কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১২

১২

উলা একটি প্রাচীন জনপদ। গোয়াড়ি-কৃষ্ণনগর থেকে দক্ষিণে, কয়েক ক্রোশ দূরত্বে। পাকা নবাবী সড়ক দুই জনপদকে যুক্ত করেছে। সড়কের শেষ সেখানেই নয়। ঐ পথরেখা ধরে চলতে থাক দক্ষিণবাগে—চূর্ণী পার হয়ে—পাবে একের পর এক প্রাচীন জনপদ। রণার ঘাট, চৌবেড়িয়া, কাঞ্চনপল্লী, কুমারহট্ট, ভট্টপল্লী, মূলাযোড়। কিন্তু সেসব কথা এখন নয়। আবার ঐ একই নবাবী সড়ক ধরে গোয়াড়ি-কৃষ্ণনগর ছাড়িয়ে যদি উত্তরমুখো চলতে থাক, পাবে প্রথমেই জলাঙ্গীর খেয়াঘাট। পার হলে। পাবে বেলডাঙ্গা, দেবগ্রাম তারপর গঙ্গাতীরের লাখবাগ।

[জনপদগুলির বর্তমান নাম
রণার ঘাট = রাণাঘাট, কাঞ্চনপল্লী=কাঁচড়াপাড়া, কুমারহট্ট = হালিশহর, ভট্টপল্লী = ভাটপাড়া = কাঁকিনাড়া, মূলাযোড় = শ্যামনগর।]

‘লাখবাগ’কে তোমরা চেন না। নামটা অজানা। কেমন করে জানবে গো? ‘লাখে এক’ও যে আজ নেই। এই পরগণার অনেকটা অংশ ছিল নাটোরের স্বনামধন্য রানী ভবানীর জমিদারীর অন্তর্গত। রানীমার নির্দেশে এখানে গুনে গুনে এক লক্ষ আমের কলম পোঁতা হয়। খানদানি সব গাছ! বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে হাজার হাজার গো-গাড়ি আর নৌকায় সেই সব হিমসাগর, ল্যাংড়া, বেগমখাশ, বাদশা-পসন্দ, কোহিতুর আমের পাহাড় চালান যেত—কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপে, মুদাবাদ, ওদিকে রাজসাহী, নাটোর। শেষ আমগাছটি কালবৈশাখীর ঝড়ে ভূতলশায়ী হয় 1893 খ্রীষ্টাব্দে। ঐ শেষ রসালবৃক্ষের মৃতদেহের পাশেই ইংরাজ-সরকার বাহাদুর খাড়া করেছিল একটা গ্র্যানাইট পাথরের ছোট্ট ফলক। তাদের বঙ্গবিজয়ের স্মৃতিচিহ্ন। তার ষোলো বছর পরে লর্ড কার্জন সেটা অপসারণ করে বসিয়েছিল একটা বড়মাপের মজবুত স্মৃতিচিহ্ন। ‘লাখবাগে’ গেলে সেটা আজও দেখতে পাবে। তবে তোমরা লাখবাগের খোঁজ কর না। ওর নাম পরের জমানায় যা হয়েছিল সেই নামেই আজ ওর পরিচয়: পলাশী।

সেটা পার হয়ে উত্তরমুখো গেলে পৌঁছাবে মুর্শিদাবাদে।

উলার কথায় ফিরে আসি।

চূর্ণীনদীর পশ্চিমপারের এই গ্রামটির নাম কেন অমন হল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, জ্ঞানী অর্থে ইরানীয় শব্দ ‘আউল’– যা থেকে বাঙলায় প্রচলিত শব্দ ‘আউল-বাউল’–তা থেকেই উলা নামটা এসেছে। আবার কেউ বলেন, তা নয়, গ্রাম পত্তনের আগে এখানে চূর্ণী নদীর কিনার ঘেঁষে ছিল দিগন্তবিস্তৃত উলুবনের জঙ্গল। ‘উলু’ ঘাস চেন তো? উলুখড় দিয়ে বাঙলা-চালা ছাওয়া হয়। ধানখড়ের চেয়ে তা অনেক অনেক বেশি টেকসই। ঐ জঙ্গলে বাস করত এক আদিম জাতি। সে অনেক অনেক কাল আগে। মানে, ধর্মাশোক তখনো চণ্ডাশোক। অর্থাৎ সম্রাট অশোক তখনো কলিঙ্গ-বিজয়ে আসেননি। আর্য সভ্যতা এসে পৌঁছায়নি বঙ্গভূমে। নৃতাত্ত্বিকেরা বলেন, সেই বিস্মৃত অতীতে গোটা বঙ্গভূমে বাস করত অস্ট্রিক-গোষ্ঠীর কিছু কৃষিজীবী আদিম জাতি। তাদেরই একটি শাখা বাস করত এই চূর্ণীতীরের ঘন জঙ্গলে। তাদের এক লৌকিক দেবতা আজও টিকে আছেন ওখানে : উলাইচণ্ডী দেবী।

দেবীসেবার বংশানুক্রমিক অগ্রাধিকার হাড়ী জাতীয় এক পূজারীর। এখন বোধহয় হয় না, কিন্তু আমাদের কাহিনীর কালে বৈশাখী পূর্ণিমায় এখানে “মায়ের মন্দিরে শূকর-বলি হত।

চণ্ডী প্রাগার্য দেবী। মা মনসার মতো। পরবর্তী সহস্ৰকে আর্য-অনার্য-সংমিশ্রণে গৌড়মণ্ডলে জন্ম নিল একটি মিশ্র জাতি-বাঙালী; তখন ঐ দুই দেবীকে মার্জনা করে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা তাঁদের তেত্রিশ কোটির মধ্যে সামিল করে নিলেন। ঐ অনার্য ব্যাধের দেবী হলেন শিবের অর্ধাঙ্গিনী। বাঙালীর কবি-মন রচনা করতে শুরু করল—মনসামঙ্গল আর চণ্ডীমঙ্গল।

এক সময়ে ভাগীরথী বইত এই উলা-গ্রামের পাশ দিয়েই। উলা ছিল গঙ্গাতীরবর্তী গ্রাম। এখন যেন বিশ্বাস হতে চায় না—গঙ্গা কত দূরে সরে গেছে! গঙ্গার সেই আদিম মরা-খাত উলার নগর সীমান্তে আজও দেখা যায়। উলা যে গঙ্গাতীরবর্তী জনপদ তার একটি পরোক্ষ প্রমাণ রয়ে গেছে বাঙলা সাহিত্যে। কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে

শ্রীমন্ত সওদাগর চলেছেন সিংহল-দ্বীপে—তাঁর সপ্তডিঙা-মধুকর ভাসিয়ে। ভাগীরথী বেয়ে উপনীত হতে হবে কপিলমুনির আশ্রমে—সেই ‘দক্ষিণরায়ের’রাজ্যে, গঙ্গাসাগরে। তারপর সমুদ্রযাত্রা। নদীপথেই একদিন উঠল দারুণ ঝড়। শ্রীমন্ত নোঙর করলেন। শুনলেন, গ্রামটির নাম উলা। এমন নাম কেন গো?—জানতে চাইলেন শ্রীমন্ত সওদাগর। সর্দার-মাঝি বললে, সে কি হুজুর? আপনি জানেন না? এখানেই যে আছে মা উলাইচণ্ডীর মন্দির। তাঁর বরে কী না হয়? ‘অপুত্রের পুত্র হয়, নির্ধনের ধন’। মোটকথা : ‘যে যে-বর চায়, সে সে-বর পায়!

শ্রীমন্ত বললেন, তাহলে আমিই বা তাঁর পূজা না করি কেন? বর চাইব—যাতে নির্বিঘ্নে বাণিজ্য করে ফিরে আসতে পারি।

তাই হল। শ্রীমন্ত সওদাগর সাড়ম্বরে উলাইচণ্ডীর পূজা করলেন।

কেউ কেউ বলেন, যেহেতু শ্রীমন্ত সওদাগর এই ঘাটে নৌকা থেকে ‘উলা’ করেছিলেন, তাই গ্রামটির নাম ‘উলা’। ‘উলা’ ক্রিয়াপদের অর্থ জান তো?—অবতরণ করা, নামা।

আমার বাপু এ ব্যাখ্যায় মন মানেনি। এ যেন ঘোড়ার আগে গাড়ি যোতা! শ্ৰীমন্ত নৌকা থেকে উলা করার আগেই তো শুনলেন—গাঁয়ের নাম: ‘উলা’, যেহেতু সেখানে আছে মা উলাইচণ্ডীর দেউল।

মোটকথা, শ্রীমন্ত সওদাগরের আমলে উলা গ্রামখানি ছিল গঙ্গার কিনারে। এখন এ জনপদের নাম : বীরনগর।

উলাকে এ খেতাবটি দিয়েছিলেন ইংরাজ সরকার-বাহাদুরের তরফে কলকাতার এক ন্যায়াধীশ—কোট অব সার্কিটের প্রধান বিচারপতি। কারণ ছিল। সেটা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদ। সে সময় উলার কাছাকাছি—ঐ গঙ্গার মরাখাতের জঙ্গলে বাস করত একদল দুর্ধর্ষ ডাকাত, যা থেকে ঐ বর্তমান নাম ‘ডাকাতের খাল। তাদের উপদ্রবে সরকার-বাহাদুরের কোতোয়াল হিমসিম। শেষমেষ ঊলার যুবশক্তি সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ধরে ফেলল ডাকাত দলকে কোতোয়াল পাঠিয়ে দিল সেই ডাকাতদের শহর কলকাতায়। জজবাহাদুর তাদের দিলেন শাস্তি আর উলাবাসীকে ঐ খেতাব। উলা হয়ে গেল : বীরনগর!

আমাদের কাহিনীর কালেও উলার যথেষ্ট খ্যাতি। শিল্প ও বিদ্যাচর্চায়। অনেকগুলি টোল পরিচালিত হয়—অধিকাংশই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অর্থানুকূল্যে। এখান থেকেই বিভিন্ন যুগে স্বনামখ্যাত হয়েছিলেন—চতুর্ভুজ ন্যায়রত্ন, সদাশিব তর্কালঙ্কার, কৃষ্ণরাম ন্যায়পঞ্চানন, শিবশিব তর্করত্ন প্রভৃতি। এই জনপদের পণ্ডিত সারণ সিদ্ধান্ত তাঁর দুই আত্মজাকে সংস্কৃত শিক্ষায় পারদর্শিনী করে তোলেন। তবে সে ঘটনা যে ঠিক কোন আমলের তার হক-হদিশ জোগাড় করতে পারিনি। বীরনগরবাসী কোন পণ্ডিত কিছু হদিস দিতে পারেন?

দুই অশ্বারোহী বন্ধু শহর দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছেন। সড়কের দুধারে পাকা বাড়ি। পাতলা ইটের। মোটা দেওয়াল। কাদার গাঁথনি। স্থানে স্থানে দ্বিতল বাড়ি। মাঝে-মাঝে প্রতিষ্ঠিত জলাশয় এবং মন্দির। পথে পদাতিকেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। দু-একটি গো-গাড়ি বা অশ্বযান। ঘরানা-ঘরের মহিলারা চলেছেন পাকি চেপে। পদাতিক পুরুষদের অধোবাস ধুতি, হাঁটু পর্যন্ত। ঊর্ধাঙ্গে উত্তরীয়। সেলাই করা বস্ত্র—পিরান বা কুর্তার চল কলকাতা বা মুর্শিদাবাদে হয়েছে। বর্ধমান বা কৃষ্ণনগরেও উচ্চকোটি মহলে তা সুপরিচিত; কিন্তু এখানে তা বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। দু-একটি সীমন্তিনীকে দ্বিতলের বারান্দায় বা প্রাঙ্গণের ভিতরে চকিত দর্শনে দেখা যায়। তারাও একবস্ত্রা। গায়ে কামিজ নাই। তবে চর্যাপদের যুগে বক্ষযুগল অনাবৃত রাখায় যে বাধা ছিল না,এখন সে অবস্থা নয়। শাড়ির দৈর্ঘ্য সচরাচর কম, বহরেও ছোট। তার পরিপূরক হিসাবে যৌবনবতীরা ব্যবহার করেন একটি পৃথক ওড়না। তাতেই উর্ধ্বাঙ্গ আবরিত, তাতেই অবগুণ্ঠনের আয়োজন। কোন কোন সীমন্তিনী সন্তানবতী। তাদের ক্রোড়ে শিশু। অধিকাংশই উলঙ্গ, মাজায় ঘুন্সি, মাথায় ‘কাকপক্ষগুচ্ছ’—অর্থাৎ চূড়ো-করে বাঁধা চুলের তিনটি শিখর। রমণীকুলের অলঙ্কারের মধ্যে সবার আগে যেটা নজর পড়ে তা প্রৌঢ়াদের ক্ষেত্রে নথ এবং যুবতী ও কিশোরীদের নোলক।

ওঁদের দুজনকে বৈঠকখানায় বসিয়ে রসিকলালের কর্মচারী ভিতরে এত্তেলা দিতে গেল। যাবার আগে জানতে চায়, হুজুরকে কী বলব? কে দেখা করতে এসেছেন?

ভারতচন্দ্র বললেন, উদ্দেশ্যটা গোপন এবং বৈষয়িক।

এঁরা অশ্বারোহণে এসেছেন। বেশবাস সম্ভ্রান্ত। লোকটা দ্বিতীয় প্রশ্ন করেনি। একটু পরে দ্বিতল থেকে নেমে এলেন গৃহস্বামী। কোঁচানো ফরাসডাঙার ধুতি। ঊর্ধ্বাঙ্গে রেশমী কামিজ, তদুপরি বেনিয়ান। জবরদস্ত কোমরবন্ধ। দক্ষিণ তর্জনীতে একটি পোষা বুলবুল। দু হাতের নখ অতি দীর্ঘ এবং অলক্তক রাগরঞ্জিত। এটি ঋষি বাৎস্যায়ন নির্দেশে : ‘নখক্ষত প্রদানেচ্ছু গৌড়ীয় নাগর সচরাচর হস্তশোভী ও চিত্তগ্রাহী দীর্ঘনখরলাঞ্ছিত হয়েন। চোখ দুটি রক্তবর্ণ। বুঝতে অসুবিধা হয় না এই প্রত্যুষেই কিছু গৌড়ীয় মাধবী সেবন করেছেন। যুক্তকরে উভয়কে নমস্কার করে বললেন, অহোবত! কী সৌভাগ্য! আসুন, বসুন।

ওঁরা বসেই ছিলেন। প্রতিনমস্কার করলেন শুধু।

প্রথমেই ওঁদের পরিচয় লাভের বাসনাটা জাগাই স্বাভাবিক। মদ্যপ সে পথে গেলেন না। পর্যায়ক্রমে দুজনকে দেখে নিয়ে রূপেন্দ্রকে সম্বোধন করে বললেন, মহাশয়ের জেব-এ সিঁদকাঠি নাই, আশা করি?

—সিঁদকাঠি!—রূপেন্দ্র আঁৎকে ওঠেন।

—আপনার খানদানি বদনখানিতে যে ‘মদন মুরছা যায়!’ তা যাগ্ গে, মরুগ্যে! মদন-শালা মুচ্ছো গেল তো ভারি বয়েই গেল আমার! যত ইচ্ছা সিঁদ দিন। আমার ঘরে কোন ‘বিদ্যা’ নেই! তিনকড়ি-পণ্ডিতের বেতের চোটে বাল্যেই ‘বিদ্যা’কে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছি! বলুন, কী ভাবে আপনাদের সেবা করতে পারি?

ভারতচন্দ্র বলেন, আমার এই বন্ধুটি একজন কবিরাজ। উনি আপনার আস্তাবলে গিয়ে গয়ারামকে একবার দেখতে চান। আপনি অনুমতি দিলে…

রসিক একটা হেঁচকি সামলালেন। বলেন, এ তো আজব কথা শোনালেন মহাশয়! না ডাকতেই উনি গয়ারামের চিকিচ্ছে করতে এসেছেন! আপনাদের উদ্দেশ্যটা কী? কোত্থেকে আসছেন?

রূপেন্দ্র বলেন, আসছি সোঞাই গাঁ থেকে। বর্ধমানভুক্তির অন্তর্গত!

—সেই অদ্দূরের গাঁ থেকে গয়াতীর্থে আসছেন! মতলবটা কী?

–মতলব কিচ্ছু নেই। গয়ারামের সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ করলে আপনার আপত্তি আছে?

—আলবাৎ আছে! তার আগে বলতে হবে, আপনাদের মতলবটা কী?

রূপেন্দ্র বুঝতে পারেন, রসিকলালের আপত্তির মূলটা কোথায়। গয়ারামের প্রসঙ্গ ওঠামাত্র উনি বদলে গেছেন। তাই প্রসঙ্গটার মোড় ঘোরান আপাতত। আর একটু ঘনিষ্ঠ না হয়ে-সে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করা ঠিক হবে না। বলেন, আপনার যখন আপত্তি আছে, তখন গয়ারামের প্রসঙ্গ থাক, কিন্তু সিঁধকাঠির কথা বললেন কেন তখন?

আবার প্রফুল্ল দেখায় মদ্যপকে। ঘনিয়ে এসে বলেন, আপনি ‘বিদ্যাসুন্দর’ পড়েননি? ভারতচন্দ্র উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠেন। রূপেন্দ্র বলেন, না। কার লেখা?

—মহারাজ কেষ্টচন্দ্রের আমদানি করা নয়া-চিড়িয়া! লোকটাকে এখনো দেখিনি। কিন্তু গোয়াড়ি-গঞ্জে এখন ঘরে-ঘরে তার নাম!

রূপেন্দ্র চকিতে তাঁর পার্শ্ববর্তী বয়স্যের দিকে দৃকপাত করেন। দেখেন, উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কবির মুখখানি। বলেন, ঐ কাব্যগ্রন্থ লিখে এত খ্যাতি? আপনি পড়েছেন?

—সবটা পড়িনি। কিছু কিছু কেচ্ছা পড়েছি। আমার এক বয়স্য আছে। ঝষধ্বজ দত্ত। সে অনুলিপি করিয়েছে। অংশ-বিশেষ। পড়ে শুনিয়েছে! দারুণ লেখা, মহাশয়। মহারাজ সে-শালার উপাধি দিয়েছেন : ‘রায়-গুণাকর’; আমি হলে উপাধি দিতাম : ‘খেউড়-বিশারদ’।

ভারতচন্দ্র অধোবদন হলেন। যেন রসিকলাল একটি সূচ বিদ্ধ করে দিয়েছেন ওঁর পঞ্জরে। রসিক বলেই চলেন, ঢের-ঢের কবি দেখেছি মহাশয়, এমন কাঁচা খিস্তি পদ্যের আকারে লেখার হিম্মৎ কারও নেই! সাঁঝের বেলা আসবেন, ঝষধ্বজের আড্ডায়। শুনিয়ে দেব! এ পুঁথির শত শত অনুলিপি হবে, বুয়েছেন, ঘরে ঘরে সবাই লুকিয়ে পড়বে।

রূপেন্দ্র নিরতিশয় লজ্জিত হন, প্রসঙ্গটা উত্থাপন করায়।

ভারত মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে বসে আছেন। তাঁর কর্ণমূল রক্তিম হয়ে উঠেছে।

রসিকলাল পুনরায় বলেন, তার ফলাফল কী হবে আন্দাজ করতে পারছেন? কুমোরভায়াকে রণ্ডিবস্তিতে গিয়ে আর প্রতিমার মাটি সংগ্রহ করতে হবে না। ঐ পুঁথির সম্যক প্রচার হলে কুমোরভায়া যে-কোন গেরস্তবাড়ি থেকেই তুলে নিতে পারবে এক খাবলা মাটি। শুরু করতে পারবে মূর্তি গড়ার কাজ। গেরস্তবাড়ি আর রণ্ডিবাজার একাকার করে ছেড়েছে শালা! ধীর পায়ে ভারতচন্দ্র কক্ষ ত্যাগ করেন। যেতে যেতে শুনতে পান, রসিকলাল বলছেন, ‘বিদ্যাসুন্দরের কিস্সা অমৃতের কথা/খেউড়ানন্দ কবি ভনে শুনে তার রাধা।।”

রূপেন্দ্র প্রতিবর্তী-প্রেরণায় যেন প্রতিধ্বনি করেন, রাধা।

—খেউড়ানন্দ নিজেকে ‘রাধানাথ’ বলেছে; খোদায় মালুম সে মাগী ওর বউ, অথবা… দু-হাতে দুই কান ঢেকে ছুটতে ছুটতে প্রাঙ্গণটা অতিক্রম করে রাজপথে চলে আসেন। প্রভাতী সূর্যের আলো গাছের পাতার ভিতর দিয়ে টাকা-টাকা ছোপ ফেলেছে বনভূমিতে ভারতচন্দ্রের কিন্তু মনে হল—নীরন্ধ্র অন্ধকার! এ কী হয়ে গেল! এ কী করলেন তিনি! কে ঐ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র? কী প্রয়োজন তাঁর অনুগ্রহের? আজও কি নতুন করে শুরু করা যায় না? ঐ বুনো রামনাথের মতো? তিনি তো রাজানুগ্রহের প্রত্যাশা করেননি, প্রত্যাখ্যান করেছেন! আছে, ‘ ভারতচন্দ্রেরও আছে সেই হিম্মৎ! তিনিও পারেন ওল-সিদ্ধ আর তিন্তিড়ীপত্রের ব্যঞ্জনে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে। রাধাও পারে। পারবে। তিনি যদি তাকে হাত ধরে নিয়ে যান কোনও অরণ্যপ্রান্তের পর্ণকুটিরে। রাধাও গরিব ঘরের মেয়ে—দাসদাসী, অলঙ্কারের প্রত্যাশী সে নয়! সে শুধু চেয়েছিল অরুন্ধতীর মতো মহাবশিষ্ঠের চরণপ্রান্তে একটুকু ঠাই! ভারতচন্দ্রও লাভ করবেন বরদা বাণীর আশীর্বাদ! রাধাও সেদিন তার শাঁখা-পরা হাতখানি তুলে দেখাতে পারবে নবদ্বীপ রাজমহিষীকে! বলবে, আমার হাতে যতদিন এই শাঁখা আছে…

চোখ দুটি জলে ভরে এল কবির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *