আপিলা-চাপিলা – ১৯

ঊনিশ

দিল্লিতে নিজেকে ব্যস্ত রাখছি, অথচ অস্বীকার করার উপায় নেই, মনটা কলকাতায় পড়ে থাকতো। বিভিন্ন সুযোগে যখন-তখন কলকাতায় চলে যেতাম, প্রথম দিকে কমিশনের কাজের ছুতোয়, ব্যাংক জাতীয়করণের পর বাড়তি ভণিতার সুযোগ ঘটলো, কলকাতায় প্রধান দফতর স্থিত এমন একটি-দু’টি ব্যাংকের সরকার-মনোনীত ডিরেক্টর হওয়ার সুবাদে।

কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনে যোগ দেওয়ার দু’মাসের মধ্যেই অবশ্য মস্ত ধাক্কা খেয়েছিলাম। মুম্বই গেছি কমিশনের কী কাজে, এখন মনে নেই। রবিবার সকালে যে-সরকারি অতিথিনিবাসে ছিলাম, অশোক রুদ্র দেখা করতে এলো, দু’জনে পালি হিলে হিতুবাবুর প্রাসাদোপম বাংলোয় শচীনদার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, রোগের জের আদৌ কাটিয়ে উঠতে পারেননি, কণ্ঠস্বর দুর্বল, দেখাশোনা করবার জন্য কলকাতা থেকে ওঁর ভাগিনেয়ী আনা, কুচিদির কন্যা, গেছে। শচীনদাকে প্রফুল্ল রাখবার জন্য সারাদিন ধরে আমরা গল্পে-আড্ডায় মেতে রইলাম; তিনি নিজে ঈষৎ স্তিমিত, প্রায় নিঃশব্দ। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ দিল্লির বিমান, পাঁচটা-সওয়া পাঁচটায় শচীনদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চাপলাম। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, বেতারে ক্রিকেট টেস্টের ধারাবিবরণী চলছিল, কোনও বিদেশি দলের সঙ্গে টেস্ট খেলা, অপরাহ্ণকালে ভারতীয় ইনিংস শুরু করতে নেমে ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার ধুমধাড়াক্কা পেটাচ্ছিলেন। শচীনদা, যে-কাহিনী আগেই একবার বলেছি, আমাকে একটু পাশে ডেকে নিম্নস্বরে বললেন : ‘আমার শরীরে আর সে সামর্থ্য নেই যে অশোক রুদ্রের সঙ্গে একা তর্ক করতে পারি। তুমি মাসে অন্তত একবার করে এসো’। আটচল্লিশ ঘণ্টাও পেরোলো না, দিল্লিতে খবর পেলাম মঙ্গলবার দুপুরে; শচীনদা এক প্রবাসী ভারতীয় দম্পতিকে খেতে বলেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে হঠাৎ ফের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন, অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।

টিকিট জোগাড় করে সন্ধ্যার বিমানে মুম্বই ফিরে গেলাম। চৌধুরী ভাইয়েরা সবাই এসে গেছেন, বোনেরা কেউ যেতে পারেননি, তবে খোকন, ছোট্টু ও একজন-দু’জন ভাগ্নে-ভাগ্নি মুম্বইতে ছিল, দেবুদার সঙ্গে হেনাদিও কলকাতা থেকে চলে এসেছেন। কয়েকটা দিন ঘোরের মধ্যে কাটলো, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-র জন্য সম্পাদকীয় লিখলাম: এখন থেকে শচীন চৌধুরীহীন ভূমণ্ডল। পারিবারিক বৃত্তের বাইরে এমন নিবিড় করে আর-কাউকে এতটা কাছে পাইনি, আমার জীবনের একটি অধ্যায় সমাপ্ত।

শচীনদার অবর্তমানে সমীক্ষা ট্রাস্ট পুনর্গঠিত হলো, আমি অন্যতম সদস্য। ফের একবার কথা উঠলো, সম্পাদক হিশেবে আমি যোগ দিতে পারি কিনা, সেই প্রস্তাব বেশিদূর এগোলো না, বোধহয় কোনও ট্রাস্ট সদস্যের আপত্তি ছিল, তা ছাড়া আমার পক্ষে জোর সওয়াল করবার জন্য শচীনদা তো আর নেই। যিনি সম্পাদক হয়ে এলেন, বছর খানেক বাদে রিজার্ভ ব্যাংকে চলে গেলেন, তারপর থেকে আমাদের অনেক কনিষ্ঠ কৃষ্ণরাজ সম্পাদনার দায় বইছে, পরমাশ্চর্য নিষ্ঠার সঙ্গে, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি আজ যে-প্রতিষ্ঠায় পৌঁছেছে, তার কৃতিত্ব প্রায় পুরোপুরি তাঁর একার, আমরা তো নিমিত্ত মাত্র। একেবারে হালে, সম্ভবত বিশ্বায়নের প্রকোপে, কৃষ্ণরাজ একটু ডাইনে হেলেছে, যা আমার মতো অনেকের অপছন্দ, কিন্তু সম্পাদকীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ তো অকল্পনীয়।

সাতষট্টি সাল থেকেই রাজনীতির দ্রুত পট পরিবর্তন, কলকাতায়, দিল্লিতেও। পশ্চিম বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনে দুই কমিউনিস্ট দল মিলতে পারলো না, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিভিন্ন গোষ্ঠীর একটি মিশ্র নির্বাচনী জোট, দক্ষিণীপন্থী পার্টির নেতৃত্বে আর একটি, যার সঙ্গে অজয় মুখোপাধ্যায়-হুমায়ুন কবিরদের বাংলা কংগ্রেসও যুক্ত। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর এই প্রথম রাজ্য বিধানসভায় কংগ্রস দল সংখ্যাধিক্য হারালো। যথাযোগ্য মূল্যে বাংলা কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁট বাঁধলে সংখ্যাধিক্য হয়তো ফিরে পাওয়া যেত, তবে অতুল্য ঘোষ সেই মূল্য দিতে রাজি হলেন না, আগেভাগেই ঘোষণা করে দিলেন, কংগ্রেস দল পুনর্বার সরকার গড়তে আগ্রহী নয়। দুই বাম তথা কংগ্রেস-বিরোধী জোটের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ আলোচনায় বসলেন। কিছু দরকষাকষি হলো; যদিও ভোটের ও বিধায়কের সংখ্যার বিচারে বামপন্থী কমিউনিস্টরাই প্রধান দল, বাংলা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অজয় মুখোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী হলেন, জ্যোতি বসু যুগপৎ উপমুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। অজয়বাবুর দায়িত্বে স্বরাষ্ট্র বিভাগ। অবশ্যই সবচেয়ে উপযুক্ত মন্ত্রী নির্বাচন হয়েছিল ভূমি ও ভূমিরাজস্ব বিভাগের ক্ষেত্রে, হরেকৃষ্ণ কোঙার। দুই গোষ্ঠীর মিলিত সত্তার নাম দেওয়া হলো যুক্তফ্রন্ট। জ্যোতিবাবু কলকাতা ট্রাম কোম্পানি অধিগ্রহণ, কর্মচারীদের জন্য বেতন কমিশন নিয়োগ ইত্যাদি কিছু-কিছু চমক-লাগানো কাজ করেছিলেন, তবে হরেকৃষ্ণবাবু ভূমিহীন কৃষক ও ভাগচাষীদের জমি দখলের যে-আহ্বান জানিয়েছিলেন, তার পরিণামে অচিরে, যুক্তফ্রন্টের ঊনিশ মাসের মধ্যেই, পশ্চিম বাংলার সমাজবিন্যাসে গুণগত পরিবর্তন ঘটেছিল অনেক। যদি হুমায়ুন কবির নিজের রাজনৈতিক প্রভাবের ভিত্তিভূমি পশ্চিম বাংলায় প্রতিষ্ঠার জন্য অত অস্থির হয়ে না উঠতেন, এবং প্রফুল্ল ঘোষ মহাশয় পরিণত বার্ধক্যে আর একবার মুখ্যমন্ত্রী হবার জন্য অতটা উদ্‌গ্রীব না হতেন, সম্ভবত যুক্তফ্রন্ট সরকার এলোমেলো চেহারা নিয়ে আরও কিছুদিন টিকে থাকতে পারতো। কিন্তু ভয়ের মধ্যে ভয়, সমস্যার মধ্যে সমস্যা। অজয় মুখোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিশেবে আদৌ সড়গড় নন, বয়সের পীড়নে প্রায়ই মন্ত্রিসভার বৈঠকে ঘুমে ঢলে পড়েন। তাঁর অনুজ বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় মন্ত্রিসভায় সি. পি. আইয়ের অন্যতম প্রতিনিধি, জ্যোতি বসু বা হরেকৃষ্ণ কোঙার তখন তাকে ঠেলা দিয়ে বলেন: ‘ও মশাই, আপনার ছোড়দাকে জাগিয়ে তুলন’।

আরও অনেক সমস্যা জড়ো হয়ে এলো। মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে দ্রুত বাড়ছে, বাংলা কংগ্রেসের মধ্যে অনেকেই সন্ত্রস্ত। তারা দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, ইন্দিরা গান্ধি বাংলার দখলদারি ফিরে পেতে উৎসুক, আশু ঘোষ নামে এক ফড়ে, কলকাতায় অনেক বাড়িঘরের মালিক, ঠিকেদার হিশেবে কাজে নেমে পড়লেন, আটষট্টি সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে তেরো-চোদ্দো জন বিধায়ক বাংলা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এলেন প্রফুল্ল ঘোষের নায়কত্বে। অতুল্য ঘোষকে জব্দ করবার জন্য ইন্দিরা গান্ধি সোৎসাহে এগোলেন, অতুল্যবাবুকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করলেন না। রাজ্যপাল ধরমবীরকে দিয়ে অজয়বাবুকে বরখাস্ত করানো হলো, রাতের অন্ধকারে প্রফুল্ল ঘোষ মুখ্যমন্ত্রী পদে বৃত হলেন। পরিণাম কিন্তু আখেরে আদৌ সুবিধার হলো না। তিন-চার মাসের মধ্যেই যাঁরা প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে গিয়েছিলেন, অথচ মন্ত্রী হতে পারেননি, তাঁরা বিগড়ে গেলেন, আশু ঘোষের সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল, প্রফুল্ল ঘোষ পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। এবার রাষ্ট্রপতির শাসন, কলকাতা ও পশ্চিম বাংলাকে অনেক মিষ্টিমধুর কথা শোনানো হলো দিল্লি থেকে, এই আশায়, যদি যুক্তফ্রন্টকে আসন্ন নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়া যায়।

পৃথিবীতে কৌতুককাহিনীর শেষ নেই। প্রফুল্ল ঘোষের মন্ত্রিসভার শেষ লগ্নে ইন্দিরা গান্ধি অন্তিম আলোচনার জন্য প্রফুল্ল ঘোয-আশু ঘোষ-পূরবী মুখোপাধ্যায় সবাইকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছেন। ভোরের বিমানে দিল্লিগামী সবাই, সেই বিমানে ভূপেশ গুপ্তও আছেন, আমিও আছি। বিমান প্রায় লখনউর আকাশে পৌঁছেছে, হঠাৎ শুনি ভূপেশবাবু গলা উঁচু পর্দায় তুলে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করছেন: ‘এ প্লেইনলোড অফ সিন, বিমান-বোঝাই পাপ যাচ্ছে, বিমান-বোঝাই পাপ’।

ঘটনাসমাচ্ছন্ন বছর, আরও অনেক কিছু ঘটলো। সি. পি. আই.’ (এম)-এর মধ্যে একদল বিপ্লবউন্মার্গী, চীনদেশের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দৃষ্টান্তে অভিভূত, পশ্চিম বাংলা যে ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্য মাত্র, তা তাঁদের সেই মুহূর্তে খেয়ালে এলো না, তাঁরা ধরেই নিলেন চীনের মতো এখানেও মৃত্তিকা প্রস্তুত, বিপ্লবটি ঘটিয়ে ফেললেই হলো। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজভুক্ত অনেক ছাত্র-যুবক তাঁদের ডাকে সাড়া দিলেন। দার্জিলিং জেলায় হিমালয়ের সানুদেশে নকশালবাড়ি থানা অঞ্চলে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে উৎসাহীদের একটি অংশের সংঘর্ষ, কয়েকজন আদিবাসী কৃষক নিহত হলেন, কয়েকজন মহিলাও, উত্তেজনার পর্দা হঠাৎ উঁচুতে চড়ে গেল। শিলিগুড়ির বিদ্রোহী নেতা চারু মজুমদারকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলো, কিন্তু আগুন নেভবার কোনও লক্ষণ নেই, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব অথচ বেড়েই যাচ্ছে, দলত্যাগীদের জন্য তেমন-কিছু আপাতত কোনও অসুবিধা হলো না , বিশেষ করে হরেকৃষ্ণ কোঙার গ্রামাঞ্চলে যে জমিদখলের বীজমন্ত্র ছিটিয়ে দিয়েছিলেন, তা থেকে মস্ত উপকার হচ্ছিল পার্টির।

আরও যা ঘটলো, সমর সেন-সুদ্ধু সবাই সদলে ‘নাউ’ পত্রিকা থেকে বিতাড়িত হলাম। একটু-একটু করে হুমায়ুন কবিরের বিরক্তি বাড়ছিল, সমরবাবুর সঙ্গে এই সম্পাদকীয়-সেই সম্পাদকীয় এই প্রবন্ধ-ওই প্রবন্ধ নিয়ে প্রায়ই খিটিমিটি। কে না জানে, কবির সাহেবের অভিযোগের যাথার্থ্য নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। হুমায়ুন কবির আশু ঘোষের প্রয়াসে সক্রিয় সাহায্য করেছিলেন, সংঘাত চরমে গিয়ে ঠেকলো প্রফুল্ল ঘোষের মুখ্যমন্ত্রিত্ব গ্রহণকে ‘নাউ’-য়ের এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে এক লোলচর্ম বৃদ্ধের সদ্যোদ্ভিন্নাযৌবনা ষোড়শীর প্রতি লালসা রূপে বর্ণনায়। আমি দিল্লি থেকে চারণ গুপ্ত ছদ্মনামে ‘নাউ’-তে কলকাতা ডায়েরি চালিয়ে যাচ্ছিলাম, কেন্দ্রীয় সরকারি কমিশনের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও; তারও সাময়িক মুলতুবি। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই কোম্পানি গড়ে বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা তোলা হলো, নতুন সাপ্তাহিক পত্রিকার উদ্যোগ সম্পূর্ণ, ‘ফ্রন্টিয়ার’। কলকাতা ডায়েরিও নতুন কাগজে স্থানান্তরিত হলো, সমরবাবুর সুহৃদ্‌কুল ও অনুরাগীদের উৎসাহের শেষ নেই, গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউর অদূরে মট লেনে নতুন পত্রিকার দপ্তর। ঘোর বামপন্থী বন্ধু রবি সেনগুপ্ত, ততদিনে তিনি আপাদমস্তক নকশালপন্থী, পত্রিকার অন্যতম কর্ণধার, বিপ্লবের আর যেন একটুও বাকি নেই। রবিবাবুকে যদি কেউ রঙ্গ করে প্রশ্ন করতো: ‘আপনি খড়িবাড়ি না নকশালবাড়ি’, তাঁর হয়ে উত্তর যোগাতাম : ‘উঁহু, উনি পুরোপুরি ফাঁসিদেওয়া’।

সমর সেনের সঙ্গে আমার মতান্তরের তখন থেকেই একটু-একটু শুরু। যে-কোনও বাঙালি মধ্যবিত্তের মতো, বিপ্লব সম্পর্কে আমারও তখন ঈষৎ রোমান্টিক ধ্যানধারণা, নকশালবাড়ি আন্দোলনের সমর্থনে প্রথম পর্যায়ে বেশ কিছু সম্পাদকীয় লিখেছি ‘নাউ’ ও ‘ফ্রন্টিয়ার’-এ। মাঝে-মাঝে স্নেহাংশু আচার্যের বাড়িতে জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা হতো, কখনও-কখনও সমর সেনও থাকতেন। সমরবাবু ততদিনে উগ্র মতামত ধারণ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন, প্রায়ই জ্যোতিবাবুর সঙ্গে তাঁর তিক্ত কথাবার্তা, স্নেহাংশুবাবু ও আমি দু’জনেই একটু বিব্রত।

এখন তো স্বীকার করতে সংকোচ নেই, এই পর্বে অদমনীয় স্বপ্নবিলাসিতায় ভুগছিলাম আমরা অনেকেই। স্বপ্ন দেখার সামাজিক সার্থকতা আছে, পৃথিবীর বিভিন্ন ঋতুতে দেশে-মহাদেশে যে-সমাজ পরিবর্তন ঘটেছে, মানুষের ইতিহাস যে এগিয়ে গেছে, তা কেউ-কেউ মাঝে-মাঝে স্বপ্ন দেখতেন বলেই, স্বপ্ন থেকে সঞ্জাত অঙ্গীকার, অঙ্গীকার থেকে আলোড়ন, আলোড়ন থেকে বিপ্লব। মুশকিল হলো নিছক বাষ্পের সংস্থানে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন থেকে বিপ্লবে উত্তরণ অসম্ভব। স্বপ্নকে পরিপার্শ্বের কাঠ-খড়-রোদের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয়, মিলিয়ে নিতে হয় রূঢ় বাস্তবের প্রতিটি অণু-পরমাণুর সঙ্গে। যা কল্পনায় সুন্দর করে আঁকা যায়, সেই চিত্রকল্পকে নদী-প্রস্তর-পর্বতসংকুল পৃথিবীতে ততটা অবলীলায় আঁকশি দিয়ে টেনে আকাশ থেকে নামানো যায় না। বিবেচনা প্রয়োজন, পরিচিকীর্ষা প্রয়োজন, প্রতীক্ষা প্রয়োজন। কখনও-কখনও স্বপ্নকে একটু কাটছাঁট করেও নিতে হয়, সম্ভপরতার প্রেক্ষিত থেকে বিচার করে। এই প্রক্রিয়াকেই বোধহয় সাধারণ ভাষায় বলা হয় সাধ ও সাধ্যের সংশ্লেষণ। একটি বিশেষ প্রতীতিতে এখনও আমি অবিচল। নকশালপন্থীরা যদি ওসময় হুট করে দল ছেড়ে না দিয়ে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য রক্ষা করে চলতেন, তাতে সমাজের সার্বিক উপকারই হতো। এই রাজ্যে ক্ষমতায় পৌঁছে মাঝে-মাঝে ওই দলে যে-ধরনের দুর্বলতা ও বিচ্যুতি চোখে পড়ে, তা হয়তো তা হলে রোধ করা সম্ভব হতো। সুশীতল রায়চৌধুরী-সরোজ দত্তদের তিতিক্ষা তা হলে হয়তো অন্য মাত্রা পেতো, সময়ের ফেরে প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে যে-লড়াই দলের অভ্যন্তরে এখনও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এঁরা যদি পার্টিতে থাকতেন, লড়াইয়ে জেতা অনেক বেশি সহজ হতো। মার্কসীয় বীক্ষণে আস্থা রাখি। বলে ললাটলিখনে খুচরো বিশ্বাস আরোপ হয়তো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ নয়। তবে যে যা-ই বলুক, দেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিশেষ পর্যায়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের মতো অকস্মাৎ-উপগ্রহ, কে জানে, বোধহয় কিছুতেই অনাবির্ভূত থাকতো না।

একটি ব্যাপারে আমার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না, তখনও ছিল না, এখনও নেই। ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায়, বামপন্থী জনতা মার্কসবাদী কমিউনিস্ট দলের প্রতি যে-আনুগত্য ঘোষণা করেছে, তা চট করে শিথিল হবার নয়। সুতরাং যাঁরা বামপন্থী তথা বিপ্লবী আন্দোলনের মোড় ঘোরাতে চান, গুণগত পরিবর্তনের ছক আঁকেন, তাঁদের এই বৃহত্তম বামপন্থী দলের বাইরে চলে যাওয়া অসার্থক। তাঁরা এই দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বামপন্থী জনতার কাছ থেকেও বিশ্লিষ্ট হবেন, তাঁদের শৌর্য ছুটকো-ছাটকা এখানে-ওখানে প্রিয়জনদের মোহিত করবে, কিন্তু সামগ্রিক আন্দোলনের কোনও কাজে আসবে না। নকশালপন্থী বন্ধুদের তাই তখন বহুবার অনুরোধ জানিয়েছি, তাঁরা বিদ্রোহ জারি রাখুন, কিন্তু পার্টির মধ্যে থেকে রাখুন। ঘটনাবলী অবশ্য অন্যদিকে মোড় নিল। এখনও আমার মনে হয়, নাগি রেড্ডি ও তাঁর সমর্থক-অনুরাগীরা যদি পার্টিতেই থেকে যেতেন, সাময়িক বোঝাপড়া করে, তা হলে দেশের-সমাজের-আন্দোলনের বিপুল সুবিধা হতো, পার্টির মধ্যে সংশোধনবাদী ঝোঁক নিয়ে মাঝে-মাঝে যেসব আকুলি-বিকুলি শোনা যায়, সেগুলি সম্ভবত একটু কম করে উচ্চারিত হতো।

নাগি রেড্ডির প্রসঙ্গে ভারতীয় উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজের বিচিত্রগামিতার প্রসঙ্গে আর একবার পৌঁছে যেতে হয়। সত্তরের দশকের উপান্তে সঞ্জীব রেড্ডি দেশের রাষ্ট্রপতি; তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাজশেখর রেড্ডি অন্ধ্রপ্রদেশে সি পি আই-এর সম্পাদক; এবং তাঁদের ভগ্নীপতি নাগি রেড্ডি মার্কসবাদী কমিউনিস্ট দল থেকে দুরে সরে ক্রমে নকশালপন্থীদের নেতৃত্বে অবস্থান করছেন। শুধু তাই-ই নয়, সঞ্জীব রেড্ডির সহধর্মিণী নাগি রেড্ডিরই সাক্ষাৎ ভগিনী।

সাতষট্টি সালের গ্রীষ্মের শেষের দিক, ওই অশান্ত সময়ে কয়েকদিনের জন্য দিল্লি থেকে কলকাতায় এসেছি। হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটে আমাদের চারতলার ফ্ল্যাটের ঠিক নিচে আই এ এস-ভুক্ত জনৈক মহিলা আমলা থাকতেন, তাঁর পিতামহ ঢাকা জেলার পুরনো দিনের কংগ্রেস নেতা বীরেন্দ্র মজুমদার, উনিশশো ঊনচল্লিশ সালে মাজদিয়া রেল দুর্ঘটনায় মারা যান। মহিলাটির মা জর্মান, অতি শান্ত, সৌজন্যবতী, করুণাময়ী। আমাদের প্রতিবেশিনীর ছোটো বোনের স্বামীও আই এ এস-এ, সেই মুহূর্তে দার্জিলিং জেলার ডেপুটি কমিশনার, তাঁর তত্ত্বাবধানে নকশালবাড়ি আন্দোলনের নেতাদের— কানু সান্যাল, সৌরেন বসু, খোকন মজুমদার, এঁদের— হন্যে হয়ে পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোঁজা হচ্ছে। তাঁর দুই কন্যা ও এক জামাতা-সহ জর্মান মহিলাকে আমরা নৈশাহারে বলেছি। টেবিলে গোল হয়ে বসে খাচ্ছি, আলাপ করছি, হঠাৎ দরজায় বেল। খুলে দেখি রবি সেনগুপ্ত, সঙ্গে আমার অচেনা এক ভদ্রলোক। রবিবাবু নিচু গলায় বললেন: ‘ইনি সৌরেন বসু, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন’। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, এর চেয়ে বড়ো সংকট আর কী হতে পারে, খাবার ঘরে সৌরেনবাবুকে যিনি গ্রেফতার করবেন সেই ডেপুটি কমিশনার মশাই বসে আছেন, আর সৌরেন বসু নিজে দরজায় দাঁড়ানো। দ্রুত তাঁদের দু’জনকে রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে শোবার ঘরে নিয়ে গেলাম, খাবার জায়গায় গিয়ে সমাগত অতিথিদের বললাম: হঠাৎ দু’জন দেখা করতে এসেছেন, ওঁদের সঙ্গে একটু কথা বলতে হচ্ছে, মাফ চাইছি কিছুক্ষণের জন্য। সৌরেন বসুর সঙ্গে নকশালবাড়ি-উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা; তিনিই বলছেন, আমি প্রধানত নির্বাক শ্রোতা। আলোচনাক্রমে আমি একবার বোধহয় বলেছিলাম,’ সমস্যা ক্রমশ ঘনীভূত হবে বুঝছেন তো; নকশালবাড়িতে, দেখে মনে হচ্ছে, শিগগিরই ফৌজ নামানো হবে, আপনারা কী করবেন তখন?’ সৌরেনবাবু দ্বিধাহীন, তাঁর উচ্ছ্বাস বেড়ে গেল, ঝটিতি জবাব দিলেন : ‘আমাদের কাছে খবর, নকশালবাড়িতে একটি মারহাট্টা রেজিমেন্ট আসবে। ওরা তো মহারাষ্ট্রের দেহাতি মানুষ, প্রায় সবাই গরিব কৃষক। যে মুহূর্তে জানতে পারবে আমরা জমির জন্য লড়াই করছি, গরিব কৃষককুলের জন্য লড়াই করছি, সঙ্গে-সঙ্গে ওরা ওদের বন্দুককামান-সহ আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে’। আমি আর কথা বাড়ালাম না; রোমান্টিকতা নমস্য, কিন্তু তা তো হঠকারিতারও জনক। এর কিছুদিন বাদে সৌরেনবাবু লুকিয়ে চীন চলে যান, চু এন লী-র সঙ্গে দেখা হয়, চীনের প্রধান মন্ত্রী তাঁকে কী বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন জানি না, তবে সৌরেনবাবু দেখা করতে না এলে এত তাড়াতাড়ি হয়তো আমি নিজে নাস্তিক বনে যেতাম না।

শুনেছিলাম, ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ তাঁদের ভারতীয় অনুরাগীদের এই স্লোগানে উদ্বেল হওয়াতে চীনের নেতারা সৌরেনবাবুর কাছে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, বলেছিলেন ওটা কাণ্ডজ্ঞানহীন। অবশ্য কলকাতার রকে তখন যুক্তি কপচানো হয়েছিল, ১৯৪২ সালে হীরেন মুখুজ্যে মশাই তো উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, হ্যাঁ, বলবো, শত বীণাবেণু রবে বলবো, সোভিয়েট দেশ আমার পিতৃভূমি; তা হলে সিকি শতাব্দী বাদে চারু মজুমদার কী এমন অন্যায় করেছেন? মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে যে-কমরেডরা বিদ্রোহের ঝাণ্ডা ওড়ালেন, তাঁদের অভিযোগ সংশোধনবাদ রুখতে বেজিং বেতারে প্রত্যহ যে-যে উপদেশাবলী বর্ষিত হচ্ছে এখানকার নেতারা সে-সব কিছুই মানছেন না। শ্লেষবিচ্ছুরণে জ্যোতিবাবু তুলনাহীন, প্রসঙ্গটি উঠতে একদিন সঙ্গে-সঙ্গে মন্তব্য করলেন: ‘সম্পূর্ণ বাজে কথা, আমাদের চেয়ে বড়ো চীনে ভক্ত কে? বিশের দশকের শেষের দিকে, তিরিশের দশকের গোড়ায় সোভিয়েট পার্টি লম্বা-লম্বা নির্দেশ-উপদেশ পাঠাত চীনে পার্টিকে। চীনে কমরেডরা তা শ্রদ্ধার সঙ্গে পড়তেন, পড়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখতেন। আমরাও তো ঠিক তাই করছি চীনে বেতারের উপদেশাবলী নিয়ে।’

কয়েক মাস গত হলে ‘ফ্রন্টিয়ার’-এ আমার লেখা বন্ধ হয়ে গেল। সমরবাবুর উগ্রতর সুহৃদরা নালিশ জানাতে শুরু করলেন, অশোক মিত্রের লেখাগুলি বড়ো বেশি মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি-ঘেঁষা, পত্রিকার পবিত্রতা নষ্ট করছে। মত-কষাকষি চরমে উঠলো ঊনসত্তর সালে বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে। দ্বিতীয় যুক্ত ফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছে, অজয় মুখোপাধ্যায় পুনর্বার মুখ্যমন্ত্রী, বিধান সভায় সি পি আই (এম) সর্ববৃহৎ দল হওয়া সত্ত্বেও জ্যোতিবাবু ফের উপমুখ্যমন্ত্রী, অবশ্য এবার তিনি অর্থ দপ্তর নয়, স্বরাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্বে। প্রায় গোড়া থেকেই বাংলা কংগ্রেসের সঙ্গে জ্যোতিবাবুদের বিসংবাদ শুরু, অনেক নাটক-যাত্রা হলো, ইন্দিরা গান্ধি ইতিমধ্যে প্রচুর অঙ্ক কষেছেন, সত্তর সালের শুরুতে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার ফের ভাঙলো। বাংলা কংগ্রেসের সুপারিশে তৎকালীন রাজ্যপাল আর-এক দফা পশ্চিম বঙ্গের মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করলেন। আট-দশ মাস বাদে, লোকসভা নির্বাচনের পাশাপাশি, রাজ্য বিধানসভার পুনরায় নির্বাচন, চার বছরের মধ্যে তৃতীয় বার। সি পি আই (এম)-এর সঙ্গে কয়েকটি বামপন্থী দল রইলো, অন্যদিকে সি পি আই ও ফরোয়ার্ড ব্লক বাংলা কংগ্রেসের সঙ্গে। বরানগর কেন্দ্রে কংগ্রেস, বাংলা কংগ্রেস, সি পি আই, ফরোয়ার্ড ব্লক এবং নকশালপন্থীদের সর্বসম্মত একক প্রার্থী অজয় মুখোপাধ্যায় জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে। ‘ফ্রন্টিয়ার’-এ সম্পাদকীয় বেরোলো অজয় মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন জানিয়ে; আমি তা পড়ে বিমূঢ়। জ্যোতি বসু অবশ্য অনেক ভোটে এবারও জিতেছিলেন। একটি ঘটনা ঘটলো, এখন হাসির উদ্রেক করে। আমার বহুদিনের বন্ধু হিতেন ও অ্যাঞ্জেলা ভায়া তখন কলকাতায়, হিতেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের অধ্যক্ষ পদে সমাসীন, আলিপুরের নিউ রোডে ওদের বাড়িতে আমাদের, সমরবাবুদের এবং আরও কয়েকজনকে খেতে বলা হয়েছিল এক সন্ধ্যায়, বরানগরের নির্বাচনী ফল যেদিন বেরোবার কথা। সমরবাবুর অনুরোধে রেডিও খোলা হলো, আমরা সংবাদ শুনলাম, অজয়বাবু ভীষণভাবে হেরে গেছেন। সমরবাবুর মেজাজ সহসা খিঁচড়ে গেল। বরাবরই দেখেছি, সামান্য জলপথে বিহার করলে ওঁর মুখ থেকে নিখাদ খাঁটি কথা বেরোয়। জ্যোতিবাবুর জয় ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের পরাজয় নিয়ে ওই সন্ধ্যায় আমাদের দু’জনের মধ্যে প্রথমে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, পরে রীতিমতো কড়া বাক্যাবলীর বিনিময়। সমরবাবু থেমে-থেমে, গভীর তিক্ততার সঙ্গে জানালেন, আমি পর-পর তাঁর দুটো পত্রিকারই— ‘নাউ’ এবং ‘ফ্রন্টিয়ার’-এর— সর্বনাশ করেছি, সি পি আই (এম)-এর প্রতি আমার ধারাবাহিক পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন দ্বারা, তাঁর, ও পত্রিকাদ্বয়ের, বদনাম হয়েছে। এর পর সমরবাবুর কাগজে আমার পক্ষে লেখা চালিয়ে যাওয়া সত্যিই অসমীচীন হতো৷ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ইংরেজি প্রবন্ধসংকলনের একটি আলোচনা সমরবাবুর কাছে ইতিমধ্যে গচ্ছিত ছিল, আর ফেরত চাইনি, ওটা ছাপা হয়ে গেল। তবে আর কোনওদিন ‘ফ্রন্টিয়ার’-এ লিখিনি, যদিও সমরবাবুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যসম্পর্কে আদৌ চিড় ধরেনি, আমাদের মেলামেশা অব্যাহত থেকেছে, সমরবাবু যতদিন বেঁচে ছিলেন, শেষ পর্যন্ত।

কলকাতায় ঊনিশশো ঊনসত্তর-সত্তর-একাত্তর জুড়ে আরও অনেক কিছু ঘটছিল। রবি সেনগুপ্ত তখন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য নকশাল সমর্থক, সমর সেনের সঙ্গে রাজযোটক। আমি লেখা বন্ধ করলে কী হবে, আগুন-ঝরানো রচনা-লেখকের অভাব ছিল না কলকাতা শহরে, তাঁরা ‘ফ্রন্টিয়ার’-এ আসর জমিয়ে রইলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনো আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র নয়ন চন্দ তাঁদের অন্যতম; নয়ন এখন বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক। অবশ্য অন্য দিকে ইতিমধ্যেই অন্তত উৎপল দত্তের অত্যুৎসাহী বিপ্লবী অধ্যায় সমাপ্ত। কিছুদিন পর্যন্ত উৎপল, ও সেই সঙ্গে লিটল থিয়েটার গ্রুপ, নকশালবাড়ি আন্দোলনের উজ্জ্বলন্ত দৃষ্টান্তে মোহিত। উৎপল ও তাপস সেন শিলিগুড়ির গোপন ডেরায় চারু মজুমদারের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন, তখনই বোধহয় উৎপলের মোহাচ্ছন্নতা একটু কমেছিল, তা হলেও মস্ত কুচকাওয়াজ করে ‘তীর’ নাটক লেখা হলো, অভিনব মঞ্চস্থাপনা, বিভিন্ন কাট-আউটে জ্যোতি বসু-প্রমোদ দাশগুপ্ত-হরেকৃষ্ণ কোঙারের মুখের প্রতিচ্ছবি, তাঁদের মুখ দিয়ে অনেক প্রগাঢ় প্রতিক্রিয়াশীল বচন শোনানো, নকশালবাড়ি লাল সেলামের জয়ধ্বনিতে মিনার্ভা মঞ্চ তিন ঘণ্টা জুড়ে কম্পমান।

একটু বাদেই অকস্মাৎ যবনিকা পতন। জেমস আইভরি-ইসমাইল মার্চেন্ট জুটি অনেক ভারতীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে, প্রধানত মুম্বইতে, এক চলচ্চিত্রের শুটিং করছেন, উৎপলকে, অনুমান করছি, অনেক টাকার বিনিময়ে, প্রধান ভূমিকায় বেছেছেন। সেই মাহেন্দ্রমুহূর্তে উৎপল দত্ত পুনরায় গ্রেফতার, ঠিক কী মামলায় জড়িয়ে প্রথমে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, তখনও প্রফুল্ল ঘোষের স্বল্পায়ু মুখ্যমন্ত্রিত্ব চলছে। মার্চেন্ট আইভরিদের মাথায় হাত, তাঁদের ছবির মুক্তি পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা, তাতে প্রচুর ব্যবসায়িক ক্ষতিরও ঝুঁকি। পর্দার অন্তরালে ঠিক কী ঘটেছিল বোঝা মুশকিল, কিন্তু একদিন শুনলাম, উৎপল মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে বিমানে চেপে মুম্বইমুখো শ্যুটিঙের উদ্দেশ্যে।

তখনও আমি ‘ফ্রন্টিয়ার’-এ লেখা ছাড়িনি, দিল্লিতে প্রতি সপ্তাহে সমরবাবু চিঠি দিতেন, কে কী লিখছেন, আমার কাছ থেকে পরবর্তী সংখ্যার জন্য কী লেখা আশা করছেন, এ-সমস্ত জানিয়ে। উৎপল-কাহিনী সমাপ্ত হবার পর এরকম এক পোস্টকার্ড, একটি-দু’টি কেজো কথাবার্তার পর সমরবাবুর স্বাক্ষর: ইতি সমর। হঠাৎ একটি পুনশ্চ সংযোজন: ‘উৎপলের কাণ্ডটা দেখলেন?’ উৎপল দত্ত অবশ্য পরে তাঁর লেখা এক ইংরেজি গ্রন্থে মুচলেকা দেওয়ার ব্যাপারটাকে লঘু করে বর্ণনা করেছেন: শ্রেণীশত্রুদের সঙ্গে শঠতায় অপরাধ নেই, তাদের উজবুক বানিয়ে যদি কারান্তরাল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকে, তা কেন গ্রহণ করা হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *