সাঁইতিরিশ
আশির দশকের শেষ অধ্যায় থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলি আমার কাছে বিষাদের ঘন কুয়াশায় মোড়া; মৃত্যুশোকের মিছিল। কয়েকজন প্রিয়জনের বিয়োগের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। খুরশীদ অস্ট্রিয়াতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত, কঠিন পীড়ায় ভুগে-ভুগে সে-ও অবশেষে বিলীন হয়ে গেল। আমি তো তা হলেও তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগে কানাডা থেকে ফিরে আসবার পথে ভিয়েনায় নেমে তার সঙ্গে দেখা করে এসেছিলাম, আমার স্ত্রীর সেই সুযোগটুকুও ঘটলো না। প্রায় চল্লিশ বছর তার সঙ্গে স্নেহপ্রীতির নিগড়ে জড়িয়ে ছিলাম; তার মৃত্যুসংবাদে দু’জনেরই মনে হলো সত্তার খানিকটা যেন ধ্বসে পড়লো। খুরশীদের জীবন সুখের হয়নি, কয়েক বছর আগে আমাকে সখেদে জানিয়েছিল, সব-কিছুই তার কাছে এখন অর্থহীন; তার শরীরে একাধিক জটিল ব্যাধি বাসা বেঁধেছে, আমেরিকায়, ইওরোপে বহু চিকিৎসা করিয়েছে, ক্রমশ শীর্ণ থেকে শীর্ণতরা, কয়েক সপ্তাহ সামান্য হয়তো ভালো, তার পরেই আবার অবস্থার অবনতি। এমনি করেই তার জীবনের শেষ বছর পনেরো কেটেছে। প্রথাগত আধুনিক চিকিৎসায় উপকার না পেয়ে সে হাকিমি-ইউনানির শরণাপন্ন হয়েছে; আমাদের লিখেছে, কোনও কবিরাজের সঙ্গে পরামর্শ করে ওষুধ পাঠাতে পারি কি না। পারিবারিক বন্ধ কলকাতার এক খ্যাতনামা হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকের কাছ থেকে নির্দেশ নিয়ে ওকে ওষুধের বিবরণ পাঠিয়েছি। তবে সব কিছুই বিফল হলো। ঈশ্বর সম্পর্কে বীতরাগের অনেক কারণ দাখিল করতে পারি; তবে সবচেয়ে উপরে ঠাঁই দেবো এই আর্ত অভিমান: খুরশীদের মতো এমন ধর্মপ্রাণা দয়াবতী স্নেহশীলা মহিলাকে কেন এমন দুঃসহ শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবনের শেষের বছরগুলি কাটাতে হলো, তার কোনও সদর্থক উত্তর আজ পর্যন্ত পাইনি। ওর মৃত্যুর পর মুম্বইয়ের এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় আবেগাচ্ছন্ন একটি স্মরণিকা লিখেছিলাম, সঙ্গে ছাপতে দিয়েছিলাম ওঁর বিবাহ-দিবসের হাস্যোজ্জ্বল আনন্দ-ঝলমল ছবি, যে-ছবির দিকে তাকিয়ে হৃদয়ের মোচড়ানি আরও বাড়ে। লেখাটি বেরোবার পর পাকিস্তান থেকে একাধিক ধন্যবাদজ্ঞাপক চিঠি পাই, হয় তাঁর কোনও ছাত্রীর, নয়তো কোনও সহকর্মীর। ছেলে কামাল পড়াশুনোয় তেমন দড় নয়, খুরশীদের তা নিয়েও প্রচুর চিন্তা ছিল। এখন কামাল কোথায় কীভাবে আছে, কিছুই জানি না। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পর আর একটি প্রবন্ধ লিখি, যে কামালকে বহুদিন দেখি না, যার স্মৃতিতে আমি সম্ভবত আর অবশিষ্ট নেই, তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে।
মৃত্যুরা যখন আসে, সারি বেঁধেই আসে৷ খুরশীদের প্রয়াণের সন্নিকট সময়ে কলকাতায় আমার অতি কাছের মানুষ এক মহিলা, অর্ধ শতাব্দী ধরে যাঁকে গৌরীবৌদি বলে সম্বোধন করেছি, বেশ কয়েক বছর কর্কট রোগে ভুগে কঙ্কালসমা, তিনিও জীবনের নির্দয়তা থেকে উদ্ধার পেলেন। বন্ধু বাচ্চুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃজায়া, যখন নববধূ হয়ে ওদের ঢাকাস্থ টিকাটুলির বাড়িতে গৌরীবৌদি প্রবেশ করলেন, প্রায় কিশোরীই বলা চলে, আমাদের চেয়ে বয়সে সামান্য মাত্র বড়। আমুদে, সদাহাস্যময়ী, সমস্ত ব্যক্তিত্ব থেকে স্নেহ বিচ্ছুরিত হচ্ছে, আমাদের আড্ডায় গৌরীবৌদি বন্ধুর মতো মিশে গিয়েছিলেন। যতদিন কলকাতায় পাকা ডেরা বাঁধিনি, কাশী থেকে, দিল্লি থেকে, লখনউ থেকে, কিংবা বিদেশের এ প্রান্ত-ও প্রান্ত থেকে, দমকা হাওয়ার মতো একদিন-দু’দিনের জন্য কলকাতায় হাজির হয়েছি, বাচ্ছুদের রাসবিহারী এভিনিউ বা রাজা বসন্ত রায় রোডের বাড়িতে কখনও-কখনও রাত্রিবাস করেছি, আবিষ্কার করেছি গৌরীবৌদির আত্মীয়তাবোধ থেকে অভিন্ন তাঁর আতিথেয়তা। বাচ্ছুদের বাড়ির সবাইর গানবাজনার নেশা, নানা ধরনের শখ, ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা ব্যবসায়ে নেমে: গৌরীবৌদি সব-কিছুর সাক্ষাৎ শরিক। শেষের দিকে লেক মার্কেটের উল্টো পাড়ে, যেখানে ফুলওলাদের আস্তানা, একটি বাড়ির দোতলায় রেস্তরাঁ খুলেছিলেন, সকাল-বিকেল চায়ের আয়োজন, দুপুরে-রাত্তিরে খাঁটি বাঙালি রান্না পরিবেশন। রেস্তরাঁটি এখনও আছে, গৌরীবৌদি নেই: জীবনে অনেক আনন্দের দিনের জন্য তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
একই ঋতুতে চলে গেলেন লখনউ জীবনের পরম শুভানুধ্যায়ী বিনয়েন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মহাশয়। কয়েক মাস বাদে ছায়ামাসি, ধূর্জটিপ্রসাদের মৃত্যুর পর এই এতগুলি বছর যিনি আমাকে আদরে ঢেকে রেখেছিলেন। একানব্বুই সালে যে-নির্বাচনে আমি সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কাছে হেরে ভূত হই, তার একটি স্মৃতি আমাকে অপরাধবোধে এখনও আনত করে: গ্রীষ্মের ঝাঁ-ঝাঁ রোদে প্রায় নব্বুই-উত্তীর্ণা ছায়ামাসি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, আমাকে ভোট দেবেন।
শরীরের উপর বহু বছর ধরে অনেক অত্যাচার করেছেন রবি সেনগুপ্ত, আশির দশকের গোড়ায় কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসকরা প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, আমরা এক ঝাঁক বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়পরিজন হাসপাতালের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে প্রত্যহ অনিশ্চিত প্রহর গুণি, মনে-মনে নিজেদের তৈরি করি চরম দুঃসংবাদের জন্য। একমাত্র ঘোর আশাবাদী জোছন দস্তিদার, এক সন্ধ্যায় সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো: ‘না, রবিদা যানেওয়ালা পার্টি না’। তার কথাই ফললো, সেই যাত্রায় রবি সেনগুপ্ত বেঁচে উঠলেন। দশ বছর বাদে ফের দুরারোগ্য ব্যাধির কবলে, এবার জোছন দস্তিদারের প্রত্যয় ব্যর্থ। রবি সেনগুপ্তর উপর বিরক্ত এমন লোকের অভাব নেই; বিরক্তি উদ্রেক করবার মতো ইন্ধন ভদ্রলোক, না মেনে উপায় নেই, অনেক জুগিয়েছেন। বদমেজাজি, যে-কোনও উপলক্ষ্যে বা উপলক্ষ্যহীনতায় এঁর-ওঁর-তাঁর সঙ্গে ঝগড়ায় প্রবৃত্ত হতে সদা-প্রস্তুত, রাজনৈতিক গোঁড়ামি, সেই গোঁড়ামি চরিতার্থ করতে যতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায়, তাঁর যাওয়া। অথচ এই মানুষটিই পরোপকার করবার জন্য সর্ব ঋতুতে মুখিয়ে থাকতেন: ক-কে ধরে খ-র জন্য চাকরি জোটানো, খ-কে ধরে গ-র জন্য ঘ-র কাছ থেকে একটি প্রশংসাপত্র সংগ্রহ, ঙ-র কাছ থেকে জ-র জন্য ক্রিকেট খেলার টিকিট জোগাড় করে দেওয়া, স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে মধ্যরাত্রিতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন যে-মহিলা, তাঁর জন্য বিকল্প ডেরা খুঁজে দেওয়া: রবি সেনগুপ্তর মতো এমন পুরোপুরি অপেশাদারি, পুরোপুরি অবৈতনিক পরপরিত্রাতা আমার অভিজ্ঞতায় দ্বিতীয় দেখিনি। তাঁর রুক্ষ বহিরাবরণ থেকে যা অনুমান করা সম্ভব ছিল না, গভীর কবিতাপ্রেমিক, সংগীতপ্রেমিক, নাটকপ্রেমিক, সাহিত্যপ্রেমিক, ধ্রুপদী সংগীতের অঢেল খবর রাখতেন, রবীন্দ্রনাথ ও পরবর্তী কবিদের রচনা থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্ভুল আবৃত্তি করে যেতে পারতেন, আর নাটকের নেশায় তো ঘরছাড়াই হয়েছিলেন। সবচেয়ে যা উল্লেখ্য, তা তাঁর বন্ধুবাৎসল্য: তাপস সেনদের কাছ থেকে আমার এই উক্তির সমর্থন মিলবে। পুরনো রেকর্ড স্তূপ করে এনে রবিবার বা অন্য কোনও ছুটির দিনের শিথিল সময়ে আমরা একত্র বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শোনায় ডুবে থেকেছি; রবি সেনগুপ্তর মৃত্যুর পর আমার সংগীত-শ্রবণের ঋতু-অবসান। এখন রবি সেনগুপ্ত নেই, তাঁকে যেতেনা-দেওয়া জোছন দস্তিদারও নেই।
মাস্টারমশাই অমিয় দাশগুপ্তর খুব শখ ছিল, অন্তত নব্বুই বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন: আমরা নিশ্চয়ই সেই উপলক্ষ্যে তাঁকে অভিনন্দন জানাব, অভিনন্দনের ধরন-ধারণ কী হবে তার বিশদ বিবরণ জানতে চেয়ে আমাদের কাছে প্রায়ই তাঁর কৌতুকী প্রশ্ন। তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলো না, বিরানব্বুই সালের জানুয়ারি মাসে শান্তিনিকেতনে গত হলেন। গুরুপত্নীর নির্দেশে আমি আর অশোক রুদ্র মিলে মুখাগ্নি করলাম। ধনবিজ্ঞানে তদগতপ্রাণ, এই মুহূর্তে বাইরের পৃথিবীতে কী ঘটছে-না ঘটছে তা নিয়ে আপাত-আগ্রহহীন, অমিয়বাবু নিজস্ব মূল্যবোধে তথাচ অনড়। ছেলে সুবিখ্যাত ধনবিজ্ঞানী, প্রায় বিদেশী বনে গেছে, মেয়েরও দূরবর্তী ভিন রাজ্যে ব্যস্তসমস্ত জীবনযাপন। তিনি নিজে কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিখাদ বাঙালি ছিলেন, বাংলা ভাষায় কিছু লেখবার অনুরোধ জানালে সানন্দে রাজি হয়ে যেতেন। শেষের দিকে কানে শুনতে পেতেন না, তাই নাটক দেখে আর রস সঞ্চার হতো না, অথচ শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্তের প্রচণ্ড অনুরাগী। শান্তিনিকেতনে কয়েক মাস শম্ভু মিত্র তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন, শম্ভুবাবুর সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার বিবরণ আমাকে মাঝে-মাঝেই শোনাতেন। শেক্সপিয়রের নাটকেরও অসম্ভব ভক্ত, যতবার বিদেশে গেছেন, প্রায় হন্যে হয়ে ঘুরে লরেন্স অলিভিয়ের-জন গিলগুড-র্যালফ রিচার্ডসনদের অভিনয় দেখেছেন। শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথের গানে বিভোর, সুগায়ক-সুগায়িকার সন্ধান পেলে তাদের অব্যাহতি নেই। ফুলের মরশুমে নিজের হাতে বাগান করতেন, তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে শান্তিনিকেতনে পৌঁছে দেখি, বাড়ির সম্মুখবর্তী মাঠ নানা রঙের, নানা জাতের, নানা আকারের গোলাপে ছেয়ে আছে। শান্তিমাসিমাকে তাঁর মেয়ে নিজের কাছে বরোদাতে নিয়ে যত্নে রেখেছিল। মহিলা অ্যালজাইমার রোগের শিকার, স্মৃতিশক্তি এলোমেলো, কয়েকবার ওই শহরে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি, প্রতিবার গাঢ়তর অবসাদ নিয়ে ফিরেছি। কয়েক মাস হলো তিনিও প্রয়াত। পরলোকে বিশ্বাস করি না, ঈশ্বরচিন্তা অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়, তা হলেও জীবনে যা হলাম, যা পেলাম, সমস্ত-কিছুর জন্যই তো কারও-না-কারও কাছে আমরা ঋণী: আমার সর্বাধিক ঋণ গুরু ও গুরুপত্নীর কাছে।
অশান্ত অশোক রুদ্র, চিরপ্রেমিক অশোক রুদ্র, সদা-গর্বিত অশোক রুদ্র, এত রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছিল, তার দুর্মর প্রাণশক্তিও তাকে বাঁচাতে পারলো না। জীবনানন্দের পঙ্ক্তিটি তার সম্পর্কেই আমার কাছে সবচেয়ে যথাযথ মনে হয়: এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।
সুদূর কানাডা থেকে মন গভীর বিষণ্ণ করে দেওয়ার মতো আরও খবর। পরেশ চট্টোপাধ্যায় দেশ ছাড়ার পর কিছুদিন অ্যামস্টার্ডামে, কয়েক বছর বাদে মন্ট্রিয়েল চলে যান ওখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়ে, সঙ্গে সাবিত্রী ও শিশুকন্যা সুপূর্ণা, যার সঙ্গে আমার ভীষণ ভাব, যে আমাকে ‘ঘনশ্যাম’ বলে ডাকে। সাবিত্রী রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মনীষাসম্পন্না, বিদেশী ডিগ্রীধারিণী, একদা অন্ধ্র প্রদেশে জনবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তার মনটা দেশে পড়ে আছে, ফেরার জন্য প্রহর গুণছে। মনে হয় ফিরে আসার ব্যাপারে পরেশের বরাবরই দ্বিধাবোধ ছিল। ওদের যাতে এক সঙ্গে এক জায়গায় কাজ হয়, বহুবার সেই চেষ্টা করেছি। সুন্দর ব্যবস্থা হয়েছিল, প্রথমে তিরুবনন্তপুরমে, পরের বার শান্তিনিকেতনে; উভয় ক্ষেত্রেই শেষ মুহূর্তে পরেশের পিছিয়ে যাওয়া। বিদেশে আদৌ মন টেকে না, সাবিত্রী হতাশ থেকে হতাশতর, প্রায়ই আমাকে উদ্ভ্রান্ত, ক্রন্দনসিক্ত চিঠি পাঠায়। হঠাৎ একদিন নিদারুণ দুঃসংবাদ, সাবিত্রী মন্ট্রিয়েলে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে; হয়তো মায়ের শোকে, হয়তো বাবার উপর অভিমানে, কিংবা অন্য কোনও কারণে সুপূর্ণা বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেছে, আজ পর্যন্ত আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। সুরেলা গলায় আমাকে আর কেউ ‘ঘনশ্যাম’ বলে সম্বোধন করবে না।
নিকষ পদার্থবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ হয়ে খুব বেশিদিন টেকা যায় বলে আমি বিশ্বাস করি না। যাঁরা তা হলেও টিকে থাকেন, তাঁরা আমার কাছে তেমন আকর্ষণীয় চরিত্র নন, একটাই তো জীবন, অনেক ঘাটের জল না-খাওয়ার চেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার কিছু হতে পারে না; যেটুকু বরাদ্দ সময়, পরিপূর্ণ ব্যবহার না করা মহাপাতক। আমার সুতরাং বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় সময়হেলনের জন্য বিবেকদংশন নেই। হইহই করে ক্রিকেট খেলা দেখতেও নেই, পরনিন্দা-পরচর্চায়ও নেই, অথচ তারই পাশাপাশি রক্তে-ধমনীতে এই বিশ্বাস প্রোথিত, সমাজে জন্ম, সমাজ থেকে হাত পেতে উপচার গ্রহণ করেছি, বিনিময়ে সমাজকে কিছু অন্তত দিতে হবে; পড়শিদের থেকে শুধু হাত পেতে নেবোই না, তাঁদের দেববাও। এবং সেই কারণেই আমার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকার অন্তঃস্থিত আকূতি, যা কবি-সাহিত্যিক বন্ধুদের বিবমিষা উদ্রেক করে। তাঁরা ভেবে পান না যে লোকটা তাঁদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ফক্কুরি করছে, কিংবা সুচিত্রা মিত্র-জর্জ বিশ্বাসের গাওয়া গানের উন্মাদনায় ভেসে গিয়ে উথালপাথাল হচ্ছে, জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে’র কাব্য থেকে পঙক্তির পর পঙ্ক্তি আপাতঅবলীলায় আবৃত্তি করছে, সে কী করে রাজনীতির পঙ্কিল গহ্বরে স্বেচ্ছানিপতিত হয়। প্রথম-প্রথম আঁটঘাট বেঁধে যুক্তির সারণি সাজিয়ে তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করতাম, সবাই যাতে কবিতা উপভোগ করবার, গান শোনবার, খেলা থেকে আনন্দ সংগ্রহের সুযোগ সমানভাবে পেতে পারেন, সেজন্যই, যাকে তাঁরা নোঙরা রাজনীতি বলেন, তাতে আমার মজে থাকা। তবে একটা স্তরের পর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের, আমার ধারণা, যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না, তাঁরাও তাঁদের মতসমর্থক সুগঠিত যুক্তির মালা বিস্তার করে আমাকে শিক্ষিত করতে এগিয়ে আসবেন, নীট ফল অতএব শূন্য। সুতরাং মেনে নেওয়া ভালো আমরা ধেড়ে মানুষেরা বৃথাই পরকে জ্ঞান থেকে উচ্চতর জ্ঞানমার্গে ঠেলবার চেষ্টা করি; শেষ পর্যন্ত নিজেদের বিশ্বাসের খুঁটি আকড়ে ধরে থাকি প্রত্যেকেই। কবিবন্ধুরা তাই তাঁদের কাব্যচর্চায় তন্নিষ্ঠ থাকবেন, আমি নিমগ্ন থাকবো আমার বাউণ্ডুলেপনায়; উপর্যুপরি মৃত্যুশোকে বা অন্যান্য বিষণ্ণ অভিজ্ঞতার যে অনিবার্যতা এই সত্তরোত্তর জীবনে না মেনে উপায় নেই, তা মেনে নিয়েই অস্থিতিতে স্থিত থাকবো।
তবে, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নানা জায়গায় ইঙ্গিত দিয়েছেন, বা প্রতীতি ব্যক্ত করেছেন, আমরা নিরন্তর নিজেদের ছাড়িয়ে যাই। যে কবিতাপ্রেমে শৈশব থেকে ডুবে ছিলাম, ষাটের কোঠায় পৌঁছে একটু-একটু করে বুঝতে পারলাম, তা আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে। না কি আমিই কবিতার পারিজাতভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে বিচ্ছিন্নতর হচ্ছি? কবিতা যেন আখড়ায় পরিণত হয়েছে, এক কবির আঙ্গিক-রীতি-ভাষা-প্ৰয়োগকে অন্য আর এক কবির মুদ্রাদোষ থেকে পৃথক করা যাচ্ছে না, যেন সম্মিলিত প্রেতস্বরের ঐক্যতান চলছে। অর্থনীতিবিদ সম্প্রদায়ের মতো, কবিকুলও নিজেদের নিয়ে মজে আছেন, একে অপরকে সম্ভাষণ জানাচ্ছেন: তুমিও দুর্দান্ত কবিতা লিখছে, আমিও লিখছি; পরস্পরে প্রশান্ত বাহবা। কিছুদিন আগে এক মারাত্মক কাহিনী শুনেছিলাম: কোনও বিখ্যাত পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় এক কবির কবিতার মুড়ো নাকি আর এক কবির রচনার লেজের সঙ্গে তালগোল করে ছাপা হয়েছে, দ্বিতীয় কবির কবিতার মুড়োর সঙ্গে প্রথম কবির কবিতার লেজ, কিন্তু উভয় কবিই বেশ কিছুদিন এই ভ্রান্তিবিলাস আবিষ্কার করতে পারেননি। হয়তো গপ্পোই, কিংবা অতিরঞ্জন তা হলেও কাহিনীটির প্রতীকী ব্যঞ্জনা অস্বীকার করা আদৌ সম্ভব নয়: কবিদের আর আলাদা করে চেনা যায় না। ব্যতিক্রম যে নেই তা আদৌ বলছি না। আমার অন্যতম প্রিয় রচনা তারাপদ রায়ের ‘দারিদ্র রেখা’: খাঁটি কবিতা, কবিকে তাঁর বিশিষ্টতায় প্রোজ্জ্বল করে চেনানো কবিতা, অথচ যার বাচনিক সারাৎসার পেল্লাই-পেল্লাই অর্থনীতিবিদদের গালে চড় মেরে জনগণের উচ্ছ্বসিত তারিফ কুড়োবেই। পণ্ডিত-পণ্ডিত অর্থশাস্ত্রবিদরা আমাকে শূলে চড়াবেন, কিন্তু আমি আদৌ ভড়কাবো না, তাঁরা জটিল অঙ্ক কষে প্যাঁচালো সন্ধ্যাভাষায় লম্বা-লম্বা প্রবন্ধ-বই লিখে দারিদ্র্যের সমস্যা নিয়ে হাজার কাহন যা বলেন, তারাপদ এই ছোটো কবিতায় তার মর্মবস্তু জল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, পণ্ডিতরা তাঁদের সামগ্রিক চর্চায়ও যা পারেননি। অথচ সমসাময়িক অন্য অধিকাংশ বাঙালি কবিদের সম্পর্কে আমার অনীহার ব্যাপ্তি সুদূর।
যে-মাসগুলি আমি শিক্ষা কমিশন নিয়ে ব্যাপৃত, দেশের অর্থব্যবস্থায় মস্ত ওলটপালট ঘটলো। রাজীব গান্ধি অর্থনীতির বিন্দুবিসর্গও বুঝতেন না, কিন্তু চুরাশি সালের নির্বাচনে এত ভালোভাবে জিতলেন, ওঁর দৃঢ়বদ্ধ ধারণা জন্মালো দাদু বা মাতৃদেবীর চেয়েও জনগণের বেশি আস্থা তিনি অর্জন করতে পেরেছেন, এবার তাঁর খেয়াল কী করে এই হতচ্ছাড়া গরিব দেশটাকে দ্রুততম উপায়ে মার্কিন মুলুক বানিয়ে তোলা যায়। মন্ত্রিসভায় তাঁর যাঁরা বয়স্য, তাঁরাও প্রায় সবাই রাজা-মহারাজা বংশভুক্ত, বা টাকাওলা ব্যবসাদার পরিবারের। সবাই মিলে স্থির করলেন, ভারতবর্ষের অর্থব্যবস্থাকে দক্ষতম, আধুনিকতম করে তুলতে হবে, বিদেশ থেকে অঢেল যন্ত্রপাতি, নতুন প্রযুক্তি আমদানি করে কৃষি ও শিল্পের উৎপাদনকাঠামো খোলনল্চে পাল্টে দিতে হবে। তাঁদের বাড়তি বাই চাপলো: দেশের বড়োলোকরা পুঁজির পাহাড়ের উপর বসে আছেন, সেই পুঁজি না খাটাতে পারলে জাতীয় অর্থব্যবস্থার সন্তোষজনক বিকাশ অসম্ভব; অতএব সর্ব উপায়ে পুঁজিওলা শ্রেণীগোষ্ঠীর মন ভেজাতে হবে। তাঁদের আরও সিদ্ধান্ত, স্বাধীনতার পর থেকে চালু মান্ধাতা আমলের যে-আমদানি-রফতানি নীতি—বিদেশ থেকে যাবতীয় বিলাসদ্রব্য আনা বন্ধ, বৈদেশিক মুদ্রা টিপে-টিপে খরচ করা, বেসরকারি মালিকদের বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের ক্ষেত্রে কঠোর কৃচ্ছ্রপ্রয়োগ— সব-কিছুর আমূল পরিবর্তন অবশ্যকর্তব্য। যে-পাঁচ বছর রাজীব গান্ধি প্রধান মন্ত্রী, ঢালাও আমদানির এই ব্যবস্থা অব্যাহত। ফল দাঁড়ালো ভয়ংকর। এতদিন প্রতি বছর দেশের আমদানির বহর ছিল জাতীয় আয়ের বড়ো জোর পাঁচ শতাংশ; ১৯৮৯ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ালো জাতীয় আয়ের প্রায় দশ শতাংশের কাছাকাছি; যেহেতু রফতানির পরিমাণ বাড়লো না, বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি প্রকট থেকে প্রকটতর। ততদিনে নতুন-নতুন পরামর্শদাতা জড়ো হয়েছেন প্রধান মন্ত্রীর চারপাশে, তাঁরা বললেন, কুছ পরোয়া নেই, আন্তর্জাতিক বাজারে টাকা ধার করলেই তো হয়, আমরা তো এতদিন বিদেশ থেকে-যা কিছু ঋণ নিয়েছি প্রায় সমস্তই বিদেশী সরকার ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলি থেকে, তার বাইরে তেমন ঋণ নিইনি, আমাদের অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে খোলা বাজারে যথেষ্ট আস্থার ভাব আছে, ধার পেতে অসুবিধা হবে না। হলোও না। দেদার টাকা বিদেশে ধার করা হলো, ওই চার-পাঁচ বছরে সামগ্রিক বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেল। ঋণ করে ঘৃত সম্ভোগের প্রক্রিয়ায় একটি গেরো আছে, বিশেষত স্বল্প বা মাঝারি মেয়াদের ঋণের ক্ষেত্রে; কয়েক বছরের মধ্যে সুদসমেত ঋণের টাকা কিস্তিবন্দী ফেরত দিতে হয়, তখন দেশের সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারে টান পড়ে। একানব্বুই সালের মধ্যমুহূর্ত, রাজীব গান্ধির হত্যার প্রভাবে আর এক দফা ‘সহানুভূতি’ ভোট, কংগ্রেস দল কেন্দ্রে পুনরায় সরকারে ফিরেছে, নরসিংহ রাও নতন প্রধান মন্ত্রী। দিকে দিকে বার্তা রটে গেল, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় কমে যা দাঁড়িয়েছে তাতে আর মাত্র দু’সপ্তাহের আমদানির দায় মেটানো সম্ভব, তারপর শিয়রে সংক্রান্তি। এই বারতা শুধু দেশেই রটলো না, বিদেশেও। অবস্থা যা দাঁড়ালো বিদেশ থেকে বেসরকারি ঋণ সংগ্রহ যা দাঁড়ালো, অন্তত দাঁড়িয়েছে বলে প্রচার করা হলো, এখন থেকে সম্ভবপরতার অনেকটা বাইরে, যদি না জাতীয় আর্থিক রীতি-নীতি ঢেলে সাজানো হয়।।
প্রধান মন্ত্রী রূপে শপথ নেওয়ার পূর্বাহ্ণেই নরসিংহ রাও বোধহয় মনস্থির করে ফেলেছিলেন। বিভিন্ন সূত্রে ইতিমধ্যেই বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আবেদন জানানো হয়েছিল, সংস্থাদ্বয় যদি এবার ভারত সরকারের পাশে এসে না দাঁড়ায়, দেশ স্বখাত সলিলে ডুববে। কে না জানে, এই দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কলকাঠি নাড়ে খোদ মার্কিন সরকার, তার কাছেও গোপন দরবার করা হলো। বহু বছর ধরে মার্কিন সরকার, বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার এরকম একটি পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষমাণ ছিল, স্বাধীনচেতা ভারতবর্ষের সরকার কবে মুখ থুবড়ে পড়বে, বড়ো আকারের বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে নিমজ্জিত হবে, তখন পথে আসবে নতুন দিল্লি। দূত মারফত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাদ্বয়ের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে নতুন দিল্লিতে বাণী পৌঁছুলো: আপনারা অথৈ জলে পড়েছেন, আমরা বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা না করে দিলে আপনারা মারা পড়বেন, আপনাদের ফিরিয়ে দেবো না, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আপন্ন দেশগুলির জন্য আমাদের যে-স্থায়ী ব্যবস্থা আছে, যে-শর্তাবলী মানা আবশ্যিক, আপনাদেরও সে-সব মানতে হবে। শর্তগুলির ফর্দ নামতার মত করে পড়ে যাওয়া যায়: টাকার আর্ন্তজাতিক বিনিময় মূল্য অনেক কমাতে হবে, শিল্পক্ষেত্রে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রদ করতে হবে, বৃহৎ শিল্পে ও একচেটে পুঁজির উপর কোনও বিধিনিষেধ আরোপ করা চলবে না, বিদেশী পুঁজি অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে পুরোনো নিয়মকানুন রদ করতে হবে, অবাধ বাণিজ্যনীতি অনুসরণ করতে হবে, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের উপর কড়াকড়ি ক্রমশ কমিয়ে আনতে হবে, সর্বোপরি সরকারি ব্যয় তথা সরকারি খাতে বিনিয়োগ সম্যকরূপে ছাঁটতে হবে, এমনটা করলে নাকি স্বদেশ-বিদেশের বিনিয়োগকারীরা এখন থেকে ভারতবর্ষে টাকা ঢালতে আগ্রহবান হবেন। তা ছাড়া করব্যবস্থারও সংশোধন প্রয়োজন, প্রত্যক্ষ করের বোঝা যথেষ্ট না-কমালে পুঁজিপতি-ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে উৎসাহ পাবেন কেন?
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা শুরু হতেই গোপন কথাবার্তা শুরু হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নতুন দিল্লি থেকে যথাযথ জানিয়ে দিয়েছিলেন, উল্লিখিত প্রত্যেকটি শর্তই দ্রুত অথবা ক্রমশ মেনে নেওয়া হবে। তাতেও কিন্তু ওয়াশিংটনের চিঁড়ে ঠিক ভিজলো না। লাতিন আমেরিকা ও পশ্চিম এশিয়ার অনেক দেশে— অর্থাৎ মার্কিন সরকারের অনুশাসন যেখানে-যেখানে অলঙ্ঘনীয় তাদের ক্ষেত্রে— অলিখিত নিয়ম: তাদের অর্থমন্ত্রী কে হবেন তা আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার ও বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃপক্ষ স্থির করে দেবেন, মার্কিন সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে; তাঁদের আস্থাভাজন কোনও লোককে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে না বসালেই নয়। ভারতবর্ষ যেহেতু এখন ল্যাজেগোবরে, দুই আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থা ও মার্কিন সরকারের কাছে আত্মসমর্পণে প্রস্তুত, তার সরকারকেও এই নির্দেশ মানতে হবে। ওয়াশিংটন থেকে প্রথম যে-ব্যক্তির নাম বাছাই করে পাঠানো হলো, তিনি চিন্তাভাবনা করে অর্থমন্ত্রী হওয়ার আহ্বান ফিরিয়ে দিলেন; তালিকায় যাঁর নাম দ্বিতীয়, নরসিংহ রাও তাঁকে ডেকে পাঠালেন, তিনি সানন্দে-সাগ্রহে সম্মত। অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে এই ভদ্রলোকও মন্ত্রীরূপে শপথ নিলেন, মন্ত্রীদের দায়িত্ব সরকারিভাবে বণ্টন হওয়ার আগেই তাঁর অর্থমন্ত্রকে গিয়ে বসা শুরু। কয়েক দিনের মধ্যেই আলোচিত শর্তাবলী অনুযায়ী একটির পর আর একটি আত্মসমর্পণের গ্লানিজনক সিদ্ধান্ত ঘোষণা শুরু হলো, বাহারি নাম দেওয়া হলো, কাঠামোগত আর্থিক সংস্কার। খবর কাগজে আহ্লাদ ধরে না, পুঁজিপতি-সওদাগর-জমিদারদের আনন্দে ধেই-ধেই নৃত্য, ভারতবর্ষ মায়াবী আর্থিক সংস্কারের উন্মাদনায় বিভোর। এখনও সেই বিভ্রান্তির মহাক্রান্তিলগ্ন চলছে, কবে শেষ হবে কে বলতে পারে!
একটি কথা তখন মুখে-মুখে ফিরতো: হ্যাঁ, বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার যা-যা শর্ত চাপিয়েছে, সব ক’টিই গুরুভার, দেশবাসীর আপাতত কিছু কষ্ট হবে, কিন্তু কী আর করা, আমরা তো অনন্যোপায়, আমাদের সামনে কোনও বিকল্প ছিল না, ওই শর্তগুলি না মানলে দেশ সর্বনাশের অতলে ডুবে যেতো। সত্যিই কি তাই? ওই বছরগুলিতে আমদানি-রফতানির মধ্যে ব্যবধান দাঁড়িয়ে ছিল জাতীয় আয়ের শতকরা চার ভাগের কাছাকাছি। যদি জাতিকে কৃচ্ছ্রে বাঁধা যেতো, আমদানির, বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় শৌখিন পণ্যাদি আমদানির, বহর কমিয়ে আনা যেতো, কিংবা দেশের সুরক্ষার নামে নানা বাহারি অস্ত্রশস্ত্র কেনবার মোচ্ছব, বহির্বাণিজ্য ঘাটতি তা হলে অনেকটাই মিলিয়ে যেতো, বৈদেশিক মুদ্রাসংকট নিয়ে মোটেই ভুগতে হতো না আমাদের। অতীত ঋণের যে-বোঝা টানছিলাম, তা নিয়েও বিদেশী ঋণদাতাদের সঙ্গে আলাদা বোঝাপড়ায় আসা আদৌ অসম্ভব ছিল না। প্রাপ্য টাকা ফেরত না পেলে ওদেরই অসুবিধা; তা আদায় করতে আর যা-ই হোক সৈন্য পাঠাতে না ওরা, কোনও মীমাংসায় পৌঁছুতে অবশ্যই ওদের সম্মত হতে হতো, গরজ বড়ো বালাই। অতি সম্প্রতি লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে এধরনের বোঝাপড়া হয়েছে।
কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে, প্রধান রাজপুরুষদের তো আগেই গেছে, আত্মবিশ্বাস শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে, এখন আমার-যে-সব-দিতে-হবে-সে-তো-আমি-জানি পর্বের মানসিকতা। মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্তদের একটি বড়ো অংশেরও চোখ চকচক, বিত্ত-হতে-চিত্তবড়ো-এই-ভারতের-পুণ্যবাণী-র চেয়ে অসত্যভাষণ কিছু হতে পারে না; স্বাধীনতার পর চার দশক ধরে বিদেশী জিনিশের ব্যবহার থেকে তাঁদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে, এবার, কী মজা, বাঁধন খুলে দেওয়া হচ্ছে। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা উচ্ছ্বসিত, সচ্ছল বাড়ির গৃহিণীরা উচ্ছ্বসিত, সম্ভোগের জোয়ারে এবার ভেসে যাওয়ার পালা। বামপন্থীদের তরফ থেকে প্রতিবাদ জানানো হলো, তবে তাঁদের প্রভাব বা ক্ষমতা আর কতটুকু? আর এটা তো সর্ববিদিত, কমিউনিস্টরা বরাবরই দেশের স্বার্থের পরিপন্থী কথাবার্তা বলে এসেছে, মনে নেই সেই জনযুদ্ধ নীতির কথা?
এখন তো মহান আর্থিক সংস্কারের এক দশকের বেশি অতিক্রান্ত, কৃষিতে উন্নয়নের বার্ষিক হার জনসংখ্যাবৃদ্ধির হারের নিচে নেমে গেছে, শিল্প ক্ষেত্রে বিকাশের হার পূর্ববর্তী দশকে যা ছিল তার অর্ধেকেরও কম, কর্মসংস্থান সংকুচিত থেকে সংকুচিততর, বিদেশী ফরমায়েসে সরকারি খাতে বিনিয়োগ অতি দ্রুত কমিয়ে আনা হয়েছে, অথচ বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না, কর্তাব্যক্তিরা যা আশা করেছিলেন, বিদেশ থেকে শিল্পে-কৃষিতে-পরিকাঠামোয় টাকা ঢালবার বন্যা বয়ে যাবে, সেরকম কিছুই ঘটছে না। অর্ধশতাব্দী ধরে বহু তিতিক্ষায় গড়ে তোলা রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাগুলি একের পর এক বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, নয়তো জলের দরে বেসরকারি মালিকদের কাছে বিক্রি। তবে, মিছে কথা বললে জিভ খসে পড়বে, স্বীকার না করে উপায় কী, কিছু-কিছু বিদেশী বিনিয়োগ সত্যিই ঘটেছে, বিদেশীরা এসে ঠান্ডা পানীয়ের কারখানা খুলেছে, দামি ফরাশি মদ, স্কচ-হুইস্কির কারখানা, বড়ো-ছোটো-মাঝারি বিদেশী গাড়ির দিশি সংস্করণ বেরোচ্ছে, পরের পণ্যে গোরা সৈন্যে যদিও ঠিক জাহাজ বইছে না, বিদেশী জলখাবারের দোকান পর্যন্ত এখন আস্তানা গেড়ে বসেছে, ঝলমলে অলঙ্কার, দামি পোশাক, কাপড় ধোওয়ার যন্ত্র, গান শোনানোর কল, খাবার-শরীর ঠান্ডা রাখবার উপকরণ, সব-কিছু হাতের মুঠোয়, অবশ্য যদি আমাদের কড়ি ফেলবার ক্ষমতা থাকে: দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার উপরতলাবর্তী শতকরা দশ-পনেরোজনের মাত্র সেই ক্ষমতা আছে, বাকিদের নেই। শতকরা দশ-পনেরোজন খাশা আছেন, বাকি পঁচাশি-নব্বুই শতাংশ ক্লিন্নতায়-অভাবে-কর্মহীনতায় নরকের কাছাকাছি পৌঁছুচ্ছেন। পৃথিবীর সব দেশেই অভিজ্ঞতা, আর্থিক মন্দা জেঁকে বসলে, বেকারের সংখ্যা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেলে, শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। ভারতবর্ষেও গত দশ বছরে ঠিক তাই-ই হয়েছে। অল্পসংখ্যক উটকো আদর্শবাদী, কিছু-কিছু ধরাধার্য-বিপথে-যাওয়া অর্থনীতিবিদ, গোঁয়ারগোবিন্দ হয়ে সংস্কারের বিরোধিতা করে যাচ্ছেন, তাঁদের হয়তো শিগ্গিরই কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হবে, নয়তো পাগলা গারদে।
কারখানার পর কারখানা বন্ধ, দফতরের পর দফতর, শাসকবর্গের ভ্রূক্ষেপ নেই, হড়বড় করে ইংরেজি বা অন্য বিদেশী ভাষা-বলিয়ে, মড-পোশাক পরিহিত, কম্পিউটার-দূরস্ত বড়লোকদের ঘরের ছেলেমেয়েরা তো কাজ পাচ্ছে বিদেশী ব্যাংক, বীমা সংস্থায়, হোটেলে, পর্যটন ও বিবিধ বিনোদনশিল্পে, লক্ষ-লক্ষ অধস্তন কর্মীকর্মচারী মারা পড়ছেন, তাতে স্বর্গোদ্যানবাসী-বাসিনীদের চিত্তবিভ্রমের কারণ নেই।
যাঁরা সেই একানব্বুই সালে দাবি করেছিলেন, আহা, কী আনন্দ, দু’-তিন বছরের মধ্যেই দেশকে সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়া যাবে, তাঁরা উপস্থিত মৌনব্রত অবলম্বন করেছেন। সরকার অবশ্য বলবেন, আর কিছু হোক না হোক, বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার এখন উপছে পড়ছে, সাত হাজার কোটি ডলার বর্তমানে আমাদের তহবিলে, দশ বছর আগে এই অঙ্ক ছিল মাত্র একশো কোটি। বিবৃতিটিতে দু’টি জরুরি তথ্য কিন্তু সযত্নে অনুচ্চারিত: এক, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় যত, দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ তার প্রায় দ্বিগুণ; এবং দুই, বিদেশ থেকে যে-টাকা এসেছে তার বেশির ভাগই খাটানো হচ্ছে ফাটকা বাজারে, নয়তো চড়া হারে সুদ গুনছে ব্যাংকে-ব্যাংকে, এই শর্তে যে, গচ্ছিত টাকা প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা যখন খুশি বিদেশে সুদসমেত ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। বছর চার-পাঁচ আগে এশিয়ার বেশ কয়েকটি পূর্ব প্রান্তের দেশের ঘটনাবলী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, তেমন-তেমন বড়ো গোছের কোনও আতঙ্ক ছড়ালে আমাদের সাত হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক সঞ্চয় এক রাত্রেই ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
জাতীয় বিপর্যয়ের একটি সাংস্কৃতিক উপসমস্যাও আছে। স্বাধীনতার পর অর্ধশতাব্দীর উপর গড়িয়ে গেছে, দেশের ধনবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত্বে আস্থা রেখেছেন, বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন, পরস্পরের সঙ্গে বিতর্কে রত হয়েছেন, তা হলেও এতদিন মতান্তর কখনও মনান্তরে পর্যবসিত হয়নি। এবার হলো। যাঁরা বিশ্বায়ন, বেসরকারিকরণ, উদারীকরণ ইত্যাদি ব্যাপারে বিশ্বাস করেন না, স্বয়ম্ভর অর্থনীতির ভক্ত, তাঁরা সবাই এখন প্রায় একঘরে। ভারতবর্ষের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে হীনম্মন্যতার প্রভাব বরাবরই একটু বেশি, সেই সঙ্গে বিদূষণালিপ্সার। সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে কেউ তেমন সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেন না, তার একটি ব্যবহারিক দিকও আছে: সরকার তো মা-বাপ, মাইনেপত্তর জুগিয়ে থাকে, গবেষণার টাকার ব্যবস্থা করে দেয়, মাঝে-মধ্যে বিদেশে সফরেরও। সরকার যতদিন মৃদুমন্দ স্বনির্ভর অর্থব্যবস্থার কথা বলতো, কচিৎ-কদাচিৎ এমনকি ভড়ং করে সমাজতন্ত্রের কথাও, অর্থনীতিবিদরা ঝটিতি সম্মতিবাচক ঘাড় নাড়তেন। এখন থেকে প্রতীপ হাওয়া, জাতীয় সরকার পশ্চিমী ধনতান্ত্রিক দেশগুলির অঙ্গুলিহেলনে উঠছে-বসছে, অর্থনীতিবিদরা অন্য ধাঁচের কথাবার্তা বলবেন কোন সাহসে? দেশকে বিদেশী শশাষণ থেকে মুক্ত করবার জন্য দ্বিশতাধিক বৎসরব্যাপী অধ্যবসায়ে এবার চিড় ধরেছে। এক চিলতে বাড়িয়ে বলছি না, মাত্র কয়েক বছর আগে দেশের এক অর্থমন্ত্রী-লন্ডনে গিয়ে নিম্নরূপ বক্তৃত দিয়ে বসলেন পর্যন্ত: প্রভুরা, আপনারা দীর্ঘ দু’শো বছর আমাদের দেশে অধিষ্ঠান করেছিলেন, আমাদের রীতি-নীতি আচার-সভ্যতা শিখিয়েছিলেন, এবার আর একবার আসুন, ধনী অর্থব্যবস্থা তৈরি করার জাদুমন্ত্র অনুগ্রহ করে আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যান, ধন্য করুন আমাদের।
ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না, বশংবদ অর্থনীতিবিদদেরও হয় না। আর্থিক সংস্কারের ধ্বজা ওড়াতে কাতারে-কাতারে অনেক বিদ্বান-পণ্ডিত-প্রাজ্ঞ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে গেলেন: বামপন্থী বলে বাজারে যাঁদের পরিচিতি, কোণঠাসা হয়ে গেলেন তাঁরা। গোদের উপর বিষের ফোঁড়া, এক পাল দিশি অর্থনীতিবিদ, যাঁরা বিলেতে-আমেরিকায় দিব্যি গুছিয়ে বসেছেন, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাঁদের এতদিন বিশেষ ভাবনাচিন্তা ছিল না, দেশের শাসকবর্গের হঠাৎ উচ্ছ্বসিত-উদ্বেল পাশ্চাত্যপ্রীতিতে তাঁরা ভারি আরাম পেতে লাগলেন: অ্যাদ্দিন দেশটা ভুল বেগানায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, সমাজতান্ত্রিক ঝোঁক না কী সব আজেবাজে ঝামেলায় জড়িয়ে ছিল, এবার রাহুমুক্তি ঘটেছে, ভারতবর্ষ এবার ব্যক্তিগত মালিকানার হাতে তার ভাগ্য সমর্পণ করবে, বিশ্বায়িতও হবে সেই সঙ্গে, দেশের ঠাকুর ছেড়ে বিদেশী কুকুর পূজার ব্রত গ্রহণ করবে। একদা-স্বদেশের এই নতুন রূপকল্পের দিকে তাকিয়ে চিরপ্রবাসী অর্থনীতিবিদদের মুগ্ধ বিস্ময়ের সীমা নেই। তাঁদের ব্যস্ত সময় থেকে পাঁচদিন-ছ’দিন-দশদিন বের করে নিয়ে তাঁদের প্রাক্তন দেশের বুড়ি ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছেন তাঁরা, মন্ত্রীদের সঙ্গে, আমলাদের সঙ্গে গুরুগম্ভীর বৈঠক করছেন, ভিড়-ঠাসা সেমিনারে বক্তৃতা দিচ্ছেন, অজস্র অমৃতবাণী বিলোচ্ছন, অতঃপর হুড়মুড় করে ফের পাশ্চাত্যগামী বিমানে চাপছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ জনসমক্ষে অভিযোগ ব্যক্ত করে যাচ্ছেন, ভারতে এখনও মুষ্টিমেয় কিছু নামকাওয়াস্তে অর্থনীতিবিদ আছেন, যাঁরা এই বিলম্বিত মুহূর্তেও সমাজতন্ত্রের বুলি কপচাচ্ছেন, স্বনির্ভর অর্থব্যবস্থার কথা বলছেন, বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছেন, এঁদের জন্য তাঁদের— চিরস্থায়ী প্রবাসবাসী ধনবিজ্ঞানীদের— বিদেশে মুখ দেখানোর উপায় নেই; সরকারের, এবং সাধারণ মানুষের, ন্যূনতম কর্তব্য এসমস্ত এলেবেলে সমাজতান্ত্রিক-আদর্শে-এখনও-বিশ্বাসী তথাকথিত অর্থনীতিবিদদের ঝাড়বংশে নির্মূল করা। অর্থাৎ যাঁরা প্রাণপণে চেঁচিয়ে বলতে চাইছেন, আছে, বিদেশীদের কাছে আত্মসমর্পণের সম্মানীয় বিকল্প আছে, তাঁদের কণ্ঠরোধের জন্য প্রচার প্রচণ্ড বাগ্ময় হয়ে উঠেছে। যে সব পত্রপত্রিকায় স্বনির্ভরতাবিশ্বাসীদের বক্তব্য ছাপা হয়, তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাতে বিশ্ব ব্যাংক-আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের আদর্শে আস্থাহীনরা যেন নিজেদের কথা বলবার সুযোগ না পায়। এই গোছের ঘটনাবলীর একটি ব্যক্তিগত দিকও আছে। দশকের পর দশক ধরে যাঁদের বন্ধু বলে বিবেচনা করতাম, যাঁদের সংসারকে নিজের সংসার বলে ভাবতাম, যাঁরা আমাদের সংসারের সঙ্গেও একাত্ম হয়েছিলেন, তাঁরা ক্রমশ দূরবর্তী হয়ে গেছেন গত এক দশকে, এমন কি কারও-কারও সঙ্গে মৌখিক বাক্বিনিময়-প্রতিবিনিময়ও বন্ধ। বিশ্বায়নবাদীরা ‘উদারনৈতিক’ অর্থশাস্ত্রে আস্থাবান, ধনতন্ত্রে প্রত্যয়শীল; দেশের স্বার্থের সঙ্গে বিদেশী স্বার্থের বিভেদীকরণ তাঁদের চিন্তার বাইরে; অন্য পক্ষে হাতে-গোনা কয়েকজন নিকষ বিপথগামী এখনও সাম্যঘেরা সমাজের স্বপ্ন দেখেন, দেশকে সর্ব অর্থে বিদেশী প্রভাবমুক্ত করবার লক্ষ্যে চিলচিৎকারে নিমগ্ন হন, এঁদের কি কোনওদিনই কাণ্ডজ্ঞান হবে না?
অবসাদবোধের সমাচ্ছন্নতা। কয়েক অনুচ্ছেদ আগে বহু প্রিয়জনের দেহাবসানের কথা উল্লেখ করেছি। অন্তরঙ্গদের মৃত্যুর বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়, তবে তাতে দুঃখের লাঘব হয় না। সেই সঙ্গে, পটোল-চেরা দৃষ্টিক্ষেপ করে এখন দেখতে হচ্ছে, সময় অশান্ত, চোখের সামনে দেশটা বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিরোধের শক্তি অনেকেই যেন হারিয়ে ফেলেছেন, মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত।