আঠারো
ঠিক ক’দিন অথবা ক’মাস দিল্লিতে টিকতে পারবো, তা নিয়ে মনে অবশ্য গভীর সন্দেহ। তাই কলকাতায় হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটের ফ্ল্যাট স্ত্রীর জিম্মায় রইলো সমস্ত লটবহরসুন্ধু, আমি একা গিয়ে সরকারি পান্থনিবাস ওয়েস্টার্ন কোর্টে একটা বড়ো ঘর নিয়ে রইলাম। তখনও ওয়েস্টার্ন কোর্টের দুর্দশা তেমন চরমে পৌঁছয়নি, ঘরগুলির যত্নআত্তি নেওয়া হতো, যে-ঠিকেদারের হাতে খাদ্য পরিবেশনের দায়িত্ব, তাঁর বোধহয় সংসদ সদস্য তথা রাজপুরুষদের বিষয়ে সামান্য সমীহের ভাব অবশিষ্ট ছিল, যা খাদ্য সরবরাহ করা হতো তা অন্তত অকহতব্য স্তরে পৌঁছয়নি। যা সংযোজনযোগ্য, ওয়েস্টার্ন কোর্টে সে সময় অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ থাকতেন, সংসদ সদস্যদের বাদ দিয়েও। যাঁদের কথা বিশেষ মনে পড়ে তাঁদের অন্যতম শকুন্তলা পরাঞ্জপে, প্রথিতযশা সমাজসেবক, হালে-বিখ্যাত-চলচ্চিত্রনির্মাতা সই পরাঞ্জপের মাতা। শকুন্তলা দেবী সে-সময় রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য, ভোরবেলা এক টেবিলে বসে প্রাতরাশ সারতাম, আমাকে প্রায় বালক ভেবে প্রচুর স্নেহ করতেন, তাঁর ব্যস্ত বিচিত্র জীবনের অনেক ঘটনা গল্প বলার মতো করে বর্ণনা করতেন। আরও একজন ছিলেন, সাহেব সিং সোখে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে ভারতীয় সৈন্যদলে মেডিকেল জেনারেল, পরে মুম্বইতে হফকিন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সর্বাধ্যক্ষ, দেশকে যাতে ওষুধপত্র তৈরির ব্যাপারে স্বনির্ভর করা যায় তা নিয়ে বহু বছর প্রয়াস চালিয়েছেন। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী শিরিন ভাজিফদার একদা জেনারেল সোখের স্ত্রী ছিলেন। তবে তার চেয়েও বড়ো শোরগোলের কারণ সাহেব সিং সোখের প্রবল সোভিয়েট-প্রীতি। আমার সঙ্গে বোধহয় আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন হিতেন চৌধুরী; জেনারেল সোখের বয়স তখন আশি বছর ছুঁই-ছুঁই, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির চমৎকারিত্ব, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে, বলতে শুরু করলে তাঁকে আর থামানো যেত না।
ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত বরাবরই তো তাঁর সাংসদ জীবন ওয়েস্টার্ন কোর্টে কাটিয়ে গেছেন, তখনও ছিলেন। আরো বিশেষ করে মনে পড়ে মুরশিদাবাদের সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে। অতি সজ্জন, উদারচরিত, সর্ব অর্থে নিখাদ বাঙালি, প্রাতরাশের টেবিলে উজাড় করে নিজের মনের কথা বলতেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের ডামাডোলে কংগ্রেস সরকার তাঁকে ওদেশের গুপ্তচর অপবাদ দিয়ে বেশ কয়েক মাস কয়েদ করে রেখেছিল; সে-প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বদরুদ্দোজা সাহেব অভিমানে উদ্বেল হয়ে উঠতেন।
অস্থায়ী অনেক আগন্তুক আসতেন-যেতেন। অত্যন্ত আকর্ষণীয় অতিথি-আলয় ছিল তৎকালীন ওয়েস্টার্ন কোর্ট, একজন-দু’জন অপ্রিয় মানুষও যে মাঝে-মাঝে হাজির হতেন না তা অবশ্য নয়। জনৈক জনসংখ্যাবিদ, বাড়ি তামিলনাড়ুতে, অনেক বছর মার্কিন দেশে কাটিয়েছিলেন, পরে দেশে ফিরে কংগ্রেস দলে যোগ দিয়ে কিছুদিনের জন্য কেন্দ্রে মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন, গলা চুলকে ঝগড়া করতে ভালবাসতেন।
ওয়েস্টার্ন কোর্ট থেকে কৃষিভবন তেমন কিছু দূর ছিল না, আমি পৌঁছে যেতাম সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে; ভোরবেলা হেঁটে যেতে, এমনকি গ্রীষ্মকালেও, অসুবিধা হতো না, আর বিকেলে তো এর-ওর সঙ্গে আড্ডা দিতে চলে যাওয়া। পুরোনো বাঙালি-অবাঙালি বন্ধুরা তো ছিলেনই, তা ছাড়া কয়েকমাস বাদে দিল্লিতে কার্যসূত্রে কিরণময় রাহা পৌঁছে গেলেন, তাঁর সান্নিধ্য ও সৌহার্দ্যে বরাবর আপ্লুত থেকেছি। কিরণবাবু আয়কর বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু সেই পরিচয় ধর্তব্যের মধ্যে নয়, তিনি নাট্য-চলচ্চিত্র-সাহিত্যে মজে-থাকা মানুষ। তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর অতিথিপরায়ণতাও প্রবাদপ্রতিম। নতুন করে আরও আলাপ হলো কবিদম্পতি শরৎকুমার-বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। উঠতি যুগের কবিদের সম্পর্কে আমার মনে পুঞ্জিত ভয়; তাঁরা সম্ভবত নিজেদের নিয়েই বিভোর, সমাজভুক্ত অবশিষ্টদের নিরাসক্ত অন্যমনস্কতায় পাশ কাটিয়ে যান! শরৎ-বিজয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে সেই ভয় খানিকটা ঘুচলো। বিজয়া অমলেন্দু দাশগুপ্তের অনুজা, হয়তো সেই কারণেই ওঁদের কাছে খানিকটা প্রশ্রয় পেয়েছি।
কৃষিমন্ত্রকের কেষ্টবিন্ধুরা আমার মতো অতি-নবীন যুবককে তাঁদের সমপর্যায়ের পদে বসানো হয়েছে, তা নিয়ে প্রচুর মনোক্ষোভে ভুগছিলেন, প্রথম দিকে তাই তাঁদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেতে সামান্য অসুবিধা হচ্ছিল, কিন্তু কৃষিমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন, সবচেয়ে বড় কথা, কয়েকদিনের মধ্যেই পরমেশ্বর হাকসার প্রধান মন্ত্রীর প্রধান সচিব হিশেবে যোগ দেওয়াতে আমার মস্ত সাচ্ছল্যবোধ। হাকসার আমার পূর্ব-পরিচিত। লন্ডনে ছাত্রাবস্থা থেকে থরনার ও চণ্ডীর বন্ধু। তখন ঘোর কমিউনিস্ট ছিলেন, দেশে ফিরেও কিছুদিন মধ্যপ্রদেশে সাতনা, না অন্য কোথাও, গুজব শুনেছিলাম, পার্টির স্থানীয় কমিটির সম্পাদক ছিলেন। সম্ভবত পারিবারিক উপরোধে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম বিসর্জন দিয়ে প্রথমে এলাহাবাদে আইনজীবী বৃত্তিতে, পরে বিদেশ মন্ত্রকে যোগ দিয়েছিলেন, নানা জায়গায় রাষ্ট্রদূত হিশেবে কাজ করেছেন, জওহরলাল নেহরুর খুব স্নেহাস্পদ। ইন্দিরা গান্ধি উনিশশো ছেষট্টির জানুয়ারি মাস থেকে প্রধান মন্ত্রী, কিন্তু সদাশিব পাতিল-অতুল্য ঘোষ গোছের নেতারা এক দিকে দলে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, অন্য দিকে ধড়িবাজ বুড়ো-বুড়ো আমলারা তাঁকে কব্জা করার ছক কষছেন। মহিলা অথৈ জলে, কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর পিতার অতি-বিশ্বস্ত হাকসারকে দেশে ফিরিয়ে এনে নিজের সচিব পদে বসালেন। হাকসারের সম্পর্কে পবে আমাকে বেশ কয়েক কাহন বলতেই হবে, অতএব আপাতত ক্ষান্ত দিচ্ছি।
কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনের প্রধান হিশেবে প্রাথমিক সমস্যাদি আমি সহজেই যে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম, তার অন্যতম কারণ অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের এক সময়ে প্রধান কৃষি অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞ, আমার পুরনো মাস্টারমশাই সমররঞ্জন সেন, তখন যোজনা কমিশনে সমাসীন, আমলাতন্ত্র তাঁকে প্রচুর সমীহ করে, তিনি যথাযথ জায়গায় বার্তা পাঠিয়েছিলেন, আমার প্রতি বীতরাগ ক্রমশ দূর হলো। বিশেষ ব্যক্তিগত বন্ধু, তীক্ষ্ণবুদ্ধি অর্থনীতিবিদ, ধরম নারায়ণ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অফ ইকনমিক গ্রোথে গবেষক-অধ্যাপক, আমার অনুরোধ ঠেলতে না পেরে আংশিক সময়ের জন্য কমিশনের সদস্য রূপে যোগ দিতে সম্মত হলেন। চার বছর ওখানে ছিলাম, নিবিড় স্বস্তিসুখ, চরিতার্থবোধ ও সম্প্রীতির মধ্যে।
ইন্দিরা গান্ধি সাময়িকভাবে বাঁয়ে হেললেও তা তো নিছক কৌশলগত কারণে, কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রেণী-চরিত্র তো পাল্টাবার নয়, পুঁজিবাদী-ব্যবসাদার-ধনী কৃষক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বসংকুল কংগ্রেসের উপর তলার নেতৃত্ব। সেই বিশেষ মুহূর্তে উচ্চফলনশীল শস্যের বাণী ভারতবর্ষের কর্তাব্যক্তিদের সমীপে পৌঁছে গেছে, ফোর্ড ফাউন্ডেশন গণ্ডায়-গণ্ডায় বিশেষজ্ঞ পাঠাচ্ছেন বোঝাতে ভারতবর্ষকে কী করে কৃষিক্ষেত্রে অত্যাধুনিক করে তোলা যায়: শুধু উন্নত বীজের ব্যবস্থা হলেই তো চলবে না, সেচের জলের মাপমতো ব্যবহার চাই, নানা ধরনের প্রতিষেধক কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে, যথেষ্ট প্রসারিত বর্গক্ষেত্র না হলে জলসেচন অসুবিধাজনক, সুতরাং গমের উন্নত বীজশস্য জড়িয়ে যে-তথাকথিত ‘সবুজ’ বিপ্লবের সূচনা, তা সফল করতে হলে জমিজমাওলা ধনী কৃষকদেরই পৃষ্ঠপোষকতার জন্য বাছাই করতে হবে, সেই সঙ্গে তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত কৃষি ঋণেরও ব্যবস্থা। তাঁদের সমীপে উন্নত বীজশস্য পৌঁছে দেওয়া যেমন কর্তব্য, সেচের জল প্রয়োগের যথাযথ ব্যবস্থার উদ্যোগ গ্রহণও সমকর্তব্য। সুতরাং যা হবার তা-ই হলো, ‘সবুজ’ বিপ্লব থেকে প্রথমে গম, পরে চাল, তারও পরে তুলোর উৎপাদন বাড়লো দেশ জুড়ে, কিন্তু বাড়লো প্রধানত ধনী কৃষকদের বড়ো-বড়ো ক্ষেতখামারে, কৃষিক্ষেত্রে আর্থিক বৈষম্য উৎকীর্ণতর। ধনী কৃষককুলের তবু ভরিল না চিত্ত, তাঁদের দাবি, এবং বাঘা-বাঘা মার্কিন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, প্রতিটি কৃষিপণ্যের জন্য উদার হারে ন্যূনতম সহায়ক-মূল্য ঘোষণা করতে হবে: যদি বাজারে উৎপাদন আধিক্যহেতু দাম নিম্নমুখী হয়, তা হলে পূর্বঘোষিত সহায়ক-মূল্যে সরকারকে কৃষক ও ব্যবসাদারদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনতে হবে, এই দামে যে-পরিমাণ উৎপন্ন শস্য বিক্রয় করতে তাঁরা উৎসুক, পুরোটাই। কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনের দায়িত্ব বিভিন্ন শস্যের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়মূল্য নির্ধারণ। তবে, তখন পর্যন্ত, বাজারে শস্যপ্রাচুর্যের চেয়ে শস্যের অনটনের ইতিহাসই জনমানসে মুদ্রিত। তদনুরূপ পরিস্থিতির সম্ভাবনা সরকারের পক্ষে উপেক্ষা করা সহজ ছিল না, সুতরাং কমিশনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হলো, প্রতি মরশুমে বিভিন্ন শস্যাদি কৃষক ও ব্যবসাদারদের থেকে সরকার কোন সংগ্রহ-মূল্যে কিনবেন, এবং কত পরিমাণ কিনবেন, সে-সব নিয়ে সুপারিশ জ্ঞাপন। এই সংগ্রহ-মূল্য বাজারে চালু মূল্য থেকে যদিও কম হবে, ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থেকে অবশ্যই বেশি। সহায়ক-মূল্য, বলা বাহুল্য, কৃষকদের খরচ পুষিয়ে দেবে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, ন্যূনতম ব্যয়ের উপর যথাযোগ্য লাভের একটি অংশও জুড়ে দিতে হবে, এবং সংগ্রহ মূল্য নির্ধারিত হবে আরও মগ্ডালে।
ততদিনে দেশের উচ্চবিত্ত কৃষককুল জ্ঞানশলাকার স্পর্শ পেয়েছেন, মার্কিন দেশে কৃষকদের কী পরিমাণ তোয়াজ করা হয় তা তাঁরা জেনে গেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার বড়ো জোর চার শতাংশ কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, অন্যেরা সবাই শিল্প-পরিষেবা থেকে জীবন নির্বাহ করেন। এই অতি স্বল্পসংখ্যক কৃষিজীবীদের তাই তুষ্ট না-রেখে মার্কিন দেশের উপায় নেই। ভারতবর্ষে সম্পূর্ণ অন্য সমস্যা: আমাদের জনসংখ্যার শতকরা দুই-তৃতীয়াংশ কৃষির উপর নির্ভরশীল, তাঁদের অধিকাংশই হয় ভূমিহীন কৃষক নয় ক্ষুদ্র বর্গক্ষেত্রের মালিক নয়তো ভাগচাষী। ভাগচাষী অথবা ক্ষুদ্রায়তন কৃষিভূমির স্বত্ত্বাধিকারীদের উদ্বৃত্ত শস্য থাকে না, আর ক্ষেত-মজুরদের তো ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় পুরো খাদ্যশস্যই খোলা বাজার থেকে কিনতে হয়। অনটনের বছরে বাজারদর ক্রমশ চড়ে, চড়া দরে শস্য কেনা গরিব কৃষকদের পক্ষে সম্ভব নয়, যেমন সম্ভব নয় শহরের গরিব মানুষদেরও। সুতরাং সরকারি সরবরাহ ব্যবস্থার মধ্যবর্তিতায় দরিদ্ৰজনকে সস্তায় খাদ্যশস্য পৌঁছুনোর প্রয়োজন দেখা দেয়। আমাদের কমিশনের উপর বাড়তি দায়িত্ব চাপানো হলো, বিভিন্ন খাদ্যশস্যের সংগ্রহ-মূল্য সুপারিশ করবার। সংগ্রহ-মূল্য সাধারণত যদিও সহায়ক-মূল্যের চেয়ে বেশি হবে, ভীষণরকম বেশি হলে সমস্যা, রাষ্ট্রীয় সরবরাহ ব্যবস্থার মারফত তো গরিবদের খাদ্যশস্য পৌছনো মুখ্য উদ্দেশ্য, সরবরাহ-মূল্য তেমন চড়া হলে তাদের সাধ্যের বাইরে চলে যাবে। বাণিজ্যিক শস্যের ক্ষেত্রেও অনুরূপ সমস্যা: ন্যূনতম সহায়ক-মূল্য নির্ণয় করা জরুরি, অন্যথা গরিব কৃষকরা মারা পড়বেন; কিন্তু তা খুব উঁচু স্তরে বাঁধা হলে কার্পাসজাত বা পাটজাত পণ্যাদি বিদেশে রফতানি করতে অসুবিধা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা।
দেশে ওই বছরগুলিতে আকীর্ণ খাদ্যসমস্যা। স্বাভাবিক কারণে জাতীয় রাজনীতিতে সচ্ছল কৃষককুলের প্রভাব ক্রমবর্ধমান। তাঁরা প্রধানত পঞ্জাব-হরিয়ানা-পশ্চিম উত্তর প্রদেশে কেন্দ্রীভূত, গোটা দেশকে তাঁরা খাদ্যশস্য জোগাচ্ছেন, তাঁদের হামবড়া ভাবের শেষ নেই। কমিশনে থাকাকালীন আমাকে ভারতবর্ষের সব ক’টি রাজ্য চষে বেড়াতে হয়েছে, প্রত্যন্ততম অঞ্চলে পর্যন্ত। যেখানেই গেছি, সর্বত্র ধনী শ্রেণীভুক্ত কৃষকদের বর্ধমান ক্ষমতার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা হয়েছে। এঁদের দখলে বৃহৎ বিস্তৃত কৃষিবর্গক্ষেত্র, এঁদের জন্য ঢালাও উন্নত বীজশস্যের ব্যবস্থা, সরকার থেকে সস্তা দরে সেচের জল-সার-কীটনাশক ইত্যাদি এঁদের সরবরাহ করা হচ্ছে, সুতরাং এঁদের গড় উৎপাদনব্যয় তুলনাগতভাবে অন্য শ্রেণীভুক্ত কৃষকদের খরচপাতির চেয়ে কম হওয়ারই কথা। কিন্তু এই যুক্তি কে মানবেন, সম্পন্ন কৃষককুলের ভাবটা এরকম: অধিক ফলন ফলিয়ে তাঁরা দেশকে কৃতার্থ করে দিয়েছেন, তাঁদের দাবিকৃত চড়া দাম মঞ্জুর না করে সরকার যাবে কোথায়। তখনকার পরিভাষায় এঁদের ‘প্রগতিশীল’ কৃষক বলে অভিহিত করা হতো, ‘প্রগতিশীল’ এই কারণে যে তাঁরা কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ বরণ করে নিয়েছেন। মনে পড়ে, নানা অনুদান ও অন্যান্য সুবিধাদি পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর কর্ষিত শষ্যের উৎপাদন ব্যয় এত বেশি কেন, সেই প্রশ্ন এক ধনবান পঞ্জাবি কৃষককে করাতে, সেই ভদ্রলোকের সম্যকরূপে ক্ষিপ্ত উত্তর: অবশ্যই তাঁর উৎপাদনব্যয় অধিক হবে, তিনি যে প্রগতিশীল কৃষক। আমাকে নিরুত্তর থাকতে হলো; এঁরা হাতে মাথা কাটবেনই, দেশকে মুখের খাবার জোগাচ্ছেন তো এঁরা। প্রগতিশীলতার সংজ্ঞা যে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে গড় উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা কে বোঝাবে এঁদের?
বিচিত্র সব ব্যাপারস্যাপার। হায়দরাবাদ গেছি, অন্ধ্র প্রদেশের তদানীন্তন কৃষি মন্ত্রী, থিম্মা রেড্ডি, নেলোর না কুনুর জেলার কুলককুলপতি, প্রচুর আপ্যায়ন করলেন। দেশের স্বার্থে শস্যোৎপাদনে তাঁরা যে প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন, তাঁদের উৎপাদন ব্যয় অতএব যে ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী, সহায়ক ও সংগ্রহমূল্য নির্ধারণে আমি যে সে-সমস্ত কথা বিবেচনা করবো, তা নিয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। যথাসময়ে আমাদের প্রতিবেদন দাখিল করলাম, প্রতিবেদন আলোচনার জন্য মুখ্যমন্ত্রীদের দিল্লিতে আহ্বান জানানো হলো, থিম্মা রেড্ডি-ও এলেন: আমার সঙ্গে বিজ্ঞানভবনের লবিতে দেখা, নমস্কার-প্রতিনমস্কারের পর মন্ত্রীমশাইয়ের সক্ষোভ উক্তি, ‘আপনার সঙ্গে যখন আলাপ হয়েছিল, ভেবেছিলাম আপনি অতি সহৃদয় ভদ্রলোক। এখন দেখছি আপনি একটি অ্যাটম বোমা’!
তবে অন্যরকম শিক্ষালাভও হচ্ছিল৷ গুজরাটে সফর, বরোদাতেই বোধহয় এক সদাশয় বৃদ্ধ খামারের মালিক, আমাকে অনুতাপের ভঙ্গিতে উপদেশ বিতরণ করলেন, ‘তোমাদের বাঙালিদের দিয়ে পয়সাকড়ি করা হবে না। তোমরা পঁচিশ একর জমি পেলে সারি দিয়ে শত-শত আম গাছ পুঁতবে, আম গাছে সহজেই পোকা ধরে, প্রচুর পরিচর্যা করতে হয়, তা সত্ত্বেও তিন-চার বছর বাদেই এক একটা গাছ মরে যায়, বলতে গেলে তোমাদের টাকা প্রায় জলে যায়। অন্য পক্ষে আমাদের, গুজরাটিদের, দ্যাখো, ওরকম জমি পেলে আমরা আম গাছ লাগাই না, সজনে বাগানের ব্যবস্থা করি। সজনে গাছের কোনও পরিচর্যা করতে হয় না, একটা গাছ একশো-দু’শো বছর পর্যন্ত বাঁচে। সাধে কি আর আমাদের টাকার পাহাড় জমে, তোমাদের কিস্যু না’। ধনী কৃষকদের আয়কর দেওয়ার দায় নেই, সরকার থেকে বিবিধ ভরতুকি দিয়ে তাঁদের উৎপাদনব্যয় হ্রাস করার ব্যবস্থা হয়েছে, সরকার যথেষ্ট দরাজ হাতে সহায়ক ও সংগ্রহ-মূল্যের উদ্যোগ নিয়েছেন, এটা তাই প্রায় অবধারিতই ছিল যে, শীততাপনিয়ন্ত্রিত খেতখামার দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে সেই সঙ্গে দক্ষিণ দিল্লিতে ‘দীনদরিদ্র’ কৃষকদের পয়সায় বিরাট-বিরাট প্রাসাদ।
আসলে শুধু কংগ্রেস দলের নেতাদের মধ্যেই কেন, বামপন্থী মহলেও তখন কৃষিপণ্য মূল্য সম্পর্কে যথেষ্ট বিভ্রান্তি। কৃষিপণ্যের মূল্য বাড়লে অধিকাংশ কৃষিজীবীর লাভ নেই, বরঞ্চ ক্ষতি, এটা অনেককেই বোঝানো যাচ্ছিল না। গোটা দেশে অন্তত চার-পঞ্চমাংশ কৃষিজীবী খাদ্যশস্যে স্বনির্ভর নন, তাঁদের বাজার থেকে ধান-চাল-গম-বাজরা ইত্যাদি কিনতে হয়, মূল্যবৃদ্ধিতে সম্পন্ন চাষিদের পৌষমাস, গরিব কৃষকদের সর্বনাশ, কিন্তু অনেক বামপন্থী নেতাই অতটা গভীরে যেতে চাইতেন না: কৃষিজাত পণ্যের মূল্যমান বৃদ্ধি পেলে, তাঁরা ধরেই নিতেন, ছোটোচাষী-ভাগচাষীদেরও সুবিধা, হয়তো ক্ষেতমজুরদের উপার্জনও বৃদ্ধি পাবে। তাঁরা যে ভুল ভাবছেন, তথ্যের হিশেব দাখিল করেও বিশেষ লাভ হতো না, সেই ভুল সংশোধনের জন্য গরজ কারো মধ্যেই তেমন দেখা যেত না। সাতষট্টি সালের গ্রীষ্ম, আট বছর বাদে ইএমএস ফের কেরলে মুখ্যমন্ত্রী, তিনি মহা উৎসাহে পঞ্জাব মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গমের সংগ্রহমূল্য অনেকগুণ বাড়াবার প্রস্তাবে সায় দিয়ে যাচ্ছেন। ত্রিবান্দ্রমে তাঁকে গিয়ে ধরলাম: ‘আপনার রাজ্য কেরলে এক রত্তি গমও উৎপন্ন হয় না, আপনারা প্রতি বছর বারো লক্ষ টন গম পঞ্জাব-হরিয়ানা থেকে আমদানি করেন, যদি ক্যুইন্টাল প্রতি একশো টাকা দাম বাড়ে, আপনারা কেরল থেকে প্রতি বছর আরও একশো কুড়ি কোটি টাকা পঞ্জাব-হরিয়ানার জমিদার-জোতদার-ব্যবসাদারদের হাতে তা হলে তুলে দেবেন, সেই টাকায় ওরা দক্ষিণ দিল্লিতে শৌখিন মস্ত অট্টালিকা বানাবে, কেরলের জনগণ আরও একটু শোষিত হবেন’। বৃথাই আমার চ্যাঁচাননা, পার্টির সর্বভারতীয় নীতি অন্য কথা বলে, ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরলাম।
সেই মুহূর্তে দলীয় নেতৃত্ব উত্তর ভারতের গ্রামাঞ্চলে প্রভাব বাড়াবার জন্য আঁকুপাঁকু। শ্রেণী বিভাজনের তত্ত্ব প্রয়োগে আদৌ সুরাহা হচ্ছে না, হয়তো কোনও-কোনও নেতা ভাবছিলেন, কৌশলগত কারণেই ভাবছিলেন, চরণ সিংহ-গোছের ধনী কৃষক সম্প্রদায়ের প্রতিভূদের প্রসাদে যদি অবস্থার মোড় ফেরানো যায় মন্দ কী, অতএব চোখ-কান বুঁজে চরণ সিংহের কৃষিপণ্য মূল্যনীতি তাঁরা সমর্থন করতে প্রলুব্ধ হচ্ছিলেন। সেই মোহ কাটতে অনেক দিন লেগেছিল, এখনও পুরোপুরি কেটেছে তা বলতে পারি না। আমি কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনের দায়িত্বে থাকাকালীন এ-সমস্ত সমস্যা নিয়ে হরেকৃষ্ণ কোঙারের সঙ্গে প্রচুর আলোচনা হতো; উনি দিল্লি এলে যোগাযোগ করতেন, তখন হতো, নইলে আমি মাঝে-মধ্যে কলকাতায় গেলে। বুঝতে পারতাম তাঁর মনেও দ্বিধা। তবে যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁর অভিজ্ঞতার ও প্রজ্ঞার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি।
১৯৬৭ সালের গোড়ায় দেশ জুড়ে সাধারণ নির্বাচন, কংগ্রেস দল হারতে-হারতে কোনওক্রমে লোকসভায় সংখ্যাধিক্য পেলো, কিন্তু কামরাজ-সহ বহু নেতাকে পরাজয় বরণ করতে হলো। কৃষিমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম্ অনেক ভোটে হারলেন; তাঁর সঙ্গে দেখা করে মৌখিক সমবেদনা জ্ঞাপনের চেষ্টা করছি, হঠাৎ দেখি দরদর করে মন্ত্রীমশাইয়ের চোখ দিয়ে জল ঝরছে, আমি বিব্রত, কী বলবো ভেবে পাই না। কৃষিমন্ত্রকে নতুন মন্ত্রী এলেন জগজীবন রাম। পিছিয়ে-পড়া শ্রেণীভুক্তদের প্রতিভা ও বুদ্ধি সম্পর্কে আমাদের সমাজে অনেক অবজ্ঞাসূচক তির্যক মন্তব্য বর্ষিত হয়, জগজীবন রামের সঙ্গে পরিচয় ঘটলে সে ভুল ভাঙতো। চর্মকার শ্রেণীতে জন্ম, বেশি লেখাপড়ার সুযোগ পাননি, কোনওক্রমে বোধহয় ওকালতি পাশ করেছিলেন, তারপর পুরোটা সময়ই কংগ্রেস আন্দোলনে থেকেছেন, ছেচল্লিশ সাল থেকে একাদিক্রমে মন্ত্রী, শুধু কামরাজ পরিকল্পনায় বছর চারেকের জন্য বাদ পড়েছিলেন। ক্ষুরধার বুদ্ধি, যে-কোনও পালিশ-করা অর্থনীতিবিদের চাইতেও প্রগাঢ়তর ষত্ত্ব-ণত্ত্ব জ্ঞান, ইংরেজি ভাষার উপর দখলও চমৎকার। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে কেন্দ্রে ও রাজ্যে কম মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত হইনি, দক্ষতার দিক দিয়ে জগজীবন রামকে আমার বিবেচনায় একেবারে শীর্ষস্থানে রাখবো, তার মানে এই নয় যে, তাঁর নীতিজ্ঞান বা ব্যক্তিগত জীবনচর্যা সম্বন্ধে সমপরিমাণ শ্রদ্ধা পোষণ করবো। আপাত-অপ্রয়োজনীয় তথ্য, তবু এখানে উল্লেখ করতে মজা লাগছে: জগজীবনবাবু সব সময় দামি বিলিতি সিগারেট খেতেন, কিন্তু খেতেন খাঁটি দেহাতি বিভঙ্গে, সিগারেটটা ঠোঁটের পাশে হুঁকোর মতো ধরে।
কৃষিমন্ত্রকের সঙ্গে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন, কিছুদিন বাদেই বুঝতে পারলেন, কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনের সভাপতিটি ধানি লঙ্কা; তাঁরা ধনী কৃষকদের সঙ্গে দিব্যি দহরম মহরম চালিয়ে যাচ্ছিলেন, বাগড়া দেবার জন্য এই লোকটি এল কোত্থেকে, ফোর্ড ফাউন্ডেশনের মন যুগিয়ে কথা বলে না, মন্ত্রীদের কথাও শিরোধার্য করে না, শাঁসালো কৃষককুলের কথাবার্তা উপেক্ষা করে। তবে খানিক বাদে তাঁদের ধারণা হলো, প্রধান মন্ত্রীর দফতরে, যে কারণেই হোক, আমার খুঁটি বাঁধা, আমাকে চিমটি কেটে আপাতত তেমন সুবিধা হবে না। যে-দু’জন কৃষিমন্ত্রীর জমানায় কাজ করেছি, কোনও সময়ই তাঁদের সৌজন্যের অন্তত অভাব হয়নি, আমার পরামর্শ মানুন না-মানুন। কে জানে, তার কারণও হয়তো ওই একই।
যে-সাড়ে তিন বছর-চার বছর কমিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, দেশের অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে আমার জ্ঞান প্রভূত বৃদ্ধি পেয়েছিল, সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কেও। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কার্পাস নিগম কর্তৃক তুলো কেনা হবে, পাট নিগম থেকে কৃষকদের কাছ থেকে পাট। অথচ আমরা যে ন্যূনতম সহায়ক-মূল্য কমিশনের তরফ থেকে স্থির করে দিতাম, অনেক বছর তার দ্বিগুণ দাম দিয়েও কার্পাস নিগম কর্তৃক কৃষককুলের কাছ থেকে তুলো কেনা হতো। কারণ স্পষ্ট: তুলো উৎপাদনকারী কৃষক ও তুলোর ব্যাপারীরা সবাই রাঘব-বোয়াল, সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে সুদক্ষ; তুলোর দাম অস্বাভাবিকরকম বেশি হলে কার্পাস বস্ত্র রফতানি করতে অসুবিধা দেখা দেবে, সেই যুক্তিও গ্রাহ্য হতো না; বরঞ্চ কার্পাস বস্ত্রাদি রফতানির ক্ষেত্রে সরকার থেকে অঢেল ভর্তুকির ব্যবস্থা, সুতরাং দু’ দিক থেকেই তুলোর ব্যাপারীদের লাভ। অথচ পাটের প্রসঙ্গে চলে আসুন, পাট চাষিরা পশ্চিম বাংলা-বিহার-ওড়িশা-অসমে বিক্ষিপ্ত, অধিকাংশই ছোটো জমির মালিক, তাঁরা ফড়ে ও ব্যাপারীদের পদতললুণ্ঠিত, তাঁদের কথা সরকারকে ভাববার দরকার নেই: এমনকি অধিক ফসলের বছরে পর্যন্ত, ন্যূনতম সহায়ক-মূল্যেও সরকারের তরফ থেকে পাট কেনবার কোনও উদ্যোগ দেখা যেতো না, বাজার দর সহায়কমূল্যের অনেক অনেক নিচে নেমে গেলে তখনই পাট নিগমের টনক নড়তো। এই ঐতিহ্য এখনও বহমান।
ভারতের পাট নিগম কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থা; সংস্থাটির নির্লিপ্ততা রাজ্য সরকার অসহায় দৃষ্টি নিয়ে একমাত্র নিরীক্ষণই করতে পারেন। রাজ্য সরকার নিজের অধীন কোনো ক্রয়সংস্থা খুলে গরিব চাষীদের কাছ থেকে সহায়ক-মূল্যে যথেষ্ট পরিমাণ পাট কিনবেন, তারও উপায় নেই, ব্যাংকগুলিও কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন, নতুন দিল্লির অনুমতি ব্যতীত তারা পাট কেনবার জন্য রাজ্যসরকারকে টাকা ধার দেবে না।
অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করি। তুলোর সহায়ক মূল্য নির্ণয় করার মরশুম, আমি মুম্বইতে টেক্সটাইল কর্পোরেশনের দফতরে সমাসীন; তুলো চাষ ও কার্পাস শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছি। সকাল সাড়ে দশটায় এলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কটন কর্পোরেশনের সভাপতি শ্রীযুক্ত রামনারায়ণ রুইয়া; সংগঠনটি প্রধান-প্রধান তুলো ব্যবসাদারদের প্রতিনিধিস্থানীয়। রামনারায়ণজীর সঙ্গে আলোচনা সমাপ্ত হলে ঠিক দ্বিপ্রহরবেলায় এলেন শ্রীযুক্ত রাধাকৃষ্ণ রুইয়া; পরিচয়: সভাপতি, ইন্ডিয়ান কটন মিলস ফেডারেশন, আহমেদাবাদস্থ বস্ত্র-শিল্পের দুঁদে চাঁইদের সংগঠন। রাধাকৃষ্ণজী রামনারায়ণজীর মধ্যম অনুজ। বেলা আড়াইটায় এলেন কৃষককুলের তথাকথিত নেতৃবৃন্দ, গুজরাট রাজ্য কোঅপারেটিভ কটন গ্রোয়ার্স সোসাইটি, তুলোচাষিদের ডাকসাইটে প্রতিনিধিসংস্থা, এই সংস্থার প্রধান রামনারায়ণজীর আর এক অনুজ, নাম, যতদূর মনে পড়ে, লক্ষ্মীবিলাস রুইয়া। ওয়াজেদ আলি সাহেব যা লিখে গিয়েছিলেন, তা যেমন ভারতবর্ষের সামাজিক পরম্পরার প্রতিবিম্ব, রুইয়া ভ্রাতাদের পরস্পরের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকাও তেমনই ভারতবর্ষের সমাজ-কাঠামোর অন্য এক রূপ: যে-খাতেই টাকা গড়াক না কেন, শেষ পর্যন্ত রুইয়াদের মতো মাত্র কতিপয় গোষ্ঠীর তা কুক্ষিগত হবে।
খানিকটা নেশা ধরে গেল। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার কলকাঠি কারা নাড়ছেন, কেন নাড়ছেন, কী পদ্ধতিতে নাড়ছেন, জানবার এমন সুযোগ আর কখনও আসবে না, সুতরাং ক্ষণিকের অতিথি হয়ে এসেছি তাতে কী, অন্তত যে-প্রতিবেদনগুলি পেশ করতাম, সরকার তাদের কক্তব্য মানুন না-মানুন, সেগুলি তো ছাপা হতো, জনে-জনে পড়ার সুযোগ পেতেন, স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করে বলতাম, ধরমনারায়ণ আমার ছায়াসঙ্গী।
কৃষিপণ্যে মূল্য কমিশনে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই বিচিত্র অপর এক অভিজ্ঞতা। হিন্দু সাধু সমাজ কিংবা ঐ নামের কোনো গোষ্ঠীর অনুপ্রেরণায় এক দঙ্গল শরীরে-ছাই-মাখাহাতে-ত্রিশূল রক্তচক্ষু সাধু ছেষট্টি সালের নভেম্বর মাসের এক দিবসে সংসদ ভবনে চড়াও হলেন, তাঁদের দাবি, অবিলম্বে সারা দেশে গো-হত্যা বন্ধ করতে হবে, অন্যথা তাঁরা তাঁদের হিংসা দিয়ে সরকারের পতন ঘটাবেন। ইন্দিরা গান্ধি সদ্য প্রধান মন্ত্রী হয়েছেন, নিজের উপর তখনও আস্থা উপার্জন করতে পারেননি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ ভক্ত মানুষ, তাঁর পরামর্শে প্রধান মন্ত্রী বিষয়টি বিশদে দেখার জন্য এক কমিটির কথা ঘোষণা করলেন। ওরকম বহু-আঁশলা কমিটি ইতিহাসে সত্যিই বিরল। সুপ্রীম কোর্ট থেকে প্রধান বিচারপতি হিশেবে সদ্য অবসর গ্রহণ করেছেন, বাগবাজার পাড়ার বনেদি বাসিন্দা, মজলিশি মানুষ—স্নেহাশুবাবুর ওখানে প্রচুর আড্ডা দিয়েছি ওঁর সঙ্গে—অমলকুমার সরকার মশাই কমিটির সভাপতি; ভারত সাধু সমাজের তরফে খোদ গুরু গোলওয়ালকর, পুরীপীঠের জগৎগুরু শঙ্করাচার্য ও রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়; অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ হিশেবে বর্ণিত আমরা তিনজন: ‘আমূল’-এর প্রতিষ্ঠাতা-প্রাণপুরুষ ভার্গিজ কুরিয়েন, ভারত সরকারের তৎকালীন পশুপালন সর্বাধ্যক্ষ অতি সজ্জন বাঙালি ভদ্রলোক পুণ্যব্রত ভট্টাচার্য, অর্থনীতিবিদ হিশেবে আমি; তা ছাড়া একজন-দু’জন বিভিন্ন রাজ্যের কৃষি মন্ত্রীরাও কমিটিতে ছিলেন, তবে তারা তেমন নিয়মিত বৈঠকে আসতেন না। তা হলেও কমিটি অচিরে বিস্তীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলো। অমল সরকার সুচতুর নম্রতা ও সৌজন্যের আদর্শ স্থাপন করে যাচ্ছেন, একদিকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা-সর্বস্ব প্রতিনিধিগণ, প্রতিপক্ষ আমরা তিন যুক্তিবাদী বিজ্ঞানবিশ্বাসী। প্রতি পদে তর্ক-বাধা দেওয়া-প্রশ্ন তোলা, যাঁরা সমস্যাটির উপর আলোকপাত করার উদ্দেশে কমিটির কাছে আলোচনার জন্য আসতেন, তাঁরা মুহূর্তে গৌণ হয়ে যেতেন, কমিটির আভ্যন্তরীণ আচরণিক-মানসিক বিভাজনই সামনে চলে আসতো। সনাতনপন্থীদের প্রতিনিধিবৃন্দ প্রথম থেকেই উগ্ৰপরমত-অসহিষ্ণু, সব সময় ধড়ে মাথা কাটছেন, অন্যদের কথা শোনবার প্রয়োজন তাঁরা ধর্তব্যের মধ্যে আনছেন না। সবচেয়ে ঝাঁঝালো পুরীর শঙ্করাচার্য মহারাজ, ধরাকে সরা জ্ঞান করেন, অন্য কে কী বললো তাতে কিছু যায় আসে না, তিনি জগদীশ্বরের সাক্ষাৎ বাণীবাহক, আদেশ করছেন, সঙ্গে-সঙ্গে মানতে হবে, বাড়তি কোনো কথা নয়, যুক্তি-ফুক্তি অপ্রয়োজনীয়-অপ্রাসঙ্গিক, এই মুহূর্তে গো-নিধন বন্ধ করতে হবে। এঁকে দেখেই স্পষ্টতম উপলব্ধি করি, ধর্মান্ধতা কী ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। আরো যা হতভম্ব করলো তা আর্যাবর্তের বোধবুদ্ধিরহিত ধর্মাপ্লুতা: শঙ্করাচার্য কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে কৃষিভবনের বর্হিদ্বারে গাড়ি থেকে নামলেন, শান্ত্রী-পুলিশের এস্ত অভিবাদন-অভ্যর্থনা, করিডোর দিয়ে জগৎগুরু সভাকক্ষের দিকে ক্রমশ এগোচ্ছেন, করণিককুল ও অন্যান্য কর্মচারীরা দু’পাশে সারিবদ্ধ দাঁড়ানো, যে-মুহূর্তে ধর্মীয় ভদ্রলোক তাঁদের পাশ দিয়ে গেলে, সমবেত সাষ্টাঙ্গ প্রণাম। জগৎগুরু সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন, অফিসারবৃন্দ সশ্রদ্ধ সম্ভ্রমে সঙ্গে-সঙ্গে দণ্ডায়মান, তিনি যতক্ষণ ব্যাঘ্রছাল পেতে আসন গ্রহণ না করছেন, তাঁরা দণ্ডায়মানই আছে; তাঁর প্রতিটি বাগাড়ম্বর তাঁদের কাছে দৈববাণীস্বরূপ।
রমাপ্রসাদবাবুও সমান সরব। আচারে তিনি বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ, হয় স্ব-পাক, নয় গৃহিণীর রান্নার বাইরে তাঁর রুচি নেই। তখন অল্প বয়স আমাদের, উদ্ভট-মতামতসম্পন্ন প্রবীণদের একটু-আধটু চিমটি কেটে মজা পেতাম। আশুতোষের জ্যেষ্ঠ তনয় এমনিতে অত্যন্ত স্নেহশীল, প্রায়ই মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতেন, কিন্তু তাতে কী, কমিটির বৈঠক চলাকালীন তাঁর গো-ভক্তি-মদির উচ্ছ্বাসের প্রাবল্য নিরীক্ষণ করে পাশ থেকে একটি-দুটি কুটনি কাটতাম, যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হতেন, তাঁর একদা-ছাত্র আমার শ্বশুর মহাশয়ের কাছে। নালিশ জানিয়েছিলেন, ‘তোমার জামাতা বাবাজীবন প্রতিভাবান, কিন্তু অতিশয় দুর্বিনীত।’
যেটা কারো-কারো কাছে মস্ত আশ্চর্য মনে হবে, যদিও এটা সর্ববিদিত গুরু গোলওয়ালকর গো-হত্যা প্রতিরোধ আন্দোলনের পালের গোদা, কমিটির সভাগুলিতে প্রায় পুরোটা সময়ই তিনি নিঃশব্দ থাকতেন, তাঁর শিষ্যসামন্তরাই তো দিব্যি কার্য সমাধা করেছে, তিনি স্বয়ং কেন অপ্রয়োজনীয় অসি ঘোরাবেন। ক্ষুরধার বুদ্ধি, সুবিনয়ী, মৃদুভাষী, অন্তত চোদ্দো-পনেরোটা ভাষা জানেন, আমার সঙ্গে সর্বসময় সুপরিচ্ছন্ন বাংলায় কথা বলতেন।
তবে হাড়-মাস জ্বালাতে জগৎগুরু একাই একশো। আমরা মনস্থ করলাম, ওঁকে লক্ষ্য করে আমাদের তীর ছুঁড়বো, নানা ছুতোয় ওঁকে ক্ষেপিয়ে তুলে প্রচণ্ড মানসিক অস্থৈর্যের মধ্যে ফেলবো। গুজরাটে কুরিয়েন-প্রতিষ্ঠিত আনন্দ দুগ্ধ প্রকল্পের সব-কিছু ঘুরে দেখতে গোটা কমিটির সফর। জগৎগুরু পনির খেতে খুব পছন্দ করেন, এই সমাচার শোনা-মাত্র কুরিয়েন আমূলে-প্রস্তুত কুড়ি-পঁচিশ বাক্সো পনির গুরুজীর ঘরে পাঠিয়ে দিলেন, জগৎগুরু মহা খুশি। পরদিন আলোচনার ছলে হঠাৎই যেন কুরিয়েনের জ্ঞানদায়ী মন্তব্য: আমূলে উৎপাদিত পনিরে নধর বাছুরের পঞ্চম না সপ্তম পাকস্থলীস্থ চর্বি ব্যবহৃত হয়। শুনে। জগৎগুরু মহলে ত্রাস; আমাদের, বলা বাহুল্য, উল্লাস।
কমিটির কাজ শেষই হচ্ছে না, সাধু সমাজের সর্বাধিনায়কেরা ক্রমশ অধিকতর অধৈর্য, ইতিমধ্যে ইন্দিরা গান্ধি তাঁর গদি অনেকটা সামলে নিয়েছেন, গো-বলয়ের আস্ফালনে আর ততটা উদ্বিগ্ন নন, তিনিও আর তেমন গা করছেন না, তিতিবিরক্ত হয়ে একটা সময়ে ভারত সাধু সমাজের তিনি বাঘা প্রতিনিধি কমিটি থেকে বেরিয়ে গেলেন, কমিটির নিশ্চিন্ত অপমৃত্যু ঘটলো, সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, সবাই, অর্থাৎ সনাতনপন্থীরা ছাড়া অন্য সবাই।
এই বিচিত্র কাহিনীরও একটি বিচিত্ৰতর উপসংহার আছে। কয়েক মাস বাদে ট্রেনে করে ভূপাল না ঝাঁসি কোথায় যাচ্ছি, আবিষ্কার করলাম একই কামরায় আমার সহযাত্রী গুরু গোলওয়ালকর। গোলওয়ালকরের সৌজন্যপ্রকাশে কোনো ঘাটতি নেই, পরস্পরে কোলাকুলি হলো, এক কাঁড়ি গল্পগুজব। ট্রেনের গতি যখন বাড়লো, দু’জনেই ব্যাগ থেকে বই বের করে নিয়ে পড়তে মনোনিবেশ করলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো, গোলওয়ালকর পড়ছেন হেনরী মিলারের একটি রসালো উপন্যাস। মেলানো যায় না, কিছুতেই মেলাননা যায় না; দেশকে প্রতিক্রিয়ার গভীরতম গহ্বরে বিসর্জনের উদ্যোগে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনিই অবসর সময় হেনরী মিলার চেখে-চেখে পড়ছেন, রহস্যময় দুর্জ্ঞেয় ভারতবর্ষ