কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৭

পরদিন রূপেন্দ্রকে নিয়ে ভারতচন্দ্র উপস্থিত হলেন রাজসভায়।

সে এক অভিজ্ঞতা বটে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাতঃকালীন রাজসভার দুইটি পর্যায়। প্রথমাংশে তিনি শুধু রাজকার্য করেন। প্রজাদের অভাব-অভিযোগ শোনেন। প্রয়োজনে আদেশনামা জারী করেন, স্বাক্ষর দেন দলিলে। সে সময় সভায় উপস্থিত থাকেন শুধুমাত্র মন্ত্রী, দেওয়ান, সেনাপতি, বিভিন্ন গুপ্তচর এবং রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা। একটু বেলায় প্রায় একদণ্ডের মতো একটি বিরতি ঘটে। রাজা তখন সংলগ্ন কক্ষে প্রাতরাশ সেরে নেন। রাজসভার পালাবদল হয়। রাজকর্মচারীরা বিদায় নেয় আর আসর জমিয়ে বসেন পণ্ডিতের দল, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ। ভারতচন্দ্র সেই বুঝে একটু বেলাতেই এসেছেন।

রাজবাড়ির এই দরবারকক্ষটির নাম—বিষ্ণুমহল। প্রকাণ্ড দরবার গৃহ। চারমিনার-বিশিষ্ট তোরণপথ মুসলিম স্থাপত্যানুসারী। স্তম্ভ, খিলান, কালবুদ পঙ্খের কাজ করা, অতি মসৃণ। দুইসারি স্তম্ভের মাঝখান দিয়ে গালিচা-মোড়া প্রবেশ পথ। মাথার উপর সারি সারি সহস্রমুখ ঝাড়-বাতি। দু-পাশের দেওয়ালে প্রাক্তন রাজবর্গের তৈলচিত্র—ভবানন্দ, রাঘব, রুদ্র রায়, রঘুবীর!

ভূপেন্দ্র রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বসে আছেন সিংহাসনে। দু-পাশে পাত্রমিত্র। পিছনে দুজন ব্যাজন করছে। দ্বারে সশস্ত্র প্রহরী। এক দিকে একটি উচ্চ বেদিকা। পণ্ডিতদের আসন। বিপরীত দিকে কিছু সঙ্গীতজ্ঞ নানান বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে আছেন। তাঁরা সর্বক্ষণই অতি মৃদু শব্দ ঝংকারে একটি আলাপ করে চলেছেন। পরিকল্পনাটি শাহজাহার দরবারের সঙ্গে আকবরের রাজসভার এক বিচিত্র সংমিশ্রণ।

ভারতচন্দ্র রাজসমীপে অগ্রসর হয়ে এসে তাঁকে অভিবাদন করলেন। দেখাদেখি একই ভঙ্গিমায় রূপেন্দ্রনাথও রাজাকে অভিবাদন করেন। রাজা বললেন, স্বস্তি! আজ কবিবরের সপার্ষদ আগমন হল মনে হচ্ছে। তোমার ঐ কন্দর্পকান্তি বয়স্যটির পরিচয় দান কর, কবি।

–ইনি বর্ধমানভুক্তির সোঞাই গ্রামনিবাসী ভেষগাচার্য। নাম শ্রীরূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। নৈকষ্য কুলীন। পিতার নাম “সৌরীন্দ্রনাথ কাব্যতীর্থ। উনি গতকাল কৃষ্ণনগরে এসেছেন ঝষধ্বজ দত্ত মশায়ের চিকিৎসা করতে।

রাজা বললেন, উনি সার্থকনামা! রূপেন্দ্র! নিতান্ত দুর্ভাগ্য আমার। আজ সভায় উপস্থিত-কবি মহাপণ্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার অনুপস্থিত। থাকলে ‘রূপেন্দ্র’ শব্দের উপর তিনি নিশ্চয় একটি শ্লোক রচনা করে শোনাতেন।

বিদ্যাবাচস্পতি বলেন, মহারাজ! অধম স্বভাবকবি নয়। তবে এই রূপের ইন্দ্রটিকে দর্শন করে আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থের একটি উদ্ধৃতি মনে পড়ছে। আপনি অনুমতি করলে সেটি শোনাতে পারি। ‘রূপ’-এর সংজ্ঞা।

রাজা বললেন, শাস্ত্র বলছেন, ‘মধ্বাভাবে গুড়ং দদ্যাৎ’। তাই হোক তাহলে।

বিদ্যাবাচস্পতি বলেন, “অঙ্গান্যভূষিতান্যেব কেনচিদ্ ভূষণাদিনা। যেন ভূষিতং ভান্তি তদ্‌রূপমিতি কথ্যতে।” রায় গুণাকরের বয়স্য দেখছি পুষ্পধনু ব্যতিরেকেই মীনকেতনের প্ৰতিদ্বন্দ্বী!

রূপেন্দ্র নিরতিশয় লজ্জিত হন। রাজনির্দেশে দুজনে উপবেশন করেন। ওপাশ থেকে একজন বৃদ্ধ হঠাৎ বলে ওঠেন, আমি কিন্তু কবিবরের ঐ শব্দটির অর্থগ্রহণ করতে পারিনি। ‘ভেষগাচার্য’ শব্দের অর্থ কী?

এই অর্বাচীন প্রশ্নে রূপেন্দ্রনাথ প্রশ্নকর্তার দিকে দৃপাত করলেন। এবং তৎক্ষণাৎ সনাক্ত করলেন তাঁকে। খর্বকায়, স্ফীতোদর। পরিধানে একটি খাটো ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন, শুধুমাত্র একটি উত্তরীয়। উপবীত নাই। মেদবহুল দেহ। নিঃসন্দেহে গোপাল ভাঁড়।

রাজা বললেন, কবি, অন্বয় ব্যাখ্যা দাখিল কর। গোপাল ‘ভেষগাচার্য শব্দের অর্থ বোঝেনি।

ভারতচন্দ্র বললেন, উপায় কি? হংসমধ্যে বক যখন উপস্থিত, তখন ব্যাখ্যা করতেই হবে। ভেষগাচার্য শব্দের অর্থ—চিকিৎসক, কবিরাজ, বদ্যি।

গোপাল বলে, এতক্ষণে বোঝা গেল! রায়গুণাকর তো দেবভাষায় কাব্য রচনা করেন না, তাই খট্‌কা লেগেছিল শব্দটায়। কবিরাজ! গোবদ্যি! এবার বুঝেছি। তা বাড়জেমশাই, আপনি যখন গো-আড়িগঞ্জে এসেই পড়েছেন, আমার বাড়িতে একবার পদধূলি দেবেন। আমার দুধেলা গাইটে বেমক্কা দুধ দেওয়া বন্ধ করেছে। গিন্নি বলেছেন, একটি ভাল গোবদ্যি ধরে নিয়ে যেতে!

ভারতচন্দ্র জবাবে কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু রূপেন্দ্র তাঁর জানুতে হস্তস্পর্শ করায় থেমে গেলেন। অনুমান করেন, রূপেন্দ্র স্বয়ং এ বিদ্রূপের উত্তর দিতে চান। ঠিক তাই। রূপেন্দ্র বললেন, হাস্যার্ণব, এজন্য আমাকে আপনার ভদ্রাসনে নিয়ে যেতে হবে না—তাহলে আপনার কিছু অর্থদণ্ড হবে। আমি আপনার গো-মাতাকে না দেখেই এখান থেকে বিধান দিয়ে দিচ্ছি। গৃহিণীকে বাড়ি ফিরে বলবেন, তাঁর যেমন একটি দুধেলা গাই-গরু আছে তেমনি একটি পোষা অনডবানও তো আছে। সেটি ইদানীং মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় আসন পাওয়াতে বিরহানলে দগ্ধ হয়েছে ঐ গাভিটি। তাই দুধ দেওয়া বন্ধ করেছে।

রাজা প্রাণখোলা হাসি হাসলেন। বললেন, নাও গোপাল! জবাব দাও!

গোপাল ইতস্তত করে বলেন, ইনিও যে সংস্কৃত শুরু করলেন মহারাজ! ‘অনজ্বানও’ যে বড় ভারি শব্দ। অর্থ গ্রহণ হচ্ছে না।

রূপেন্দ্র তৎক্ষণাৎ বলেন, ওর আর অন্বয় ব্যাখ্যা-হয় না। আপনি তো পেশায় প্রামাণিক।

ভূষণভূষিত দেহ না হওয়া সত্ত্বেও যাঁকে ভূষিতবৎ প্রতীয়মান হয়, তাকেই বলে রূপবান —তাই রূপ! বাড়িতে দর্পণ নিশ্চয় আছে। তার ভিতরেই ওর অর্থ খুঁজে দেখবেন।

গোপাল বলে ওঠেন, ইনি যে দেখছি খাস্ ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি! ‘আত্মবন্মন্যতে জগৎ’।

রাজা বাধা দিয়ে বললেন, উহুঁ হুঁ। হল না। গোপাল, হল না। তুমি ঢং ধরেছিলে সংস্কৃত জান না। এখন ঠাঁই বদলাতে পার না। একবার অক্রুর, একবার বিন্দে দূতী—এ তো চলবে না। তোমার হার হয়েছে বাপু!

গোপাল ব্যাজার হলেন। রাজা প্রশ্ন করেন রূপেন্দ্রকেই, তা ঝষধ্বজকে দেখে কী বুঝলেন? ওর অসুখটা সারবে তো?

প্রত্যুত্তরে রূপেন্দ্র বলেন, এখনো রুগী দেখা সম্ভবপর হয়নি। কারণ ….

মাঝপথেই থেমে যান।

রাজা বলেন, জানি! কারণ—’কারণ’! কালীপূজার ধাক্কা এখনো সামলে উঠতে পারেনি। ঐটাই ওর রোগ ভেষগাচার্য! যা হোক, কতদিন আছেন? কোথায় উঠেছেন? ঋষধ্বজের অতিথিশালায়?

—আজ্ঞে না মহারাজ। উঠেছি বন্ধুবর ভারতচন্দ্রের আবাসে। থাকব দিন-দুই-তিন।

রাজা বললেন, ‘উহুঁহু! তা হবে না। আজ শুক্লা তৃতীয়া। পাঁচ দিন পরে মায়ের পূজা। এ সময় তো আপনি স্বদেশে ফিরতে পারবেন না!

একজন মোসায়েব বলে উঠে, গোয়াডি-কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা দেখলে জীবনে ভুলবেন না। ফরাসডাঙার দেওয়ান ইন্দ্র চৌধুরীর জগদ্ধাত্রী পুজার জৌলুস …

কৃষ্ণচন্দ্র ধমক দিয়ে ওঠেন, তুমি চুপ কর মধু! ঁমা—ঁমা! তুলনামূলক আলোচনা করে তোমাকে খোসামোদি করতে হবে না। ছিঃ!

মধু নামের মোসায়েব ম্লান হয়ে যায়। মাথা নিচু করে।

রূপেন্দ্র বলেন, বেশ কথা। আপনি যখন আদেশ করছেন তখন মায়ের পূজা প্রত্যক্ষ করে দেশে ফিরব। সত্যই তো, এ এক দুর্লভ সৌভাগ্য।

রাজা ভারতচন্দ্রের দিকে দৃকপাত করে বলেন, উনি তোমার আতিথ্য স্বীকার করেছেন আমার কিছু বলার নেই; কিন্তু যে-কয়দিন উনি কৃষ্ণনগরে থাকবেন ওঁর ‘সিধা রাজবাড়ি থেকে যাবে।

গোপাল যেন প্রতিবর্তী-প্রেরণায় তৎক্ষণাৎ বলে ওঠেন, দুজনের মতো মহারাজ! না হে কবিরাজ মশায়ের হজম হবে না। কিছু মনে করবেন না রায় গুণাকর—আমি ন্যায্য কথা‍ বলেছি! অতিথি রাজভোগ কি হজম করতে পারবে যদি গৃহস্বামী পান্তা খায়?

এরপর শুরু হল মার্গ সঙ্গীত। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন সঙ্গীত-বিশারদ।

এই সুযোগে ভারতচন্দ্র পণ্ডিতমণ্ডলীর পরিচয় নিম্নস্বরে বিবৃত করতে থাকেন রূপেন্দ্ৰে কর্ণমূলে। রাজার বাম দিকে প্রথমেই বসে আছেন গোস্বামীপাদ রাধামোহন বিদ্যাবাচস্পতি শান্তিপুরের বৈষ্ণব ভক্ত-পণ্ডিত। যিনি উজ্জ্বলনীলকান্তমণি থেকে ‘রূপ’-এর সংজ্ঞা-নির্ধার শ্লোকটি শুনিয়েছিলেন। সৌমদর্শন বৃদ্ধ, মুণ্ডিতমস্তক, ললাটে শ্বেতচন্দনের তিলক।

তাঁর পাশে শঙ্কর তর্কবাগীশ। তদানীন্তন নদীয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িক। তাঁর চতুষ্পাঠীতে ছাত্রসংখ্যা সর্বাধিক। শুধু বিদ্বৎসমাজে নয়, তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি নিরক্ষর চাষী-মজুরেরা জানত। একবার তিনি শান্তিপুরে গঙ্গার পারানিঘাটে এসে দেখেন, খেয়াঘাটের নৌকাটি দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীর অপ্রতুলতায় মাঝি অপেক্ষা করছে। তর্কবাগীশ মশায়ের কিছু তাড়া ছিল। মাঝিকে বললেন, এবার নৌকাটা ছাড়বে মাঝি ভাই? আমার কিছু তাড়া আছে।

মাঝি তাঁকে ধমকে উঠেছিল, কেনে ঠাকুরমশাই? আপনি কি স্বয়ং শঙ্কর তক্কোবাগীশ এয়েচেন আমারে উদ্ধার করতি যে, নৌকা ভরতি না হতেই নুকশান দে ওপারে যাব?

শঙ্কর তর্কবাগীশ সহাস্যে বলেছিলেন, তা বটে!

পারানি-যাত্রীদের একজন নাকি তাঁকে চিনতে পারে। সে মাঝির কানে-কানে কী যেন বলে শুনে মাঝির চোখ কপালে ওঠে। দৌড়ে ছুটে এসে জলকাদার মধ্যেই ব্রাশ করে লুটিয়ে পড়ল তর্কবাগীশের চরণজোড়া আঁকড়ে। মাথা খুঁড়তে খুঁড়তে সে বলে চলেছে, এ আমি কী বল্লাম ঠাউর! নরকেও যে মোর ঠাঁই হবেনি!

নৈয়ায়িক বুঝে উঠতে পারেননি—লোকটা অমন করছে কেন? তার কথায় তো তিনি তৃপ্তিই পেয়েছিলেন—বুঝে নিয়েছিলেন, তাঁর সত্যানুসন্ধানের প্রভাব আজ পারানি-মাঝিদেরও প্রভাবান্বিত করছে।

শঙ্কর তর্কবাগীশের পাশের আসনটিতে যিনি বসে আছেন, শ্যামবর্ণ, মধ্যবয়সী, মাথাভরা টাক—উনি গোকুলানন্দ বিদ্যামণি। কাব্য-ন্যায় প্রভৃতির ধার ধারেন না। তিনি সমকালীন এক প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ। নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ সুবুদ্ধি শিরোমণির—প্রপৌত্র। জ্যোতির্বিদ শব্দের অর্থ না বুঝে কৃষ্ণনগর-শান্তিপুর-উলার অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি ওঁর কাছে ধমক খেয়েছে। তারা ওঁর দ্বারস্থ হয়েছিল কোষ্ঠিবিচার করাতে, জন্ম পত্রিকা বানিয়ে ভবিষ্যৎ জানতে। উনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন ঐ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মূর্খগুলোকে বোঝাতে—ফলিত জ্যোতিষ নয়, তাঁর এলাকা গণিত জ্যোতিষ। আর্যভট্ট তাঁর আরাধ্য, খনার বচন নয়! মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বৃত্তিভোগী এই পণ্ডিত শুধু আকাশচারী গ্রহনক্ষত্রের সঙ্গে সৌহার্দ্য করেছেন! বৃত্তিভোগী পণ্ডিতের নানান কামনা—কেউ স্বপ্ন দেখেন কেদার-কৈলাসের, কেউ বা বৃন্দাবন। বিদ্যামণিরও অন্তরে অন্তর্লীন হয়ে আছে এক তীর্থদর্শনের কামনা—জয়পুরে সোয়াই জয়সিংহের মানমন্দির! সম্প্রতি তিনি একটি অদ্ভুত আবিষ্কার করে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন—বিদেশী ঘড়ি আবিষ্কৃত হবার পূর্বেই নিজ তত্ত্বাবধানে তিনি নির্মাণ করেছেন এক বালুকাঘড়ি। তার সাহায্যে শুধু দণ্ড, পল নয়, অনুপলও সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়। অদ্ভুত প্রতিভা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *