কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

কাশীধাম – ২

রাজাসাহেব পুরন্দর ক্ষেত্রী কাশীধামের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক। তা বলে তিনি কিন্তু কাশীনরেশ নন। কাশীরাজ বলবন্ত সিংহের দেহান্ত হয়েছে গত দশকে। তাঁর নাবালকপুত্র কৃষ্ণেন্দুনারায়ণের তরফে প্রাক্তন কাশীনরেশের ভাগিনেয় পুরন্দর ক্ষেত্রী এখন শাসক। কিন্তু প্রজারা তাকে সিংহাসনে বসবার নিরঙ্কুশ অধিকার দেয়নি। ভোগৈশ্বর্য, বিলাসবৈভব সব কিছু হস্তামলকবৎ পেয়েও পুরন্দর তাই মানসিক শান্তি লাভ করেনি। মনে মনে সে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে। যতদিন মাথায় মুকুট, হাতে রাজদণ্ড এবং পশ্চাদ্দেশে সিংহাসনের কোমলস্পর্শ অনুভব না করছে ততদিন সে বিবাহ করবে না। তা বলে সে কিছু শুকদেব গোঁসাই নয়। সহধর্মিণী না হলেও নিত্যনতুন শয্যাসঙ্গিনীর গোপন ব্যবস্থা আছে।

সমস্ত কাশীরাজ্য প্রতীক্ষা করে আছে—কবে ঐ কিশোর রাজপুত্র সাবালক হবে, অপশাসকের হাত থেকে শাসনদণ্ডটি ছিনিয়ে নেবে। পুরন্দরের অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি নেই পূর্বতন রাজকর্মচারীদের হত্যা অথবা অপসারণ করেছে একে একে। নিজের বিশ্বস্ত অনু- চরদের বসিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে। রাজ্যের কোন প্রত্যন্ত-দেশে বিক্ষোভের বীজ অঙ্কুরিত হবার উপক্রম হলেই, সে সুচারুরূপে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু মামাতো ভাইটিকে বিষপ্রয়োগে মণিকর্ণিকার ঘাটের দিকে পাঠিয়ে দেবার হিম্মৎ তার হয়নি। বিষের নয়, সাহসের অভাবে। পুরন্দর জানে, প্রজাবৃন্দ তাকে সাময়িক উপদ্রব বলে মনে করে মাত্র। প্রজাবিদ্রোহের একটা সূচনাও হয়েছিল, অত্যন্ত কঠোর হস্তে সে অভ্যুত্থান দমন করেছে। প্রাক্তন সেনাপতি বজ্রধর সপরিবারে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। বর্তমানে সে শাহাবাদ জেলায় রোহিতাশ্ব দুর্গের দুর্গাধিপ। প্রাক্তন কাশীনরেশের লাঠিয়াল-সর্দার ঈশান কৈবর্তও পালিয়ে যায়। কিছুদিন কাশীরাজ্যের ভিতরেই ডাকাতি করত। ইদানীং তার সাড়া- শব্দ নেই; সম্ভবত পিতৃভূমি বঙ্গাল-মুলুকেই ফিরে গেছে।

বিদ্রোহদমনের পরে পুরন্দর চলে গিয়েছিল এলাহাবাদ। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির একটা জঙ্গী ছাউনি সেখানে গড়ে উঠবার উপক্রম করছে। কোম্পানির মূল ঘাঁটি শহর-মাদ্রাজ আর শহর-কলকাতা। আগের জমানায় মাদ্রাজের রবরবাই ছিল বেশী। পলাশী-যুদ্ধের পর জাঁকিয়ে উঠেছে শহর-কলকাতা।

পলাশী-যুদ্ধে পরাজয়ের পর সিরাজের মর্মান্তিক মৃত্যু। তারপর নবাবী পেয়েছিল বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর আলি খাঁ। বছরতিনেকের জন্য। কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণের জন্য প্রজাসাধারণের উপর নির্মমভাবে অত্যাচার করতে থাকে মীরজাফর। ইতিমধ্যে ক্লাইভ ফিরে গেল বিলাতে। কিন্তু মীরজাফর ইংরেজের অর্থদাবি মিটাতে পারল না। ফলে ষাটের দশক শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বাসঘাতকের নবাবীও ফুরালো। জাফর খাঁকে হটিয়ে ইংরাজ বাঙলার নবাবী গদিতে বসিয়ে দিল তারই জামাইকে—মীরকাশিমকে। মীরজাফর-তনয়া ফতেমাকে বিবাহ করেছিল সে। পূজ্যপাদ শ্বশুরমশাইকে যখন ইংরাজ-কোম্পানির কাউন্সিলাররা ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিল তখন মীরকাশিম এগিয়ে এল প্রচুর অর্থদানের প্রতিশ্রুতিসহ। কিন্তু বঙ্গদেশের ততদিনে নাভিশ্বাস উঠেছে। দীর্ঘ দিনের বর্গীর-হাঙ্গামা, ইংরাজের অত্যাচার, মীরজাফরের অপশাসন—মীরকাশিম ব্যর্থ না হবে কেন? তবে জামাই ঠিক শ্বশুরের মতো ছিল না—মনে মনে তার তাল ছিল সুবিধামতো ইংরাজকে সমূলে উৎপাটন করবে। তাই প্রথম পদক্ষেপ মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে রাজধানী স্থানান্তর করা—সেটা ইংরেজের ফোর্ট উইলিয়াম থেকে কিছু বেশী দূরে। পরের ধাপে মীরকাশিম আর একটা কাজ করে বসল যাতে বেনিয়া ইংরাজ প্রমাদ গণল। তাদের এতদিনের একচেটিয়া বিনা শুল্কে বাণিজ্য অধিকার মীরকাশিম অর্পণ করল প্রতিযোগী বিদেশী ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলিকেও। ফলে বিরোধ বেধে গেল। 1763 খ্রীষ্টাব্দে—অর্থাৎ আমাদের কাহিনীর কালের পূর্ব দশকে নবাবের সৈন্যদলের সঙ্গে ইংরাজের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ হল—প্রথমে উধুয়ানালায়, পরে ঘেরিয়ায়। পরের বছর মারা গেল মীরকাশিম।

রঙ্গমঞ্চে এবার আর্বিভূত হল দিল্লীর বাদশাহ শাহ্ আলম আর অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা।

ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কাউন্সিলাররা কিন্তু ফিরিয়ে আনল আবার মীরজাফরকেই। তখন তার বয়স সত্তরের উপর। মাত্র দুটি বছর নবাবী করে মাটি নিল সেই বিশ্বাসঘাতক 5.2.1765 তারিখে।

তার তিন মাস পরে ক্লাইভ ফিরে এল বিলাত থেকে।

মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভ—ততদিনে সে লর্ড ক্লাইভ—শহর কলকাতায় এসে পৌঁছাল তেশরা মে। তার দুদিন পরেই কাউন্সিলের জরুরী মিটিং ডাকল।

মীরজাফর, মীরকাশিম দুজনেই ফৌত হয়েছে—ক্লাইভের ইচ্ছা ছিল এবার বাঙলার গদীতে বসিয়ে দেবে সিরাজউদ্দৌলা-হত্যার নায়ক এবং মীরজাফর-তনয় মীরণের শিশুপুত্র মীর সৈইদকে। কারণ ক্লাইভ ততদিনে বুঝে নিয়েছে যে, কোম্পানি তাকে দ্বিতীয়বার গভর্নর করে দেবে। ঐ শিশুপুত্রকে শিখণ্ডী করে বস্তুত ক্লাইভ নিজেই হয়ে বসবে বাঙলার হর্তাকর্তা। নবাব না হলেও সুবেদার। কিন্তু তার মনের সাধে বাদ সাধল তদানীন্তন গভর্নর আর তার কাউন্সিলাররা। তারা প্রস্তাব করল বাঙলার মসনদে বসানো হবে ঢাকার ফৌজদার মহম্মদ রেজা খাঁকে। ক্লাইভের প্রথমটা প্রবল আপত্তি ছিল, কিন্তু সতেরো বছরের ঐ মেদামারা হাঁদা-গঙ্গারাম রেজা খাঁকে দেখে ক্লাইভ আশ্বস্ত হল। এই ছোকরা-নবাবকে দিয়ে কাজ চলবে—বিশেষ, ঐ কিশোর বিশ লাখ টাকার নজরানা কাউন্সিলারদের দিতে প্রস্তুত।

ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হচ্ছে এজন্য যে, আমাদের কাহিনীর চরিত্র পুরন্দর ক্ষেত্রী ঐ স্রোতে গা ভাসাতে চেয়েছিল। একই ঢঙে, একই ছাঁদে। এবার সে-কথাই বলব।

পূর্ব-প্রান্তে যাবতীয় সুবন্দোবস্ত করে—লর্ড ক্লাইভ এল ‘ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের’ মহড়া নিতে। দিল্লীর নখদন্তহীন শাহ-য়েন-শাহ শাহ্আলম আর অযোধ্যানবার সুজাউদৌল্লা ভিতর ন্যায়বিচার- সম্মতভাবে পিঠাবণ্টন করে দিতে।

প্রাচীন নথিপত্র হাতড়ে দেখবেন—স্থান : কাশীধাম; কাল : 1.8.1765 এবং পাত্র : লর্ড ক্লাইভ। তখনো কাশীনরেশ বলবন্ত সিং জীবিত। ইংরাজ সেপাই-পল্টন ক্লাইভকে রাজকীয় সম্মান জানালো উনিশবার তোপধ্বনি করে। খোদায়-মালুম প্রটোকলের কোন্ ধারা মোতাবেক রাজকীয় সম্বর্ধনায় তোপধ্বনি এক কুড়ি পূরণ হল না! সে যাই হোক, ক্লাইভ দিল্লীশ্বর আর অযোধ্যা-নবাব সুজাউদ্দৌলার সঙ্গে কনফারেন্সে বসল। বাহাত্তর ঘণ্টা! ব্যস্! খতম্! এতবড় একটা মহাযজ্ঞের ফয়শালা হয়ে গেল মাত্তর তিনটি দিনে। বাদশা শাহ্ আলম এবং সুজাউদ্দৌলা বোধকরি বুঝতে পেরেছিল এই বানরের পিঠাভাগ দীর্ঘায়ত করলে আহার্য-পাত্রের অবস্থা হবে—’পিপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে’!

সুজাউদ্দৌলা আর শাহ্ আলম দুজনেই ইংরাজের বিরুদ্ধে মীরকাশিমকে মদৎ জুগিয়েছিল! ফলে, আলোচনা-সভায় তাদের ভূমিকা ছিল পরাজিতের। যা পেল—’যথালাভ’ বলে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

সুজাউদ্দৌলা ফেরত পেল প্রায় তার গোটা রাজত্বটাই। দুটি জেলা বাদে—এলাহাবাদ আর কোরা। সে দুটি শাহ্ আলমের খাশে রাখা হল। কাশীরাজ বলবন্ত সিং কনফারেন্স-কক্ষের আনাচ-কানাচে তিনদিন ধরেই ঘুরঘুর করছেন। জেনারেল কারন্যাককে যথেষ্ট পরিমাণ তৈলাক্ত করেও রেখেছিলেন। বস্তুত কারন্যাকের সুপারিশেই কাশীনরেশের স্বাধীনতা অটুট থাকল। কাশীরাজ্য সুজাউদ্দৌলার অধীনে রাখা হল না।

সে সময় পুরন্দরও ছিল মামার পাশে পাশে। কী ভাবে গদী লাভ করা যায় তা স্বচক্ষে দেখেছিল। তাই কাশীনরেশ বলবন্ত সিং-এর দেহান্ত হবার পর সে দরবার করতে গিয়েছিল এলাহাবাদে। সেটা 1772 খ্রীষ্টাব্দে। ততদিনে ক্লাইভ ফিরে গেছে কলকাতায়। এলাহাবাদের ফৌজি ছাউনির দায়িত্ব মেজর কিপ্যাট্রিকের। তাকেই মুরুব্বি পাকড়াও করে পুরন্দর চেষ্টা করেছিল কাশীর গদীটা পাকাপাকি হাতাতে। কিলপ্যাট্রিক প্রথমে সম্মত হয়েছিল। উৎকোচের অঙ্কটা দরদস্তুর করে স্থির হবার পূর্বেই হঠাৎ বেঁকে বসল কিলপ্যাট্রিক।

কারণ ছিল। ইতিমধ্যে বিলাত থেকে কাউন্সিলারদের উপর হুকুম এসে গেছে যে, কোম্পানির কোন কর্মচারী কাউন্সিলারদের লিখিত সম্মতি ব্যতিরেকে “এদেশের রাজারাজড়া নবাব-বাদশা আমীর-ওমরা কারো কাছ থেকে চার হাজার টাকার বেশি দামের উপহার, জমি জিরাৎ, জায়গির, খাজনাজমা ইত্যাদি নিতে পারবে না, আর ঐ মর্মে তাদের প্রত্যেককেই দু’-প্রস্থ করে মুচলেকা সই করে দিতে হবে। তার একটা থাকবে কাউন্সিলের দপ্তরে, আর একটা চলে যাবে লন্ডনে, ডিরেক্টরদের অফিসে।”

শুনে পুরন্দর বলেছিল, তাহলে উপায়?

মেজর কিলপ্যাট্রিক হেসে বলেছিল, চুটিয়ে রাজত্ব তো করেই চলেছ পুরন্দর, মাথায় ঐ মুকুটটা নাই বা চড়ালে?

পুরন্দর মুকুটহীন মাথাটা নেড়ে বলেছিল, তা হয় না! মুকুটটা আমার চাইই। আমি যদি তোমাকে মাসে-মাসে তিন হাজার ন’শ নিরানব্বই করে জমা দিতে থাকি? তাহলে কত বছর পরে তুমি ব্যবস্থা করতে পারবে?

কিলপ্যাট্রিক বলেছিল, হিসাবটা পরে করা যাবে। তুমি মাস-মাস পাঠাতে থাক তো! ফাঁদে পড়ে গেছিল পুরন্দর। এ কী ঝামেলা! কবে সিংহাসন পাবে তার কোনও স্থিরতা নেই, মাস-মাস কিস্তি দিয়ে চল? লোকটা ফৌজি জোয়ান! বেমক্কা ফৌত হয়ে গেলে? আবার কিস্তির টাকা না পাঠালেও কিলপ্যাট্রিক চটে যাবে! ইংরাজের দয়া না হলে সে যুগে নবাবী বা রাজত্ব করা চলত না।

কী আতান্তরিতেই পড়েছে পুরন্দর! মেজাজ তার খাপ্পা হয়ে থাকবে এতে বিচিত্র কী? সপ্তাহখানেক আগে একদল টুলো-পণ্ডিত রাজদরবারে এসে অভিযোগ জানিয়ে গিয়েছিল মহামহোপাধ্যায় দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের বিরুদ্ধে। দ্বারকেশ্বর কাশীধামের সর্বাগ্রগণ্য পণ্ডিতদের অন্যতম। অশীতিপর বৃদ্ধ। এককালে নব্যন্যায় চর্চা করতেন। ইদানীং আর নিজে চতুষ্পাঠী পরিচালনা করেন না। তাঁর অনেকগুলি শিষ্য—প্রশিষ্য। তারাই চতুষ্পাঠীর ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। উনি নিজে সাধন-ভজন নিয়ে আছেন। প্রায় সন্ন্যাসী। আজন্ম ব্রহ্মচারী। তাঁরই গুরুগৃহে পালিতা হচ্ছিল ঐ মেয়েটি। শোনা যায়—বঙ্গভূমের, কুলীন ব্রাহ্মণবংশের বালবিধবা! সে যে কী করে এই সুদূর কাশীধামে এসে উপনীত হয়েছিল, কেমন করে ঐ মহাপণ্ডিতের স্নেহধন্যা হয়ে ওঠে, সেটা ইতিহাসের এক অনুদ্ঘাটিত অধ্যায়। এতদিন কাশীর নব্যপণ্ডিতেরা এ বিষয়ে নজর করেনি। কেউ ভ্রুক্ষেপও করেনি। কিন্তু অবস্থা ঘোরালো হয়ে উঠল কয়েক বছর পরেই।

অপরাধ সেই মেয়েটিরই : অনন্যসাধারণ মেধাবিনী সে! একে একে উত্তীর্ণ হয়ে গেল নানান পরীক্ষায়—ব্যাকরণ, স্মৃতি, কাব্য—শেষমেশ নব্যন্যায়! সহাধ্যায়ী পুরুষ প্রতিযোগীদের অনেক পিছনে ফেলে। সব শেষে মহামহোপাধ্যায় দ্বারকেশ্বর তাকে উপাধি দান করে বসলেন : বিদ্যালঙ্কার!

এটা বাড়াবাড়ি!

হতে পারে মেয়েটি মেধাবী। তাই বলে অমন সম্মানজনক উপাধি—স্ত্রীলোককে! এমন অঘটন আগে কখনো ঘটেছে? যা হোক, তাতেও কোন প্রতিবাদ ওঠেনি। বুড়ো পণ্ডিতের খেয়াল—ওটা নজর না করলেই হল।

কিন্তু দেখা গেল সেই আরবী উটের গল্পটি পুনরভিনীত হতে চলেছে। প্রথমে নাক, পরে গলা, ক্রমে সারা দেহ—শেষমেশ আশ্রয়দাতাকেই বিতাড়ন করে গোটা তাঁবুর অধিকার। হটী বিদ্যালঙ্কার বিদ্যার্ণবের পরিত্যক্ত চতুষ্পাঠীর একান্তে নিজেই একটি টোল খুলে বসেছেন। আশ্চর্য! বিদ্যার্থীদের ভিড় দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। জগমোহন তর্কবাগীশ প্রমুখ নব্যপণ্ডিতদের মনে হল—এটা শুধু আপত্তিকর নয়, অপমানজনক! কাশীর বিদ্যাচর্চার দীর্ঘদিনের ইতিহাসে এটা অভূতপূর্ব। যার উপনয়ন হয়নি, অর্কফলায় ভারতীয় সংস্কৃতির বিজয়-বৈজয়ন্তী উড্ডীন করার হিম্মৎ যার নেই—সেই অর্বাচীন কোন সাহসে টোল খুলে বসে! দ্বিতীয় আপত্তি, হটী বিদ্যালঙ্কার অসম প্রতিযোগিতার সুযোগ নিচ্ছেন। অন্যান্য টোল থেকে কেন যে তরুণ ছাত্রের দল ঐ চতুষ্পাঠীতে ছুটে আসছে এ কথা বুঝতে হলে দিগ্‌গজ পণ্ডিত হবার দরকার নেই। চতুষ্পাঠী তো নয়—লীলাকুঞ্জ! ছাত্ররা কেন যে মুগ্ধ হয়ে পড়া শোনে, তা কে না বোঝে! বয়সটাই যে মুগ্ধ হবার। জনশ্রুতি হুটী বিদ্যালঙ্কারের চতুষ্পাঠীতে সর্বাপেক্ষা আবশ্যিক বস্তুটিই অনুপস্থিত : বেত্রদণ্ড! কী দরকার? ঈশ্বরদত্ত বিলোলকটাক্ষ যার অধিকারে, তার ছাত্ররা অমনোযোগী হবে কেন?

জগমোহন পণ্ডিতের দল এসে প্রথমে দরবার করেছিল বিদ্যার্ণবের কাছে: কাশীর নব্যপণ্ডিতসমাজ এ জাতীয় অনাচার বরদাস্ত করবে না!

দ্বারকেশ্বর ধৈর্য ধরে ওদের বক্তব্য শুনলেন। অর্থগ্রহণ হল না। প্রশ্ন করেন, এটাকে ‘অনাচার’ বলছ কেন?

—কাশীধামে কোনও স্ত্রীলোক কখনো কোনও চতুষ্পাঠী পরিচালনা করেনি।

—মানছি। কাশীধামে আজকের প্রভাতটিও ইতিপূর্বে আসেনি!

—আজ্ঞে?

—বাপু হে! যা কখনো হয়নি তা কখনো হবে না—এটা তোমাদের কেমন যুক্তি? ঐ যুক্তিতে ‘ম্লেচ্ছান্ মূর্ছয়তে’ দশম অবতার এলে তোমরা তাঁকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? -আমরা সে কথা বলছি না। বলছি, স্ত্রীলোকের ধর্ম ভিন্ন প্রকার। বেদপাঠের অধিকার তার নাই!

—আমি সে মত স্বীকার করি না!

—শূদ্র এবং স্ত্রীলোকের যে বেদপাঠের অধিকার নাই—এই ধ্রুবসত্যকে আপনি স্বীকার করেন না?

বিদ্যার্ণব বললেন, দেখ বাবাসকল! আমার একার মতামতে তো কিছু হবে না। তোমরা বরং একটি বিচার সভার আয়োজন কর। স্ত্রীজাতির বেদাধ্যয়ন, বেদাধ্যাপনের অধিকার ব্রাহ্মণ্যধর্মে স্বীকৃত কি না সেটাই হবে বিচার্য বিষয়। তোমরা তোমাদের ভিতর থেকে পাঁচজন প্রতিনিধিকে নির্বাচন কর। তর্কযুদ্ধে আমার পালিতকন্যাটিকে পরাস্ত কর। তার পর কাশীর পণ্ডিতসমাজ যথাকর্তব্য করবেন।

নব্যপণ্ডিতের দল সানন্দে স্বীকৃত হল। বললে, তাহলে আপনিই হবেন সে সভার বিচারক। দৃঢ়স্বরে প্রতিবাদ করেন বিদ্যার্ণব, না। তা হবে না। যেহেতু এ বিষয়ে আমি স্থিরসিদ্ধান্ত। আমার বিচার একদেশদর্শী হয়ে যাবে। ও বিষয়ে স্থিরসিদ্ধান্ত না হলে আমি আমার পালিতা কন্যাটিকে চতুষ্পাঠীতে গ্রহণ করতাম না। তাকে বেদাভ্যাস করতে দিতাম না। তোমরা বরং কাশীধামের তিনজন সর্বাগ্রগণ্য মহামহোপাধ্যায়কে সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ কর।

অগত্যা তাই। স্থির হল, প্রধান বিচারপতির আসন অলঙ্কৃত করবেন মহাপণ্ডিত রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন। বিদ্যার্ণবের অনুরোধে তিনি স্বীকৃতি হলেন এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে।

রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন কাশীর পণ্ডিত সমাজের এক প্রখ্যাত নৈয়ায়িক। আদি নিবাস হুগলীর ইলছোবা গ্রামে। বাঁশবেড়িয়া বিদ্যাসমাজের ভট্টাচার্য বংশীয় এই মহাপণ্ডিত আকৈশোর কাশীবাসী। প্রসঙ্গত বলি, আমাদের আখ্যায়িকার যে সময়কাল তার সতের বছর পরে, 1791 খ্রীষ্টাব্দে কাশীতে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিরাশী বৎসর বয়সে তখন ঐ রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন সেখানে ন্যায়ের প্রথম অধ্যাপকরূপে নিযুক্ত হন। আর তার পরের বাইশ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে অধ্যাপনা করে এই অসাধারণ পণ্ডিত যখন অবসর গ্রহণ করেন তখন তাঁর বয়স : একশ তিন! তখন তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ! তবু নিষ্কৃতি পাননি। অবসর গ্রহণের পরেও অনেক জ্ঞানপিপাসু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসত। অন্ধ পণ্ডিতের স্মৃতি-মঞ্জুষায় থরে থরে সাজানো জ্ঞানের মাধ্যমে তারা তাদের ‘অনুপপত্তি’ নিরাকরণ করে যেত!

আমাদের কাহিনীর কালে তাঁর বয়স চৌষট্টি। তাঁর দুই সহকারী বিচারক—শ্রীজীব ন্যায়াধীশ এবং শ্রীরতনলাল ব্রহ্মচারী।

প্রথমে স্থির হয়েছিল বিচার সভার আয়োজন করা হবে দুর্গাবাড়িতে। দুর্গাবাড়ি তখন যুবতী—মাত্র উনিশ বছর বয়স তার। নাটোরের পুণ্যশ্লোক রানী ভবানী নির্মিত এ মন্দিরের পোড়ামাটির মূর্তিগুলি তখন ঝকঝক্-তক্তক্ করছে। কিন্তু পরে স্থান পরিবর্তন করতে হল। বিপুল জনসমাগমের আশঙ্কায়। আলোচনা হবে বিশুদ্ধ সংস্কৃতে—যা শ্রোতৃবৃন্দের বৃকোদরভাগের কাছে অর্থহীন। তা হোক—বিচার্যবিষয়টি অতি অদ্ভুত। তার চেয়ে বড় কথা—প্রতিযোগীদের এক তরফে পাঁচজন নব্যপণ্ডিত, অন্যদিকে এক যুবতী! এ যে অবিশ্বাস্য! কাশীর অতিবৃদ্ধ নাগরিকেরাও স্মরণ করতে পারলেন না—কোন বিচারসভায় স্ত্রীলোক প্রতিযোগীরূপে আবিভূর্তা!

স্থির হল, দুর্গাকুণ্ডের অনতিদূরে ‘কুরুক্ষেত্র তালাও’-এর মুক্তমণ্ডপে এই বিচারসভার আয়োজন করা হবে। এই তালাওটিও রাণী ভবানীর কীর্তি।

নব্যপণ্ডিতেরা দলে ভারি। তারা মোটামুটি নিশ্চিন্ত। বারোহাত কাপড়ে যে হতভাগিনী কাছা দিতে শেখেনি—দেবার চেষ্টা করছে এখন—তাকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করা তো ছেলেখেলা! দ্বারকেশ্বর নেহাৎ স্নেহে অন্ধ। সংসারধর্ম করেননি, শেষবয়সে পালিতা কন্যার পিতা হয়েছেন—তাই ওকে ‘বিদ্যালঙ্কার’ উপাধি দিয়ে বসে আছেন!

মেয়েটির বিরুদ্ধে শুধু টুলো পণ্ডিতেরা নন, আরও একদল সোচ্চার। বারাণসীধামের কিছু বিচক্ষণ কবিরাজ়। যাঁরা চতুষ্পাঠী আদৌ পরিচালনা করেন না—দেহধারী মানুষের আধি-ব্যাধিই যাঁদের উপার্জনের রাজপথ। ঐ দুর্বিনীতা নাকি তাঁদেরও যারপরনাই অপমান করেছে। মেয়েটির দাবী—কাশীধামে আগমনের পূর্বেই সে নাকি চরক, সুশ্রুত, নিদান আয়ত্ত করে বসে আছে। দেবমূর্তির পিছনে চালচিত্রের মতো অনৃতভাষণের পশ্চাতে একটা বিশ্বাসযোগ্যতার আচ্ছাদন প্রয়োজন। তাও ও মেয়েটি জানে না। হিসাব মতো সে কাশীতে এসে পৌঁচেছে পঁচিশ বছর বয়সে। তার পূর্বে সেই এরণ্ডের-দেশ বঙ্গভূমে কে ঐ যুবতীকে চরক, সুশ্রুত শিখিয়েছে? আর কী আকাশচুম্বী স্পর্ধা! সে আর্তের সেবা করতে চায়! শিকড়, বাকড়, ঘাস-পাতা, জড়িবুটি খাইয়ে। যদি বলতিস্—ডাকিনীবিদ্যা জানি, তাহলেও না হয় মেনে নেওয়া যেত! আয়ুর্বেদশাস্ত্র যে বিজ্ঞানসম্মত! দীর্ঘদিন ভেষগাচার্যের পদতলে বসে শিক্ষা না করলে তাতে অধিকার জন্মায় না। বয়ঃপ্রাপ্তি হওয়ার পূর্বে সে বিদ্যা শিক্ষা করা যায় না। এমন কি যেসব হতভাগ্যের জন্য অন্তর্জলিযাত্রার নিদান হেঁকেছেন কাশীর সর্বাগ্রগণ্য কবিরাজেরা—ও তাদেরও দায়িত্ব নিতে চায়! অপিচ তাদের দু-চারজনকে নিরাময় করে সে গঙ্গাতীর থেকে সংসারাশ্রমে ফেরত পাঠিয়েছে! দুর্বিনীতা এই সহজ কথাটাও জানে না—অন্তর্জলি যাত্রা থেকে প্রত্যাবর্তন শাস্ত্রে নিষিদ্ধ! তাছাড়া এর অর্থ কী? একটাই অর্থ—প্রতিষ্ঠাবান ভেষগাচার্যদের বেইজ্জত করা! অপমান করা! নয় কি?

সভার একপ্রান্তে একটি উঁচু বেদী। সেখানে তিন বিচারকের অজিনাসন। তার দক্ষিণে পঞ্চ নব্যপণ্ডিতের আসন। বামে একটিমাত্র আসন, প্রতিবাদীর। বেদীর দক্ষিণপার্শ্বে আর একটি পৃথক বেদীর উপর রত্নখচিত সিংহাসন। সেটি কাশীনরেশের জন্য চিহ্নিত। যেহেতু কাশীনরেশ বলবন্ত সিং লোকান্তরিত, তাঁর উত্তরাধিকারী নাবালক—তাই ঐ সিংহাসনের উপর আনুষ্ঠানিকভাবে রাখা আছে কাশীরাজের রাজদণ্ডটি। সম্মুখে দর্শকদের আসন। ‘শ্রোতৃবৃন্দ’ শব্দটি, সুপ্রযুক্ত হবে না—কারণ আলোচনা হবে বিশুদ্ধ সংস্কৃতে। দূর-দূরান্ত থেকে যারা এসেছে, তারা শুনতে আসেনি, এসেছে তামাশা দেখতে। তামাশা বইকি! স্ত্রীলোক, অথচ পুরুষের বেশ! অবগুণ্ঠন নাই, অর্কফলা! সে সমানতালে তর্ক করতে চায় পুরুষের সঙ্গে। তামাশা নয়?

বামপ্রান্তে চিকন মাদুরের একটি চিকের আড়াল। এটি মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট। এটিও অভূতপূর্ব! কাশীর কোনও বিচারসভায় ঐ চিকের ব্যবস্থা কখনো হয়নি। যাত্রার আসরে তা থাকে; কীর্তন, রামলীলা বা কবিগানের ব্যবস্থা হলে চিকের আড়াল থাকে। কিন্তু বিচার সভায় চিকের আড়াল! এ তো নপুংসকের বিবাহে ছাদনাতলার ছাউনি! এ তো অহৈতুকী! মহিলা তো কেউ আসবে না!

হটী বিদ্যালঙ্কার সে যুক্তিটি মেনে নিতে পারেননি। বলে পাঠিয়েছিলেন—কেউ আসুক, না আসুক ঐ ব্যবস্থা থাকা চাই!

স্ত্রীলোকের জিদ্দিবাজি! ঠিক আছে, মা!

বিচারারম্ভের পূর্বেই সভামণ্ডল পরিপূর্ণ। হটী বিদ্যালঙ্কার সভায় এলেন—না, পালকি চেপে নয়, পদব্রজে। অনেকটা পথ হেঁটে। আশ্রম থেকে এই মণ্ডপের দূরত্ব প্রায় এক ক্রোশ! মুণ্ডিত মস্তক। দীর্ঘ শিখাপ্রান্তে একটি শ্বেতকরবী পুষ্প অনুবিদ্ধ। পরিধানে পট্টবস্ত্র—শাড়ি নয়, ধুতি। পুরুষের মতো কাছা-কোঁচা দিয়ে পরা। নগ্নপদ। ঊর্ধ্বাঙ্গে ঢিলে-ঢালা পিরান, তদুপরি নামাবলী। কর্ণাভরণ নাই, দু’হাতে নাই কোনও অলঙ্কার, শুধু প্রতিযোগীদের উপবীতের পরিপূরক কণ্ঠে রুদ্রাক্ষের মালা।

একাকী নন। দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের গুরুকুলভুক্ত অনেকেই পদব্ৰজে তাঁর সঙ্গে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে এসেছেন। সর্বাগ্রে আসছিলেন প্রধান আচার্য স্বয়ং। অশীতিপর বৃদ্ধ—কিন্তু বয়সের ভারে নুয়ে পড়েননি। তাঁরও মস্তক মুণ্ডিত, দীর্ঘ অকফলা। ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ, শুধু সামবেদী দীর্ঘ যজ্ঞোপবীত। পাশে পাশে আসছে রমারঞ্জন ভট্টশালী—হটী বিদ্যালঙ্কারের সহাধ্যায়ী। একটি তালপাতার ছত্র বৃদ্ধের মাথার উপর ধরে। সভায় বিচারকদল ইতিপূর্বেই এসেছেন। প্রতিপক্ষরা উপস্থিত। দর্শকের আসনগুলিও পূর্ণ। দূর থেকে শোভাযাত্রাটিকে আসতে দেখেই একটা কলগুঞ্জন উঠল : এসে গেছেন। এসে গেছেন।

কোথাও কিছু নেই, ঘেরাটোপ চিকের আড়াল থেকে বেজে উঠল মঙ্গলশঙ্খ। সকলেই হতচকিত। এমনটি তো হবার কথা ছিল না!

হটী বিদ্যালঙ্কার তাঁর গুরুর কর্ণমূলে কী যেন অনুমতি প্রার্থনা করলেন মনে হল। বৃদ্ধ শিরশ্চালনে সম্মতি জানালেন। পদপ্রক্ষালনান্তে তিনি দর্শকদলের প্রথম সারিতে তাঁর চিহ্নিত আসনে উপবেশন করলেন। আজ তিনি শ্রোতামাত্র।

ততক্ষণে হটী বিদ্যালঙ্কার একাকী অগ্রসর হয়ে গেলেন ঐ ঘেরাটোপের দিকে। তাঁর সহযাত্রীরা, যারা এতক্ষণ শোভাযাত্রা করে আসছিল—তারা একে একে দর্শক-সভায় আসন গ্রহণ করল।

বিদ্যালঙ্কারের দুরন্ত কৌতূহল হয়েছিল—শঙ্খধ্বনি করল কে? তাঁর ধারণা ছিল ঐ অংশটা জনশূন্য পড়ে থাকবে। এ শুধু নারীর সম-অধিকারের দাবীতে; জেনে বুঝে যে, বিচারসভায় কোন স্ত্রীলোক উপস্থিত থাকবে না। সভায় উপস্থিত হয়েই টের পেলেন, তাঁর ধারণাটা ভ্রান্ত!

হটী পর্দা সরিয়ে ভিতরে এলেন।

দেখলেন মাত্র দুইজন মহিলা বসে আছেন।

দুজনেই উঠে এসে ওঁর চরণবন্দনা করলেন। একজনকে সহজেই চিনতে পারলেন—স্বর্গত কাশীনরেশের বিধবা। রাজরানী—কিন্তু নিরাভরণা। দ্বিতীয়াও তাই। সম্পূর্ণ নিরাভরণা, ফেনশুভ্র থান তাঁর পরিধানে। অপূর্ব সুন্দরী। কণ্ঠে একটা স্ফটিকের মালা।

বিদ্যালঙ্কার রানীকে বললেন, আপনি যে এ সভায় আসতে পারবেন তা ভাবতে পারিনি। কিন্তু ইনি—?

রানী বললেন, ইনি তারাসুন্দরী। ঘটনাচক্রে উনি এখন কাশীধামে। আমি তো কিছুই বুঝব না, উনি হয়তো কিছু কিছু বুঝবেন।

তারাসুন্দরী সলজ্জে বলেন, না, না, আমার সংস্কৃতজ্ঞান অতি অল্প। আজ যদি মা কাশীতে থাকতেন……

—মা?—বিদ্যালঙ্কার জানতে চান।

রানী-মা বলেন, আপনি ওঁকে চিনতে পারেননি। উনি নাটোরের স্বনামধন্যা রানী ভবানী—যাঁর দেবোত্তর ভূখণ্ডে এই বিচারসভার আয়োজন হয়েছে—তাঁরই একমাত্র কন্যা।

বিদ্যালঙ্কার যুক্তকরে বলেন, আপনার জননী তো প্রাতঃস্মরণীয়া! আপনি এ সভায় এসে আমাকে কৃতার্থ করেছেন।

যুক্তকরে কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে তারাসুন্দরী প্রতিবাদ করেন, এ আপনি কী বলছেন! আপনি নারীমুক্তির প্রথম ধ্বজাধারিণী! এ তো আমাদের কর্তব্য!

এই তাহলে সেই তারাসুন্দরী—ভাবেন বিদ্যালঙ্কার—রানী ভবানীর আত্মজা। বালবিধবা। অসাধারণ রূপবতী—তা তো স্বচক্ষেই দেখছেন। যাঁর সৌন্দর্যে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বাঙলার সেই শেষ নবাব তারাহরণের চক্রান্ত করেছিল। ঐ অনিন্দ্যকান্তির রূপই হচ্ছে পরোক্ষ কারণ, যে জন্য পুণ্যশ্লোক নাটোরের রানী ভবানী পলাশী-প্রান্তরে সিরাজপক্ষে যোগ দিতে পারেননি।

ইতিহাস যুগে যুগে একই কাহিনী লিখে চলেছে। পুনরুত্তি দোষের দিকে ভূক্ষেপ নেই তার—লঙ্কেশ্বর রাবণ—আলাউদ্দিন খিলজী—মুর্শিদাবাদের সিরাজ!

ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলেন সভামণ্ডপে। বিচারবেদীতে পদার্পণের পূর্বে মুণ্ডিত মস্তকটি সেই মৃত্তিকা বেদিকায় স্পর্শ করালেন। বিচারক ও সমাগত পণ্ডিতদের সমবেত প্রণাম জানিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন তাঁর নির্দিষ্ট আসনে। উপবেশন করলেন ধ্যানস্থ যোগীর ভঙ্গিতে—সমংকায়শিরোগ্রীব।

ক্ষত্রিয়ের বেশে চিত্রাঙ্গদা যুদ্ধ করেছিলেন অর্জুনের সঙ্গে। ব্রাহ্মণের বেশে বিদ্যালঙ্কার আজ যুদ্ধ করতে এসেছেন পঞ্চপণ্ডিতের সঙ্গে। বেশভূষায় যদিচ নারীত্বের বাষ্পমাত্র নাই, তবু ত্রিংশতিবর্ষীয়ার প্রকৃতিদত্ত প্রভায় বিচারসভাটি যেন প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

প্রধান বিচারক মহাপণ্ডিত রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন তাঁর কৌতূহলটি গোপন করতে পারলেন না। বললেন, এ তোমার কী বেশ, মা?

—যে প্রতর্কের সমাধান সন্ধানে আপনাদের দ্বারে উপস্থিত হয়েছি এ তারই উপযুক্ত সাজ, বাবা!

নামিয়ে রাখলেন বিচারকদের পদপ্রান্তে ভূর্জপত্রে রচিত তাঁর স্বীকৃতি-প্রতিজ্ঞা। সংস্কৃতে, দেবনাগরী হরফে :

নিম্নস্বাক্ষরকারী, আদি নিবাস সোঞাই বর্ধমানভুক্তি, গৌড়দেশ, পিতা রূপেন্দ্রনাথ ভেষগাচার্য, বর্তমানে মহামহোপাধ্যায় দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের গুরুকুলভুক্তা বিদ্যাৰ্থী, এই মত কড়ার করিলাম বিচার মানিলাম, তাহাতে পাতসাহী শুভ শ্রীমন্ মহারাজ কাশীনরেশের অনুজ্ঞাক্রমে দলিল লিখিয়া দিলাম। অদ্য বিচারসভায় স্ত্রীজাতীয়ার অধ্যাপন ও বেদাধ্যয়ন সংক্রান্ত যে সিদ্ধান্ত হইবে তাহা মানিতে বাধ্য থাকিব।

প্রতিপক্ষ পঞ্চপণ্ডিতের তরফে জগমোহন তর্কবাগীশ তাঁদের প্রতিজ্ঞাপত্রটি এবার পেশ করলেন। সেটি পাঠান্তে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন হটী বিদ্যালঙ্কার। বললেন, না, এই শর্তে আমি বর্তমান বিচারসভায় অংশগ্রহণ করিতে আসিনি। হটী বিদ্যালঙ্কারের এই কাশীধামে চতুষ্পাঠী পরিচালনার অধিকার আছে কি নাই, এ প্রশ্ন বিচারসভার এক্তিয়ার-বহির্ভূত, বাহুল্য ও প্ৰক্ষিপ্ত

জগমোহন মৃদু হেসে বলেন, আমাদের তো ধারণা ছিল, সেটাই এই বিতর্কসভার আলোচ্য।

—তাহলে বলব, আপনারা ভ্রান্ত ধারণার বশীভূত। মহামহোপাধ্যায় দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের চতুষ্পাঠীভুক্তা জনৈকা বিদ্যার্থীকে কাশীর পণ্ডিতসমাজ বিদ্যালঙ্কার উপাধি প্রদান করেছেন; তাঁকে চতুষ্পাঠী পরিচালনের অনুমতিও দান করা হয়েছে। কাশীনরেশের অনুপস্থিতিতে রাজগুরুর অনুমতিক্রমে রাজমাতা সে আদেশে পাতসাহী ছাপও দিয়েছেন। এক্ষেত্রে বর্তমান বিচারসভায় পূর্বপক্ষীয় প্রতিযোগীদের সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশের কোন অধিকার নাই! আমার বিশ্বাস ছিল, আজিকার বিচারসভার বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক—নারীর অধ্যাপনা ও বেদাধ্যয়নের অধিকার আছে বা নাই। এটুকুই বিচারসভার এক্তিয়ারভুক্ত। আমি মাননীয় বিচারকমণ্ডলীর নির্দেশপ্ৰাৰ্থী।

বিচারকত্রয়ী নিম্নকণ্ঠে আলোচনা করে বিদ্যালঙ্কারের মতটিই স্বীকার করে নিলেন। দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের গুরুকুল যাঁকে চতুষ্পাঠী পরিচালনার অধিকার দিয়েছেন, রাজমাতা যা অনুমোদন করেছেন সেইসব প্রসঙ্গে সন্দেহ প্রকাশ করার কোনও অধিকার পঞ্চ নব্যপণ্ডিতের নাই। তাঁরা নির্দেশ দিলেন, পূর্বপক্ষকে নূতনভাবে প্রতিজ্ঞাপত্র লিখে দিতে হবে।

জগমোহন ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলে, কী লিখতে হবে বলুন?

বিদ্যালঙ্কার বলেন, আপনাদের এই মর্মে স্বীকৃতিপত্র দিতে হবে যে, তর্কে পরাজিত হলে ভবিষ্যতে কোনও মহিলা-পণ্ডিতকে কোনভাবেই বাধা দেবেন না।

তর্কবাগীশ রুখে ওঠে, তা কী করে সম্ভব? ভবিষ্যতে যে মহিলা ঐ জাতের ধৃষ্টতা দেখাবেন, তাঁর শিক্ষা বা জ্ঞান কতদূর তা আমাদের বিচার করে দেখতে হবে না!

—না! নিশ্চয় নয়! সে বিষয়টি বিচার করে দেখবেন যে গুরুকুল তাঁকে অধ্যাপন-অধিকার প্রদান করছেন, দেখবেন কাশীনরেশ সে সিদ্ধান্তে পাতসাহীছাপ দেওয়ার পূর্বে। আপনাদের কী অধিকার? কে দিয়েছে সেই দায়িত্ব?

এবারও বিচারকত্রয়ী বিদ্যালঙ্কারের মতই স্বীকার করলেন। পঞ্চপণ্ডিতকে সেই মর্মে প্রতিজ্ঞাপত্র লিখে দিতে হল।

শুরু হল বিচার।

যুক্তি-তর্ক, প্রতিতর্ক, বিপ্রতীপতর্ক, উদ্ধৃতি, অনুজ্ঞা, নির্দেশ। জগমোহন এবং তাঁর সহযোগীরা স্তূপাকারে সাজিয়ে রেখেছেন নানান পুঁথি। যখন যা প্রয়োজন যেন হাতের কাছে পাওয়া যায়।

তালিকা মিলিয়ে ক্রমে ক্রমে যুক্তিগুলি পেশ করতে থাকেন। নানান পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, স্ত্রীজাতীয়াকে হিন্দুধর্ম বেদপাঠের অধিকার দেয়নি, বস্তুত তার দেবার্চনা, দেবপূজার অধিকার নাই। শুধু স্বামীসেবা :

গুরুরগ্নিদ্বিজাতীনাং বর্ণানাং ব্রাহ্মণো গুরুঃ।
পতিরেকো গুরুঃ স্ত্রীণাং সর্বত্রাভ্যাগতো গুরুঃ।।

অর্থাৎ দ্বিজগণের গুরু হচ্ছেন অগ্নি, ব্রাহ্মণ সকল বর্ণেরই গুরু, অতিথি গৃহস্থের গুরু আর স্বামী স্ত্রীলোকের পরম গুরু।

বিদ্যালঙ্কার বললেন, এটি কোনও প্রামাণ্য শাস্ত্রবাক্যরূপে চিহ্নিত করা যায় না। সম্ভবত এটি একটি উদ্ভট শ্লোক। কিন্তু পূর্বপক্ষ যখন সেটিকেই যুক্তি হিসাবে দাখিল করেছেন তখন তারই বিচার করি : অগ্নি নির্বাপিত হলে অরণি কাষ্ঠের সাহায্যে তাকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়। অতিথির অভাব কোন গৃহস্থকেই কখনো সহ্য করতে হয় না, বিশেষ করে আমাদের মতো দরিদ্র দেশে। মন্ত্রটি যখন ব্রাহ্মণ-রচিত তখন ব্রাহ্মণদেরই সকলের গুরু হিসাবে দেখানো স্বাভাবিক। কিন্তু স্বামী? কোথায় তার পরিপূরক? এই ব্রাহ্মণ্যধর্মে? পতিব্রতা সাধ্বী বিধবা হয়ে পড়লে তখন সে গুরু কোথায় পাবে? তখন সে যদি স্বাবলম্বী হতে চায়—নিজের এবং সন্তানের অন্নবস্ত্রের প্রয়োজন মেটাতে—তখন তাকে উপার্জনক্ষম হতেই হয়। সেই বিধবা যদি বিদুষী হন, তাহলে তাঁকে চতুষ্পাঠী পরিচালনাই বা করতে দেওয়া যাবে না কেন? অন্যথায় সে কীভাবে তার এবং তার সন্তানের ভরণপোষণ করবে? তার স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করবে?

তর্কবাগীশ বললেন, করবে না। স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যর এই ধারণাটা অর্বাচীন, প্রাচীন শাস্ত্রে তার কোনও স্বীকৃতি নেই। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে স্পষ্ট নির্দেশ আছে :

পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।[১]

[১. কুমারীকালে নারীকে রক্ষা করবেন পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্ররা। নারীর স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্য বলে কিছু নাই [৫/১-২]।]

বিদ্যালঙ্কার বললেন, বশিষ্ঠের এই ধর্মসূত্রটি সাধারণ সূত্র। আর্য ঋষিরা যাযাবরবৃত্তি ত্যাগ করে যখন কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থা গ্রহণ করছেন, মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার গোষ্ঠী ও কৌম যখন পিতৃতান্ত্রিক ‘কুল’ ও ‘প্রবর’-এর জন্ম দিচ্ছে তখন এই নীতি সাধারণভাবে গ্রাহ্য হয়েছিল।

সূতিকাগৃহে যে কন্যা পিতৃহীন হয়ে যাচ্ছে, যৌবনপ্রাপ্তির পূর্বেই যে বিধবা হয়ে যাচ্ছে, তার প্রতি যে এই সাধারণ সূত্র প্রযোজ্য নয় এ-কথা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।

—আপনি কি তাহলে সেই ব্যতিক্রমক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের অধিকার প্রার্থনা করছেন?

—নিশ্চয় নয়। শৈশবে পিতৃহীন, কৈশোরে বিধবা না হলে স্ত্রীলোক বিদ্যাচর্চা করতে পারবে না এ-কথা আমি বলছি না। আমি সাধারণভাবেই বলতে চাই—’ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্য্যমইতি’ বিধানটি ক্ষেত্রবিশেষে প্রযোজ্য হলেও সর্বত্র স্বীকার্য নয়।

—কিন্তু ভারতীয় শাস্ত্রে সর্বত্র এই নির্দেশই আছে যে, স্ত্রী সর্বদা স্বামীর অনুগামিনী হবেন শতপথ ব্রাহ্মণ বলছেন, “স্ত্রীয়ঃ পুংযোহনুবর্তানো ভাবুকাঃ”[১]। বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলছেন, “পতিং বা অনুজায়া”[২]।

বিদ্যালঙ্কার সহাস্যে বললেন, আপনি শতপথ ব্রাহ্মণ ও উপনিষদের উদ্ধৃতি শুনিয়েছেন। তার প্রত্যুত্তরে আমি ঋগ্বেদের উদ্ধৃতি দিই। ঋগ্বেদের ঋষি বলছেন, “ঊষো যাতি স্বসরস্য পত্নীত। অর্থাৎ পতি-সূর্য পত্নী-ঊষার অনুগমন করেন। এবার আপনিই বলুন—কোন নির্দেশটি মানবেন? বৈদিক নির্দেশ অথবা পরবর্তী যুগের রচনা?

—ঋগ্বেদের ঋষি ওখানে কবিত্ব করেছেন মাত্র!

—কিন্তু তথ্যটা প্রাকৃতিক। সূর্যপত্নী ঊষা কোনদিন সূর্যের অনুগমন করেন না!

তর্কবাগীশ বলেন, মনে হচ্ছে আমরা সামাজিক বিধান এবং তত্ত্বকথা ছেড়ে কাব্য নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছি। আমাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে প্রত্যাবর্তন করি : ব্রাহ্মণ্যধর্মে স্ত্রীলোক বেদমন্ত্র পাঠ করতে পারত না। স্বামী যজ্ঞ করলে সে শুধু উপস্থিত থাকত, কোন মন্ত্রোচ্চারণ করার অধিকার তার ছিল না—“ন স্ত্রী জুহুয়াৎ”[৪]। বৈদিক যজ্ঞের পূর্বার্ধ স্বয়ং যজমান, উত্তরার্ধ তার পত্নী; কিন্তু পত্নী শুধু তার স্বামীর পাশে বসে থাকার অধিকার লাভ করত। শতপথ ব্রাহ্মণের স্পষ্ট নির্দেশ—”পূর্বার্ধো বৈ যঞ্জস্যাধযুদ্ধজঘনার্থং পত্নী”[৫]।

—জানি। সে জন্য শ্রীরামচন্দ্র স্বর্ণসীতাকে বামে বসিয়ে যজ্ঞ সম্পাদন করতে চেয়েছিলেন। তাতে কী প্রমাণ হয়?

—প্রমাণ হয় “অস্বতন্ত্রা ধর্মে স্ত্রী”[৬] সন্তান উৎপাদন, স্বামীসেবা, এবং গৃহকর্ম ব্যতীত সামান্য টু’ একটি বৃত্তি কুলনারীর অধিকারভুক্ত বলে শতপথব্রাহ্মণে উল্লেখ আছে, যথা—পশম পাকানো, বোনা, সূতা-কাটা বা রেশমের গুটি বানানো। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ তো বহু দূরের কথা, বৈদিকমন্ত্র তাঁদের শোনাও পাপ। বোধকরি যজমানের বামপার্শ্বে উপবিষ্টা তদীয় পত্নীর কর্ণমূলে কার্পাসখণ্ড প্রবিষ্ট করার বিধান ছিল, কারণ : “স্ত্রীশূদ্রদ্বিজবন্ধনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা”[৭] এটিকে আপনি নিশ্চয় অর্বাচীন শ্লোক বলবেন না, কারণ এ শ্লোক যখন রচিত হয়েছিল তখন ‘অথর্ববেদ’ পর্যন্ত অনুপস্থিত। তাই ‘ত্রয়ী’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ ‘ঋক্, সাম ও যজুঃ বেদই তখন উপস্থিত।

[১. নারীর কর্তব্য পুরুষের অনুগামিনী হওয়া [১৩/২/২৪]।
২. স্ত্রী স্বামীর পশ্চাতে অনুগমন করবে [১/১/২/১৪]।
৩. ঊষা সূর্যদেবের আগে আগে যান [ ১/১১৫/২]।
৪. নারী হোম করতে পারবে না [অবাস্তব ধর্মসূত্র ২/৭/১৫/১৭]।
৫. যজমান পূর্বার্ধ, তদীয় পত্নী যজ্ঞের উত্তরার্ধ [শ· ব্রা· ১/৯/১/২, ৫/২/১-১০]।
৬. ধর্মচারণে নারীর কোন স্বাতন্ত্র্য নেই, ভূমিকা নেই [গৌতম ধর্মসূত্র, ১৮/১]।
৭. স্ত্রীলোক, শূদ্র এবং ব্রাহ্মণদের বন্ধুস্থানীয় ক্ষত্রিয়-বৈশ্য আদির পক্ষে তিন বেদের মন্ত্র শোনাও পাপ।]

বিদ্যালঙ্কার বললেন, এটিও কোনও বৈদিক সূক্ত নয়। মনে হয় ঐ শ্লোকটি খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে রচিত, কারণ সেই সময়েই সূত্রসাহিত্য সংকলিত হয়। যে কোন হেতুতেই হোক সূত্ররচনাকার অথর্ববেদকে পরিত্যাগ করেছেন। সে যাই হোক, আলোচ্য শ্লোকে বক্ষ্যমান তিনটি দৃষ্টিকোণ—স্ত্রীলোক, শূদ্র এবং ক্ষত্রিয়-বৈশ্য। সম্ভবত এ শ্লোক মহাকাব্য যুগের পূর্বে রচিত—না হলে শম্বুক উপাখ্যানে বাল্মীকি শ্রীরামচন্দ্রের চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করতেন না…

সভায় একটা অস্ফুট গুঞ্জন শ্রুত হল।

বিদ্যালঙ্কার তৎক্ষণাৎ সংযত হলেন। যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করিয়ে বলেন, আমি কোনভাবেই শ্রীরামচন্দ্রের পূত চরিত্রে অথবা আদি কবির রচনার সমালোচনা করতে চাইছি না! ারা তৎকালীন সামাজিক নির্দেশে পরিচালিত হয়েছিলেন মাত্র। কিন্তু অপর দুইটি দৃষ্টিকোণ {ম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ আছে। উপনিষদের যুগে “ক্ষত্রিয়কুলোদ্ভব নরপতিরা অনেকেই আত্মজ্ঞানের উপদেষ্টা ছিলেন; ব্রাহ্মণ সন্তানেরা তাঁহাদের সমীপে শিষ্যত্ব স্বীকার করিয়া তদ্বিষয়ে উপদিষ্ট হইতেন। ছান্দোগ্যোপনিষদে স্পষ্টই লিখিত আছে, প্রবাহন রাজা গৌতম ঋষিকে কহিতেছেন—

যথেয়ন্ন প্রাকৃত্বত্তঃ পুরা বিদ্যা ব্রাহ্মণান্
গচ্ছতি তস্মাদুসর্বেষু লোকেষু ক্ষত্রস্যৈব
প্রশাসনমভূদিমি।”—ছান্দোগ্য। ৫।৩।৭। [১]

[১. উদ্ধৃতিটি অক্ষয়কুমার দত্ত বিরচিত ‘ ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’(করুণা প্রকাশনী, ১৩৯৪, পৃঃ ১১১) থেকে। বিদ্যালঙ্কার এ ভাষায় কথা বলছেন তা লেখকের কল্পনা—কিন্তু তথ্যটা যে কাল্পনিক নয় এটা বোঝাতে ঐ উদ্ধৃতি। শ্লোকের অর্থ : “তোমার পূর্বে ব্রাহ্মণদের এই বিদ্যায় অধিকার ছিল না। অতএব সর্বত্র ক্ষত্রিয়জাতিরই ইহা উপদেশ দেবার অধিকার ছিল।”]

অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের সমান্তরালে আদি যুগে ক্ষত্রিয় নৃপতিরাও ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করতেন। ব্রাহ্মণরা তাঁদের শিষ্যত্বও গ্রহণ করেছেন। যেমন বিশ্বামিত্র মুনি, যেমন কাশীমহিষী মদালসা।

তৃতীয় দৃষ্টিকোণ : নারীজাতি।

সে সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করার পূর্বে আমি পূর্বপক্ষকে একটি প্রতিপ্রশ্ন পেশ করছি : ‘উপাধ্যায়া’ এবং ‘উপাধ্যায়িনী’ শব্দদ্বয়ের পার্থক্য কী?

তর্কবাগীশ কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে বলেন, মতভেদে কিছু যোগরূঢ় অর্থভেদ হতে পারে, মূলত শব্দ দুটি সমার্থক। তার অর্থ: অধ্যাপকের সহধর্মিণী।

হাসলেন হটী বিদ্যালঙ্কার। বললেন, বিশ্বাস করা কঠিন, এমন দুইটি বহুলব্যবহৃত শব্দের অর্থ পূর্বপক্ষীয় পণ্ডিতদের জানা নাই। ঐ শব্দ দুটি আদৌ সমার্থক নয়। পাণিনির সুস্পষ্ট নির্দেশে ‘উপাধ্যায়িনী’ শব্দের অর্থ উপাধ্যায়ের স্ত্রী; এবং ‘উপাধ্যায়া’ শব্দের একটিমাত্র অর্থ—’স্ত্রী-জাতীয়া অধ্যাপক’ বা অধ্যাপিকা। আমি সভাস্থ পণ্ডিতমণ্ডলীকে সম্বোধন করে প্রশ্ন রাখছি—এখানে এমন কোন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত কি আছেন, যিনি আমার সঙ্গে একমত নন? অর্থাৎ ‘উপাধ্যায়া’ শব্দের অন্য কোনও যোগরূঢ় ব্যবহার যিনি লক্ষ্য করেছেন? থাকলে, তিনি অনুগ্রহ করে আমার ভ্রান্তি অপনোদন করুন।

সভাস্থলে মৃদু গুঞ্জনই শুধু উঠল। হটী বিদ্যালঙ্কারের সঙ্গে তাঁরা যে একমত তা বোঝা গেল।

বিদ্যালঙ্কার পুনরায় বলতে থাকেন, ঐ শব্দটির অস্তিত্বই প্রমাণ করে—ব্যবহারিক প্রয়োজনে শব্দটির সৃষ্টি হয়েছিল। স্ত্রীজাতীয়া অধ্যাপকের অস্তিত্ব না থাকলে তার অর্থবোধক ঐ শব্দটি আদৌ সৃষ্টি হত না। এবার আমার প্রশ্ন—বৃহদারণ্যক উপনিষদের যাজ্ঞবল্ক-গার্গী উপাখ্যান :

মিথিলাধিপতি জনক একবার এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছেন। দেশ-দেশান্তর থেকে দক্ষিণার লোভে সমবেত হয়েছেন বহু বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ। শাস্ত্রালোচনা শ্রবণমানসে ঐ সঙ্গে সমবেত হয়েছেন অনেকানেক নির্লোভ ব্রহ্মজ্ঞও। মহারাজ সভাস্থলে নিয়ে এলেন এক সহস্ৰ গাভী। শুধু তাই নয়, প্রত্যেকটি গাভীর প্রতিটি শৃঙ্গে দশাদ পরিমাণ সুবর্ণ-অলংকার! ধরুন প্রতিটি তিন তোলা ওজনের। সমবেত পণ্ডিতদের সম্বোধন করে রাজা জনক ঘোষণা করলেন, ‘আপনাদের মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ্ তিনি অনুগ্রহ করে অগ্রসর হয়ে আসুন, এই গাভীকুল তাঁর প্রাপ্য।’ স্বভাববিনয়ী ব্রাহ্মণেরা অধোবদনে নিস্তব্ধ হয়ে বসেই রইলেন। গোধনে তাঁদের যথেষ্টই লোভ। কিন্তু লোভের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে সঙ্কোচ ও আতঙ্ক। শুধু আর্যাবর্তের নয়, হিমবর্ত থেকেও একান্তচারী সাধকবৃন্দও সমাগত—কোন আক্কেলে উঠে দাঁড়ান? ওঁরা যদি সমবেতভাবে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তখন?

সভাস্থ ব্রাহ্মণদের অধোবদন দেখে উঠে দাঁড়ালেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। বিশ্বামিত্রের বংশধর, ঋষি যজ্ঞবল্ক বা চারায়ণের তনয়। মহামুনি তিনি। বাজসনেয়ী সংহিতা, শতপথব্রাহ্মণ ও বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ এঁরই রচনা। তিনি শিষ্যদের ডেকে বললেন, বাবাসকল! এই গাভীকুলকে আমার আশ্রম অভিমুখে পরিচালিত কর।

স্তম্ভিত হয়ে গেল সভাস্থ সকলে!

এবার গাত্রোত্থান করলেন জনকরাজের কুলপুরোহিত অশ্বল। বললেন, ঋষিবর যাজ্ঞবল্ক্য আপনি কি বলতে চান যে, এই আর্যাবর্তের ভিতর আপনিই শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মিষ্ঠ?

যাজ্ঞবল্ক্য করজোড়ে নিবেদন করেন, ব্রহ্মিষ্ঠের শ্রীচরণে শতকোটি নমস্কার! শ্রেষ্ঠ ব্ৰহ্মবিদ হিসাবে আমি অগ্রসর হয়ে আসিনি; বাস্তবে আমার কিছু গোধনের প্রয়োজন। তদ্ভিন্ন লক্ষ্য করে দেখলাম, সমবেত সকলেই নীরব। তাই অনুমান হল—আমি কিছু অস্পষ্ট দেখি বটে, কিন্তু সমবেত সকলে সম্ভবত ছুছুন্দরপ্রতিম দৃষ্টিহীন!

অশ্বল বলেন, ক্ষান্ত হোন ঋষিবর! প্রথমে প্রমাণ করুন—আপনিই শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মিষ্ঠ। আমাদের সবাইকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করুন। প্রথমে আমিই প্রশ্ন রাখি:

একের পর একজন পর্যায়ক্রমে প্রশ্ন করতে থাকেন। যাজ্ঞবল্ক্য প্রত্যেকটি প্রশ্নের যথাযথ সদুত্তর দান করে যান। প্রথমে অশ্বল। ‘অশ্বল-যাজ্ঞবল্ক্য-সংবাদ’ বৃহদারণ্যকোপনিষদের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তারপর এলেন জরৎকারু-বংশীয় আর্তভাগ ঋষি। তৎপর ভৃত্যুঋষি অতঃপর চাক্রায়ণ উষস্ত, উষস্তের পরে কৌষীতকেয় কহোল। প্রত্যেকের উত্থাপিত প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর বা সমাধান দিলেন যাজ্ঞবল্ক্য।

সর্বশেষে উঠে দাঁড়ালেন মহাপণ্ডিতা গার্গী।

এই খণ্ড-কাহিনীর শেষ প্রশ্নকর্ত্রী সেই মহিলাটি।

বচক্রতনয়া ব্রহ্মবাদিনী। তাঁর প্রশ্নগুলিই হল সর্বাপেক্ষা জটিল, সর্বোচ্চস্তরের ব্রহ্মজিজ্ঞাসা। উপনিষদকার যে পর্যায়ক্রমে প্রশ্নকর্তাদের সাজিয়েছেন তার সর্বশেষে গার্গীকে স্থান দেবার একটাই অর্থ। পরিচিত রচনাশৈলী! দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরসভায় অর্জুন অথবা জানকীর বিবাহসভায় শ্রীরামচন্দ্র যে কারণে সবার শেষে উপস্থাপিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ সেদিন জনকসভায় উপস্থিত ব্রহ্মবিদ্‌গণের মধ্যে উত্তরদাতা যাজ্ঞবল্ক্য ব্যতিরেকে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবাদিনী ছিলেন ঐ বচক্রতনয়া গার্গী! বস্তুত তাঁর শেষ প্রশ্নটির প্রত্যুত্তর দিতে অশক্ত হয়ে যাজ্ঞবল্ক্য বলে উঠেছিলেন, “গার্গী মাতিপ্রাক্ষীমা তে মূৰ্ধবা ব্যপপ্তৎ।” [১]

[১ গার্গি! আর বেশী প্রশ্ন কর না, তোমার মাথা খসে পড়বে [বৃ-আ-উ-৩/৬/১]।]

বলা বাহুল্য, এই সতর্কবাণীর মধ্যে পরাজয় স্বীকারের একটি অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা অনস্বীকার্য! প্রকাশ্যে নারীর কাছে পরাজয় স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয়ে তিনি তির্যকপথে গার্গীকে অনুরোধ করছেন, ঐ জাতীয় অস্বস্তিকর প্রশ্ন করা থেকে বিরত হতে।

ভুললে চলবে না, বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ স্বয়ং যাজ্ঞবল্ক্যের রচনা। লেখক অনায়াসে ঐ কথোপকথন অনুক্ত রাখতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা রাখেননি। লেখকের নিজস্ব ত্রুটির এই অকুণ্ঠ স্বীকৃতি ভারতীয় সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত—ঠিক যেভাবে অকুণ্ঠভাষায় কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু-বিদুরের জন্মরহস্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। সত্যাশ্রয়ী যাজ্ঞবল্ক্য তাই ঐ অনবদ্য শ্লোকটিও রচনা করেছেন—গার্গী, তুমি প্রশ্নসীমা অতিক্রমণে ‘অতিপ্রশ্নের’ নিষিদ্ধ রাজ্যে প্রবেশ করতে চলেছ। ক্ষান্ত হও!

গার্গী সে সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে পুনরায় বললেন, ঋষিবর! এবার আমার শেষ প্রশ্ন : বলুন—এই যে দ্যুলোক, তার উপরে কী বর্তমান? এই যে ভূলোক, এর অতলেই বা কী আছে?

যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, তার নাম : সূত্রাত্মা! সূত্রের মতো এই তিন ভুবন গ্রথিত। সেই সূত্রটির অভিধা : ব্ৰহ্ম!

অতঃপর গার্গী সমবেত পণ্ডিতমণ্ডলী এবং জনকরাজকে সম্বোধন করে বললেন, আপনারা যাজ্ঞবল্ক্যকে নমস্কার করুন। বিদ্যায় আর ব্রহ্মজ্ঞানে তাঁর সমকক্ষ এই ভূভারতে আর কেউ নাই!

সমগ্র রাজসভা এই শেষ নিদান এক কথায় মেনে নিলেন।

দীর্ঘ কাহিনীটি বিদ্যালঙ্কারকে বিবৃত করতে হয়নি। বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ বিচারসভায় উপস্থিত পণ্ডিতমণ্ডলীর কাছে সুপরিচিত। তাই ইঙ্গিত দিয়েই তিনি প্রশ্ন রাখলেন, এবার আপনারা বলুন, সেই ব্রহ্মবাদিনী গার্গী—উপনিষদ্‌কার যাঁকে সাহিত্যরচনার শৈলীমাধ্যমে ইঙ্গিতে বলেছেন—যাজ্ঞবল্ক্য-ব্যতিরেকে তিনিই ছিলেন সর্বাগ্রগণ্যা, একমাত্র যিনি যাজ্ঞবল্ক্যক পরীক্ষা করে দেখার মতো জ্ঞানের অধিকারিণী, যাঁর ঘোষণা সমগ্র পণ্ডিতসমাজ নতমস্তকে শেষবিচার বলে স্বীকার করে নিলেন—তিনি বৈদিকমন্ত্র উচ্চারণের সময় কী বলতেন? ‘ওঁ’ এর পরিবর্তে ‘নমঃ’?

পঞ্চপণ্ডিতের মধ্যে একজন বলে ওঠেন, গার্গী এক দুর্লভ ব্যতিক্রম।

—সে ক্ষেত্রে মৈত্রেয়ী? ঐ যাজ্ঞবল্ক্যের সহধর্মিণী? যিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘যেনাহ নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম?’[১] অথবা এই কাশীধামের পৌরাণিক মহারাজা অলকের জননী, মদালসা? অলককে ব্রহ্মবিদ্যা লাভের জন্য গুরুর আশ্রমে যেতে হয়নি, রাজান্তঃপুরে তত্ত্বদর্শিনী জননীর কাছে তা পেয়েছিলেন। কেমন করে? বাল্মীকির শিষ্যা আত্রেয়ী ছিলেন পণ্ডিতা—বিদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিণী শ্রীকৃষ্ণকে কী করে স্বহস্তে গোপনপত্র লিখে পাঠান, যদি তাঁর অক্ষর-পরিচয় না হয়ে থাকে? উভয়ভারতী কোন অধিকারে আচার্য শঙ্কর এবং মণ্ডন মিশ্রের বিচারসভায় বিচারকরূপে নির্বাচিতা হন?

[১. যা (যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তরাধিকারিণী হিসাবে পার্থিব ধনসম্পদ) পেলে আমি ‘অমৃত’লাভ করব না, তা নিয়ে কী করব?]

তর্কবাগীশ বললেন, আপনি উত্তেজিতা হবেন না! চিন্তা করে দেখুন, যুগযুগান্তরের ঐতিহ্যময় ব্রাহ্মণ্যধর্ম থেকে এ পর্যন্ত চার-পাঁচটি উদাহরণ আপনি পেশ করেছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে এই কয়েক সহস্রাব্দে কয়েক লক্ষ পুরুষ শাস্ত্রজ্ঞ এসেছেন এবং গেছেন। ফলে ঐ মুষ্টিমেয় কয়েকজনকেই সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে ব্যতিক্রম বলা চলে।

বিদ্যালঙ্কার বলেন, না। চার-পাঁচটি মাত্র নয়। ঋগ্বেদের সূত্রকারদের ভিতর অন্যূন সাতাশজন মহিলার নাম পাওয়া যায়। গার্গী প্রণীত ঋগ্বেদের টীকা আজও প্রামাণ্য। ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের অন্তর্গত অষ্টবিংশতি সুক্তটি আদ্যন্ত রচনা করেছিলেন বিশ্ববারা-নাম্নী একজন অত্রি বংশীয়া মহাপণ্ডিতা। এছাড়া সংখ্যাতত্ত্ব-বিচার ওভাবে করা যায় না। সংখ্যাতত্ত্বর বিচার তখনই গ্রাহ্য যখন দুটি তুলনীয় বিশেষ্যপদ একই পরিমণ্ডলে অবস্থিত। বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানলাভের বাতাবরণ যদি পুরুষ ও স্ত্রীর পক্ষে তুল্যমূল্য থাকত, তাহলেই আপনার ঐ কয়েক লক্ষ এবং মুষ্টিমেয় সংখ্যা দুটির বিচার গ্রাহ্য হত। দুর্ভাগ্যক্রমে দুটি বিচার্য বিষয়ের বাতাবরণ দুই রকম ছিল। সমস্যাটির গভীরে প্রবেশ করুন, তার ধারাবাহিকতাটি বিচার করুন। তাহলেই প্ৰণিধান করবেন কেন বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে নারী সংখ্যালঘিষ্ঠ।

অতঃপর বিদ্যালঙ্কার তত্ত্বটির দীর্ঘ বিশ্লেষণে ব্রতী হলেন :

মনুর বিধান শাশ্বতকালের হতে পারে না। প্রত্যেকটি মনুর শাসনকালের অবসানে, অর্থাৎ প্রতিবার মন্বন্তরে কালকশাঘাতে সে বিধান জরাজীর্ণ হয়ে যায়, পরিবর্তনযোগ্য হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে বৈদিক অনুশাসন অনাদ্যন্তকালের। তিনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন—বৈদিকযুগের আদিম পর্যায়ে পুরুষের মতো ব্রহ্মবিদ্যার্থিনীদের ব্রহ্মচর্য পালন করতে হত। শিক্ষণীয় বিষয়ের তারতম্য অনুসারে ছাত্রীদের সে-কালে দুইটি প্রধান ধারায় বিভক্ত করা হত। যাঁরা আজীবন দর্শন ও ঈশ্বরতত্ত্বের আলোচনায় নিরত থাকার সঙ্কল্প করতেন, তাঁদের বলা হত : “ব্রহ্মবাদিনী’। তাঁদের পক্ষে আশ্রমিক, চিরকুমারী বা বিগতভর্তা হবার কোনও আবশ্যিক শর্ত ছিল না। অনেকেই সীমন্তিনী, ব্রহ্মচারিণী নন। সংসারধর্ম পালনের অবকাশে তাঁরা যোগসাধনা করতে পারতেন। রাজবৈভব যেমন রাজর্ষি জনকের সাধনমার্গে অন্তরায় সৃষ্টি করেনি তেমনি কাশীরাজ মহিষী মদালসাও স্বামী-সংসার পুত্র-কলত্র দাসদাসী পরিবেষ্টিতা হয়েও রাজান্তঃপুরে ব্রহ্মবিদ্যার অধিকারিণী হতে পেয়েছিলেন।

স্মর্তব্য—আদিমতম যুগে যাযাবরধর্মী পশুচারী আর্যরা যখন প্রথম উত্তরভারতে আসেন তার আগেই সেখানে ছিল কৃষিজীবী নগরসভ্যতার একটি অপূর্ব নিদর্শন : ‘সিন্ধুসভ্যতা’। তারা ছিল ব্রোঞ্জযুগের মানুষ—বলদে-টানা ব্রোঞ্জধাতুর লাঙ্গল ছিল তাদের অধিকারে, লৌহ-নির্মিত অস্ত্রধারী অশ্ববাহিত রথী তারা চিনত না। হয়তো লৌহ-নির্মিত তরবারি অথবা ভল্লই ছিল ইন্দ্রের বজ্র, যা নির্মাণ করেছিলেন দধীচি নামের কোনও অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণ—হাপরে ফুঁ পাড়তে পাড়তে যাঁর পাঁজরা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। প্রাগার্য সভ্যতার বীরদল—মহেন্ জো-দড়ো-হড়াপ্পার প্রতিরোধকারীরা তাদের ব্রোঞ্জনির্মিত অস্ত্র দিয়ে সে লৌহ-বজ্রকে প্রতিহত করতে পারেনি। তা সে যাই হোক, পঞ্চনদের উর্বর ভূখণ্ডে কুঠারধারী পরশুরাম হলেন হলধারী বলরাম। কাঠুরিয়া যাযাবর বৃত্তির মানুষ হল কৃষিজীবী। স্থায়ী হবার পরই এল জমি অধিকারের প্রশ্ন এবং তার অনিবার্য ফলশ্রুতি জমির উত্তরাধিকারের প্রশ্ন। যাযাবরধর্মীর গোষ্ঠী[১] ও কৌম[২] ভেঙে গড়ে উঠতে থাকে শস্যক্ষেত্র-ভিত্তিক কুল[৩] ও পরিবার[৪]—ক্রমে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থা রূপান্তরিত হল পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়। দেখা দিল দুটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ—’ভৃত্য আর ‘ভার্যা’! দুটিই এক ‘ধাতুতে গড়া = Vভৃ+য! অর্থাৎ ভরণীয় যাকে খাওয়া পরা দিয়ে কাজ করাতে হয়। এমনকি ‘ভৃত্য’ শব্দের দুটি অর্থ—(১) দাসবর্গ, (২) “অবশ্যভরণীয়পুত্রদারাদি বর্গ”[৫]। কী কাজ? ভৃত্য করে শস্য উৎপাদন, গৃহস্বামীর সুখস্বাছন্দ্যবিধানে নানান শ্রমের কাজ; ভার্যাও তা করে, উপরন্তু করে সন্তান উৎপাদন। দুজনের কর্মক্ষেত্রে একাংশে আছে মিল—উভয়েরই অবশ্য-কর্তব্য গৃহস্বামীর পদসেবা

এই যে পুং-জাতির সেবক ‘ভৃত্য’ এবং ‘ভার্যা, এরা ভরণীয় তো বুঝলাম, কিন্তু কীভাবে তাদের ভরণপোষণ করতে হবে? যাতে প্রথমজন কৃষিক্ষেত্রে শস্য এবং দ্বিতীয়া সংসার-ক্ষেত্রে পুত্রসন্তান উৎপন্ন করতে পারে? শাস্ত্রে কী কোনও নির্দেশ নাই? আছে। বৎস! অবধান কর : ভৃত্যকে প্রদান করবে ব্যবহৃত পোশাক, যা জীর্ণ হয়ে এসেছে এবং ভার্যাকে দেবে—”ভুক্তেবাচ্ছিষ্টংবধৈব দদাৎ”[৬]।

[১. গোষ্ঠী = tribe, ২. কৌম = clan, ৩. কুল = sect, ৪. পরিবার = family, ৫. মনুসংহিতা ১১/১২। ৬. আহারান্তে যা খেতে পারলে না সেই ভুক্তাবশিষ্ট সমেত এঁটো পাতাখানা স্ত্রীকে ধরে দেবে [গৃহ্যসূত্র ১/৪/১১]।]

এই যখন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে যাচ্ছে তখন যে ‘ব্রহ্মবাদিনী’ শিক্ষার্থী অপ্রতুল হয়ে আসবে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তখনো ছিল আর এক জাতির স্ত্রীশিক্ষার ব্যবস্থা—ঐ মানসিকতা থেকে—শুধু জান্তব ক্ষুন্নিবৃত্তিতেই মানুষ তৃপ্ত হতে পারে না। তাই আদিমযুগে বালিকা,,কিশোরী এমনকি যুবতীদেরও কিছু কিছু শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। তারা ব্রহ্মবাদিনী হত না অন্তিমে—ব্রহ্মাস্বাদের বাসনা তাদের থাক না থাক, অভিভাবককুল চেয়েছিলেন তাদের অক্ষর পরিচয় দিতে। কিছুটা ব্যাকরণ, অলঙ্কার, কাব্য। সচরাচর প্রাগবিবাহকালেই এই বিদ্যাচর্চার আয়োজন হত বটে তবু প্রথম যুগে বিবাহিতা ও বিগতভর্তা অবস্থাতেও কেউ কেউ এ জাতীয় বিদ্যার্জনের সুযোগ পেতেন। তাঁদের বলে : ‘সদ্যোদ্বাহা”।

বৈদিকযুগে স্বামীস্ত্রী যে একত্রে যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতেন তার প্রমাণ রয়ে গেছে ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের একশত একত্রিশতম সূক্তে। “বি ত্বা ততস্রে মিথুনা অবস্যবো ব্রজস্য সাতা…” ইত্যাদি সূক্তে যজমান-দম্পতি যৌথভাগে অগ্নিকে আহুতি দিচ্ছেন (১/১৩১/৩)। পঞ্চম মণ্ডলের অষ্টবিংশতি সূক্তে অগ্নিদেবতাকে বলা হল, “সং জস্পত্যং সযমমা কৃণুম্ব” (তুমি আমাদের দাম্পত্য-সম্পর্ক সুশৃঙ্খলাবদ্ধ কর—৫/২৮/৩)। অর্থাৎ গার্হস্থ্যধর্ম পালন করেও নারী যজ্ঞ করতে পারতেন। এই মন্ত্রটির দেবতা : অগ্নি, ছন্দ : গায়ত্রী এবং ‘দ্রষ্টা’ বা রচয়িতা হচ্ছেন অত্রি-গোত্রজা বিশ্ববারা-নাম্নী—রমণী-ঋষি! শুধুমাত্র ঋগ্বেদেই পাচ্ছি একাধিক ‘মহিলা-দ্রষ্টা’—অগস্ত্যপত্নী লোপামুদ্রা (১/১৭৯), ঋষি অত্রির কন্যা অপালা (৮/৯৬), ঋষি কক্ষিবৎ-তনয়া ঘোষা (১/১৭৭/৭ এবং ১০/৩৯-৪০), ঋষি অম্ভৃণাত্মজা বাক্ (১০/১২৫) এবং ইন্দ্রের সহধর্মিণী ইন্দ্রাণী (১০/১৪৫)। সেকালে কুমারী কন্যার উপনয়ন হত, তাদের সাবিত্রীমন্ত্র জপ এবং অধ্যাপনের অধিকার স্বীকৃত (“পুরাকল্পে কুমারীণাং মৌঞ্জী বন্ধনমিষ্যতে/অধ্যাপনং চ বেদানাং সাবিত্রীবচনং তথা।।”—শব্দকল্পদ্রুম-মতে ‘মৌঞ্জী’ অর্থে ‘উপনয়ন’)। চিরকুমারী-সাধিকা ভ্রাতাদের সঙ্গে সমানভাগে পিতৃসম্পত্তির অধিকারিণীও হতেন (২/১৭/৭)।

কীভাবে আদিম বৈদিকযুগের স্ত্রীশিক্ষার ঐ দ্বিধারা—ব্রহ্মবাদিনী ও সদ্যোদ্বাহা—অবলুপ্ত হয়ে গেল তার একটি চুম্বকসার অতঃপর ব্যাখ্যা করে শোনালেন হটী বিদ্যালঙ্কার :

চতুর্বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণভাগ ছিল কর্মপ্রধান, আরণ্যক ও উপনিষদ্-অংশ জ্ঞানপ্রধান। মীমাংসকগণ আরও সূক্ষ্মভাবে বিচার করে শ্রুতিকে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করলেন: বিধি, নিষেধ, অর্থবাদ, মন্ত্র, নামধেয় এবং উপনিষদ। যা যজমানের প্রবৃত্তিকে যাগাদি বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে তাই হচ্ছে প্রথম শ্রুতিঃ বিধি। যা শ্রবণে চিত্তে নিবৃত্তির উদয় ঘটায় তা হল : নিষেধ। “দেবস্য ত্বা ইত্যাদির দ্বারা অনুষ্ঠেয় বিষয়ের স্মরণ হয় বলে তা মন্ত্ৰ”[১]। অর্থবাদ দুই প্রকার—প্রশংসা ও নিন্দা। “জ্যোতিষ্টোম—এই নামভাবনা করিবার জন্য নামধেয় এবং অবিদ্যানিরাসপূর্বক ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উপদেশ উপনিষদে আছে।”[২]

[১-২. এবং : ‘বাঙলার সংস্কৃত সমাজের এক বিস্মৃত অধ্যায়’, শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ, ‘দেশ’ পত্রিকা, 20 জুন, 1987।]

বৈদিকযুগে কর্মবাদের আদর্শ ছিল গার্হস্থ্যধর্ম। সস্ত্রীক আচরিতব্য। নিত্য যাগ-যজ্ঞাদির অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বামীস্ত্রী বৈদিক বিধিগুলি স্বীকার করে ধর্মচর্চা করতেন যৌথভাবে। তখনও ভার্যাকে ভুক্তাবশিষ্ট দিয়ে ‘ভরণীয়’ মনে করা হত না। যজমানের স্ত্রী তখনো তার সহধর্মিণী, ‘ভার্যা’ নয়! ধর্মসূত্র, গৃহ্যসূত্রের প্রথম পর্যায়ে এইসব স্বামীস্ত্রীর যুগলে আচরিতব্য গার্হস্থ্য ধর্মাচরণের প্রণালী বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল।

তার পরবর্তী কালে উপস্থিত হল দুটি অন্তরায়।

এক : বেদবিরোধী কর্মবাদের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব; দুই: শ্রুতিপথরোধী জ্ঞানবাদের ধ্বজাধারী জৈন তীর্থঙ্করের দল, তথা বর্ধমান মহাবীর ও প্রায় সমকালের চার্বাক প্রভৃতির লোকায়ত দর্শনের প্রভাব।

শ্রুতি তখন রূপান্তরিত হয়ে গেল স্মৃতিতে।

ব্রাহ্মণ্যধর্মে ক্রমে আবির্ভূত হল মনু প্রভৃতির রচিত ঊনবিংশতি সংহিতা।

মেধাতিথি, কুল্লুকভট্ট, ইত্যাদিরা রচনা করতে শুরু করলেন সংহিতার সটীক ব্যাখ্যা। স্মার্তপণ্ডিতেরা নানান বিধান জারী করতে শুরু করলেন। ইতিপূর্বে প্রতিটি সিদ্ধান্তের পূর্বে হিতাহিতের ব্যাখ্যা দেওয়া হত—ভাল কেন ভাল, মন্দ কেন পরিহার্য। এখন সে জাতের ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রবণতা লোপ পেল। স্মার্ত পণ্ডিতেরা ‘আপ্তবাক্য’ ধরনের হুকুমনামা জারী করতে শুরু করলেন।

বলা যায় এখনই শুরু হল অচলায়তনের সেই ‘তট-তট-তট তোটয়’-র জমানা।

প্রাশ্বর্তী যুগে যদিচ বিবাহযোগ্যা কন্যার বয়স সচরাচর ধরা হত ষোলো-সতেরো, এই যুগে তা কমিয়ে আনা হল নয়-দশে। ‘কেন’, তার হেতু প্রদর্শন স্মার্ত-পণ্ডিতদের স্বভাব-বিরুদ্ধ। ক্রমে প্রচলিত হল মারাত্মক গৌরীদানের ব্যবস্থা : ‘অষ্টমবর্ষেতু ভবেৎ গৌরী।’

ফলে ‘সদ্যোদ্বাহা’–র অনুপাত অনিবার্যভাবে হ্রাস পেতে থাকে।

মুসলমান যুগে স্ত্রীশিক্ষার পথে দেখা দিল আর একজাতের বাধা—

প্রথমত আগন্তুক বিজয়ীদের পর্দাপ্রথা হিন্দুসমাজে প্রভাব বিস্তার করল। দ্বিতীয়ত কিশোরী মেয়েদের পক্ষে পাঠশালায় যাতায়াত করার নিরাপত্তা আর রইল না। নারী বিদ্যাচর্চার প্রাঙ্গণে স্বতই সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে গেল।

ক্রমে ঐ স্মার্ত টুলো-পণ্ডিতদের প্রভাবে বিদ্যাশিক্ষার অধিকার থেকে নারীসমাজ সম্পূর্ণ বঞ্চিতা হয়ে গেল। কূপমণ্ডূকেরা নিদান হাঁকল : অক্ষর পরিচয় আর অকালবৈধব্য পরস্প সম্পর্কযুক্ত।

তবু, ব্যতিক্রম হিসাবে প্রতিটি যুগেই মাথা খাড়া করে উঠে দাঁড়িয়েছেন গার্গী-মৈত্রেয়ীর উত্তরাধিকারিণীরা। অকালবৈধব্যের নিদারুণ সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে তাঁরা সারস্বত আরাধনা করে গেছেন অকুতোভয়ে।

বিদ্যালঙ্কার তাঁর যুক্তির সমর্থনে দুএকটি উদাহরণ শোনালেন। বিগত দুই এক শতাব্দীর ভিতর থেকে—

প্রথমত—ফরিদপুর অঞ্চলের কোটালিপাড়া গ্রাম নিবাসিনী প্রিয়ম্বদা দেবী।

ষোড়শ শতাব্দীর শেষপাদে তাঁর জন্ম। পিতা প্রখ্যাত পণ্ডিত শিবরাম সার্বভৌম। টুলো পণ্ডিত হলেও তিনি ছিলেন ধনীব্যক্তি। কন্যাকে শিশুকাল থেকেই শিক্ষাদান করেছিলেন। পশ্চিমদেশীয় একটি ছাত্রের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দান করে তিনি কন্যা ও জামাতা বাবাজীবনকে ‘মাঝবাড়ি’ গ্রামে অধিষ্ঠিত করেন। ভূসম্পত্তিদান ও চতুষ্পাঠী নির্মাণ করে দেন। “পিতার যত্ন ও শিক্ষাগুণে প্রতিভাশালিনী প্রিয়ম্বদা কাব্যে, সাহিত্যে, ও ব্যাকরণে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। বালিকা বয়স থেকেই সংস্কৃত ভাষায় যেমন অনর্গল কথা বলতে পারতেন তেমনি কবিতা রচনায় পারদর্শিনী ছিলেন। কুলদেবতা শ্রীগোবিন্দদেবের উদ্দেশ্যে তাঁর রচিত সংস্কৃত কবিতাটি ইংরেজীতেও অনূদিত হয়েছে।”[১] “শ্যামারহস্য” নামে সুবিখ্যাত তন্ত্রশাস্ত্রের গ্রন্থটি এই প্রিয়ম্বদা দেবীর রচনা। তাছাড়া মদালসা-উপাখ্যানের দার্শনিক টীকা আর মহাভারতের মোক্ষধর্মের একটি সুবিস্তৃত টীকার ইনিই রচয়িত্রী।

[১. ‘বাঙালী চরিতাভিধান, সংসদ। বলাবাহুল্য ইংরাজী অনুবাদটি হয়েছে অনেক পরবর্তী কালে।]

দ্বিতীয়ত—ঐ ফরিদপুরেরই ধাকা গ্রামের জয়ন্তী দেবী। সপ্তদশ শতকে তাঁর জন্ম। মধ্যযুগের এক বিখ্যাত বিদুষী। স্বামী কৃষ্ণনাথ সার্বভৌম। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে তাঁরা রচনা করেছিলেন একটি চম্পূকাব্য, ‘আনন্দলতিকা’(1652)। কাব্য,ব্যাকরণ, দর্শন, অলঙ্কারশাস্ত্রের অধিকারিণী এই মহিলাও বিশ্বাস করেননি ঐ অর্বাচীন যুক্তিতে স্ত্রীলোক সাক্ষর হলে অকালবৈধব্য প্রাপ্ত হয়।

তৃতীয়তঃ দ্রবময়ী।[২]

[২. এটি লেখকের সজ্ঞান ‘অ্যানাক্রনিজম’। দ্রবময়ীর জন্ম উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে, হটী বিদ্যালঙ্কারের তিরোধানের পরে। কিন্তু দেরী করে আবির্ভূত হবার অপরাধে এই আশ্চর্য মহিয়সী মহিলার নামটি বাদ দিতে মন সরল না।]

সমকালীন পত্রিকায় সম্পাদক তাঁর পরিচয় দিচ্ছেন, “খানাকুল কৃষ্ণনগর সন্নিহিত বেড়াবাড়ি গ্রামনিবাসী ব্যাসোক্ত ব্রাহ্মণ শ্রীযুক্ত তর্কালঙ্কারের কন্যা শ্রীমতী দ্রবময়ী দেবী (প্রবন্ধ রচনাকালে দ্রবময়ী পঞ্চদশী বালিকামাত্র, তবু তর্কবাগীশ তাঁকে ‘আপনি’ বলে উল্লেখ করেছেন) বালিকা বয়সে বিধবা হইয়া পিতার টোলে পড়িতে আরম্ভ করেন। পুরাণ মহাভাগবতাদি সর্বশাস্ত্রে সুশিক্ষিতা হয়েন মাত্র চৌদ্দ বৎসর বয়সে। পিতা তখন বৃদ্ধ। দ্রবময়ী কিঞ্চিৎ ব্যবধানে এক আসনে বসিয়া পিতার টোলে ১৫-১৬জন প্রায় সমবয়সী ছাত্রকে ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার পড়াইতেন।”[৩] সম্পাদক বর্ণনা করেছেন, ঐ প্রায় নাবালিকা পণ্ডিতাকে পরীক্ষা করতে প্রায়ই বিভিন্ন গুরুকুলের পণ্ডিতেরা সমবেত হতেন। দ্রবময়ী তাঁদের সঙ্গে বিচার করতেন ‘অনবগুণ্ঠিতা’ অবস্থায়। ‘পৃথগাসনে উপবিষ্টা’ হয়ে, এবং ‘অনর্গল সংস্কৃত ভাষায়’। যাঁরা তাঁকে পরীক্ষা করতে এসেছিলেন তাঁরা স্বীকার করে যেতে বাধ্য হন যে, দ্রবময়ী পিতার চতুষ্পাঠী পরিচালনার উপযুক্ত পাত্রী!

[৩. গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ, সম্পাদক ‘সম্বাদ প্রভাকর’ (১৯ এপ্রিল, ১৮৫১)]

পরিশেষে হটী বিদ্যালঙ্কার বিচারক-মণ্ডলী তথা কাশীধামের পণ্ডিতসমাজের নেতৃস্থানীয় মহামহোপাধ্যায়দের উদ্দেশ্যে কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করলেন : নারীশিক্ষার এই রুদ্ধদ্বারটি আপনারা উন্মুক্ত করে দিন। নারী সমাজকে কূপমণ্ডূপ দৃষ্টিভঙ্গিতে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখলে সমাজের সামূহিক উন্নতি ব্যাহত হতে বাধ্য! অশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, অবশ্য পরিত্যাজ্য। বালবৈধব্য আর সহমরণ প্রথার বীভৎসতায় হিন্দুসমাজ ক্রমশ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে। বিচারকত্রয়ী সর্ববাদীসম্মতভাবে বিধান দিলেন : শুধুমাত্র নারীজন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূতা হবার অপরাধে কারও বিদ্যার্জন ও বিদ্যাবিতরণের অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না!

.

বলাবাহুল্য জগমোহন তর্কবাগীশ আর তার দলবল এ পরাজয় শান্তচিত্তে গ্রহণ করতে পারল না। শুধু নব্যপণ্ডিতেরা নয়, প্রতিষ্ঠাবান কবিরাজেরাও। ক্রমে দেখা গেল—দ্বন্দ্বটা পুরুষ ও স্ত্রীজাতির অধিকারভেদের সংগ্রামে পর্যবসিত হতে চলেছে। হয়তো হটী বিদ্যালঙ্কারের পক্ষে ছিল মুষ্টিমেয় আলোকপ্রাপ্তা রমণীকুলের সমর্থন—কিন্তু সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদে ‘আলোকপ্রাপ্তা’ শব্দটাই যে অশ্রুত! তাদের উচ্ছ্বাস ঐ একবারই শ্রুত হল—কুরুক্ষেত্র তালাও-এর বিচারসভায়—চিকের আড়াল থেকে। শঙ্খধ্বনিতে। অপরপক্ষে নব্যপণ্ডিতের দল মনে করল, এ প্রচেষ্টা শুধু অবমাননাকরই নয়, এ তাদের রুজি-রোজগারে হাত দেওয়া। ঐ কুলীনঘরের বালবিধবাটির কর্তব্য ছিল স্বামীর মস্তকটি ক্রোড়ে ধারণ করে সহমরণে যাওয়া। তাহলে সে ড্যাংডেঙিয়ে স্বর্গে যেতে পারত। তা সে যায়নি। তাই বলে যা-নাকি আবহমানকাল পুরুষের অধিকারে—তাতেও সে হাত বাড়াবে?

ওরা সিদ্ধান্তে এল—ঐ কয়জন স্থবির পণ্ডিতের এই বিধান মানা চলে না। সে বিচারসভায় শ্রীমন্ মহারাজ কাশীনরেশের পাতসাহীই তো ছিল না—আনুষ্ঠানিকভাবে রাজদণ্ডটি শুধু শোভা পাচ্ছিল সভাস্থলে। স্বীকার্য—কাশীনরেশ লোকান্তরিত, তাঁর পুত্রটি নাবালক—কিন্তু মহারাজের ভাগিনেয়টি তো সশরীরে বর্তমান। শোনা যাচ্ছে, সম্প্রতি তিনি এলাহাবাদ ক্যান্টনমেন্ট থেকে কাশীতে প্রত্যাবর্তনও করেছেন! ওরা সদলবলে তাঁরই দ্বারস্থ হল।

পুরন্দর ক্ষেত্রী এসব বৃত্তান্ত কিছুই জানত না। আদ্যন্ত শুনে সে ক্রোধে উন্মাদ হয়ে গেল! এ কী অনাচার! কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা—সহমরণে স্বর্গে যাবি, তা নয় কাশীধামে এসে বেলেল্লাপনা শুরু করে দিলি? মস্তকমুণ্ডন করে, শিখাধারণ করে, প্রকাশ্যে পুরুষের সঙ্গে পণ্ডিত্যেমি করছিস্।

কঠিন শাস্তি দিতে হবে সেই দুর্বিনীতাকে!

জনমতকে স্বমতে আনার সাধনা তার। পুরন্দর জানে, দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণব বা রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন প্রভৃতিরা নিতান্তই সংখ্যালঘিষ্ঠ। সমগ্র কাশীর পণ্ডিতসমাজ বিদ্যালঙ্কারের বিপক্ষে। তদুপরি কবিরাজদল। সকলেই মনেপ্রাণে চাইছে, হয়তো মুখে স্বীকার করছে না—ঐ বিদ্রোহিনীকে শায়েস্তা করতে, অপমান করতে।

তাই করবে পুরন্দর। এমন পৈশাচিক পদ্ধতিতে বেইজ্জত করবে যাতে ভবিষ্যতে আর কোন পুরললনা এ দুঃসাহসের কথা স্বপ্নেও না চিন্তা করতে পারে।

পুরন্দর ধুরন্ধর। হঠকারিতা তার ধাতে নেই। অভিযোগ শুনেই সে ঐ ছুকরির চতুষ্পাঠীতে হানা দেয়নি। বিশ্বস্ত গুপ্তচরের মাধ্যমে সর্বপ্রথমে সংগ্রহ করল সংবাদের যাথার্থ্য। যখন জানতে পারল, জগু-পণ্ডিতের অভিযোগের মধ্যে অতিরঞ্জন কিছু নেই, তখন এক পৈশাচিক উল্লাসে সে মেতে ওঠে। এতদিন কামচরিতার্থতা করতে হচ্ছিল গোপনে। প্রজাদের অসন্তোষের আশঙ্কায়। এবার সে নির্ভয়। এবার জনসমর্থন আছে তার কামচরিতার্থতায়—কিন্তু সেটাতে এমন প্রলেপ দিতে হবে যাতে মনে হয় এ রাজকর্তব্য! সমাজের কলুষতা দূরীকরণের জন্যই তাকে এ জাতীয় শাস্তির বিধান দিতে হল!

পৈশাচিক শাস্তিদানের সবচেয়ে বড় জাতের নজির রেখে গেছেন দীনদুনিয়ার মালেক বাদশাহ জাহাঙ্গীর! শাহাজাদা খুরম্-এর বিদ্রোহ দমন করে পুত্রের দুই সেনাপতিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরিকল্পনাটি অভিনব। একটি মৃত গাধা ও একটি মৃত ষণ্ডের চামড়ার খোলের ভিতর জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল দুই সেনাপতিকে। তারপর চর্মশিল্পীরা ঐ দুটি মৃত জন্তুর খোল সেলাই করে দেয়। এমন সুচারুভাবে তা করে, যাতে বায়ুর অভাবে দুই হতভাগ্য তৎক্ষণাৎ মারা না যেতে পারে। যাতে তারা আট-দশ ঘণ্টা ঐ মৃত জন্তুর পূতিগন্ধময় নিশ্বাসে জীবনের শেষকটি প্রহর জীবিত থাকে। তারপর ঐ দুটি মৃতপশুকে গো-শকটে উঠিয়ে সমগ্র শহর শোভাযাত্রা করে প্রদক্ষিণ করানো হয়। সমগ্র আগ্রা শহর শিহরিত হয়েছিল গো-শকটের উপর ঐ দুটি মৃত জন্তুকে ক্রমাগত ধড়ফড় করে উঠতে দেখে।

না, পুরন্দর সে জাতীয় কিছু করবে না। নারীহত্যা করবে না! তবে স্থির করেছিল শাস্তিদান সমাপ্ত করে সে ঐ অপরাধিনীকে বাধ্য করবে পদব্রজে সমগ্র কাশীনগরী পরিক্রমায়। সঙ্গে ঢাক-ঢোল-শিঙা বাজিয়ে মিছিল করে যাবে শোভাযাত্রীরা। প্রকাশ্য দিবালোকে। অপরাধিনী থাকবে সম্পূর্ণ বিবস্ত্ৰা!

দশাশ্বমেধে সহস্রযাত্রীর দৃষ্টির সম্মুখে সেই বস্ত্রহীনা নগ্ন স্নান করবে এবং তার পর শোভাযাত্রীদের সঙ্গে পদব্রজে উপনীত হবে তার বাকি জীবনের বন্দী আবাসে।

কাশীর রণ্ডিবাজার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *