আট
দিল্লিতে নতুন-নতুন মানুষজনের সঙ্গে আলাপ। ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতে ক্রমে-ক্রমে সামান্য দুরস্ত হলাম। স্থানীয় ছাত্র ফেডারেশনেরও ঘনিষ্ঠ হওয়া গেল। প্রতি সন্ধ্যাতেই কোনও-না-কোনও বক্তৃতা বা বিতর্ক বা সংগীতের অনুষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাঙ্গণে-ওই প্রাঙ্গণে, অথবা দিল্লির কোনও কলেজে। অনেক মিশ্র আচ্ছা; আড্ডা দিচ্ছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি, সর্ব অর্থে সাবালক হচ্ছি, প্রতি রবিবার সকালে কনৌট প্লেসে গিয়ে প্রচুর বিদেশী সিনেমা দেখছি।
সময় কাটছে বিবিধ প্রসঙ্গে, কিন্তু কাজের কাজ গবেষণা কিছুই এগোচ্ছে না। অথচ রাও মহাশয় আমাকে নিযুক্তিপত্রেই লিখেছিলেন, যেহেতু আমি অমিয় দাশগুপ্তের পেয়ারের ছাত্র, আমার গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি স্বয়ং পরামর্শদাতা হবেন। কী নিয়ে গবেষণা করবো খেটে-খুটে তার একটি দশ পৃষ্ঠার চুম্বক তৈরি করে তাঁর কাছে দাখিল করে অপেক্ষায় থাকি, খোদ পরামর্শদাতাকে অথচ আর ধরতে পারি না। সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বছরই বুঝি গড়িয়ে যায়, তিনি রাজকার্যে ব্যাপৃত, নয়তো স্কুলের জন্য হন্যে হয়ে এই তল্লাট-ওই তল্লাট থেকে অর্থ সংগ্রহ করছেন। সাত-আট মাস প্রতীক্ষার পর একদিন ওঁকে অবশেষে ধরা গেল। ঘরে ঢুকে সবিনয়ে নিবেদন করলাম, ‘আপনার দফতরে আমার গবেষণা-চুম্বকটি মাস কয়েক আগে রেখে গিয়েছিলাম, আপনি দয়া করে পড়ে উঠতে পেরেছেন কি? যদি পড়ে থাকেন, তা হলে আপনার মতামত জানতে পেলে উপকৃত হবো’। শুনে রাও সাহেব মহাকুপিত। গলা উঁচু পর্দায় চড়িয়ে বললেন, ‘অশোক, আমার বদ্ধমূল ধারণা আমার বন্ধু দাশগুপ্তর কাছে তুমি ঠিকমতো অনুশীলন পাওনি, তোমাকে দাশগুপ্ত বড্ড বেশি আদুরে করে তুলেছে। গবেষণা মানে নিজে চিন্তা করবে, চিন্তা করে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করবে, সে-সব নিয়ে বিস্তৃত সিদ্ধান্তে পৌঁছে নিজের উপর নির্ভর করে লিখবে, অথচ সে-সব কিছু না করে তুমি আমার কাছে এসে ঘ্যানর-ঘ্যানর করছো। আমি দুঃখিত’। গোস্তাকি মাফ করতে হয় বলে আমার পড়ি-কি-মরি প্রস্থান।
পরিমলবাবুকে গিয়ে সবিস্তারে জানালাম। বরাবরের মতো ওঁর মুচকি হাসি, সেই সঙ্গে আড্ডার বিভঙ্গে উক্তি, ‘দিল্লি এসেছো, লাড্ডুটা খেয়েছো, এবার আরাম করে পস্তাও’। যে-কয় মাস দিল্লিতে ছিলাম, আমার প্রধান প্রস্থানই ছিল পরিমলবাবুর মেটকাফ হাউসের বাড়ির নিয়মিত রবিবাসরীয় আড্ডায়। নিটোল বাঙালি আড্ডা। নীরদচন্দ্র চৌধুরী অবশ্য আসতেন না, তিনি সাহেবসুবো বাদে কারও বাড়িতেই পদধূলি দিতেন না। যাঁরা আসতেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা মনে পড়ছে। আসতেন বিনয়েন্দ্রমোহন চৌধুরী, সাহিত্যরসিক, ‘কবিতা’ পত্রিকায় একবার বাংলা ছন্দ নিয়ে একটি চিত্তাকর্ষক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, পেশায় সরকারি চাকুরে, বেতার বিভাগে। আর আসতেন দিল্লি পলিটেকনিকে ইংরেজির অধ্যাপক দিলীপ সান্যাল: একদা বোধ হয় ‘শনিবারের চিঠি’-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরে কলকাতা থেকে কিছুদিন ‘সমসাময়িক’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দিলীপবাবু কথা বলতেন, অফুরন্ত কথা, বিভিন্ন বিষয়ে কথা, তবে শুনতে খারাপ লাগতো না, এলেম ছিল বলার ধরনধারণে, বিষয়বস্তুতে আকর্ষণও ছিল। আর একজন ছিলেন, তখনও তরুণ অধ্যাপক, কলকাতারই ছাত্র। তিনিও সমানে কথা বলে যেতেন, অন্য কাউকে সুযোগ না দিয়ে। মুশকিল হলো, তাঁর বচনে সমস্ত জায়গা জুড়ে আমিত্ব, খানিকবাদে একঘেয়ে ঠেকতো, অন্যদের যে বিরক্তি উৎপাদন হচ্ছে, তা বোঝবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। এখন তিনি অগ্রগামী বার্ধক্যে; অবসর জীবনে কথা বলার সুযোগ কমে গেছে বলেই হয়তো এখানে-ওখানে অজস্র লিখে যাচ্ছেন। একটি ব্যাপারে তাঁর চরিত্র অনড়: অন্যদের যে বিরক্তি উৎপাদন করছেন, উপলব্ধি করার ক্ষমতা এখনও তাঁর নেই।
আর যাঁরা পরিমলবাবুর আড্ডায় নিয়মিত হাজির, তাদের মধ্যে ছিলেন খগেন্দ্রনাথ চৌধুরী, রামযশ কলেজে অর্থনীতি পড়াতেন, কিছুদিন পরিমলবাবুর বাড়িতেই ছিলেন। কোনওদিন গিয়ে যদি খগেনবাবুর খোঁজ করতাম, পরিমলবাবু ভাববিহীন মুখে বলতেন, ‘উনি সদ্য দশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠেছেন, ঘুম থেকে উঠে পদ্মাসন হয়ে আধ ঘণ্টা ধরে নিদ্রার শ্রান্তি দূর করবার জন্য একটু বিশ্রাম করছেন’। মাঝে-মাঝে আসতেন পরিমলবাবুর ছাত্র, এবং ঢাকাতে আমার কিছুদিনের মাস্টারমশাই, সমররঞ্জন সেন। তিনি তখন থেকেই বরিষ্ঠ সরকারি আমলা, পরে বরিষ্ঠতর হয়েছেন, ওরকম অতিথিবৎসল মানুষ কদাচিৎ দেখা যায়। তাঁর স্ত্রী শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রী, অনীতা সেন, সেই সুবাদে ওঁদের বাড়িতে শান্তিনিকেতন থেকে দিল্লিতে বেড়াতে-আসা অনেক গুণী শিল্পীর সংগীত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমসাময়িকা সুশীলা জুন্নরকরও তখন দিল্লিতে, ইতিমধ্যে অমলেন্দু দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিণীতা। অমলেন্দু তখন কেন্দ্রীয় তথ্য বিভাগে, না কি বৃটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে।
পরিমলবাবুর ওখানে আড্ডা দিতাম, রানিদি যত্ন করে খাওয়াতেন, কোনও এক সপ্তাহে কী কাজে বুদ্ধদেব বসু এলেন, সন্ধ্যাবেলা মেটকাফ হাউসের বাইরে যমুনাসংলগ্ন মাঠে বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে পা ছড়িয়ে আমাদের ঢাকা-কাব্য-সাহিত্য-ঘেঁষা বিশ্রম্ভালাপ। যমুনার ওপারে এবড়োখেবড়ো ঘাস, একটি-দু’টি জীবজন্তু চরছে, হঠাৎ বুদ্ধদেব উল্লসিত উৎসাহে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, ‘দ্যাখো, দ্যাখো, কী সুন্দর একটা হরিণ ঘাস চিবুচ্ছে’। পরিমল রায়, তাঁর প্রথামতো ভাববিকাররহিত, সংক্ষেপে জানালেন, ‘ওটা হরিণ নয়, বাছুর’। বুদ্ধদেব হতাশ।
বাঙালি আড্ডায় দিল্লিতে মশগুল হচ্ছি, মার্কসবাদী বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো, পৃথ্বীনাথ ধরের সঙ্গে আলাপ জমলো। শীলা বাহাদুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী, সে মাঝে-মাঝে গয়্যার হলে এসে ধর সাহেবের খোঁজ করতো, প্রেমের প্রথম পর্বের মায়াঞ্জন তাঁর দু’চোখে। বিবাহের পর শীলা সংগীতজ্ঞ হিশেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, কিন্তু পৃথ্বীনাথের গানে তেমন ভক্তি আছে বলে তখনও মনে হয়নি, এখনও মনে হয় না। তখন তাঁর কমিউনিস্ট অনুরাগের ঋতু, আমার কাছাকাছি আসার তা-ও বোধ হয় অন্যতম কারণ। একদিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন কক্ষে সভা ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে। ছাত্র ফেডারেশনের মস্ত চাঁই হরিশচন্দ্র, পরে দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছিল, বিয়ে করেছিল চীনে-পাঠানো মেডিক্যাল মিশন-খ্যাত ডক্টর অটলের কন্যাকে। ১৯৫০ সালে জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে তিব্বত নিয়ে চীন সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তি সদ্য-সদ্য সই করা হয়েছে, বামপন্থী মহলে উচ্ছ্বাস। চুক্তির সমর্থনে ছাত্র ফেডারেশন দ্বারা আহুত সভা। আমি আর পৃথ্বীনাথ ধর একসঙ্গে গেছি, পিছন দিকের আসনে বসেছি। নির্বিঘ্নে চলছিল সব কিছু, হঠাৎ সম্ভবত-জর্জ-ফার্নান্ডেজের-ভক্ত কিছু যুবক, চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সভাকক্ষে সরব। হরিশ নিজেই দক্ষতার সঙ্গে ব্যাপারটা সামলে দিচ্ছিল, কিন্তু পৃথ্বীনাথের সেটা উগ্র রুশ-চীন ভালোবাসার ঋতু। হঠাৎ আমার পাশ থেকে উঠে দাপিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘মারো বুন্ধুলোগোকো’। বহু বছর ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় না। সময় পাল্টে গেছে, কাহিনীটি মনে করিয়ে দিলে লজ্জায়-অনুশোচনায় নিশ্চয়ই লাল হয়ে উঠবেন।
রাও সাহেবের ভর্ৎসনা বিবরণ নিয়ে রঙ্গপালা শেষ হওয়ার পর পরিমল রায় পরামর্শ দিলেন, সব জানিয়ে অবিলম্বে অমিয়বাবুকে যেন চিঠি দিই। চিঠি দিলাম, অমিয়বাবু সক্রিয় হলেন। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির কেউকেটা, বিনয় দাশগুপ্ত মশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও আমার কথা জানতেন, এম এ পরীক্ষায় আমার একটি পেপার পরীক্ষা করে অতিশয় আহ্লাদিত হয়েছিলেন; তিনিও উপাচার্য নরেন্দ্র দেবকে বললেন। বিনয়বাবুর তার পেলাম: অবিলম্বে যেন বাক্সপ্যাঁটরাসুদ্ধু লখনউয়ের ট্রেনে চাপি, সোজা তাঁর বাড়িতে গিয়ে উঠি। রাও সাহেবকে না বলেই, তাঁর কাছে অনুমতি না নিয়েই, পলায়নপর হলাম, অবশ্য তিনি তখন দেশেও ছিলেন না। লখনউ পৌঁছুলাম, চারবাগ স্টেশন থেকে টঙ্গায় চেপে নতুন হায়দরাবাদ পাড়ায় বিনয়বাবুর বাড়িতে। বাড়ির বাইরের বারান্দা-সংলগ্ন অতিথি গৃহে তোফা রাত্রিবাস। পরদিন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ঘরে ইন্টারভিউ। কয়েক মিনিট গড়ালেই বুঝতে পারলাম ইন্টারভিউটি নেহাতই মামুলি, অমিয় দাশগুপ্ত মহাশয় চিঠি দিয়েছেন, ডি পি সাব প্রশংসা করেছেন, বিনয়বাবুর সুপারিশ। আচার্য নরেন্দ্র দেব, দেবতুল্য মানুষ, আগে থেকেই মনস্থির করেছেন, আমাকে একটা-দুটো স্বাস্থ্যসূচক প্রশ্ন করলেন, বাকি সময় নির্বাচন কমিটির অন্যান্যরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত রইলেন, আমি নির্বাক শ্রোতা। পরদিন কলকাতার ট্রেন ধরলাম, সুরঞ্জন ততদিনে আতোয়ার রহমানের গণেশ অ্যাভেনিউস্থ ‘চতুরঙ্গ’র ফ্ল্যাটে নিজেকে স্থানান্তরিত করেছে। আমিও ওখানে প্রশ্নহীন নিরুদ্বিগ্নতার সঙ্গে উঠলাম, পাচক-অভিভাবক-সর্বময় কর্তা আতিকুল্লা-র তৃতীয় প্রজা হিশেবে। দু’দিন বাদে লখনউ থেকে বিনয়বাবুর চিঠি, লেকচারারের পদে নিযুক্ত হয়েছি, বড়দিনের ছুটির পর কাজে যোগ দিতে হবে।
প্রায় দু’-বছর লখনউতে পরম আরামে মনের সুখে পড়ানোর কাজ করেছি। যেদিন কাজে যোগ দিতে পঞ্জাব মেল ধরে লখনউ রওনা হলাম, সেদিনও কফি হাউসে সন্ধ্যা অবধি আড্ডা। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে, সম্ভবত জল খাচ্ছিলাম, জলের গ্লাস নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে হুড়মুড় করে ট্যাক্সিতে চাপা। লখনউ পৌঁছে পরদিন হজরতগঞ্জের কফি হাউসে চিঠিতে ব্যাখ্যাসহ গেলাসটি জমা দিলাম, গেলাসটি পরে ওঁরা কলকাতায় কলেজ স্কয়্যারের কফি হাউসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কিনা জানতে আমার বিবেক পীড়িত হয়নি কখনোও।
লখনউ নিয়ে প্রগল্ভ হওয়ার আগে একটি অন্তিম দিল্লিকাহিনীর বিবৃতি সেরে নিই। আমলা শহর দিল্লি, কিন্তু তখন থেকেই সেই সঙ্গে বৈশ্য শহরও। এক রবিবার সকালে কনৌট প্লেস পাড়ায় সিনেমা দেখতে এসেছি, ছবি শেষ হলে সিন্ধিয়া হাউসের বাসস্টপে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। দিল্লিতে পরিবহনের হাল এমনিতেই করুণ, রবিবার আরও বেশি বেহাল। দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি বিশ্ববিদ্যালয়মুখো বাসের জন্য। প্রায় চল্লিশ মিনিট গত, বাস আর আসে না, এমন সময় একটি ঝলমলে চালো রঙের মস্ত মার্কিন গাড়ি রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়ালো, চালকই একমাত্র আরোহী, দুরস্ত পোশাক, চোখে কালো চশমা, বিশুদ্ধ ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন আমার গন্তব্য কোথায়, তিনি লিফ্ট দিতে পারেন কিনা, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে পাশে গিয়ে বসলাম, গাড়ি চললো, ধনবিজ্ঞানে গবেষণা করছি জেনে চালক জানালেন তিনি দর্শন শাস্ত্রের অনুরাগী, অস্তিত্ববাদ নিয়ে প্রচুর কিয়ের্কগার্দ-হিদেগার-সার্ত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। আলাপ জমলো, আমার মন্তব্য, তাঁর প্রতি-মন্তব্য, বুদ্ধির চর্চায় প্লাবিত হলাম। গয়্যার হলে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে তাঁকে বিদায়ী ধন্যবাদ জানাতে উদ্যত হয়েছি, হঠাৎ দার্শনিক ভদ্রলোক দ্রুত ডান হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আট আনে’।
কাশীর গেরুয়া সংস্কৃতিতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলাম এক বছর-দু’বছর আগে, প্রতিতুলনায় লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম দর্শনেই ভারি হৃদয়-জুড়োনো ঠেকলো। ক্যানিং কলেজের গথিক স্থাপত্যের নিদর্শন-ঠাসা পুরনো ঘরবাড়ি, চারপাশে অপেক্ষাকৃত নতুন অট্টালিকার সারি, বাদশাবাগে বৃক্ষনিবিড় অধ্যাপকদের কোয়ার্টারপুঞ্জ, কেয়ারি-করা ফুলের বাগান, টেনিস কোর্ট ইত্যাদি। তখনও পর্যন্ত লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ে উগ্র প্রাদেশিকতার ছোঁয়া লাগেনি, বরং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঝাঁকে-ঝাঁকে শিক্ষককুল বিশের দশক থেকেই জড়ো হয়েছিলেন বলে বেশ খানিকটা ঔদার্যের পরিমণ্ডল। বিশিষ্ট একটি মিশ্র সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়কে আচ্ছন্ন করে: একদিকে অযোধ্যার তালুকদার সম্প্রদায়ের বনেদিয়ানা, পাশাপাশি একগাদা তরুণ মার্কসবাদী শিক্ষকের চিন্তাভাবনার প্রভাব। সহবতের শহর লখনউ, হিন্দুস্থানি সংগীতচর্চার কেন্দ্রভূমি, আদবকায়দার বিচ্ছুরণে তকল্লুফের বন্যা। তার উপর, কে অস্বীকার করবে, ইসাবেলা থোবার্ন কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া অসংখ্য সুন্দরী মেয়ে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মানবিক সৌন্দর্যের চমৎকার সংশ্লেষণ। ক্যানিং কলেজ থেকে এক ফার্লং দূরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দফতরের সঙ্গে সংযোগকারী সুদৃশ্য রাস্তাটিকে অভিবাদন জানাতেই যেন, দীর্ঘ জম্বুপুঞ্জ; যতবার হেঁটে গেছি, বারবার রবীন্দ্রনাথের চরণখণ্ড, ‘জম্বপুঞ্জে নীল বনান্ত’, মনে ধাক্কা দিয়েছে।
সমাজতন্ত্রে গভীর বিশ্বাসী জননায়ক নরেন্দ্র দেব মহাশয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তাঁর অদৃশ্য কিন্তু অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ-ইঙ্গিতের প্রসাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ মিত্রতা-মদির তথাচ অভিনব। অভিজাত, কিন্তু সব কিছু তবু অতি সহজা-সচ্ছল। আরও যা বলতে হয়, একা ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সংস্কৃত করতে, উন্নত করতে, শাণিত করতে যথেষ্ট। লখনউ জুড়ে ডিপি সাহেবের খ্যাতি। আমার এক বন্ধু কলকাতা থেকে একবার চিঠি পাঠিয়েছিলেন, ‘অশোক মিত্র, প্রযত্নে ডি পি, উত্তর ভারত’। সেই চিঠি বেপাত্তা হয়নি, নিশানা ভুল করেনি, কারণ ডাক বিভাগেও ধূর্জটিপ্রসাদের অনেক ছাত্র, শিষ্য ও ভক্ত। আমি যখন হাজির হলাম, রাধাকুমুদ-রাধাকমল মুখোপাধ্যায় এই দুই বিশ্রুত মনীষী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। তবে রাধাকমল তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাংলোতে থাকছেন, প্রতি সকালে তাঁর বাসগৃহে গবেষক-ছাত্রদের ভিড়। অন্যান্য বাঙালি অধ্যাপকরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ আলো করে আছেন: ইতিহাসে কালিকারঞ্জন কানুনগো ও শৈলেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, যিনি ক্ষিতিমোহন সেনের মধ্যম জামাতা; দর্শন শাস্ত্রে সম্মানিত অধ্যাপক প্রবাদপ্রতিম সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এবং তাঁর স্ত্রী সুরমা দাশগুপ্ত; রসায়নে অবিনাশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এ.সি চ্যাটার্জি নামে সমধিক পরিচিত, সেই ধ্যানচাঁদের আমল থেকে এক নাগাড়ে প্রায় তিরিশ বছর ভারতীয় হকি ফেডারেশনের কর্ণধার। অবশ্যই উল্লেখ্য ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত, যাঁর স্ত্রী চিত্রলেখা সিদ্ধান্ত প্রথম যুগের রবীন্দ্রসংগীত গায়িকাদের মধ্যে অগ্রগণ্যা। তা ছাড়া নৃতত্ব বিভাগে ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার, কথায়-বার্তায় সামান্য হাম্বড়া, কিন্তু কৃতী পুরুষ। এত বছরের ব্যবধানে অন্য অনেক নাম ভুলে গেছি। ঈষৎ মনে পড়ছে আর একজনের কথা, বোধহয় অর্থনীতি বিভাগের, ভুজঙ্গভূষণ মুখোপাধ্যায়। বাণিজ্য বিভাগে বিনয়েন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মহাশয় তো প্রায় সম্রাট হিশেবেই বিরাজ করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অখণ্ড প্রতিপত্তি। সবশেষে ঈষৎ সন্তর্পণে আর একজনের কথা বলি, ধনবিজ্ঞানী, বাণিজ্য বিভাগে আমার সহকর্মী ছিলেন, ভূপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, খুব কম মানুষই তাঁকে এখন চিনবেন, তিনি সিগনেট প্রেসের নীলিমা দেবীর প্রথম স্বামী। ভূপেনবাবুর দ্বিতীয় বিবাহও সুখের হয়নি। সজ্জন, চাপা মানুষ, লোকেরা তাঁকে কৃপা করে, এই প্রতীতির ফলে আরও কুঁকড়ে থাকতেন।
সুরেন দাশগুপ্ত মশাই তখন খুবই অসুস্থ, বাড়ি থেকে বেরোতে পারতেন না, সুরমাদিকে পড়াতে যেতে হতো, আমি অনেক সময় পরমজ্ঞানী দার্শনিককে সঙ্গ দান করে আসতাম। দু’জনেই স্নেহ করতেন প্রচুর, ছেলেমানুষ আমার সঙ্গে প্রায় কৌতুকবিনিময়ের সম্পর্ক। দাশগুপ্ত মশাই মাঝে-মাঝে রঙ্গ করতে বলতেন, যদি বদ্যি মেয়ে বিয়ে করতে চাই, ওঁকে যেন বলি, ওঁর জানা অনেক ভালো-ভালো মেয়ে আছে।
লেকচারার হিশেবে মাসে তিনশো পঁচিশ টাকা মাইনে পেতাম, খরচ করে ওঠা যেতো না। লখনউতে পৌঁছে প্রথম দু’-একমাস নিউ হস্টেলে ছিলাম। নির্মল সিদ্ধান্ত মহাশয় দিল্লিতে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হয়ে গেলেন; শ্রীমতী সিদ্ধান্তও সঙ্গে গেলেন। তাঁদের মেয়ে রঞ্জনা—অপু—মার্কিন দেশে পি-এইচ ডি. করছে, ছেলে কলকাতায় চাকুরিরত। সিদ্ধান্ত মহাশয়ের বাদশাবাগের বাড়ি খালি পড়ে আছে, অথচ ব্যবস্থাপনার জন্য লোকজনের অভাব নেই। ধূর্জটিবাবু আমার জন্য ওই বাড়ির একটি অংশে থাকবার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি, আর সদ্য কেমব্রিজ থেকে পি.এইচডি. করে ফেরা, কেন্দ্রীয় ড্রাগ রিসার্চ গবেষণাগারে ক’দিন আগে যোগ দেওয়া, সুভদ্র, অতি চমৎকার দেখতে নিত্যানন্দ, আমরা দু’জন সিদ্ধান্ত-নিলয়ে বিনিপয়সার তালুকদার হয়ে রইলাম। যে-অংশটিতে আমি থাকতাম তার একটি ঘরে আলমারি-বোঝাই শার্লক হোমস ও আগাথা ক্রিস্টি; রাত জেগে এক-একটি আগাথা ক্রিস্টি কাহিনী নিয়ম করে নিধন করতাম।
বি.এ-বি.কম ক্লাসে হিন্দিতে পড়ানোর রেওয়াজ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তাতে আমার সুবিধাই, রাজভাষা যেহেতু জানি না, লেকচারের দায়ভার সপ্তাহে মাত্র দশটি, পাঁচদিন করে প্রতিদিন দু’টি পিরিয়ড। সাড়ে ন’টায় শুরু হয়ে সাড়ে এগারোটায় আমার দিনের পালা সমাপ্ত হতো, কিংবা মধ্যিখানে এক ঘণ্টার বিরতি দিয়ে সাড়ে বারোটায়। তারপর থেকে নিচ্ছিদ্র নিশ্চিন্ত অবসর। অবশ্য, কয়েক মাস গত হলে, ধূর্জটিবাবু মাঝে-মাঝে তাঁর ক্লাসে আমাকে দিয়ে বক্তৃতা দেওয়াবার ব্যবস্থা করেছিলেন। একবার একাদিক্রমে দুই সপ্তাহ ধরে কেইনস সাহেবের সাধারণ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছিলাম; ধূর্জটিবাবু ছোট্ট করে বলেছিলেন, ‘ছেলেরা তারিফ করেছে’।
বাচ্চা ছেলে হলেও ভালোই পড়াতে পারছি জেনে নরেন্দ্র দেব মহাশয়ও বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। কখনো-কখনো ছুটির দিনে আমাকে বাসস্থান থেকে তুলে নিয়ে কফি হাউসে যেতেন, আমার উগ্র বামপন্থী কথাবার্তা একটু প্রশ্রয়ের সঙ্গেই শুনতেন। সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওঁর লেখা একটি হিন্দি প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করে ‘চতুরঙ্গ’-এ ছাপিয়েছিলাম, খুশি হয়েছিলেন খুব। মাত্র একদিনই আমাকে মৃদু ভর্ৎসনা করেছিলেন। কলকাতা সে-সময় ক্রমশ অগ্নিগর্ভ, কংগ্রেস-বিরোধী মনোভাব সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। ছ’-সাত বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে, অভিভাবকের সঙ্গে ট্রামে যাচ্ছে, হাতে খেলনা পিস্তল ঘুরে-ঘুরে তাগ করে যাত্রীদের বলছে, ‘কংগ্রেসকে যদি ভোট দাও, তোমাকে গুলি করে মারবো’। আমি ঈষৎ শ্লাঘার সঙ্গে নরেন্দ্র দেব মশাইকে কাহিনীটি বলতেই ওঁর মুখ গম্ভীর, তারপর ছোটো মন্তব্য: ‘তোমরা হিংসার বাতাবরণ আমদানি করছো, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যে সর্বনাশ হবে তা চিন্তা করছো না’। আমার হয়তো কিছু বলবার ছিল, কিন্তু সম্মানীয় মানুষ, নিরুত্তরই রইলাম।
সিদ্ধান্ত মহাশয়ের বাড়িতে আমাদের কয়েকমাস থাকার পর অপু আমেরিকা থেকে ফিরে এলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে কাজ শুরু করলো, আমি অন্যত্র সরে গেলাম। বিনয়বাবুই দুই বিচিত্র ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন: শ্যামকিষেণ কিচলু ও গামাণ্ডিমল বান্টিয়া। শ্যামকিষেণ কাশ্মিরি, গামান্ডিমল রাজস্থানী। কিন্তু তাঁদের সেই পরিচয় উহ্য। দু’জনেই বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাসময় থেকে সদস্য, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্ধ ভক্ত। এই দুই বাউণ্ডুলে বন্ধু কী করে যেন ম্যাল অ্যাভিনিউর অতি অভিজাত পাড়ায় করাচিতে-চলে-যাওয়া কোনও মুসলমান তালুকদারের বিরাট বাগানঘেরা প্রাসাদের দোতলাটি দখল করে ছিলেন, একতলা পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা এক সিন্ধি পরিবার ভোগ করেছিলেন। শ্যামকিষেণরা তাঁদের দখলদারি থেকে একটি বড়ো আয়তনের আলোকোজ্জ্বল ঘর ও সংলগ্ন তকতকে বাথরুম আমাকে ভাড়া, কিংবা উপভাড়া, দিলেন, মাসিক দক্ষিণা পঞ্চাশ টাকা। আহা, সে ভারি সুখের সময় ছিল। প্রতিদিন সকালে কফি হাউসে প্রাতরাশ সেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে, সাড়ে এগারোটা নয়তো সাড়ে বারোটার মধ্যে পড়ানো শেষ, হেঁটে হজরতগঞ্জে পৌঁছনো, সেখানে ‘রঞ্জনা’ নামে এক রেস্তোরাঁয় দুপুর-রাত্রি দু’বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা, এখানেও মাসে পঞ্চাশ টাকা দেয়। মিচকে লোকে বলতো, রেস্তোরাঁটির নামকরণের প্রেরণা নাকি জুগিয়েছিল স্বয়ং অপু, অর্থাৎ সিদ্ধান্ত-তনয়া রঞ্জনা। দুপুরে আহার সেরে ম্যাল অ্যাভিনিউর ঘরে ফিরে যাওয়া। মাঝে-মাঝে একতলার সিন্ধি পরিবারের তিনটি তরুণী কন্যা, যৌবনযন্ত্রণায় দীর্ণ, একটু-আধটু উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করতো। তাদের এড়িয়ে দোতলায় নিজের ঘরে, নিদ্রা কিংবা বই পড়া। বিকেল যখন সন্ধ্যার দিকে গড়িয়ে যেত, হজরতগঞ্জের কফিহাউসের দিকে পুনঃপ্রস্থান।
কফি হাউস সরগরম। ধূর্জটিপ্রসাদ তো এসেইছেন, অধ্যাপকবৃন্দের একটি বড়ো অংশও। সংগীত নিয়ে আলোচনা, মেটাফিজিক্স কি সাংখ্য দর্শন, অথবা অর্থনীতি-রাজনীতি, বিশেষ করে সমাজতন্ত্র ও কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে কচকচানি, কারণ রামমনোহর লোহিয়াও পৌঁছে গেছেন, আচার্য নরেন্দ্র দেব তো একটু আগে থেকেই ছিলেন। এক কোণে তাঁর নিজের দলবল নিয়ে ফিরোজ গান্ধি, পরে লোকসভায় অত্যন্ত সরব হলেও কফি হাউসে তত মুখর হতেন না, অন্যদের আলাপচারিতা শুনতেন। নৃতত্ত্ব বিভাগের ধীরেন মজুমদার মহাশয়, ঢাকাই বাঙাল, ঠোঁটকাটা। একদিন ফিরোজ আমাদের টেবিলের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, ধীরেনবাবু উচ্চস্বরে বললেন, ‘এই নির্বাক লোকটা আড়াই লক্ষ ভোটে শাজাহানপুর থেকে জিতেছে। যদি জিতে না-ও থাকে, শিগগিরই জিতবে, নেহরু-মাহাত্ম্য, ভারতীয় গণতন্ত্র’।
কফি হাউসের আড্ডা ছুটির দিনেও সমান জমাট। অনেকের সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা জাইন আহমেদও জড়ো হতেন, কখনও-সখনও লখনউ বেড়াতে-আসা অরুণা আসফ আলি, কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে হবো-হবো করছেন। বিশেষ একজনের কথা উল্লেখ না করা অন্যায় হবে: অর্থনীতি বিভাগে আমার সতীর্থ, বীরবাহাদুর সিংহ। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাসমারোহে ‘মার্কস ক্লাব’ পরিচালনা করতো। প্রতি বছর মাত্র একটি সভা বসতো, বিষয়, মার্কসবাদের তাৎপর্য। শুরুতেই শেষ, এলিয়ট সাহেব তো বলেই গেছেন সেটাই নিয়তি, সারা বছর ‘মার্কস ক্লাব’ আর একবারও মিলিত হতো না।
কয়েকমাস বাদে বিনয় দাশগুপ্ত মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র পরিমল, ডাক নাম অংশু, প্যারিস থেকে ফিরলো, সরবোন-এর ডিগ্রি-সমেত, ইতিহাসে মস্ত পণ্ডিত। বিনয়বাবুর খুশি উপচে পড়ে, অংশুর জন্য বাড়ির প্রাঙ্গণে আলাদা সুইট তৈরি করে দিলেন, আমাদের অবারিত আড্ডার আর একটি জায়গা হলো। তবে পৃথিবীতে বোধহয় অবিমিশ্র সুখ বলে কিছু নেই। অংশুর সঙ্গে পরিচয় ও আড্ডা দেওয়ার কল্যাণে আমাদের কয়েকজনের প্রায়ই ওই বাড়িতে নৈশাহারের নিমন্ত্রণ থাকতো। মুশকিল দেখা দিল বেশি রাত হলে আহারান্তে অংশু প্রায়ই বলতো, ‘চলো, তোমাদের ছেড়ে দিয়ে আসি’। প্রমাদ গুণতাম আমরা, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাড়া থেকে গোমতী নদী পেরিয়ে পুরনো শহরে ঢোকবার মুখে মাঙ্কি ব্রিজের উপর অংশুর ঝরঝরে ফোর্ড গাড়ি অবধারিত বন্ধ হয়ে যেতো, ভরা পেটে সেই গাড়ি অতঃপর আমাদের চড়াইতে ঠেলতে হতো। একটা সময় এলো, ওর নৈশাহারের নিমন্ত্রণ আমরা সভয়ে, কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে, প্রত্যাখ্যান করতে লাগলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলের বাইরে নতুন হায়দরাবাদ পাড়া, অভিজাত বাঙালি বসতি। ওখানে তখন বাড়ি করেছিলেন অসিতকুমার হালদার। সরকারি কলাভবনে ছিলেন বীরেশ্বর সেন। পুরনো বিপ্লবী স্বদেশী নেতা কানাইলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ওখানে পরিচয়, তাঁর কন্যাদ্বয় গীতা ঘটক ও রীতা গঙ্গোপাধ্যায় বর্তমানে সংগীতজগতে বিখ্যাত, অবশ্য তখন তারা নেহাত বালিকা। বিনয় দাশগুপ্ত আমিনাবাদে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন পাহাড়ী সান্যালের অগ্রজ ধীরেন সান্যালের সঙ্গে, ভাইয়ের মতোই স্নেহোচ্ছল, অতিথিবৎসল; যতবার ওঁর কাছে গেছি, গভীর তৃপ্তি নিয়ে ফিরেছি।
তবে ধূর্জটিপ্রসাদের বাড়ির আড্ডাই লখনউতে পরমতম আকর্ষণ। ধূর্জটিবাবুর বাকচাতুর্যের তুলনা নেই। ইংরেজিতে বলছেন, বিশুদ্ধ হিন্দুস্থানিতে বলছেন, শান্তিপুরি সুসংস্কৃত বাংলায় বলছেন। খেয়ালি মানুষ, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাচ্ছেন, অর্থনীতি থেকে দর্শনে, দর্শন থেকে ইতিহাসে, ইতিহাস থেকে সমাজতত্ত্বে, সমাজতত্ত্ব থেকে ব্যাকরণতত্ত্বে, পাণিনি বিশ্লেষণে, অতঃপর উদয়শঙ্কর প্রসঙ্গ উঠতে নৃত্যচর্চা, পরমুহূর্তে শিশির ভাদুড়ীতে পৌঁছে গেছেন। আবর্তের মতো ঘুরে-ঘুরে আসতো কথার তোড়, গল্পের তোড়, চিমটি কাটার তোড়। আমাদের প্রায় সমবয়সী, রাম আদবানি নামে একটি ছেলে, হজরতগঞ্জে একটি সুশোভন বইয়ের দোকান খুলেছিল। কফি হাউসে ঢোকবার আগে বা পরে আমরা প্রত্যেকেই ওর দোকানে ঢুঁ মারতাম, বিদেশ-থেকে-আসা টাটকা বইয়ের সম্ভার, যথাসাধ্য কিনতাম। ধূর্জটিবাবুর বাড়িতে রাম টাঙ্গা বোঝাই করে বই পাঠিয়ে দিত ওঁর বাছাইয়ের জন্য। ধূর্জটিবাবু প্রতি সপ্তাহে টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট ও এডুকেশনাল সাপ্লিমেন্ট রাখতেন; যে কোনও হালের বইয়ের কথা তাঁর ঠোঁটের ডগায়, সিগারেট যেমন।
অনেকের সম্পর্কে অনেক গল্প শুনিয়েছেন তিনি, নিদর্শন হিশেবে মাত্র দু’টির উল্লেখ করবো। ঘোর ব্রাহ্ম হেরম্ব মৈত্র, কলেজ স্ট্রিট থেকে পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফিরবেন, বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। কোনও বাসই তাঁর পছন্দ হয় না: কোনও বাসের নাম শিব, কারও দুর্গা, কারও সরস্বতী, অন্য কারও বা পার্বতী। অবশেষে রাত যখন ন’টা ছুঁই-ছুঁই, একটি বাস এলো, ‘সত্যনারায়ণ’। হেরম্ববাবু উঠে চালকের পাশে গিয়ে বসলেন, সত্য রক্ষা হলো। অপর এক গল্প। লখনউবাসী এক বাঙালি ব্যারিস্টার, ঘোর সাহেবিভাপাপন্ন, নাম এইচ. কে, ঘোষ, লোকেরা জনান্তিকে বলতো হেঁচকি ঘোষ। অতুলপ্রসাদ সেনের প্রয়াণ দিবস, শোকে-মুহ্যমান হেঁচকি ঘোষ হাঁক পাড়লেন, ‘বেয়ারা, মেরা রোনেকা কুর্তা লাও।’
ধূর্জটিপ্রসাদের বাড়িতে যখন আড্ডা বসতো, ছায়ামাসি প্রতি আধঘণ্টা অন্তর কফি সন্দেশ-সহ পাঠাতেন, নিজের হাতে বানানো সন্দেশ। ধূর্জটিবাবুর আড্ডায় আমরা এমন কি দোহার গাইবারও ঠিক সুযোগ পেতাম না, তিনি একাই একশো। কফি হাউসে যাঁরা যেতেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে ধূর্জটিপ্রসাদের বাড়িতেও উপস্থিত। আড্ডার নেশা, কিংবা ধূর্জটিপ্রসাদের কণ্ঠবৈভবের মায়ামুগ্ধতা, কিছুতেই ছাড়বার নয়। অন্য যে-দু’জন নিয়মিত আসতেন, আগে উল্লেখ করিনি, তাঁরা নবেন্দু বসু ও গিরিন চাটুয্যে। নবেন্দুবাবু বৃত্তিতে হাওয়াবিদ, লখনউর বনেদি মানুষ, শহরের পুরনো কাহিনী তাঁর চেয়ে বেশি কেউ জানতেন না। ‘প্রবাসী’-‘ভারতবর্ষ’-‘বিচিত্রা’-য় প্রচুর লিখেছেন, পরবর্তী সময়ে আমি অন্তত একবার তাঁকে দিয়ে ‘চতুরঙ্গ’-এ একটি প্রবন্ধ লেখাতে সফল হয়েছিলাম: লিখেছিলেন লা মার্টিনিয়ারের প্রতিষ্ঠাতা ক্লদ মার্তাঁ-কে নিয়ে।
গিরিন চাটুয্যে নিশ্চয়ই আর বেঁচে নেই, লখনউ সেক্রেটারিয়েটে কাজ করতেন, স্মিত চেহারা, ঠোঁটে সব সময় অর্ধস্ফুট হাসি৷ মুখে শৌখিন পাইপ, একটিও কথা বলতেন না, শুধু মাঝে-মাঝে পাইপটি মুখ থেকে নামিয়ে ঈষৎ ঘাড় নাড়তেন, তাতেই ভয়ংকর বুদ্ধিজীবী হিশেবে লখনউ জুড়ে তাঁর খ্যাতি।
ধূর্জটিপ্রসাদ ও ছায়ামাসি স্নেহ উজাড় করে দিয়েছিলেন আমার উপর। ছায়ামাসি প্রায়ই খেতে বলতেন, অবশ্য বাদশাবাগ পাড়ার অন্য মহিলারাও বলতেন, ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা লাবুদি কিংবা ধীরেন মজুমদারের সহধর্মিণী মাধুরীদি। অবিবাহিত আপাতঅসহায়-দেখতে বাঙালি যুবক, প্রচুর অনুকম্পা কুড়োতাম। তা হলেও আলাদা করে ছায়ামাসির স্নেহবর্ষণের কথা বলতেই হয়। তিনি চমৎকার কবিতা লিখতেন, একসময় ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছে। কিন্তু ধূর্জটিপ্রসাদের পরিচর্যায় নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। অতি আস্তে কথা বলতেন, বাঙালি আভিজাত্যের বিচ্ছুরণ তাঁর বাক্যরাজিতে। লখনউর সময় থেকে শুরু করে, পুরো পঞ্চাশ বছর, তাঁর ভালোবাসা-স্নেহাশীর্বাদ কুড়িয়েছি: এই সৌভাগ্যের তুলনা নেই।
লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি স্বভাবতই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর, ওখানে ফিরে যাওয়ার আগ্রহও আর তেমন কোনওদিন হয়নি। কিন্তু এটা তো স্বীকার না-করে পারি না, পড়াতে শিখেছিলাম ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে-নিতে, কোনও ছাত্র অতর্কিত একটি প্রশ্ন করলো, যার সে-মুহূর্তে উত্তর জোগাতে পারিনি; ওই অক্ষমতার পীড়নে ভাবতে শিখলাম, ভাবতে-ভাবতে বিষয়টির গহনে যেতে শিখলাম; পড়ানোও ক্রমে-ক্রমে স্বচ্ছন্দ ও সুখকর হয়ে এলো। তবে অর্থশাস্ত্র যে-গতিতে গত অর্ধশতাব্দীতে এগিয়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ধৈর্য বা সামর্থ্য আমার কোনওদিনই ছিল না। সুতরাং একটি বিশেষ ক্ষণে অর্থনীতিচর্চা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছি। এক ধরনের দ্বান্দ্বিকতা এখানে। পড়াতে ভালো লাগে, অথচ যা পড়াতে হবে সে বিষয়ে আমার সম্যক জ্ঞান নেই, সুতরাং নিষ্ক্রমণ বিধেয়। অর্থনীতির বৃত্ত থেকে বিদায় নেওয়ার ফলে আমার মনে কোনও শোকতাপ নেই, যা অবধারিত তাই-ই ঘটেছে। অবশ্য লখনউতে যে দু’-বছর ছিলাম, একটু-আধটু দুরাশা সম্ভবত ছিল, ধনবিজ্ঞানে রপ্ত হবো, বই লিখবো, নাম কুড়বো। গণিত চর্চার অভ্যাসে তখনও পুরো মরচে পড়ে যায়নি। বাবা পদার্থবিদ, মা-ও গণিতশাস্ত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ: কিছুটা বংশগত ধারাবাহিকতায় আস্থা পোষণ তেমন অযৌক্তিক ছিল না। অর্থনীতির সঙ্গে গণিত মিশিয়ে নতুন একটি বিজ্ঞান সবেমাত্র শুরু হয়েছে। গাণিতিক পরিভাষায় অর্থনীতির তত্ত্ব প্রথমে ব্যক্ত করতে হবে, তারপর সেই তত্ত্বের সূত্র ধরে কোনও সম্পাদ্য গঠন করতে হবে; সেই সম্পাদ্য তথ্যযুক্ত কিনা তা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করবার জন্য পরবর্তী পর্যায়ে সংখ্যাবিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে হবে। উল্লিখিত তিনটি ধাপ মিলিয়ে ইকনোমেট্রিক্স। এই বিদ্যায় প্রভূত কৃতিত্ব সে সময় অর্জন করেছিলেন ইয়ান টিনবার্গেন নামক এক ওলন্দাজ অর্থনীতিবিদ। সুপণ্ডিত পদার্থবিজ্ঞানী, সেখান থেকে অর্থশাস্ত্রে তাঁর প্রব্রজ্যা, বিশের-তিরিশের দশকের আর্থিক মন্দার বিশ্লেষণে ইকনোমেট্রিক্স প্রয়োগ করে তিনি ধনবিজ্ঞানকে নবতর স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন, পৃথিবী জোড়া তাঁর নাম। মনের গোপনে ইচ্ছাপোষণ করতাম, অধ্যাপক টিনবার্গেনের সান্নিধ্যে থেকে যদি কিছুদিন গবেষণাচর্চা করতে পারি, বড়ো ভালো হয়।
ভাগ্যলিখন বলাটা বাড়াবাড়ি হবে, তবে ঠিক এমনই সুযোগ আমার সামনে উপস্থিত হলো। বিদেশে গিয়ে ওই নববিজ্ঞান সাধনা করবার মতো রেস্ত নেই, আমার শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন। হঠাৎ আমস্টারডাম থেকে এক সমাজবিজ্ঞানী-অধ্যাপক, হফস্ট্রা, ভারতবর্ষ ঘুরতে এলেন, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। হল্যান্ড ছোটো দেশ, রফতানি করেই সে দেশের মানুষদের জীবনধারণ। দু’শো-তিনশো বছরের সাম্রাজ্যবিস্তারের আদি ইতিহাস যা-ই হোক, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ছোটো পরিসরে হল্যান্ডের অবস্থান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালে উপার্জন-উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে নতুন-নতুন দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে বিনিময়-পরিচয় জরুরি। ওলন্দাজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হল্যান্ডের সব ক’টি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সেই লক্ষ্যে কিছুদিন আগে একটি আন্তর্জাতিক সহযোগ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। ইনস্টিটিউট অফ সোস্যাল স্টাডিজ নামে একটি আন্তর্জাতিক মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়েছে, প্রথম অধ্যক্ষ হিশেবে মনোনীত হয়েছেন অধ্যাপক হফস্ট্রা। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা ঘুরে ছাত্র সংগ্রহের। হল্যান্ডের রাণী মহোদয়া হেগ শহরে অবস্থিত তাঁর অন্যতম প্রাসাদ, নর্ডেন্ডে প্যালেস, মহাবিদ্যালয়ের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন, বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্রছাত্রী যাঁরা আসবেন, তাঁদের সমস্ত ব্যয় ওই ওলন্দাজ আন্তর্জাতিক সহযোগসংস্থা নির্বাহ করবে।
হফস্ট্রা সাহেব লখনউতেও এলেন, ধূর্জটিবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন, ধূর্জটিবাবু আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, নর্ডেন্ডে প্রাসাদবাসী হতে রাজি আছি কিনা। অধ্যাপক টিনবার্গেনের সঙ্গে গবেষণা করার আকাঙক্ষার কথা তাঁকে খুলে বললাম। হফস্ট্রা জানালেন, কোনও অসুবিধা হবে না, অধ্যাপক টিনবার্গেনও ওই মহাবিদ্যালয়ে নিয়মিত পড়াবেন। সুতরাং আমার লখনউয়ের পালার আপাতত সমাপ্তি।