১৬
ভূরি-ভোজনান্তে দুজনে আবার এসে বসলেন বার-মহলের সেই কক্ষটিতে। রূপেন্দ্র ধূমপানে অভ্যস্ত নন। মহারাজ সুগন্ধী অম্বুরী-তামাক সেবন করার অবকাশে প্রশ্ন করেন, রানী-মার অসুখটা কী?
রূপেন্দ্র ইতিমধ্যে রানী-মাকে পরীক্ষা করেছেন। বললেন বিচলিত হবার মতো কিছু নয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী উপসর্গ তিন জাতের : বায়ু, পিত্ত, কফ্। রানীমার শেষ দুটি উপসর্গ নাই। বায়ু কিছু কুপিত। হেতু : রক্তচাপ বৃদ্ধি। আমি ঔষধ প্রেরণ করছি, সেবনবিধিও জানিয়ে দেব। কিন্তু আরও দুটি কাজ করলে ভাল হয়। প্রতিদিন রাত্রে একমুঠি ‘কুলুখ কলাই’ জলে ভিজিয়ে দেবেন। পরদিন প্রত্যুষে শুধু জলটুকু ছেঁকে খেতে হবে। তদ্ভিন্ন প্রত্যুষে—সূর্যোদয়ের পূর্বে, কিছু প্রাতর্ভ্রমণেও উপকার পাবেন। পদচারণা করতে হবে অন্দরমহলের তৃণাচ্ছাদিত প্রাঙ্গণে। নগ্নপদে। কচি থোড়-এর রসও উপকারী।
রাজা এবার প্রসঙ্গান্তরে এলেন, গঙ্গাচরণ যেতে রাজী হয়েছে?
রূপেন্দ্র চমকে ওঠেন। পরক্ষণেই বুঝে নেন, যে গুপ্তচরের মাধ্যমে ভারতচন্দ্র গঙ্গাচরণের সন্ধান পেয়েছেন সে রাজার বেতনভুক। তিনি স্বীকার করলেন, হয়েছে।
—কই আপনি তো আপনার বিবাহে আমাকে আমন্ত্রণ করলেন না?
এবার দুরন্ত বিস্ময়ে বলেন, আপনি সে-কথা কী করে জানলেন? ভারতের কাছে?
–না। কিন্তু, রূপনগরের মঠলুণ্ঠনের সংবাদ কি আমি জানব না? আর সেই সূত্রে কী হেতু সেদিন মঠ অরক্ষিত ছিল? রূপনগরের ‘রাইরানীর’ কথা এই নবদ্বীপেও এসে পৌঁচেছে। কবে বিবাহ? এই অগ্রহায়ণে?
রূপেন্দ্র স্বলজ্জে স্বীকার করলেন। জানালেন, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে সে বিবাহে নিমন্ত্রণ করার মতো সাহস বা সঙ্গতি তাঁর নাই।
মহারাজ বলেলেন, তৎ-সত্ত্বেও আমি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। স্বয়ং যেতে পারছি না। জগৎশেঠের গদী লুট হয়েছে। আলিবর্দী মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছেন। কখন কী হয় বলা যায় না। তবে ‘কুসুমমঞ্জরীকে’ রানী-মা এই সামান্য আশীর্বাদটি দিচ্ছেন। এটি বিবাহের উপহার—রাজানুগ্রহ বা বৈদ্যবিদায় নয়—আপনি গ্রহণ করুন।
রূপেন্দ্র বাধ্য হলেন উপহারটি গ্রহণ করতে। মুক্তাখচিত একটি শতনরী।
এবার তিনি বলেন, মহারাজ, আমারও একটি জিজ্ঞাস্য আছে। যদি অভয় দেন তো নিবেদন করি?
—বলুন?
—সাহিত্যরসিক হিসাবে কি আপনার মনে হয়নি ‘অন্নদামঙ্গল কাব্য’ সুসমাপ্ত?
রাজা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। কুঞ্চিত-ভূভঙ্গে প্রতিপ্রশ্ন করেন, জিজ্ঞাস্যটি কার? আপনার, না আপনার বন্ধুবরের?
–সেও স্বতই কৌতূহলী, কিন্তু প্রশ্নটি নিতান্তই আমার
—আপনার জিজ্ঞাস্যটি তো এই : ‘অন্নদামঙ্গল’-এর কবিকে কেন রাজাদেশে ‘বিদ্যাসুন্দর’ রচনা করতে হল? তাই নয়?
রূপেন্দ্র যুক্তকরে বললেন, সরলভাষায় প্রশ্নটি সেইরকমই বটে।
—তার হেতু, আমি আপনার ঐ বন্ধুটির ভিতর একটি মহান সম্ভাবনাকে দেখতে পেয়েছি। আমার বাসনা, নদীয়ারাজের সভাকবির কাব্যের শতশত সহস্র সহস্র অনুলিপি হোক। সমগ্র গৌড়মণ্ডলে তা ছড়িয়ে পড়ুক। যখন আমি থাকব না, আপনার বন্ধুও থাকবে না, তখনও যেন গৌড়বাসী রায়গুণাকরের গুণগান করে। আর সেই প্রসঙ্গে তারা বলে, এই কবি ছিলেন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি।
রূপেন্দ্র নির্বাক শ্রোতা। ওঁর মনে হল মহারাজ কিছুটা উত্তেজিত। তিনি বললেন, আজ থেকে দু-চারশ বছর পরে এই বিষ্ণুমহল রাজসভার একখানি ইটও হয়তো থাকবে না। বল্লাল সেনের ‘গঙ্গাবাস’, ঢেকুড়ে ইছাই ঘোষের ‘শ্যামরূপা’র গড়ের মতো তা হারিয়ে যাবে। কিন্তু জেনে রাখুন : তখনো থাকবে রায়গুণাকরের কাব্য। নবীন যুগের নবীন পাঠকের কাছে কাব্যমাধুর্যে ভরপুর। আমি সেই সূত্রে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থাকতে চাই, বাঁড়ুজ্জেমশাই!
রূপেন্দ্র বলেন, কিন্তু ঐ চটুল দৈহিক-মিলন বর্ণনার মধ্যে ভারতের বেঁচে থাকার কী সার্থকতা? ‘অন্নদামঙ্গলে’ কবি নিরন্ন মানুষের সুখ-দুঃখের সার্থক চিত্র এঁকেছেন, ‘বিদ্যাসুন্দরে’ রাজা-রাজড়ার বিলাসবৈভব আর যৌন-মিলন বর্ণনা! অন্নদামঙ্গলই বা বেঁচে থাকবে না কেন?
—ভুলবেন না ভেষগাচার্য, বাল্মীকি-বেদব্যাস থেকে কালিদাস পর্যন্ত রাজা-রাজড়ার ছবিই এঁকেছেন, নিরন্ন ভিক্ষাজীবীর নয়। আর ঐ তথাকথিত ‘যৌনমিলন-বর্ণনা’ হচ্ছে নবরসের আদিরস। শিশুকে যখন তিক্ত ঔষধ প্রদান করেন তখন কি তাকে মিষ্টান্নের প্রলোভন দেখান না?
—দেখাই। সে শিশু বলে। প্রাপ্তবয়স্ক পাঠক শিশু নয়।
—ভুল বললেন। প্রাপ্তবয়স্ক পাঠক শিশুরও অধম। শিশুর সারল্য আছে, তার সেই গুণটুকুও নাই। সমকাল তাকেই কাঁধে তুলে নিয়ে নৃত্য করে, যার জয়গান করে সমকালীন সাহিত্যবাজারের ক্ষমতাশালীগোষ্ঠী। ভেষগাচার্য! আমার একটি নিদারুণ ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাখুন : আজ থেকে দুশ’ বছর পরে যদি কেউ এইকালের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগুণীপণ্ডিতের জীবনী: লিখতে বসে তখন একটিমাত্র লোকের সন্ধান সে পাবে না। কেউ তার জীবনের কথা লেখেনি। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত হারিয়ে যাবে! তিনি কে জানেন? আমার কালের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত : বুনো রামনাথ!
—কিন্তু কেন?
–যেহেতু সমকাল তাঁকে স্বীকার করবে না, তাঁর সম্বন্ধে নীরব থাকবে।
–সেটাই বা কেন? শুনি তিনি নরদ্বীপধামের সর্বশ্রেষ্ঠ মহর্ষি!
—কিন্তু তিনি যে’লাঙ্গুলহীন’শৃগাল হতে অস্বীকৃত! জীবনী লেখে কারা? ইতিহাস রচনা করে কারা? বৃত্তিভোগীর দল। রাজা-রাজড়ার অনুগ্রহভোগীর দল। তারা যে এক নিদারুণ হীনমন্যতায় ভুগছে—ঐ বদ্ধ উন্মাদটা তেঁতুল-পাতা সিদ্ধ খেয়ে জঙ্গলে পড়ে থাকবে তবু লাঙ্গুলহীন’ হতে স্বীকৃত নয়! ঠিক একই কথা আপনার বন্ধুর বিষয়েও। সে ভালই সংস্কৃত জানে, তবু কাব্য রচনা করে সাদা বাঙলায়। কী নিদারুণ ধৃষ্টতা! কৃত্তিবাস-কাশীরামের মতো সে চতুর্দশাক্ষরা বৃত্তির পয়ারে সন্তুষ্ট থাকছে না! দ্বাদশাক্ষরা তোটক বা ভুজঙ্গ-প্রয়াত থেকে পঞ্চদশাক্ষরা তৃণক, মালতী, চামর ছন্দে অনায়াসে যাতায়াত করছে—বাঙলায়, সংস্কৃতে নয়। এ কী সহ্য করা যায়? নবদ্বীপে পাড়ায় পাড়ায় কবি—কিন্তু সকলেই রচনা করেন সংস্কৃতে। সাদা বাঙলায় ঐ একজনই—
—কেন মহারাজ? আপনার সভার আর এক জ্যোতিষ্ক—রামপ্রসাদ?
—কবিরঞ্জনও বেঁচে থাকবে, কবি হিসাবে নয়—সুরস্রষ্টা হিসাবে, কালীভক্ত হিসাবে। রায় গুণাকরই বাঙলা-ভাষায় একমাত্র কবি। সমকাল তাই তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদাটি কিছুতেই দিতে চাইবে না। বেঁচে থাকতে হলে তাকে জীবনীশক্তি আহরণ করতে হবে পাঠকের ভালবাসায়। তাকে জনপ্রিয় হতে হবে।
—কিন্তু জনপ্রিয় হওয়ার মাশুল কি নিরাবরণ দৈহিক মিলন-বৰ্ণনা?
—যদি যত্ন নিয়ে পাঠ করেন, তাহলে প্রণিধান করবেন—নগ্ন মিলনবর্ণনাকে অতিক্রম করে প্রতিটি ছত্র কাব্যরসমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। আমি রাজসিক পাঠক, আমি তো সবটুকু থেকেই রসাস্বাদন করি, আপনি যদি সাত্ত্বিক হন—দৈহিক-মিলন বর্ণনায় যদি অসোয়াস্তি বোধ করেন, তবু আপনাকে স্বীকার করতে হবে, ‘বিদ্যাসুন্দর’—’পয়ঃকুম্ভ বিষোমুখম্’! নয় কি?
রূপেন্দ্র নিরুত্তর থাকেন।
রাজা বলেন, বেশ, আমাকে আর একটা কথা বুঝিয়ে বলুন দেখি—রায় গুণাকরের ‘বিদ্যাসুন্দর’ তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ মাত্র। এখনো তিনি সম্যক প্রতিষ্ঠা পাননি। অথচ মহাকবি কালিদাস যখন তাঁর ‘কুমারসম্ভবম্’ রচনা করেন তখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে। আশা করি স্বীকার করবেন, কাব্যবিচার সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান আপনার-আমার অপেক্ষা ন্যূন ছিল না। অর্থাৎ তিনি জানতেন যে, সপ্তম সর্গেই তাঁর সে কাব্য সুসম্পূর্ণ। তাহলে কেন তিনি রচনা করেছিলেন : ‘অথঃ অষ্টম সর্গঃ।। পাণিপীড়ণবিধেরনন্তরং শৈলরাজদুহিতুর্থরং প্রতি……’
রূপেন্দ্রনাথ কী একটা প্রত্যুত্তর করতে গেলেন। তারপর সহসা নিজেই থেমে যান। রাজা অভয় দিয়েছেন, কিন্তু তাই বলে অমন একটা কথা কি তাঁকে বলা যায়?
তীক্ষ্ণধী নদীয়ারাজ সেটা লক্ষ্য করলেন। স্মিত হাসলেন। বলেন, হ্যাঁ! এবার আপনার অকথিত প্রশ্নের জবাবটা দিই—
রূপেন্দ্রনাথ বিস্মিত। স্তব্ধ।
—তার জবাব ভারতচন্দ্রকে আমি ভালবাসি। ‘বন্ধু’ বলে মনে করি। তাই সব জেনেবুঝেও বন্ধুকৃত্য করতে ওটুকু কলঙ্কতিলক ললাটে ধারণ করেছি। স্বেচ্ছায়!
—কীসের কথা বলছেন, মহারাজ? কী কলঙ্ক?
—আপনি তো বলতে চাইছেন—ভবিষ্যৎকাল এ-কথা বলবে যে, রাজাদেশেই ভারতচন্দ্র ‘অমাবস্যার গান’ গেয়েছেন? বলুক তা। স্বয়ং বিক্রমাদিত্যকেও তো আমরা একইভাবে দায়ী করি। বলি, রাজাদেশেই মহাকবি রচনা করেছিলেন : অষ্টম সর্গঃ। স্বেচ্ছায় নয়। তাই নয়? রূপেন্দ্রনাথ বজ্রাহত হয়ে গেলেন। মনে হল, এ আলোচনাটুকু না হলে তিনি ঐ প্রাচীনপন্থী সংস্কারাচ্ছন্ন নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রকে ঠিক মতো চিনতে পারতেন না।