৪
নন্দ চাটুজ্জের ভদ্রাসনে মহাপ্রসাদ কিছু বেশি পরিমাণে সেবা করা হয়ে গেছে। দুর্গাচরণ তাই জানিয়ে রেখেছেন, রাত্রে এক কুচো প্রসাদ মুখে দেবেন মাত্র। সন্ধ্যাহ্নিক সেরে তিনি উঠে এলেন ভিতরবাড়িতে। এত সকাল-সকাল সচরাচর তিনি বৈঠকখানা ছেড়ে আসেন না। সন্ধ্যায় তাঁর কাছে আসতে থাকে নানান দর্শনার্থী। অধিকাংশই তন্তুবায় পরিবার। তাদের নানান আর্জি, নানান দাবী-দাওয়া। আজ কিন্তু উনি এক প্রহর রাত না হতেই শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন। মৃন্ময়ী ঘরে ঘরে ধুনো দিচ্ছিল বিশেষ করে শয়নকক্ষে। মশা প্রচণ্ড! সন্ধ্যাবেলায় ধুনো না দিলে ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়ে। বামুনবাড়ি বলে রেয়াৎ করে না। দুর্গা ওকে কাছে ডাকলেন, শোন। এখানে এসে বস দিনি। কতা আছে।
—রসুন, তেলের বাটিতে এট্টু তেল গরম করে আনি।
—থাক না, ছুট্কি। একদিন পদসেবা না করলে তোমার সগ্যের বাতি কমতি হবে না। বসো দিনি। দুটো প্রাণের কতা কই! আজ একটা ভারি মজার কতা শুনে এলুম চাটুজ্জেবাড়ি তোমারে বলি।
মৃন্ময়ীকে উনি সচরাচর ‘ছোট গিন্নি’ নামে ডাকেন। আবেগ উথলে উঠলে—‘ছুট্কি’! মৃন্ময়ী ওঁর নাগালের মধ্যে একটা তালপাখা এগিয়ে দিয়ে বলে, কী শুরু করলেন আপনি! সঝে রাতে প্রাণের কতা! ঠাকুরপোর আহ্নিক এখনো সারা হয়নি। ঠাকুরঘরে অংবং করছেন।
—করুন। তুমি ইদিকে এস দিনি।
মৃন্ময়ী ওঁর চতুর্থপক্ষ। এ সংসারে এসেছে সম্প্রতি। এখনো বছর পোরেনি। নববধূই বলা চলে। তখন সে ছিল পঞ্চদশী। এক বছরেই ষোলকলা পুরেছে। ভাগ্যবতী বলতে যা বোঝায়। এই ভরভরান্ত গাঙ্গুলী পরিবারে রাজ-রাজেশ্বরী হয়ে এসেছিল একেবারে অসপত্ন-অধিকারে! কটা এয়োতি মেয়ের সে ভাগ্য হয়? বড়-সতীন—যদি আজও বেঁচে থাকেন—তাহলে পঞ্চাশোর্ধবা—দীর্ঘদিন কাশীবাসী। একটিমাত্র সন্তান তাঁর—কন্যাসন্তান। মাঝের দুই সতীন অসময়ে সংসারের মায়া কাটিয়েছে। একটি সন্তান প্রসব করতে গিয়ে—আহা ছেলেই হত তার, হল না। দ্বিতীয় জন আন্ত্রিক রোগে। বৃদ্ধ বয়সে লুপ্ত-পিণ্ডোদক হবার আশঙ্কায় বাধ্য হয়ে বৃদ্ধকে চতুর্থপক্ষ করতে হল। তবে মৃন্ময়ীকে বিবাহ করতে প্রথমটা কিছুতেই স্বীকৃত হননি—তার একমাত্র অপরাধ, সে অত্যন্ত সুন্দরী! দৃঢ় আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, না, না, সে হয় না। আমি তো শুধু বংশধরের কামনায় ……
কন্যাদায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণ পীতু মুখুজ্জে ওঁর হাতদুটি ধরে বলেছিলেন, কী আবোলতাবোল বলছেন গাঙ্গুলী-মশাই! পুত্র কামনাতেই তো সবাই বিবাহ করে! শাস্ত্রেই আছে—‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’! আমি যে নিতান্ত গরিব! উপযুক্ত কুলীনের মর্যাদা দেবার সামর্থ্য কি আমার আছে? কোথায় বিয়ে দেব?
দুর্গাচরণ শেষমেশ সম্মত হয়েছিলেন, কিন্তু এক কঠিন শর্তে! শুধু শাঁখা-সিঁদূর। আর মাত্র এক কপর্দক কৌলিন্য মর্যাদা!
ওটা নিতেই হয়। শাস্ত্রীয় নির্দেশ!
তা মনস্কামনা সিদ্ধ হয়েছে গাঙ্গুলীমশায়ের। বছর না ঘুরতেই নববধূর গর্ভসঞ্চারের লক্ষণ পরিস্ফুট! গৃহকর্তার আনন্দের আর সীমাপরিসীমা নাই! এই বাষট্টি বৎসর বয়সে যে নিয়োগপ্রথার সাহায্য নিতে হল না, এটাই পরম তৃপ্তি। বস্তুত সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা আদৌ আছে কি না এ বিষয়ে তাঁর নিজেরই সন্দেহ ছিল। ছয় দশক দুনিয়াদারী করে তিন-তিনটি সহধর্মিণীকে পার করার পরেও তাঁর ধর্মরক্ষা হয়নি—পুত্র সন্তান ছিল না এতদিন। কনিষ্ঠ দুটি ভ্রাতা আছে, তাদের সন্তানও আছে—কিন্তু পুত্রের হাতে পিওলাভের একটা আলাদা তৃপ্তি! প্রতিজ্ঞা করেছেন, এবার যদি পুত্রসন্তান লাভ করেন তাহলে আগামী বৎসর এ ভদ্রাসনে দুর্গোৎসব লাগিয়ে দেবেন। গ্রামে একটিই দুর্গা পূজা হয়—ভাদুড়ী বাড়ি—এবার ‘বারিন্দির’দের কব্জা থেকে মুক্তি পেয়ে এই রাঢ়ভূমে পূজা পাবেন জগজ্জননী। সেই লোভে পড়েও কি মা দুর্গা ওঁকে একটি সোনার চাঁদ উপহার দেবেন না? কন্যা সন্তান আছে—বড় বৌয়ের। শোভারাণী। মৃন্ময়ীর চেয়ে মাত্তর বছর তিনেকের বড়। তার মা-মাগী কাশী যাবার আগে তাকে ওঁর স্কন্ধে চাপিয়ে দিয়ে গেছে। পাষাণী যাকে বলে, আর কী!
মৃন্ময়ীকে চাটুজ্জে-বাড়ির কেচ্ছাটা না শোনানো পর্যন্ত ওঁর তৃপ্তি হচ্ছিল না। ব্যাপারটা ঠিক মতো সমঝে উঠতে পারেননি। দ্বিপ্রহরে প্রাগাহার পর্যায়ে দ্বাদশ ব্রাহ্মণ তামাকু সেবন করছিলেন। পংক্তিভোজনে বসবার আহ্বান শুনে নিতান্ত খোলা মনে বলেছিলেন, রুপো বাঁড়ুজ্জে এখনো আসেনি দেখছি?
অন্দরমহলের দ্বারপ্রান্তে দণ্ডায়মান ছিলেন গৃহস্বামী স্বয়ং, নন্দ চাটুজ্জে। তিনি তৎক্ষণাৎ বলে ওঠেন, রুপো গুনতির বামুন নয়। আপনারা বারো জন এসেছেন। আসুন……..
—তা এসেছি। কিন্তু রুপো বাঁড়ুজ্জের ভিটে তো আর তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে নয়। কেউ আগ্ বাড়িয়ে তাকে ডেকে আনলে সবাই একসঙ্গে…
না। তার দেরী হবে। সে ভিন্ গাঁয়ে গেছে রুগী দেখতে।
অতপর সবাই পংক্তি ভোজনে বসে পড়েন। বেণী চাটুজ্জে বসে ছিল ঠিক ওঁর পাশেই। নন্দের জ্ঞাতি ভাই—সরিক আর কী। দুর্গাচরণের কর্ণমূলে নিবেদন করেছিল, ‘একবগ্গা’ আসবে না গাঙ্গুলীদাদা। সে নেমন্তন্ন গ্রহণই করেনি।
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন দুর্গাচরণ। পঞ্চদেবতার অন্যতম শেষ দেবতাটি হাপিত্যেসে গণ্ডূষ -জলের অপেক্ষায় আছেন। অস্ফুটে ‘অপানায় স্বাহা’র বদলে বলে ফেলেন, বল কী হে? কেন?
—পরে বলব।
এই মর্মান্তিক সংবাদটা কি মধ্যাহ্ন আহারের পরে পরিবেশন করা চলত না? মন দিয়ে আর মহাপ্রসাদ গ্রহণ করতেই পারেননি। ব্যাপার কী? এ যে অবিশ্বাস্য! যদ্দুর মনে পড়ে একবগ্গার পাড়ে তো একটাই মাথা দেখেছেন! তাহলে?
আহারান্তেও সমস্যাটার সমাধান হয়নি। নন্দ সবাইকে চোখে চোখে রেখেছেন সেবান্তিক তাম্বাকু সেবনের পর্যায়ে। ওরই ফাঁকে একবার সুযোগ পেয়ে বেণীকে একটা কনুইয়ের গোত্তা মারার সৌভাগ্য জুটেছিল, কী ব্যাপার হে? সৌদামিনী? অ্যাদ্দিন পরে?
—ঠিক জানি না দাদা। সদুর কেচ্ছা কি একবগ্গা জানে? সে তো তখন ভিন গাঁয়ে। আপনার ভাদ্দর-বৌ বলছিল, নন্দদা নাকি জগুদিদির কাছে প্রস্তাব তুলেছিলেন—হরিমতির সঙ্গে…
—তা তো হতেই পারে; তার সঙ্গে নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার কী সম্পর্ক?
বেণী জবার দেবার সুযোগ পায়নি। হঠাৎ দেখে জগুঠাকরুণ সন্দিগ্ধ চোখে এগিয়ে আসছেন। বলে, আরে জগুদিদি! আপনি কখন এলেন?
জগুঠাকরুণ অনিমন্ত্রিত এসেছেন। মধ্যাহ্নে শুধু ব্রাহ্মণ-সেবার আয়োজন। তিনি বিধবা, মানুষ। তাঁর আহারের প্রশ্ন তো নেই। তিনি না এসে পারেননি। সকাল থেকে দেখা-শোনা করছেন, তরকারি কুটে দিচ্ছেন। পাগল ভাইপোটার ঐ হিমালয়ান্তিক অপরাধের যদি সামান্য কিছুটা স্খালন হয়।
দুর্গাচরণ ভালমানুষটি সেজে বলেন, কখন এসেছেন মানে? এ তো জগুদিদির নিজের বাড়ি। জগুদিকে বাদ দিয়ে সোঞাই গাঁয়ে কোন যজ্ঞিবাড়ির কাজ কখনো হয়েছে, যে আজ নতুন করে হবে?
জগুঠাকরুণ কথা ঘোরান, মিনুটা এখন কেমন আছে? এ সময়ে খুব সাবধানে রাখবে ভাই। ঘরের বার হতে দেবে না। নজর-টজর না লাগে।
ছয়দশকের দুনিয়াদারীর অভিজ্ঞতা নিয়ে হবু পিতা বোধকরি লজ্জা পেলেন। নতমস্তকে বলেন, সেসব তো আপনাদেরই দেখার কথা, দিদি। আসবেন সুযোগ মতো। পায়ের ধুলো দেবেন, আশীর্বাদ করবেন, আর ঐ সঙ্গে দুটো সৎ পরামর্শও দেবেন! তা, ভাল কথা। রুপো কোন গাঁয়ে গেল চিকিচ্ছে করতে? এতটা বেলা হয়ে গেল……
নন্দ বৃদ্ধাকে মিথ্যাভাষণের হাত থেকে অব্যাহতি দিলেন। বলেন, না, আর খোশ গল্প নয়। জগুদি, আপনি এবার মেয়েদের ঠাঁই করতে বলুন।
দুর্গাচরণ মনে মনে হেসেছিলেন। বেণীটা তাহলে তো মিছে কথা বলেনি। একবগ্গা বাঁড়জ্জে তাহলে নন্দ চাটুজ্জের নাকে সত্যিই ঝামা ঘষে দিয়েছে! কিন্তু কেন? একবগ্গা ঠাকুর এভাবে ক্ষেপে গেল কেন?
একটু পরে সংসারের কাজ সেরে মৃন্ময়ী এসে বসল ওঁর শয্যাপ্রান্তে। তেল না হয় নাই দিল পায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়াটা বাদ দেবে কেন? বলে, এবার বলুন, কী বলছিলেন তখন?
এই এক যন্ত্রণা! মৃন্ময়ী ওঁর সন্তানকে গর্ভে ধারণ করতে পারল, কিন্তু ‘আপনি’ ছেড়ে ‘তুমি’তে নামতে পারল না। নিবিড়তম মুহূর্তেও!
দুর্গা গম্ভীর হয়ে বলেন, বামুনদি তো কাজ ছেড়ে দেননি, তাহলে তোমার এই হাল কেন ছোটগিন্নি?
জনান্তিকে ‘ছুটকি’ থেকে ‘ছোটগিন্নি’তে যখন সম্বোধনটা সরে গেছে তখন বুঝে নিতে হবে কর্তা অসন্তুষ্ট। কারণটা বুঝে উঠতে পারে না। কাজলকালো দুটি চোখ মেলে বলে, মানে?
—যে রাঁধে, শুনেছি সে চুল বাঁধে না। তার একটা কৈফিয়ৎ থাকে। তা তোমার এ হাল কেন হল?
শোভারাণীর বিকালের দিকে তেড়ে জ্বর এসেছিল। মালোয়ারি। এ জ্বর ঘরে ঘরে। এই অসে এই যায়। ওর মাথায় জলপটি দিতে দিতে মৃন্ময়ী বিকালে চুল বাঁধার সময় পায়নি। স্বামীর প্রশ্নে ফিক্ করে হেসে বলে, আপনার সব দিকে নজর!
—মাথার পিছনেও এক জোড়া চোখ না থাকলে কি এত বড় সংসারটা চালাতে পারি ছোটগিন্নি? আর শুধু কি সংসার? এই পঞ্চগ্রামের গোটা সমাজটা। সে কতা নয়, কিন্তু ভরসন্ঝে বেলায় এলোচুলে থাকতে নেই—বিশেষ করে পোয়াতি মাগীর—এই কটা কতাও কি শিখিয়ে দেয়নি তোমার মা-আবাগি?
মৃন্ময়ী নিতান্ত গরিব ঘরের মেয়ে। শাঁখা-সিঁদূর সম্বল করে এ সংসারে এসেছিল। তার পিতৃকুলকে উদ্ধার করেছেন কুলীন কুলতিলক। প্রায় বছরখানেক সকাল-সন্ধ্যা শ্বশুরালয়ের নানান জনের মুখে বাপমায়ের সম্বন্ধে এজাতীয় মধুর বিশেষণ শুনে শুনে এখন সে অভ্যস্তা। কোন ভাবান্তর হয় না আর। পিঠভরা চুলের শেষপ্রান্তে একটা গ্রন্থি দিয়ে বলে, কী মজার কতা বলবেন বলছিলেন তখন?
দ্বিপ্রহরে সংগৃহীত মজাদার কেচ্ছাটা সবিস্তারে বর্ণনা করেন, যার উপসংহার : হেতু যাই হোক, নন্দ চাটুজ্জের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখান করেছে একবগ্গাটা!
নামটা শুনেই কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়ে মৃন্ময়ী।
একবগ্গা-ঠাকুর! রূপেন্দ্রনাথ! ওর প্রতিবেশী। পীতাম্বর চাটুজ্জের চালাখানা পদ্মদীঘির পুবপারে আর বাঁড়ুজ্জে বাড়ির ভদ্রাসন পশ্চিমপারে। মাঝখানে ঐ পদ্মদীঘি—রসি কয়েক ব্যবধান। রসি কয়েক, তবু অতলান্ত। রুপোদা ওর চেয়ে নয় বছরের বড়। তাঁর সান্নিধ্য ও অবশ্য খুব ঘনিষ্ঠভাবে পায়নি, পাশের বাড়ির বাসিন্দা হয়েও। তিনি তো মিনুর জ্ঞান হবার পর থেকেই গুরুগৃহে। তবে কাত্যায়নী ওর সমবয়সী, সখী। সকাল-সন্ধ্যা দেখা হত। প্রাণের কথা হত। তা হোক, রুপোদা বৎসরান্তে এক বার আসত। দেখা হত।
‘নয়’ একটা গাণিতিক সংখ্যা। গণিত বলে সেটা নিৰ্গুণ। ঐ নয়’ সংখ্যাটা। নয়টি আসরফি আর নয়টি কপর্দকের মূল্যমানে যা ফারাক তার জন্য ‘নয়’ দায়ী নয়। কিন্তু হিসাবটা কি ঠিক? সব ‘নয়’ কি এক জাতের?
স্মৃতি ভিড় করে আসছে। প্রায়-শৈশবের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। দামোদরের বাইচ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ভিড়ে-ভিড়। কিছুতেই দেখতে পাচ্ছিল না বেচারি। হঠাৎ রুপোদা ওকে কোলে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিল কাঁধে। বললে, কী রে মিনু? এবার দেখতে পাচ্ছিস? কাতু চিৎকার করে নিচে থেকে বলে, নেমে আয় বলছি! পাজি, বাঁদর। ও তো আমার দাদা! আমি ওর কাঁধে চড়ব। তুই চড়েছিস্ কোন আক্কেলে?
রুপোদা বোনকে ধমক দিয়েছিল, হিংসুটেমি করলে তোকে কোনদিন কোলে নেব না কিন্তু কাতু!
তখন মিনুর বয়স ছয়। তাহলে রুপোদার কত? নয়ে ছয়ে পনের
মনে পড়ে আরও একদিনের ঘটনা। পিতৃশ্রাদ্ধ করতে এসেছিল রূপেন্দ্রনাথ। কাচা গলায় উদাস দৃষ্টি মেলে বসেছিল সামনের দাওয়ায়। মিনু তার কোল ঘেঁষে বসে পড়ে বলেছিল, তুমি কেঁদ না, সোনাদা। আমার তো বাবা আছেন, আমরা দুজন তাঁকে ভাগ করে নেব। কেমন?
সোনাদা সেদিন ম্লান হেসে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়েছিল শুধু। একজন পিতৃবিয়োগে মুহ্যমান, আর-জন তার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে চায় হিসাব কষে দেখ, একজন আট, আর জন সতের। ফারাক সেই সমান—নয় বছর।
সোনাদা! নামটা ওরই দেওয়া। মনে আছে, একদিন প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা তোমার নাম ‘রুপোদা কেন গো? ‘সোনাদা’ হলে আরও মানোতো।
রূপেন্দ্র ছদ্মগাম্ভীর্যে বলেছিল, তুই আমার দাম কমিয়ে দিতে চাইছিস, মিনু? জানিস না, সোনার চেয়ে রুপো দামী?
হঠাৎ হকচকিয়ে যায়। তাই নাকি? রুপোদা তো মিছে কথা বলে না। পরে বাবামশাইকে প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছিল। রুপোদার পিঠে গুম্ম বসিয়ে বলেছিল : মিথ্যুক! তোমাকে আমি কী শাস্তি দিই দ্যাখ!
—কী শাস্তি দিবি? তোর কিলে আমার কিছু হয় না!
—শুধু কিল কেন? তোমাকে সবার সামনে আমি ‘সোনাদা’ বলে ডাকব।
তা কিন্তু পারেনি। কারণ পরের বছর দুর্গোৎসবে যখন রুপোদা ফিরে এল, তখন সে কেমন যেন তালঢ্যাঙা হয়ে গেছে। না ভুল হল, দুর্গোৎসবে সেবার আসতে পারেনি। প্রায় দেড় বছর পরের কথা। ততদিনে মিনুও মৃন্ময়ী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। একাদশবর্ষীয়া কিশোরী। তার দেহেমনেও ভিতর থেকে পরিবর্তন শুরু হয়েছ। বুঝতে পেরেছিল সর্বসমক্ষে ওঁকে আর ‘সোনাদা’ ডাকা যায় না। সে বড় লজ্জার কথা! সেবার উনি ফিরে এসেছিলেন ফাল্গুন মাসে—দুর্গোৎসব পার করে। জগুপিসির ‘মায়ের দয়াত হয়েছে খবর পেয়ে। রঙ-দোলের আগেই ভাল হয়েছিল পিসি। তখন দখিন থেকে বইতে শুরু করেছে একটা পাগলা হাওয়া। প্রতি বছরই হয় তো তা বয়। কিন্তু মৃন্ময়ী সেই কিশোরী বয়সে তখন প্রথম বুঝতে শিখছে—ওটা ‘মন-কেমনের’ হাওয়া। প্রতি বসন্তেই হয়তো নিলর্জ্জ কোকিলটা অমন আকুলভাবে ডাকে। এ বছরই যেন সেটা প্রথম খেয়াল হল। কাতুকে রঙ দিতে গিয়েছিল বাড়জ্জে বাড়ি। কাতু কোথায় লুকিয়ে বসে আছে ঘাপটি মেরে। আনাচে-কানাচে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল তাঁর। রুপোদার হাতে একটা আবীরের পুঁটুলি। সেও বুঝি এতক্ষণ ছেলের দলে রঙ খেলছিল। দোর আগলে বললে, এবার?
বুকের মধ্যে ধড়াস্ করে উঠেছিল কিশোরী মেয়েটির। এ কে? ঐ তালঢ্যাঙা মানুষটা? আর ওর গলার স্বরও তো রুপোদার মতো নয়! আশেপাশে তাকিয়ে দেখে–ত্রিসীমানায় কেউ নেই! কী সর্বনাশ! এখন যদি ঐ লোকটা ওকে…….
রুপোদা ‘এবার’? বলে ওর দিকে এক পা এগিয়ে আসতেই কী যেন কিসের আশঙ্কায় ওর সারা দেহ থরথর করে কেঁপে উঠল। ওর মনে হল—এখনি দুই হাত বাড়িয়ে রুপোদা ওকে বুকে টেনে নেবে। আর তার পর ওর মুখে, বুকে, সর্বাঙ্গে….
দুরন্ত লজ্জায় দু-হাতে মুখ ঢেকে বলে ওঠে, নৃ-না!
রুপোদা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ওর আতঙ্কতাড়িত কচি মুখখানার দিকে অবাক দৃষ্টিতে নির্নিমেষলোচনে শুধু তাকিয়ে দেখেছিল। তারপর কী ভেবে যেন অনুমতি ভিক্ষার সুরে জানতে চেয়েছিল, কী ব্যাপার রে মিনু?
মুখ থেকে হাত সরায়নি। আবীরমাখা লালে-লাল মাথাটা ঝাঁকিয়ে সে পুনরুক্তি করেছিল শুধু, ন্-না!
কী বুঝল তা সেই জানে। হাসতে হাসতে বললে, রঙ মাখতে এত ভয়? ঠিক আছে, আমি আলতো করে একটা টিপ্ শুধু পরিয়ে দিই তোমার কপালে। কেমন? বোকা মেয়ে! তুমি এখনো খুকি!
বোকা! বোকা কে? আমি, না তুমি? কথা কটা শুধু মনেই ফুটেছিল, মুখে নয়। কপালে একটা টিপ নিয়ে এক ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। একটু দৌড়েই, থেমে, পিছন পানে তাকিয়ে দেখেছিল। না, রুপোদা ওকে তাড়া করে আসেনি!
আড়ালে গিয়ে ইচ্ছে করছিল নিজের গালেই ঠাস্ ঠাস্ করে চড় কষাতে। স্নানের সময় সেই এক বিন্দু আবীরের টিপটুকুও ধুয়ে গেল! যাক্! কিন্তু সোনাদা সেই প্রথম ওকে ‘তুই-তোকারি’— করতে পারেনি। চিরটা কাল যাকে ‘তুই” বলেছে, তাকে সেদিন বলতে হয়েছিল, ‘তুমি এখনো খুকি।’
কেন গো? এই বোকা মেয়েটাকে তুমি বুঝিয়ে দেবে গো পণ্ডিতমশাই? ‘তুই’ কেমন করে ‘তুমি’ হয়ে যায়?
—কেন গো? কারণটা কী হতে পারে?
রীতিমতো চমকে উঠেছে মৃন্ময়ী। তার নিজের মনের ঐ নিভৃত প্রশ্নটা এই নির্জন কক্ষে স্বামীর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠায়।
—কী হল? দেয়ালা দেখছ নাকি? অমন চমকে উঠলে যে?
—কিছু নয়। কী জিজ্ঞেস্ করছিলেন যেন?
—মানে, কারণটা কী হতে পারে? কেন একবগ্গা এমন কাণ্ডটা করে বসল? সেই সৌদামিনীর কেচ্ছা?
এতক্ষণ স্মৃতিচারণে যে পুণ্যতোয়া ভাগীরথীর উজান পথে কৈশোর-বাল্যের গোমুখ গঙ্গোত্রীর নির্মল জলে অবগাহন করছিল তাতে এসে মিশল পূতিগন্ধময় নর্দমার ক্লেদাক্ত জল! মনটা বিষিয়ে ওঠে! টানা নথে অনুবিদ্ধ নাকটা কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। বলে, সদুপিসি! বাবা! পারেনও বটে আপনারা! মরেও সে হতভাগীর শান্তি নেই!
—আহাহা! আবার আমাকে টানছ কেন ছোটগিন্নি? আমি কী করেছি?
নন্দ চাটুজ্জে তার বালবিধবা শ্যালিকাটিকে আশ্রয় দিয়েছিল নিজ ভদ্রাসনে। যৌবনপ্রাপ্তির পর তার অপঘাত মৃত্যু হয়েছে বছর-পাঁচেক আগে। কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বা—হত্যাই। অনেকেরই বিশ্বাস কীর্তিটা স্বয়ং নন্দেরই—মানে, অন্তিম মৃত্যুর আগের যে মৃত্যু—অর্থাৎ কে সেই বিধবাটির গর্ভসঞ্চ.. করেছিল তাও নাকি সবার জানা। তবে প্রকাশ্যে সবাই মেনে নিয়েছিল—খাদ্যে বিষক্রিয়া। কার্তিক ময়রার পচা পক্কান্নো খেয়ে। পঞ্চায়েত তাই কার্তিককে অর্থদণ্ডও করেছিল—মায়ের থানে একটি পাঁঠা দিতে হয়েছিল তাকে। অবশ্য কার্তিক আড়ালে স্বীকার করে, তার দামটা নন্দ গোপনে ওকে মিটিয়ে দিয়েছিলেন। মৃন্ময়ী এ-গ্রামেরই মেয়ে। ফলে আর পাঁচজনের মতো এসব কেচ্ছা তার না-জানা নয়। এতদিন পরে সেই হতভাগিনীর নামটা উঠা পড়ায় তাই ও-কথাটা বলে ফেলেছে।
দুর্গাচরণ বলেন, বেণী আবার একটা উল্টো কতা শোনালো, বুয়েছ? তার বউয়ের খপর—নন্দ চাটুজ্জে নাকি হরিমতির সঙ্গে সুরোর বে-র কথা বলে। তাতেই ঐ একবগ্গা ঠাকুর ক্ষেপে গিয়ে—
—তা তো ক্ষেপবারই কথা বাপু! ওঁর সঙ্গে কি হরিমতিকে মানায়?
—তুমি যে অবাক করলে ছোটগিন্নি! কুলীন ঘরের আইবুড়ো ধেড়ে খোকা! কেউ বিয়ের কথা তুলতে এলে মায়ের পেসাদ প্রেত্যাখ্যান করবে?
মৃন্ময়ীকে স্বীকার করতেই হয়, সে-কথা ঠিক। এটা রুপোদার একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে।
দুর্গাচরণ হেসে ফেলেন, ‘রুপোদা’ কী গো! তুমি যে সম্পর্কে তার খুড়ি!
মৃন্ময়ী লজ্জা পায়। কথাটা তার খেয়াল ছিল না।
দুর্গা কৌতুক করে ওর তলপেটে আঙুল ছুঁইয়ে বলেন, একবগ্গাটাকে ‘রুপোদা’ যে ডাকবে সে তো এখানে ঘুমুচ্ছে গো!
মৃন্ময়ী দুহাতে মুখ ঢাকে।
কর্তা পাশ ফিরে শুলেন। বলেন, পিঠে এট্টু সুড়সুড়ি দিয়ে দাও দিনি।
স্বামীর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে আর এক দিনের কথা মনে পড়ে গেল মৃন্ময়ীর। সেই তাঁর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ। গ্রামে ফিরে আসার পরে তাঁকে আর দেখেনি। তার পূর্বেই মৃগী গাঙ্গুলীবাড়ির নববধূ হয়ে গেছে। ওর বিয়ে হয়েছিল মাঘে। সে বছর আশ্বিন মাসের কথা। সে বারও উনি গাঁয়ে এসেছিলেন দুর্গোৎসবে। তখনো কিন্তু দুজনের বয়সের ফারাক সেই নয় বৎসর। মিনু পনের, রূপেন্দ্রনাথ চব্বিশ।
বিজয়ার পরদিন সকালে মৃন্ময়ী এসেছে জগুপিসিকে প্রণাম করতে। কাতু বললে, দাদাকে পেন্নাম করবি না, মিনু?
মীনু হেসে বলেছিল, করব না! বলিস কীরে! সবাই বলে, তিনি দিগ্গজ পণ্ডিত হয়ে গেছেন। একটা পেন্নাম ঠুকে দিলে ভালমন্দ আশীর্বাদ পেয়ে যাব!
কাতু বলেছিল, দস্তুরি যদি দিস্, ভালোমত আশীর্বাদ পাইয়ে দেব। কী বর চাস বলদিনি? শিবের মতো বর?
মিনু ফিফিসিয়ে বলেছিল, শিবের মতো হোক-না-হোক। তোর মতো বেপাত্তা বর যেন না হয়!
তারপর লজ্জিত হয়ে কাত্যায়নীর হাতখানা টেনে নিয়ে বললে, ছি, ছি। বচ্ছরকার দিনে বেফাঁস কথাটা বলে তোকে মিছিমিছি দাগা দিলাম।
কাত্যায়নী ম্লান হেসে বলেছিল, কিন্তু কতাটা তো মিছে নয় রে মীনু! এ সব্বোনাশ যেন শত্রুরেরও না হয়। কোনদিন মানুষটাকে চোখেই দেখিনি!
একট! দীর্ঘশ্বাস চেপে বলেছিল, আয়।
—কোথায়? রুপোদা কী করছে?
—চিরটাকাল যা করেছে। পুঁথি পড়ছে।
পুবের জানালাটা খোলা। এক ঝলক প্রভাত-সূর্যালোক ঘরে ঢুকে পড়ে যেন থমকে গেছে। রূপেন্দ্রনাথ তন্ময় হয়ে কী একটা পুঁথি পড়ছিলেন। কাত্যায়নী তাঁকে ডাকতে গেল। মৃন্ময়ী হঠাৎ মুখ চেপে ধরল তার। কাতু সবিস্ময়ে চোখ দিয়ে প্রশ্ন করে, কী?
মৃন্ময়ী নিঃশব্দে ওষ্ঠাধরে আঙুল ছোঁওয়ায়।
ধ্যানমগ্ন বিদ্যার্থীর ঐ তন্ময় ভাবটা ছিন্ন করতে তার মন সরছিল না। ওর মনে পড়ে গেল—একবার ভাদুড়ী-বাড়ির নাটমঞ্চে ‘নিমাই সন্ন্যাস’ পালা দেখেছিল। এক গাদা রঙ-চঙ মেখে, চোখে সুর্মা আর ঠোঁটে অলক্তক-হিঙ্গুলী লাগিয়েও সেই মেকি নিমাই পণ্ডিত এত সুন্দর হতে পারেনি! রূপেন্দ্রের ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ, শুধু সামবেদী উপবীত। মস্তক মুণ্ডিত, শিখাপ্রান্তে কোনও পুষ্প অনুবিদ্ধ নেই। চোখ দুটি আয়ত, উন্নত নাসা,—ঠিক যেন নিমাই পণ্ডিত! সোনার গৌরাঙ্গ। সার্থক নাম : সোনাদা! কাত্যায়নীর কণ্ঠস্বরে ধ্যানভঙ্গ হল তাঁর।
—দাদা, মীনু তোমাকে পেন্নাম করতে এয়েছে!
ধ্যানস্থ সন্ন্যাসী চোখ তুলে চাইলেন যেন। তখনো তাঁর ঘোর কাটেনি। তারপর সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ান। কোচার খুঁটটা খুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে বলেন, তুমি আমাদের সেই মীনু?
—বিশ্বাস হচ্ছে না?—প্রশ্ন করে কাত্যায়নী।
রূপেন্দ্রনাথ বলেন, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা নয় কাতু—কিন্তু পথে-ঘাটে দেখলে ওকে আমি চিনতেই পারতাম না! কী সুন্দর মানিয়েছে তোমাকে এই শাড়িখানিতে!
কাতু মুখ টিপে হাসে, শুধু শাড়িখানাই নজরে পড়ল দাদা? দৃষ্টি বটে তোমার!
রূপেন্দ্রনাথ জবাবে কী একটা কথা বললেন। উচ্ছসিত শোনালো তাঁর কণ্ঠস্বর। বেচারী মৃন্ময়ী—উনি কথাটা বলেছেন বিশুদ্ধ সংস্কৃতে! অর্থ গ্রহণ হয়নি তার।
মৃন্ময়ী তার শান্তিপুরে ডুরে শাড়ির আঁচল গলায় জড়িয়ে ব্রাহ্মণের পদপ্রান্তে নামিয়ে রাখে একটি সলজ্জ প্রণাম। সাহস করে পদস্পর্শ করতে পারে না!
রূপেন্দ্রনাথ যুক্তকরে বললেন, ওঁ, নমঃ নারায়ণায়!
কাত্যায়নী বলে, এমন একটা জমকালো পেন্নামের ঐটুকু আশীর্বাদ?
হেসেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ওটা আশীর্বাদ নয় রে বোকা! আমি মীনুর প্রণামটা নারায়ণকে নিবেদন করলাম শুধু—
—তার মানে তুমি ওর পেন্নামটা নিলে না?
—পাগলি! তুই বুঝবি না!
কাত্যায়নী রীতিমতো জেদ করে, ওসব শুনছি না। ওকে আশীর্বাদ করতে হবে। কর বলছি।
—বেশ তাই করছি……
বলেই আবার একটি শ্লোক বললেন দেবভাষায়।
কাত্যায়নী রীতিমতো বিরক্ত! বলে, অং বং নয়। সোজা কথায় মানেটা কী হল বলতে হবে! শ্লোকটা কি তুমি মুখে মুখে বানালে?
—না, এটা মহাকবি কালিদাসের। তিনি বলছেন, তোমার আখগুলের মতো ভর্তা হৌক, জয়ন্তের মতো কীর্তিমান সুতঃ। তুমি পৌলমী হবে! তোমার মতো কল্যাণময়ীর আর কোন আশীর্বাদই যেন সুপ্রযুক্ত নয়!
এখনো মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়।
না, অন্বয়-ব্যাখা শুনেও সে কিছু বুঝতে পারেনি। কিন্তু কথাগুলো যেন ওর মনের পাষাণফলকে খোদাই করে লেখা হয়ে গিয়েছিল।
বাড়িতে ফিরে এসে সে পিতার কাছে প্রশ্ন করে বুঝে নিয়েছিল—‘আখণ্ডল’ মানে ইন্দ্ৰ, ‘সুত’ মানে সন্তান। আর ‘পৌলমী’ হচ্ছে ইন্দ্রাণীর নাম।[১]
[মূল শ্লোকটি :
১ আখণ্ডল সম ভর্তা জয়ন্ত প্রতিমোসুতঃ।
আশীরন্যাঃ ন তে যোগ্যাঃ পৌলমী মঙ্গলা ভব।।]
তখনই ওর সারা দেহ ফোটা-কদমের মতো কণ্টকিত হয়ে উঠেছিল!
হঠাৎ শয্যার উপর উঠে বসেন দুর্গাচরণ।
আবার চমকে ওঠে মৃন্ময়ী, কী হল?
—আমার মাথায় একটা জবর ফন্দি এয়েছে ছোটগিন্নি। তোমার ক্ষুধামান্দ্য তো লেগেই আছে। মাঝে মাঝে বমির বেগও আছে। পাগলাটাকে ডেকে পাঠাই—বদ্যি হিসাবে। সে তোমাকে একবার দেখে যাক। ঐ ফাকে জেনে নেওয়া যাবে, কেন সে জলে বাস করে স্বেচ্ছায় কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করতে চাইছে। কী বল?
মৃন্ময়ীর বুকের ভিতর গুড়গুড় করে মেঘ ডাকল। তিনি এ বাড়িতে আসবেন! আবার মুখোমুখি দেখা হবে! আবার গলায় আঁচল দিয়ে তাঁকে প্রণাম করার সৌভাগ্য হবে! কিন্তু…..
—ইতস্তত কিসের গো? তুমি তো তার পাড়ার মেয়ে। ন্যাংটো হয়ে হামা দিয়েছ তাদের বাড়িতে।
আঃ! কর্তার কথার কোন আড় নেই! সে তো বহু যুগ আগেকার কথা! মীনুর তখন এক, আর সোনাদার দশ—সেই ‘নয়’ কি আজকের ‘নয়? যখন রূপেন্দ্রনাথ পঁচিশ, আর মৃন্ময়ী পরস্ত্রী?