কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

সোঞাই – ১৯

১৯

পরদিন সকাল। মহাষষ্ঠী। বৎসরের একটি চিহ্নিত শুভদিন।

ব্রজেন্দ্রনারায়ণ অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বসে ছিলেন তাঁর আরাম-কেদারায়। প্রাতঃকৃত্যাদি সারা হয়েছে। পরনে পট্টবাস। ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি উত্তরীয় শুধু। নিচে, পূজামণ্ডপে সকাল থেকে ঢাক বাজছে। মহাষষ্ঠীর পূজা একটু বেলায়।

ব্রজসুন্দরী প্রবেশ করলেন অন্দরমহল থেকে। পূজার নববস্ত্র তাঁর পরিধানে। লালপেড়ে তাঁতের কোরা শাড়ি, হাতে বাউটি পৈছে, মকরমুখী সোনার ভারী বালা, লোহার খাড়ু ও শাখা। কপালে গিনি-মাপের টিপ, সিঁথিতে পাকাচুলের ঘের-দেওয়া লাল-সিঁদুর।

ব্রজেন্দ্রনারায়ণ অতি প্রত্যুষেই একটি বিচিত্র সংবাদ পেয়েছেন—অপ্রত্যাশিত সংবাদ। ঘুম ভাঙতেই তারাপ্রসন্ন সেটি জানিয়ে গেছে, বলেছে, সেই সংবাদবহ লোকটি সমস্ত রাত অশ্বারোহণে ক্লান্ত। সে নিদ্রাগত। সকালে সে এসে বিস্তারিত জানাবে বড় হুজুরকে। তবে সংক্ষিপ্তসার সে ইতিমধ্যেই নিবেদন করেছে তারাপ্রসন্নের কাছে। সেই বিচিত্র সংবাদের কথাই ভাবছিলেন বসে বসে।

ব্রজসুন্দরী সবার আগে সেই প্রশ্নটাই করলেন, ভোররাত্রে তারা এসে তোমাকে কী বলে গেল গো?

ব্রজেন্দ্র ফরসির নলটা সরিয়ে রেখে বললেন, বস। কথা আছে। ঐ মেয়েটি কী যেন নাম?—ওর সম্বন্ধে কী করা যায় বল?

ব্রজসুন্দরীর বুঝতে অসুবিধা হল না। নাম না শুনেও। গতকাল হাঙ্গামা মিটে যাবার পর পুরললনার দল যে-যার ভিটেয় ফিরে গেছে, শুধু ব্রজেন্দ্রনারায়ণের নির্দেশে কুসুমমঞ্জরী আর তার মাসিকে যেতে দেওয়া হয়নি। কর্তার যুক্তিটা অকাট্য। প্রেমদাস বাবাজীর ভাইপো হুম্‌কি দিয়ে গেছে মহাষ্টমীর দিন সে সদলবলে আসবে গাঁয়ের মেয়েকে গাঁয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু লোকটাকে বিশ্বাস নেই—যে কোন সময়েই সে অতর্কিতে ঐ আরোগ্য-নিকেতনে হানা দিতে পারে। সেদিন যেমন দিয়েছিল। সেবারকার মতো ভীমা বা তার ভাইপো ঈশেন কাছাকাছি না থাকলে ওরা দ্বিতীয় হানায় ব্যর্থ নাও হতে পারে। তাই এই ব্যবস্থা। এসব কথা জানা ছিল ব্রজসুন্দরীর। বললেন, আমি কী বলব বল, এসব বিষয়ে? তুমিই নাকি কাটোয়া যাবার আগে তারাকে বলে গেছিলে:, রূপনগরের মোহন্ত মহারাজকে এসময় বিরূপ করা ঠিক হবে না—

বাধা দিয়ে ব্রজেন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, তাই তখন বলেছিলাম। কিন্তু তারপর অনেক জল যে বয়ে গেছে দামোদর দিয়ে। বর্গীর হাঙ্গামা হলে রূপনগরের মোহন্ত মহারাজ শুধু নিজের এলাকাটাই রক্ষা করবেন, আর পাঁচটা গ্রামের কী হল তা ভ্রুক্ষেপ করেও দেখবেন না—এই নির্মম তথ্যটা বোঝা গেছে। তাছাড়া ঘটনাচক্রে ভীমা আর ঈশেন পরিস্থিতিটা আদ্যন্ত পালটে দিয়েছে—ঠিকই করেছে তারা। এখন ঐ অনাথা আশ্রিতাকে রক্ষা না করা যে আমার অধর্ম হবে, রানী।

রাঙিয়ে ওঠেন বৃদ্ধা। সম্বোধনটায়। বিশেষ আনন্দঘন নৈশ মুহূর্তে ছাড়া এ-নামে ব্রজেন্দ্র তাঁকে সম্বোধন করেন না। সামনে নিয়ে বলেন, তা যদি মনে কর, তাহলে ওকে রক্ষা কর, আশ্রয় দাও।

—তাই তো দিয়েছি। কিন্তু একটা খট্‌কাও যে লেগে রয়েছে। ওকে রক্ষা করার নৈতিক দায়িত্বটা আমার আছে, কিন্তু সামাজিক অধিকার তো নেই!

—সামাজিক অধিকার! তার মানে?

—সে একটি অনাথা কুমারী কন্যা। যদি বারেন্দ্রশ্রেণীর হত, তাহলে না হয় তারাপ্রসন্নকে বলতাম, আর একটি দারপরিগ্রহ করতে। কিন্তু ওরা রাঢ়ী শ্রেণীর। মেয়েটি যদি এ গাঁয়ের বধূ হয়ে যায়, শুধুমাত্র তখনই আমার সামাজিক অধিকার বর্তাবে। না হলে, তার সেই কাকা যদি স্বয়ং এসে দাবী করে তখন আমি তো তাকে ফেরাতে পারব না। আর তারপর যদি সে আবার হতভাগিনীকে ঐ প্রেমদাসের আখড়ায় পাঠায় …

ব্রজসুন্দরী যুক্তির সারবত্তা প্রণিধান করেন। বলেন, ওর সেই মাসি বললে, ওরা নৈকষ্য কুলীন, শাণ্ডিল্য গোত্র।—এ গ্রামে তেমন পাত্র কি তুমি পাবে না?

—পাব। নন্দ চাটুজ্জে আর দুর্গা গাঙ্গুলী দুজনেই সুপাত্র—কিন্তু তাঁরা কি সম্মত হবেন? দুজনের ঘরেই ‘বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’ মজুত।

ব্রজসুন্দরী রুখে ওঠেন, কেন? ঘাটের মড়া ছাড়া কি এ গাঁয়ে রাঢ়ী-শ্রেণীর কুলীন পাত্র নেই? নন্দ ঠাকুরপোর বড় ছেলেটি তো এখনো বিয়ে করেনি।

—তা করেনি। পত্নী না থাক তার উপপত্নী একাধিক। ছেলেটি বিকৃতরুচির। নানা রকম নেশা-ভাঙ করে। রাতের পর রাত থাকে ঐ অন্ত্যজ পল্লীতে। তার চেয়ে নন্দ সুপাত্র! তবে সুপাত্র যে নেই, তা বলব না। আছে। কিন্তু তাকে কি রাজী করাতে পারবে?

এবারও বুঝে নিতে অসুবিধা হল না। হাসলেন ব্রজসুন্দরী। বলেন, হলে কিন্তু দুর্দান্ত মানাবে! তবে আমার মনে হয়, একবগ্গা রাজী হবে না।

—হবে না? বলছ?

—পারলে একমাত্র তুমিই পার। তোমার অসাধ্য কাজ নেই। দেখবে চেষ্টা করে?

—দেখব। তবে তার আগে জমিটা তুমি একটু তৈরী করে রেখ। শোন বলি—

বলা হল না। নিচে, পূজো-দালানে একটা শোরগোল। ঢাকের বাদ্যিটা থেমে গেছে। অনেকে একসঙ্গে উত্তেজিত হয়ে কিছু আলোচনা করছে। ব্রজেন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। খড়মজোড়া পায়ে দিয়ে বার হয়ে এলেন। দ্বিতলের টানা বারান্দার রেলিংটা দু-হাতে চেপে ধরে ঝুঁকে পড়লেন নিচের দিকে।

ইতিমধ্যেই অনেকে এসেছেন ঠাকুর দেখতে। ছেলে বুড়ো, অবগুণ্ঠনবতীও কিছু। সবারই অঙ্গে পুজোর নতুন পোশাক। নন্দ এসেছেন, দুর্গাচরণ, শিরোমণি-মশাই, বাচস্পতি, ঘোষপাড়ার অন্নদা ঘোষ, বিপিন দত্ত, রূপেন্দ্র আরও কে কে।

প্রহ্লাদ বায়েনের পিঠে ঢাক। বায়েনপাড়ার মোড়ল সে। বোধকরি এতক্ষণ বাজাচ্ছিল। তার ঢাকের বাদ্যি সদ্য থেমেছে। আর পুজা-মণ্ডপের বাহিরে—সিং দরোজার এক পাশে ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে আছে একটি কিশোর। তার পিঠে ঢাক, হাতে ঢাকের কাঠি। খালি গা, তাতে একটা কাচায় বাঁধা একটা চাবি। মহাগুরুনিপাতের চিহ্নিত সজ্জা। চিনতে অসুবিধা হল না—বেষ্টা বায়েনের বড় ছেলে নবা, বছর পনের বয়স। মুখটা শুকিয়ে গেছে, চোখ দুটো রাঙা।

নন্দ চাটুজ্জে তাকে ধমকাচ্ছিলেন, এই জন্যেই তোদের ছোটলোক বলে, বুয়েছিস্! কোন আক্কেলে তুই ঢাক কাঁধে পুজোতলায় আসিস্? অশৌচ চলছে তোর, মহাগুরুনিপাত! শুভকাজে কি এখন আসতে আছে? আর শুভ কাজ মানে কী? মায়ের পূজা! মা আমার দশভুজা!

নবা বায়েন সম্ভবত সারারাত দুচোখের পাতা এক করার সময় পায়নি। ছোট দুটি বোনকে, মাকে সামলাতে সামলাতেই রাতটা কোথা দিয়ে কেটে গেছে। ভোর বেলা মা অজ্ঞান-অচৈতন্যের মতো শুয়ে পড়ার পর খুড়ির পরামর্শে ঢাক কাঁধে সে রওনা হয়েছিল। খুড়ি অর্থে প্রহ্লাদের বউ। পেল্লাদ আর বেষ্টা বছর বছর ঢাক বাজায়। মায়ের মণ্ডপে। খুড়ি বলেছিল, আমি অ্যারে দেখছি, টুক বাজায়ে আয় বাপ—নয়তো খাজাঞ্চি-বাবু তোরে পাব্বনি দিবেনি! নন্দের দিকে ফিরে হাতদুটি জোড় করে নবা বায়েন কাতরকণ্ঠে বললে, ঠিগাছে ঠাউর! মুই ভিরি যাবনি। এই বাইরে ডাঁড়ায়ে বাজাব অনে।

—আবার মুখে মুখে তক্কো? কথা বললে শুনিস না কেন? অশৌচের মধ্যে মায়ের পুজায় ঢাক বাজাতে নেই। শাস্তরে বারণ—

—না বাজালি খাজাঞ্চিবাবু পানি দেবে না যে! বছরে তো দু-বার মাত্তর পাই। তা বটে।

শারদীয়া দুর্গোৎসবে আর গাজনের মেলায় প্রহ্লাদ আর বেষ্টা জুড়ি বেঁধে ঢাক বাজাতে আসে। বাৎসরিক পার্বণী বাঁধা—একখানি ধুতি, একটি লালপাড় শাড়ি, একটি গামছা। এছাড়া পাঁচ কুনকে চাল, তেল-সিঁদুর, পাঁচটা পান সুপারি আর পাঁচ-কপর্দক নগদ। বায়েন-বিদায়। এ ওদের বংশগত বৃত্তি—বংশানুক্রমিক অধিকার। কিশোরটির আশঙ্কা পুজো-মণ্ডপে গড়হাজির থাকলে, বাপের বদলে বেটা অনুপস্থিত হলে, সেই বংশানুক্রমিক অধিকারটা খোয়া যাবে।

নন্দ গর্জে ওঠেন, ছোটলোক একেই বলে! বাপটা দাঁত ছিরকুটে পড়ে আছে, তার মুখে এখনো আগুন ছোয়াসনি—সেসব দিকে খেয়াল নেই, শুধু আদায়-পত্রটা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর!

রূপেন্দ্র দাড়িয়ে ছিলেন। বুঝে উঠতে পারেন না—কেন নন্দ-খুড়ো এই সামান্য কথাটা বুঝতে পারছেন না। কী চরম দরিদ্র ওরা! কী মর্মান্তিক প্রয়োজনে সদ্য-পিতৃহারা এভাবে এসে দাড়িয়েছে। বলেন, তুই বাড়ি যা, নবা। আমি কথা দিচ্ছি—ব্যবস্থা করে দেব—তোকে বাৎসরিক প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হবে না।

ছেলেটি মাথা ঝাঁকিয়ে বললে, দিবে না ঠাউর। খাজাঞ্চিবাবু বুলবে—তু তো বাজাস নাই!

হঠাৎ যেন দৈববাণী হয়। সবাই ঊর্ধ্বমুখ হয়ে গেল।

দ্বিতলের বারান্দা থেকে ঝুঁকে ব্রজেন্দ্র বললেন, তোর পার্বণীটা পরে নিয়ে যাস্। তবে কাপড়ের পুঁটুলিটা এখনই নিয়ে যা নবা। কোরা কাপড় তোর এখনি লাগবে।

নবা ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে হঠাৎ ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল। উদ্দেশ্যে গড় হয়ে পেন্নাম করল জমিদারমশাইকে।

ব্রজেন্দ্রর নির্দেশে খাজাঞ্চিবাবু তখনই পুঁটুলিটা বার করে আনলেন। স্পর্শ বাঁচিয়ে ঐ কিশোরটির প্রসারিত হস্তে ফেলে দিলেন।

প্রত্যেকের নাম-লেখা কাপড়ের বাণ্ডিল প্রতিমার পিছনে থাক দিয়ে রাখা থাকে—পুরোহিত, তন্ত্রধারক, কুমোর, মালাকার, ঢাকি, কাসি, সানাই—মায় একটি পুঁটুলিতে শুধু ঢেড়া-চিহ্ন। খাজাঞ্চিবাবু জানেন, সেটা কাকে পৌছে দিতে হবে। সেই পাপীয়সীর নামটা লিখতে নেই—কিন্তু তার জন্যেও বরাদ্দ করা আছে এই সামাজিক মর্যাদা। যার দ্বারপ্রান্ত থেকে কুমোরভায়া সংগ্রহ করে এনেছিল মূর্তি গড়ার মৃত্তিকা! প্রতিমা গড়ার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে।

পুঁটুলিটায় মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে পুজো মণ্ডপ ত্যাগ করে গেল নবা। কাঁধে ঢাক, গলায় কাচা, হ্যাঁ সত্যি কথাই বলেছিলেন নন্দ-ঠাউর! বাপের সৎকার হয়নি এখনো।

অপরাহ্ণে সাড়ম্বরে তাকে দাহ করা হবে সোঞাইয়ের শ্মশানঘাটে!

বায়েনের আবার দাহকার্য!

কপালে একটা টিপ দিবি, ব্রহ্মতালুতে এক ঘটি গঙ্গাজল, মুখে নুড়ো ছুঁইয়ে ত্যানায় জড়াবি। তারপর ঠেলে দিবি দামোদরের দিকে। ব্যস! বাকি দায়দায়িত্ব কামঠ, কুমির আর বোয়ালের। এই তো হল অন্তুজ্য পরিবারের চিরাচরিত সৎকারের আয়োজন। তা নয়! চিতা জ্বেলে বায়েনের দেহ দাহ করা! কী ভাগ্যি করেই জন্মেছিল বেষ্টা! জমিদারবাবু তার জন্য বরাদ্দ করেছেন—শুধু চিতার কাঠ নয়, চন্দন কাঠ! গব্য ঘৃত। হেসে বাঁচি না! কী? না, বেষ্টা বায়েন শহীদ!

তেলাপোকার পাখা আছে? বল কী! তবে তো তার জন্যে খাঁচা বানাতে হয়! পাখি হয়ে গেল যে সে! বেষ্টা বায়েন শিঙে ফুঁকছে! বল কী? তাহলে তার জন্যে….

যত্তসব আধিক্যেতা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *