দুই
বছর ঘোরে। এবার স্কুলে ভর্তি হবার পালা। আর্মেনিটোলা স্কুলে কিছুদিন আগে পর্যন্ত সাহেব প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমি যখন ভর্তি হতে গেলাম, এক বাঙালি খৃস্টানধর্মী ভদ্রলোক, একদা সম্ভবত সৈন্যবাহিনীতে ছিলেন, বীরেন্দ্রকুমার বিশ্বাস, প্রধান শিক্ষকের পদে আসীন। কড়া মানুষ; কোনও বিষয়ই তেমন পড়াতেন না, তবে স্কুলের নিয়ম-অনুশাসন রক্ষা করতেন সুদক্ষভাবে। ক্লাস চলাকালীন প্রায়ই করিডোর দিয়ে হেঁটে বেড়াতেন, লক্ষ্য করতেন, কোথাও শোরগোল হচ্ছে কি না, বা কোনও ছেলে দুষ্টুমি করছে কিনা। তাঁর হাতে ছড়ি। আমাদের দিকে মাঝে-মাঝে তাকিয়ে হয়তো কপট রাগেই বলতেন : ‘আমার বেতটা দেখেছো, তোমাদের চাইতে লম্বা’। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম তাই শুনে।
মুশকিল হলো ভর্তি হবার দিনই। একটা পরীক্ষা দিতে হবে। তৃতীয় শ্রেণীর জন্য নির্দেশিত কক্ষে তিনটি সারণিতে বেঞ্চিগুলি সাজানো। আমি বসেছি তৃতীয় সারণির একেবারে শেষের দিকে; ছেলেরা উচ্চ-অনুচ্চ স্বরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। এমন মুহুর্তে যিনি ক্লাস-শিক্ষক, নামটি এখনও মনে আছে, হেরম্বচন্দ্র ঘটক, অনেকে তাঁকে রঙ্গ করে ডাকতেন, ‘মিস্টার হর্স’, ঘটক-ঘোটকের উচ্চারণ-নৈকট্য হেতু। তো তিনি প্রথম সারণির ছেলেদের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন: ‘লেখো’। কোনও সরল বাংলা বই থেকে আট-দশটি পঙ্ক্তি ধীরে-ধীরে বললেন। আমি কিন্তু বসেই রইলাম; আমার ধারণা হলো, উনি তো প্রথম সারণির সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, তৃতীয় সারণিতে উপবিষ্ট আমি, আমি কেন লিখতে যাবো ? যে শাদা কাগজগুলি আমাদের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল, মিনিট পনেরো বাদে তা নিয়ে নেওয়া হলো। আমার কাগজটি অবশ্য শাদাই থেকে গেল, আঁচড়বিহীন। ঘণ্টা দেড়েক বাদে বাবা প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি সবিনয়ে বললেন, ‘আপনার ছেলের এখনও ভালো করে বোধোদয় হয়নি। কিছুই লিখতে পারেনি। বাড়িতে একটু শিখিয়ে-পড়িয়ে না হয় আগামী বছর ভর্তি করাবেন।’ বাবা জানালেন, বাড়িতে লেখাপড়ার ব্যাপারে আমি অনেকটাই এগিয়ে গেছি। প্রধান শিক্ষকমশাই কী ভাবলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সন্তান, শেষ পর্যন্ত ভর্তি করে নিলেন।
যত দূর মনে পড়ে, আমরা বোধহয় সবসুদ্ধু তিরিশ-পঁয়তিরিশ জন ছেলে ওই তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলাম। প্রায় অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক মুসলমান। সরকারি স্কুল বলেই বোধহয় মুসলমান ছাত্ররা একটু বেশি পরিমাণে এখানে পড়তে আসতো। হিন্দু ছাত্রদের শ্রেণীবিন্যাস উচ্চবিত্ত থেকে বড়োজোর নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যন্ত। কিন্তু মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই আশপাশের মহল্লার বস্তি থেকে এসেছে। তাদের বাড়িতে শিক্ষার আদৌ কোনও ঐতিহ্য ছিল না, পরিবার থেকে তারাই প্রথম, যারা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। শিশুরা সম্ভবত খুব নিস্পাপ হয়। অমুকরা হিন্দু, তমুকরা মুসলমান: এই বোধ হয়তো ছিল, তবে তা থেকে কোনও বিকৃত সিদ্ধান্তে পৌঁছুবার উৎসাহ কারও মধ্যে চোখে পড়েনি। স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে সবাই সবাইর সমান, সবাই সবাইকে বন্ধুভাবে মেনে নিয়েছি। কখনও-কখনও ঝগড়া হয়েছে, কিন্তু সেই কলহ সাম্প্রদায়িক বিষে জর্জরিত হয়নি।
উপরের ক্লাসে যাঁরা পড়তেন, তাঁরা আমাদের কাছে নায়কতুল্য। খেলাধুলোর উদ্যোগে হোক, নাটকে-আবৃত্তিতে হোক, কিংবা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্কুল বাড়ি সাজানোর উপলক্ষ্য হোক, তাঁদের প্রধান ভূমিকা নিয়ে আমাদের ছোটোদের মধ্যে সোচ্চার অথবা অর্ধ-উচ্চারিত কৌতূহল আর উৎকণ্ঠা। উঁচু ক্লাসে পড়তেন ঢাকার নবাববাড়ির ছেলে ইউসুফ রেজা; হকিতে তিনি তুখোড়! ইউসুফদা বড়োললাকের বাড়ির ছেলে, নিয়মিত স্কুলে আসতেন না তেমন। তবে অন্য কোনও স্কুলের সঙ্গে হকি খেলার প্রস্তাব এলেই তাঁকে খবর পাঠানো হতো; তিনি হাজির হয়ে আমাদের কৃতার্থ করে দিতেন। কিংবা ধরা যাক দোলারদা’র কথা। স্কুলের পশ্চিম-উত্তরপ্রান্ত সংলগ্ন মসজিদবাড়ির পাশের বস্তিতে থাকতেন। কিন্তু যখন বাইরে বের হতেন, পোশাকে খুব কেতাদুরস্ত। দোলারদা বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে আসছিলেন, কৃতকার্য হচ্ছিলেন না। তাতে কী, আমাদের স্কুলের যে-কোনও সমস্যার আসান করতে হলে দোলারদাই ভরসা। বনভোজনে যেতে হবে, দলপতি দোলারদা। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের স্কুল দলের ক্রিকেট অথবা ফুটবল খেলার ব্যবস্থা হয়েছে, নেতৃত্বে দোলারদা। গ্রীষ্মকালে প্রভাতী স্কুল, গ্রীষ্মবকাশের ছুটি শুরু হবার দিন মাস্টারমশাইদের ফুল দিয়ে, কবিতায় বন্দনা রচনা করে সম্ভাষণ জানাতে হবে, প্রধান উদ্যোক্তা দোলারদা। ইদলশরিফ অনুষ্ঠানে দোলারদা, এমনকি সরস্বতী পুজোর ব্যাপারেও প্রধান পরামর্শদাতা দোলারদা। মাস্টারমশাইদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু, একজন-দু’জন করে মুসলমান শিক্ষক সবেমাত্র যোগ দিচ্ছিলেন। পরাধীন দেশের আর্থিক দুর্দশা তখন চরমে। সরকারি স্কুলে তা-ও মাস্টারমশাইরা পঁচাত্তর টাকা করে মাইনে পেতেন, এবং কাজের স্থিরতা ছিল। অন্য পক্ষে বেসরকারি স্কুলে মাইনের হার সরকারি স্কুলের হারের অর্ধেকেরও কম।
একটু উঁচু ক্লাসে পৌঁছুবার পর আমাকে এক ভদ্রলোক বাড়িতে থেকে অঙ্ক পড়াতেন। তিনি পদার্থবিদ্যায় বি.এসসি-তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, এম. এসসি-তেও, বি.টি-তেও প্রথম শ্ৰেণী। শহরের পশ্চিমপ্রান্তের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাসিক পঁচিশ টাকা মাইনেতে কাজ করতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাধবার পর একচল্লিশ-বেয়াল্লিশ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের আবহাওয়া দফতরে চাকরি নিয়ে পুনায় চলে গেলেন, শুরুতেই মাস মাইনে ছ’শো টাকা। যে কথা বলছিলাম, মন্দার ভয়াবহতা, আর্থিক দুরবস্থার সেই ঋতুতে, অন্যত্র কাজের অভাবে, বুদ্ধিমান প্রতিভাবান ব্যক্তিরা সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করবার সুযোগ পেয়ে বর্তে যেতেন। নিজেরা পড়াশুনো করতেন, প্রচুর পরিশ্রম করে ছেলেদের জ্ঞানান্বিত করবার চেষ্টা করতেন। এখন বলতে দ্বিধা নেই, বিদ্যাচর্চা সম্পর্কে আমার যতটুকু আগ্রহ, তার প্রায় পুরোটাই আর্মেনিটোলা স্কুলের সেই সব মাননীয় শিক্ষকদের প্রসাদে।
নিচের এবং উপরের ক্লাসে যে-যে বইগুলি পড়ানো হতো, তাদের কিছু—কিছু স্মৃতি এখনও মুছে যায়নি। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সমসাময়িক ‘বান্ধব’ পত্রিকার সম্পাদক, ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিক, কালীপ্রসন্ন ঘোষের পৌত্র শ্রীপতিপ্রসন্ন ঘোষ সম্পাদিত একটি বাংলা সংকলন নিচের ক্লাসে পাঠ্য ছিল। বইয়ের গোড়ায় শ্রীপতিবাবুর নাম জ্বল্জ্বল্ করে ছাপা। শ্রীশ্রীপতিপ্রসন্ন ঘোষ। আমি বরাবর বলতাম, শ্রীশ্রী পতিপ্ৰসন্ন ঘোষ, অর্থাৎ তাঁর উপর দেবত্ব আরোপ করতাম। যদিও ভদ্রলোক অতিপরিচিত, প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন আড্ডা দিতে, তাঁর আটপৌরে আলাপের সঙ্গে কিছুতেই তাঁর ডবল শ্রী-ত্ব মেলাতে পারতাম না।
আরও যা মনে পড়ছে, তৃতীয় শ্রেণীতে শ্রীপতিবাবুর যে-সংকলনগ্রন্থ পড়তে হতো, তার প্রথম পাঠ রবীন্দ্রনাথের গান ‘তোমারই গেহে পালিছ স্নেহে তুমি ধন্য ধন্য হে’। সমস্যা দেখা দিল। ড্রিল-ড্রয়িংয়ের সঙ্গে আমাদের একটি আলাদা ঘণ্টা ছিল গানের জন্য। ক্লাস-শিক্ষক ঘটকস্যার সর্বপারঙ্গম, আমাদের গানও শেখাতেন। শেখাবার জন্য ধার্য ছিল ‘তোমারই গেহে…’ সংগীতটিই। ঘটক স্যার স্কেল উঁচিয়ে আমাদের বলতেন, ‘পদ বলো।’ গানের পদ কাকে বলে, তা আমার অন্তত জানা ছিল না। সুতরাং বছর ভরেই আমার ভাগ্যে জুটতে লাগলো স্কেলের বাড়ি, কিছুতেই আর ‘তোমারই গেহে’ গানটি শেখা হলো না। যেটা বলতে খুব আনন্দ পাচ্ছি, বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর বাদে যখন রাজ্যের মন্ত্রী হিশেবে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বসা শুরু করেছি, হঠাৎ একদিন বেলঘরিয়া কিংবা বনহুগলি থেকে ঘটকস্যার কাঁপা—কাঁপা অক্ষরে এক আশীর্বাদ-ভরা চিঠি পাঠালেন, যত্ন করে রেখে দিয়েছি চিঠিখানা।
ব্যায়াম শিক্ষক ছিলেন পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়। প্রথাগত কুচকাওয়াজ তো আমাদের দিয়ে করাতেনই, সেই সঙ্গে স্কুল-প্রাঙ্গণে সবাইকে জড়ো করে ‘ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণীতল’-এর সঙ্গে সুর-তাল মিলিয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়িতেও অভ্যস্ত করাতেন। অঙ্কন শিক্ষক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সম্ভবত রাঢ় দেশের মানুষ, আমরা খুব বেশি চেঁচামেচি করলে জুলপির উপর চুল ধরে টানতেন। কিন্তু অন্য সময় প্রশান্ত, সমাহিত। ব্ল্যাকবোর্ডে রঙিন খড়ি বুলিয়ে বলতেন, ‘এমনি করে, এমনি করে’। আমরা তাঁকে অনুসরণ করছি কি না তা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ ছিল না বলেই প্রথম বছর বাৎসরিক পরীক্ষায় একটি পাখি আঁকতে বলায় আমি তিনটি এঁকে পঞ্চাশে তিন পেয়েছিলাম। তাতে অবশ্য প্রমোশন আটকায়নি। সংস্কৃতের পণ্ডিতমশাই প্রিয়নাথ বিদ্যাভূষণ দ্বারা সংকলিত একটি গ্রন্থ উপরের ক্লাসে আমাদের পাঠ্য, সম্ভবত প্রবেশিকা পরীক্ষায় সেই গ্রন্থ থেকে প্রশ্ন করা হতো। পণ্ডিতমশাই-কৃত এই সংকলনের কথা বিশেষ করে মনে আছে, কারণ তাতে বুদ্ধদেব বসুর একটি কবিতা ছিল। তাতে বুদ্ধদেব অঙ্গীকার করছেন, তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ উচ্চাভিলাষ, গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজে নিজেকে নিয়োগ করা। কবে কোন মাহেন্দ্রলগ্নে যে তিনি কবিতাটি রচনা করেছিলেন, পরে মাঝে-মাঝেই লোভ হয়েছে বুদ্ধদেব বসুকে জিজ্ঞেস করি। পাছে তিনি লজ্জা পান, প্রতিবারই নিজেকে সংবরণ করেছি।
সরকারের স্কুল, মহামান্য ইংরেজ সরকারের। সুতরাং ইতিহাস পাঠের অর্ধেকটা জুড়ে ইংল্যান্ডের ইতিহাস, বাকিটা ভারতের। প্রবেশিকা পরীক্ষায়ও ইতিহাসের এই দু’টি ভাগ বজায় ছিল। ১৯৩৬ সাল, আমি স্কুলের নিচের শ্রেণীতে। জানুয়ারি মাসে সম্রাট পঞ্চম জর্জের রজতজয়ন্তী অভিষেক। স্বদেশী পরিবার থেকে এসেছি, তাতে তো ব্যত্যয় ঘটবার নয়: সারা স্কুল জুড়ে খানাপিনা হলো, আমরা নিমন্ত্রিত, আমাদের অভিভাবকরা পর্যন্ত।
(পরেও আর একবার মহোৎসবের আয়োজন হয়েছিল আমাদের স্কুলে। প্রধান শিক্ষক মহোদয় একটু বেশি বয়সে, ১৯৪০ সালে, বিবাহ করলেন। আমাদের আনন্দ ধরে না। ব্যান্ড বাজলো, বিউগল বাজলো, স্কুলের চারশো ছাত্র খানাপিনা করলো। পরের দিন ছুটি ঘোষিত হলো, যেমন হয়েছিল পঞ্চম জর্জের জয়ন্তী উৎসবের পরের দিন।)
বাড়িতে হয়তো আগেই এ-বি-সি-ডি তালিম নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু স্কুলেই রীতিমতো ইংরেজি শিক্ষার শুরু। বহু বছর ধরে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন মাইকেল ওয়েস্ট। তিনি ছাত্রদের ভালো করে ইংরেজি শেখবার সুবিধার জন্য অভিনব পদ্ধতিতে একটি পাঠ্যপুস্তকমালা রচনা করেছিলেন, ‘নিউ মেথড রিডার’। একেবারে গোড়ায় ইংরেজি অক্ষরমালা চেনাননা, তারপর বিএটি ব্যাট, সিএটি ক্যাট পর্যায়। প্রতি খণ্ডে হয়তো পনেরো-কুড়িটি অধ্যায়: কোনওটি গল্প, কোনওটি কবিতা, কোনওটি হয়তো বা প্রবন্ধ, সরল শব্দের সমারোহ। সেই সঙ্গে ছবির বাহার, প্রতিটি অধ্যায়ের পর লেখা থাকতো ‘তুমি এখন পঁচিশটি শব্দ জানো’, বা ‘আটশো পঞ্চাশটি’ কিংবা ‘এক হাজার’। আর ছিল ভারতীয় পুরাণ থেকে অথবা আরব্য উপন্যাস থেকে সরলীকৃত কিছু উপাখ্যান, নয়তো কোনও ইংরেজি বাচ্চাদের ছড়া। ধাপে-ধাপে এগিয়ে যাওয়া, কবিতার ছন্দ শেখা, পাশাপাশি এখানকার-ওখানকার নানা ইতিবৃত্ত, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের কথা ওয়েস্ট সাহেবের বই থেকেই আমি প্রথম জানতে পেরেছিলাম। অথবা সেই ভয়ংকর দানবের কথা, যে বলতো, ‘ফি ফাই ফো ফাম, আই স্মেল দি স্মেল অফ এ ম্যান, বি হি অ্যালাইভ অর বি হি ডেড, আই শ্যাল ইট হিম উইথ মাই ব্রেড’। আলিবাবা আর সেই চল্লিশ দস্যুর কাহিনীও ওয়েস্ট সাহেবই আমাদের প্রথম শুনিয়েছিলেন। একটু-একটু করে এগোতাম আর মনে-মনে আওড়াতাম এতগুলি ইংরেজি শব্দ আমরা এখন জানি, প্রভুদের ভাষার শব্দ।
তবে শিক্ষার বাহন কিন্তু পুরোপুরি বাংলাই ছিল। ইতিহাস, ভূগোল, গণিত: সব-কিছুরই পাঠ্যপুস্তক বাংলাতে। ইতিহাস-ভূগোল চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের স্কুলে খানিকটা অভিনবত্ব। আগেই উল্লেখ করেছি, ইতিহাস পাঠের দুটো ভাগ: ইংল্যান্ডের আর ভারতের। প্রধান-প্রধান ঐতিহাসিক চরিত্রদের মুখে শিক্ষকমশাইরা কাল্পনিক ভাষণ রচনা করে বসিয়ে দিতেন, ভাষণে তাঁদের উজ্জ্বল কীর্তি ধরা পড়তো। তেমনই ভূগোলের ক্ষেত্রেও: বাঘা-বাঘা পর্যটকদের মুখে তাঁদের রোমাঞ্চকর ভ্রমণের বৃত্তান্ত উল্লিখিত হতো, যেমন মার্কো পোলো, আলবেরুনি, অথবা, নামটা যত দূর মনে পড়ছে, লাতিন পরিব্রাজক রুবরুকি। বিভিন্ন শ্রেণী থেকে একটু চোখে-মুখে কথা-কওয়া ছেলেদের বেছে নিয়ে তাদের দিয়ে এ সব ভূমিকার ভাষণ বলার সঙ্গে হাত-পা নেড়ে অভিনয় করার ব্যবস্থা ছিল দেদার। পড়ন্ত বিকেলে স্কুল ছুটি হবার আগে দোতলায় ট্রেনিং কলেজের লেকচার গ্যালারিতে ছাত্রদের জড়ো করে ঐতিহাসিক কিংবা ভৌগোলিক চরিত্রে অভিনয়ের আয়োজন, যথাযথ পোশাক পরিয়ে, এমনকি গোঁফ-দাড়ি-পরচুলার ব্যবস্থা করেও। একই সঙ্গে পড়াশুনো তথা বিনোদনের সমাহার।
আরও যে-ব্যাপারটা ছিল, বছরের গোড়ার দিকে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিটি ক্লাসেই বি.টি কলেজের শিক্ষার্থীরা উপর থেকে এসে আমাদের পড়ানোর ভার নিতেন। এটা তাঁদের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত সূচী, তথাকথিত কেজো অনুশীলন, তাঁরা কীরকম পড়াচ্ছেন, ছাত্রদের মধ্যে কতটা আগ্রহ-উৎসাহ সঞ্চার করতে পারছেন, পড়াতে গিয়ে তাঁদের জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে কি না, এসব বিষয়ে তাঁদের পরীক্ষা নেওয়া হতো। পরীক্ষকমশাইরা এ সমস্ত কিছু দেখে এবং শুনে ক্লাসের এক কোণে বসে তাঁদের মন্তব্য নোটখাতায় পেশ করে চলে যেতেন। পাঠরত বি.টি ক্লাসের বাচ্চা মাস্টারমশাইরা যেমন আসতেন, তেমনই আসতেন কচি দিদিমণিরাও। দিদিমণিদের মধ্যে ভালোমানুষ কাউকে—কাউকে নিয়ে আমরা একটু মজাও করতাম। আর আমাদের খোদ মাস্টারমশাইরাও দিদিমণিদের খেপাতেন। বলতেন, ‘আমাদের ছেলেরা আপনাদের এত ভালোবাসে যে আপনারা চলে যাওয়ার পরও কিছুদিন আমাদের স্যার না বলে দিদিমণি সম্বোধন করে ওরা।’
স্কুলের নিচের ক্লাস থেকে শুরু করেই, কিংবা তার আগে থেকেই, পাঠ্যপুস্তকের গণ্ডি অতিক্রম করে, যে-কোনও বইয়ের দিকে আমার ঝোঁক। অতি শৈশবে, তখন তো রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ আমাদের জন্য ছিল না, বিদ্যাসাগর মশাইর ‘বর্ণ পরিচয়’ ও যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘হাসিখুশী’ পেরিয়ে ‘মোহনভোগ’ (‘কে নিবি মোহনভোগ আয় ছুটে’ আয় সে যে অমৃতযোগ স্নেহমমতায়’), উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সুললিত ভাষায় কাহিনীসম্ভার। কুঁচবরণ-কন্যা-তার-মেঘবরণ-চুল, চাঁদ-সদাগর, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি রাক্ষস-খোক্কস, সুয়োরানি-দুয়োরানিদের গল্পের পর গল্প: ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র সঙ্গে আরও এন্তার বইয়ের মিশেল। এখন আর মনে আনতে পারি না কোথায় পড়েছিলাম: ‘পেটুক গণেশ, পেটুক গণেশ, তোমার কী কী খেতে রুচি?’ যার ঝটপট জবাব: ‘নরম-নরম রসগোল্লা আর গরম-গরম লুচি’। একটু বড়ো হলে আনন্দ-আবিষ্কারের কপাট একটির পর আর একটি খুলে যায়। দেব সাহিত্য কুটিরের বার্ষিক সংকলনগুলি, ‘বার্ষিক শিশুসাথী’, ‘মৌচাক’, ‘রামধনু হেমেন্দ্রকুমার রায়ের রুদ্ধশ্বাস-করা বিমল-কুমার কাহিনী ‘যখের ধন’, ‘আবার যখের ধন’, পাশাপাশি জয়ন্ত-মানিক-সুন্দরবাবু। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘চালিয়াৎ চন্দর’, দমকা হাওয়ার মতো শিবরাম চক্রবর্তী। সাধারণ জ্ঞান-বিলোনো সেই চমৎকার বই ‘কে কী কেন কবে কোথায়’, লেখকের নাম এখন আর মনে নেই। যেমন মনে নেই কে লিখেছিলেন, এক ছারপোকার সেই চমকপ্রদ আত্মজীবনী, ‘রক্তচোষার দিগ্বিজয়’। না, আমাদের বাল্যে-কৈশোরে ‘আবোল-তাবোল’ অনুপস্থিত: শুধু মায়ের মুখে একটি-দু’টি মজাদার ছড়া শুনেছি মাত্র।
মনস্তাপ তো অন্য কারণেও। বাড়ির সবক’টি ছেলেমেয়েকে সন্ধ্যাবেলা অর্গ্যান বাজিয়ে মা গান-গাওয়ার তালিম দেওয়াতেন। কোন ফাঁকে আমি ও আমার এক তুতো ভাই পালিয়ে যেতাম, ‘ঐ যে তোমার ভোরের পাখি, নিত্য করে ডাকাডাকি’-র বৃত্তের বাইরে। সুরবোধ আছে, কিন্তু গলায় সুর নেই, এখন অনুশোচনা হয়।
স্কুলের বৃত্তান্তে ফিরে আসি। যে-কোনও শ্রেণী থেকে হঠাৎ-হঠাৎ আমাদের দোতলার লেকচার গ্যালারিতে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হতো। আমরা বসতাম গ্যালারির সামনে। পিছনের সারিগুলিতে বি টি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপকরা আমাদের পড়িয়ে আদর্শ শিক্ষণের নমুনা দেখাতেন, ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস বা ভূগোল। একবার ট্রেনিং কলেজের পঠনে সাহায্যে কলেজের অধ্যক্ষ আমাদের দু’দিন ধরে র্যাল্ফ হজসনের ‘টাইম ই ওল্ড জিপসিম্যান’ পড়িয়েছিলেন। প্রথম দিন পঠনান্তে তিনি আমাদের বললেন, ‘কবিতাটি কাল বাংলায় অনুবাদ করে নিয়ে এসো সবাই।’ আমি যে-বাংলা বয়ানটি নিয়ে হাজির হই তা তাঁর বেশ মনঃপূত হয়, নিজেই ঘরভর্তি সবাইকে পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন সেই পদ্য। আমার সেই আদি অনূদিত কবিতার কিছুই আর মনে নেই, শুধু এইটুকু ছাড়া: ‘আর কত সুন্দরী বালা/গলায় দেবে তোমার মালা’। এখনও মাঝে-মাঝে শখ হয়, হজসনের কাব্যগ্রন্থ পেড়ে কবিতাটির মূল ইংরেজি পাঠ কী ছিল জানতে; হয়তো বাকি জীবনে সেই শখ মিটবে না। তবে স্কুল ম্যাগাজিনে আমার নামে ছাপানো প্রথম পদ্য নির্ভেজাল অপরাজিত দেবী : ‘আমি শুধু বেঞ্চিতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ ত্রিভুজের যূপকাঠে গলা দিছি বাড়িয়ে’।
সময় গড়িয়ে যায়। তৃতীয় থেকে চতুর্থ, চতুর্থ থেকে পঞ্চম, তারপর একটু-একটু করে উপরের ক্লাসে উঠে গেলাম। ইতিমধ্যে পুরনো বহু সহপাঠী এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল; নতুন সহপাঠীও এলো অনেক। আমরা গড়ে তিরিশ-পঁয়তিরিশ জন, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী থেকে। তবু, কিছু আগেই উল্লেখ করেছি, বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েও সম্প্রীতির অভাব বোধ করিনি কখনও। স্কুলে প্রথাসিদ্ধ যে-সমস্ত খেলাধুলো হতো, আমাদের ক্ষেত্রেও তাদেরই চল ছিল। স্কুলের সামনের দিকে বিস্তীর্ণ মাঠ, পিছনেও। পিছনের মাঠটাকে বলতাম বি টি ফিল্ড, টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ছাত্রদের থাকবার হস্টেল-সংলগ্ন বলে। খেলা হতো ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, হা-ডু-ডু কিংবা বাস্কেটবল। তা ছাড়া ব্যবস্থা ছিল অন্য একটি ক্রীড়ার, বোধহয় পৃথিবী থেকে যা ইতিমধ্যে বিলুপ্ত, আমরা বলতাম ‘হ্যান্ডবল’। ফুটবলের তুলনায় অনেক ছোটো মাঠে খেলা, মাঠের মধ্যবিন্দুতে, ফুটবলের মতোই, রেফারিমশাই বাঁশি বাজাবার সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়ে যেত খেলা। হাতে ড্রিবল করে অন্য পক্ষের গোলে বল ঢোকাবার লড়াই। ফাউল ছিল, এমনকি পেনাল্টি কিকও ছিল। স্কুলের তত্ত্বাবধানেই প্রতিযোগিতামূলক খেলা হতো, হকি, ফুটবল, ক্রিকেট আর বাস্কেটবলে, বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে। দল বাছাই নিয়ে উত্তেজনা ছিল: কারও হরিষ, কারও বিষাদ। প্রতিযোগিতায় জেতা-হারা নিয়েও সমান উত্তেজনা। ‘পেনাল্টি কিক’-এর মতো রাশভারি শব্দটি আমাদের জিভে-ঠোঁটে ঠিক আসতো না, বলতাম ‘প্ল্যান্টিক’। কলেজে উঠেও এই শব্দটি উচ্চারণ করেছি বলে মনে পড়ে। আরও একটি মজার ব্যাপার চালু তখন। প্রতিযোগিতায় কোনও ক্লাস হেরে গেলে সঙ্গে-সঙ্গে তারা প্রতিবাদপত্র লিখতে বসতো। আমাদের যিনি ব্যায়াম শেখাতেন তিনিই ছিলেন ক্রীড়াশিক্ষক, চিঠি যেত তাঁরই কাছে। যথা, ‘আমাদের অমুক সময়ে একটি প্ল্যান্টিক প্রাপ্য ছিল। আমাদের তা দেওয়া হয়নি।’ যথা, ‘এই প্রতিযোগিতায় নিয়ম, প্রতিযোগীরা কেউই চার ফুট নয় ইঞ্চির বেশি লম্বা হতে পারবে না। কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষের অমুক ছেলেটি কোমরে রশি বেঁধে নিজের দৈর্ঘ্য দেড় ইঞ্চি কমিয়ে এনেছিল। সুতরাং ওই দলকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে, এবং পরের রাউন্ডে আমাদের উত্তীর্ণ করতে হবে।’
যেটা বলতে ভুলে গেছি, উপরের ক্লাসের ছেলেদের জন্য টেবল টেনিসও চালু হয়েছিল সেই সময়, আমরা বলতাম ‘পিংপং’। দৌড়ঝাঁপ, মই বেয়ে ওঠা, স্লাইড বেয়ে নামা ইত্যাদি তো ছিলই। বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর স্কুলের বাৎসরিক স্পোর্টস। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে একটি আজব প্রতিযোগিতামূলক খেলাও বার্ষিক ক্রীড়া উৎসবের আবশ্যিক অঙ্গ ছিল: ধীরে সাইকেল চালানো। নিয়ম এরকম: সাইকেলের উপর বসে, ভারসাম্য বজায় রেখে, অথচ স্থাণু না থেকে, প্রতিযোগীদের সাইকেল চালাতে হবে; যে সবচেয়ে পরে প্রান্তরেখায় পৌঁছুবে, সে জয়ী; মধ্যপথে যাঁরা ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাবে, তারা তো আগেই বরবাদ। জীবনের প্রান্তসীমার কাছাকাছি এসে এখন বন্ধুবান্ধবদের বলি, আমরা নিয়ত ধীরে সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতায় নিরত; কে আগে ঢলে পড়বো সাইকেল থেকে, কে পরে পড়বো, কেউ তা জানি না।
বছরের পর বছর, ঋতুর পর ঋতু গত হয়, আমাদের চেতনার মানও ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী, কখনও ধীর লয়ে, কখনও দ্রুত। স্কুলের পাঠক্রম এবং পরিপার্শ্ব থেকে জ্ঞানের পরিধি বাড়ে একটু-একটু করে। বাড়ির আবহাওয়া থেকেও প্রতিদিন নিত্যনতুন জ্ঞানাহরণ করছি, পাড়াতে ঘুরে বেড়িয়েও। সরকারি স্কুল, অনেক বাধার নিগড়, প্রহরগুলি কাটাতে হয় রাজভক্তির পরাকাষ্ঠার মধ্যে। মহল্লায়-মহল্লায়, এ-পাড়া ও-পাড়ায় এবং বাড়ির মানচিত্রে অথচ অন্য ঢেউয়ের সঞ্চার। ইতিউতি মিছিলের উচ্চারণে শুনি, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই,’ ‘বিনাবিচারে আটক আইন রদ করতে হবে’ ইত্যাদি। একটু রোমাঞ্চ, একটু গা-ছমছমানি হয় সেসব শুনে। তবে যেটা এখনও গভীর বিষাদে মনকে ছেয়ে যায়, তা কয়েক ক্লাস উপরের ঘটনা। শহর জুড়ে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তার ফিসফাস। মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব পর-পর পাঁচবার লিগ জিতেছে সেই পর্বে। বাঘা-বাঘা খেলোয়াড়—ওসমান জান, জুম্মা খাঁ, বাচ্চি খাঁ, বড়ো রশীদ, ছোটো রশীদ, নুর মহম্মদ, দলপতি আব্বাস—এঁরা তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মাঠে-ময়দানে। প্রবীণ হিন্দুরা সহসা তাই নিয়ে মনস্তাপ করতে আরম্ভ করলেন, যার ছোঁয়া অল্পবয়সীদের মধ্যেও সেঁধোনো। মুসলমান ছাত্রদের মধ্যেও প্রতি-আলোড়ন। তাদের কেউ-কেউ বলতে শুরু করলো, ইচ্ছা করে, ছক কেটে তাদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে, হিন্দু জমিদাররা তাদের শোষণ করছে। ফজলুল হক সাহেব ওই সময়েই কংগ্রেস দলের সঙ্গে প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন। তাঁকে তা গড়তে দেওয়া হলো না। বাধ্য হয়ে মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বঙ্গ প্রদেশের সরকার গড়লেন তিনি। জ্ঞানোন্মষের পর আমি বহুবার ভেবেছি, শরৎ বসু মশাইকে যদি ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে হাত মেলাতে কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিতেন, তা হলে হয়তো গোটা ভারতবর্ষেই তথাকথিত সাম্প্রদায়িক সমস্যা অন্য চেহারা নিত। যদি বছর পাঁচেক হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা মিলে-মিশে প্রাদেশিক প্রশাসন চালনা করতেন, জনমুখী, বিশেষ করে প্রজাকুলের স্বার্থে, বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, ভেল্কিবাজি ঘটতো। হক সাহেব নিজের উদ্যোগে জমিদার ও মহাজনদের ক্ষমতা খর্ব করতে যেমন সফল হয়েছিলেন, তেমনই হতে পারতো কংগ্রেস-কৃষক প্রজা দলের সম্মিলিত উদ্যোগেও। নিশ্চয়ই তার প্রভাব গোটা ভারতবর্ষের রাজনীতির উপর ছড়িয়ে পড়তে এবং সম্ভবত বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক অভ্যুদয় কুড়ি-পঁচিশ বছর এগিয়ে আসতো। ফলে তাঁদের হীনম্মন্যতাবোধ দ্রুত হ্রাস পেত, অন্য দিকে উপর তলার হিন্দুদের ছড়ি-ঘোরানো মানসিকতা ক্রমশ দমিত হতো। এটা তো না মেনে উপায় নেই, আমাদের মতো দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখনও পর্যন্ত সমাজচেতনার অগ্রদূত হিশেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে সুখবোধ করেন। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্তদের মধ্যে যদি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সৌম্য সংঘটিত হতো, সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির আশঙ্কা অঙ্কের নিরিখে অনেকটাই নির্বাপিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
তবে এ সমস্তই ভাবনাবিলাস! কেউ-কেউ হয়তো যুক্তি দেবেন, তেলে-জলে মিশ খায় না, জমিদারসংকুল কংগ্রেস দলের সঙ্গে গরিব কৃষকদের সমর্থনপুষ্ট কৃষক প্রজা দলের বোঝাপড়া খুব বেশিদিন টিকতে না; জমিদারি উচ্ছেদ ও ঋণ মকুবের ব্যাপারে দুই দলে সংঘাত তো প্রায় অবধারিত ছিল; পরিণামে সম্মিলিত সরকার অচিরেই ভেঙে পড়তো। কিন্তু, অন্তত একটি সম্ভাবনা আমার কাছে এখনও তেমন অবাস্তব মনে হয় না: যে আড়াআড়ি হতো, তা হতো শ্রেণীবিন্যাসের ভিত্তিতে; হয়তো কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা দলের উপরতলার জমিদার ও তাঁদের সমর্থক মানুষজন এক দিকে হেলে পড়তেন, অন্য দিকে গরিব হিন্দু- মুসলমানের জোট অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উঠতো।
যা ঘটে গেল, বিকল্প কী ঘটতে পারতো, তা নিয়ে বিস্তারিত হওয়ার সত্যিই হয়তো তেমন আর সার্থকতা নেই। যেটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, স্কুলের প্রতিটি ক্লাসে শ্রেণীবিন্যাসের জটিলতা সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলমান ছেলেরা একসঙ্গে ক্লাসে বসতাম, দুষ্টুমি করতাম, খেলতাম, বাড়ি-বাড়ি ফুল চুরি করতাম, কেউ পড়াশুনোয় একটু খাটো হলে তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতাম। আমাদের চেতনায় অন্তত সাম্প্রদায়িক সমস্যাটি কোনও বড় আকার নিয়ে হাজির হয়নি। গোলমাল বাধতে শুরু করলো ১৯৪০-৪১ সাল থেকে: খবরের কাগজে বিষ ছড়ানো, কংগ্রেসের তরফ থেকে ফজলুল হককে শত্রু বলে ঘোষণা করা, অতঃপর তাঁর মুসলিম লিগে ঢুকে পড়া, সেই সঙ্গে বিভিন্ন চক্র থেকে দাঙ্গার উস্কানি ইত্যাদি নানা গোলমেলে পরিস্থিতির সৃষ্টি। একচল্লিশ সালের একটা বড় সময় জুড়ে ঢাকায় আমরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হই। স্কুল বন্ধ, হাটবাজার বন্ধ, লোকালয় নিঝঝুম, এ-পাড়া থেকে ও-পাড়ায় যেতে গা ছমছম। বারো-চোদ্দো বছরের বাচ্চা ছেলেদের ধরে পাড়ার দাদারা ছুরি চালানোয় হাতেখড়ি দিচ্ছেন। প্রথমে কলাগাছে ছুরি চালিয়ে নিশানা এবং আঙ্গিক রপ্ত করা; ছেলেছোকরারা এই বিদ্যায় তালেবর হয়ে উঠলে তাদের মন অস্থির, হাত নিশপিস। অন্য সম্প্রদায়ের কোনও গরিব ফেরিওয়ালা এ পাড়ায় এলে কীভাবে তাঁর পেট ফাঁসিয়ে দেওয়া হতো, এ-পাড়ার শিক্ষক বা কেরানি ও-পাড়ার মধ্য দিয়ে শর্ট কাট করতে গিয়ে কেমনভাবে আক্রান্ত হতেন, কচি মাস্তানদের দাপটের রমরমা, কীভাবে তারা তৈরি হতো দাগি অপরাধী হিশেবে, চোখের সামনে সে সব দৃষ্টান্তিত হতে দেখেছি। অন্য সম্প্রদায়ের কোনো চটজলদি শিকার না পেলে ওই কচি অপরাধীর দল তখন নিশ্চিন্তে-ঘাস- খেয়ে-বেড়ানো মাঠে-চরা ঘোড়াগুলির পেট ফাঁসিয়ে দেওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা হতো। এই পাপের তো ক্ষমা নেই। যে-গুরুজনস্থানীয়রা তখন এদিকে-ওদিকের নেতৃপর্যায়ে স্থিত ছিলেন, তাঁদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমরা করেছি গত পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে।
সমস্ত অন্তঃকরণ এখনও সেই ভয়ংকর স্মৃতির নির্দয়তায় শিউরে ওঠে। স্কুল-কলেজে যাওয়া, দোকানপাট, বাজার, অফিসে আদালতে হাজিরা, সব-কিছু বন্ধ। দিনভর গুজবের একচ্ছত্র আধিপত্য। ওই দুঃসহ বাতাবরণে সব গুজবের বাস্তব ভিত্তিও উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। জটলা এ-পাড়ায় যেমন, ও-পাড়ায়ও তেমনি। গোনাগুনতিও হতো, যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছি আমরা: আজ ওদের ঊনতিরিশজন ঘায়েল, আমাদের বাইশজন, আগামীকাল এই ঘাটতি উসুল করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হোক তক্ষুনি। ছেলেদের ডেকে তাদের উপর ফরমান চাপানো হলো, কে ক’টা ছুরি মারবে, ক’টা ঘরে আগুন দেবে, কোন-কোন বাড়িতে ঢুকে লুঠপাট চালাবে।
১৯৪১ সাল শেষ। ১৯৪২-এ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স্ এলেন আর গেলেন। জওহরলাল নেহরু ও জিন্নার পারস্পরিক দাবি-দাওয়াগত সমস্যার কোনও ফয়সালা তিনি করতে পারলেন না। গান্ধিজী বলতে শুরু করলেন, প্রভুগণ, ঢের হয়েছে, এবার তোমরা বিদায় নাও, তেমন তেমন হলে ভারতবর্ষকে নৈরাজ্যের হাতে ছেড়েই প্রস্থান করো; আমাদের ভবিষ্যৎ আমরাই তৈরি করে নেবো৷ ততদিনে অবশ্য জিন্না রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছেন। বিলেতে প্রধানমন্ত্রী রূপে আসীন হয়েছেন পরম নাক-সিঁটকোনো উইনস্টন চার্চিল মহাশয়। একের পর আর-এক ঘটনাবলী: ভারত ছাড়ো প্রস্তাব, কংগ্রেস নেতাদের গ্রেফতার, দেশের নানা প্রান্তে অস্থিরতা, ডাক ও তার চলাচল বন্ধ, রেললাইন উপড়োনো, ধর্মঘটের পর ধর্মঘট। ততদিনে তো মনের দিক থেকে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবধান দুস্তর বেড়েছে। অথচ এমনটা না-ও হতে পারতো। হরিপুরা এবং ত্রিপুরী কংগ্রেসের স্মৃতি তখন প্রায় ফিকে। সুভাষচন্দ্রকে প্রায় ঘাড় ধরে কংগ্রেস দল থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে। তিনি ফরোয়ার্ড ব্লক গড়লেন, হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একবার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়কে পরস্পরের কাছাকাছি টানবার উদ্যোগ নেওয়া হলো। পাশাপাশি, কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে ১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্র মুসলিম লিগের সঙ্গে মিতালি করলেন; উপরন্তু লিগের পক্ষ থেকে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পথও মসৃণ করে নিলেন। কংগ্রেস দলে তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা: ‘জাতীয়তাবাদী’ সংবাদপত্রে ছুভাছ মিয়াঁ ও আচার্য ইস্পাহানিকে ব্যঙ্গ করে কার্টুনের পর কার্টুন। স্পষ্টতই অনেক দেরি হয়ে গেছে। কে জানে, সুভাষচন্দ্র যদি সে-মুহূর্তে ইউরোপে প্রস্থান না করতেন, হয়তো যে-সম্ভাবনার অঙ্কুর ফুটতে-ফুটতে নির্জীব হয়ে পড়েছিল তাকে বাঁচিয়ে তোলা যেত আর একবার।