কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

সোঞাই – ১৩

১৩

পার্শ্ববর্তী গ্রামে যে গৃহে গিয়েছিলেন সেখানেও ছিল একটি মৃত্যুপথযাত্রী রোগী। সারাটা দিন সেখানে থাকতে হল। সেটিও ব্রাহ্মণবাড়ি। বাধ্য হয়েই সেখানেই মধ্যাহ্ন-আহার সারতে হল। অপরাহ্ণ বেলায় রোগীর অবস্থা কিছু ভালোর দিকে পরিবর্তিত হওয়ায় ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করে গ্রামের দিকে ফিরতে থাকেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে একটি অশ্ব ক্রয় করেছেন সম্প্রতি। সৈনগুপ্ত তার নাম। নিজেই তাকে দানাপানি দেন, পরিচর্যা করেন। জীবন দত্তও করে।

সমস্ত দিন একটি রোগপাণ্ডুর মুখের ছবি ভাসতে থাকে তাঁর মনের পটে। মেয়েটি ‘অনাথা’। গোঁসাইজী লিখেছেন। ‘নাথ’ অর্থ কি স্বামী? অর্থাৎ বিধবা? কে জানে? সধবা যে নয়, এটুকু বোঝা যায়। কিন্তু একটি ‘অনাথা’,হতভাগিনীর বাবদে মোহন্ত-মহারাজ এত অর্থব্যয় করছেন কেন? সে কি ওঁর ‘সেবাদাসী? আবার লিখেছেন সে শুধু ‘হতভাগিনী’ নয়, ‘ভাগ্যবতী’–-‘রাইরানী’ হওয়ার জন্য দৈবনির্বাচিতা। মেয়েটিকে ঘিরে একটা রহস্যজাল গড়ে উঠছে বলেই কি ওঁর এই চিত্তচাঞ্চল্য? সে শুধু আর্ত নয়—সে বিশেষ!

গৃহে যখন প্রত্যাবর্তন করলেন তখনো সন্ধ্যা নামেনি। দেখলেন, গো-শকটটি বৃক্ষচ্ছায়ায় অপেক্ষারত। রোগিণীর এখনো জ্ঞান হয়নি। কাত্যায়নী বসে আসে তার শিয়রের কাছে। আর কোন জনমানব নেই।

—কেমন আছে রে? জ্ঞান হয়েছিল?

—পুরো জ্ঞান হয়নি। দুপুরে একবার চোখ মেলে তাকিয়েছিল।

—এরা সব কোথায়?

কাত্যায়নী জানায়, প্রৌঢ়া মধ্যাহ্ন আহারান্তে নিদ্রাগতা। এখনো ঘুমাচ্ছে। বোধ করি পূর্বরাত্রে সম্পূর্ণ জাগরিত থাকতে হয়েছিল তাকে গো-যানে। সেপাইগুলো কে-কোথায় কাতু জানে না। রোগিণীর জ্বরতাপ দেখলেন কপালে হাত দিয়ে। জ্বর অনেকটা কমেছে। নাড়ি দেখলেন—হ্যাঁ, ঔষধে কাজ হয়েছে। নাড়ির গতিবেগ উন্নতির দিকে।

বললেন, সারা রাত ওকে এখানে রাখা ঠিক নয়। কার্তিকের হিম সহ্য হবে না। তুই ঘরে একটা বিছানা পেতে দে।

কাত্যায়নী জানায় আরোগ্য নিকেতনের নবনির্মিত একটি কক্ষে সে বিছানা পেতে রেখেছে। কিন্তু সেপাইগুলো ফিরে না আসা পর্যন্ত কী করে রোগিণীকে স্থানান্তরিত করা সম্ভব?

রূপেন্দ্রনাথ বলেন : সে তোকে ভাবতে হবে না। তুই একটু দুধ গরম করে নিয়ে আয়। নড়াচড়ায় যদি ঘুম ভেঙে যায় তাহলে দুধটুকু খাইয়ে দেওয়া যাবে। আমিই ওকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাব।

সহজ সরল নির্দেশ, কিন্তু কাতুর বুঝি তা মাথায় ঢুকল না। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তার দাদার দিকে। ফলে ধমক খায়, কী বললাম মাথায় ঢুকল না? আমি তো সংস্কৃতে বলিনি কাতু।

থতমত খেয়ে কাত্যায়নী তৎক্ষণাৎ স্থানত্যাগ করে। রূপেন্দ্রনাথ এপাশে ফিরে এগিয়ে আসেন রোগীকে স্থানান্তরিত করতে। ঠিক তখনি পশ্চিমাকাশে অস্তসূর্য মুক্তি পেল মেঘের বন্ধন থেকে। এক মুঠি হলুদ—আবীর রোদ ছড়িয়ে দিলেন সূর্যদেব শেষ বিদায়ের পূর্বে। রূপেন্দ্রনাথের মনে পড়ে গেল আয়ুর্বেদশাস্ত্রের নির্দেশ : ‘বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তে সূর্য যেমন প্রকৃতির ললাটে শেষ চুম্বন চিহ্ন এঁকে দিয়ে যায় তেমনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে রোগীর ললাটে ফুটে ওঠে এক মহিমাময় দ্যুতি।’

এই অস্তসূর্যের ‘কনে-দেখা আলোয় রোগীর ভ্রমধ্যে তেমন কোন দ্যুতি ফুটে উঠেছে কি না দেখবার জন্য ধন্বন্তরি মুখটা ওর অচৈতন্য আননের সন্নিকটে নিয়ে এলেন।

আর তৎক্ষণাৎ সত্যটা প্রণিধান করলেন : ও রোগী নয়, রোগিণী! পূর্ণযৌবনা একটি নারী!

বুঝতে পারেন, কেন কাতু অমন অবাক চোখে তখন তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল। তার জ্ঞানত দাদা কখনও কোন নারীদেহ এভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে বহন করে নিয়ে যায়নি।

নজর হল, অসাবধানে মেয়েটির বক্ষাবরণ কিছুটা অপসারিত। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে তার প্রাণধারণের প্রেরণা বক্ষের যুগ্মকামনায় ফুলে-ফুলে উঠছে। অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করলেন দৃশ্যটায়। ভ্রমধ্যে নজর গেল না।

বরং স্মরণ হল আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অপর একটি শ্লোক : ‘তৃতীয় ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে যৌবনপ্রাপ্তা কোনও নারীদেহ কদাচ পরীক্ষা করিবে না। তার দেহস্পর্শ করিবে না।’

নির্দেশটির অর্থ, উদ্দেশ্য, প্রাঞ্জল। কিন্তু সে নির্দেশের কি ব্যতিক্রম নাই? নির্জন প্রান্তরে যদি কোন মুমূর্ষু যৌবনপ্রাপ্তার সন্ধান পান, তাহলে তাকে উপেক্ষা করে পলায়ন করতে হবে—যেহেতু তৃতীয় ব্যক্তি অনুপস্থিত? বিবেকের নির্দেশকে নস্যাৎ করতে হবে—যেহেতু শাস্ত্রীয় অনুশাসনটি দেবনাগরী হরফে সংস্কৃতে রচিত?

মনস্থির করলেন পণ্ডিত। না, এ অনুশাসন তিনি মানেন না, বর্তমান অবস্থায়-মানতে রাজি নন। প্রথমেই ঐ অচৈতন্যার আঁচলটি টেনে দিলেন বুকের উপর। একগুচ্ছ রুক্ষ কুন্তলচূর্ণ এসে পড়েছিল কপালের উপর—-আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিলেন তা। তারপর একটি হাত সাবধানে স্থাপন করলেন ওর মাথার নিচে, দ্বিতীয় হাত জানুদ্বয়ের তলা দিয়ে। অনায়াসে মেয়েটিকে পাজাকোলা করে তুলে নিলেন বুকে।

কী হাল্কা। যেন একটি কবুতর।

অতি সাবধানে মূর্ছিতাকে বহন করে নিয়ে এলেন নির্দিষ্ট কক্ষে। সেখানে সদ্যরচিত ‘শয্যাপার্শ্বে দুধের পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে ‘কাত্যায়নী। পথের দিকে নজর থাকায় রূপেন্দ্রের খেয়াল হয়নি, কোলে তুলে নেওয়ার পরমুহূর্তেই মেয়েটি চোখ মেলে তাকিয়েছে। ওঁর বাহুবন্ধে এলায়িততনু মেয়েটি নির্নিমেষ নয়নে ওঁকেই দেখছিল এতক্ষণ। শয্যায় তার দেহটি স্থাপিত করার উপক্রম করতেই সে দুই বাহু দিয়ে সবলে ওঁর কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরল। তার দুটি চোখে ততক্ষণে আনন্দের জোয়ার। অস্ফুটে সে বললে, এসেছ? এত দেরী হল যে?

একটা বিদ্যুত-তরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে গেল রূপেন্দ্রের সর্বদেহে। ভারমুক্ত হতে পেরেছেন, কিন্তু বন্ধনমুক্ত নয়। বুঝতে অসুবিধা হয়নি—এ ঘোর প্রলাপ। অসংলগ্ন উক্তি! কাকে কী বলছে, তা ও জানে না। কিন্তু রজ্জুতে সর্পভ্রম হলে ভ্রমাত্মক ব্যক্তির সর্পদর্শনজাত ভীতি যেমন নিখাদ, এই প্রলাপোক্তিও তেমন একটা মিথ্যা মোহের বাস্তব মাদকতা বিস্তার করতে চাইছে যেন।

নিরুপায় রূপেন্দ্র ভগিনীকে আদেশ দিলেন, পিছন থেকে ওর হাতের বাঁধন আলগা করে দে।

দুধের পাত্রটা নামিয়ে রেখে কাত্যায়নী এগিয়ে এল। আদেশ পালন করল। রূপেন্দ্ৰ বন্ধনমুক্ত হলেন। দেখলেন রোগিণী পুনরায় অচৈতন্য। কিন্তু তার পূর্বেই তিনি অনুভব করেছেন ঐ মৃত্যুপথ যাত্রিণীর আর্তি—য়ে বাঁচতে চায়! কিছুক্ষণ পূর্বে দৃষ্টির মাধ্যমে মনে হয়েছিল নিশ্বাস-প্রশ্বাসের তালে-তালে ওর যুগ্মবক্ষের স্ফীতি শুধুমাত্র প্রাণধারণের তাগিদে, এখন স্পর্শের মাধ্যমে বুক দিয়ে, হৃদয় দিয়ে, অনুভব করেছেন—না, ও শুধু মানবশিশু হয়েই বাঁচতে চাইছে না—নারী হিসাবে বেঁচে উঠতে চাইছে।

রোগিণীর দিকে যেন আর তাকিয়ে দেখতে পারছেন না। নতমস্তকে আত্মস্থ হতে চাইছেন। কাতু বললে, ঐ কথাটা ও কেন বললে দাদা?

—প্রলাপ। বিকারের ঘোরে।

—তা বুঝেছি। কিন্তু ও তোমাকে ভুল করে কাকে ভেবেছিল?

—ওর কোন নিকট-আত্মীয়। দাদা-টাদা হবে।

—দাদা?

এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। ধমক দিয়ে ওঠেন, দাদা কি বাবা, কি পিসেমশাই তা কি আমার জানার কথা? তুই বড় বোকার মতো কথা বলিস কাতু। দে, পারিস তো দুধটুকু খাইয়ে দে।

স্থানত্যাগ করেন। পলায়নই বলা যায়। কারণ, কাত্যায়নীকে ধমক দিলেও বোঝেন—যেমন কাতু বুঝেছে—ঐ আকুলতা, ঐ সম্ভাষণ দাদা, বাবা, পিসেমশায়ের প্রতি প্রযুক্ত নয়। মেয়েটি নিঃসন্দেহে বিধবা। বিকারের ঘোরে সে তার মৃত জীবনমরণের সাথীকেই দেখতে পেয়েছিল খণ্ডমুহূর্তের জন্য।

এতক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বাড়ির দাওয়ায় এসে বসলেন। রোগিণীর কথা নয়, নিজের কথাই চিন্তা করতে থাকেন। ন্যায়ের সেই সূত্রটিকেই বিচার করতে বসেন মনে মনে : ঠিক কথা। রজ্জুতে সর্পভ্রম হলে ভ্রমাত্মক ব্যক্তির ভীতির পরিমাপটা সমানই হওয়ার কথা; কিন্তু সে ব্যক্তির যদি পূর্বজ্ঞান থাকে যে, ওটা সর্প নয়, রজ্জু? তাহলে সে ভয় পাবে কেন? রূপেন্দ্রনাথ তো উচ্চারণ মাত্র বুঝতে পেরেছিলেন—মেয়েটির ঐ উক্তি নিতান্ত প্রলাপ। তাঁর দিকে দৃপাত করে শব্দকয়টি উচ্চারিত হলেও উদ্দিষ্ট ব্যক্তি তৃতীয় ব্যক্তি। তাহলে? বিগতভর্তা যুবতীর প্রলাপোক্তিতে তিনি বিচলিত হলেন কেন? তার স্বামীর উদ্দেশ্যে উচ্চারিত প্রেমসম্ভাষণে তিনি শিহরিততনু হন কোন অধিকারে? এ তো পর্স্বাপহরণ!

—রুপেন আছ নাকি?

চমকিত হয়ে দেখেন তারাপ্রসন্ন এগিয়ে আসছেন। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। কৃষ্ণপক্ষের রাত। এক আকাশ তারা। পল্লীর বিভিন্ন কুটিরে শঙ্খধ্বনি নীরব হয়েছে। একটানা ঝিঝি পোকার ডাক। ঝোপেঝাড়ে শুধু মুঠো-মুঠো জোনাকি।

—তারাদা নাকি? এস, বস।

নিজে বসেছিলেন মেঠো দাওয়ায়। তারাপ্রসন্নের জন্য একটি চৌপায়া এগিয়ে দিলেন। তিনি সেটি সরিয়ে দিয়ে ঘনিয়ে এসে বসলেন। বললেন, মেয়েটি বাঁচবে?

—তুমি জানলে কী করে?

—মোহন্ত মহারাজ বাবামশাইকেও একটি পত্র লিখেছেন যে। কুসুমমঞ্জরীকে পাঠিয়ে দিয়েছেন তোমার কাছে। চিকিৎসা করাতে।

—কুসুমমঞ্জরী? মেয়েটির নাম?

—হ্যাঁ। তুমি জানতে না? ওর যে এ বছর রাইরানী হওয়ার কথা।

—‘রাইরানী’ কাকে বলে তারাদা?

—ও। তুমি বুঝি কিছুই জান না? শোন।

তারাপ্রসন্ন দীর্ঘ কাহিনী শোনালেন। এসব বৃত্তান্ত তাঁর ভাল ভাবে জানা। নিতান্ত ঘটনাচক্রে। তারাপ্রসন্নের প্রথমা পত্নী তারাসুন্দরী—ভাদুড়ী-বাড়ির ঐ রেওয়াজ, অর্থাৎ বিবাহের পর প্রথমা পত্নীর নাম হয়ে যায় স্বামীর নামে—রূপনগরের মেয়ে। তিনি কুলীন বারেন্দ্র ঘরের সুন্দরী বালিকা ছিলেন। তাঁর পিতৃদেবের উপাধি সান্যাল—বাৎস্যগোত্র। কন্যা সন্তানের ফুটফুটে রূপ দেখে শৈশবেই সান্যাল মশাই আত্মজাকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেন। স্বগ্রামে আনয়ন করতেন না—পাছে কারও নজর পড়ে যায়। তারাপ্রসন্ন বিবাহ করতে যান স্ত্রীর মাতুলালয়ে, পিতৃগৃহে নয়!

—কারও নজরে পড়ে যায়’ মানে?

ধর্মপত্নীর কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যগুলিই এবার সবিস্তারে বর্ণনা করতে থাকেন : প্রেমদাস মোহান্ত একটি নববৃন্দাবন রচনা করেছেন। বৃন্দাবনে যেমন এক কৃষ্ণ আর ষোড়শ গোপিনী, রূপনগরেও তারই প্রতিচ্ছবি। মোহান্ত বাবাজীর অসংখ্য গোপিনী, কিন্তু ‘রাইরানী মাত্র একজনই। এক বৎসরের মেয়াদে। প্রতি বৎসর রাসপূর্ণিমার দিন নির্বাচিত হয়ে যায় পর বৎসর রাসপূর্ণিমায় কোন ষোড়শী ‘রাইরানী’ হবে। দ্বাদশমাসে দ্বাদশবার প্রতি-পূর্ণিমায় তার কাছে ভেট যায়—মুর্শিদাবাদী রেশমের শাড়ি, অলঙ্কার, গন্ধদ্রব্য, অগুরু-চন্দন। সেবাদাসীরা তার অঙ্গমার্জনা করে, তাকে নানান আভরণে সাজায়। এই এক বৎসরকাল সে কিন্তু গোবিন্দদর্শনে বঞ্চিতা। মন্দিরে তার আসার অধিকার নেই। তখন তার বিরহের কাল। প্রতি পূর্ণিমায় আখড়ার ব্যবস্থাপনায় মন্দির-সংলগ্ন নাটমঞ্চে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রেমদাস বাবাজী এসে বসেন। আশীর্বাদ করেন। ‘মাথুর পালা’ গীত হয়। বিরহের গান। তারপর দ্বাদশ মাস বিরহযাপনান্তে রাসপূর্ণিমায় মেয়েটিকে ‘রাইরানী সাজানো হয়। হস্তিপৃষ্ঠে তাকে নগর প্রদক্ষিণ করানো হয়। মুহুর্মুহু পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। নগরবাসী হরিসংকীর্তন করতে করতে অনুগমন করে। সন্ধ্যায় শোভাযাত্রা এসে থামে গোবিন্দ মন্দিরে। সেদিন সান্ধ্য-আরতির অধিকার ঐ ভাগ্যবতীর। অতঃপর কীর্তন। এবার মিলনের গান। মধ্যরাত্রে আসর ভাঙে। বরমাল্য নিয়ে তখন রাইরানী প্রবেশ করেন গোবিন্দজীর শয়নকক্ষে—মন্দিরে নয়, মন্দির-সংলগ্ন একটি পুষ্পশোভিত ফুলশয্যাগৃহে। প্রেমদাস বাবাজী পট্টবস্ত্র পরিধান করে, চন্দন-তিলক সেবা-অন্তে গোবিন্দের তরফে তার পাণিগ্রহণ করেন। তাকে আশীর্বাদ করেন। রাইরানীর জীবনযৌবন ধন্য হয়ে যায়।

এক বৎসরের মেয়াদ। পরবর্তী রাসপূর্ণিমা পর্যন্ত। তখন আবির্ভূতা হন নতুনকালের নবীনা রাইরানী। বাসিফুলে কি দেবতার পূজা হয়? তবে নাকি দেবতাদের একটি দিবারাত্র মানবিক বিচারে এক বৎসর, তাই এই বৎসরান্তিক পালাবদলের পালা।

পুরাতনী? সে তখন আর রাইরানী নয়—সেবাদাসী। অসংখ্য সেবাদাসীর অন্যতমা কখনো বা গোবিন্দের ঐ নির্মাল্যটি কাঞ্চনমূল্যে মাথায় করে গৃহে নিয়ে যায় রূপনগরের কোনও বিত্তশালী বৈষ্ণবসাধক—সেবাদাসী করে। তার প্রণামীতে স্ফীত হয় দেবতার তহবিল। গোবিন্দের ইচ্ছেয় যার অধিকার একমাত্র প্রেমদাস বাবাজীর।

একটা নিরুদ্ধ আক্রোশে ফেটে পড়তে ইচ্ছা করছিল রূপেন্দ্রনাথের। আশ্চর্য! এই হচ্ছে হিন্দু সমাজ! এই হচ্ছে ধর্মের স্বরূপ। এতবড় একটা ক্লেদাক্ত অনাচারকে সারা দেশ মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। কেউ রুখে দাঁড়ায় না। বরং দু-হাত তুলে হরিসংকীর্তন করতে করতে পাপাচারকে ধর্মীয় প্রলেপ দেয়।

—কী মনে হয়? মেয়েটি বাঁচবে?

রূপেন্দ্র বলেন, আয়ুর্বেদশাস্ত্রের নির্দেশ আজ লঙ্ঘন করতে ইচ্ছা করছে, তারাদা। মৃত্যুকে প্রতিহত করতে ওর পক্ষে একটিই ঔষধ—এক পুরিয়া বিষ!

তারাপ্রসন্ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কী করবে বল ভাই, রূপেন্দ্র? এই হচ্ছে হিন্দুধর্ম।

তিক্তকণ্ঠে রূপেন্দ্র বলেন, ওরা বলুক, কিন্তু তুমিও একথা বললে তারাদা? এই ধর্ম? ধর্ম কী? ‘ধৃ’-ধাতুতে গড়া ‘ধর্ম’ হচ্ছে পিলসুজ, যা ধরে রাখে। কিন্তু কাকে ধরে রাখে? যারা তার বিকৃত ব্যাখ্যা করে কামচরিতার্থ করছে, তাদের? না! ‘ধর্মং যো বাধতে ধর্মো ন স ধর্মঃ কুবৰ্ত্ত তৎ—‘ স্বয়ং বেদব্যাসের উক্তি। মঙ্গলকে, শিবকে যে ধারণ করে তাই ধর্ম—পাপকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ধর্ম নয়।

তারাপ্রসন্ন বলেন, কিন্তু আমরা যে নিরুপায় ভাই। এটাই যে সামাজিক নির্দেশ।

—সমাজ! হাঃ! ‘সমাজ’ শব্দটা পুংলিঙ্গ, তারাদা। ক্লীবলিঙ্গ নয়। তোমরা, বঙ্গদেশের ভূস্বামীরা রুখে দাঁড়াও, দেখি আমরা সমাজটাকে বদলাতে পারি কি না।

—আমি ভূস্বামী নই রূপেন্দ্র। তাই বাবামশায়ের তরফে তোমাকে ডাকতে এসেছি। তিনি অবিলম্বে তোমাকে একবার দেখা করতে বলেছেন।

—এখনই চল। ঐ মেয়েটির বিষয়ে আলোচনা?

—সম্ভবত না। বাবামশাই কাল প্রত্যুষে কাটোয়া যাচ্ছেন। আমাকে তো বললেন, পিতৃপক্ষে গঙ্গাতীরে তর্পণ করতে যাচ্ছেন; কিন্তু আমার মনে হল আরও কিছু গভীর উদ্দেশ্য আছে। কাল থেকে মনে হচ্ছে তিনি বেশ উত্তেজিত। ক্রমাগত পদচারণা করে চলেছেন। আমি এই একটু আগে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম ঐ কুসুমমঞ্জরীর বিষয়ে; তিনি এককথায় আমাকে থামিয়ে দিলেন।

—এককথায় থামিয়ে দিলেন! কী বললেন তিনি?

—বললেন, রূপনগরের মোহন্ত মহারাজ অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। তাঁর বিরুদ্ধাচরণ কোনভাবেই করা উচিত হবে না। তাছাড়া রূপেন্দ্র চিকিৎসক—এসব বিষয়ে তার মাথা না ঘামালেও চলবে।

রূপেন্দ্রর একটা আঘাত লাগল। জেঠামশাই বৃদ্ধ, প্রাচীনপন্থী, কিন্তু তাঁকে সংস্কারাচ্ছন্ন কূপমণ্ডূক বলে মনে হয়নি কখনো। তাঁর এ সিদ্ধান্তে ব্যথা পাওয়ারই কথা। প্রশ্ন করেন, তুমি কী পরামর্শ দাও?

—আমি কী বলব? বাবামশাই যখন…

তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দেন, না! আমি তোমার ব্যক্তিগত মতামত জানতে চাইছি তারাদা। ধর, জেঠামশাই আগামীকালের বদলে যদি গতকাল কাটোয়া রওনা হয়ে যেতেন? তাহলে তাঁর অনুপস্থিতিতে সিদ্ধান্তটা তো তোমাকেই নিতে হত। তুমি সে ক্ষেত্রে কী করতে?

তারাপ্রসন্ন একটু চিন্তা করে বলেন, আমি সে ক্ষেত্রে গোঁসাই মহারাজকে জানিয়ে দিতাম, মেয়েটির সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অল্প; তিনি যেন বিকল্প ব্যবস্থা করেন।

—অর্থাৎ ওর পরিবর্তে আর কোন ছাগশিশুকে যূপকাষ্ঠে প্রেরণ করতে!

—তাহলে তুমি কী করতে বল?

—শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ। আমাদের ছলনার আশ্রয় নিতে হবে। আমরা জানিয়ে দেব, রাসপূর্ণিমার পূর্বেই মেয়েটি সুস্থ হয়ে যাবে। বিকল্প ব্যবস্থার কোন প্রয়োজন নাই। তারপর একেবারে শেষ মুহূর্তে জানিয়ে দেব মেয়েটি সুস্থ হল না। এমনটা তো হতেই পারে।

—মিথ্যাচার? তঞ্চকতা?

—না! সত্যাচার! ধর্মরক্ষা।

—তাতে কী লাভ?

—অন্তত একটি বছর একটি মেয়ে রক্ষা পাবে। গতবৎসর যে মেয়েটি রাইরানী হয়েছে—তার তো যা সর্বনাশ হবার হয়েই গেছে—তার মেয়াদ এক বৎসর বৃদ্ধি পেয়ে যাবে, অজানা-অচেনা এক কামুক শ্রেষ্ঠীর অঙ্কশায়িনী হবার যন্ত্রণাটা পিছিয়ে যাবে।

তারাপ্রসন্নের ভ্রুকুঞ্চন হল। বললেন, রূপেন্দ্র, আমাকে খোলাখুলি বল তো, বাবামশাই যদি বারণ করেন তা সত্ত্বেও তুমি এই ছলনার আশ্রয় নিতে চাও?

মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে রূপেন্দ্র বলেন, আমিই রোগিণীর অভিভাবক। তার ভালমন্দ আমাকেই দেখতে হবে।

তারাপ্রসন্ন ‘ওর হাতখানা টেনে নিয়ে বলেন, তুমি আগুন নিয়ে খেলা করতে চা‍ইছ রূপেন্দ্রনাথ। প্রেমদাস মোহন্তের গুপ্তচর সমস্ত রাঢ়খণ্ড ঘুরে বেড়ায়। অত্যন্ত কুটকৌশলী সে। অপরিসীম তার ক্ষমতা। তার নিজস্ব সৈন্যদল আছে। টের পেলে সোঞাই গ্রামখানাকে সে নিশ্চিহ্ন করে দেবে!—

—মুসলমান রাজত্বে সে গোসাই মানুষ এতটা ক্ষমতা পেল কী করে? আর কোন সম্প্রদায়ের হিন্দু সাধকের নিজস্ব সৈন্যদল আছে বলে তো শুনিনি।

—না। প্রেমদাস বাবাজী সে দিক থেকে এক দুর্লভ ব্যতিক্রম। ‘অঙ্গাঙ্গিভাবমজ্ঞাত্বা কথং সামর্থ্যনির্নয়ঃ?[১]—বাবাজীর মুরুব্বির জোর আছে। তুমি জানতে না?

[১. কার সঙ্গে কী জাতের খাতির আছে তা না জানা পর্যন্ত কারও প্রকৃত ক্ষমতা বোঝা যায় না।]

—না। কে মুরুব্বি?

—স্বয়ং ফতেচাঁদজী!

—বল কী। কিন্তু তিনি তো বৈষ্ণব নন?

—না। শোন বলি—

ফতেচাঁদজীর নাম শুনেই তাঁকে চিনতে পেরেছেন রূপেন্দ্রনাথ। আপনি-আমিও চিনব। তবে নামে নয়, কৌলীক উপাধিতে। আপাতত তারাপ্রসন্ন-কথিত কাহিনীটি শোনাই—

ফতেচাঁদ ছিলেন নিতান্ত গরিব পিতামাতার সন্তান। সুদূর রাজস্থান থেকে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিলেন বঙ্গদেশে। কিশোর বয়সে। অত্যন্ত সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান, উচ্চাভিলাষী ও বুদ্ধিমান। কৌতূহলী হয়ে রূপনগরে এসেছিলেন রাসের মেলা দেখতে। সেখানে খুব জমকালো রাসমেলা হয়। সে বৎসরের নির্বাচিতা রূপনগরের রূপবতীকে হস্তিপৃষ্ঠে নগর প্রদক্ষিণ করানো হয় সন্ধ্যায় প্রেমদাস বাবাজীর রাসলীলার আসর। সে এক দুর্লভ দৃশ্য। রাসমঞ্চের কেন্দ্রবিন্দুতে রাইরানীকে পাশে নিয়ে সিদ্ধপুরুষ প্রেমদাস মোহন্ত—একমেবাদ্বিতীয়ম্ শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক। আর তাঁকে ঘিরে তালে তালে নৃত্যরতা বিশ-বাইশজন গোপিনী। ষোলো থেকে ছত্রিশ—যারা প্রাক্তন রাইরানী, বর্তমানে গোপিনী। তাদের পরিধানে টাইট ‘চো আর কাঁচুলি—মোগলাই কখক নর্তকীদের ঢঙে। নিম্নাঙ্গে ঘাঘরা এবং বরাঙ্গে ওড়না। ঢাকাই মসলিনের। এতই স্বচ্ছ যে, যৌবনপুষ্ট তনুদেহের স্বরূপ অনুধাবনে ‘ভক্তদের কোন বাধা সৃষ্টি করে না। এমনকি ইতিমধ্যে যেসব গোপিনী অন্য কোন ধনীভক্তের সেবাদাসী হবার সৌভাগ্য লাভ করেছেন, তারাও ঐ বার্ষিক উৎসবে যোগদান করতে আসে। নৃত্যগীতে অংশ গ্রহণ করে। ভক্তেরা দোহার দেয়। মাথা নাড়ে।

কিশোর ফতেচাঁদ সেই সুন্দরীদের হাট দেখতে এসেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের সভাতেও নাকি একযোগে এতগুলি সুন্দরীর সমাবেশ ঘটে না। একেবারে সামনের সারিতে বসেছিলেন তিনি।

প্রেমদাস বাবাজী নিজেও তখন তরুণ। তাঁর বিলক্ষণ নেশা হয়েছে। সিদ্ধি, না বড় কলকে অথবা তরল পানীয় জানা নেই, কিন্তু ঘোর লেগেছে তাঁর। গোপিনীদের দেহ হিন্দোলের তালে-তালে ঝাড় লণ্ঠনগুলোও যেন পাক খাচ্ছে। হঠাৎ তাঁর নজর হল, সামনের সারিতে বসে আছে এক বালকৃষ্ণনন্দকিশোর। অপূর্ব সুপুরুষ ছেলেটি। বাৎসল্যরস উথলে উঠল। তিনি হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকলেন। এক কদম কীর্তন তখন সবে থেমেছে। নূতন কীর্তনীয়া তান ধরেনি। বাদক তার বাঁধছে, সুর বাঁধছে। গোঁসাইজী প্রশ্ন করলেন, কী নাম রে তোর?

—আজ্ঞে, ফতেঁচাদ।

—বোষ্টম?

—না, প্রভু। আমি জৈন। শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের।

—তবে মধুর লোভে এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন? দ্যাখ, এদের কাউকে মনে ধরে? পাঁচ আঙুলে গ্রহবারণ পঞ্চরত্ন : মুক্তা, প্রবাল, নীলকান্ত, পদ্মরাগ ও হীরকখণ্ড। দক্ষিণ হস্তটি প্রসারিত করে গোপিনীদের দেখিয়ে দেন। তারা এতক্ষণ নৃত্যরতা ছিল। শ্রমজনিত শ্বাসপ্রশ্বাসে জোড়া-জোড়া স্বর্ণকলস উথালপাথাল করছে। তারা হেসে মুখে ওড়না চাপা দেয়। কারও বা কাজলকালো চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ঐ কন্দৰ্পকান্তিকে দেখে।

ফতেচাঁদ কৌতুক বোধ করেন। অনিন্দ্যকান্তি গোপিকাকুলের উপর চোখ বুলিয়ে বলেন, আমি নিতান্ত অদ্যভক্ষ্যধনুর্গুণ গোঁসাইজী। সাধিকা পুষব কী ভাবে?

হঠাৎ কী যেন হল সিদ্ধপুরুষের। দুই বাঘের থাবায় খামচে ধরলেন তরুণের দুই বাহুমূল নিকটে আকর্ষণ করলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কী যেন দেখতে থাকেন তার ভূমধ্যে। তারপর ধীরে ধীরে তাকে মুক্ত করে দেন। বলেন, মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। যাকে মন চায় তুলে নিয়ে যা। সূর্য উত্তরায়ণে যাত্রা করার পূর্বেই তুই লাখপতি হয়ে যাবি।

দু-একটি প্রগল্ভা সকৌতুকে বলে ওঠে, আমাকে, আমাকে শেঠজী।

ফতেচাঁদ দারুণ কৌতুক বোধ করেন। গোপিনীদের দিকে ফিরে বললেন, একটু দেরী হবে সুন্দরীরা। মকর-সংক্রান্তির এখনো এক পূর্ণিমা বাকি। আমি এখন শেঠজী নই, ফকিরজী।

সবাই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

ফতেচাঁদ গোঁসাইজীর দিকে ফিরে যুক্তকরে নিবেদন করেন, প্রভু! মনে মনেই যখন খেতে দিচ্ছেন তখন দুধ কেন? ক্ষীরের বাটিই বরাদ্দ করুন। লাখপতির বদলে ক্রোড়পতি।

প্রেমদাস বৈষ্ণব। সদা সুনীচ—তৃণাদপি। রাগ করতে জানেন না। ‘রাগ’ বলতে বোঝেন ‘অনুরাগ’। একগাল হেসে বললেন, কথাটা প্রত্যয় হল না, বাবা নন্দকিশোর? জানিস্ না, আমি বাক্‌সিদ্ধ?

—জানি প্রভু! তবে আমার নাম ‘নন্দকিশোর’ নয়, ‘ফতেচাঁদ’। আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজস্থানী বণিক। আমি তাঁদের এক অযোগ্য পুত্র।

প্রেমদাস স্মিত হেসে বলেন, বুঝেছি। রাজস্থানী বণিক বংশের বেটা বলেই ‘ক্ষীর’ ছাড়া মুখে আর কিছু রোচে না। তা বেশ। ক্ষীরই বরাদ্দ করে দিলাম। একমাসের মধ্যেই তুই—না লাখপতি নয়, ক্রোড়পতি হয়ে যাবি। যা’ ভাগ! পালা!

ভক্ত অনুচরেরা ঐ রসভঙ্গকারী বিধর্মীকে সসম্মানে পথ দেখিয়ে রাসমঞ্চের বাইরে নিয়ে যায়। যেসব ভদ্রঘরের মেয়ে গোপিনীবৃত্তিতে পাকা হয়েছে তাদের কেউ কেউ পিছন থেকে বলে ওঠে—মাসখানেক পরে ফিরে এস ফকিরজী! আমাদের বিরহ যন্ত্রণার অবসান কর।

আশ্চর্য ঘটনাচক্র। প্রায় অবিশ্বাস্য!

সিদ্ধপুরুষ প্রেমদাস গোঁসাই-এর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। মকর-সংক্রান্তির পূর্বেই ফকির হয়ে গেল আমীর। এ যেন রূপকথার গল্প! অপুত্রক ধনকুবের মানিকচাঁদের নজর পড়ল ঐ অসামান্য রূপবান তরুণটির উপর। মানিকচাঁদও রাজস্থানী বণিক—শ্বেতাম্বর বণিক, সম্প্রদায়ের। ফতেচাঁদকে দত্তক নিলেন তিনি। ফতেচাঁদ প্রণাম করতে এলেন প্রেমদাস বাবাজীকে।

মানিকচাঁদ বা ফতেচাঁদকে সে আমলে সবাই চিনত। দু’শ বছরের ব্যবধানে আপনি-আমি হয়তো ঠিক ধরতাইটা ধরতে পারছি না; কিন্তু উপাধিটা শুনলে আজও তাঁদের সনাক্ত করতে পারবেন। ওঁদের কৌলীক উপাধি—জগৎশেঠ।

‘জগৎশেঠ’ কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়। পারিবারিক পরিচয়। মহাকালের স্রোতে আমরা যে ঘাটে বর্তমানে নৌকা ভিড়িয়েছি তার বছর পনের পরে পলাশীর আমবাগানে যিনি ক্যাপ্টেন ক্লাইভকে ইতিহাসের ভিড়ে ঠেলে-ঠুলে ঠাঁই করে দিলেন তিনি যেমন ‘জগৎশেঠ মহতাপচাদ’, তেমনি প্রেমদাস বাবাজীকে যিনি গড় গড়বার অনুমতি নবাব সরকার থেকে পাইয়ে দিলেন তিনি—‘জগৎশেঠ ফতেচাঁদ।’ মহতাপের পূজ্যপাদ পিতামহ।

শুধু অর্থকৌলীন্য নয়, ফতেচাঁদ ছিলেন আলিবর্দীর প্রিয়পাত্র অন্য এক হেতুতেও। প্রাগ্ববর্তী নবাব—সরফরাজ খার—হাত থেকে আলিবর্দীর শাসনদণ্ড ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

হাতেম আলী এতবড় মুরুব্বির জোরকে উপেক্ষা করতে পারেননি—প্রেমদাস বাবাজীকে গড় গড়তে দিতে হয়েছিল। প্রেমদাস তাই নিজস্ব বেতনভুক সৈন্যও রেখেছেন। তারাপ্রসন্ন যা বলেছেন তা বড় মিছে কথা নয়—‘অঙ্গাঙ্গি ভাবমজ্ঞাত্বা—। বাবাজী ইচ্ছা করলে সোঞাই গ্রামখানিকে রাঢ়খণ্ডের মানচিত্র থেকে মুছে দেবার ক্ষমতা রাখেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *