আপিলা-চাপিলা – ১৩

তেরো

ব্যাংকক থেকে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের পর উপলব্ধি হলো, ইকনমিক উইকলি-র খ্যাতি যদিও মধ্যগগনে, আর্থিক পরিকল্পনা নিয়ে উন্মাদনা অনেকটাই ডুবুডুবু। হঠাৎ অর্থমন্ত্রকসুদ্ধু গোটা আমলামহল আবিষ্কার করলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে আমাদের সংকট দেখা দিয়েছে, হু-হু করে ডলার-পাউন্ডের মজুত কমছে, বিপদসংকুল অবস্থা, সুতরাং, তাঁদের সরব অভিমত, পরিকল্পনা নিয়ে বিলাসিতা মুলতুবি থাকুক, মুলতুবি থাকুক স্বনির্ভরতা নিয়েও বাসনার লীলাকেলি। অধ্যাপক মহলানবিশ ও তাঁর আশা-ঝলমল পরিকল্পনার খসড়া মন্ত্রীশান্ত্রীদের একাগ্রচিত্ততার আর মধ্যবিন্দু হয়ে রইলো না। রফতানি ছাড়িয়ে আমদানির মাত্রা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ড শূন্যতে গিয়ে ঠেকবে, এখন আর দেরি নয়, পরিকল্পনা শিকেয় তোলা থাক, মার্কিন সরকারের পায়ে গিয়ে আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি, হুজুর, মহানুভব, ধর্মাবতার, আমাদের তরিয়ে দিন। সেই লগ্নে, এবং পরেও, বহু আলোচনা হয়েছে, ভারতবর্ষের এই যে বহির্বাণিজ্যিক সংকট নিয়ে সহসা সরকারি মহলের এত উতল হওয়া, তা কি নেহাৎই কাকতালীয়, না কিছু-কিছু আমলার, এবং কিছু-কিছু রক্ষণশীল মন্ত্রীর, যুগ্ম ষড়যন্ত্রের ফসল। যদিও অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রে দেশ তখন অনেকটাই বিবিধ নিয়ন্ত্রণের নিগড়ে, রাজনৈতিক দর্শন ও ভাবনার প্রেক্ষিতে পরিবেশ কিন্তু ভীষণ ভোলামেলা, যে-কেউ আসছেন, যে-কেউ যাচ্ছেন, পূর্ব ইওরোপ এবং অন্যত্র থেকে পরিকল্পনা বিশারদদের যেমন আগমন ঘটছে, সেই সঙ্গে পরিকল্পনা-বিরোধী রথীমহারথীরাও নতুন দিল্লির যত্রতত্র বিহার করছেন, হরিজন-মহাজনদের কাছে পরামর্শ-উপদেশ বিলোচ্ছেন। আমার নিজের ধারণা, অর্থমন্ত্রকের কুচক্রী আমলারাই বোধহয় প্রধান কলকাঠি নেড়েছিলেন, পরিকল্পনা নিয়ে যে-দুরন্ত উৎসাহ সরকারি-বেসরকারি মহলে কয়েকমাস আগেও দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছিল, তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মন্ত্রী, আমলাবর্গ ও তাঁদের পারিষদরা তখন থেকে ঘন-ঘন মার্কিন মুলুকে ছুটোছুটি শুরু করলেন, যোজনা পরিষদে অধ্যাপক মহলানবিশের প্রাক্তন প্রতিপত্তি অনেকটাই নির্বাপিত। পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে জওহরলাল নেহরুর যে-পরিমাণ স্বপ্নোচ্ছলতা ছিল, তদনুরূপ বাস্তবপ্রত্যয় ছিল না। সুতরাং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই খোলা হাওয়ার পালে আবেগ সংযোজিত হলো, আর খোলা হাওয়া মানেই তো মার্কিন কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ব ব্যাংক যা বলবেন হুবহু তা মেনে নেওয়া।

শচীনদা ইকনমিক উইকলি-র মধ্যবর্তিতায় খানিকটা সময় লড়াই চালিয়ে গেলেন, মন্ত্রী-আমলাদের বিদেশী সাহায্য পাওয়ার চাতকতৃষ্ণা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করলেন, কিন্তু সরকারি মহলে শ্রেণীস্বার্থের হাতছানি, স্বনির্ভর অর্থব্যবস্থার ব্রত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে গেলে অধ্যবসায়, চিকীর্ষা ও আত্মত্যাগের প্রয়োজন, বড়ো দীর্ঘ অকরুণ পথ তা, কী দরকার, তার চেয়ে মার্কিন সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে মিতালি করাই তো শ্রেয়, পায়ের উপর পা তুলে দিব্যি আরামে কালাতিপাত করতে পারি আমরা তা হলে।

চিন্তাভাবনার স্তরে মেরুপরিবর্তন, যোজনা পরিষদের দাক্ষিণ্যে দেড়-দু’বছর আগে যেখানে স্বনির্ভর পরিকল্পনার মাহাত্ম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে-বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণাকেন্দ্রে-গবেষণাকেন্দ্রে মস্ত-মস্ত বিশ্লেষণ-আলোচনা-প্রবন্ধ ফাঁদা চলছিল, সেখানে এখন বিপরীত ঋতুর প্রভাব, পরিকল্পনার সংকট নিয়ে দিস্তা-দিস্তা প্রবন্ধের চর্চা। শচীনদাকে তো তাঁর পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে হবে, আমলামহল ও সেই সঙ্গে অর্থনীতিবিদকুল যখন উল্টো সুর গাইতে শুরু করলেন, ইকনমিক উইকলি-র একক প্রতিরোধও ক্রমশ মিইয়ে আসতে লাগলো। যাঁরা বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন, তাঁরা মলিন হেমন্ত-সন্ধ্যার বৈরাগী পরিপার্শ্বের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে শিখলেন। আসলে স্বনির্ভর পরিকল্পনার রাজনৈতিক ভিত্তিভূমি গোটা দেশে তখনও খুব দুর্বল সংস্থানে দাঁড়িয়ে, এমন কি কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও এই ব্যাপারে তেমন গভীর চিন্তার দোলা ছিল না। তথাকথিত বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের আড়ালে যে-আসল, বৃহত্তর সংকট, তা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছে প্রাঞ্জল করে ব্যাখ্যা করা কর্তব্য ছিল অর্থনীতিবিদদের, সেই কর্তব্য যথাযথ পালিত হয়নি। আমার এখনও বিশ্বাস, মধ্যপঞ্চাশের বছরগুলিতে পরিকল্পনা নিয়ে ভাবনা-চিন্তায় প্রাথমিক যে-জোয়ার এসেছিল, তা ধরে রাখতে পারলে, তার প্রায়োগিক সমস্যা নিয়ে সাধারণ মানুষজনকে সম্যক বোঝাতে পারলে, যে-বদ্ধ ডোবায় আমাদের অর্থব্যবস্থা গত চার-সাড়ে চার দশক ধরে আটকে আছে, তা থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব হতো। শ্রেণীস্বার্থের গুরুত্ব অস্বীকার করছি না, কিন্তু গণচেতনা যদি সর্বস্তরে ব্যাপ্ত করা যেত, হয়তো নতুন শ্রেণীসংশ্লেষণ ঘটতো, সেই ক্ষেত্রে আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-পুঁজিবাদী গোলকধাঁধা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারতাম।

অর্থনীতিতে আমি তখনও পর্যন্ত বিশ্বাস পুরোপুরি হারাইনি, তবে একটু-একটু করে উপলব্ধি করছি, অর্থনীতিই রাজনীতি, রাজনীতি অর্থনীতি। সেই মুহূর্তে নিজের মনোনীত বৃত্তি ছেড়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতির মাঠে নেমে পড়ার জল্পনা মনে-মনেও শুরু করিনি। এদিকে ঝুঁকছি, ওদিকে ঝুঁকছি, রাজনীতির বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি, ধনবিজ্ঞানী বন্ধুদের সঙ্গেও, শচীনদা ও ইকনমিক উইকলি-র অলঙ্ঘনীয় মাধ্যাকর্ষণে প্রত্যহ আরও বেশি আবিষ্ট হচ্ছি, কলকাতাস্থ কবি-সাহিত্যিক বন্ধুদের সান্নিধ্যের মায়াবেষ্টনী তো অহরহ ঘিরে রেখেইছে। এই বছরগুলিতেই কলকাতায়, অনেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, এক দঙ্গল কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপ: সুবীর রায়চৌধুরী, অমিয় দেব, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং অবশ্যই নবনীতা। দিল্লিতে পরিমলবাবু আর নেই, তিনি নিউ ইয়র্কে কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু মন্মথবাবু আছেন, দাতরজির বাড়ির আড্ডার বন্ধুরা আছেন, সুশী-অমলেন্দু দাশগুপ্তরা আছেন। মাঝে-মাঝে কলকাতা থেকে ‘বহুরূপী’, ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ ইত্যাদি দিল্লি ঘুরে যাচ্ছেন, তাঁদের কুশীলবদের অনেকের সঙ্গে আস্তে-আস্তে আলাপ হচ্ছে। দেশের আর্থিক সংকটের চেহারা-চরিত্র যা-ই হোক, নতুন দিল্লির বহির্বৈভব থেকে তা কিছুমাত্র অনুমান করা সম্ভব নয়, বালাসরস্বতীদের নাচ, রবিশঙ্কর সম্প্রদায়ের বাদন, অপরিসর আইফ্যাক্স মঞ্চে, নয়তো সপ্রু হাউসে, বিদেশী কলাকুশলীদের ঘন-ঘন প্রতিভা-কুশলতা নিদর্শন প্রদর্শন, ‘টপ্পা-ঠুংরি’ কবিতার ভাষায়, দিন কাটছিল যেন জিহাবিলম্বিতে।

ইতিমধ্যে সহসা বিস্ফোরণের মতো বাংলাদেশ জুড়ে জীবনানন্দ-বিহ্বলতা, তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে যা দেওয়া যায়নি, এখন তা সুদসমেত পাইয়ে দেওয়ার আয়োজন, কিন্তু কাকে পাইয়ে দেওয়া, তা নিয়ে তেমন উদ্বেগ-আকুলতা নেই। সেই লগ্নে স্পষ্ট করে বলা নিশ্চয়ই ঈষৎ কুরুচিকর ঠেকতো, তবে আমার মনে হয় দুটো প্রবাহ মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতায় পাশাপাশি তখন বহমান, একটি জীবনানন্দের চেতনাবলয়ে প্রথম প্রবেশের অবাধ আবেগের মহাস্রোতস্বিনী, অন্যটি তাঁর ভাষার গহনে সোনা-রুপো-কাগজের খনি আবিষ্কারের গভীর সম্মোহ। কী আর করা যাবে, ইতিহাসধারাকে তো মেনে নিতেই হয়, তা যদি ভুল খাতে ধেয়ে চলে, তা হলেও।

এই সময়টাতেই অরুণকুমার সরকার অসাধারণ কিছু মহৎ কবিতা লিখে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি তো রাজনৈতিক পক্ষনিরূপণের বিচারে ঘরেও নহেন, পাড়েও নহেন, সাম্যবাদী মহলে তাঁকে নিয়ে আগ্রহ নেই, এবং কবিতাভবন ঘিরে তখন নবীন প্রজন্মের চঞ্চল সমাগম। এই শেষোল্লিখিত প্রজন্মের অন্তর্গত যাঁরা, কোনও পর্যায়েই তাঁদের আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল না, প্রথম থেকেই তাঁরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, ক প্রশস্তি গাইছেন খ-র, খ প্রশস্তি গাইছেন গ-র, গ প্রশস্তি গাইছেন ক ও খ উভয়ের। বুদ্ধদেব বসু বরাবরই একটু পরমত-নির্ভর, একদা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের তাগিদে যেমন সাম্যবাদী দলিল-দস্তাবেজে স্বাক্ষর দিয়েছেন, পঞ্চাশের দশকের শেষের প্রহর থেকে মার্কিন-অনুরক্ত প্রিয় বয়স্য ও কবিযশোপ্রার্থীদের তাড়নায় মধ্যবর্তী প্রজন্মের কবিদের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা প্রায় ভুলে থাক্‌লেন। আমি কোনও অভিযোগ তুলছি না, একটি ঐতিহাসিক সংঘটনার বিশ্লেষণপ্রয়াস করছি মাত্র।

নতুন দিল্লির গবেষণাগারের অধ্যক্ষের সঙ্গে আমার খুচখাচ মনোমালিন্য লেগেই ছিল, অব্যাহতি খুঁজছিলাম, সুযোগ এসে গেল: মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন শহরের ইকনমিক ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটে গিয়ে পড়ানোর প্রস্তাব। মাত্র কয়েক বছর আগে এই শিক্ষায়তনের পত্তন হয়েছে, বিভিন্ন অনুন্নত দেশ থেকে প্রশাসকদের জড়ো করে প্রতি বছর ছ’মাস করে তাঁদের ধনবিজ্ঞানে তালিম দেওয়ার পরিকল্পনা। যাঁরা পড়তে আসতেন তাঁরা অধিকাংশই প্রবীণ আমলা, পনেরো-কুড়ি-তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ছোটো-ছোটো দেশ থেকে একজন-দু’জন মন্ত্রী পর্যন্ত অধ্যয়নচর্চায় আসতেন। তাঁদের জন্য একটু অন্য ধাঁচের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা: প্রথাগত বুলি ও তত্ত্ব কপচানো বাদ দিয়ে, সহজ অনাড়ম্বর ভাষায়, কিন্তু তত্ত্বের মূল কথাটি প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা করে, সেই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আর্থিক সমস্যালগ্ন তথ্যাদি নিয়েও আলোচনা। ইনস্টিটিউটের অর্থসংস্থান বিশ্ব ব্যাংকের কৃপায়। ব্যাংকের কর্তৃপক্ষের সম্ভবত উদ্দেশ্য ছিল, জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি গরিব দেশগুলির মন্ত্রী-আমলারা ব্যাংকের দর্শনচিন্তাকেও শ্রদ্ধা করতে শিখুক, এই পীঠস্থানে ঘুরে যাওয়ার কল্যাণে।

পড়াতে আসতেন মার্কিন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়াদি থেকে বাছা-বাছা অধ্যাপক, কখনও ইংল্যান্ড তথা ইওরোপ থেকেও, ক্কচিৎ-কদাচিৎ অন্যান্য মহাদেশের পণ্ডিতবর্গও। অবশ্য আমার ক্ষেত্রে তখন কোথায় যাচ্ছি তার থেকেও কোন জায়গা থেকে পালাতে পারছি সেই সমস্যাই বড়ো ছিল, কিন্তু যে-চার বছর ইকনমিক ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটে ছিলাম, বলতে বাধা নেই, নানা দিক থেকে উপকৃত হয়েছি। সারা পৃথিবী ছেঁকে—এমনকি পূর্ব ইওরোপ থেকেও—যাঁরা অধ্যয়নের জন্য আসতেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিভিন্ন দেশের সমস্যাবলী সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান আহরণ সম্ভব হয়েছিল, কোন-কোন দেশগুলির সমস্যা-সমূহের মধ্যে ভাবসাদৃশ্য আছে, অন্য কোন-কোন দেশগুলির মধ্যে নেই, এবং এই সাদৃশ্য ও সাদৃশ্যহীনতার কারণগুলি কী, সে-সমস্ত নিয়ে ক্রমশ চিন্তা প্রাঞ্জলতর হয়েছে। দ্বিতীয় যে লাভ, পৃথিবীর বাছা-বাছা ধনবিজ্ঞানীদের সঙ্গে ওখানে অধ্যাপনার সূত্রে পরিচয়, আগে থেকে যাঁদের সঙ্গে পরিচয় ছিল, যেমন কালডর কিংবা ৎসুরু বা মার্টিন ব্রনফেনব্রেনার, তাঁদের সঙ্গে গভীরতর সখ্য। আমার শিক্ষক টিনবার্গেনও একবার এসেছিলেন। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে— অমর্ত্য-সুখময় তখন দু’জনেই ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়াচ্ছে—অতি তরুণ অমর্ত্য এসে আমাদের প্রবীণ ছাত্রদের কাছে বক্তৃতা দিয়ে গিয়েছিল, ছাত্ৰকুল একটু ক্ষমাঘেন্নার সঙ্গেই যেন তার বক্তব্য শুনেছিলেন।

অন্য-কিছু ব্যক্তিগত শুভবর্ধনের কথাও উল্লেখ করি। চেনা-জানার পরিধি ওয়াশিংটন থাকাকালীন অনেক বাড়লো। যে-মস্ত অ্যাপার্টমেন্ট দালানে বাস করতাম, তাতে একজন-দু’জন মার্কিন সেনেটরও থাকতেন, তা ছাড়া রাজধানী শহর ওয়াশিংটন, তখনও পর্যন্ত অনেকটাই পল্লীর মদিরতা ছাওয়া, বিভিন্ন স্তরের রাজনীতিবিদ-অধ্যাপক-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল সে সময়, এমন কি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পর্যন্ত এখানে-সেখানে মাঝে-মাঝে দেখা যেত, নিরাপত্তার অভেদ্য বলয়ের নির্মাণ ভবিষ্যতের গর্ভে।

ছ’ মাস পড়ানো, বাকি ছ’মাস পড়ানোর জন্য তৈরি হওয়া, সুতরাং হাতে প্রচুর সময় থাকতো নিজের পড়াশুনোর, বিভিন্ন পত্রিকা ঘাঁটার, এখানে-ওখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বা অন্য কোনও শিক্ষা-কেন্দ্রে ঘুরে আসার। একটি রেওয়াজ ছিল, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনও অনুন্নত দেশে কিংবা উন্নত কোনও দেশের অনুন্নত অঞ্চলে গিয়ে, সপ্তাহ দুই-তিন ধরে, সে-দেশে বা সে-অঞ্চলে তন্ন-তন্ন বিহার করে, উন্নয়নমূলক সমস্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন। সুযোগ ঘটেছিল ভেনেজুয়েলা, মেক্সিকো, ইতালির সিসিলি ও সার্ডিনিয়া ইত্যাদি জায়গায় যাওয়ার, এরও বাইরে ইনস্টিটিউট থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছিল জ্যামাইকা ও কোরিয়ায় বিশেষ পাঠক্রম পড়ানোর জন্য। আমি রঙ্গ করে মাঝে-মাঝে বলি, আমি সম্ভবত সেই বিরল মনুষ্যদের একজন, যারা একই সঙ্গে সার্ডিনিয়া, ভেনেজুয়েলা ও কোরিয়া সফর করেছে। অবশ্য এই কাজের সূত্র ধরেই আমেরিকা ও ইওরোপেও চষে বেড়িয়েছি কয়েকটি বছর।

পরে খানিকটা নিন্দামন্দ শুনেছি, ইকনমিক ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট-এর ব্যবস্থাপনার প্রধান উদ্যোক্তা যেহেতু বিশ্ব ব্যাংক, আমার মতো বামপন্থীর ওখানে সময় কাটানো নৈতিক দ্বিচারিতার সাক্ষ্যবহন করছে। এ ব্যাপারেও কিন্তু আমার মনে কোনও দ্বন্দ্ব-বোধ নেই। বিশ্ব ব্যাংকের তহবিলে আমাদের সরকারেরও টাকা গচ্ছিত, তা ছাড়া আরও অনেক ভারতীয় অর্থবিজ্ঞানী, যেমন আমার বন্ধু কৃষ্ণস্বামী কিংবা রাজ, এই ইনস্টিটিউটে কিছু সময় কাটিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি, আমার বেলা উঠছে কেন? তার চেয়েও আমার বড়ো সাফাই, ওই চার বছর তদগতমন হয়ে বিভিন্ন উন্নতিশীল দেশ থেকে আসা বৃদ্ধ বা প্রায়-বৃদ্ধ ছাত্রদের পরমানন্দে সোভিয়েট দেশের ফেল্ডম্যান পরিকল্পনা মডেল বিস্তৃত করে পড়িয়েছি, সমাজতন্ত্রের উৎকর্য-উপযোগিতা সম্পর্কে যাতে তাঁদের মনে কোনও দ্বিধা আদৌ না থাকে: এটা অনেকটা সেই মার্কিন মহিলার উপহারদত্ত ডলার দিয়ে পিকাসোর শান্তি রুমাল-আঁকা রুমাল কিনে বিলোনো-সদৃশ আচরণ।

ওয়াশিংটনে কয়েক বছর বসবাস করা থেকে অন্য যে-অভিজ্ঞতা, তার রাজনৈতিক ব্যঞ্জনাও তুচ্ছ নয়। পটোম্যাক নদী পেরিয়ে ভার্জিনিয়া রাজ্য, অন্য দিকে ওয়াশিংটন শহরকে বলা চলে মেরিল্যান্ড রাজ্যের একটি টুকরো। মার্কিন রাষ্ট্রে বর্ণবিভাজনের প্রায় ভৌগোলিক মধ্যরেখায় এই শহরের অবস্থান। ওয়াশিংটনের আভ্যন্তরীণ ভূগোলও ঠিক তাই-ই। শহরের উত্তর-পশ্চিম খণ্ডের যোলো নম্বর স্ট্রিটের এদিকে শাদা মানুষদের ঘরবাড়ি, আর ওদিকে রাস্তার ক্রমিক সংখ্যা যত কমছে, ততই কৃষ্ণকায়দের ঘন থেকে ঘনতর বসতি, শহরের অন্যান্য খণ্ডগুলিও কৃষ্ণকায়দের জন্য বরাদ্দ। ‘সভ্য’ অংশে নানা অজুহাতে কালো মানুষদের সম্পত্তি কিনতে দেওয়া হয় না, তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অন্যান্য অঞ্চলের প্রায়-ঘেটোগুলিতে। ষাটের দশকের গোড়া থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, সময় উত্তাল, মার্টিন লুথার কিং-এর নায়কত্বে সংঘবদ্ধ অহিংস উত্থান, যে-কোনও প্ররোচনায় যা হিংসার রূপ নিতে পারে। আন্দোলন-প্রতিরোধের চাপে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে একটু-একটু করে শ্বেতকায়দের অখণ্ড ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে, ভোটের তাগিদে দু’টি প্রধান দলের মধ্যেও বর্ণসংমিশ্ৰিত রামধনু মিতালির লক্ষণ মাথা চাড়া দিচ্ছে; হাজার সামাজিক বাধাবন্ধ সত্ত্বেও, কৃষ্ণবর্ণদের মধ্যে শিক্ষার ঢেউও একটু-একটু আন্দোলিত হচ্ছে। অন্য আবর্তের অনুকম্পনও। আফ্রিকায় একটির-পর-আর-একটি কৃষ্ণবর্ণ-প্রধান দেশ পরাধীনতা থেকে মুক্ত হচ্ছে, লাতিন আমেরিকার বর্ণসৌষাম্যের কাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চুঁইয়ে ঢুকছে, অদূরবর্তী ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলিতে প্রধানত কৃষ্ণকায় মানুষদের ক্ষেত্রে যে-ধরনের সহজ সামাজিক উত্তরণ ঘটছে, যথা ত্রিনিদাদে, যথা জ্যামাইকায়, তা-ও মার্কিন মুলুকে অজানা থাকছে না। এমনিতেই জাজ-সঙ্গীতের মূৰ্ছনা সর্বশ্রেণীর মার্কিনিদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে উন্মাদনার সঞ্চার করে আসছিল, তার উপর হালে জ্যামাইকা থেকে আগত হ্যারি বেলাফন্টের উদাত্ত কণ্ঠেশ্বর্য গোটা দেশকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বর্ণবৈষম্যের ভূত আর কতদিন তাঁদের কাঁধে চেপে থাকবে? যা যোগ করতে হয়, আমি ও আমার স্ত্রী যে-বছর যে-মাসে আমেরিকা পৌঁছুলাম, সে-বছর সে-মাসে কিউবাতে ফিদেল কাস্ত্রোর নায়কত্বে ও প্রেরণায় গণবিপ্লব। চল্লিশ বছর ধরে মার্কিন রক্ষণশীল রাজনীতিবিদরা সেই বিপ্লবের বাস্তবতা অগ্রাহ্য করবার চেষ্টা করে এসেছেন, জন কেনেডির আমল থেকে শুরু করে বহুবার বহু ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, কিন্তু কিউবা অনবদমিত। এখন আস্তে-আস্তে মার্কিন দেশের বিভিন্ন মহলে শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে, তবে সেই প্রথম থেকেই দেশের কৃষ্ণকায়দের মধ্যে কিউবা বিপ্লবের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক লক্ষণাদি নিয়ে উতরোল আলোচনা। তাঁরা অশান্ত, সেই অশান্তির তরঙ্গ প্রতিহত করার প্রয়াসে মার্কিন কর্তাব্যক্তিরা পুরোপুরি অসফল। এরই সূত্র ধরে, ভিয়েতনামে যে-কলঙ্কময় সাম্রাজ্যবাদী সমরে মার্কিন প্রশাসন নিজেকে লিপ্ত করছিল, তার বিরুদ্ধে একটু-একটু করে প্রতিবাদ ও বিরোধিতার অযুত বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল, কয়েক বছরের মধ্যেই তা বিস্ফোরণের আকার নেয়।

অকপটেই বলতে হয় কথাটা। কট্টর মার্কিন-বিরোধী হিশেবে আমার মতো অনেকের নামে জনপ্রবাদ, কিন্তু সেই বিরোধিতা তো মার্কিন সরকারের নীতি ও নীতিপ্রয়োগ সম্পর্কে। যে ক’বছর মার্কিন দেশে ছিলাম, প্রচুর শ্বেতকায় মার্কিন পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, সৌহার্দ্য হয়েছে, তাঁদের সৌজন্য ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছি। এমন নয় যে তাঁরা অনেকেই নিজেদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের রীতিনীতি সম্পর্কে অসুখী নন, কেউ-কেউ অসুখী, কেউ-কেউ নন, কিন্তু যাঁরা অসুখী তাঁরা প্রথাগত রাজনীতি-সমাজনীতির ঘেরাটোপ থেকে সহজে বের হয়ে আসতে পারেন না। যদিও বুঝতে পারেন, সরকারের তরফ থেকে যা বলা হচ্ছে বা করা হচ্ছে তাতে অনেক অনৈতিকতা, অসহায়ের মতো মেনে নেন তাঁরা। এই অসহায় মানসিকতার প্রতিবাদে অগুন্তি মার্কিন মধ্যবিত্ত পরিবারে ক্রমশ অসন্তোষের আগুন জ্বলেছে ষাটের দশকের গোড়া থেকে। অন্য একটি কথার উল্লেখ প্রয়োজন। হয়তো, প্রাচুর্য, একটি সীমানা ছাড়িয়ে গেলে, সুখের চেয়ে অসুখের বেশি জন্ম দেয়। ছেলেরা-মেয়েরা শিশু বয়স থেকেই বিলাসে-ঐশ্বর্যে লালিত হয়েছে; ঘরময় ঠাসা সামগ্রীর সমারোহ, কোনও ইচ্ছাই তাদের অপূর্ণ থাকে না, ছবির মতো ঘরদালান, ছবির মতো গাড়ি-রাস্তাঘাট-পার্ক, সিনেমা-থিয়েটার, শৌখিনতার পর শৌখিনতার শোভাযাত্রা। বোধহয় একটা সময় আসে যখন উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের কিছুতে-কেন-যে মন লাগে না, অপরিতৃপ্তির কালো মেঘ পরিতৃপ্তিকে ঢেকে দেয়, অশান্ত তাদের মন, তারা বিদ্রোহের জন্য মুখিয়ে, বাবা-মার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, সমাজপরিবেশ সম্পর্কে বীতরাগ, রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে তুড়ি মেরে উপেক্ষা করার উন্মত্ততা। তেষট্টি সালের গোড়ায় আমরা যখন মার্কিন দেশ ছাড়ি, তখন থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল, প্রহর অনিশ্চিত, শিগিরই ভয়ংকর-কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সেরকমই হলো, মাত্র কয়েক বছর বাদে।

একটি ব্যক্তিগত কবুলতিও সেই সঙ্গে করতে হয়। আমার জীবনে আমেরিকায় ওই ক’বছরই সম্ভবত অলস মায়ায় খেয়ালি ঝোঁকে বিহার-বিচরণের শেষ অধ্যায়। পড়াশুনোর পাশাপাশি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘড়ি না-মেনে আড্ডা দিয়েছি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় টইটম্বুর দিনযাপন। দেশ থেকে ছুটকো-ছাটকা উড়ো খবর পাই, কলকাতার রাস্তায় কাতারে কাতারে কৃষক নিধন কংগ্রেসি প্রশাসনের নির্দেশে, অত দূর থেকে জেনে অস্থির বোধ করি। কিন্তু তা তো ক্ষণিকের বিবেকদংশন। কেরলে বামপন্থী সরকারকে ষড়যন্ত্র করে হটিয়ে দেওয়া হলো, তা নিয়ে উত্তেজনাবোধ, তবে তা-ও তো থিতিয়ে গেল। বছর দুই কাটতেই বন্ধু অরুণ ঘোষ, তাঁর স্ত্রী ডালিয়া, দুই কন্যা অদিতি ও জয়তী, ওয়াশিংটনে এসে হাজির, ভারতীয় দূতাবাসে অরুণ ঘোষের কোনও কাজের সূত্রে। বন্ধুদের মধ্যে আরও ছিলেন শাম্বমূর্তি ও তাঁর স্ত্রী উমা, শাম্বমূর্তিও তখন ভারতীয় দূতাবাসে, পরে নতুন দিল্লিতে কেন্দ্রীয় জলবিদ্যুৎ কমিশনের সভাপতি হয়েছিলেন, তারও পরে কেন্দ্রীয় সরকারের বিদ্যুৎ সচিব। অরুণ ঘোষের সুদক্ষ প্রশাসক হিশেবে প্রচুর নামযশ, কেন্দ্রীয় সচিব হিশেবে বিরাজ করেছেন বেশ কয়েক বছর, আমি রাইটার্স বিল্ডিং-এ থাকাকালীন পশ্চিম বঙ্গ পরিকল্পনা সংসদের কর্তাব্যক্তিরূপে যোগ দিতে ওঁকে রাজি করিয়েছিলাম। অসাধারণ ভালো কাজ করেছিলেন, পরে দিল্লিতে যোজনা পরিষদের সদস্য হন জনতা দলের স্বল্পকালীন মরশুমে। ডালিয়া, মনে হয় আগে বলেছি, হাটখোলার দত্তবাড়ির কন্যা, আভিজাত্যের সঙ্গে সহৃদয়তা তাঁর স্বভাবে অঙ্গাঙ্গী জড়িত, দিল্লিতে বহুদিন ওঁদের অতিথি ছিলাম, তবে নিকষ অতিথিরূপে নয়, ঘরের মানুষ হিশেবে সেই আতিথ্যগ্রহণ পর্ব আমার এখনও ঘোচেনি। অদিতি একটু পাগলাটে ধরনের মেয়ে, চঞ্চল, কিন্তু সমস্ত ব্যাপারে তুখোড়, আই এ এস-এ ভালো ফল করে রাজস্থান রাজ্যে কর্মরতা, আপাতত দিল্লিতে, খানদানি বংশের একটি রাজস্থানী ছেলেকে বিয়ে করে চমৎকার সংসার পেতেছে, তার তিন কন্যা অনন্যা, আরাধ্যা, মেঘনা, আমাদের নাতনিস্বরূপা, তাদের সঙ্গে হুটোপাটিতে জীবনের প্রগাঢ় চরিতার্থতা আবিষ্কার করেছি। অন্যদিকে জয়তী শৈশব থেকেই অনেক বেশি পরিণত। কিছুদিন সমাজবিজ্ঞানের এঁদো ডোবায় চর্চারতা থেকে পরে ধনবিজ্ঞানে চলে আসে, কেমব্রিজ থেকে তাক-লাগানো পি-এইচ. ডি খেতাব জড়ো করে, এখন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক, বামপন্থী মহলে ঘোর সমাদর। বিয়ে করেছে আমার শিক্ষক সমররঞ্জন সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র মানিককে, যে অভিজিৎ সেন নামে অর্থনীতি মহলে সমধিক পরিচিত। তাঁদেরও এক কন্যা, জাহ্ণবী, দিল্লি গেলে যে আমাদের শাসনে রাখে।

চিঠিতে যোগাযোগ বরাবরই ছিল, ওয়াশিংটনে ফের দেখা হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী পাকিস্তানি কন্যা খুরশীদ হাসানের সঙ্গে। খুরশীদ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে কিছুদিন কাজ করেছে, তারপর পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতি নিয়ে বই লিখবে বলে গবেষণা করতে চলে এসেছে ওয়াশিংটনে, ওর দাদা পাকিস্তান দূতাবাসে উঁচু পদে বৃত। হ্যারি টুম্যানের জমানায় পররাষ্ট্রসচিব ডিন অ্যাচিশনের সঙ্গে কোথায় কী সূত্রে যেন ওর আলাপ, খুরশীদকে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, তার গবেষণার কাজে পর্যাপ্ত সাহায্য করবেন। ওর দাদার বাড়ি আমাদের বাসস্থানের কাছেই, অচিরে খুরশীদ তার দাদার ওখানে যতটা সময় কাটাত, আমাদের ওখানেও ততটাই, কিংব্রা তারও বেশি। হল্যান্ড থাকাকালীনই খুরশীদ আমাকে তাদের বংশের-ঘরবাড়ির অনেক কথা শুনিয়েছিল। বাবা মাঝারি গোছর সরকারি কাজ করতেন দিল্লিতে, আটটি ছেলেমেয়ে, সাধু প্রকৃতির মানুষ, ধর্মভীরু, অমায়িক, সজ্জন। দিল্লিতে টোডরমল রোডে ওঁদের বাড়ি ছিল, দেশভাগের পর সবাই করাচি চলে আসেন। কিন্তু দিল্লি শহর নিয়ে খুরশীদের সমাচ্ছন্ন স্বপ্নমেদুরতা, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করতো, সরল মেয়ে, আমাকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিশেবে জ্ঞান করে সমস্ত-কিছু খুলে বলতো, তবে তেজি মেয়েও সেই সঙ্গে। ওর একটি কিশোরীপ্রেমের আখ্যান, এক বিদেশি তরুণের সঙ্গে, আমাকে চুপি-চুপি বলেছিল, যে-প্রসঙ্গ আগেই উল্লেখ করেছি। যা হবার নয়, তা তো হতে পারে না, অতি ধর্মনিষ্ঠ সৈয়দ বংশের দুহিতা সে, বিদেশী ছেলেকে বিয়ে করার কথা কল্পনাতেও আনতে পারে না। ছেলেটি ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে যায়। তবে তাদের মধ্যে পত্র-বিনিময় চলতেই থাকে, তাতে খুরশীদের হৃদয়-দৌর্বল্যের উপশম না হয়ে তা বেড়েই চলে, প্রায়ই আমার কাছে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কান্না, ‘আমার কী গতি হবে’।

ওয়াশিংটনে খুরশীদের সঙ্গে যখন ফের দেখা, জানতে পেলাম সেই কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটেছে, ছেলেটি কী অসুখে ভুগে অতর্কিতে মারা গেছে। সেই শোক অনেকটা সে সামলে উঠেছে, কিন্তু সমস্যা, মনের ভার লাঘব করবার মতো মানুষ তার কাছে-পিঠে আদৌ নেই, আমাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনে আবার দেখা হওয়াতে যেন খানিকটা স্বস্তি পেল। ইতিমধ্যে সাত-আট বছর গড়িয়ে গেছে, সে এখন সম্রান্ত বয়স্কা তরুণী, ভারত-পাকিস্তান সমস্যা নিয়ে আমাদের মধ্যে মাঝে-মধ্যে একটু খুনসুটি হয়, তবে সে-সব ছাপিয়ে খুরশীদের সারল্য উপচে ওঠে।

এরই মধ্যে শচীনদা সানফ্রান্সিসকোতে এক সম্মেলনে যোগ দিতে আমেরিকা এলেন। আমারও সেই সম্মেলন উপলক্ষ্যে পশ্চিম উপকূলের ওই মোহ-মাখানো শহরে উড়ে যাওয়া। সম্মেলন তো ছুতো, শচীনদার উপস্থিতি মানেই অহোরাত্র আড্ডা, দিনকে রাত করা আড্ডা, রাতকে দিন করা আড্ডা। মার্কিন দেশের বিদ্বজ্জন মহলেও ইকনমিক উইকলি নিয়ে প্রশংসার বন্যা, যে-বন্যায় অবগাহিত হতে শচীনদার বিন্দুমাত্র সংকোচ বা দ্বিধা নেই। সম্মেলনান্তে তিনি ক্রমান্বয়ে এ-শহর থেকে ও-শহর, ও-শহর থেকে সে-শহর, ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। সবখানে তাঁর অনুরাগীজন, তাঁকে নিয়ে সভা-সম্মানপ্রদর্শনের অন্তহীন আয়োজন। হঠাৎ ফিলাডেলফিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন, অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন দেখা দিল, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সোজা ওয়াশিংটনে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে, তাঁর শরীর তখনও দুর্বল, তবু তাঁকে ঘিরে আমাদের সত্যিই আনন্দনিষ্যন্দ আকাশ। ওয়াশিংটন উজাড় করে তাঁর অনুরাগী-অনুরাগিণীরা—অধ্যাপক-ছাত্র-গবেষক-প্রশাসক-কূটনীতিবিদ—দেখা করতে এলেন, কয়েকটা দিন আমাদের অফুরন্ত উত্তেজনার মাদকতায় কাটলো। একজন-দু’জন মার্কিন মহিলা, তখনই টের পাচ্ছিলাম, তাঁকে গাঁথবার জন্য ব্যাকুল, কিন্তু ক্রান্তিমুহূর্তে চৌধুরী-ভ্রাতাদের আত্মরক্ষার আশ্চর্য প্রতিভা।

আক্রমণাত্মক মার্কিন মহিলাদের উল্লেখে অন্য একটি কাহিনী মনে পড়লো। সাতান্ন-আটান্ন সালে জনৈকা মার্কিন তরুণীকে কলকাতা এবং দিল্লিতে বহুবার এর-ওর-তার বাড়িতে দেখেছি। চোখে-মুখে কথা বলে, নাম গ্লোরিয়া স্টাইনাম। কলকাতা থেকে প্রথমবার আমেরিকাগামী প্লেনে চাপবো, মেয়েটির এক কলকাতাস্থ অনুরাগী, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গ্লোরিয়ার কাছ থেকে অনুরোধ পেয়েছেন, ওর জন্য যেন একজোড়া হীরেমণিমাণিক্য-খচিত সোনার বালা পাঠিয়ে দেওয়া হয়, আমরা কি দয়া করে সঙ্গে নিতে সম্মত আছি। মদন-শর-বিদ্ধ বন্ধুর অনুরোধ, ঠেলি কী করে? ওয়াশিংটনে পৌঁছে ওর দিদির বাড়িতে গ্লোরিয়াকে ফোন করলাম, সে ত্বরায় ছুটে এলো, বালাজোড়া দেখে মহা খুশি হয়ে আমার দু’ গালে চুমো খেল। ওর সঙ্গে আমেরিকায় আর তেমন দেখা হয়নি, দেশে ফিরে আসার কয়েক বছর বাদে হঠাৎ কাগজে পড়ি গ্লোরিয়া স্টাইনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় বিখ্যাততমা মহিলা, জ্যাকেলিন কেনেডির ঠিক পরেই, সে নাকি ওদেশে নারীবাদী আন্দোলনের পয়লা নম্বর নেত্রী। একটু ভয়ে-ভয়ে আছি, তার একদা-অলঙ্কার আসক্তির সংবাদ এখানে ফাঁস করলাম বলে, ভারতবর্ষের নারীবাদিনীরা আমার মাথা কাটতে আসবেন না তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *