৯
ব্রজসুন্দরীকে নামিয়ে আক্না হয়েছে পূজামণ্ডপে। বাড়িটি চক মেলানো। অর্থাৎ চারিদিকে সারি সারি ঘর। মাঝখানে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। সেটা পূজামণ্ডপ। এখানেই দুর্গাপূজা, শ্যামাপূজা হয়। আবার ঝুলনে রাধাকৃষ্ণের দোলনমঞ্চ। এই প্রাঙ্গণেই বসে যাত্রার 127. আসর। কীর্তনের আসর। বর্তমানে ঐ প্রাঙ্গণের কেন্দ্র-স্থলে একটি সুসজ্জিত পালঙ্কে গৃহস্বামিনী শায়িতা। তাঁর পরিধানে নিতান্ত বেমানান একটি অত্যন্ত মহার্ঘ বেনারসী শাড়ি। বেমানান এজন্য যে, বৃদ্ধার পরিধানে তা দৃষ্টিকটু। কিন্তু জগুঠাকুরুণ কোন কথা শোনেননি। বলেছিলেন, গঙ্গাজল, আর কোনদিন তো তোকে কিছু বলতে আসবনি। কতা শোন! এই বে-র বেনারসী পরেই ড্যাংডেঙিয়ে যাত্রা করতে হবে।
জগুঠাকুরুণ ব্রজসুন্দরীর ‘গঙ্গাজল’। সখী। ব্রজসুন্দরী এই শেষ অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি। বড়বৌমা—তারাপ্রসন্নের স্ত্রী, তাই এই শাড়িখানিই পরিয়ে দিয়েছেন তাঁকে। বৃদ্ধার মাথায় অপর্যাপ্ত সিন্দুর, চরণদুটি অলক্তকরাগরঞ্জিত। তিনি শয্যালীন। কিন্তু পূর্ণ জ্ঞান আছে। বিহ্বল দুটি চোখ মেলে তিনি সবাইকে দেখছিলেন। চিনতে পারছিলেন। শয্যালীন হলেও তাঁর মাথার পিছনে কয়েকটি উপাধান—শায়িত অবস্থায় প্রণাম করতে নেই—এমনকি অন্তর্জলিযাত্রার পথিককেও!
রূপেন্দ্রনাথ যখন এসে উপস্থিত হলেন তখনো অপরাহ্ণের আলো আছে। সন্ধ্যা হতে আরও দুদণ্ড বাকি। সমস্ত গ্রাম ভেঙে পড়েছে। প্রাঙ্গণে তিলধারণের ঠাঁই নাই। শয্যালীনাকে ঘিরে পুরললনার দল। পুরুষেরা প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। বাহিরেও অনেক দর্শনার্থী। তারা সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করে প্রণাম করে অন্য নিষ্ক্রমণ দ্বার দিয়ে বহির্গত হয়ে যাচ্ছে। সারা দুপুর ধরে। রূপেন্দ্রনাথ অনেককেই চিনতে পারলেন, যদিও তিনি গ্রামের অনেককেই চেনেন না। বরাবর ভিনগাঁয়ে থাকায়। বৃদ্ধার চরণপ্রান্তে বসে আছেন বৌষ্ঠান—তারাপ্রসন্নের সহধর্মিণী। তার পাশে পুঁটু। ওপাশে নন্দখুড়োর দুই স্ত্রী, তার পরে শোভারাণী, মতি, মৃন্ময়ী। তার পাশে কাত্যায়নী। জগুপিসি বৃদ্ধার মাথার কাছে। রূপেন্দ্রনাথের লক্ষ্য হল বৃদ্ধা সজ্ঞানে আছেন। দু-চারটি কথাও বলছেন। কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলেন না তিনি। পেলে বুঝতে পারতেন—জগুঠাকুরুণ প্রশ্ন করেছিলেন, কীরে গঙ্গাজল? ভয় করছে?
বৃদ্ধা বলছিলেন, ওমা, ভয় করবে কেন রে? ভর-ভরাম্ভ সংসার রেখে যাচ্ছি—এতো আনন্দের যাওয়া। শুধু ঐ বুড়োটার জন্যে—ওকে একটু দেখিস্, গঙ্গাজল!
ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। রূপেন্দ্রনাথ রোগীবাড়ি এসেছিলেন তাঁর সেই বিচিত্র পুলিন্দাটি হাতে নিয়ে। এখন মনে হল ভুল করছেন তিনি। এ রোগের চিকিৎসা নেই। এই রোগীবাড়ি থেকে কেউ তাঁকে কোনদিন ডাকেনি—চিকিৎসক হিসাবে। কিন্তু এ বাড়ির দ্বার তাঁর কাছে অবারিত। বছর বছর দোল-দুর্গোৎসবে এসেছেন। সামাজিক নিমন্ত্রণ রাখতে তো কতবার। ব্রজসুন্দরী তাঁকে ভালও বাসতেন খুব। ব্রজেন্দ্রনারায়ণও। কিন্তু এখন তিনি অবাঞ্ছিত! যে রোগী মৃত্যুর কাছে দাসখত লিখে দিয়ে বসে আছে তার চিকিৎসা হয় না!
দাসখৎ? না, কথাটা ঠিক হল না। বরং বলা উচিত মৃত্যুই ওঁর কাছে দাসখৎ লিখে দিয়েছে। মৃত্যু তার মহিমা, তার ভয়াবহতা, তার আতঙ্ককে ত্যাগ করে রীতিমতো চোরের মতো এসে চুপটি করে দাড়িয়েছে ওঁর পদপ্রান্তে। নতনেত্রে। তার লজ্জার সীমা-পরিসীমা নেই। নেহাৎ অভ্যাসবশে প্রতীক্ষা করছে—কখন ঐ সীমন্তিনী ড্যাংডেঙিয়ে যাত্রা শুরু করবেন।
—রুপেন!
সম্বিত ফিরে পান রূপেন্দ্রনাথ। পাশে ফিরে দেখেন তারাপ্রসন্ন এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর পাশটিতে। চোখাচোখি হতে বলেন, বাবামশাই তোমাকে একবার ডাকছেন
—জেঠামশাই! কই কোথায় তিনি?
—এস আমার সঙ্গে।
তাই তো! গৃহস্বামীর অনুপস্থিতিটা তো এতক্ষণ নজরে পড়েনি
ব্রজেন্দ্রনারায়ণ বসেছিলেন পাশের ঘরে। একা। ঘরজোড়া তক্তাপোশে ফরাস বিছানো। উনি কিন্তু বসেছিলেন একটি আরাম-কেদারায়। ইঙ্গিতে বসতে বললেন রূপেন্দ্রনাথকে।
তারাপ্রসন্ন দাঁড়িয়েই রইলেন।
রাশভারী মানুষটি একবার তাকিয়ে দেখলেন পাশের দিকে। বললেন, তোমার বড়-মার এতবড় অসুখে তোমাকে একবারও ডাকিনি। তুমি অভিমান করতে পারো রূপেন্দ্র। কিন্তু কেন ডাকিনি জান?
রূপেন্দ্রনাথ নতনেত্রে নীরব রইলেন।
—এ পোড়া দেশে স্ত্রীলোকের চিকিৎসা হয় না বলে। স্ত্রীজাতির তিন অবস্থা—অথবা, সধবা আর বিধবা। বাকি দুজনের তো কথাই নেই, এমনকি সধবাও চায় ড্যাংডেঙিয়ে স্বর্গে যেতে। কী করে চিকিৎসা করবে তুমি?
এবারও রূপেন্দ্রনাথ জবাব দিলেন না।
—তোমাকে এখনি ডেকে পাঠিয়েছি কিন্তু চিকিৎসক হিসাবে পরামর্শ নিতেই।
এতক্ষণে চোখ তুলে তাকালেন, চিকিৎসক হিসাবে?
—হ্যাঁ, রূপেন্দ্র। তুমি একবার ওঁর নাড়িটা দেখ। দেখে বল—আমার কী কর্তব্য। ব্যবস্থা কাটোয়ায় করব না নবদ্বীপে? অর্থাৎ ওঁর মেয়াদ…
বাক্যটা অসমাপ্ত থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হল না। রূপেন্দ্র তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ান।
—আর একটি কথা, বাবা। কী বুঝলে তা শুধু আমাকে জানিও। আগামী পূর্ণিমা পর্যন্ত কি উনি আছেন?
রূপেন্দ্রনাথ ফিরে এলেন প্রাঙ্গণে। তারাপ্রসন্ন ওঁকে পথ করে, ভিড় সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বসালেন রোগীর পাশটিতে। বড়মাকে প্রণাম করতেই তিনি বললেন, এসেছিস? এবার সত্যিই চললাম রে, রুপো!
—আপনার নাড়িটা দেখি।
—নাড়ি? কী হবে রে? …ও বুঝেছি! গঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব কিনা? পারব রে, পারব! ভুলিস না রুপো—‘নিয়তি কেন বাধ্যতে’? প্রশ্নটার জবাব হচ্ছে : ‘মনসা’! মনের জোর থাকলে মৃত্যুকেও—না, ফেরানো যায় না, কিন্তু তাকে অপেক্ষা করতে হয়!
রূপেন্দ্রনাথের ইচ্ছা হল পুনর্বার ঐ মৃত্যুপথ যাত্রিণীর পদধূলি নিতে। পরিবর্তে ওঁর রোগজীর্ণ হাতটি তুলে নিয়ে নাড়ি ধরে বসলেন।
মনঃসংযোগ করতে পারলেন না কিন্তু। প্রাঙ্গণে তিন-চারশ লোক-পুরুষ ও স্ত্রী। একটা কলগুঞ্জনে ওঁর একাগ্রতা ব্যাহত হচ্ছিল। মুখ তুলে বললেন, তারাদা, সকলকে নীরব হতে বলুন। কেউ কোন শব্দ করবেন না।
তারাপ্রসন্নকে সে কথা দ্বিতীয়বার বলতে হল না। রূপেন্দ্রনাথ যথেষ্ট উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন তাঁর নির্দেশ। সভাস্থল স্তব্ধ হয়ে গেল। সালঙ্কারা শীর্ণ হাতের মণিবন্ধে দুটি আঙুল স্পর্শ করে ভেষগাচার্য ধ্যানে বসলেন। নিমীলিত নেত্র। সমংকায়শিরোগ্রীব ভঙ্গি।
অষ্টোত্তর শতবার গায়ত্রীমন্ত্র জপ করতে যতটা সময় লাগে তাও যেন অতিবাহিত হয়ে গেল। তারপর যেন ধ্যানভঙ্গ হল। ধীরে ধীরে হাতটি নামিয়ে রাখলেন।
বৃদ্ধা এবার প্রশ্ন করেন, কী বুঝলি রে পাগলা ঠাকুর? তোর বড়মা নবদ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে?
হাসলেন রূপেন্দ্রনাথ। প্রতিপ্রশ্ন করলেন, ‘নিয়তি কেন বাধ্যতে? বড়মা?
উঠে দাঁড়ালেন এবার। কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। সভাস্থ সকলের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। মৃন্ময়ী ঠিক ওঁর সামনেই অনিমেষ লোচনে তাকিয়ে আছে—নজর পড়ল সেদিকে। কী যেন মনে পড়ে গেল। আবার ধীরে ধীরে বসে পড়লেন। পুলিন্দা হাড়ে বার করলেন তাঁর সেই বিচিত্র যন্ত্রটি। বললেন, আপনার বুকটা একটু দেখব, বড়মা!
পাশেই খখস্ শব্দ। নজর পড়ল সেদিকে। বললেন, শব্দ করবেন না।
মৃন্ময়ী জড়সড় হয়ে চুপ করে বসে রইল। বৃদ্ধা বললেন, দেখ্
যন্ত্রটার একপ্রান্ত বৃদ্ধার বুকে বসিয়ে অপর প্রান্তে কান লাগাতে গেলেন।
আঃ! আবার কিসের শব্দ!
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, একটি থেলো হুঁকো হাতে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন দুর্গাচরণ। তারই গুড়ুক খাওয়ার শব্দ। রূপেন্দ্রনাথ পুনর্বার বলেন, তারাদা, যাঁরা তামাক খেতে চান, তাদের বাইরে যেতে বলুন। শব্দে আমার অসুবিধা হচ্ছে।
গাঙ্গুলীমশাই থেলো হুঁকোটা একজন খিদমদগারের হস্তে সমর্পণ করলেন।
রূপেন্দ্রনাথ যন্ত্রে কান লাগিয়ে বৃদ্ধার হৃদস্পন্দন শুনলেন দীর্ঘসময়। তারপর নিঃশব্দে উঠে চলে গেলেন। কেউ কোন প্রশ্ন করল না।
এ ঘরে একই ভঙ্গিতে বসে আছেন ব্রজেন্দ্রনারায়ণ। রূপেন্দ্রনাথ নিঃশব্দে গিয়ে বসলেন তাঁর পাশে। ব্রজেন্দ্র আড়চোখে সেদিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন। অভিজ্ঞ ভূয়োদর্শীর বুঝতে অসুবিধা হল না—রূপেন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিচলিত। যেন রোগিণীকে পরীক্ষা করে তিনি কী-একটা মর্মান্তিক সংবাদ জেনেছেন, বলতে সাহস পাচ্ছেন না। দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও ব্রজেন্দ্র দেখলেন নতনয়নে নবীন ভেষগাচার্য দারুণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তিনি এখনো নীরব।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল বৃদ্ধের। বললেন, বুঝলাম।
রূপেন্দ্রনাথ চকিতে মুখ তুলে বলেন, কী? কী বুঝেছেন আপনি?
—কতটা সময় পাব? ডুলিতে যদি সরাসরি নবদ্বীপে নিয়ে যাই? পৌঁছানো যাবে না?
হঠাৎ আসন ছেড়ে এগিয়ে এলেন রূপেন্দ্র। আবেগের সঙ্গে বৃদ্ধের হাত দুটি ধরে বললেন, যাপনার কাছে একটা ভিক্ষা চাইব, জেঠামশাই; দেবেন?
ব্রজেন্দ্রনারায়ণ রীতিমতো বিস্মিত। তারাপ্রসন্ন এখনো স্থানত্যাগ করেননি। তিনি দাঁড়িয়ে ইলেন দ্বারপথে। ঘটনার প্রবাহ লক্ষ্য করে তিনি কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করলেন। দ্বারের পাল্লা দুটি নিঃশব্দে বন্ধ করে দিলেন ভিতর থেকে।
ব্রজেন্দ্রনারায়ণ কী বলবেন যেন ভেবে পাচ্ছেন না। এমন কথা বাঁড়ুজ্জে পরিবার তিন পুরুষে কখনো বলেনি! রূপেন্দ্রনাথের পিতামহকে কিছু ব্রহ্মোত্তর ভূখণ্ড দান করতে চেয়েছিলেন ওঁর পিতৃদেব। সেই সাগ্নিক ব্রাহ্মণ প্রত্যুত্তরে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, কেন ভাদুড়ীমশাই? আপনার রাজ্যে কি অগ্রদানী বামুনের আকাল পড়েছে? রূপেন্দ্রের পিতাও জমিদারের খরচে তাঁর চতুষ্পাঠী সম্প্রসারিত করতে স্বীকৃত হননি। সেই বংশের সন্তান রুপো বাঁড়ুজ্জে এই মর্মান্তিক সময়ে নিজে প্রার্থী হয়ে ভিক্ষা চাইছে!
—জেঠামশাই!
—তার পূর্বে আমাকে বল—তুমি কী বুঝেছ? গঙ্গা পর্যন্ত উনি পৌঁছাতে পারবেন!
—হ্যাঁ। তাঁকে নিয়ে গেলে তিনি শুধু সশরীরে কাটোয়া নয়, নবদ্বীপেই পৌঁছাবেন!
—তাহলে আমি আজ দাতাকর্ণ! বল, কী প্রার্থনা করছ আমার কাছে? সব কিছুই আজ এই আনন্দের দিনে তোমাকে দিতে প্রস্তুত! বল, কী চাইছো?
জিজ্ঞাসিত হয়ে বিড়ম্বনায় পড়লেন যেন। কীভাবে এই অবাস্তব প্রস্তাবটা পাড়বেন—কী ভাষায়—তা যেন প্রণিধান করে উঠতে পারছেন না। ওঁর নীরবতার সুযোগে বৃদ্ধ পুনর্বার বলে ওঠেন, আমার আশঙ্কা হয়েছিল, তুমি ওঁর নাড়ি দেখে বুঝেছ যে, তোমার বড়মার শেষ ইচ্ছাটা আমি পূরণ করতে পারব না। তা যদি না হয়… কিন্তু একটা কথা রুপেন, কিছু মনে কর না বাবা, তোমার কথাটা আমার কানে একটু বেসুরো লেগেছে! এ তো বাঁড়ুজ্জে বংশের রেওয়াজ নয়!
—যাচ্ঞা মোঘা বরমধিগুণে, নাধমে লব্ধকামাঃ।[১]
[১. যাঁরা মহৎ তাঁদের কাছে প্রার্থনা করে বিফল হওয়াও ভাল, অধমের কাছে মনস্কামনা সিদ্ধ হওয়ার চেয়ে।]
—অধিগুণ তোমার জেঠার আছে কিনা জানি না, কিন্তু আগেই বলেছি—আজ আমি দাতাকর্ণ! আমার পৌরুষ আর ধর্ম ছাড়া তুমি আজ যা ইচ্ছা প্রার্থনা করে দেখতে পার।
রূপেন্দ্রনাথ বললেন, শুনুন জেঠামশাই, গুরুর আশীর্বাদে ‘নিদান’ যদি বিন্দুমাত্রও আয়ও করে থাকি, তাহলে নিশ্চয় বুঝেছি, পক্ষকালের মধ্যে বড়মা আমাদের ছেড়ে যাবেন না। আপনি ওঁর যাত্রা স্থগিত রাখুন। একপক্ষ কালের জন্য। এই একপক্ষকাল আমাকে একবার শেষ চেষ্টা করতে দিন।
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ব্রজেন্দ্র, এ কী বলছ রূপেন? কাল প্রভাতে আমরা যাত্রা করব! সব কিছু যে প্রস্তুত!
—আপনি কিন্তু সত্যবদ্ধ জেঠামশাই! আমি আপনার পৌরুষ বা ধর্মে হস্তক্ষেপ করিনি।
ব্রজেন্দ্রনারায়ণ আসন ছেড়ে উঠে পড়েন। বারকতক কক্ষের ভিতরেই পদচারণা করে হঠাৎ থেমে বলেন, কিন্তু কী লাভ? আরও কয়েক মাস পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকার? এ যে ওঁর নিয়তি।
—পঙ্গু হয়েই যে থাকবেন একথা তো আমি বলিনি জেঠামশাই। আর ‘নিয়তির কথা বলছেন? ‘নিয়তি কেন বাধ্যতে?—এই প্রশ্নের জবাবটা কী, জানেন?—’মনসা’!
—কে বলেছেন?
—বড়মা!
—কবে?
—এইমাত্র!
আবার পদচারণা শুরু করেন ব্রজেন্দ্র। তারাপ্রসন্ন আর স্থির থাকতে পারেন না। ডেকে ওঠেন, বাবা?
—কিন্তু গুরুদেব যে বিধান দিয়ে বসেছেন?
—তাঁকে ডাকুন। রুপেন তো তাঁর নির্দেশ অমান্য করার পরামর্শ দেয়নি। সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার পরামর্শ দিয়েছে শুধু। আপনি বরং গুরুদেবকে বলুন—আপনার বাসনা, যজ্ঞ সমাপ্তির ভস্মতিলক মাথায় নিয়েই পক্ষকাল পরে মা যাত্রা করবেন।
পুত্রের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন এবার। এ প্রস্তাবে হয় তো গুরুদেব স্বীকৃত হয়ে যাবেন। লোক-চক্ষুর আড়ালে যজ্ঞের কোনও মহিমা থাকবে না।
গুরুদেব রাজী হলেন।
রূপেন্দ্রনাথ পক্ষকালের মধ্যে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন না আদৌ। নিরলস নিষ্ঠায় বালু-ঘড়ি হাতে বসে রইল রোগিণীর শিয়রে। দণ্ড-দণ্ড ঔষধ প্রস্তুত করে সেবন করালেন। এমনকি পথ্যও প্রস্তুত করালেন নিজের তত্ত্বাবধানে। জগুঠাকরুণ আর কাত্যায়নী- সকাল-সন্ধ্যা সংবাদ সংগ্রহ করে যেত। কাত্যায়নী একদিন সুযোগ মতো ওঁর কর্ণমূলে বলতে গেল, দাদা, আজ মিনু খুড়িমা এসেছিল, বললে—-
রূপেন্দ্রনাথ একটি হাত তুলে শুধু বললেন, থাক! আমার একাগ্রতা ব্যাহত করে দিস্ না কাতু। বাড়ি যা—
বিচিত্র ঘটনাচক্র। পক্ষকাল পরে একদিন যজ্ঞ সমাপ্ত হল। গুরুদেব তাম্রপাত্রে ঘৃত-নিষিক্ত যজ্ঞভস্ম নিয়ে যেদিন রোগিণীর শিয়রে উপস্থিত হলেন সেদিন আর তিনি শয্যালীনা নন। উঠে বসেছেন।
ব্রজসুন্দরী মাঝে-মাঝে জিজ্ঞাসা করতেন, তুই আমার সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিলি কেন রে, পাগলা?
রূপেন্দ্রনাথ মিটিমিটি হেসে বলতেন, কী করব? জেঠামশাই যে আমাদের জন্য একটা নতুন জেঠিমা আনতে কিছুতেই রাজি হলেন না?
—জেঠা তো হলেন না। ভাইপো কেন অমন জিদ্দি ধরে বসে আছে?
.
পরবর্তী পূর্ণিমায় জমিদার বাড়িতে সাড়ম্বরে সত্যনারায়ণের পূজা হল। গোটা গ্রাম প্রসাদ পেয়ে গেল এসে। এমনকি ভিন-গাঁয়ের মানুষও। ব্রতকথার আসরে বড়মা আসন-পিড়ি হয়ে বসতে পেরেছিলেন। মানুষজন শুধু তাদের ‘বড়মা’কে পেন্নাম করেই তৃপ্ত হতে পারে না—খোঁজ করে, আর সেই পাগ্লা কোবরেজ-মশাই কোনজনা গো?
গুরুদেব বললেন, কেমন? বলিনি? এ যজ্ঞ অমোঘ! অব্যর্থ! ‘অশ্বমেধাসহস্রানি’র যে পুণ্যফল, ‘লক্ষং প্রদক্ষিণাঃ পৃথ্ব্যাঃ’-র যে ফল—এই মহাযজ্ঞে ‘তদ্ফলম্’! বুঝলে না, বাবা, যমদূতেরা ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারেনি।
সকালেই সেটা সহজে বুঝে নিল। এই রকম একটা ভবিষ্যদ্বাণীই করেছিলেন বটে উনি।
ব্রজেন্দ্রনারায়ণও তা স্বীকার করলেন, কিন্তু ঐখানেই থামলেন না তিনি। একবগ্গাঠাকুরকে অন্তরালে ডেকে জনান্তিকে যে নতুন নামে সম্বোধন করলেন কী-জানি কী করে তা ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে। ব্রজেন্দ্র ওঁকে বললেন, ধন্বন্তরি! তোমাকে কী বৈদ্যবিদায় দেব, বল?
—বড়মা আমার নিজের মায়ের মতো, জেঠামশাই!
—বটেই তো! তুমিও আমার ছেলের মতো! তারাকে যদি একটা মহাল দান করতে পারি, তাহলে তোমাকেই বা কিছু ব্রহ্মোত্তর লিখে দিতে পারব না কেন?
রূপেন্দ্রনাথ যুক্তকরে নীরব রইলেন।
—কী হল? জবাব দাও? স্বীকার কর!
—স্বীকার করলে কথাটা যে আপনার কানে আবার বেসুরো লাগবে জেঠামশাই। আপনি নিজেই যে সেদিন বলেছিলেন—সেটা বাঁড়ুজ্জে বংশের রেওয়াজ নয়। বৈদ্যবিদায় হিসাবে আমি সকলের কাছ থেকে সমপরিমাণেই সম্মানমূল্য নিয়ে থাকি। অর্থাৎ যেখানে আমি বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা করছি না।
ব্রজেন্দ্রনারায়ণ বলেন, কিন্তু ‘অধিগুণ’ আর ‘অধম’-এর পার্থক্যের প্রসঙ্গ তো তুমি নিজে থেকেই তুলেছিলে?
এবারেও রূপেন্দ্রকে নীরব দেখে কেমন যেন বিচলিত হয়ে পড়েন বৃদ্ধ। হঠাৎ সেই সেদিন ও যেমন করে বৃদ্ধের হাতদুটি আবেগভরে টেনে নিয়েছিল সেইভাবে রূপেন্দ্রের হাতদুটি ধরে বললেন, আজ আমিই তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি রুপেন! বামনের দ্বারে আজ বলিরাজা ভিক্ষাদানের অধিকারটুকু প্রার্থনা করছে।
রূপেন্দ্রনাথ নিচু হয়ে বৃদ্ধের পদধুলি নিলেন। শান্তস্বরে বললেন, আপনি বিদ্বান, পণ্ডিত, বিবেচনা করে দেখুন,—আপনি যা চাইছেন তা আমার ধর্ম! আমার পৌরুষ! আমার বংশে কেউ কখনো যে ভিক্ষা নেয়নি, জেঠামশাই!
তৎক্ষণাৎ হাত দুটি ছেড়ে দিলেন। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মতো বারকতক পদচারণা করে নিলেন রুদ্ধদ্ধার কক্ষে। তারপর ফিরে এসে আবার বসলেন তাঁর আরাম-কেদারায়। বললেন, শোন! আমি কখনো কারও কাছে পরাজয় স্বীকার করিনি। আজও করব না। আমার বিকল্প প্রস্তাবটি শোন। বল, এতে কি তুমি স্বীকৃত? এ প্রস্তাবে কি আমি তোমার পৌরুষ অথবা ধর্মে হস্তক্ষেপ করছি?
জমিদার মশায়ের বিকল্প প্রস্তাবটি বিচিত্র।
তিনি লক্ষ্য করেছেন, স্বগ্রামে প্রতিষ্ঠা না পেলেও চিকিৎসক হিসাবে ওঁর কাছে ভিগায়ের মানুষ প্রায়ই আসে। এবার যে অলৌকিক প্রক্রিয়ায় তিনি অন্তর্জলিযাত্রার রোগিণীকে সংসারে ফিরিয়ে এনেছেন তাতে অচিরেই দূর-দূরান্তর থেকে বাড়ুজ্জে বাড়িতে রোগীর দল আসতে শুরু করবে। হয়তো তাদের চিকিৎসা করতে দু-দশদিন সময় লাগবে। গাছের তলায় আশ্রয় নেওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নাই। জমিদারের একটি অতিথিশালা অবশ্য আছে; কিন্তু সেটা গ্রামের অন্য প্রান্তে। তাছাড়া সেখানে রোগীকে আশ্রয় দেওয়ার নানান বাধা। ব্রজেন্দ্রনারায়ণের প্রস্তাব, ধন্বন্তরির ভদ্রাসনের দক্ষিণপূর্বে যে পুষ্করিণীটি আছে—পদ্মদীঘি—তার পাড়ে পাশাপাশি পাঁচটি কুটির নির্মিত হবে। সে জমি জমিদারের, কুটিরের মালিকও থাকবেন তিনি। শুধু তাতে আশ্রয় নেবে গ্রামান্তরের রোগী বা তার পরিবারবর্গ—ধন্বন্তরির নির্দেশে। যারা আশ্রয় পাবে তাদের জন্য জমিদারের ব্যবস্থাপনায় ‘সিধা’ যাবে অথবা কাঁচা-ফলার। পরিকল্পনাটি পেশ করে বলেন, বল ধন্বন্তরি! আমি কি তোমার পৌরুষ বা ধর্মে হস্তক্ষেপ করেছি?
ব্রজেন্দ্রনারায়ণ এই বিচিত্র ব্যবস্থা কেন করতে চাইছেন আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না। সেকালে কোন কোন জমিদার প্রজার মঙ্গলবিধানে, পিতৃমাতৃস্মৃতিতে এই জাতীয় দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করতেন।
রূপেন্দ্রনাথ করজোড়ে বলেন, না, জেঠামশাই! আপনি নরনারায়ণের সেবা করতে চাইলে আমি অন্তরায় হব কেন? এ তো অতি শুভ প্রস্তাব। তবে সে-ক্ষেত্রে আমার দুটি বিকল্প প্রস্তাব আছে।
—বল?
—আপনি পাঁচটির পরিবর্তে আপাতত তিনটি আশ্রয়গৃহ নির্মাণের আদেশ দিন। একটি পুরুষের, একটি স্ত্রীলোকের, এবং তৃতীয়টি বেশ কিছু দূরে, সংক্রামক রোগীর—নরনারী নির্বিশেষে
বিস্মিত ব্রজেন্দ্রনারায়ণ বলেন, কেন ধন্বন্তরি? তোমার জেঠামশাই ‘অধিগুণ’ হতে চাইলে তাঁকে ‘অধম’ করতে চাইছ কেন? পাঁচটি কমিয়ে তিনটি…
রূপেন্দ্রনাথ সহাস্যে বলেন, আজ্ঞে না। আপনার অর্থসাশ্রয় করতে এ-কথা বলিনি। যে অর্থ সাশ্রয় হবে তাই দিয়ে আপনি ঐ পদ্মপুকুরের চতুর্দিকে শক্ত একটা বেড়া দেবার ব্যবস্থা করুন। ঐ পুষ্করিণীতে অবগাহন স্নান, বস্ত্রাদি বা বাসনপত্র ধৌত করা নিষিদ্ধ করতে হবে। পদ্মপুকুর থেকে এখন শুধুমাত্র পানীয় জল সংগ্রহ করা যাবে।
বৃদ্ধ স্মিতহাস্যে বললেন, তোমার এই অদ্ভুত প্রস্তাব সম্বন্ধে আমার মতামত জ্ঞাপন করার পূর্বে একটি প্রতিপ্রশ্ন করছি—বল তো, পদ্মপুকুরে একটিও পদ্ম নাই, তবু ওর নাম কেন ‘পদ্মপুকুর?
রূপেন্দ্র স্বীকার করেন, জানি না। বোধকরি এককালে ওতে পদ্ম ছিল, মানে যখন নামকরণ করা হয়।
—না। আমার প্রপিতামহীর নাম ছিল পদ্মরাণী। ঐ পুষ্করিণীটি আমার পিতামহ খনন করান মাতৃস্মৃতিতে। ওটি প্রতিষ্ঠিত জলাশয়। প্রতিষ্ঠাকালে আমার পূজ্যপাদ পিতামহ “নারায়ণ সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—ঐ জলে জনসাধারণের অবগাহন স্নানের অধিকার যাবৎচন্দ্রাকমেদিনী স্বীকৃত। তা ছাড়া ঐ প্রতিষ্ঠিত পুষ্করিণীতে ‘করণ হয়ে থাকে। ‘করণ বোঝ? কুলীন শ্রেণীর বারেন্দ্র পুত্রকন্যার বিবাহে সম্মত হবার পর অবগাহন স্নানান্তে পুষ্করিণীর জলে দাঁড়িয়ে বিবাহসূত্রে আত্মীয়তার বন্ধন স্বীকার করেন। প্রতিজ্ঞা করেন।
রূপেন্দ্র বলেন, প্রতিষ্ঠিত পুষ্করিণীর অভাব তো সোঞাই গ্রামে নেই জেঠামশাই। ‘নীলসায়র’ দীঘি তো মাত্র কয়েক রসি দূরে। অতঃপর সেখানেই ‘করণত হবে। পদ্মদীঘি সংরক্ষিত করা হলে অসুবিধা কারও হবে না।
—না, তা হয় না। অসুবিধা হয় তো হবে না। কিন্তু আমার পিতৃপুরুষেরা যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তা তো আমি ব্যত্যয় হতে দিতে পারি না …কিন্তু কেন এই অদ্ভুত শর্তটি আরোপ করতে চাইছ তুমি?
—সে অনেক কথা। কিন্তু আপনি যদি এতে সম্মত না হন তাহলে আমিও আপনার প্রস্তাবে সম্মত হতে পারি না!
ব্রজেন্দ্রনারায়ণ কয়েকটা মুহূর্ত জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন—যেন ভ্রাতুষ্পুত্র নয়, দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রতিপক্ষ! যেন দুই ইজারাদার নবাব সরকারে এসেছেন রাজস্বের নিলাম-ডাকে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে অধিকার অর্জনে!
হঠাৎ উঠে পড়েন ফের আসন ছেড়ে। একই ভঙ্গিতে বার কতক পদচারণা করে ফিরে এসে বলেন, আমি যদি ঐখানে একটি নূতন পুষ্করিণী খনন করাই?
—তাতে যে আপনার অনেক-অনেক বেশি খরচ হয়ে যাবে,জেঠামশাই?
এতক্ষণে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। গর্জন করে ওঠেন, সেটুকু বুঝবার মতো বৈষয়িক বুদ্ধি আছে তোমার জেঠামশায়ের। বাজে কথা থাক। সোজাসুজি বল, তাহলে কি তুমি স্বীকৃত?
রূপেন্দ্রনাথ আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ান। বলেন, সানন্দে।
—বস। কথা এখনো শেষ হয়নি।
—আবার কী?
—তুমি ভুলে গেছ। দুটি শর্তের কথা বলেছিলে তুমি। দ্বিতীয়টি?
—ও হ্যাঁ। আবার বসে পড়েন।
এবার দ্বিতীয় শর্তটি ব্যক্ত করেন। প্রয়োজনে রূপেন্দ্রনাথ কোন অহিন্দুকেও ওখানে আশ্রয় দিতে পারবেন। পীরপুরের কোন মুসলমান পরিবার যদি তাঁর কাছে দীর্ঘদিনের চিকিৎসার জন্য আসে, তাহলে তাদেরও তো একই জাতের সমস্যা হবে।
এক কথায় সম্মত হলেন ব্রজেন্দ্রনারায়ণ। বললেন, ঠিক কথা। আর্তের জাত নেই। সেক্ষেত্রে আমি সে গৃহের কলি ফিরিয়ে নেব। শাস্ত্রীয় নিয়মে গৃহশুদ্ধি করে নেব।
—এখানকার ব্রাহ্মণ সমাজ আপত্তি করবেন না?
—সম্ভবত করবেন। কিন্তু কাঞ্চনমূল্যও তো বড় কম কথা নয়।
—আরও একটা কথা জেঠামশাই। এটা আমার শর্ত নয়, আব্দার।
—বল?
—প্রতিষ্ঠানটির নাম হবে: ‘ব্রজসুন্দরী আরোগ্য নিকেতন।
ব্রজেন্দ্র স্মিত হাসলেন। বলেন, কিন্তু নামকরণ যে আমি মনে মনে আগেই স্থির করে রেখেছি রূপেন্দ্র : ‘ধন্বন্তরী আরোগ্য নিকেতন’।
আবার উঠে দাঁড়াতে হল। বলেন, না। তাহলে ওটা আর আমার আব্দার নয়, শর্ত! ভেবে দেখুন, বড়মা যদি নিজের মনের জোরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষতে স্বীকৃত না হতেন, তাহলে আমার ঔষধে কোন ফলই হত না। আমার চেয়ে অভিজ্ঞ কবিরাজ এ রাঢ়খণ্ডে ভূরি ভূরি; কিন্তু বড়মার চেয়ে মহিয়সী নারী আপনি আর একটিও দেখাতে পারেন?
ব্রজেন্দ্র কৌতুক বোধ করেন। বলেন, কী মাহাত্ম্য দেখতে পেলে তাঁর? অনাবৃষ্টির বছরে বৃষ্টি নামানো?
—আজ্ঞে না। বড়মা কুসংস্কারকে জয় করেছেন বলে! স্ত্রীলোক বিদ্যাচর্চা করলে তার বৈধব্যযোগ অনিবার্য—এতবড় কথাটাকে তিনি উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন বলে! কোন সীমন্তিনী নারীর পক্ষে এ যে কতবড় কীর্তি, তা তো আপনার অজানা নেই জেঠামশাই।
ব্রজেন্দ্র হাসতে হাসতে বলেন, নাঃ! ‘ধন্বন্তরী নয়—তোমার ঐ বদনামটাই টিকে থাকবে : ‘একবগ্গা ঠাকুর’।
জেঠামশায়ের পদধূলি নিয়ে এবার বিদায় নেন। বলেন, আশীর্বাদ করুন—ঐ বদনামটার মর্যাদা যেন কোনদিন ক্ষুণ্ণ না করি।