১৫
বিসর্জনের পরদিন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রূপেন্দ্রকে মধ্যাহ্ন-ভোজে নিমন্ত্রণ করলেন।
জনান্তিকে বললেন, আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনার আছে, ভেষগাচার্য।
-বলুন মহারাজ?
—প্রথমে বলুন, ঝষধ্বজের রোগটা কী? কুষ্ঠ?
রূপেন্দ্র ইতিমধ্যে রুগীকে দেখেছেন। ঔষধপত্রের ব্যবস্থা দিয়েছেন। তিনি বললেন, না মহারাজ। এ একটি বিচিত্র মারাত্মক অসুখ। সাগরপারে এ রোগের প্রাদুর্ভাব। ইংরাজ-ফরাসী-পর্তুগীজদের দেশে আছে, চীনখণ্ডেও আছে। আমাদের দেশে এটি নতুন আমদানি। চিকিৎসাবিদ্যায় এর নাম রতিজ-রোগ!
—চিকিৎসা আছে? ভয়াবহ?
—না মহারাজ, এর চিকিৎসা আমার জানা নেই। আর ভয়াবহ তো বটেই। মৃত্যু অবশ্যম্ভারী—কতদিন ঠেকিয়ে রাখা যায় সেটাই দেখার।
—সংক্রামক?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, তবে রোগজীবাণু বায়ু বা জলের দ্বারা সংক্রামিত হয় না। এ রোগের আক্রমণ জননেন্দ্রিয়ে। নিরোগ ব্যক্তি রোগাক্রান্তের সঙ্গে যৌন সহবাস করলেই শুধু আক্রান্ত হয়। মুশকিল এই যে, রোগটি বংশানুক্রমিক। সন্তান জন্মান্ধ হয়ে যায়, সেও অনুরূপ রোগজীবাণু নিয়ে জন্মগ্রহণ করে!
—এ তো বড় সর্বনাশের কথা শোনালেন! কী বিধান দিয়েছেন?
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজামণ্ডপে জগদ্ধাত্রী (বিংশ শতাব্দী)
—ঔষধপত্রের ব্যবস্থা দিয়েছি, আর দত্তমশাইকে বলেছি, প্রতিবার নারী-সহবাসে তাঁর এক বৎসর, করে আয়ুক্ষয় হয়ে যাবে!
–তাই যায় বুঝি?
—আজ্ঞে না। লক্ষ্য করে দেখলাম, লোকটার মৃত্যুভয় প্রচণ্ড। এ মিথ্যা ভাষণে রোগের বিস্তার কম হবে মনে করেই ওটুকু মিথ্যাভাষণ করেছি!
—ভালই করেছেন। আমাকে কী পরামর্শ দেন?
—আমার অনুমান, ঝষধ্বজ বৎসরখানেকের ভিতরেই মারা যাবে। আপনি দেখবেন, তার দুই উপপত্নী যেন দেহ-ব্যবসায়ী হয়ে রোগ বিস্তার করতে না পারে! তাহলে অনতিবিলম্বেই এই ভয়াবহ রোগ আপনার রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়বে।
রাজা চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলেন, আমি সে সম্ভাবনার মূলোৎপাটন এখনি করে ফেলতে চাই কবিরাজ মহাশয়। ঝষধ্বজকে এখনি গ্রেপ্তার করে আনছি। আমৃত্যু তাকে রাজবন্দী করে রাখব। তার উপপত্নী দুটিকেও বন্দিনী করে আনব। আপনি পরীক্ষা করে বলে দিতে পারবেন, তারা রোগাক্রান্ত কিনা?
—পারব। কিন্তু রোগাক্রান্ত হবার অপরাধে কি ঝষধ্বজকে বন্দী করা ঠিক হবে?
—আপনি জানেন না—জাল-জুয়াচুরি—তার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ। তার মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত। সে যা হোক, আপনাকে আমার দ্বিতীয় একটি জিজ্ঞাস্য আছে।
—বলুন মহারাজ?
—আপনাকে যদি কৃষ্ণনগরে বা নবদ্বীপে কিছু নিষ্কর-ভূমি দান করা হয়, ভদ্রাসন নির্মাণ করিয়ে দেওয়া হয় এবং যথোপযুক্ত বৃত্তির ব্যবস্থাপনা করা হয়, তাহলে আপনি কি আপনার পৈত্রিক আবাস ত্যাগ করে নদীয়ায় এসে বসবাস করতে স্বীকৃত?
রূপেন্দ্র করজোড়ে বলেন, সে তো আমার পরম সৌভাগ্য হত মহারাজ। কিন্তু দুটি অন্তরায় আছে। আমার পিতৃদেবের চতুষ্পাঠী ছিল, কিন্তু তিনি আমাকে কৌলিক-বৃত্তি গ্রহণ করতে দেননি। চিকিৎসাবিজ্ঞানী করে তুলেছিলেন একটি বিশেষ হেতুতে—সোঞাই গ্রামের কাছেপিঠে কোনও কবিরাজ নাই। আমি লোভের বশবর্তী হয়ে আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করলে স্বর্গবাসে তিনি ব্যথিত হবেন।
—বুঝলাম। আর দ্বিতীয় হেতু।
—অপরাধ নেবেন না, মহারাজ! পূর্বপুরুষদের কথা জানি না, কিন্তু আমার পিতৃদের বা পিতামহ কখনো কোন দান গ্রহণ করেননি।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র হাসলেন। বললেন, এ তথ্যটা কিন্তু আপনার ইতিপূর্বেই বলা উচিত ছিল।
রূপেন্দ্র একটু অপ্রস্তুত বোধ করেন এবং কেন যে অপ্রস্তুত বোধ করলেন তার হেতু নিৰ্ণয় করতে পারেন না। জিজ্ঞাসিত হওয়ার পূর্বে সে-কথা কেন উনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলতে যাবেন? পরমুহূর্তেই মহারাজ রহস্যজাল ভেদ করে দেন—সবটাই কৌতুক। বললেন, সে কথা জানা থাকলে গৃহস্থের কিছু সাশ্রয় হত। পঞ্চ-ব্যঞ্জনের পরিবর্তে সেক্ষেত্রে অতিথির জন্য তিন্তিড়ী-পত্রের ব্যঞ্জনই যথেষ্ট হত।
এই সময় একটি সুদর্শনা কিশোরী দ্বারপ্রান্তে আবির্ভূতা হল যুক্তকরে। রত্নালঙ্কারভূষিতা। অবগুণ্ঠনবতী। এমনকি মাথায় সিঁথি, নাসিকায় টানা নথ। মহারাজ তাকে আহ্বান করলেন, এস কস্তুরি….
কস্তুরী কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে গলায় আঁচল দিয়ে দুই ব্রাহ্মণকে প্রণাম করল।
রাজা বললেন, এ হল কস্তুরীবাঈ, আমার অমাত্য শিবভট্টের কনিষ্ঠা কন্যা। ও আমাদের ডাকতে এসেছে। মধ্যাহ্ন-আহারে। তাই নয়, কস্তুরি?
মেয়েটি গ্রীবাভঙ্গিতে স্বীকার করে।
রাজা বলেন, চট করে বলে দাও তো মা, কোন পাঁচটি ব্যঞ্জন তোমার স্পর্শে ধন্য হয়েছে?
কস্তুরী জানে, রাশভারী মহারাজা অন্দরমহলে কৌতুকপ্রিয়। বললে, একি আপনাদের পুরুষদের চতুষ্পাঠী? রানী-মার টোলে ও-সব তঞ্চকতা চলে না।
রাজা প্রাণখোলা হাসি হাসলেন। বলেন ঠিক আছে, মা। তুমি যাও, আমরা এখনি আসছি।
কস্তুরী হাসতে হাসতেই প্রস্থান করল।
রাজা তখন রহস্যটা ভেদ করে দিলেন রূপেন্দ্রর কাছে।
ওঁরা দুজনে এতক্ষণ কথা বলছিলেন ‘বার মহলে’। স্ত্রী-স্বাধীনতার বিষয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রাচীনপন্থী। মহিলারা গঙ্গাস্নান করেন পাল্কি থেকে অবতরণ না করে। অর্থাৎ বাহকেরা পাল্কিসমেত স্নানার্থিনীকে গঙ্গাজলে নিমজ্জিত করে! রাজা কোনও বিশেষ অতিথিকে আহারে নিমন্ত্রণ করলে ভোজ্যদ্রব্য পরিবেশিত হয় এই ‘বার-মহলে’। অন্দরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় না। আজ মহারাজ সে নিয়মের ব্যতিক্রম করতে চলেছেন একটি বিশেষ হেতুতে। বড় মহারানী কিছুদিন ধরে প্রায়শই শিরঃপীড়ায় কষ্ট পাচ্ছেন। কৃষ্ণচন্দ্রের দুই পত্নী। ইনি শিবচন্দ্রের মাতা মহারাজের ইচ্ছা ভেষগাচার্যকে অন্দর মহলে নিয়ে এসে তাঁকে একবার দেখানো। রূপেন্দ্র রোগের লক্ষণ জেনে নিয়ে স্বীকৃত হলেন। উপরন্তু জানতে চান, ঐ কস্তুরী কেন আছে তাঁর অন্দরমহলে। আর ঐ মহারাজের সঙ্গে তার কথোপকথনের অর্থটাই বা কী?
সে-কথাও মহারাজ বিস্তারিত জানালেন।
কৈশোরে পদার্পণ করার পূর্বেই বিশিষ্ট অমাত্যের আত্মজার দল সীমন্তিনী হয়ে যায়; কিন্তু বয়ঃপ্রাপ্তির পূর্বে স্বামীর ঘরে যায় না। তারা পর্যায়ক্রমে তখন কয়েক মাস রাজান্তঃপুরে এসে বাস করে। রাজা যেমন বিদ্যোৎসাহী, পুরুষদের জন্য ক্রমাগত চতুষ্পাঠী খুলে চলেছেন, বড় রানী-মাও তেমনি অন্দরমহলে একটি বিচিত্র চতুষ্পাঠী খুলেছেন। ঐসব শিক্ষানবীশ কিশোরীদের নিয়ে। তাদের নানান বিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা—সীবন, গৃহকার্য, রন্ধন। তাদের পরীক্ষা আর উপাধিদানের ব্যবস্থাও আছে। আজ যেমন ঐ কস্তুরীর রন্ধনের পরীক্ষা। বিচিত্র সে ব্যবস্থাপনা—
মহারাজের জন্য যে দশ-বিশ পদ রান্না করা হয়েছে তার ভিতর মাত্র পাঁচটি পাক করেছে ঐ মেয়েটি, বাদবাকি রন্ধনশিল্পে অত্যন্ত অভিজ্ঞ পাচকবৃন্দ। আহারান্তে রাজা-মশাইকে বলতে হবে—কোন পাঁচটি ‘পদ’ সেই অভিজ্ঞ পাচকবৃন্দের দ্বারা প্রস্তুত নয়। সেটা যদি সনাক্ত করা না যায়, তাহলেই পরীক্ষার্থিনী উপাধি লাভ করবে। আহারের সময়ে ঐ মেয়েটি উপস্থিত থাকবে পরিবেশনের অছিলায়। রাজা মহাশয় তাকে নানান প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন। জেনে নেবেন, রন্ধনবিদ্যায় মেয়েটির জ্ঞান কতদূর। স্বহস্তে যদিচ কখনো রন্ধন করেন না তবু মহারাজ একজন খাদ্য বিশারদ! মরিচ, অম্লাস্বাদ বা লবণাধিক্যের সামান্য হেরফের তো বটেই এমনকি ‘ফোড়ন’-এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তারতম্য পর্যন্ত ধরতে পারেন রসনার অনুভূতিতে। আজ ঐ পরীক্ষার্থিনী যে কোন্ পাঁচটি ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেছে—সেগুলি আমিষ না নিরামিষ, ছেঁচকি-’কৌড়া’-ঘন্ট-কালিয়া না ‘ক্রোকে’ তা পর্যন্ত জানা নাই।
রূপেন্দ্র সহসা করজোড়ে বলে ওঠেন, একটা অপরাধ হয়ে গেছে মহারাজ! আমি বলতে ভুলে গেছি, আমি নিরামিষাশী!
রাজা হাসেন। বলেন মারাত্মক ভ্রান্তি! এখন আর উপায় কি? কিন্তু শুনেছিলাম আপনি শাক্ত?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। মৎস্য ও মাংস ত্যাগ করেছি সম্প্রতি।
—সম্প্রতি? কতদিন?
–ধরুন পক্ষকাল!
রাজার মুখভাব দেখে বোঝা গেল না তিনি কী ভাবছেন। বললেন, আসুন, অন্দরমহলে যাওয়া যাক। শুধু নিরামিষই আহার করবেন। ‘পলাণ্ডু’ সেবা করেন তো?
—আজ্ঞে না!
–তবে তো বড়ই বিপদে ফেললেন। তিন্তিড়ীপত্রের ব্যঞ্জন কি ওরা বানিয়েছে? দেখা যাক। আসুন।
যে কক্ষে ওঁদের মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন সেটিও বৃহৎ। এটি অন্দরমহলে। মর্মরমণ্ডিত কক্ষতল। প্রাচীর শুভ্রবর্ণের পঙ্খের কাজ করা। উপর থেকে ঝুলছে প্রকাণ্ড একটি সহস্রমুখী ঝাড়লণ্ঠন। কক্ষের একপ্রান্তে একটি শ্বেতপাথরের মেজ, তদুপরি পুষ্প পাত্রে কুসুমগুচ্ছ। এখানে প্রাচীরে কোন তৈলচিত্র নাই—একদিকে দেওয়াল-জোড়া প্রকাণ্ড একটি রঙিন রেশমচিত্র। মহাযানধর্মের কোন মাতৃমূর্তি—তারা, মঞ্জুশ্রী, ভৈরবী অথবা প্রজ্ঞাপারমিতা। তিব্বত অঞ্চল থেকে সংগৃহীত। কক্ষকেন্দ্রে দুটি পশমের চতুষ্কোণ আসন, অপূর্ব নক্শাকাটা। দুটি প্রকাণ্ড অন্নপাত্র—রৌপ্যনির্মিত; আর সেদুটি ঘিরে তিনসারিতে কাঁসা অথবা রূপার কটোরা। সেগুলি সমকেন্দ্রিক বৃত্তের আকারে অন্নপাত্রকে বেষ্টন করে আছে। দু-একটি কষ্টিপাথরের পাত্র অথবা খঞ্চা—যাতে ফলমূল মিষ্টান্ন পরিবেশিত—মক্ষিকাবারণ সরপোশে আবৃত।
ওঁরা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করা মাত্র বিপরীত দিক থেকে অগ্রসর হয়ে এলেন রানী-মা। রূপেন্দ্রকে প্রণাম করার উদ্যোগ করতেই তিনি সসঙ্কোচে পেছিয়ে গেলেন। বলেন, না, না, মা। আপনি আমাকে প্রণাম করবেন না।
রানী-মা রূপেন্দ্রর প্রায় সমবয়সী, হয়তো সামান্য দু-চার বছরের ছোট।
মহারাজ বলেন, একটা কথা ভেষগাচার্য বলতে ভুলেছেন। উনি নিরামিষাশী! এখন কী করা যায়?
রানী-মা প্রথমটা বিস্মিতা। তারপরেই হেসে ফেলেন। বলেন, তাতে অসুবিধা কিছু হয়নি। কস্তুরী আজ শুধু নিরামিষ-ব্যঞ্জনই পরিবেশন করেছে।
মহারাজ কস্তুরীর দিকে ফিরে বলেন, কোন ব্যঞ্জনে ‘পলাণ্ডু’ দেওয়া আছে কি?
—না মহারাজ। আপনি তো পূর্বেই নিষেধ করেছিলেন!
—করেছিলাম, না? আজকাল আর কিছুই স্মরণে থাকে না। আসুন, বসা যাক।
রূপেন্দ্র রীতিমত বিস্মিত। বলেন, সে কী! এ ব্যবস্থা কেমন করে হল?
রাজা বললেন, শোনেননি—’রাজা কৰ্ণেন পশ্যতি!’
কৃষ্ণচন্দ্র অত্যন্ত বিচক্ষণ। ভারতচন্দ্রের নিকট পূর্বেই তথ্যটা সংগ্রহ করেছেন। রূপেন্দ্রের আহাররুচি বিষয়ে। কস্তুরীকে বললেন, ইনি আমার মতো কলির ব্রাহ্মণ নন, আহারকালে বাকসংযম করে থাকেন। ফলে তুমি এখনই কিছু আভাস দিয়ে রাখ মা—কোন কটোরায় ক পরিবেশিত।
ওঁরা দুজনে আসনে উপবেশন করলেন। সম্মুখে মর্মর গৃহতলে বসল মেয়েটি। তার হাতে একটি রৌপ্যদণ্ড, তার শেষপ্রান্ত আঁকশির মতো বাঁকানো। ভোজনকারী উপবিষ্ট-অবস্থা তৃতীয় সারির কাটোরার নাগাল পায় না। তাই এই ব্যবস্থা। রৌপ্যযষ্টির সাহায্যে কস্তুর কটোরাগুলিকে আগিয়ে-পেছিয়ে দিতে পারবে। অনুরুদ্ধ হয়ে কস্তুরী মুখস্ত বলার মতে ভোজ্যদ্রব্যগুলির জাতনির্ণয় করে গেল।
বামদিক থেকে প্রথম সারিতে সর্বপ্রথম একটি ক্ষুদ্র সুবর্ণ-কাটোরায় গব্য ঘৃত। তারপর কিছু ভাজা-সবজি—পনসবীজ ও চালকুমড়োর বুকো-বড়া, লাউডগার পোড়ে-ভাজা শাপলা-ভেলার পাটভাজা। তিনরকম ডাইল—আমড়া-মুকুলের মটর-ডাল, কমলালেবু-ছান সহ ঘন মুগ ডাল এবং ওলকপি মিশ্রিত ছোলার ডাল। দ্বিতীয় সারিতে কাঁচা-পেঁপের চাপরঘণ্ট ছানার পাতুরি, বড়ি-সহযোগে পালং-ঝোল, লাউ-পোস্ত, কাঁচকলার ধোকা-ডালনা জলপাইয়ের মাখা-চাটনি, পাপড় ভাজা। এরপর তৃতীয় সারি—ক্ষীর, দধি, ও নানান মিষ্টান্ন যেগুলি সরপোশে ঢাকা[১]।
[১. হয়তো লক্ষ্য করেছেন, নিরামিষ রান্নায় ‘আলুর উল্লেখ নেই। মধ্যযুগে ডাল, আলু, টমেটো প্রভৃতি বাঙালীর খাদ্য ছিল না। আমাদের কাহিনীর কালে ‘ডাইল’-এর শুভাগমন ঘটেছে। ওলকপিরও। আলুর আবির্ভাব হতে আরও অর্ধশতাব্দী বাকি।]
রূপেন্দ্র বলেন, এ তো আমার এক সপ্তাহের খাদ্য, মহারাজ, এত কি খাওয়া যায়?
—হয়তো যায়, হয়তো যায় না। আপনার যা অভিরুচি তাই গ্রহণ করুন। অপচয় হবে না কিছু। ব্রাহ্মণের সেবান্তিক অবশেষ গ্রহণের লোকের অভাব নেই।
রূপেন্দ্রর নজর হল, কর্পূর-মিশ্রিত পানীয় জল পরিবেশিত হয়েছে দুটি সুবর্ণ-পাত্রে। তার পাশে রাখা আছে মোরাদাবাদী-কাজ করা একটি অপূর্ব রৌপ্য-ভৃঙ্গার এবং একটি পিতলের বড় পাত্র। এ জাতীয় ভৃঙ্গারে সচরাচর মাধ্বী পরিবেশিত হয়। আহার-থালিকার পার্শ্বে সেটি কেন রাখা আছে বোধগম্য হল না। সে বিষয়ে প্রশ্ন করতেও সঙ্কোচ হল।
মহারাজ বললেন, কস্তুরি, তুমি তিন্তিড়ী-পত্রের ব্যঞ্জন করনি?
কস্তুরী অবাক মানে। জবাব জোগায় না। তার হয়ে রানী-মা বলে ওঠেন, না! এ তো আরণ্যক-আশ্রম নয়, এখানে তিন্তিড়ী-ব্যঞ্জনে নানান ‘অনুপপত্তি’!
কস্তুরী বুঝল না। কিন্তু যাঁরা বোঝার তাঁরা বুঝলেন।
এবার মহারাজ বলেন, পেট ভরবে কী ভাবে? ‘শাক, মোচাঘণ্ট, ভুষ্ট-পটোল নিম্বপাত কিছুই নাই…
এবারও কস্তুরী বিহ্বল এবং এবারও জবাব দিলেন রানী-মা; সে-সব সাত্ত্বিক আহার, রাজসিক নয়। ও আপনার পরিপাক হত না।
রূপেন্দ্র বুঝতে পারেন—রানী-মা নিরক্ষরা নন—কৃষ্ণদাস গোস্বামীর শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত তাঁর ভালভাবেই পড়া। অন্নপাত্রে নৈবেদ্যর মতো চূড়ো করে রাখা মূল ভোজ্যদ্রব্যটি অন্ন নয়, ভর্জিত-অন্ন অর্থাৎ পলান্ন। তার এক-এক দিক এক-এক রঙের। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ ও সাদা। কীভাবে পলান্নের এই বর্ণ-পার্থক্য হয়েছে বুঝে উঠতে পারেন না। মহারাজ সে বিষয়েই প্রশ্ন করলেন কস্তুরীকে। মেয়েটি জানালো—কোচিনীল দিয়ে রক্তবর্ণ, জাফরান-সহযোগে হলুদ রঙ, সুপুরি মিহি গুঁড়ো করে তার সঙ্গে কালোজামের রস মিশিয়ে নীল রঙ করা হয়েছে। আর সবুজ রঙ তো হলুদ-নীলের সমাহার। মহারাজের প্রশ্নের জবাবে কস্তুরী জানালো এর মূল উপকরণ: গোবিন্দভোগ মিহি পুরাতন চাউল আড়াই পোয়া, গব্যঘৃত এক পোয়া, শর্করা দেড় ছটাক, পাতি লেবুর রস এক ছটাক। আন্দাজ মতো ঘন দুধের সর, তিনচারটি বাদাম বাটা। ছোট এলাচ আটটি। লবঙ্গ সাতটি। দারুচিনির ছোট টুকরো দশটি। সামান্য কালিজিরা ও চার-পাঁচটি তেজপাতা। ‘আকনির’ জন্য প্রয়োজন—সা-জিরে, ধনিয়া, তেজপাতা, আদ্রক ও দারুচিনি। এই বিচিত্র ভোজ্য দ্রব্যটি নাম: ‘পঞ্চরঙ অপলান্ন’।
মহারাজ বললেন, ‘পঞ্চরঙ’ তো বুঝলাম, কিন্তু ‘অপলান্ন’ অর্থ কী?
—মহারাজ, পলান্ন হচ্ছে ‘পল যুক্ত অন্ন’। ‘পল’ অর্থে মাংস। যেহেতু এটি নিরামিষ পদ তাই এর নাম ‘অপলান্ন।
মহারাজ গৃহিণীর দিকে দৃকপাত করে বলেন, তুমি একে উপাধি দিতে পার : পাকশিরোমণি!
রানী হেসে বলেন, এখনই কী? সেবা হোক। দেখি, পঞ্চ গুপ্তব্যঞ্জনকে সনাক্ত করতে পারেন কি না।
অতঃপর দুজনে পঞ্চদেবতাকে অন্নদান শুরু করলেন। দেখা গেল, অন্ন গ্রহণকালে মহারাজও বাকসংযম করে থাকেন, যদিচ পূর্বে তিনি নিজেকে ‘কলির ব্রাহ্মণ’ বলেছেন।
রূপেন্দ্র এবার বুঝতে পারেন—ঐ কারুকার্যমণ্ডিত রৌপ্যভৃঙ্গার এবং পিতলের গামলাটি কেন রাখা আছে। মহারাজ প্রত্যেকটি কটোরা থেকে সামান্য—কখনো কণিকামাত্র খাদ্য অন্নপাত্রে উঠিয়ে নিচ্ছেন এবং তার রসাস্বাদনান্তে ভৃঙ্গারের জলে মুখ প্রক্ষালন করে চলেছেন। না হলে, পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনের স্বাদগন্ধ পরবর্তীতে অনুভূত হবে—খাদ্যবিচারে ভ্রান্তি হয়ে যেতে পারে।
রূপেন্দ্র বুঝতে পারেন—রন্ধন যেমন শিল্পকর্ম তেমনি তার প্রকৃত রসাস্বাদনও একটি চারুকলা। খাদ এতদিন উদরপূর্তির উপকরণ বলেই জানা ছিল। নদীয়া রাজের আতিথ্য গ্রহণ না করলে তিনি বুঝতে পারতেন না ‘ভোজন’ও একটি চারু-শিল্প!