কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ২

রূপেন্দ্র অশ্বারোহণে যখন শহর গোয়াড়ি-কৃষ্ণনগরে এসে পৌঁছালেন তখন মধ্যাহ্ন অভিক্রান্ত। পথপ্রদর্শক তাঁকে প্রথমেই নিয়ে গেল ঋষধ্বজের অতিথিশালায়। খড়ো আটচালা। মাটির দেওয়াল, মাটির মেজে; কিন্তু সুনিপুণভাবে নিকানো। বাহিরের দেওয়ালে কিছু অর্থোৎকীর্ণ পোড়ামাটির মূর্তিস্থাপত্যের ভাষায় যাকে বলে ‘অল্টো-রিলিভো’। শিল্পীর এলেম আছে—মূর্তিগুলি অতি অপরূপ; কিন্তু বিষয়বস্তুর দিক থেকে তাতে কিছু স্থূলতার পরিচয়। রূপেন্দ্রনাথ পুরী-ভুবনেশ্বর-কোণার্ক দেখেননি। তাঁর কর্ণদ্বয় রক্তিম হয়ে ওঠে।

মাঝখানে একটিই বড় ‘হল’-ঘর। আটটি শয্যা পাতা—কাঠের তক্তাপোষ। তার উপর শয্যা। সাতটি অধিকৃত, অষ্টম শয্যাটি নির্দেশ করে পথপ্রদর্শক সরকার-মশাই বললে, এটি আপনার।

রূপেন্দ্র তাঁর ধূলি-ধূসরিত পরিচ্ছদ খুলে চৌকির উপর রাখলেন। কক্ষস্থ সাতজন অতিথিই কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তাঁকে দেখছিল। কেউ কোন প্রশ্ন করেনি। একটু পরেই একটি মহিলা এসে সরকার-মশাইকে প্রশ্ন করে, ডাকছিলেন?

—হ্যাঁ, মতির-মা, এই ঠাকুরমশাই দিনকয়েক এ বিছানায় থাকবেন। সব ব্যবস্থা করে দিও। উনি মহাপণ্ডিত, ব্রাহ্মণ এবং ভেষগাচার্য। দেখ, যেন আমাদের বদনাম না হয়।

মেয়েটি মিষ্টি করে হাসল। বললে, বদনাম হবে কেনে• গো, আমি আছি না? তারপর রূপেন্দ্রের দিকে ফিরে বললে, ছান করবেন তো, বাবা?

–করব। নদী কি কাছে?

—খড়ে রসি-দুয়েক। চান তো কুয়োর জলও তুলে দিতে পারি।

—’খড়ে’ মানে? খড়ে কী?

—জলাঙ্গী নদীর ডাক নাম।

—তা হলে খড়েতেই স্নান করে আসব। কুয়োর জল লাগবে না।

বেশ কথা। আমি সঙ্গে নোক দিচ্ছি। কাপড় গামছা নে-যাবে আর পথ দেখাবে। ফলার কী হবে, কাঁচা না পাকা? অন্নসেবা করবেন তো?

রূপেন্দ্রকে জবাব দিতে হল না। সামনের চৌকিতে উপবিষ্ট ব্রাহ্মণ থেলো হুঁকা থেকে মুখটা সরিয়ে বললেন, না! তুমি কাঁচা-ফলারের আয়োজনই করে দাও, মতির-মা!

মতির-মা তাঁর দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে দেখল। হেসে বললে, সবাই যে আপনার মতো ছুঁৎমার্গী হবেন এমন তো কতা নেই!

রূপেন্দ্র বুঝে উঠতে পারেন না, ব্যাপারটা কী। যা হোক প্রথমেই কক্ষবন্ধুর বিরাগভাজন হওয়াটা ঠিক নয়। বললেন, না, অবেলায় আর অন্নসেবা করব না। আপনি অনুগ্রহ করে কাঁচা ফলারের আয়োজনই করুন।

মেয়েটি জিহ্বা দংশন করল। পানদোক্তায় রাঙা টুকটুকে ছোট্ট জিব। বললে, আমারে আবার ‘আপনি কিসের গোঁসাই ঠাকুর? আমি যে সেবাদাসী!

এতক্ষণ স্ত্রীলোকটির দিকে চোখ তুলে তাকাননি। এবার তাকাতে হল। সধবা। বয়স দেড়-কুড়ির কাছাকাছি। প্রসাধনের পারিপাট্য নজর কাড়ে। ‘সেবাদাসী’ শব্দটায় তার জাত নির্ণয় করা যায়।

মতির-মা নিষ্ক্রান্ত হতে বৃদ্ধ ঘনিয়ে আসেন। বলেন, মহাশয়ের সঙ্গে পরিচয় নেই। কিন্তু ‘বামুন’ শুনেই নিজ বুদ্ধি-বিবেচনা মতো বিধান দিয়ে বসেছি। মহাশয় বিরক্ত হনরি তো?

—না, না, মধ্যাহ্ন অতিক্রান্ত। এখন অন্নসেবা না করাই বিধেয়।

–সেজন্য নয়, মহাশয়! এখানে যারা অন্নপাক করে তাদের সব শালার গলায় পৈতে আছে, কিন্তু শালারা বামুন কিনা আমাদের সকলেরই সন্দেহ। বিশ্বাস না হয় ভট্টাচার্য-মশাইকে শুধিয়ে দেখুন—

ভট্টাচার্য-মশাই ও-প্রান্ত থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলে ওঠেন, বুয়েছেন, একদিন এক শালাকে পাকড়াও করেছিলাম। শালা গায়ত্রীমন্ত্রটাও উরুচ্চারণ করতে পারল না!

রূপেন্দ্রনাথের মনটা খারাপ হয়ে যায়। এইসব লোকের সঙ্গে তাঁকে একই গৃহে বাস করতে হবে। প্রতিটি বাক্যে যারা ঐ ‘মধুর’ আত্মীয় সম্বোধনে অভ্যস্ত। হুঁকো-হাতে বলেন, আমরা সবাই কাঁচা সিধা নিই, পালা করে স্বপাক রন্ধন করি। ও-বেলা সে ব্যবস্থাই করা যাবে। আসুন, একটু তামাক ইচ্ছা করুন। কড়ি-বাঁধা বামুনের হুঁকো।

রূপেন্দ্রনাথ জানালেন, তিনি তামাক-সেবায় অভ্যস্ত নন। বৃদ্ধ বলেন, আমার নাম নিবারণচন্দ্র, ঠাকুরের নাম “অনুকূলচন্দ্র ঘোষাল। আদি নিবাস গুপ্তিপাড়া; বর্তমানে এই শালা দত্তর বৃত্তিভোগী। মশায়ের পরিচয়?

রূপেন্দ্রনাথ সংক্ষেপে নিজ পরিচয় দিলেন। জানালেন, তিনি মাত্র দু-একদিন থাকবেন। গৃহস্বামীর চিকিৎসা করতে এসেছেন।

নিবারণচন্দ্র আরও ঘনিয়ে এলেন। তাঁর মুখে দুর্গন্ধ। রূপেন্দ্রের কর্ণমূলে বললেন, শিবের অসাধ্য ব্যামো মশাই! কুষ্ঠ! চিকিচ্ছে নেই!

—কুষ্ঠ! আপনি কী করে জানলেন?

নিবারণচন্দ্র সরবে তাম্বাকু ‘ইচ্ছা’ করতে থাকেন। ভাগ্যক্রমে তখনই ফিরে এল মতির-মা। সঙ্গে একটি অল্পবয়সী ছেলে—যে ওঁর কাপড়-গামছা নিয়ে পথ দেখিয়ে ঘাটে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *