসর নন। কয়েক সপ্তাহের জন্য আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করলো মুখ্যত বামপন্থীদের নির্দেশনায়। আন্দোলনে অহিংসার ছিটেফোঁটাও নেই, এখানে-ওখানে পুলিশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ, রেল লাইন ওপড়ানো, ডাকঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের ঢুকতে বাধা দেওয়া। ওদিকে মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্তরা স্বচ্ছন্দে ক্লাস নিতেন, ক্লাস করতেন। সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কারণ তাঁদের আটকাতে গেলে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন খুব সম্ভব বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মোড় নিত।

ততদিনে আর্মেনিটোলা স্কুল পেরিয়ে জগন্নাথ কলেজে প্রবেশ করেছি: ইন্টারমিডিয়েট আর্টস পঠন, যা এখনকার এগারো-বারো ক্লাসের প্রায় সমপর্যায়ভুক্ত। হঠাৎ গণ্ডিটি যেন মস্ত বড়ো হয়ে গেল। প্রতিদিন নতুন-নতুন চেনা-পরিচয়, এবং মেয়েদের সঙ্গে ক্লাস করার প্রথম রোমাঞ্চ। অবশ্য সব কিছু ছাপিয়ে মন্বন্তরের বিভীষিকা! বাংলাদেশে সে বছর ফসলের ঘাটতি তেমন ছিল না। কিন্তু ফসলের একটা বড়ো অংশ মহান বিদেশী সরকার অন্যত্র পাচার করে দিয়েছিলেন। তার উপর এ-জেলা থেকে ও-জেলায়, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, খাদ্যশস্য যাতে অবাধে বাহিত হতে না পারে, সেজন্য প্রতিটি জেলায় কাতারে-কাতারে সব ধরনের নৌকো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। পরাধীন দেশ, সেই সঙ্গে প্রভুদের মনে জাপানি আতঙ্ক! জাপানিরা এসে পাছে ফসলের দখল নেয়, তাই শস্য বাজেয়াপ্ত করো, নৌকো ডুবিয়ে দাও বা বাজেয়াপ্ত করো। সরকার যে বীভৎস কুকাজ আরম্ভ করলেন, সেটা সম্পন্ন করলেন জোতদার-মহাজন সম্প্রদায়। ইতিপূর্বে মজুতদার কথাটির সঙ্গে সাধারণের পরিচয় হয়নি, এবার হলো। সর্বত্র আতঙ্ক। যাঁদের বিত্তের বা সম্পদের জোগান ছিল, বা জীবিকাগত ভিত্তি ছিল, তাঁরা কোনওক্রমে খেয়ে-পরে বাঁচলেন। অন্যদের ক্ষেত্রে খাদ্যের অনটন, পরিচ্ছদের অনটন। শহরে-গ্রামে ভয়, যে ভয়ের বাস্তব ভিত্তি ছিল। চালের দাম হু হু করে চড়তে শুরু করলো তেতাল্লিশ সালের গোড়া থেকে, কাপড়ের দামও। ক্রমশ বাড়তে লাগলো নিরন্নের হাহাকার, গ্রাম ছাপিয়ে শহরে।

স্কুলে থাকতে ইতিহাসের বইতে ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা পড়েছিলাম। এবার সেই বিভীষিকার সঙ্গে সম্পূর্ণ মুখোমুখি। যে চাষিরা ফসল বুনেছেন, ফলিয়েছেন, সেই ফসল ঘরে তুলেছেন, তাতে তাঁদের ন্যূনতম অধিকার নেই। সে ফসল কোথায় হাওয়া হলো, তা তাঁরা কেবল অনুমানই করতে পারেন। বিদেশী শাসকের ভূমিকা তাঁদের কাছে তেমন স্পষ্ট নয়। কিন্তু জোতদার-মজুতদারদের উদগ্র লোভের শিকার যে তাঁরা হচ্ছিলেন, তা তো তাঁদের প্রত্যক্ষ সজ্ঞান অভিজ্ঞতা। গ্রামে খাবার নেই; খাদ্য না পেয়ে একটা সময়ের পর অসহায় অবোধ মানুষগুলি শহরের দিকে ধাওয়া করলেন, নিজেদের জমিজমা-ভিটেভূমি ছেড়ে, গৃহস্থঘরের যতটুকু সামান্য উপকরণাদি ছিল তা-ও ঠেলে ফেলে, স্রেফ বেঁচে থাকবার, টিকে থাকবার প্রচণ্ড বাসনায়।

ঢাকা শহরে ইতিমধ্যেই সৈন্যদের আনাগোনা শুরু হয়েছে, শহরের একটা-দুটো অঞ্চলে তারা ডেরা বেঁধেছে। কোথাও-কোথাও সরকার থেকে তাদের জন্য আদেশবলে ঘরবাড়ি দখলও করা হয়েছে। এরকম দখল অবশ্য ঘটেছে অন্য অজুহাতেও। বোমার আক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাবার জন্য ভূগর্ভে আশ্রয়স্থল খোলা হয়েছে ইতস্তত। সিঙ্গাপুর-মালয়-ব্ৰহ্মদেশ ততদিনে জাপানিদের করায়ত্ত হয়ে গেছে।

ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিকরা স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিম বাংলার সমস্যার প্রধানত যে ধরনের বিশ্লেষণ করেছেন, যা পরে পড়েছি, তা একটি বিরাট অপূর্ণতার শিকার। পঞ্জাবের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে, ওরা কেমন নিজেদের উদ্যোগে ঝটপট দেশভাগের সমস্যা পেরিয়ে সুখী-সমৃদ্ধ জীবনে উঠে আসতে পেরেছে, বাঙালিরা পারেনি কারণ তারা উদ্যমহীন, পরের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপাতে তাদের জুড়ি নেই। এই স্বভাবনিন্দুকরা সময়ের পটভূমিকাটুকু ভুলে থাকতে চান। দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধজনিত সামাজিক-আর্থিক চাপ বাঙালি অস্তিত্বকে, সেই সঙ্গে অস্তিত্বচেতনাকেও, নড়বড়ে করে দিয়েছিল, যে-সংকট পঞ্জাবকে ছুঁতে পারেনি। উদ্বাস্তুদের জন্য পঞ্জাবে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে যে-পরিমাণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তার সিকি পরিমাণও বাঙালি শরণার্থীদের ভাগ্যে জোটেনি। মহাযুদ্ধ থেকে পঞ্জাবের আখেরে লাভই হয়েছে: ফৌজে-যোগ-দেওয়া পঞ্জাবকুল তাঁদের বিত্তের সম্ভার বাড়াতে পেরেছিলেন, বাঙালিরা যা আদৌ পারেননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *