আপিলা-চাপিলা – ৬

ছয়

যাঁরা আমার এই অতীত কন্ডূয়ন কৃপা করে পাঠ করছেন, তাঁদের কেউ-কেউ সম্ভবত আশ্চর্য বোধ করবেন, এতক্ষণ পর্যন্ত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়নি বলে। আমার কৈফিয়ত অতি স্পষ্ট। তিরিশের-চল্লিশের দশকের যে-বাঙালি সাহিত্যিকদের কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি, তাঁদের থেকে একটু পৃথগীকৃত আমার চেতনায়-মানসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান। দশ বছর বয়সে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় মাস থেকে মাসান্তরে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ পড়তে শুরু করি, তারপর প্রতি পাঁচ বছর অন্তর, প্রতি দশ বছর অন্তর, ফিরে-ফিরে গেছি এই অসামান্য উপন্যাসের সান্নিধ্যে। প্রতিবারই মনে হয়েছে এর চেয়ে মহত্তর সৃষ্টি বাংলা গদ্যের ইতিহাসে নেই। আমার স্পর্ধা ক্ষমার্হ বিবেচিত হোক-না-হোক কিছু যায় আসে না, বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসপ্রয়াসের ঊর্ধ্বেই আমি স্থান দেবো ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-কে: একই সঙ্গে ব্যাপ্তি, বিস্তার, গাম্ভীর্য, শ্লেষ, সমাজজিজ্ঞাসা, বিরহকাহিনী, মিলনকাহিনী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে যে-চিন্তা আমাকে অনবচ্ছিন্ন দীর্ণ করে রেখেছে: প্রতিভা কী করে এমন আপাতঊষর আপাতক্লিন্ন অপলিমাটিতে জন্মগ্রহণ করে? এটা তো ভোলা অসম্ভব, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ রচনা যখন শুরু, তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স মাত্র ছাব্বিশ। একই সঙ্গে, পাশাপাশি, তিনি ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার জন্য ‘পদ্মানদীর মাঝি’-র কিস্তিও দাখিল করে যাচ্ছেন মাসিক পাঁচ টাকার কড়ারে। মানিকবাবু জীবনভর আর যদি অন্য-কিছু না-ও লিখতেন, তাঁর সৃষ্টিমহত্ত্ব সময়ের বিচারে খাটো হওয়ার আশঙ্কা থাকতো না, নেই-ও। অথচ ওই ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকাতেই তারও কিছু আগেই প্রকাশিত হয়েছে ‘আত্মহত্যার অধিকার’ নামক গল্পটি। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক সমাজে অধঃপাতমুখী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নির্মম অবরোহণের গাথা, যার সমকক্ষ বাংলা সাহিত্যে আর কোন সৃষ্টি? মানিকবাবুর প্রসঙ্গে পরে আমাকে ফিরতেই হবে, হয়তো একাধিকবার, তা হলেও এখানে এই সামান্য মন্তব্য সংযোজন করে ঈষৎ চিত্তশান্তি পাচ্ছি। এই উল্লেখের পরোক্ষ একটি কারণ: ছেচল্লিশ সালের গোড়ার দিকে একদিন কবিতাভবনে ঢুকছি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তখনও বুদ্ধদেব বসু-প্রতিভা বসুদের সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন করেননি, বেরিয়ে আসছেন। অরুণকুমার সরকারের সঙ্গে সামান্য পরিচয় ছিল, আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন, নমস্কার-প্রতি নমস্কার। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেই-ই আমার প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ।

যে ক’টা দিন কলকাতায় থাকি, কবিতাভবনে নিয়মিত যাই, কখনও একা, কখনও অরুণকুমার সরকারের সঙ্গে। তবে কবিতা অতিক্রম করে অরুণের অন্য নেশা, মানবেন্দ্রনাথ রায় সম্পর্কে ঘোর মোহ। সেই সূত্রেই কি না জানি না, তাঁর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের রচনার প্রতিও সমান ঝোঁক। আমি মফস্বল থেকে প্রায় সকলেরই কবিতা পড়ি: বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ, অজিত দত্ত, সমর সেন, অমিয় চক্রবর্তী। ‘এক পয়সায় একটি’ সিরিজের ষোলো পৃষ্ঠার কবিতাগ্রন্থ তখন বেরোতে শুরু করেছে। ‘বনলতা সেন’-এ অন্তর্ভুক্ত সব-ক’টি কবিতা আমাদের মুখস্থ, ঘুমে-জাগরণে তারা তাড়া করে ফেরে, মনে হচ্ছিল যেন চমকে-বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে যাওয়ার অন্তহীন পালা। সমর সেনের ‘নানা কথা’, কামাক্ষীপ্রসাদের ‘রাজধানীর তন্দ্রা’, অমিয় চক্রবর্তীর ‘মাটির দেয়াল’, আরও কত। অশোকবিজয় রাহার ক্ষীণকটি বইটিতে হঠাৎ এই পঙ্‌ক্তি আবিষ্কার করে বিস্ময়ের আনন্দে, না কি আনন্দের বিস্ময়ে, আমাদের প্রায় লাফিয়ে ওঠা: ‘আ রে! আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্‌রাফের তারে’। বাংলাদেশের গ্রাম-ঘেঁষা মফস্বলে দিনযাপন না করলে পঙ্‌ক্তিটির ব্যঞ্জনা, আমার বিবেচনায়, বোঝা অসম্ভব। শ্রীহট্ট শহরের দুই কবিকে নিয়ে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম: অশোকবিজয় রাহা ও প্রজেশকুমার রায়। দেশভাগের পর প্রজেশকুমার রায় শ্রীহট্টেই থেকে গেলেন; নিঃশব্দ থেকে নিঃশব্দতর, তারপর নৃশংসভাবে তাঁর নিহত হবার প্রায়-অগোচর বৃত্তান্ত। অশোকবিজয় শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন; ওখানে একটি সুন্দর ছোট বাড়ি তৈরি করে নাম রাখলেন ‘সুরাহা’; আমৃত্যু নিখাদ কবিস্বভাব বজায় রেখেছিলেন।

ঢাকাতে ইতিমধ্যে আমাকে খুঁজে-পেতে আবিষ্কার করেছেন কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত। তিনি বয়সে আমার চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড়ো, কিন্তু অমন উদারচেতা গণতান্ত্রিক সুকোমল মানুষ কম দেখেছি। আমার কিছু-কিছু গদ্যরচনা পড়েছেন, কিছু-কিছু পদ্যপ্রয়াসও। বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপন। ভদ্রলোক সপ্তাহভর অতি প্রত্যূষে ট্রেনে চেপে নারায়ণগঞ্জ চলে যেতেন। সেখানে তাঁর বাঁধা কাজ; বেশি রাত্রে ফিরতেন। কিন্তু সপ্তাহান্ত সাহিত্যের জন্য বরাদ্দ। প্রায় প্রতি রবিবার আমি আমাদের বক্‌শিবাজার-এর বাড়ি থেকে তাঁর মালিটোলার বাসস্থানে হাজির। মাঝে-মাঝে অচ্যুত গোস্বামী এবং অজিত গুহর মতো আরও কেউ-কেউ আসতেন। কিরণশঙ্করের উৎসাহে ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ’-এর বৈঠকে আমার যাওয়া শুরু হলো।

এই সময় থেকেই আমাদের জীবনানন্দ-সম্মোহনেরও সূচনা। ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রাথমিক পর্বে প্রতি সংখ্যাতেই তাঁর মায়া-ছিটোনো কবিতার পর কবিতা। মন্বন্তরের ডামাডোলের মধ্যেই ‘বনলতা সেন’ আমাদের হাতে পৌঁছয়, মন্ত্রমুগ্ধ ঘোরে পরস্পরকে তা থেকে পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তি শোনাই। তখনও আধুনিক বাংলা কবিতার খাস মহলে জীবনানন্দ অপাঙ্‌ক্তেয়। তাঁর স্তবকে-স্তবকে বিচ্ছুরিত আকুলি-বিকুলি অনেকের কাছেই প্রলাপসম উচ্চারণ। তাঁর রচনায় রূপকথা আছে, এলায়িত আনন্দ অথবা দীর্ঘশ্বাস উপস্থিত, তবে চাতুর্য তো নেই, যে-বিশেষ চাতুর্যে ‘কবিতা’ পত্রিকার উন্মেষমুহূর্ত থেকেই পাঠকমহল অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ঢাকা থেকে কোনও এক ঋতুতে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের ঠিকানায় জীবনানন্দকে চিঠি পাঠাতে শুরু করলাম। জবাব আসতে লাগলো; তাঁর কবিতার মতোই, তাঁর চিঠিতেও এক বিশেষ ধরনের দ্বিধাবিজড়িত স্বপ্নালু বিষাদমাত্রা। আমরা—অরুণকুমার সরকার, সুরঞ্জন সরকার, আমি—ততদিনে পরিপূর্ণ জীবনানন্দগ্রস্ত। সজ্ঞান দ্বিরাচারিতা: বিষ্ণু দে-সুধীন্দ্রনাথ দত্তে আবিষ্ট আছি, অথচ জীবনানন্দীয় ঘোরও লেগেছে তা ধিন-তা ধিন।

মনের পরিকাঠামোয় সেই সঙ্গে অন্য একটি দ্বিভাজনও। কবিতার অন্তরলোকে পৌঁছে গেছি, কবিতা নিয়ে অহোরাত্র ওঠা-বসা, স্বপ্নে শিহরিত হওয়া। কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে ঘনায়মান ক্রান্তির সংকেত, দেশটা কি সত্যি-সত্যিই ভাগ হয়ে যাবে? স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজব্যবস্থা কোন দিকে মোড় নেবে তা নিয়ে চিন্তার ঘনঘটা। শুধু নিরন্তর প্রশ্নে জড়িয়ে থাকাই নয়, সক্রিয় রাজনৈতিক আবেগও সমস্ত চেতনা ছুঁয়ে। তখনও নিখাদ মার্কসপন্থা থেকে একটু দূরে অবস্থান করছি, তবে অভিজ্ঞতার সোপানগুলি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠছি; বেশ বুঝতে পারছি, ব্যক্তিসত্তাও সামাজিক সংজ্ঞার অনুজ্ঞাবাহী। অশান্ত রাত্রি গভীর হলে বিছানায় শুয়ে কবিতার জাদুকরী অক্ষরমালার পাশাপাশি সমাজজিজ্ঞাসায় উৎকীর্ণ প্রহরের পর প্রহর।

কলকাতা-নোয়াখালি দাঙ্গার জের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়লো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পাঠচর্চা বিঘ্নিত। এরই মধ্যে, উপর থেকে নির্দিষ্ট অমোঘ বিধানের মতো, সিদ্ধান্ত-অনুশাসন। কংগ্রেসের কর্তাব্যক্তিরা আর অপেক্ষা করতে রাজি নন; কিছুদিন আগেও বিদেশী শাসক-প্রস্তাবিত ঈষৎ-শিথিল ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের যে-খসড়া দাখিল করা হয়েছিল, তা পেরিয়ে এবার তাঁদের অসহিষ্ণু উৎসাহের পরিক্রমা; মুসলিম লিগের পাকিস্তান দাবি পুরোপুরি মেনে নিতেও তাঁরা সম্মত। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমাদের বাঙালি সত্তা চরম সংকটের সম্মুখীন: দেশ ভাগ হয়ে গেলে আমাদের কী অবস্থা দাঁড়াবে, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের আদর্শ থেকে, বেপথুমান, কোথায় গিয়ে অনিশ্চিত অবস্থান করবো?

এই বিশেষ মুহূর্তে শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাশেম কর্তৃক অখণ্ড বঙ্গদেশের যুগ্ম প্রস্তাব, যার সঙ্গে হাসান শহিদ সোহরাবর্দিও খানিক বাদে নিজেকে যুক্ত করলেন। অকূলপাথারে যেন পরিত্রাণের ইঙ্গিত পেলাম। বঙ্গভূমিস্থ প্রায় প্রতিটি বামপন্থী দল এই প্রস্তাবের পক্ষে; কিন্তু হলে কী হবে, কংগ্রেসের অন্য দিকে ঝুঁকে-পড়া। এবং কংগ্রেসের নতুন মিত্র হিন্দু মহাসভা। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় উঠে-পড়ে লাগলেন, বাংলাদেশ যাতে ভাগ হয়ে যায় এবং হিন্দুপ্রধান পশ্চিম প্রান্তের জেলাগুলি যাতে ভারতের অঙ্গীভূত হয়, পুবের জেলাগুলির মানুষজন পড়ে মরুক গে। শ্যামাপ্রসাদের মতের সঙ্গে ঘাড় নেড়ে সমর্থন জানালো কংগ্রেস। হিন্দু মহাসভার অবিসংবাদী নেতা আশুতোষ-তনয় তাঁর মত প্রচারে ঢাকায় বক্তৃতা দিতে এলে অ-মুসলমান ছাত্রকুল দল বেঁধে প্রতিবাদে সামিল হলাম। করোনেশন পার্কের সন্নিকটে আমাদের ঠেকাতে বেপরোয়া লাঠির বাড়ি পুলিশের। কী আশ্চর্য মহাযোগ: হিন্দু মহাসভার নেতাকে ছাত্ররোষের হাত থেকে বাঁচাতে মুসলিম লিগ মন্ত্রিসভার পুলিশ লাঠিপেটা! কয়েকজনের মাথা ফাটল, হাত ভাঙলো।

কিন্তু দেশভাগ ও বঙ্গভাগের ওই উৎসাহতরঙ্গ রোধিবে কে? সাতচল্লিশ সালের মধ্য-অগস্ট, রাতারাতি পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে গেলাম। আমরা অবশ্য মনস্থির করেছিলাম, যে-কংগ্রেস দল আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলো, যে-দল অথচ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের নেতৃত্ব দেবে, তার সম্পর্কে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত হওয়াই ভালো: আমরা পাকিস্তানের বিশ্বস্ত নাগরিক হবো, সব সম্প্রদায়ের মানুষজন মিলেমিশে নতুন দেশ গঠন করবো। এমনকি লিগ নেতাদের অনেকেই, অন্তত প্রথম লগ্নে, এ ধরনের সংকল্পেরই প্রতিধ্বনি করেছিলেন। আরও একটি মস্ত শুভ লক্ষণ: কলকাতায় যেমনটি, তেমনই ঢাকাতেও, সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহরাঞ্চলে, আজাদির পুণ্যমুহূর্ত থেকে সহসা হিন্দু-মুসলমান মিলনের মস্ত জোয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসঙ্গে পড়াশুনো করি: অ-মুসলমান ছাত্ররা ঢাকা হল-জগন্নাথ হলের সঙ্গে যুক্ত, মুসলমান ছাত্ররা সলিমুল্লা ও ফজলুল হকের সঙ্গে। এতদিন পর্যন্ত আমরা সংলগ্ন অথচ বিচ্ছিন্ন হয়েই ছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে এক সঙ্গে ভোট দেওয়া সত্ত্বেও। সে-সব নির্বাচনে এক ধরনের উপর-উপর বন্দোবস্ত হতো। ঢাকা হল-জগন্নাথ হলের এক গোষ্ঠী সলিমুল্লা মুসলিম হল-ফজলুল হক হলের কোনও এক গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে হয়তো নির্বাচনে জিততো। কিন্তু মেলামেশা ছিল না, ভাবের আদানপ্রদান ছিল না। সম্মিলিত ছাত্র ইউনিয়নের দায়িত্ব ও পয়সা-কড়ি যে-গোষ্ঠীর যাঁরা জিততেন, ভাগ করে নিতেন, কোনওক্রম সহাবস্থান।

দমকা হাওয়ার মতো মেলবন্ধনের উন্মাদনা এবার আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল। চার হলের সঙ্গে যুক্ত ছাত্ররা এই প্রথম একে অপরকে চিনতে, পরস্পরের সমস্যাগুলি বুঝতে শিখলাম। পরিণামে একটি ঘনবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন জন্মগ্রহণ করলো। আস্ত একটি নতুন দেশ, পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা করাচি-লাহোরে কেন্দ্রীভূত। ঢাকা বারোশো মাইল দূরে, আপাত অবহেলায় পড়ে থাকা। পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক পরিকাঠামোতে এলোমেলো, অব্যবস্থা। অ-মুসলমান সরকারি কর্মচারীরা অনেকেই ভারতবর্ষে চলে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককুলের একটি বড়ো অংশও, কিছুটা আতঙ্কে, কিছুটা অনিশ্চয়তার শিকার হয়ে, ভারতবর্ষ-মুখো। তার উপর পশ্চিম বঙ্গ থেকে কাতারে-কাতারে ছাত্র পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষ করে ঢাকার স্কুল-কলেজে, ভর্তি হতে আসছে, আসনের অসংকুলান, শিক্ষকের অসংকুলান, ছাত্রাবাসেরও সমান অনটন। সমস্যাগুলি মুসলমান ছাত্রদের একার নয়, হিন্দু ছাত্রদেরও একার নয়, সবাই মিলিতভাবে সমস্যাগুলির সম্মুখীন। সুতরাং অবলীলায় একমত হলাম আমরা: সম্প্রদায় নির্বিশেষে, হল নির্বিশেষে, ঐক্যবদ্ধ যৌথ আন্দোলন দাঁড় করাতে হবে। সবচেয়ে যা আতঙ্কের, দেশভাগের গোলমাল-হরিবোলের পরিণামে রাষ্ট্রীয় সরবরাহ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে; খাদ্যের অভাব, বস্ত্রের অকুলান। এ-সব সার্বিক সামাজিক সমস্যাও তো ছাত্রদের সমস্যা, সুতরাং আন্দোলনে যুথবদ্ধতা।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকে পরের বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত আমাদের নিয়মিত ক্লাস করা প্রায় হয়েই ওঠেনি। আন্দোলন-সভা-মিছিল, উপাচার্যের কাছে ডেপুটেশন, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। প্রথম দিকে কলকাতা থেকে স্থানাবিচ্যুত হয়ে আসা খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী; তিনি অবশ্য ঢাকা শহরের পুরনো বাসিন্দা। কয়েক মাস বাদে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হয়ে তিনি করাচি চলে গেলেন, তারপর ময়মনসিংহের নুরুল আমিন মুখ্যমন্ত্রী। ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের সমস্যাজড়িত বিবিধ আন্দোলন ক্রমশ যুক্ত হতে থাকলো। নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি অপেক্ষাকৃত মোলায়েম আবহাওয়ার ঋতু, আমরা দুপুর-বিকেল রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরছি, স্লোগানে নিজেরা উচ্চকিত হচ্ছি, রাজপথ উচ্চকিত করছি, দাবিসনদ রচনা করছি, তা পেশ করছি প্রশাসকবৃন্দ ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে। এই সময়েই বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের একটি যুক্ত সংগ্রাম কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এগারোজনের কমিটি, তন্মধ্যে দুজন অ-মুসলমান, আমি এবং আর একজন। সলিমুল্লা মুসলিম হলের একটি ছাত্রনেতার কথা এখনও মাঝে-মাঝে মনে পড়ে। নাম বোধহয় নইমউদ্দীন, বেঁটে, কালো, ঝটিতি বক্তৃতা দিতে ওস্তাদ। তাঁর ভাষণের দেশজ বাচনের একটি নমুনা: ‘ভাইগণ, বন্ধুগণ, আমরা অনেক সহ্য করেছি। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আসুন, আমরা একসঙ্গে মিলে ফুটবলটায় এবার একটা কিক মারি’। নাজিমুদ্দিন সাহেব মানুষ হিশেবে, মানতেই হয়, আদৌ খারাপ ছিলেন না: কথাবার্তায় শিষ্ট, সম্ভবত ধর্মভীরুও, তবে মোটা, ছোট্টো শরীর, জালার মতো স্ফীত উদর। ফুটবলে কিক মারাটা অবশ্যই প্রতীকী, তাঁর অবয়বের প্রতি ইঙ্গিত। জড়ো-হওয়া ছাত্রদের মধ্যে হাততালি-ঠাসা খুশির ঢেউ।

অ-মুসলমান ছাত্রদের কাছে একটা মস্ত আবিষ্কার: মুসলমান ছাত্রনেতারা কোনও সংকোচ বা অবদমনে ভুগতেন না, মনের কথা দুর্দান্ত স্পষ্ট করে ব্যক্ত করতেন। খাজা নাজিমুদ্দিনকে লক্ষ্য করে যেমন গাল পাড়া, অন্যদের সম্পর্কেও সমান অকুতোভয়। নুরুল আমিন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিন-চার সপ্তাহের জন্য বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ভয়ংকর বস্ত্ৰসমস্যা; মহিলাদের পরিধেয়ের পর্যন্ত আকীর্ণ অভাব। ছাত্রদল ক্ষিপ্ত, লম্বা মিছিল করে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসস্থান অভিমুখে ধাওয়া। ছাত্রদের মেজাজ দেখে রক্ষীবাহিনী ভীত, এখানে-ওখানে নিজেদের লুকোলো। আমরা সোজা মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকখানায়। নুরুল আমিন প্রায় ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছেন, দয়া ভিক্ষা করার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় নতজানু। হঠাৎ শুনি ছাত্রদের মধ্য থেকে কারও কর্কশ ক্রোধোক্তি: ‘আমাদের মায়েরা-বোনেরা কাপড় পাচ্ছে না, আর তুই হতভাগা নিজের বিবির জন্য বারো সুটকেস ভরে শিফন শাড়ি এনেছিস বিদেশ থেকে, তোকে কোতল করবো’।

আমার ধারণা, পূর্ব পাকিস্তানে সে সময় থেকে শুরু করে একাত্তর সাল পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে যে-বিদ্রোহের দীর্ঘ পর্ব, তার উৎস এই সংঘবদ্ধ ভয়হীন ছাত্র আন্দোলনেই। ছাত্রদের একটি প্রধান অংশ আকাট কৃষককুল থেকে উঠে এসেছেন, পিতামাতারা নিরক্ষর। এই ছাত্রসম্প্রদায়ই প্রথম প্রজন্ম যাঁরা শিক্ষার আলোতে দীপ্য হয়েছেন, বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের গোড়াপত্তন সংসাধিত করেছেন। নিজেদের পরিবারের মালিন্য-খিন্নতার সঙ্গে বড়োলোকদের অবস্থার দুস্তর আপেক্ষিক ব্যবধান তাঁদের ক্রমশ অস্থির করে তুলেছে। সেই অস্থিরতা থেকে সংকল্পের উত্থান, বিদ্রোহের উত্থান। যেহেতু তাঁরা কৃষককুল থেকে উদ্ভূত, ভদ্রতার পরচুলো তথা মুখোশ পরতে অভ্যস্ত হননি, রেখে-ঢেকে কথা বলতে শেখেনইনি। যা মনে এসেছে, স্পষ্ট করে বলেছেন। তেমন আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে হিন্দু প্রাধান্যের অধ্যায়ে যা ঘটেছে, আসলে তারই প্রতিধ্বনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে। ভারতবর্ষে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্রেরা জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ব্যূহ গঠন করেছেন, ছাত্র আন্দোলনকে সামগ্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে তেমনধারাই ঘটেছে, তফাত শুধু এই ছাত্রদল মাটির অনেক কাছাকাছি, তাঁদের ভাষা তাই কর্কশ। আমাদের সমসাময়িক যাঁরা সলিমুল্লা-ফজলুল হক হলের ছাত্র-নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরাই এক-চতুর্থাংশ শতক সময়ের ব্যবধানে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা বলে পরিগণিত হয়েছেন; এঁদের একজন-দু’জনের নাম ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি। অবশ্য অনেক আগে থেকেই আমরা অ-মুসলমান ছাত্ররা মাঠে-ময়দানে নামা। হিরোসিমা-নাগাসাকি নিয়ে উদ্বেগ, ১৯৪৫ সালের শেষ ভাগে আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন, রামেশ্বর-রশিদ আলি দিবসের রক্তাক্ত পটভূমি, ভারতীয় নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ, যা পরে ষাটের দশকে উৎপল দত্তের ‘কল্লোল’ নাটকে রুদ্র মহিমায় রূপায়িত। আমার দিনযাপনে ওই মুহূর্তে এক আশ্চর্য রসায়ন, কবিতায়-সাহিত্যে নিমগ্ন থাকা চলছে, দিবস-রাত্রি আড্ডার জোয়ার, কিন্তু সেই সঙ্গে রাজনীতির, ঘুম-পাড়ানো নয়, হাউইয়ের মতো জ্বালিয়ে দেওয়া, নেশা। কলকাতার আন্দোলনের রেশ মফস্বলে আমাদেরও স্পর্শ করে গেছে: ছেচল্লিশের মধ্য প্রহরে সর্বভারত-ব্যাপী ডাক-তার কর্মীদের আন্দোলনের সঙ্গে আমরা ছাত্ররাও নিজেদের যুক্ত করতে পেরে গর্ববোধ করেছি। তবে যতিপতন, কয়েক সপ্তাহ যেতে-না যেতেই অগস্ট মাসের কৃষ্ণদিবস, যার পরিণতিতে, আমাদের ঘোর অনিচ্ছাসত্ত্বেও, তথাকথিত নেতারা মেনে নিলেন দেশবিভাগের নির্দয়তা। যা বাড়তি পরিতাপের, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো তখন-পর্যন্ত-নগণ্য নেতারা ভারতবর্ষের মাটিতে সম্মানের ঠাঁই পেলেন, প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম লিগের মধ্যেও উগ্রপন্থী, রগচটা নেতাদের উপরে উঠে আসা।

অথচ এমনটা না-ও হতে পারতো। আবুল হাশেম সেই পর্বে প্রাদেশিক মুসলিম লিগের সাধারণ সম্পাদক, নিখাদ অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির জন্য সারা জীবন চেষ্টা করে গেছেন, তাঁর আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ করেছেন, কলকাতায় মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ১৯৪৩ সালে যেদিন তিনি প্রাদেশিক লিগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন, সেদিনও সভায় গেছেন ধুতি পরে। সংকীর্ণবুদ্ধি স্বার্থপর কংগ্রেস নেতারা তাঁর আবেদনে কর্ণপাত করলেন না, তাঁরা বরঞ্চ হিন্দু মহাসভার সঙ্গে হাত মেলালেন। ভারতবর্ষে অনেকেই হয়তো জানেন না, বিখ্যাত প্রাবন্ধিক ও বিপ্লবী চিন্তাজীবী বদরুদ্দিন উমর আবুল হাশেমের জ্যেষ্ঠ পুত্র; সৈয়দ শহীদুল্লা-মনসুর হাবিবুল্লাদের মাতুলও তিনি।

ততদিনে আমি প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেছি, আলোচনা-অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছি, পরিচয়ের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের বিখ্যাত ভালো ছাত্র, সরদার ফজলুল করিম, কৃষক পরিবারের সন্তান, ইচ্ছা করলেই মস্ত উঁচু কাজে যোগ দিতে পারতেন পাকিস্তানে, পরিবর্তে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে আলাপ প্রগতি লেখক সংঘের সূত্রে। মুনীর চৌধুরী ও তাঁর দাদা কবির চৌধুরীর সঙ্গে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণেই পূর্ব পরিচয়, তাঁরা বুদ্ধিমত্তা ও সৌজন্যের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। ক্রমশ আলাপ হলো ‘লাল শালু’-র লেখক, অতি অমায়িক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌-র সঙ্গে। সংঘের সম্পাদক অজিত গুহর উৎসাহের শেষ নেই, সংঘের কার্যসূচি ক্রমশ প্রসারিততর হলো। এ-সময়েই, অথবা কিছু আগে বা পরে, পরিচয় হয় সানাউল হকের সঙ্গে; পঞ্চাশের দশকের উপান্ত পর্যন্ত সানাউল পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান কবি বলে খ্যাত ছিলেন, তারপর অবশ্য রাষ্ট্রদূত গোছের বড়ো-বড়ো কাজের ঝামেলায় কাব্যচর্চা খানিকটা চাপা পড়ে, কিন্তু তাঁর সৌহার্দ্যবোধে নয়।

স্কুলে-কলেজে যাদের সঙ্গে পড়েছি, দাঙ্গার ঋতুতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আলগা হয়ে এসেছিল। আবার নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার পাঁচিল ডিঙিয়ে আমাদের মেলামেশা শুরু। হঠাৎ আবিষ্কার করে মজা পেলাম, ভালোও লাগলো, বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি প্রথা। উঠতি মুসলমান পরিবারেও অদৃশ্য প্রভাব ফেলেছে, একটু বেশি করেই ফেলেছে। হিন্দু পরিবারের প্রচলিত ডাকনামগুলি মুসলমান সংসারেও ঢুকে গেছে: ঝুনু, টুলু, পল্টু, খোকন, মন্টু, বাদল, চুনি, মণি ইত্যাদি। এমনিতেই মুসলমান সমাজে নামকরণে বৈচিত্র্যের যথেষ্ট অভাব, এক ঝাঁক নুরুল ইসলাম, এক ঝাঁক সিরাজুল হক। এক নুরুল ইসলামকে অন্য-এক নুরুল ইসলামের থেকে তফাত করার তাগিদে পোশাকি নামের সঙ্গে ডাক নাম জুড়ে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময় থেকে। নুরুল ইসলাম ঝন্টুর বন্ধু নুরুল ইসলাম সখা, সিরাজুল হক বেণুর দোসর সিরাজুল হক খাঁদু। আমার বিশেষ সুহৃদ, সত্তরের দশকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পুলিশ কর্তা, মুস্তাফিজুর রহমান খাঁ, অবশ্য বরাবরই আমাদের কাছে মন্টু।

১৯৪৮ সালের প্রারম্ভ পর্যন্ত আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম, এদিন যাবে এদিন যাবে; যেহেতু মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে সম্মিলিত আন্দোলনে নামতে সফল হয়েছি, আপাতদৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্যা বইছে, এখন থেকে অবস্থার মোড় ঘুরবে। এরকম সময় ঢাকায় হাজির বাইশ-তেইশ বছরের একটি উজ্জ্বল ইংরেজ মেয়ে, সম্ভবত লিডস বা উত্তর ইংল্যান্ড-এর অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, নাম কারমেল ব্রিংকম্যান। সে ঢাকায় এসেছে আন্তর্জাতিক ছাত্র সংহতির প্রতিনিধি হিশেবে। আন্তর্জাতিক ছাত্রসংহতি ও বিশ্ব যুবসংস্থার যৌথ উদ্যোগে কলকাতায় ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেই সম্মেলনে পাকিস্তান থেকে কারা-কারা প্রতিনিধি যেতে পারেন, তার প্রাথমিক ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পড়েছে তার উপর। পশ্চিম পাকিস্তানে পরিস্থিতি অতি প্রতিকূল, ছাত্র আন্দোলন বলে আদৌ কিছু নেই, ওমুখো আর না হয়ে কারমেল সোজা ঢাকা চলে এসেছে, ঠিক করেছে পূর্ব পাকিস্তান থেকেই গোটা পাকিস্তানের প্রতিনিধি বাছাই করা হবে। যুব প্রতিনিধিরা তিন ভাগে বিভক্ত থাকবেন: কৃষিজীবী যুবক, শ্রমজীবী যুবক এবং ছাত্র যুবক। যেহেতু ঢাকায় আগে থেকেই সব কিসিমের ছাত্ররা এক সঙ্গে কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম, ছাত্র প্রতিনিধি বাছতে কারমেলের তেমন বেগ পেতে হলো না; আমাদের সহায়তায় সে শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী যুব সংগঠনেরও অবলীলায় সন্ধান পেল। সবাই বুঝতে পারছিলাম, বিশ্ব যুবসংস্থা ও আন্তর্জাতিক ছাত্র সংহতি, দুটোই কমিউনিস্ট আদর্শে অনুপ্রাণিত প্রতিষ্ঠান, চেকোশ্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগ তাদের পীঠস্থান, তবু আমাদের আগ্রহের সীমা ছিল না। তারা অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করলো বলেই আমাদের কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী বন্ধুদের সঙ্গে কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ ঘটলো। আরও মস্ত বড়ো যে আকর্ষণ, কলকাতার সম্মেলনে সারা পৃথিবী ঝেঁটিয়ে যুব প্রতিনিধিরা এসে জড়ো হবেন, তাঁদের সঙ্গে মিলিত হয়ে চিন্তা-ভাবনার আদান-প্রদানের সুযোগ এই দুটি বিশ্ব সংস্থা আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিল। আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

সবসুদ্ধু পাকিস্তান থেকে, বকলমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে, এগারোজন প্রতিনিধি সম্মেলনের জন্য মনোনয়ন করা হলো, আমি একমাত্র অ-মুসলমান। কারমেল বললো, অন্তত একজন মহিলা প্রতিনিধি না থাকলে ঠিক শোভন হয় না। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর মাত্র এক বছরও সম্পূর্ণ হয়নি, সভা-সমিতিতে মিছিলে-আন্দোলনে যোগ দিতে পূর্ব পাকিস্তানের মেয়েরা তখনও ততটা সড়গড় নয়। শেষ পর্যন্ত আমাদের পরিচিতা এক মহিলা, বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী, মা ইরানি, বাবা বাঙালি খ্রিস্টান, মেয়েটি মুস্তাফিজুর রহমান খাঁ মন্টুর বউদি, তাকে পাকড়ানো গেল। সে অবশ্য ততদিনে নিখাদ মুসলমান, কিন্তু সকলের সঙ্গে মেলা-মেশা ও আড্ডা দিতে স্বচ্ছন্দ; সবচেয়ে বড়ো কথা, অন্তত পাকিস্তান প্রতিনিধিগগাষ্ঠীকে নারীবিবর্জিত থাকতে হলো না। তখনও পর্যন্ত ঢাকা-কলকাতার প্রধান যোগাযোগ ট্রেন-স্টিমার, স্টিমার-ট্রেন। স্পষ্ট মনে আছে সেই ফেব্রুয়ারি মাসের শীত-শীত সাত সকালে, ধুতি-পরিহিত আমি, হাতে মস্ত পাকিস্তানি জাতীয় পতাকা, শিয়ালদহ স্টেশনে প্রচণ্ড অহংকারের সঙ্গে অবতীর্ণ হলাম। মুসলমান প্রতিনিধি যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন কলকাতার এখানে-ওখানে, বিশেষ করে পার্ক স্ট্রিট-পার্ক সার্কাস অঞ্চলে, সুতরাং থাকার জায়গা নিয়ে কারওরই সমস্যা দেখা দিল না; আমি যেমন বরাবর থাকি, টালা পার্কে পিসির বাড়িতে উঠলাম। আরও যা যোগ করতে হয়, কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সংগঠন ও সভ্য ভাগাভাগি তখনও সম্পূর্ণ হয়নি: কেউ এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছেন, কেউ ওদিক থেকে এদিকে। কলকাতায় পৌঁছে জানতে পেলাম, আমাদের কৃষক প্রতিনিধিদের তালিকায় একটু বদল হচ্ছে। পূর্ব-মনোনীত তিনজনের মধ্যে একজন বাদ যাচ্ছেন, পরিবর্তে তখনই যথেষ্ট-বিখ্যাত কৃষক নেতা সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লা, যিনি পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঠিক সেই মাস থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কাজ শুরু করবার আয়োজন করছিলেন, তৃতীয় কৃষক প্রতিনিধি রূপে আসছেন। শাদা টুপি পরা, চিকনের কাজ করা মিহিন কোর্তা, খানদানি চোস্ত পাজামা পরিহিত মনসুর হাবিবুল্লা যখন পাকিস্তানের যুব কৃষকদের সমস্যা নিয়ে ওয়েলিংটন স্কয়্যারের সম্মেলন-মঞ্চ থেকে উর্দুতে-ইংরেজিতে ভাষণ দিচ্ছিলেন, অতি চমৎকার দৃশ্য। প্রায় দুই যুগ বাদে, মনসুর সাহেব, ১৯৭৭ সালে পশ্চিম বঙ্গ বিধান সভার অধ্যক্ষ, পরে বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় আমার সহযোগী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে তাঁর বক্তৃতা ও পরিধেয়ের উল্লেখ করে তখন প্রায়ই মজা করেছি।

এই যুব সম্মেলন আমার পক্ষে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। শুধু ভারতবর্ষের নানা জায়গা থেকে আসা ছাত্র ও যুব প্রতিনিধিদের সঙ্গেই নয়, তারও বাইরে প্রায় গোটা পৃথিবী থেকে জড়ো হওয়া যুব নেতাদের সঙ্গেও পরিচয় ঘটলো। এঁরা প্রত্যেকেই ইতিমধ্যে মার্কসীয় প্রজ্ঞায় দীক্ষিত, এমন কি কুমিনটাং চীন বা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদেরও আনুগত্য বুঝতে ভুল হওয়া সম্ভব ছিল না। মালয়েশিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে, সেই দেশের অরণ্যের গহন থেকে গেরিলা যুদ্ধরত যুব প্রতিনিধিরা এসেছেন, এসেছেন ব্রহ্মদেশ থেকে, ইন্দোনেশিয়া থেকে; আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির প্রতিনিধিরাও হাজির। যেমন উপস্থিত মিশর ও আলজেরিয়া থেকে কয়েকজন, বর্ণবিদ্বেষে-সমাচ্ছন্ন গভীর-তমসায়-ঢাকা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও লুকিয়ে কয়েকজন। তা ছাড়া সোভিয়েট রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা তো ছিলেনই, ছিলেন পূর্ব ইওরোপ থেকে, পশ্চিম ইওরোপ থেকে, অন্য মেরুপ্রান্তের অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড থেকেও। বোধহয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকেও, সেই সঙ্গে লাতিন আমেরিকার প্রতিনিধিরা। তবে তাঁদের কথা আলাদা করে তেমন মনে পড়ে না।

বিদেশী প্রতিনিধিরা বেশির ভাগই ছিলেন ফৌজ-কর্তৃক-যুদ্ধের-সময়-ব্যবহৃত দু’-তিন-বছর-আগে পরিত্যক্ত লেক ব্যারাকের সারি-সারি কুঠিতে। চারদিকে কৃষ্ণচূড়া-পলাশের পাশাপাশি নারকেল বৃক্ষেরও সমারোহ; ল্যান্সডাউন ও সাদার্ন অ্যাভেনিউর কোল ঘেঁষেই সম্ভবত, কোকোনাট গ্রোভ সরাইখানাটি তখনও অবলুপ্ত হয়ে যায়নি। পশ্চিমি দেশগুলির কয়েকজন প্রতিনিধিকে হোটেলে, নয়তো এঁর-ওঁর বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে অধিকাংশই ছিলেন লেক ব্যারাকে, সারারাত ধরে সেই ব্যারাকের বিশ্বনন্দিত, বিশ্বনিন্দিত মশককুলের প্রগাঢ় আশ্লেষে বিচলিত না হয়ে। কয়েকটি আলাদা ঘরে নানা বিষয় নিয়ে ছোটো-ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে প্রায় সারারাত ধরে তর্ক-আলোচনা, পরে প্রস্তাব অধিগ্রহণ। মূল অধিবেশন মধ্য কলকাতায় ওয়েলিংটন স্কয়্যারে, বর্তমান প্রজন্মের কাছে যা সুবোধ মল্লিক স্কয়্যার হিশেবে পরিচিত। বুদ্ধির দীপ্তি, আবেগের জোয়ার, অঙ্গীকারের তীক্ষ্ণতা সভামঞ্চ জুড়ে। বিভিন্ন মহাদেশ থেকে প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছেন, তাঁদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় দুস্তর ফারাক, তবু কোথায় যেন এক অত্যাশ্চর্য মিলিয়ে-দেওয়া মিশিয়ে-দেওয়া। কোনও-কোনও দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে বা শিগগিরই হবে, কোনও-কোনও দেশ স্বৈরতন্ত্রের জগদ্দল পাথর-চাপা থেকে কয়েক মাস আগে বেরিয়ে এসেছে, এখন তরুণদের দুই চোখের নীলিমা ঘিরে সাম্য-ঘেরা টলমল নতুন স্বপ্ন। প্রথম দিনের প্রারম্ভিক অধিবেশন, প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধিরা মঞ্চে উঠছেন তাঁদের জাতীয় পতাকা নিয়ে। মঞ্চস্থ মাইক্রোফোনে তাঁদের অভিনন্দন জানানো হচ্ছে, গোটা ওয়েলিংটন স্কয়্যার জুড়ে তার সহস্রগ্রাম উচ্চ সমর্থন। আয়োজন-ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে অবশ্যই ছিলেন কলকাতার পার্টি এবং ছাত্র-যুবা নেতারা। নাগপুরের অর্ধেন্দুভূষণ বর্ধন, এখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, মঞ্চে প্রধান অভ্যর্থনাজ্ঞাপকের ভুমিকায়। যুগোশ্লাভিয়া থেকে আগত প্রতিনিধিরা মঞ্চে সদ্য সমাগত, বর্ধন স্লোগান দিচ্ছেন, ‘যুগোস্লাভ প্রতিনিধিবৃন্দ জিন্দাবাদ!’ হঠাৎ নজরে এলো মঞ্চে উপবিষ্টা গীতা মুখোপাধ্যায় পাশে-বসে-থাকা সুখেন্দু মজুমদারকে সজোরে ধাক্কা দিচ্ছেন, সেই সঙ্গে ফিস ফিস অনুজ্ঞা: ‘যাও, বর্ধনকে যোগ করতে বলো, “কমরেড টিটো জিন্দাবাদ”।’

ইতিহাসের এমনই বিচিত্র রসিকতা, মাত্র কয়েক মাস গত হতেই কমরেড টিটো আর কমরেড রইলেন না, যুগোস্লাভ রাষ্ট্র কমিনটার্ন থেকে, নাকি কমিনফর্ম থেকে, বিতাড়িত। দুই বাংলা জুড়ে বামপন্থীরা ভ্যাবাচ্যাকা, ঘরে-ঘরে কয়েক হাজার সদ্য-জন্ম-নেওয়া শিশু, যাদের আদর করে টিটো নাম দেওয়া হয়েছিল, তারা রাতারাতি টুটু বনে গেল।

প্রাসঙ্গিক একটি মজার ঘটনার কথা বলি। বিলেতের এক ঘোর বামপন্থী শ্রমিক নেতা, উইলিয়াম গ্যালাচার, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপে পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন, টিটোকে ব্রাত্য বলে ঘোষণার পরমুহূর্তে অভিমানভরে দল ছেড়ে দেন। কয়েক বছর বাদে ইতালীয় সোশ্যালিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পিয়েত্রো নেনি, সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশান্যাল-এর উগ্র সোভিয়েট-বিরোধিতায় বিরক্ত হয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নান্তে স্ট্যালিনের প্রতি অনুরাগ-আনুগত্য বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করে কমিউনিস্ট মহলে প্রচুর বাহবা কুড়োন। সেই মরশুমে গ্যালাচারও পার্টিতে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর সম্বন্ধে তাই বলা হতো: He went out with Tito, came back with Nenni।

কলকাতার যুব সম্মেলনে বিশ্ব যুবসংস্থা থেকে পরিচালক মণ্ডলীতে অন্যতমা, লন্ডনপ্রবাসী ধনী পার্শি বংশের দুহিতা, কিটি বুমলা। সারা সম্মেলনে কিটির চেয়ে সুন্দরীতরা কেউ ছিল না, বিশ্ব যুবসংস্থার সংগঠনের গুরু দায়িত্বে তার অধিষ্ঠান, এঁদো ঢাকা শহরের অখ্যাত ছাত্র আমি, অবাক বিস্ময় ও মুগ্ধতাবোধ নিয়ে কিটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সেই কিটি ভারতবর্ষকে তার রাজনৈতিক কর্মস্থলরূপে বেছে নিল, কেরলের পার্টি কমরেড রামদাস মেননকে বিয়ে করলো, বছর কুড়ি বাদে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে শিক্ষক পদপ্রার্থী, ভাগ্যচক্রে নির্বাচন কমিটিতে আমি। তার উপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে, কিটি তা হলেও আদর্শে অবিচল, দিল্লিতে পার্টি মুখপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগে সর্বক্ষণের কর্মী, গর্ব বোধ করি ভেবে আমি তার কাছের মানুষ। এটাও বোধহয় সময়চক্রের খেলা; পাঁচ দশক আগে যে-দূরত্বের বিচারে সম্রাজ্ঞীসমা, সে এখন ঘনিষ্ঠ সহচর।

তবে এসব ঘটনা তো তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে জট পাকালো ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে। সমস্ত বামপন্থী দল থেকে বেছে সম্মিলিত ভারতীয় প্রতিনিধিমণ্ডলী নির্বাচন করা হয়েছিল; সভাপতি ছাত্র কংগ্রেসের প্রধান, সুভাষচন্দ্র বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র, অরবিন্দ বসু। সত্যপাল দাং, জলি কাউল, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, গীতা মুখোপাধ্যায়, এঁরা তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে ছিলেন বলশেভিক দলের বিশ্বনাথ দুবে ও শ্ৰীমতী সুধা রায়। আর ছিলেন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের জনৈক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, তখনও তিরিশের কোঠায়, সুতরাং যুবা মানুষ। মুশকিল হলো অরবিন্দ বসু সম্প্রদায় প্রথম থেকেই একরোখা; তাঁদের দাবি রাজনৈতিক প্রস্তাবে সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজের শৌর্যের বর্ণনা বিশদ করে লিপিবদ্ধ করতে হবে। অন্যান্য এশিয় দেশের প্রতিনিধিরা বললেন, সুভাষচন্দ্র বসুর—তাঁরা উল্লেখ করতেন চন্দ্র বসু বলে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ভূমিকা সর্বস্বীকৃত, কিন্তু তাঁর নাম আলাদা করে উল্লেখ করলে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের কাছ থেকেও উপরোধ আসবে তাঁদের দেশের বীর নায়ক-নায়িকাদের নামাবলী প্রস্তাবে থাকুক, সেটা খুব গোলমেলে ব্যাপার হবে; তার চেয়ে বরঞ্চ সাধারণভাবে সমস্ত দেশেরই উপনিবেশ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী অভ্যুত্থানের সপ্রশংস উল্লেখ থাক। ঘণ্টার পর ঘণ্টা উত্তীর্ণ, অরবিন্দ বসু আর ওই ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে কিছুতেই বুঝিয়ে ওঠা গেল না। বিশেষত শেষোক্ত ব্যক্তিটি, বরাবরই দেখেছি, কুচুটে, ঘোঁট পাকাতে ভালোবাসেন, তিন দশক বাদে পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভাতেও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেছেন।

বিশ্বনাথ দুবের মতো বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বিরল হয়ে এসেছে। তত্ত্ববিশ্বাসের ব্যাপারে তার ধনুর্ভঙ্গ পণ: বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। ভারতীয় প্রতিনিধিদের একটি বৈঠক ডাকা হয়েছিল সম্মেলনে গৃহীতব্য রাজনৈতিক প্রস্তাবে সংযোজনের জন্য একটি অনুচ্ছেদের খসড়া তৈরি করবার উদ্দেশ্যে। বেয়াল্লিশ সালের অগস্ট আন্দোলনকে কেউ-কেউ অগস্ট বিপ্লব বলে উল্লেখ করতে চাইলেন। বিশ্বনাথ দুবে রেগে আগুন, উনি নাকি চারশো পৃষ্ঠার থিসিস লিখেছেন প্রমাণ করতে ওই পাতি-বুর্জোয়া ব্যাপারটা মোটেই বিপ্লব ছিল না, ওটা বিদ্রোহও নয়, এমনকি উত্থানও নয়। তিন ঘণ্টা জোর তর্ক চললো, শেষ পর্যন্ত বিশ্বনাথ দুবে জয়ী, খসড়ায় লেখা হলো ‘অগস্ট ঘটনাবলী’।

শ্লীলতা থেকে বিচ্যুতির অভিযোগ উঠতে পারে, তা হলেও অন্য একটি ঘটনা, যা নিজের চোখে দেখেছি, বর্ণনা না-করে পারছি না। কমরেড দুবে ও কমরেড সুধা রায় পাশাপাশি হাঁটছেন, হঠাৎ বিশ্বনাথবাবুর ছোটো তরফের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিল। সঙ্গে-সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে ধুতি সরিয়ে জলত্যাগ। অপেক্ষমতী সুধা রায় নির্বিকার, বিশ্বনাথ দুবে ততোধিক নির্বিকার।

রাজনৈতিক প্রস্তাব প্রকাশ্য অধিবেশনে দাখিল করার মুহূর্ত সমাগত। শেষ চেষ্টাও বিফল। গভীর রাত্রিতে ভারতীয় প্রতিনিধিবৃন্দের এক-তৃতীয়াংশ তাঁদের মত মানা হলো না বলে সম্মেলন থেকে বেরিয়ে গেলেন। বেরিয়ে গিয়ে বিবৃতি দিলেন, কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা এত নির্লজ্জ যে সুভাষচন্দ্র বসুকে পর্যন্ত যথাযোগ্য সম্মান জানাতে বিমুখ। তাঁরা শাসালেন, কলকাতার সচেতন জনগণ এই অপমান মেনে নেবে না। সম্মেলনের সংগঠকদের পক্ষ থেকে অবশ্য ব্যাখ্যা করে প্রতি-বিবৃতি সঙ্গে-সঙ্গে, জল ঘোলা হওয়া তাতে বন্ধ হলো না। গুজবের পর গুজব ছড়ালো। সবচেয়ে বড়ো গুজব: ওয়েলিংটন স্কয়্যার থেকে মোড় ঘুরে খানিকটা এগিয়ে বউবাজারের মোড়ে পৌঁছুলে জনৈক স্বনামখ্যাত সমাজবিরোধীর স্বদেশী পাঁঠার দোকান; তিনি নাকি দলবল নিয়ে সম্মেলনস্থল আক্রমণ করবেন সূর্যোদয়ের পূর্বেই। সংগঠকরা শুধু বেগতিক নন, একটু ভয়ার্তও। সেই নিবিড় নিশীথেই নিজেদের মধ্যে তাঁরা আলোচনা-পরামর্শ করলেন। অতি মুখমিষ্টি নম্র স্বভাবের কয়েকজনকে সেই স্বদেশী সমাজবিরোধীকে শান্ত করার জন্য বাছাই করা হলো; এত বছর সময়ের ব্যবধানে বলতে বাধা নেই, একজন-দু’জন দৃষ্টি-আকর্ষণকারিণী তরুণীকেও সেই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে যুক্ত করা হলো। রাত্রের মতো ফাঁড়া কাটল; দেশপ্রেমিক সমাজবিরোধীটি হয়তো ভাবলেন, এত-এত বিদেশীদের ভিড়ে দিশি মামলা নিষ্পত্তি করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে শহিদ মিনারের— তখনও অক্টরললানি মনুমেন্ট—সানুদেশে কলকাতাবাসীদের পক্ষ থেকে বিদেশী প্রতিনিধিবৃন্দকে অভিনন্দনজ্ঞাপন। শ্যামবাজারের পাঁচ মাথা থেকে মিছিল শুরু করে ময়দানে শেষ; মিছিলের সম্মুখভাগ যখন ময়দানে, শ্যামবাজারের পাঁচ মাথা থেকে তখনও জনতার স্রোত বের হচ্ছে। লাল ঝাণ্ডার অসংকোচ সমারোহ, সমাজবিপ্লবের অসংকোচ দুন্দুভি। কলকাতার নাগরিকদের পক্ষ থেকে কারা-কারা বক্তৃতা দিয়েছিলেন, এখন আর মনে নেই। তবে সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠলাবণ্যে তখন দুর্দমনীয় উদ্দামতা, কী করে যেন মিনিট পাঁচেকের জন্য লাউডস্পিকারের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে, বেপরোয়া দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন সুচিত্রা মিত্র তবু খোলা গলায় স্বর আরও উঁচুতে উপরে তুলে গাইছেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি…’।

অধিকাংশ প্রতিনিধিই ফিরে গেলেন, আমি কয়েকটা দিন কলকাতায় বাড়তি রইলাম, বেশ কয়েকজন বিদেশী প্রতিনিধিও থেকে গেলেন পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য। তাঁদের মধ্যে কারও-কারও বোধহয় পরবর্তী সপ্তাহে কলকাতায় অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার কথা। এই বিদেশী প্রতিনিধিবৃন্দের জন্য জ্ঞানপ্রকাশ-চারুপ্রকাশ ঘোষ মশাইদের ক্রিক রো-সংলগ্ন ডিক্সন লেনে অবস্থিত বিরাট বনেদি বাড়িতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। নিবিষ্ট মনে অতিথিরা গান-বাজনা-আবৃত্তি-নাটকের ভগ্নাংশ ইত্যাদি শুনছেন, হঠাৎ মেদিনী কাঁপিয়ে বোমা-স্টেনগানের আক্রমণ। সেই সমাজবিরোধী স্বয়ং ছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু দুই জিপে চেপে তাঁর অনুগত সাঙ্গোপাঙ্গরা সশস্ত্র আক্রমণ হানলেন, কমিউনিস্টদের নির্বংশ করতে হবে। দু’জন সাংস্কৃতিক কর্মী অকুস্থলেই মারা গেলেন, আরও অনেকে আহত। লজ্জায় আমাদের মুখ কালো হয়ে এলো, লজ্জার সঙ্গে ক্রোধ, অপমান, ধিক্কারবোধ। হয়তো কাকতালীয়, হয়তো কাকতালীয় নয়, এই ঘটনার পর ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেই আমার পুরনো রাজনৈতিক আনুগত্য আস্তে-আস্তে আমি শিথিল করে দিলাম। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন বছর অতিক্রান্ত, স্বপ্নকে বাস্তবের মৃত্তিকায় স্থাপিত করার মার্কসবাদী অঙ্গীকারের কাছে আমার বিবেক-চেতনা-আবেগ-অভীপ্সা সমর্পণ করে আছি।

ঢাকায় ছাত্র আন্দোলন ইতিমধ্যে স্তরের পর স্তর অতিক্রম করে যাচ্ছে, ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের বিভিন্ন আন্দোলন ক্রমশ ঘনবদ্ধ হচ্ছে, অথচ কী গেরো, ধনবিজ্ঞানের সাম্মানিক পরীক্ষায় বসতে হবে, বছর ভরে তেমন পড়াশুনো হয়নি, একটা-দুটো মাস আদা-নুন খেয়ে লাগা। নির্ঝঞ্ঝাটেই আশানুরূপ—অর্থাৎ অভিভাবকদের কাছে আশানুরূপ—ফল করে বেরিয়ে এলাম। পরীক্ষায় বসা এবং ফল বেরোনোর মধ্যে কয়েক মাসের ব্যবধান, ছাত্রদের অসন্তোষ-অভিযোগ উঁচু পর্দায় বাঁধা, কয়েক মাস ধরে দফায়-দফায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জোরালো ধর্মঘট। সরকার বাহাদুর অন্তর্বর্তী কয়েক মাসে অনেকটা সামলে উঠেছেন, সাহস সঞ্চয় করেছেন, ছাত্রদের মধ্যেও কয়েকজন বিভীষণের খোঁজ পেয়েছেন, যথেষ্ট দমন-পীড়নের সাহায্যে ধর্মঘট প্রতিবার ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। ছাত্রদের কেউ-কেউ গ্রেফতার হলেন, কেউ-কেউ বহিষ্কৃত হলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমাদের মতো অ-মুসলমান ছাত্র একজন-দু’জন, যারা যবনিকার একটু আড়ালে ছিলাম, তাদের নামে হুলিয়া জারি হলো। সুতরাং সিদ্ধান্ত, কিছুদিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে গা ঢাকা দেওয়া সমীচীন। পুলিশ তখনও রপ্ত-দুরস্ত হয়নি, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পৌছে গোয়ালন্দ স্টিমার ধরে এক রাত্রের মধ্যে কলকাতা পৌঁছুতে তেমন অসুবিধা হলো না।

অপেক্ষায় আছি, কবে ফিরে যাবো, ইতিমধ্যে খবর এলো যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কর্তৃক পরীক্ষার ফল বের করা হয়েছে এবং আমি প্রথমই হয়েছি, তা হলেও, ঢাকাতে নাকি গুজব, আমাকে আর ভর্তি করা হবে না। আমার বাবা-মা তখনও ঢাকায়, দু’জনেই শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের কাছ থেকেও অনুরূপ আভাস পেলাম। যখনই তাঁর বাড়িতে থাকতে গিয়েছি আদরে ঢেকে রাখতেন আমার রাঙা পিসিমা। কিন্তু অনির্দিষ্টকাল যেহেতু কলকাতায় থাকতে হবে, পিসিবাড়ি ছেড়ে ওভারটুন হলের ওয়াই. এম. সি. এ. হস্টেলে একতলায় একটি অতি-অন্ধকার ঘর ভাড়া করে উঠে গেলাম। সেই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় কিনা তা নিয়ে এর-ওর কাছে সাহায্য ভিক্ষা শুরু।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ পর্যন্ত ভর্তি হওয়া গেল না, আশুতোষ-দ্বারভাঙা-সেনেট হল বিল্ডিংয়ে অধ্যয়ন করে পরীক্ষায় বসে নিজেকে পুণ্যবান বলে আর সারা জীবন নিজেকে বিজ্ঞাপিত করা হলো না। সমস্যা যা দেখা দিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা জানালেন, তা নাকি ‘টেকনিক্যাল’। ইন্টারমিডিয়েট আর্টস-এ উত্তীর্ণ হবার পর ঢাকায় তিন বছর কোর্সের অনার্স পড়েছি, তিন বছরের শেষে অর্থনীতিতে আট পেপারে পরীক্ষায় বসে সফল হয়েছি। যারা অনার্স পাশ করতে ঢাকায়, তাদের এম.এ পড়ার সময়সীমা মাত্র এক বছর, এবং পরীক্ষা দিতে হতো সাকুল্যে পাঁচ পেপারে। কলকাতায় দুই বছরের এম.এ পঠনান্তে আট পেপার নিয়ে পরীক্ষা। যাতে বছর নষ্ট না হয়, সেজন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম, আমি আট পেপারেই পরীক্ষা দেবো, কিন্তু দয়া করে যেন তাঁরা এম.এ ক্লাসে আমাকে ষষ্ঠ বর্ষে ভর্তি করে নেন। জবাব পেলাম, অসম্ভব, আমাকে আটটি পেপারে তো পরীক্ষায় বসতেই হবে, উপরন্তু এম.এ ক্লাসের পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পুরো দু’ বছর অতিবাহন করতে হবে, ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তির আবেদন বরবাদ। ঢাকার মতো ঘোর মফস্বল শহরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি, আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা চাঁদে হাত দিই, সরাসরি ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে চাই? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পুরুষদের একজন, তাঁদের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে একটি উক্তি করেছিলেন, যা আমার স্মৃতিতে আজও উডকাটের মতো খোদাই হয়ে আছে। ভারি মিষ্টি গলায় কথাটি বলেছিলেন ভদ্রলোক, ‘তোমাকে যদি বাবা ভর্তি করি, রাস্তা থেকে মুটে-মজুর ডেকে ভর্তি করতে হবে’।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তে বন্ধুবান্ধব ক্ষুব্ধ। সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ গৌরকিশোর ঘোষ। সে তখনও একটু-আধটু সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। শিক্ষা ও রাজনীতি বিষয়ে হালিশহর না কোথায় এক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিল। গৌরের কথায়, ‘বুঝলে, ওখানে সবাই বরাবরই সন্দেহ পোষণ করতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি অতিশয় হারামজাদা। কয়েকজনের মনে যা একটু সংশয় ছিল, তোমাকে ভর্তি না-করার ব্যাপারটি যখন বললাম, তাঁরা নিঃসন্দেহতর হলেন’।

সেই বয়সে অবশ্য বেশিক্ষণ মন খারাপ করার অবকাশ ছিল না। সুরঞ্জন সরকার তখনও ওভারটুন হলে, তেতলায়। সুতরাং আমাদের নরক গুলজার: অরুণকুমার সরকার, গৌরকিশোর ঘোষ, মণীন্দ্র মিত্র, মোনা নবিশ, সোমেশ আচার্য, পটনার এক বামপন্থী যুবক, নাম, যতদূর মনে আনতে পারি, অর্ধেন্দু হালদার, কয়েকবছর বাদে শুনতে পাই মনোবেদনায় আত্মহত্যা করেছেন। মাঝে-মধ্যে সুরঞ্জনের সঙ্গে আড্ডা দিতে ঢুকতেন, জামশেদপুরের ছেলে, দু’-বছর বাদে ক্রিকেট টেস্ট খেলবেন, পুটু চৌধুরী। বিমিশ্র ভিড়, তবে অসাহিত্যভক্তরা একটু বাদে কেটে পড়তেন। সাহিত্য-কবিতা নিয়ে, এবং সাহিত্য-কবিতা সংক্রান্ত গুজব-খেউড় নিয়ে, প্রহরের পর প্রহর। কফি হাউসে আরও অনেক সদ্য আলাপ-হওয়া বন্ধুজনের সঙ্গে অফুরন্ত আর বিস্তৃততর পালা। কফি হাউসে তখন দু’টি অতি-তরুণ যুগল টেবিলে-টেবিলে ঘুরতে, দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় ও নিমাই চট্টোপাধ্যায়। দীপক পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতির পণ্ডিত অধ্যাপকরূপে বিরাজ করে। নিমাই বহুদিন লন্ডন-প্রবাসী; তবে প্রায় প্রতি বছর, অনাবাসী ভারতীয়দের কায়দায়, এক-দুই-তিন সপ্তাহের জন্য দেশ ঘুরে যায়।

শাটুল গুপ্তের সঙ্গেও অ্যালবার্ট হলের কফি হাউসে প্রথম আলাপ, যদিও, কয়েক বছর গত হলে, তিনি তাঁর আনুগত্য মেরিডিথ স্ট্রিটে চালান করে দেন। আরও যাঁরা আড্ডা দিতেন কফি হাউসের সেই ঋতুতে, তাঁরা পান্নালাল দাশগুপ্তের তৎকালীন মন্ত্রশিষ্যদ্বয় বিপ্লবী কমিউনিস্টপার্টিভুক্ত অমর রাহা ও তান্তু (পৃথ্বীশ) দে। ঊনপঞ্চাশের গোড়ায় হইরই কাণ্ড, দমদম-বসিরহাট অভ্যুত্থান, তাতে অমর রাহা ও তান্তু দুজনেরই অগ্রবর্তী ভূমিকা। অধিকাংশের মতো, তাঁদেরও ধরা পড়তে হয়, সুতরাং বহু বছরের কারাবাস। ঘটনার দু’দিন বাদে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ, তান্তু রাতের অন্ধকারে শাটুল গুপ্তের বাড়িতে উপস্থিত। বন্ধুকে ফিরিয়ে দেননি শাটুল গুপ্ত, পুরো এক সপ্তাহ লুকিয়ে রেখে তান্তুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, অতঃপর এক প্রত্যুষে তান্তর নিঃশব্দ প্রস্থান, গ্রেফতারের পর বিচার, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

উনিশশো তেষট্টি সালে ছাড়া পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে আমার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎমাত্র তান্তুর বিস্ময়োক্তি, ‘আপনাকে তো আমি চিনি’। কী করে? অচিরে রহস্যের হদিশ মিললে। তান্তুদের বিচারক ছিলেন আমার হবু শ্বশুরমশাই। আমার স্ত্রী তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, ক্লাস ফেরত পিতৃদেবকে তুলতে প্রতিদিন বিকেলে আলিপুর আদালতের বাইরে প্রতীক্ষা করতেন, তখনই বিচারাধীন বন্দীদের কারাকক্ষে ফেরত পাঠানোর উদ্দেশ্যে ভ্যানে তোলা হতো, সে-সব বিকেলে তান্তু নাকি আমার স্ত্রীকে দেখেছেন। তান্তর কাছে অন্য একটি কথাও শুনেছিলাম। চোদ্দো বছর বাদে জেল থেকে বেরিয়ে তাঁর সবচেয়ে ভয় হতো অনভ্যস্ত পায়ে রাস্তা পেরোতে। শাটুল আর তান্তু দুজনেই আর বেঁচে নেই, পালিয়ে-বেড়ানো তান্তুকে শাটুলের আশ্রয়দানের কাহিনী খুব কম লোকেরই জানা, এখন স্মৃতির অতলে চাপা পড়ে যাবে।

সেই অদ্ভুত ঋতুতে অথচ বিপ্লব-প্রয়াস ও ফিচ্‌লেমির নিটোল সহ-অবস্থান। সুরঞ্জন ওই পর্বে চোখে-মুখে কথা বলে, ওর ভয়ে এপাড়ায়-ওপাড়ায়-বেপাড়ায় সবাই সন্ত্রস্ত কখন কী কেলেঙ্কারি বাধিয়ে ফেলে, সজ্ঞানে, সুপরিকল্পনা সহকারে। একদিনের কথা বলি, তারিখটা, বোধ হয় একুশে অক্টোবর, সুরঞ্জনের জন্মদিন। দুপুর থেকে আমার ঘরে ওর মোতায়েন হওয়া। হঠাৎ খেয়াল চাপলো সুষ্ঠুভাবে জন্মদিনটি পালন করতে হবে। এক টাকা খরচ করে বত্রিশটি পোস্টকার্ড কেনা হলো, তখন তা-ই দাম ছিল। দুপুর থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে গহন না-হয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রশংসনীয় দ্রুততার সঙ্গে বত্রিশটি বিভিন্ন ঠিকানায় পোস্টকার্ডগুলি বাণীতে ভরাট করা। শ্রম বিভাজন, আমার হাতের লেখা যাঁরা জানেন, তাঁদের সুরঞ্জন কর্তৃক শর নিক্ষেপ; সুরঞ্জনের হাতের লেখা যাঁদের চেনা, তাঁদের দিকে আমার অজ্ঞাতকুলশীল তীর ছোঁড়া। গুরুজনস্থানীয়দের কাছে লেখা, সমবয়সিনী চুম্বকরূপিণী মহিলাদের কাছে লেখা, কয়েকটি চিঠি বাংলার প্রধান-প্রধান আধুনিক কবিদের, কয়েকটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য অথবা আচার্যপ্রতিমদের, একজন-দু’জন উঠতি সাহিত্যযশোপ্রার্থীদেরও। কী ছিল না সে-সব চিঠিতে? গালাগাল, কেচ্ছা, চিমটি কাটা, ভাঙ্‌চি দেওয়া ইত্যাদি। সদ্য-শান্তিনিকেতন ছাড়া, সে-মুহূর্তে প্রচুর লিখনেওয়ালা সুদর্শনকান্তি এক কবিকে লেখা হলো, বিশ্বভারতীর ঠিকানায়, অম্লান বিবেকে লেখকের নাম স্বাক্ষর করা হলো, অরুণকুমার সরকার, প্রযত্নে ‘দ্বন্দ্ব’ পত্রিকা। শান্তিনিকেতনে তখনও ছুটি চলছে, ছাত্রদের নামে পাঠানো সমস্ত চিঠি ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের বাড়িতে জড়ো হতো। বাড়ির মহিলারা পরম উপভোগ সহকারে উক্ত কবিকে লেখা চিঠির বয়ান পাঠ করলেন: ‘শোনো খোকা, তুমি নাকি কাব্যি মকশো করো, সে কাব্যি নাকি আবার সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হয়? ফিচকেমির আর জায়গা পাওনি? এই চিঠি পাওয়া মাত্র পত্রপাঠ অবিলম্বে সঙ্গে-সঙ্গে ঝটিকাগতিতে কবিতা লেখা যদি ছেড়ে না দাও, বাবাকে বলে দেবো, বলে বেত খাওয়াবো’। মুশকিল হলো, ক্ষিতিমোহনবাবুর বাড়ির সেই মহিলারা, হয়তো অমর্ত্যর মাসতুতো বোনটোন হনে, চিঠিখানা পড়েই ক্ষান্ত হলেন না, পত্রপাঠ অবিলম্বে, সঙ্গে-সঙ্গে, ঝটিতিগতিতে ঠিকানা কেটে উক্ত কবির কলকাতার বাসস্থানে চিঠিটি রওনা করিয়ে দিলেন। কবিটি পরে আমার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলেন। তবে, বলতে বাধা নেই, সে-সময় বড়োই সরল ছিলেন, ঠিকানা-কাটা চিঠিখানা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দুই নম্বর বাসে চেপে হেদোতে নেমে ‘দ্বন্দ্ব’ দপ্তরে হাজির: ‘মহাশয়গণ, আপনাদের সঙ্গে অরুণকুমার সরকার নামে কোনও ভদ্রলোক কি যুক্ত আছেন?’ ‘অবশ্যই আছেন।’ ‘দেখুন, তিনি আমাকে কী চিঠি লিখেছেন।’ পরের সন্ধ্যায় দপ্তর-ফেরত অরুণকুমার সরকার আমার ঘরে হাজির, ভাগ্যবৈগুণ্যে সুরঞ্জনও সেখানে, মহা শোরগোল, সুরঞ্জন সরকারের মুক্ত হাসিতে অরুণের আরও ক্ষেপে যাওয়া, আমি বাধ্য হয়ে শান্তি স্বস্ত্যয়ন ছিটোলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *