২
নগেন দত্ত শহর-বর্ধমানের একজন অত্যন্ত ধনী-ব্যক্তি। প্রথম যুগে ছিলেন বঙ্গাধিপতি লক্ষ্মীনারায়ণ রায়ের অধীনস্থ নায়েব কাননগো, বর্তমানে ইজারাদার।
বোধকরি কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন—ঐ নতুন দুটি শব্দের : ‘বঙ্গাধিপতি’ আর ‘কাননগো’ চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বংগাল-বিহার মুলক-এর শের-এ-হিন্দ্ মুগলদের হাত থেবে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শাসনদণ্ড। মাত্র পাঁচবছর তিনি ছিলেন দিল্লীশ্বর। তার ভিতরেই বানিয়েছিলেন—শাহী-সড়ক : গ্র্যাণ্ড-ট্রাঙ্ক রোড। শেরশাহ শূর! আর তার ভিতরেই প্রবর্তন করেছিলেন রাজস্ব আদায়ের মূল কাঠামোটা, অন্তত এই বঙ্গদেশে। আকবর বাদশাহ্ ক্ষমতা ফিরে আসার পর সেই খসড়া-নক্শায় রঙতুলি বোলালেন। মূল রূপকার রাজা তোডরমল্ল তিনি 1582 খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গভূমের যাবতীয় ভূস্বামীদের সঙ্গে পরামর্শ করে গোটা রাজ্যের রাজহ আদায়ের একটা সুবন্দোবস্ত করলেন। সমগ্র বঙ্গদেশকে বিভক্ত করা হল উনিশটি ‘সরকারে এবং প্রায় পৌনে সাত শতটি ‘পরগণায়’। বিভিন্ন ভূস্বামীর প্রদেয় রাজস্বের পরিমাণ সুচিহ্নি হল। মোট পরিমাণ : এক কোটি সত্তর লক্ষ সিক্কা টাকা। জমির মাপ, নক্শা, পরিমাণ মালিকানা চিহ্নিত করা হল। ঐ সঙ্গে প্রতিটি ভূখণ্ডের জন্য ‘তোমরা-জমা, খালসা, আবওয়াব প্রভৃতির পরিমাণ। সে নথীপত্র পর্বতপ্রমাণ। পরগণায় পরগণায় নিযুক্ত হল আমিন নক্শানবীশ, কাননগো। এক এক ‘সরকারে’ সব কয়জন কাননগোর কাজ দেখভাল করার জন এক একজন নায়েব-কাননগো। আর সবার উপরে প্রধান কাননগো। অসীম প্রতিপত্তি তাঁর সমগ্র রাজ্যের আদায়-তহশিল, মালিকানা তাঁর নখাগ্রে।
তোডরমল্ল স্বয়ং থাকতেন রাজধানীতে। তাঁর ওরফে গোটা বঙ্গদেশের হক-হিসাব যিনি দেখতেন, তাঁর নাম ভগবান রায়। বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে খাজুরডিহি গ্রামে তাঁর জন্ম। উত্তররাঢ়ী কায়স্থ, মিত্রবংশসম্ভূত। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে তাঁর সুনিপু কর্মদক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে রাজা তোডরমল্লের সুপারিশে তাঁকে ‘বঙ্গাধিপতি’ খেতাব দেন বাদশাহ্ আকবর। এই সময় তাঁর সদর দপ্তর ছিল মালদহ জেলার শিবগঞ্জ পুখুরিয়ায়। সেখানে নাকি সেই কাছারি-বাড়ির ধ্বংসস্তূপ এই শতাব্দীর প্রথম পাদেও দেখা যেত।
ভগবান রায় থেকে লক্ষ্মীনারায়ণ পাঁচ পুরুষের ব্যবধান। আমাদের কাহিনীর কালে, অর্থাৎ আলিবর্দীর আমলে ভগবান রায়ের প্রপৌত্র শিবনারায়ণও স্বর্গলাভ করেছেন। লক্ষ্মীনারায়ণ ছিলেন শিবনারায়ণের পুত্র। তিনি ভট্টবাটীবংশীয় প্রধান কাননগো মহেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে দীর্ঘদিন যৌথভাবে এ দায়িত্ব পালন করে যান। ক্রমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে এ ব্যবস্থাপনার যবনিকাপাত ঘটে। সম্মানের পর্যায়ক্রমে মুর্শিদাবাদে বঙ্গাধিপতির স্থান তৃতীয়—স্বয়ং নবাব এবং জগৎশেঠের পরেই।
নগেন্দ্র দত্ত ছিলেন ঐ লক্ষ্মীনারায়ণের অধীনে বর্ধমান সরকারের নায়েব-কাননগো। কিন্তু সম্মান নিয়ে কি ধুয়ে খাবেন? অসার খলু সংসারে সারং রৌপ্য মুদ্রায়াম্! ইজারাদারের হাতে আসে কাঁচা সিক্কা-টাকা! বছর না ঘুরতেই হয়েছেন টাকার কুমির! বাগানবাড়িতে পাঁচ-ইয়ারের সঙ্গে মাঝে মাঝে রামপ্রসাদীর প্যারডি ভাজেন, “আমায় দে মা তবিলদারী/আমি নিমকহারাম ‘হই’শঙ্করী!”
এখন যেখানে বর্ধমানরাজার পায়রাখানা প্রাসাদ, তার কিছু দূরে ছিল তাঁর ভদ্রাসন। বিশ বিঘের প্রাচীরবেষ্টিত প্রাসাদ। দ্বিতল পাকা বাড়ি, প্রকাণ্ড সিং-দরোজা। সামনের দিকে দফতর, অতিথিশালা, মন্দুরা, এমনকি পিলখানা। অতিথিশালায় পাশাপাশি চার-পাঁচটি কক্ষ। কার্যব্যপদেশে বিভিন্ন অতিথি আসেন, অধিকাংশই উপ-ইজারাদার। দু-চারদিন তাঁদের রাত্রিবাস করতে হয়। প্রতিটি কক্ষে চার-চারজনের শয়নব্যবস্থা
এত বৃহৎ আয়োজন, তবু সমস্যা দেখা দিল রূপেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে। কোথায় তাঁকে থাকতে দেওয়া যায়? এতাবৎকাল যে-সব অতিথি-অভ্যাগত এসেছেন, প্রতিনিয়তই আসছেন, তাঁরা কখনো সস্ত্রীক আসেন না। পদমর্যাদা অনুযায়ী তাদের স্থান হয় অতিথিশালায়, কাউকে রাখা হয় একক-কক্ষে, কাউকে বা যৌথভাবে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি পুরুষদের এলাকা। কোন মহিলাকে সে অতিথিশালায় আশ্রয়দান শোভন নয়। দত্তমশায়ের প্রাসাদটিও প্রকাণ্ড—পাঁচ-সাতখানা ঘর অন্দরমহলে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু অন্দরমহলে কীভাবে ভেষগাচার্যকে স্থান দেওয়া যায়? তাতে পর্দানসীন মহিলাদের যে চূড়ান্ত অসুবিধা! সেটা শোভনও নয়। উপায় নেই—স্থির হল দুজনকে দুই মহলে স্থান দেওয়া হবে। ভেষগাচার্য থাকবেন অতিথিশালায়, তাঁর স্ত্রী অন্দরমহলে।
দোষ অতিথির! সামাজিক রীতিনীতি, কালের বিধান না মানলে উপায় কী? ‘পথি নারী বিবর্জিতা’ শ্লোকটাও যে শোনেনি তার কপালে এ জাতীয় দুর্ভোগ তো প্রত্যাশিত!
এবার বোঝ! ‘মধুচন্দ্রমা’ ‘শব্দটা যখন পয়দা হয়নি তখন সস্ত্রীক বিদেশভ্রমণের বাসনা জাগলে কী খোয়ার হয়!