আপিলা-চাপিলা – ১৬

ষোলো

অর্থনীতি পড়ানো-পড়ানো খেলা, রাজনীতি আলোচনার আবর্তে ডুবে যাওয়া, ‘নাউ’ নিয়ে মাতামাতি, ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার বেসরকারি সম্পাদনাকর্মে মাঝারি মনোনিবেশ, এরই মধ্যে কিন্তু অন্যান্য আরও পরিচয়ের ঢেউ, ঢেউয়ের পরে ঢেউ। অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের সঙ্গে আগে থেকেই আলাপ ছিল, স্কুলজীবন তাঁর ঢাকায় কেটেছে, আমাদের চেনা-জানার বৃত্তে সাযুজ্য, এবার কলকাতায় স্থিত হওয়ার সূত্রে তাঁর সঙ্গে পরিচয় গাঢ় হলো, বরাবরই তাঁর কাছে সপ্রীতি প্রশ্রয় পেয়েছি।

সুখময় প্রেসিডেন্সি কলেজে অমর্ত্যর সহপাঠী, ছাত্রাবস্থাতেই ওর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি, এবং ওই বয়সেই পড়াশুনার ব্যাপ্তি চমকে দেওয়ার মতো। ঊনিশশো ঊনষাট সালের গোড়া থেকে যে চার বছর বিদেশে ছিলাম, তখনই ললিতা ও সুখময়ের সঙ্গে প্রথম আলাপ, যা, বছর যত গড়িয়ে গেছে, নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়েছে, বরাবর আমাদের জীবনকে নন্দিত করেছে তুলনাহীন সৌভাগ্যে।

তেষট্টি সালের গোড়ায় যখন কলকাতায় স্থিত হলাম, ততদিনে ওরা দিল্লিতে। ললিতার মেজো ভাই অমিত ভাদুড়ী কেম্‌ব্রিজ থেকে প্রচুর তারিফ কুড়িয়ে সদ্য ফিরেছে, সে-ও দিল্লি স্কুলে যোগ দিয়েছে, কিন্তু প্রায়ই কলকাতা ঘুরে যায়; প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার মধ্যে ভালোত্ব ও মাধুর্যের সমাবেশ মুগ্ধ করে। ওদের শ্যামবাজারের বাড়িতে মাঝে-মধ্যে যাই, ললিতাদের বাবার কাছ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির আদিপর্বের বৃত্তান্ত শুনি।

বন্ধুত্বের পরিধি ক্রমশ বিস্তৃততর। ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষক নির্বাচনে চণ্ডী আমাকে অঢেল স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, তার পূর্ণতম সদ্ব্যবহার করেছিলাম। অর্থনীতি বিভাগে নির্মল চন্দ্র, রঞ্জিত সাউ, পরেশ চট্টোপাধ্যায়, সবাই বিভিন্ন প্রবাহের বামপন্থী অর্থনীতিবিদ, কিন্তু তাঁদের বামপন্থার আকাটত্বে কোনও ভুলচুক নেই, সবাইকেই ক্রমে-ক্রমে ইনস্টিটিউটের অধ্যাপকমণ্ডলীর সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হলো। তা ছাড়া, বরুণ দে’র আবির্ভাব ঘটলো; যদিও লেখার হাত চমৎকার, লিখতে তাঁর ঈষৎ অনীহা, কিন্তু বুদ্ধির দীপ্তিতে, বচনের চমৎকারিত্বে, সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারতো, এখনও দেয়। আমাদের বাঙালি সমাজে এমনই চারিত্রিক উচ্চাবচতা: বরুণের সাক্ষাৎ মেসোমশাই জীবনানন্দ দাশ, বাইরের কাউকে এই তথ্যের সত্যতা বোঝাতে গিয়ে অথচ বহুবার আমাকে গলদ্‌ঘর্ম হতে হয়েছে। আমার ছোটোখাটো কৃতিত্বের মধ্যে গর্বের সঙ্গে যা তালিকাভুক্ত করি, লিখতে-অলস বরুণকে দিয়ে ‘মহারানীর মৃত্যু’ নামে একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক, যদিও বিতর্কমূলক, প্রবন্ধ লিখিয়ে নিতে পেরেছিলাম, ‘ইকনমিক উইকলি’-তে বেরিয়েছিল।

শংকু, সত্রাজিৎ দত্ত, অজিত দত্ত মশাইর দ্বিতীয় পুত্র, তাকে আগে থেকেই চিনতাম। সে-ও তখন ‘মরকত কুঞ্জে’ আমাদের সঙ্গে। ভাবুক, স্নেহাদ্ৰহৃদয় শংকু ভিয়েতনাম পর্বে ঘোর বামপন্থী, পরে কানাডা চলে গিয়ে তার গবেষণা ও অধ্যাপনা, হঠাৎ অধ্যাত্ম চিন্তায় সমাচ্ছন্নতা। এখন প্রায় নিঃসঙ্গ, বছরে একটি মাত্র চিঠি পাই। আরো যে-দু’জন মরকত কুঞ্জে’ সহকর্মী হিশেবে প্রীতির নিগড়ে বাঁধলো, তারা তেলেগু-ভাষী কৃষ্ণজী ও মালয়ালম-ভাষী কৃষ্ণণ।

খানিক বাদে বাপ্পা—সব্যসাচী ভট্টাচার্য—পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের গোয়ালে ঢুকে পড়লো। যেমন ঢুকলেন নৃতত্ত্ববিদ সুরজিৎ সিংহ। তাঁর জীবনের মধ্যমুহূর্তে সুরজিৎ প্রাণ-মাতানো আড্ডায় ভাসিয়ে দিতেন, গলা ছেড়ে গানও গাইতেন অতি চমৎকার, যদিও অনুজা পূর্বা দামের ধারে-কাছেও না। ছাত্রাবস্থায় যে-কোনও বাঙালি যুবকের যেমন, সুরজিতেরও কবিতা লেখবার বাই ছিল। ওঁর সঙ্গে আলাপ হবার পর ‘কবিতা’-র পুরনো সংখ্যা থেকে ওঁর রচিত ‘সাঁওতাল’ কবিতা আউড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম: ‘পাড়ায় পাড়ায় যাস, সকল পাড়ায় যাস, মেয়ের পাড়ায় যাস না রে ভাই, না’। দেশ অখণ্ড থাকলে, ও সেই সঙ্গে জমিদারি প্রথাও, ভাবা যায় সুরজিতের পোশকি পরিচয় হতো ময়মনসিংহ জেলাস্থ সুষঙ্গ পরগনার মহারাজ হিশেবে। আর একবার বাঙালি সমাজের পরম্পরাগত বৈচিত্র্যের, উল্লেখ করতে হয়: তুলসীচন্দ্র গোস্বামীর সাক্ষাৎ ভাগিনেয় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বটুকদা, আর বটুকদার সাক্ষাৎ ভাগিনেয় সুরজিৎ সিংহ।

ষাটের দশকের মধ্য পর্বে ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের অধ্যাপকের ভিড়ে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কেউ-কেউ পরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হয়েছেন, মন্ত্রী-শান্ত্রী হয়েছেন, সরকারে ঢুকে বড়ো আমলা হয়েছেন, একজন-দু’জন সক্রিয় বিপ্লবী হওয়ার চেষ্টা করেছেন পর্যন্ত। প্রতিভার অমন সমাবেশ বিরল; চণ্ডীমশাইকে তারিফ জানাতে হয়। (তবে অনেক ঘাটের জল খেয়ে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি-প্রবণতার বিবর্তন ঘটে। চণ্ডী এমনিতে তাঁর অতীতদিনের হ্যারি পলিট-রজনী পালমা দত্ত মোহাবিষ্টতা নিয়ে আদৌ স্বল্পবাক্‌ নন, অন্তত আমাদের মতো কয়েকজনের কাছে তো ননই। তবে অনেক ক্ষেত্রেই যা মনে হয় আসলে হয়তো তা নয়। সম্ভবত চৌষট্টি সালের কোনও সময়, ই এম এস নাম্বুদিরিপদ গা ঢাকা দেওয়া অবস্থায় ক’দিনের জন্য কলকাতায় এসেছেন, খবর পেয়ে জ্যোতির্ময় বসুর পাসিয়ঁতে দেখা করতে গেছি, কথাচ্ছলে তাঁকে জানিয়েছি চণ্ডী আর আমি একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, শুনে ই এম এস বললেন, ‘ওকে একদিন আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে বলতে পারো?’ বার্তাটি যে-মুহূর্তে চণ্ডীকে পৌঁছে দিলাম, ওঁর চেহারা পাল্টে গেল। কী রকম ভ্যাবাচ্যাকা ভাব, আমতা-আমতা করে আমার দিকে তাকিয়ে চণ্ডীর পরামর্শ ভিক্ষা: ‘আচ্ছা, এমনটা কি হতে পারে, আমি গ্র্যান্ড হোটেলের লাউঞ্জে গেলাম একটা নির্দিষ্ট সময়ে, ই এম এস-ও তখন সেখানে চলে এলেন, অথবা এমনটাও কি হতে পারে, ই এম এস যখন মাদ্রাজের বিমান ধরতে দমদমে পৌঁছুবেন, আমিও তখন দিল্লির বিমান ধরতে ওখানে হাজির হবো, দেখা হয়ে যাবে।’ বৃথাই বাল্যে-পড়া কবিতার সেই মোক্ষম পঙ্‌ক্তি: ভয়ে ভীত হয়ো না মানব। আমি চণ্ডীকে আর ঘাঁটালাম না, ই এম এস-কে জানিয়ে দিলাম, ওঁর অনুরুদ্ধ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না।)

বন্ধুসৌভাগ্যের প্রসঙ্গে প্রত্যাবর্তন করি। নির্মল চন্দ্রকে প্রথম আমার কাছে নিয়ে আসে ওর বন্ধু অনুজপ্রতিম-অনুজপ্রতিমা অমিয় ও রত্না, যশোধরা বাগচী। অমিয় এখন ব্যস্ততম অর্থনীতিবিদ, পৃথিবীময় চরকিবাজি করছে; রত্নাও তথৈবচ, নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম সারির নেত্রী, ওদের দু’জনের সঙ্গে এখন, এই একবিংশ শতাব্দীতে, ক্কচিৎ-কদাচিৎ দেখা হয়। কিন্তু সেই যে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নির্মল নিয়মিত আসা শুরু করেছিল, সুখে-দুঃখে আনন্দে-সংকটে সঙ্গদান, তার কোনও যতিপাত ঘটেনি; বছর কুড়ি আগে অবধি একাই আসতো, তারপর থেকে নব-আহৃতা স্ত্রী রক্তবিজ্ঞানবিশেষজ্ঞা চিকিৎসক রুমা, যাঁর পোশাকি নাম শর্মিলা, তাকে নিয়ে। আমাদের নিবাসে এক সপ্তাহ ওদের অনুপস্থিতি ঘটলেই অস্থির হয়ে উঠি, টেলিফোনে-টেলিফোনে উত্ত্যক্ত করে তুলি।

অমিয়-নির্মলের দৌত্যেই নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে আমার সমীপবর্তী হওয়া, ওরা ছাত্রবয়সে কলেজে সমসাময়িক, কফি হাউসে আড্ডার শরিক, একেক জনের জীবনের প্রবাহ একেক খাতে প্রবাহিত হয়েছে, কিন্তু হৃদয়নৈকট্য বিঘ্নিত হয়নি তাতে। আমি অচিরে ‘এক্ষণ’-এর আড্ডায়ও ভিড়ে গেলাম, সেই সুত্রেই পরিচয় অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমলেন্দু চক্রবর্তীর সঙ্গে। একদা ‘চতুরঙ্গ’-এর যে সংস্কৃতি-আভিজাত্য ছিল, যা আস্তে-আস্তে মিইয়ে যায় আতোয়ারের প্রয়াস সত্ত্বেও, তা নির্মাল্য ‘এক্ষণ’-এর মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে নিবেদিত করে দিয়েছিলেন নিজেকে। নানা অসুবিধা, বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, আর্থিক অনটন, কিন্তু নির্মাল্য অবিচল, অবিকল। যাঁরা ঊনবিংশ শতকীয় বাঙালি উজ্জীবনের বড়াই করেন, তাঁদের কাছে আমার ঠ্যাটা জিজ্ঞাসা, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, ‘এক্ষণ’ পত্রিকার উৎকর্ষের কাছাকাছি একশো বছর আগে ‘বঙ্গদর্শন’ও কি পৌঁছুতে পেরেছিল? সময়বিচারের আপেক্ষিকতা মনে রেখেও এই প্রশ্ন করছি। তবে এখন তো নির্মাল্যও নেই, ‘এক্ষণ’ও নির্বাপিত।

‘নাউ’-তে গোড়া থেকেই নিয়মিত লিখতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু প্রথম পর্যায়ে তেমন আরাম পেতাম না। ইতিমধ্যে পশ্চিম বাংলায় রাজনীতির চেহারা যথেষ্ট পাল্‌টে গেছে, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীরা একটু-একটু করে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, প্রমোদ দাশগুপ্ত দক্ষিণপন্থীদের হটিয়ে দিয়ে ফের রাজ্য কমিটির হাল ধরেছেন, ‘দেশহিতৈষী’ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। ‘দেশহিতৈষী’-র অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা, সুধাংশু দাশগুপ্তের পাশাপাশি, সংখ্যাতত্ত্ববিদ, আমার প্রবীণ সুহৃদ, সত্যব্রত সেন। বিচিত্র জীবনযাপন করেছেন সত্যব্রতবাবু। বিখ্যাত রায়বাহাদুর দাদামশাইয়ের আদুরে নাতির শৈশব অপার বৈভবে কেটেছে বরিশাল শহরে। কিন্তু স্কুলজীবনেই অনুশীলন গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, কলকাতায় পড়তে এসে সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখেছেন সতত। মেছোবাজার বোমা-মামলায় গ্রেফতার হয়ে কয়েক বছর কারান্তরালে, ছাড়া পাওয়া মাত্র গুরুজন-আত্মীয়রা জেরজার করে বিলেতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখানে সংখ্যাতত্ত্বে ডিগ্রি নিয়েছেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে দেশে ফিরে কলকাতায় প্রশান্ত মহলানবিশের সদ্যস্থাপিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের জোয়ালে বাঁধা পড়েছেন, বিদ্যা, প্রতিভা ও দক্ষতায় অধ্যাপক মহলানবিশের নজর কেড়েছেন, ঊনিশশো ছেচল্লিশ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগে দায়িত্বপূর্ণ কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু স্বভাব যায় না মলে, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে স্টাফ অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেছেন, তার প্রথম সভাপতি হয়েছেন। বছর তিনেক বাদে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন, অধ্যাপক মহলানবিশের সঙ্গে জাতীয় নমুনা সংখ্যাসংগ্রহের যজ্ঞে বৃত হওয়া। মহলানবিশ মহাশয়ের এতটা প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন সত্যব্রতবাবু যে বরানগরের চৌহদ্দিতে দুষ্টু লোকেরা তাঁকে আখ্যা দিয়েছিল ‘যুবরাজ’। ফের বিদেশগমন, এবার ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী ম্যানিলায়। ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা, সেই সঙ্গে স্থানীয় সংখ্যাতত্ত্ববিদদের নমুনা-সংখ্যাবিজ্ঞানের রহস্যে অনুপ্রবেশ করানো। বছর দু’-তিন বাদে কলকাতায় ফিরে পুনরায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট। অতঃপর প্রশান্ত মহলানবিশের সঙ্গে ভাব ঘুচে যাওয়া, কাজ ছেড়ে দেওয়া, আংশিক সময়ের জন্য একটি প্রচার প্রতিষ্ঠানে সংখ্যাতত্ত্ব-পরামর্শদাতার পদগ্রহণ। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত, সপ্তাহের অধিকাংশ সময় কমিউনিস্ট পার্টির কাজে ব্যয় করবেন। সত্যব্রতবাবু ছক কেটে নিয়েছিলেন, বিদেশে-জমানো সঞ্চয় কিছুটা পার্টিকে দেবেন, বাকিটুকু সংসার পরিচালনার্থ স্ত্রীর হাতে সমর্পণ করে সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী বনে যাবেন। তিনি প্রমোদ দাশগুপ্তের বাল্যবন্ধু, মুষ্টিমেয় যে-ক’জনকে ‘তুমি’ বলে প্রমোদবাবুকে সম্বোধন করতে শুনেছি, তিনি তাঁদের অন্যতম। ভাবনাদর্শের ছক দিয়ে বিচার করলে সত্যব্রত সেন অবশ্যই আধুনিক ভাষায় কট্টর উগ্রপন্থী, আরও যে-যে বিশেষণ এই প্রসঙ্গে ব্যবহার করা যায়, সব ক’টি তাঁর রাজনৈতিক প্রবণতার নিখুঁত বিশ্লেষণে পৌঁছুতে সাহায্য করবে। চৌষট্টি-পঁয়ষট্টি সালে, এটা অবধারিতই ছিল, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যে দুটো গোষ্ঠী জন্ম নিল, সত্যব্রতবাবু সেই অবস্থায় বামপন্থীদের সঙ্গেই থাকবেন, তাঁদের অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা হিশেবে গণ্য হবেন। এই মানুষটিই অথচ সাহিত্যশিল্পরসসম্পৃক্ত, শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষের বন্ধু, অজিত দত্ত-শম্ভু সাহাদের সঙ্গে আড্ডায় মাততে ভালোবাসতেন: বাঙালি বহুমাত্রিকতা।

এক সঙ্গে অনেক কিছু হঠাৎ ঘটতে শুরু করলো। ‘দেশহিতৈষী’-র বিক্রি হু হু করে বাড়লো, বোঝা গেল তরুণ এবং মধ্যবয়সের কমিউনিস্ট কর্মী ও সমর্থকরা, যাঁদের একটি বড়ো অংশ নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উঠে এসেছেন, তাঁদের সমর্থনের উন্মুখতা কোনদিকে। বামপন্থীদের সমর্থককুলে যোগ দিয়েছেন হাজার-হাজার শরণার্থী পরিবারের ছেলেমেয়ে; ওই মুহূর্তে দেশের হাল দেখে তাঁরা চরম থেকে চরমতর পদক্ষেপের জন্য তৈরি। এক ধরনের জমিদারি-বিলোপ আইন বেশ কয়েক বছর আগে কংগ্রেস দল কর্তৃক পশ্চিম বঙ্গ বিধানসভায় গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি; জমিদার-জোতদাররা বহাল তবিয়তে আছেন, দারোগাবাবুদের সঙ্গে তাঁদের নিবিড় দহরম-মহরম। কৃষক সভার কর্মীরাও অবশ্য হাত গুটিয়ে বসে নেই, সংগঠনের শাখাপ্রশাখা তাঁরা প্রতিটি জেলায় কম-বেশি বিস্তার করে যাচ্ছেন, প্রায়ই ছোটোখাটো সংঘর্ষ ও হামলার খবর দৈনিক পত্রিকার পৃষ্ঠা জুড়ে। চীনের সঙ্গে বিসংবাদের ঋতুতে সোভিয়েট নেতাদের ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি আচরণ কমিউনিস্ট সভ্য ও সমর্থকদের অনেকটাই হতাশ করেছে। তাঁরা ক্রমশ চীন থেকে আমদানি-করা দলিল-দস্তাবেজ পড়ছেন, শরীরমন তাতিয়ে নিচ্ছেন। এরই কাছাকাছি সময়ে, লিন পিয়াও-এর গ্রাম-দিয়ে-শহর-ঘেরার তত্ত্ব ভারতবর্ষের, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার, আদর্শবাদীদের মন কাড়লো। ওই তত্ত্বের প্রয়োগ কবে থেকে আমাদের দেশে সম্ভব হবে, তা ভেবে তাঁরা চঞ্চল-উসখুশ। এমনকি বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা করার, প্রাথমিক প্রস্তুতি রচনা করারও যেন প্রয়োজন নেই, তার আগেই বুঝি গ্রামে-গ্রামে সাম্যবাদী সৈনিক তৈরি করে, তাদের ব্যূহবদ্ধ করে, কলকাতার মতো শহর ঘিরে ফেলা দরকার, বিপ্লবসাধনের প্রক্রিয়াই তো এক অর্থে খোলনল্‌চে উল্টে দেওয়ার পালা। লিন পিয়াও-সংকলিত সেই উত্তেজক দলিলটির একটি ছাপানো বয়ান একদিন সত্যব্রতবাবু আমার হাতে দিয়ে বললেন, অবিলম্বে আড়াইশো-তিনশো কপি প্রয়োজন। আমার বিবেকমুক্ত মন, সোজা ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে এসে বশংবদ টাইপিস্টদের দৌলতে স্টেনসিল কেটে নির্দিষ্টসংখ্যক কপি তৈরি করে ফেললাম।

আমার পূর্বপরিচিত, নতুন দিল্লিতে ভূপেশবাবুর-কমিউনে-অবস্থানরত দ্বিজেন্দ্র নন্দী, এরই মধ্যে বোমা ফাটালেন। রাজধানীস্থ মহাফেজখানায় তাঁর ঘন-ঘন যাতায়াত ছিল সেটা জানতাম, কিন্তু কেন যেতেন তা বোঝা গেল যখন চৌষট্টি সালের গোড়ার দিকে তিনি সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করলেন শ্রীপদ অমৃত দাঙ্গে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় লম্বা শাস্তি পাওয়ার পরও কী জাদুতে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই কারামুক্ত হয়ে এসেছিলেন, সেই রহস্য উদঘাটনের সূত্র, দাঙ্গে মশাই ইংরেজ শাসকদের কাছে গোপন দাসখত লিখে দিয়েছিলেন, দ্বিজেনবাবুর সেরকম দাবি। চারদিকে হইহই, দাঙ্গে তখনও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান, পার্টির জাতীয় পরিষদের বৈঠকে প্রচণ্ড হট্টগোল। আদর্শগত, কৌশলগত পার্থক্য, পরিষদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সদস্য সংখ্যাধিক্যের মর্জি না -মেনে বেরিয়ে এলেন। সরকারিভাবে কমিউনিস্ট পার্টি এপ্রিল মাসে দু’ভাগ হয়ে গেল। আমার পিতৃদেব তখন মৃত্যুশয্যায়। এই ভাঙনের খবরে সম্পূর্ণ বাইরের মানুষ হয়েও তিনি বাড়তি মনস্তাপে ভুগছিলেন। শ্বাসকষ্ট, প্রায়ই নাড়ি নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, তবু এরই মধ্যে আমার দিকে কাতর নয়নে চেয়ে অস্ফুটে বললেন, দেশে কমিউনিজম আসা পঁচিশ বছর পিছিয়ে গেল। ভদ্রলোক ঠিক না বেঠিক বলেছিলেন তা আজও নির্ণয় করতে পারিনি।

সংসার ভাগ হলে গৃহশত্রুতা চরমে ওঠে। কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রেও তাই হলো। প্রথম দু’এক বছর মনে হয়েছিল হয়তো দু’দিকেই পাল্লা সমান। কিন্তু বিহার ও অন্ধ্র প্রদেশ বাদ দিয়ে অন্য সর্বত্র বামপন্থী কমিউনিস্টরা, যাঁরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) নামে পরিচিতি পেলেন, অতি দ্রুত সমর্থকসংখ্যা বাড়াতে সফল হলেন। তাঁরা আলাদা পার্টি কংগ্রেস আহ্বানের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। প্রথমে অন্ধ্র প্রদেশের তেনালি শহরে ছোটো একটি বৈঠক, স্রেফ নেতাদের নিয়ে। তারপর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় কংগ্রেস, দক্ষিণ কলকাতার ত্যাগরাজ হলে। দিল্লি এবং পশ্চিম বাংলার কংগ্রেস সরকার গোড়া থেকেই বুঝতে পারছিলেন কারা শত্রু কারা মিত্র, পার্টি কংগ্রেসের প্রাক্কালে তাঁরা আঘাত হানলেন। প্রথম সারির নেতাদের বিনা বিচারে আটক করা হলো, কোনও দুর্জ্ঞেয় কারণে একমাত্র জ্যোতি বসুকে বাদ দিয়ে। মাঝারি স্তরের নেতা এবং বহু সাধারণ কর্মী, যাঁরা লুকোতে পারলেন না আবার শ্রীঘরে গেলেন, মুক্তি পাওয়ার পর এক বছর না ঘুরতেই। গুলজারিলাল নন্দ তখখন কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সংসদে ঘোর চেঁচামেচি হওয়াতে তিনি একটি বিস্তারিত ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করলেন: মাননীয় সংসদ সদস্যরা ধারণাও করতে পারবেন না বাম কমিউনিস্টরা কী ভয়ংকর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাঁরা আমাদের শত্রুদেশ চীন থেকে প্রেরণা পাচ্ছেন; তার উপর চোরাগোপ্তা পথে চে গুয়েভারার লেখা গেরিলা যুদ্ধশাস্ত্রের কেতাব তোরঙ্গ ভর্তি করে আমদানি করছেন; সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য আঁটঘাট বেঁধে তৈরি হচ্ছিলেন তাঁরা, এই অবস্থায় তাঁদের বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে, তাঁদের ফের কয়েদ না করে উপায় ছিল না! অন্য শরিকের কমিউনিস্টরা মহা খুশি, তাঁদের ধারণা হলো এবার ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারবেন! সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে আদৌ তাঁরা বুঝতে পারেননি সে সময়।

‘নাউ’ তখনও শৌখিন বুর্জোয়াদের জন্য শৌখিন নির্বিষ পত্রিকা। রাজনীতির, কিংবা কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনের, ছিটেফোঁটা নেই। ঝাঁকে-ঝাঁকে সি পি আই (এম) নেতাদের গ্রেপ্তার হওয়ার সপ্তাহে আমি ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের দপ্তরে বসে এক দুপুরবেলা ইত্যাকার গ্রেফতারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে, সরকারকে প্রচণ্ড গালাগাল দিয়ে, এক প্রবন্ধ রচনা করলাম। সেটা হাতে নিয়ে সোজা সমর সেনের সম্পাদকীয় দফতরে। সমরবাবু একটু বিচলিত, একটু দোদুল্যমান, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় পুরো লেখাটি ছাপিয়ে দিলেন। হুমায়ুন কবিরের চক্ষুস্থির, কলকাতার বামপন্থী মহলে উৎসাহের ঢল। এক সপ্তাহে ‘নাউ’-এর বিক্রি তিনগুণ বেড়ে গেল। দু’দিন বাদে বন্দীমুক্তির দাবি জানিয়ে সি পি আই (এম)-এর তরফ থেকে ময়দানে জমায়েত। সাধারণ লোকের মনে অনিশ্চয়তা, তা সত্ত্বেও যথেষ্ট ভিড়। প্রধান বক্তা জ্যোতি বসু, বলতে শুরু করার মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনি ‘নাউ’ পত্রিকা থেকে আমার লেখা সেই সম্পাদকীয় নিবন্ধটি পুরো পড়ে শোনালেন, সঙ্গে-সঙ্গে তা বাংলাতেও অনূদিত হলো। জ্যোতিবাবু সবশেষে তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে মন্তব্য জুড়ে দিলেন, ‘শুনতে পাই পত্রিকাটির মালিক নাকি হুমায়ুন কবির’। পরদিন সমরবাবুর কাছে যখন জ্যোতিবাবুর মন্তব্যের উল্লেখ করলাম, তাঁর একটি বিরক্তিসূচক রূঢ় শব্দের উচ্চারণ। হয়তো সমরবাবু আশঙ্কা করছিলেন, তেমন বেশি মাতামাতি-কানাকানি হলে হুমায়ুন কবির অচিরেই রাশ টানবেন।

কবির সাহেবের চিন্তান্বিত হওয়ার যথার্থ কারণ ছিল। আমি আগল খুলে দিলাম, সমরবাবু নিজেও এখন থেকে গরম-গরম রাজনৈতিক মন্তব্য-ঠাসা সম্পাদকীয় লেখা শুরু করলেন, আমার লেখা তো অব্যাহত ছিলই। কিছুদিনের মধ্যেই প্রতি সপ্তাহে একটি করে কলকাতা ডায়েরিও লিখতে শুরু করলাম, নিজের নামের ইংরেজি আদ্যাক্ষর এ এম ব্যবহার করে। পরে কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ঊনিশশো বাহাত্তর সালে ডায়েরিটির ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-তে পুনর্জন্ম হয়। তার আয়ু এখনও ঠিক ফুরিয়ে যায়নি, তবে, আমার সন্দেহ মহীনের বুড়ো ঘোড়াদের মতো এখন তার হাল।

কাকতালীয় হতে পারে, না-ও পারে, যে কারণেই হোক, ‘নাউ’ যতই উগ্র বামপন্থী চেহারা নিল, বিক্রি ততই বাড়লো। ক্রমে দশ হাজার ছাড়িয়ে গেল। কোথায় তিনি খুশি হবেন, হুমায়ুন কবিরের কপালে ভাঁজ। তিনি পুরোপুরি আশা তখনও ছাড়েননি, হয়তো ভেবেছিলেন সমরবাবুর সাময়িক বিপথগমন, শুধরে নেবেন। এটা তো মানতেই হয়, হুমায়ুন কবির অতীব ভদ্রলোক ছিলেন, তদুপরি সমরবাবু তাঁর সাক্ষাৎ ছাত্র, অতি প্রিয় ছাত্র। সমরবাবুর ঠোঁটকাটা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর তো পরিচয় ছিল, পর্যাপ্ত ভয়ই পেতেন প্রিয় ছাত্রটিকে।

নেতারা অধিকাংশই কারান্তরালে, কয়েক সপ্তাহ বাদে জ্যোতিবাবুকেও কয়েদ করা হলো। কিন্তু সি পি আই (এম)-এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব বোধ করা গেল না। চীন যুদ্ধের সময় ও তার পরবর্তীকালে যে-কংগ্রেস সরকার পশ্চিম বঙ্গে প্রশাসনের দায়িত্বে ছিল, তা সর্ব অর্থে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। প্রত্যন্ত গ্রামেও ক্রমবর্ধমান অশান্তি, কলকাতা, শহরতলি ও মফস্বলে, গ্রামে-শহরে। অগুন্তি মিছিলের ঠাসা সমারোহ, সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী ঝোঁক উঁচু মাত্রায় উঠে যাওয়া। এমনটা না হলেই প্রকৃতিবিরুদ্ধ হতো; নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিশপত্রের দাম নিত্য বাড়ছে, খাদ্য সরবরাহে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ঘাটতি, গ্রামে জোতদার-পুলিশের যৌথ বিক্রম।

এই পটভূমিকাতেও অথচ, কেউ-কেউ বলবেন অবধারিত, কমিউনিস্টদের অর্ন্তদ্বন্দ্ব। এক পক্ষে, ক্রুশ্চেভের প্রতিধ্বনি তুলে, স্ট্যালিন-নিন্দা, অন্য পক্ষে কিন্তু স্ট্যালিন-বন্দনা অব্যাহত। আদর্শবৈষম্যের সঙ্গে ক্রমে ব্যক্তিগত সংঘাতের সংযোজন। বামপন্থীরা স্ট্যালিনের এতটুকু অসম্মান হতে দেবেন না, দক্ষিণপন্থীরা উগ্র স্ট্যালিনবিরোধী। একমাত্র ব্যতিক্রম অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, তিনি বরাবর দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে আছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে স্ট্যালিনভক্তিতেও অবিচল।

ওই বাজারে বামপন্থী কমিউনিস্টরা যেহেতু চীনের সঙ্গে সীমান্তসংঘর্ষ আলাপ-আলোচনান্তে মিটিয়ে আনতে আগ্রহবান, সরকারের পেটোয়া খবর কাগজমহলের মতে তাঁরা আসলে ‘দেশদ্রোহী’। সম্ভবত পঁয়ষট্টি সালের এক বসন্তসন্ধ্যা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে সংবাদপত্র জগতের এক কেষ্টবিষ্টুর সঙ্গে আলাপ হলো, ভালোই লাগলো আলাপ করে। ক’দিন বাদে অরুণকুমার সরকারের সঙ্গে দেখা, উক্ত ভদ্রলোক অরুণকে বলেছেন, ‘তোমার বন্ধু অশোক মিত্রের সঙ্গে পরিচয় হলো। এমনিতে তো ভদ্রই ঠেকলো, তবে দেশদ্রোহী কেন?’

পঁয়ষট্টি সালের মার্চ মাসে, সদ্য-স্বাধীন আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার শহরে ওদেশের কর্তৃপক্ষ একটি অ্যাফ্রো-এশীয় আর্থিক সম্মেলনের ব্যবস্থা করলেন, অনেকটা সেই আটচল্লিশ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনের ধাঁচে: সারা পৃথিবীর কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট-ভাবাপন্নদের মিলনোৎসব। ঘোষিত উদ্দেশ্য আলজেরিয়ার যুদ্ধজয়কে, স্বাধীনতালাভকে, বন্দনা জানানো। এই স্বাধীনতা তো মুফতে আসেনি, অনেক রক্ত ঝরেছে, নারী-পুরুষ-শিশুর অনেক আত্মাহুতি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলজেরিয়ার টগবগে আরব প্রজাকুল খোলা আকাশের নিচে স্বাধীন নিঃশ্বাস নেওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন। উপনিবেশবিলাসী ফরাশি বাসিন্দারা কেউ-কেউ ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তন করেছেন, কারও-কারও মরোক্কো বা ট্যানজিয়ার্সে প্রস্থান; অনেকে পালিয়ে গিয়েছেন সংগোপন গ্রামে। এখন নব অরুণোদয়ের জয় ঘোষণা, সেই উদ্দেশ্যেই সম্মেলনের উদ্যোগ, পৃথিবীব্যাপী উপনিবেশ-বিরোধী বিপ্লবী সংগ্রামের দুন্দুভি সূচনা। এই সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি যে-ছয় জন গিয়েছিলাম, তাঁদের দলপতি আমার শিক্ষক অমিয় দাশগুপ্ত মহাশয়। বাকি পাঁচজন প্রত্যেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত, অথবা পার্টির কাছাকাছি। ইতিমধ্যে সোভিয়েট-চীন রেষারেষি চরমে গিয়ে ঠেকেছে। সম্মেলনে পৌঁছে দেখা গেল, চীনে প্রতিনিধিরা যা বলছেন, সোভিয়েট প্রতিনিধিরা সঙ্গে-সঙ্গে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, যুক্তির সারবত্তা সে-প্রতিবাদে থাকুক না থাকুক, কিছু যায় আসে না। ভারতবর্ষ থেকে যাঁরা গেছেন, মাস্টারমশাই ও আমাকে বাদ দিয়ে, সবাই সোভিয়েট-অনুসারী, আমার সঙ্গে খুচখাচ দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। তবে এ সমস্ত বিসংবাদ ছাপিয়ে আমাদের চেতনা জুড়ে নবলব্ধ স্বাধীনতা নিয়ে আলজেরিয়দের উল্লাসের উন্মাদনা। বিদেশী অতিথিদের প্রতি তাঁদের চুঁইয়ে-পড়া সম্প্রীতি। অর্থনৈতিক সম্মেলন নয়, যেন আমরা এক মহোৎসবে যোগ দিয়েছি। মেয়ে-পুরুষ সবাই আশ্চর্য সুন্দর, কিছু-কিছু মহিলা তখনও বোরখার আড়ালে, কিন্তু স্বাধীন দেশ, তাঁরাও জানেন এখন থেকে মুক্তির নিঃশ্বাসে তাঁদের সমান অধিকার, বোরখার আড়াল থেকে তাঁদের সহাস্যমুখ বেরিয়ে আসছে। দৃপ্ত হাত আকাশের দিকে উঠছে, নামছে; বোরখার নিম্নপ্রান্ত থেকে যে-সুডৌল পায়ের আভাস, তাতেও উচ্ছল হরিণীর গতি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম প্রধান হোতা ও নব-নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, বেন বেল্লা, আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এলেন। চমৎকার ভাষণ দিলেন, আমরা অভিভূত। অভিভূত হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল: হঠাৎ সম্মেলনের বিশাল কক্ষে গুঞ্জন, খবর এসেছে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কিউবার প্রতিনিধিবৃন্দ এসে পৌঁছুবেন, তাঁদের নেতা স্বয়ং চে গুয়েভারা। আমরা চমকিত, আমরা আলোড়িত। একটু বেশি রাত্রে গুয়েভারা এলেন, মঞ্চময় হর্ষধ্বনি। সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, আগাগোড়া সৈনিকের ফিকে সবুজ পরিধেয়। সৌম্য মুখমণ্ডল, গালময় একটু-একটু হাল্কা দাড়ি। চে দু’ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিলেন। কিউবা যুদ্ধ আর আলজেরিয়ার যুদ্ধ যে একই সংগ্রাম, গোটা পৃথিবীতে নিপীড়িত মানুষের যুদ্ধের যে কোনও দেশবিভাগ নেই, সে বিষয়ে বিস্তৃত হলেন। পৃথিবীময় মার্কিন অর্থনৈতিক শোষণের চিত্র বিশ্লেষণ করলেন, সভাকক্ষময় ঘন-ঘন উচ্ছ্বাসমন্দ্রিত করধ্বনি, ঘন-ঘন লাল সেলামের বজ্রমুষ্টি উত্তোলন। গুয়েভারার ভাষণ শেষ, প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে অনুরোধ জ্ঞাপন করা হলো, তাঁরা সার বেঁধে মঞ্চে যাবেন, গুয়েভারার সঙ্গে করমর্দন করে কৃতার্থ হবেন। তিনি সানন্দে রাজি।

আমার যখন পালা এলো, আমার মাথা তাঁর ঘাড়েরও নিচে, হঠাৎ অমিত শক্তিশালী তিনি আমাকে দু’হাতে শূন্যে ছুঁড়ে সঙ্গে-সঙ্গে ধরে ফেলে আলিঙ্গনবদ্ধ করলেন। তারপর যা বললেন, তার সারমর্ম: ‘আমি শুনতে পেলাম তোমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমার সম্বন্ধে কীসব ভয়াবহ উক্তি করেছেন, আমি নাকি কীসব খারাপ কথাবার্তা লিখে তোমাদের কুপরামর্শ দিয়েছি, তোমাদের খারাপ জিনিশের জোগান দিয়েছি। দোহাই, তুমি দেশে ফিরে তাঁকে বোলো, আমার মতো নির্দোষ শান্তিপ্রিয় মানুষ হয় না, তুমি নিজেই তো দেখছো, আমার দশটা হাত-দশটা পা নেই’। সেই সঙ্গে অট্টহাস্য।

আলজেরিয়া থেকে ফিরে আসার এক মাসের মধ্যেই দুটো মস্ত খবর আমাদের কাছে পৌঁছুল, অবসন্ন বোধ করলাম। প্রথম খবর, আলজেরিয়ায় অভ্যুত্থান ঘটে গেছে, বেন বেল্লা আর রাষ্ট্রপতি নন, তাঁর জায়গায় অন্য একজন ক্ষমতা দখল করেছেন, যাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তখনও তেমন স্পষ্ট নয়। অন্য যে সমাচার সারা পৃথিবীকে যুগপৎ বিভ্রান্ত ও মোহিত করলো, চে গুয়েভারা আর কিউবাতে নেই, তিনি লাতিন আমেরিকার দেশে-দেশে বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্ব সূচনার তাগিদে উধাও হয়ে গেছেন, পাহাড়ে-জঙ্গলে তখন থেকে তাঁর প্রব্রজ্যা, সঙ্গে মাত্র গুটিকয় বিশ্বস্ত কমরেড। এখন ভেবে বিস্ময় লাগে, যে-ক’জন মুষ্টিমেয় ভারতীয় চে গুয়েভারার সঙ্গে করমর্দন করেছেন, আলিঙ্গনবদ্ধ হয়েছেন, আমি তাঁদের অন্যতম। বয়স গড়িয়ে গেছে, আমি বার্ধক্যের দরজায় উপনীত, তবু বারংবার মনে হয়, এই সৌভাগ্যের তুলনা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *