কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

সোঞাই – ১৭

১৭

মহালয়ার আর মাত্র তিনদিন বাকি। কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশী। মধ্যাহ্ন অতিক্রান্ত। তর্পণ সেরে দ্বিপ্রাহরিক আহারে বসেছিলেন রূপেন্দ্রনাথ। জগুঠাকরুণ সামনে বসে আছেন তালপাখা হাতে।

কাত্যায়নী আর কুসুমমঞ্জরী বসে গল্প করছিল। আরোগ্য নিকেতনের মেঠো দাওয়ায়। হঠাৎ ওদের নজর হল—দূর থেকে তিনজন অশ্বারোহী সৈনিক এগিয়ে আসছে। মাঠের ওপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিল গো-গাড়িটা। তার গাড়োয়ানের সঙ্গে কী যেন কথা হল। গাড়োয়ানটা নত হয়ে প্রণাম করল, হাত তুলে দেখিয়ে দিল কুসুমমঞ্জরীদের দিকে।

অশ্বারোহী তিনজন এদিকে আগিয়ে আসে।

উঠে পড়ে ওরা দুজন। দ্রুতগতি কক্ষের ভিতর চলে যায়। কুসুম বলে, মাসি, কারা যেন আসছে।

প্রৌঢ়া সেবাদাসীটি এগিয়ে এল সদরের দিকে।

আগন্তুক তিনজন ততক্ষণে আরোগ্যশালার দোরগোড়ায়। মুখটা সাদা হয়ে গেল সেবাদাসীর। কৃত্রিম হাসি টেনে এনে বললে, কী সৌভাগ্য! ছোটহুজুর যে! আসুন, আসুন!

—যাক, তবু চিনতে পেরেছ।

সম্মুখস্থ অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে নেমে আসে। বছরত্রিশেক বয়স, বলিষ্ঠ গঠন। তিনজনের মধ্যে তারই সাজ-পোশাকের ঘটা বেশী। রূপনগরের মোহান্ত মহারাজের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং দক্ষিণহস্ত। ধর্মে বৈষ্ণব, কিন্তু মারদাঙ্গায় সিদ্ধহস্ত। বস্তুত সে হচ্ছে প্রেমদাস বাবাজীর সৈন্যদলের প্রধান। চোখ দুটি ছোট আর ক্রূরতা মেশানো। কথা বলে কেটে কেটে। বললে, মাসির শরীরগতিক তো ভালই দেখছি, খুব মালপো-টালপো সাঁটছ বোধহয়। তা তোমার বোনঝিটিও ভাল হয়ে গেছেন দেখলাম। ফেরায় মন নেই কেন?

প্রৌঢ়া জোড়হস্তে বললে, আমরা তো দাবাবোড়ের ঘুঁটি, ছোটহুজুর! যেমন চালাবে তেমনি চলব। আমাদের আবার মন হওয়া-হওয়ি কী?

—তাই নাকি? তাহলে এবার গতর নাড়াও। পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে নাও। রওনা হতে হবে। এখনই।

ঘরের ভিতর তখন কুসুম সবলে চেপে ধরেছে কাত্যায়নীর দুটি হাত। আগন্তুককে সে চেনে মা, দেখেনি কোনদিন, কিন্তু মাসির ঐ ‘ছোটহুজুর’ সম্বোধনে ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে কাত্যায়নী নিজেকে বন্ধন-মুক্ত করে নিল। নিঃসাড়ে বার হয়ে গেল ঘর ছেড়ে। ছোটহুজুর নজর করল, বাধা দিল না।

‘অশুভস্য কালহরণম্’ নীতিবাক্যটা বোধকরি মাসির জানা। বললে, ওমা, সে কী গো? একটা ডুলি-টুলির ব্যবস্থা কর?

—ডুলি লাগবে না। যাতে এসেছে, তাতেই ফিরবে। নাও দেরী কর না অহেতুক।

—তা কোবরাজ-মশায়ের অনুমতি তো নিতে হবে?

এবার ধমকে ওঠে ছোটহুজুর, হবে না! খাঁচা খালি দেখলেই তোমার কোবরেজ-মশাই বুঝে নেবে পাখি উড়ে গেছে।

—তবু একটা খপর তো দেওয়া দরকার।

—খবর দিতে একজন যে ছুটে গেল তা তো স্বচক্ষেই দেখলে।

দাওয়ায় উঠে আসে। দ্বারপথে দাঁড়ায় দুই চৌকাঠে দু-হাত দিয়ে। আতঙ্কে পাষাণ প্রতিমার মতো কক্ষের দূরতম প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে কুসুমমঞ্জরী। ছোটহুজুর তাকে আপাদমস্তক দেখে নিল একবার। বললে, তোমার কাপড়-জামা পুঁটলি বেঁধে নাও। খাওয়া হয়েছে? এখনি রওনা হব আমরা।

যেন প্রতিবর্তী প্রেরণায় বলা কথা, আমি যাব না!

—যাবে না!—ঘরের ভিতর এতক্ষণে প্রবেশ করে ছোটহুজুর। এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে।

ততক্ষণে ছুটতে ছুটতে কাত্যায়নী পৌঁচেছে নিজের ভদ্রাসনে। মাঠের ও প্রান্তেই তাদের বাড়ি। রসি-খানেক দূরে। বলে, দাদা, শিল্পির! কুসুমকে ধরে নিয়ে যেতে পাইক এসেছে!

—ধরে নিয়ে যেতে? কে?

আহারকালে রূপেন্দ্র বাক-সংযম করেন। অসতর্ক মুহূর্তে প্রশ্নটা করার পরেই অন্নপাত্র সরিয়ে দেন। গণ্ডূষ করে উঠে পড়েন। দ্রুত হস্তপ্রক্ষালন করে বলেন, চল তো দেখি।

দুজনে বেরিয়ে এলেন বাইরে। জগুঠাকরুণ কিন্তু সদরদ্বারের কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। দৃষ্টি তাঁর ক্ষীণ, তবু দৃশ্যটা দেখতে পেলেন। মাঠের ও-প্রান্তে আরোগ্যশালার সম্মুখে দুজন অশ্বারোহী। তৃতীয় একটি অশ্ব আরোহীহীন। একজন বলিষ্ঠগঠন যুবাপুরুষ কুসুমমঞ্জরীকে হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসছে। মেয়েটি মাটিতে শুয়ে পড়েছে। জড়িয়ে ধরেছে দাওয়ার একটা বাঁশের খুঁটি। আর সেই প্রৌঢ়া দু-হাত শূন্যে তুলে আর্তকণ্ঠে বিলাপ করছে। জগু-ঠাকরুণ ঘর ছেড়ে পথে নামলেন না। দ্রুতগতি ফিরে গেলেন তাঁর ঠাকুরঘরে। তুলে নিলেন লক্ষ্মীর পায়ের কাছে পড়ে থাকা শঙ্খটিকে। আবার বেরিয়ে এলেন বাইরে। শাঁখে ফুঁ দিলেন। স্তব্ধ-মধ্যাহ্ন শিউরে উঠল! পদ্ম দীঘির ও-পাশে, পীতুঠাকুরের বাড়ির সামনেও মেয়েদের একটা জটলা। বোধকরি ঐ সেবাদাসীর আর্ত কণ্ঠের চিৎকার শুনে ওরাও বার হয়ে এসেছে কৌতূহলী হয়ে। তাদের মধ্যে থেকে কে একজন সঙ্গে সঙ্গে বাজিয়ে দিল একটা শাঁখ।

এমন নির্দেশ দেওয়াই ছিল। বর্গীর আক্রমণ প্রতিহত করতে পুরললনাদের কী কী কর্তব্য।

মাঠের ও প্রান্তে ভীমা বাগদি আপন-মনে বিড়বিড় করতে করতে আল পথ ধরে কোথায় যাচ্ছিল। খরমধ্যাহ্নে পাশা-পাশি দুবাড়ি থেকে শাঁখ বেজে ওঠায় সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। দৃশ্যটা তার নজরে পড়ে। ছুটতে ছুটতে সেও এসে পড়ে অকুস্থলে।

ততক্ষণে রূপেন্দ্রনাথও পৌঁছে গেছেন। কিন্তু তার পূর্বেই পৌঁচেছে ভীমা। সে নিরস্ত্র। তবু অকুতোভয়ে চেপে ধরে ঐ হাতিয়ারবন্দ মানুষটার কব্জি—বলে, অ্যাইও! কী করছিস তুই? হারামজাদা?

দুই অশ্বারোহী তৎক্ষণাৎ তার দুদিকে অশ্বকে পরিচালিত করে। হাতে তাদের কোষমুক্ত তরবারি। ছোটহুজুরের আদেশের অপেক্ষায় তারা ঐ বিশালকায় মানুষটার দু-পাশে অশ্বপৃষ্ঠে অপেক্ষা করে। মাথাটা ঘাড় থেকে নামিয়ে দেয় না।

ছোটহুজুর মেয়েটির হাত ছেড়ে দেন। এগিয়ে এসে ভীমার গালে কষিয়ে দেন ঠাশ করে একটা চড়। কুসুম তার স্খলিত অঞ্চলটা টেনে নিয়ে বুকটা ঢাকে। বাঁশের খুঁটির আলিঙ্গন কিন্তু সে ছাড়েনি।

ভীমা তার গালে হাতটাও বোলায় মা। তিনজনের দিকে পর্যায়ক্রমে সে তাকিয়ে দেখে নেয়। তিনজনের হাতেই নাঙ্গা তরোয়াল। ভীমা তিলতিল করে পাঁচটা পা পিছিয়ে যায়। তরোয়ালের কোপ থেকে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে সে যে কাণ্ডটা করল তা নিতান্ত অপ্রত্যাশিত। হঠাৎ নিচু হয়ে মুখে হাতের তালু সঞ্চালনে ‘কুক’ দিয়ে উঠল। সে ধ্বনি অতিবিচিত্ৰ : আ-বা-বা-বা-বা!

ছোটহুজুর এই রাঢ়খণ্ডেরই মানুষ। বাঙলা দেশের ছেলে—মারদাঙ্গাতে সে অভ্যস্ত। তৎক্ষণাৎ বুঝে নেয়-এ ধ্বনি যে ওভাবে বাজাতে পারে সে সামান্য চাষার ছেলে নয়—এ বাঙলার একটি বহু-বিখ্যাত যুদ্ধধ্বনি। লোকটা ডাকাত!

তৎক্ষণাৎ স্তব্ধ প্রকৃতি যেন মুখর হয়ে উঠল। যেন হঠাৎ এসে পড়া কালবৈশাখীর ঝড়।

পল্লীর এপ্রান্তে ওপ্রান্তে ক্রমান্বয়ে হতে থাকে শঙ্খধ্বনি। দামোদরের দিক থেকে ভেসে এল ঐ ‘কুক’ এর প্রতিধ্বনি : আ-বা-বা-বা-বা!

দামোদরের দুই তীরের মাঝি-মাল্লা-দুর্ধর্ষ নমঃশূদ্র, আর কৈবর্ত মাছমারার দল যেন জানিয়ে দিল : আমরা সজাগ আছি! আসছি! ভয় নেই!

আরও আশ্চর্য! দামোদরের ওপার থেকে—বোধকরি পীরপুর গ্রামের দিক থেকে ভেসে এল দামামার শব্দ : ডুম্-ডুম্, ডুম্-ডুম্, ডুম-ডুম্।

ছোটহুজুর এদেশের ছেলে। তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলে—এরা চড় খেয়ে তা হজম করে নেবে না। কিন্তু ওদের সঙ্গে বন্দুক নেই। তৎক্ষণাৎ অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে বসে। যাতে প্রয়োজনে ঐ পদাতিক বাহিনীর মাঝখান দিয়ে তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে ঘোড়া ছোটানো যায়।

রূপেন্দ্র বলেন, কে আপনি? আমার বাড়ির মেয়েদের গায়ে হাত তোলেন কোন অধিকারে?

ছোটহুজুর ঘোড়াকে এক চক্কর টহল দিয়ে ঘুরে এসে বলে, আমি কে, তা ঐ মাসিকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন। আপনিই বরং বলুন, আমাদের গাঁয়ের মেয়েকে এভাবে আটকে রেখেছেন কোন অধিকারে?

—সে কৈফিয়ৎ আপনার মালিককে দেব। আপনি ওড়ে চড় মারলেন কেন?

—ও আমার হাত চেপে ধরেছিল। সে তো নিজে চোখেই দেখলেন!

রূপেন্দ্র নজর হল—মাঠের এপ্রান্তে ওপ্রান্তে দু-চারজন ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে—ভীমা বাগদীর চেলা চামুণ্ডা। অধিকাংশের হাতেই তেলপাকা লাঠি, দু-একজন ভীল ধনুক হাতে।

—আপনি নেমে আসুন। ওর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

—ক্ষমা?—অট্টহাস্য করে ওঠে দুঃসাহসী ছোটহুজুর। চোখ বুলিয়ে সেও পরিস্থিতিটা সমঝে নেয়। যদিও ওরা পদাতিক, তবু ওদের অনেকের হাতে ধনুর্বাণ। সংখ্যাতেও এতক্ষণে দশ-পনেরজন। বলে, আজ আমি ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আবার আসব। আপনি আগুন নিয়ে খেলা করছেন কোরেজ-মশাই। তারিখটা জানিয়ে যাচ্ছি: মহাষ্টমীর দিন! আপনার ঐ তীরন্দাজ ডাকাতদের জানিয়ে দেবেন—যারা আসবে তারা তীরধনুক নিয়ে ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ খেলতে আসবে না, তারা বন্দুকধারী। হাতি আর কামানও আসবে। অহেতুক এ গ্রামে রক্তগঙ্গা বহাতে চাই না।

তারপর ভীমার দিকে ফিরে প্রশ্ন করে, তোর নামটা কী রে হারামজাদা?

ভীমা এক-পা এক-পা করে এগিয়ে আসছিল। এ প্রশ্নে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। পাশে ফিরে বলে, অ-ঈশেন! বাবু মোর নামটো জিগাইছে রে। নবাব-ছরকারে শিকায়েত করবে।

যাকে প্রশ্নটা করেছে সে দাঁড়িয়ে আছে হাত দশেক দূরে। তার হাতে একটা ভীল-ধনুক। আকর্ণ তার জ্যা টেনে ছোটহুজুরের দিকে স্থির লক্ষ্যে দাঁড়িয়ে আছে। যেন দ্রৌপদীর স্বয়ংম্বর সভায় মীনলক্ষ্যে অর্জুন! তার দৃষ্টি সরল না। জবাবে বললে, নাম জিগাইছে তো নামটো বলি দাও কেনে?

ভীমা আবার এগিয়ে এল কাছে। বললে, বাবুর হাতে চড় খায়ে তোর খুড়ো যে বাপের দেওয়া নামটো ভুলি গেল রে ঈশেন!

ঈশান একইভাবে জবাবে বললে, ও হারামজাদার বাপের দেওয়া নামটো যখন কীচক, তেখন তো অর আজাদ করা উচিত নামটো কী হতি পারে। …শোনেন কীচক বাবু মশয়। খুড়োর নাম ভীমা বাগদী, অধমের নাম ঈশেন। বড় কোতোয়ালের খাতায় নামদুটি নেখা আছে। তাই পছান্তে পারবেন!

ভীমা এতক্ষণে অশ্বারোহীর পাঁজর ঘেঁষে। হঠাৎ কোথাও কিছু নেই এক লাফ দিয়ে উঠল মে। তার ডান হাতটা শূন্যে একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করল। প্রচণ্ড একটা থাপ্পড় সে কষিয়ে দিল ঐ অশ্বারোহীর গণ্ডদেশে। টলে উঠল ছোটহুজুর। তৎক্ষণাৎ সে কোষমুক্ত করল তার ধারালো তলোয়ার, কোমরবন্ধের খাপ থেকে। আর একই মুহূর্তে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল ঈশান সর্দার : খবরদার!

ছোটহুজুর টাল সামলে সোজা হয়ে বসল। ভীমা ততক্ষণে পাঁচ হাত দূরত্বে। অশ্বারোহী তিনজনেরই লক্ষ্য হল—চার পাঁচজন ধানুকী স্থিরলক্ষ্যে তাদের ঘিরে ফেলেছে। প্রত্যেকের ধনুকের জ্যা আকর্ণ-বিস্তৃত।

ঠিক তখনই দেখা গেল মাঠের ওপ্রান্ত থেকে মাঝিমাল্লার দল পিলপিল করে ছুটে আসছে এদিকে। কারও হাতে দাঁড়, কারও বা লগি! আকাশবাতাস মথিত করে ধ্বনিত হচ্ছে : আ-বা-বা-বা-বা-

গালটা জ্বালা করছে! উপায় নেই! এরা ডাকাত! ছোট সরকার তার সঙ্গী দুজনকে নিয়ে তীর বেগে বেরিয়ে গেল ভিড়ের মাঝখান দিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *