বাইশ
কলকাতায় প্রত্যাবর্তন, তবে জীবিকার কথাও তো একটু ভাবতে হয়! মুশকিল আসান করে দিলেন ভারতীয় সমাজবিজ্ঞান পরিষদের কর্ণধার জয়ন্ত নায়ক। আমি পরিষদের। প্রতিষ্ঠামুহূর্ত থেকে পরিচালকমণ্ডলীর অন্যতম, হয়তো চক্ষুলজ্জাবশত, হয়তো করুণাবশত, দিল্লি ছাড়ার প্রাক্মুহর্তে পরিষদের জাতীয় ফেলোশিপ গ্রহণ করার জন্য নায়ক আমাকে অনুরোধ জানালেন। কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁর দত্ত সুযোগ গ্রহণ করলাম, বন্ধু— ও রাজনৈতিক বৈরী— মোহিত সেনের মেজদা পোটলার সৌজন্যে কলকাতায় গৃহসমস্যারও একটি সন্তোষজনক নিরসন ঘটলো। পোটলা হায়দরাবাদস্থ এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফ কলেজ অফ ইন্ডিয়ার অধ্যক্ষ, ওদের কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া ছিল, আমি ব্যবহারের জন্য পেলাম এই শর্তে যে, বছরে বার কয়েক হায়দরাবাদে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে আসবো। হিতেন চৌধুরী তখন ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-র স্বত্ত্বাধিকারী সমীক্ষা ট্রাস্টের কার্যনির্বাহী অছি, সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন প্রতি সপ্তাহে যেন ই. পি. ডাবলিউ-র জন্য কলকাতা ডায়েরি লেখা শুরু করি, সেই সঙ্গে একটি-দু’টি সম্পাদকীয় মন্তব্য। সুতরাং কলকাতায় সময়ের ফাঁক বলে কিছু রইলো না। তবে কংগ্রেসি রাজত্ব, হাজার-হাজার রাজনৈতিক কর্মী বিনাবিচারে বন্দী, অনেকে পাড়া ছাড়া, ঘর ছাড়া, প্রতিপক্ষ কোনও রাজনৈতিক দলের সভা-মিছিল করার অধিকার নেই, সংবাদপত্রগুলি কেন্দ্র এবং রাজ্যের কংগ্রেসি সরকারের ধামা ধরে আছে, একমাত্র সমর সেন ‘ফ্রন্টিয়া’র-এ তির্যক বিদ্রুপ ও কষাঘাতের ফুলঝুরি ছড়িয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু প্রধান প্রতিপক্ষ দল সম্পর্কেও তাঁর তো সমান অনীহা। একটি-দু’টি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা, যেমন হীরেন বসু-র ‘দর্পণ’, প্রতিবাদে মুখর, কিন্তু ক’জন আর সেগুলি পড়েন?
এই প্রথম ছাত্রাবস্থার পর রাজনীতির অঙ্গনে যথার্থ সক্রিয় হয়ে উঠলাম। জ্যোতিবাবু-প্রমোদবাবুদের সঙ্গে ঘন-ঘন দেখা হয়, আলাপ-আলোচনা-পরামর্শ, এঁরা দু’জনেই সেই সময় নিয়মিত ই পি ডব্লিউ পড়ছেন, আমার বদমেজাজি প্রবন্ধাদি পাঠ করে ভারি খুশি। সত্যব্রত সেন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী তথা নেতা, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলি, পার্টির বিভিন্ন গণসংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত থাকি। জীবনযাপনকে কয়েকটি ভাগ করে নিতে কোনও অসুবিধা হতো না। সমাজবিজ্ঞান পরিষদের জন্য দেশের হালের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে তত্ত্বের মিশেল-দেওয়া বই লিখছি, সপ্তাহে একদিন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়াতে যাচ্ছি, রাজনীতির তখন-খুব-অনিশ্চিত ভিড়ে জুটছি। সাহিত্যিকদের সামীপ্যেও আলাদা ঘোরাফেরা-মেলামেশা।
পুরনো অনেক রাজনৈতিক বন্ধু দূরে সরে গেছেন, নতুন সৌহার্দ্য ঘটেছে। যাঁরা সরে গেছেন তাঁদের হয়তো পাল্টা অভিযোগ দায়ের করতে পারতেন, আমিই আস্তে-আস্তে গোঁড়া সংকীর্ণতাবাদীরূপে পরিণত হচ্ছি। তবে, এখনও বলবো, আমার দিক থেকে রাগ-বিরাগের পর্যাপ্ত কারণ ছিল। একটি ঘটনার কথা বলি। একাত্তর সালের মার্চ মাস হয়তো বা, বিধানসভার নির্বাচনের তারিখ অত্যাসন্ন, আমি দিল্লিতে, কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে ভোট দিতে কলকাতায় এসেছি, একদিন দক্ষিণপন্থী এক কমিউনিস্ট কবির গৃহে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পার্টির বহুদিনের পুরনো একনিষ্ঠ সদস্য, আমাকে কাতর অনুরোধ জ্ঞাপন করলেন: আমি ভারত সরকারে ভালো জায়গায় আছি, তাঁর ধারণা তাঁকে সাহায্য করতে পারবো। তিনি নিজে যদিও ঘোর দক্ষিণপন্থী, তাঁর ছেলে উগ্র নকশালপন্থী, কোথায় বোমা ছুঁড়ে দেওয়াল টপকে পালাতে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। আপাতত আদালতের জিম্মায় আছে, তবে যে-কোনও দিন পুলিশ আর্জি জানালে বিচারক সম্ভবত তাঁকে পুলিশের হেফাজতে তুলে দেবেন; পুলিশ এমন অকথ্য প্রহার শুরু করবে যে তাঁর ছেলে মারা যাবে, নয়তো চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে থাকবে। ভদ্রলোকের একান্ত প্রার্থনা, আমি যদি সরকারি মহলে প্রভাব খাটিয়ে তাঁর সন্তানকে আদালতের জিম্মায় রেখে দেওয়ার ব্যাপারটা পাকা করতে পারি। সাধুজনরা তো বলেন, মানুষের উপকার করতে হয়। রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব, যিনি তখন অতিরিক্ত মুখ্যসচিবও, তাঁকে গিয়ে বললাম, কাজ হলো, ছেলেটি আদালতের জিম্মাতেই রইলো। পিতা ভদ্রলোক আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানালেন, তবে ভোটের দিন সন্ধ্যাবেলা সেই কবির বাড়িতে বসে আছি, ভদ্রলোকের শুভাগমন, একগাল হেসে বললেন: ‘জানেন, এবার ভোটটা কংগ্রেসকেই দিলাম’। কবি হয়তো নিমিত্তমাত্র, তা হলেও তাঁর বাড়িতে আর কোনওদিন পা রাখিনি।
‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখি, অরুণকুমার সরকারের প্রাত্যহিক সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করি, পুরনো বন্ধু সুরঞ্জন এখন খুব কাছাকাছি থাকেন, সমরবাবুর বাড়িতেও সপ্তাহে এক দিন-দু’ দিন নিয়ম করে যাই, ওঁর দাদারা আসেন— অমলদা, গাবুদা, অমলদার মতো পরোপকারী মানুষ জীবনে দেখিনি— অনেক খোশগল্প হয়। সমরবাবু আমাকে লিখতে বলেন না, জানেন অনুরোধ করে কোনও লাভ হবে না, তবে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুট। দিল্লিতে থাকার শেষ বছর ওঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা বীথি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে, আমরা খানিকটা দেখাশুনো করি, সমরবাবু ও সুলেখা সেন তা নিয়ে আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ, সুতরাং সুইনহো স্ট্রিটে আমার আড্ডা অব্যাহত, রাজনৈতিক মতপার্থক্য যাই-ই হোক না কেন। অবশ্য, যে কথা আগেও উল্লেখ করেছি, তরল-গরল গলাধঃকরণ করলে সমরবাবু অত্যন্ত কড়া-কড়া কথা বলতেন, আমার রাজনৈতিক ঝোঁক নিয়ে ব্যঙ্গ করে, আমার গায়ে লাগতো না।
ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটে: বই লেখার কাজ করছি, প্রতি সপ্তাহে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-র জন্য কলকাতা ডায়েরি ও সম্পাদকীয় মন্তব্য, বহু ধরনের কর্মসূচি, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক সমিতির বার্ষিক অধিবেশনের জন্য সভাপতির ভাষণ মকশো করছি, আতোয়ার রহমানকে ‘চতুরঙ্গ’-এর সম্পাদনায় সাহায্য যোগাচ্ছি, নানা রাজনৈতিক-আধারাজনৈতিক সভাতে গিয়ে বক্তৃতা কপচাচ্ছি, এন্তার গ্রুপ থিয়েটারের নাটক দেখে বেড়াচ্ছি, অর্থনীতিবিদ্ ও অন্যান্য ব্যক্তিগত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার অনবচ্ছিন্ন প্রবাহ।
কয়েক মাসের ব্যবধানে কিছুদিন ফের দিল্লিতে কাটিয়ে এলাম, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় অর্থনীতিবিদ বন্ধুদের আমন্ত্রণে। তাঁরা আমি যে-বইটি লিখছি, অধ্যায় ধরে-ধরে তার ব্যাখ্যাবিশ্লেষণসহ একপ্রস্থ বক্তৃতার ব্যবস্থা করলেন। আমার সীমিত চৌহদ্দির অর্থনীতিতে রাজনীতির মিশেল, ইতিহাস-দর্শনেরও, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় ছেঁকে ছেলেমেয়েরা শুনতে আসতো, ব্যাপক অংশগ্রহণ সব মহলের। খুব আনন্দে কেটেছিল ওই ঋতুটি, সেই সঙ্গে বিনোদনেও। মানসিকতার দিক থেকে নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা অধিকাংশই আমার কাছাকাছি, তাঁরা আদরে ঘিরে রেখেছিলেন। প্রভাত পট্টনায়ককে আগেই চিনতাম, এই পর্বে তাঁকে জানা হলো। ওর কথা পরে অবশ্যই আরো বলতে হবে: অর্থনীতিবিদ হিশেবে অবশ্যই সে সর্বোত্তম পর্যায়ভুক্ত, কিন্তু ভালোমানুষ হিশেবেও তার তুলনা নেই। সকাল-সন্ধ্যা বন্ধুরা সবাই এক সঙ্গে ঘুরতাম, একসঙ্গে খেতাম, আনন্দ করতাম, পরচর্চায় নিয়োজিত হতাম। অমিত ভাদুড়ী ও তাঁর স্ত্রী মধু ভাল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি-নিবাস থেকে ভালোবাসার জোর খাটিয়ে আমাকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে তুললো, পরম বিলাসে ছিলাম সেই ক’সপ্তাহ৷ ভোরবেলা প্রাতরাশের টেবিলে আমার আনাড়িত্ব আঁচ করে মধু ছোটো বোনের আদর ঢেলে আমার জন্য বরাদ্দ আধাসেদ্ধ ডিম ভেঙে দিত, স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করতাম। অসাধারণ প্রতিভাবতী অর্থনীতিবিদ, কৃষ্ণা ভরদ্বাজ, রাগসংগীতচর্চায়ও সমান পারদর্শিনী, ততদিনে সে-ও জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। কৃষ্ণা ও তার কন্যা সুধার সান্নিধ্যও সমান আনন্দ দিয়েছে ওই এক মাস-দেড় মাস।
কলকাতাস্থ অনেক বন্ধুরই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমার দুস্তর তফাত, কিছুমাত্র ক্ষতি হতো না তাতে। রবিবার সকালে আমাদের ফ্ল্যাটে ভিড়-ঠাসা আচ্ছা, কবি-সাহিত্যিক ছাড়াও অনেক গোত্রের মানুষ আসতেন। যাঁর কথা বিশেষ করে মনে পড়ছে, তিনি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রভাবে তিনি চল্লিশের একটি বিশেষ সময়ে কিছু ‘সাম্যবাদী’ কবিতা যদিও লিখেছেন, আসলে তিনি অত্যন্ত সরল মানুষ, রাজনীতির আপাতজটিলতায় পথ খুঁজে পাওয়া তাঁর সাধ্যের বাইরে। প্রথম জীবনে মস্ত সাহিত্যকীর্তির যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা তাঁর মধ্যে ছিল, তা বিবিধ কারণে মিলিয়ে যায়। জীবনে ব্যর্থ ব্যক্তিদের প্রতি আমার বরাবরই কেন যেন অতল সহানুভূতি, হয়তো নিজেও ব্যর্থ বলে; কামাক্ষীপ্রসাদকে বরাবরই খুব কাছের মানুষ মনে হতো। ব্যর্থতার অভিশাপ তাঁর দিনযাপন ঘিরে, তা হলেও অমন সরল স্বচ্ছ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়া যে-কারও পক্ষেই সৌভাগ্যের। কামাক্ষীপ্রসাদও গত হয়েছেন দীর্ঘ পঁচিশ বছর হলো, কিন্তু তাঁর স্ত্রী একদা-অসামান্যা-সুন্দরী পরম সৌজন্যবতী রেখা ও মেয়ে রুনুর সঙ্গে যথাসম্ভব যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি।
সবচেয়ে বেশি আড্ডা দিতাম অবশ্য স্নেহাংশু আচার্যের ওখানে। স্নেহাংশুবাবুর গল্পের ভাণ্ড অফুরন্ত, হেসে পেটে খিল ধরে যেত, তা ছাড়া, পূর্বেই উল্লেখ করেছি, তিনি এবং সুপ্রিয়া আচার্য সমপরিমাণ অতিথি-বৎসল। বাইরে হাসি-মস্করা যতই করুন না কেন, স্নেহাংশুবাবু রাজনৈতিক বিশ্বাসে অব্যয়-অচঞ্চল, জ্যোতি বসু ও প্রমোদ দাশগুপ্ত উভয়েরই মস্ত অবলম্বন। এই দুই নেতার মধ্যে প্রকৃতিগত অনেক তফাত ছিল, অথচ স্নেহাংশুবাবুর সঙ্গে দু’জনেরই সমান নৈকট্য। বেকার রোডের ওই বাড়িতে অবশ্য বিচিত্র চরিত্রের আরও নানা মানুষ আসতেন, বিচারক-ব্যারিস্টার থেকে শুরু করে ডাক্তার-কবিরাজ, কবিয়াল-সঙ্গীতজ্ঞ, খেলোয়াড়-ধড়িবাজ, কে না। একমাত্র যাঁদের দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট বলে সন্দেহ করতেন, স্নেহাংশুবাবু দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না তাঁদের।
অন্য দু’একজন বন্ধুর কথা বলি। আগে থেকেই ছুটকো-ছাটকা দাঁতের মেরামতির জন্য ওয়াটারলু স্ট্রিটে গোপাল বাঁড়ুয্যের কাছে যেতাম, এবার নতুন করে কলকাতায় স্থিত হয়ে ওঁর বাড়ি তথা চেম্বার অন্যতম প্রধান আড্ডাস্থল হয়ে উঠলো। বিখ্যাত দন্তচিকিৎসক বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় তাঁর দুই ভাগিনেয় গোপাল বাঁড়ুয্যে ও বারীন রায়কে তাঁর চেম্বার-এর উত্তরাধিকার অর্পণ করে যান। উভয় ভাগিনেয়ই মামার মতো উদারপ্রাণ, নম্র, পরোপকারী। তাঁর মাসতুতো দাদার প্রতি বারীনের প্রায় লক্ষ্মণসুলভ ভক্তি। শুধু দন্তসংক্রান্ত নয়, যখনই যে-সমস্যা নিয়ে তাঁদের কাছে উপস্থিত হয়েছি, অভয় মিলেছে। গোপাল বাঁড়ুয্যে খাওয়াতে ভালবাসতেন, বেশ কয়েক বছর হলো তিনি প্রয়াত, বারীন কিন্তু তাঁর দাদার ঐতিহ্য সসম্মানে বজায় রেখেছেন। ওই চেম্বারের সঙ্গে অন্য যাঁরা কর্মরত, তাঁদের সবাইকেও আত্মার আত্মীয় বলে মনে হয়। তিন ওয়াটারলু স্ট্রিটের আড্ডার চরিত্র যথার্থই বহুমাত্রিক। তাঁদের বৃত্তির সূত্রেই গোপাল-বারীনদের সমাজের বহু অংশের, বহু স্তরের ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মিশতে হতো এবং হয়, বিভিন্ন কিসিমের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা যেমন আসেন, তেমনি আসেন অভিনেতা-অভিনেত্রী-কবি-সাহিত্যিক-ঔপন্যাসিক-গল্পলেখক-সম্পাদক-শিল্পী-ভাস্কর-সঙ্গীতজ্ঞ। এখানে উৎপল দত্ত-শোভা সেনকে দেখা যেত, দেখা যেত শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রকেও, এখন যেমন দেখা যায় শাঁওলিকে। আসতেন পাহাড়ী সান্যাল, চারুপ্রকাশ-জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ভ্রাতৃদ্বয়, অন্যদিকে সমর সেন পর্যন্ত। এক সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে, সম্ভবত ছেষট্টি সাল, চেম্বারের দুই এলায়িত চেয়ারে দুই অশোক মিত্রের দাঁতের পরিচর্যায় ব্যস্ত সর্বজনপ্রিয় গোপাল ডাক্তার; এমন সমাপতন নিশ্চয়ই বিরল। ঘোর বিপ্লবী রবি সেনগুপ্ত, গোপাল বাঁড়ুয্যের হরিহরআত্মা বন্ধু, ওখানে নিয়মিত হাজির থাকতেন, থাকতেন অন্য বিপ্লবী সুহৃদ অমর রাহাও; তবে তাঁদের রাজনীতি ওয়াটারলু স্ট্রিটের বাসিন্দারা, আমার ধারণা, তেমন ধর্তব্যের মধ্যে আনতেন না। মাসতুতো দাদা বিগত, বারীনের ওখানে অন্য সকলের সঙ্গে ‘দেশ’-‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার লোকজনও সদা উপস্থিত, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
কলকাতার তরুণতর অর্থনীতিবিদ বন্ধুরাও অবশ্য অহরহ সঙ্গ দিত: অমিয় বাগচী, নির্মল চন্দ্র, সঞ্জিত বসুদের বাইরেও অনেকে। তবে বহু ক্ষেত্রে তাঁদের প্রধান আগ্রহের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে বেগ পেতে হতো আমাকে। তাঁরা অর্থনীতিতে বিভোর, অন্য পক্ষে আমার ওই বিষয়ে তেমন আগ্রহ কোনওকালেই ছিল না, প্রথাগত পরীক্ষায় বরাবর উৎরে গেছি, তা স্রেফ আকস্মিকতা। আমার বিবেচনায়, ইতিমধ্যেই যা বলেছি, যা রাজনীতি তা-ই অর্থনীতি, অর্থনীতিই রাজনীতি। অর্থনীতিবিদরা তাঁদের প্রজ্ঞার প্রভাব খাটিয়ে সমাজের অবস্থা পাল্টাতে পারেন না, রাজনীতিবিদরা তাঁদের কর্ম-অকর্ম দিয়ে পারেন। প্রতিটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তেরই আসলে একটি রাজনৈতিক দিক আছে। গণিতসমুদ্রে ভেসে অর্থশাস্ত্রে যে-তত্ত্ব-তথা-বিশ্লেষণের ঘোর এখন দৃশ্যমান, তা, আমি বলবো, অপরিমেয় অপচয়। বড়োলোক দেশে সে ধরনের ব্যভিচার তা-ও বোঝা যায়, তাদের সামর্থ্য অঢেল; গরিব দেশের পক্ষে কিন্তু অনুরূপ চর্চা অমার্জনীয় বিলাসিতা। সমাজবিজ্ঞান পরিষদের জন্য আমি যে বই দাঁড় করালাম, তাতে অর্থনীতি-রাজনীতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। এই প্রসঙ্গে পরে হয়তো আরও কিছু বলবার উৎসাহ জাগবে।
বাহাত্তর সালের মাঝামাঝি থেকে পঁচাত্তর সালের মধ্যমুহূর্ত পর্যন্ত দিন কাটছিল উচ্ছল ব্যস্ততায়, তবে ঈষৎ অনিশ্চয়তায়ও। জিনিশপত্রের দাম সমানে বাড়ছে, পশ্চিম বাংলাতেও শস্যের অনটন, গাঁয়ের মানুষ খরার মরশুমে অন্ন ও কর্মের সংস্থানে কলকাতায় জড়ো হচ্ছেন, হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন, দিনমজুরির হার বাড়ছে না, নামমাত্র একটি ভূমিসংস্কার আইন প্রায় দুই দশক আগে বিধানসভায় গৃহীত হয়েছিল, অথচ ভাগচাষী ও ভূমিহীন কৃষকদের অবস্থার তেমন হেরফের হয়নি, যদিও কৃষকসভার সংগঠন ক্রমশ মজবুত হচ্ছে। শহরে অশান্তি বাড়ছে, পল্লী অঞ্চলেও অস্থিতির লক্ষণ, জগদ্দল পাহাড়ের মতো কেন্দ্রে ও রাজ্যে কংগ্রেসি দুঃশাসন। ভারতবর্ষের অন্যত্রও একটু-একটু করে অসন্তোষের পর্দা চড়ছে।
গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পরিবেশ গোটা রাজ্যে নেই। যে-নাটকে অতি সামান্য বামপন্থী গন্ধ আছে, তা-ও ভারতবর্ষের প্রধান রাজনৈতিক দলের চেলাচামুণ্ডারা জোর করে বন্ধ করে দিচ্ছে। কে অস্বীকার করবেন, ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে পরের কয়েক বছর বাংলা নাটকের উজ্জ্বলতম ঋতু। শম্ভু মিত্র ক্রমশ প্রতিষ্ঠান-বহির্ভূত সত্তায় নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেছেন, শেষ পর্যন্ত ‘বহুরূপী’ থেকেও তিনি বিশ্লিষ্ট। অথচ, এরই মধ্যে, গ্রীক পুরাণ বা অন্য-কোনও সূত্র থেকে উপাখ্যানের উপকরণ সংগ্রহ করে নাটকের পর নাটক মঞ্চস্থ করে গেছেন। এক বিচারে তিনি সমাজের বাইরে, অথচ নাটক মঞ্চস্থ করছেন তো সমাজকে নন্দিত করবার উদ্দেশ্যেই। কাছাকাছি সময়ে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘নান্দীকার’ গোষ্ঠীর নির্ভরে পর-পর অনেকগুলি উল্লেখযোগ্য নাট্যপ্রয়াস মঞ্চায়িত করেছেন। অবশ্য এখানেও প্রেরণার সূত্র এখান-ওখান থেকে খুবলে-আনা বিদেশী নাটকাদি। অজিতেশের নিজের ও কেয়া চক্রবর্তীর অভিনয়প্রতিভা কলকাতার মধ্যবিত্ত সমাজকে মুগ্ধ করেছে, বিশেষ করে ব্রেশটের ‘তিন পয়সার পালা’-র প্রযোজনা-নৈপুণ্য বহু যুগ ধরে মনে রাখার মতো। বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, বিভাস চক্রবর্তীদের ‘চাক ভাঙা মধু’ বার-বার করে দেখেছেন মধ্যবিত্ত বাঙালি দর্শক। এই লগ্নে মায়া ঘোষের অভিনয়কলাও সবাইকে আবিষ্ট করেছে; আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারিণী এই মহিলা, কিন্তু কেমন যেন বরাবর আড়ালেই থেকে গেলেন।
উৎপল দত্তের মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসা জড়িয়ে যে-ঝামেলার সৃষ্টি, তার জেরে লিটল থিয়েটার গ্রুপ উঠে গেল, কিন্তু উৎপলের উৎসাহে ভাঁটা নেই, প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে পিপল্স্ লিট্ল থিয়েটারের উন্মেষ। এখন আর ঠিক মনে পড়ছে না, সম্ভবত আটষট্টি সালের শেষের দিক সেটা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবিদ্বেষ সমস্যা নিয়ে যে-নাটক তিনি মঞ্চস্থ করেছিলেন, ‘মানুষের অধিকারে’, তার প্রযোজনা-উৎকর্ষ অভাবনীয়; আমার মতে অন্তত, এই নাটকে উৎপল দত্তের অভিনয়প্রতিভাও তাঁর আগের ও পরের সমস্ত প্রয়াসকে ছাপিয়ে গেছে। তবে উৎপল তো আরও এগিয়ে গেলেন। বাংলা নাটকের হৃদয়-মোচড়ানো ইতিকথা ‘টিনের তলোয়ার’ মস্ত আলোড়ন তুললো সত্তর-একাত্তর সালের ডামাডোলের মুহূর্তে। পশ্চিম বাংলায় জরুরি অবস্থার আগেই জরুরি পরিস্থিতি: সভাসমিতি নিষিদ্ধ, খবরের কাগজে বিপক্ষ দলের খবর নেই, দেশ জুড়ে মূল্যবৃদ্ধি ও আর্থিক দুর্গতি, অথচ কারও টুঁ শব্দটি করবার অধিকার নেই, কিন্তু উৎপল বেপরোয়া, পর পর একাধিক নাটকে স্বৈরাচারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-মুখর হলেন: ‘ব্যারিকেড’, ‘এবার রাজার পালা’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’। ততদিনে মিনার্ভা থিয়েটারের বন্ধকি শেষ হয়ে গেছে, বামপন্থীদের ব্যবসায়িক মঞ্চগুলি ব্যবহারের অধিকার নেই, পিপল্স্ লিট্ল থিয়েটরের নাটক ইতস্তত এখানে-ওখানে হল ভাড়া করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, দর্শকের ভিড় উপছে পড়ছে। ওই একই লগ্নে অন্য এক নাট্যগোষ্ঠী, ‘চেতনা’, নতুন প্রকরণচাতুর্যের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ‘মারীচ সংবাদ’ নামে একটি নাটক প্রযোজনা করে প্রচুর বাহবা কুড়িয়েছিল। হাওয়া যে গরম হচ্ছে, এত সমস্ত নাট্যপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। এই প্রসঙ্গে একটি-দু’টি চলচ্চিত্রেরও আমি হয়তো উল্লেখ করতে পারি, কিন্তু বিষয়ের চেয়ে বিভঙ্গ বাড়তি জায়গা নিয়ে নেওয়াতে সামাজিক অভিভাবসঞ্চারে সেগুলি তত সফল হতে পারেনি।
আরও যা বোঝা যাচ্ছিল, নকশালপন্থী আবেগে ভাঁটা এসেছে, তবে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে কেন্দ্র করে বামপন্থী প্রতিবাদ ঘনায়িত হচ্ছে। সভা নেই, উল্লেখ করার মতো পত্র-পত্রিকা নেই, তবু পার্টির ব্যূহরচনা নিঃশব্দে পরিণতির দিকে এগোচ্ছে, হয়তো গ্রামে ও শহরতলিতে একটু বেশি করে এগোচ্ছে। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রান্তেও মানুষ, ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছেন, বিক্ষিপ্ত, অসংগঠিত প্রতিবাদের ছোটো-বড়ো ঢেউ, ইন্দিরা গান্ধি ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত ক্ষমতা নিজের দপ্তরে কুক্ষিগত করেছেন, রাষ্ট্রপতি তাঁর ক্রীড়নক, মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরাও তাই।
মূল্যমান অপ্রতিহত বাড়ছে, শ্রেণীগত উপার্জনবিন্যাস সব অঞ্চলেই দরিদ্রদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই জনসাধারণের নিত্য সংঘর্ষ। আর্থিক সমস্যার সূত্র ধরেই সংঘর্ষগুলি যে সব সময় ঘটছে তা নয়; মানুষের মন যেখানে বিষিয়ে আছে, নানা ধরনের অভিযোগ অবলম্বন করে বিদ্রোহের লক্ষণ চারদিকে দেখা দিতে বাধ্য। প্রধান মন্ত্রীর অসহিষ্ণুতা প্রতি পদে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, তাঁর অহমিকাও সেই সঙ্গে। চুয়াত্তর সালে রেল ধর্মঘট নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক অশান্তি, নির্মম হস্তে তা দমন করা হলো, হাজার-হাজার রেলকর্মচারী খারিজ হয়ে গেলেন, অত্যাচারিত-নিপীড়িত হলেন আরও বহু সহস্র, তাঁদের মধ্যে অনেককে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারাবন্দী করে রাখা হলো, বরখাস্ত হলেন অনেকে, নানা জায়গায় রেলকর্মচারীদের বাসগৃহে পুলিশ মধ্যরাত্রিতে ঢুকে পরিবারের পর পরিবার উৎখাত করলো।
পশ্চিম বাংলায় অবশ্য এ ধরনের অত্যাচার-অনাচার সত্তর সালের শুরু থেকেই অব্যাহত, এবার অন্যান্য রাজ্যের সাধারণ মানুষ তার কিছুটা আঁচ পেতে শুরু করলেন। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে দেশ জুড়ে এক ধরনের গণ অভ্যুত্থানের সূচনা, যা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বিস্ফোরণের চেহারা নিল। পঁচাত্তর সালের জুন মাসের গোড়ায় কলকাতায় বামপন্থী ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলির উদ্যোগে ব্রিগেড প্যারেড মাঠে সভার আয়োজন, জ্যোতিবাবু একদিন সকালে আমাদের বাসস্থানে এসে জানালেন, সব ক’টি দল ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে ওই সভায় উত্থাপিতব্য প্রস্তাবটি আমাকে দিয়ে পাঠ করানো হবে। বহু দিন বাদে কলকাতায় বিরাট মাপের হতচকিত-করা রাজনৈতিক সভা, সাধারণ মানুষের উৎসাহ উদ্বেল। আমি প্রস্তাব পড়লাম, জয়প্রকাশ নারায়ণ, জ্যোতিবাবু এবং, যতদূর মনে পড়ে, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করলেন, তারপর ব্রিগেড প্যারেড মাঠ পরিক্রমান্তে মস্ত মিছিলের সমারোহ।
দু’দিন বাদে বাড়িতে গোয়েন্দা শাখার পুলিশ চড়াও, বাড়ির বাইরেও চব্বিশ ঘণ্টা গুপ্তচর বহাল, যাদের সহজেই চেনা যেত। পুলিশের যে-লোকেরা দেখা করতে এলেন, বলতেই হবে অত্যন্ত ভদ্র: ‘স্যার, আপনার কি আগামী এক-দুই সপ্তাহ অন্য কোথাও বক্তৃতা দেবার কথা আছে?’ তাঁদের বলা হলো, কথা থাকলেও তার বিশদ বিবরণ দিতে আমি বাধ্য নই। তাঁরা একটু দমে গেলেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে একজন, আবিষ্কার করলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, তাঁদের চা খাইয়ে বিদায় করা গেল, কথাবার্তায় মনে হলো, তাঁদের হার্দ্যিক সহানুভূতি আমাদের দিকেই, কিন্তু গোলামি করতে হয়, কী করবেন। অনেক পরে, কংগ্রেস জমানায় তখন মুখ্যমন্ত্রীর যিনি আপ্ত সহায়ক ছিলেন, তাঁর লেখা বই থেকে জানতে পারি, আমাকে যে ওই সভায় প্রস্তাব-উত্থাপক হিশেবে স্থির করা হয়েছে, পুলিশ তা আগে থেকেই জানতো, বিরোধী দলগুলির গোপন বৈঠকে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ অতি তৎপর, সঙ্গে-সঙ্গে সরকারকে জানিয়েছেন।