কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১১

১১

পরদিন সকালে উনি বললেন, আজ ভাবছি শান্তিপুর ঘুরে আসব। অদ্বৈতাচার্যের ভিটে… ভারতচন্দ্র বলেন, না, রূপেন্দ্র। আজ তোমাকে উলো যেতে হবে।

—উলো! কোন গ্রামের নাম?

–গ্রাম নয়, শহর। অতি প্রাচীন জনপদ। সেখানে একটি রুগী দেখতে যেতে হবে তোমাকে। আমিও যাব। ভোলাকে বলেছি আর একটি অশ্ব ভাড়া করে আনতে

রূপেন্দ্র জানতে চান—রুগীটি কে। ভারতচন্দ্র তাকে কতদিন চেনেন।

ভারত বলেন, সে আমার অপরিচিত। কিন্তু তোমার চেনা। দেখেছ, বছর সাত-আট আগে। তার নাম—গয়ারাম। একটি পা খোঁড়া, আনুষঙ্গিক আরও কী কী ব্যাধি আছে।

—আমি তাকে চিনি? গয়ারাম? সাত-আট বছর আগে দেখেছি? প্রসঙ্গটি বেদনাবহ। কৌতুকের নয়। তাই রহস্যজাল ছিন্ন করে দেন এবার।

রুগী বস্তুত গঙ্গাচরণ, রূপেন্দ্রের ভগ্নিপতি, কাত্যায়নীর স্বামী।

রূপেন্দ্রকে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ভারত নিজে গোপনে সন্ধান করেছিলেন। মহারাজের এক বিশ্বস্ত গুপ্তচরকে দিয়ে। প্রোষিতভর্তৃকা কাত্যায়নীর মর্মবেদনায় কবি স্থির থাকতে পারেননি। তাঁর কাছে কাত্যায়নী আর রাধারাণী বারে বারে একাত্ম হয়ে উঠেছিল। দুজনেই প্রত্যাশা করে দিন গুনছে শবরীর প্রতীক্ষায়। স্থির করেছিলেন, তেমন সংবাদ পেলে সে-কথা রূপেন্দ্রকে আদৌ জানাবেন না। সেই অদেখা-অচেনা মেয়েটিকে বৈধব্যযন্ত্রণা ভোগ করতে দেবেন না। কিন্তু সংবাদ নিয়ে জানতে পারলেন—নেদেরপাড়া পল্লীর বিষ্ণুচরণ চাটুজ্জের পুত্র গঙ্গাচরণ জীবিত। বছর পাঁচ-ছয় পূর্বে সে দেশত্যাগ করে। একজন ধনবান ব্যবসায়ীর সঙ্গে। আদি সপ্তগ্রামের নৈকষ্য কুলীন। তাঁর পুত্রসন্তান ছিল না। একটিই কন্যা। তিনি গঙ্গাচরণকে প্রস্তাব দেন যে, জামাতা বাবাজীবন যদি ভ্রাম্যমাণ জীবন ত্যাগ করে ঘরবসত করতে স্বীকৃত হয়, তবে তাকেই দিয়ে যাবেন সম্পত্তি। তাঁর কন্যাটিও ডাগর। গঙ্গাচরণ এককথায় রাজী হয়ে যায়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে পার্বণী আদায় করা আর সহ্য হচ্ছিল না তার। প্রণিধান করেছিল—ঐ ‘নাল্পে সুখমস্তি’ শ্লোকটা কোন কাজের কথা নয়। একটি স্থায়ী ঘর, একটি সালঙ্কারা যৌবনবতী নববধূ, তার কোলে একটা বকে বাচ্চা! সকাল-সন্ধ্যা নিরুপার্জিত ভোজ্যদ্রব্য এবং অম্বুরী-তামাক! সে তো স্বর্গসুখ!

শ্বশুরমশাই বলেছিলেন, বহুদিনের সখ একবার তীর্থে যাব—কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন। একা সাহস পেতাম না এতদিন। ছেলে নেই। ভাইপোরা আছে, কিন্তু এক একটা পাষণ্ড! তুমি যদি ভরসা দাও তাহলে সপরিবারে তীর্থ করে আসি, বিয়েটা মিটে গেলেই। নিয়ে যাবে বাবা, আমাদের?

পরের পয়সায় তীর্থেই বা আপত্তি কী? রাজী হয়ে গেল। শ্বশুরমশাই বলেন, তাহলে দুটি কাজ করতে হবে, বাবাজীবন। তোমাকে দাড়ি রাখতে হবে, আর নামটা পালটাতে হবে!

—আপনি বললে, নিশ্চয় করব। কিন্তু হেতুটা?

—পথে ঘাটে তোমার আর কোন শালা-শ্বশুর-সম্বন্ধী যদি চিনতে পেরে তোমাকে ছিনিয়ে নেয়? তাহলে বিদেশ বিভুঁইয়ে আমি অথৈ জলে পড়ে যাব।

শ্বশুর-শাশুড়ী আর সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে গঙ্গাচরণ—না, এখন সে গয়ারাম—দীর্ঘ দিন উত্তরখণ্ডের বহু তীর্থ পরিক্রমা করেছে। মাস-কতক আগে কেন্দুবিশ্বের কাছাকাছি ফেরার পথে ঘটে গেল বিপর্যয়। পড়ে গেল বর্গীর আক্রমণের সম্মুখে। ওর শ্বশুর শাশুড়ী হত হলেন। ধর্ষিতা স্ত্রী আত্মঘাতী হল। গঙ্গাচরণের একখানা চরণের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটিয়ে দিয়ে গেল বর্গীরা। যা ছিল সঙ্গে, অর্থ ও অলঙ্কার, লুণ্ঠিত হল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে আদি সপ্তগ্রামে পৌঁছায়। ওর খুড়তুতো শ্যালকেরা ইতিমধ্যেই সম্পত্তির দখল নিয়েছে। তারা বুঝিয়ে দিল—একখানা গেছে, অবিলম্বে সপ্তগ্রামের সম্পত্তির আশা ত্যাগ না করলে দ্বিতীয় ঠ্যাঙখানাও যাবে। বর্গীরা যা লুট করেছে, আগুনে পুড়িয়েছে, তার ভিতর খোয়া গেছে ওর সেই লাল খেরো খাতাখানা। এ অঞ্চলে তার অনেক-অনেক শ্বশুরবাড়ি; কিন্তু ঠিকানা মনে নেই—শ্বশুরের নাম, পত্নীর নাম, কিছুই যদি বলতে না পারে তাহলে বাড়ি খুঁজে পেলেও কেউ কি খোড়া-জামাইকে বিশ্বাস করে আশ্রয় দেবে?

পাঁচ-সাত বছর দেশত্যাগী থাকায় নেদেরপাড়ার পৈত্রিক ভিটেখানার দখলও গেছে। খড়ো ঘরখানা দু-একটা বর্ষার কোপ সামলেছিল। তারপর মুখ থুবড়ে পড়ে। সরিকেরা ভাঙা কোঠার আবর্জনা সাফা করে জমিটা দখল নিয়ে যে-যার বসতবাড়ি সম্প্রসারিত করে নিয়েছে

ঘটনাচক্রে তাকে চিনতে পেরেছিলেন উলোর রসিকলাল রায়ের জননী ঁআনন্দময়ীতলায় পূজা দিয়ে ফিরে যাবার মুখে। ঁআনন্দময়ী কালীমূর্তি। একটি খড়ো চালাই মায়ের মন্দির[১]। রাজার দেবোত্তর। জনশ্রুতি স্বয়ং আগমবাগীশের প্রতিষ্ঠা করা। তারই প্রবেশদ্বারে ভিক্ষা করতে বসেছে একজন খঞ্জ ভিক্ষুক। একমাথা রুক্ষ চুল, একমুখ দাড়ি। তার আঁচলে একটা কপর্দক ফেলে দিতে গিয়ে কেমন যেন চমকে উঠলেন বৃদ্ধা। বলেন, তোমার নামটি কী, বাবা?

[১. যে সময়ের কথা, তখন আনন্দময়ী মায়ের মূর্তিটি ছিল খড়ো-চালায়। কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র তন্ত্রসাধক মহারাজ গিরীশচন্দ্র 1804 খ্রীষ্টাব্দে চারচালা পাকা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সে অনেক পরের যুগে।]

—নাম? আজ্ঞে গয়ারাম।

—গয়ারাম? ও! গঙ্গাচরণ তোমার কেউ হয়? মুখের আদলটা…

—কোন্ গঙ্গাচরণ, মা? ঁবিষ্টুচরণের সেই কুলাঙ্গার কুপুত্রটা? নেদেরপাড়ার বিবাহ-বিশারদ? তাকে চিনতেন বুঝি? সে মরেছে!

—মারা গেছে! আহা ষাট-ষাট! কতদিন?

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো একটা সম্ভাবনার কথা মনে হল ভিক্ষুকের। বললে, কেন বলুন তো?

–সে আমার জামাই ছিল।

একটা পায়ের উপরেই ভর দিয়ে সোজা হয়ে ওঠে গঙ্গাচরণ! চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার! বৃদ্ধাকে সে চিনতে পারেনি। কেমন করে পারবে? বৃদ্ধার একটিই জামাই! দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে তাই দেখতে পেয়েছেন ওর মুখের আদলটা। কিন্তু গঙ্গাচরণের যে তিনকুড়ি শাশুড়ী! কেমন করে চিনবে?

—কী হয়েছিল তার? কতদিন আগে?

গঙ্গা সে কথার জবাব না দিয়ে বলে, আপনার মেয়ে? সে আসেনি?

—না বাবা। সে নেই। আজ বছর দুই!

আবার বসে পড়ে। দপ্ করে নিবে যায় আশার প্রদীপটা। মেয়েটির কথা ওর মনে নেই।

নামটা জানে না। দুবছর আগেও সে ওর আয়ুষ্কামনা করে সীমন্তে সিঁদুর দিত! ঈস! কী বে-আক্কেলে মেয়েটা! পট করে মরে বসে আছিস্?

—কই বললে না, বাবা ।

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল গঙ্গাচরণ।

বৃদ্ধা ওর পরিচয় জানতে পেরে ভৃত্যকে দিয়ে একখানা এক-ঘোড়ার পাল্কি-গাড়ি আনিয়ে নিলেন। কন্যাটি দুনিয়ার মায়া কাটিয়েছে, তাই বলে উল্লোর রায়বাড়ির জামাই ঁআনন্দময়ীতলায় বসে ভিক্ষা করবে! অসম্ভব!

রসিকলাল ধনী ব্যক্তি। উলোর একজন গণ্যমান্য ভূস্বামী। সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে মায়ের উপর খাপ্পা হয়ে ওঠে। এ কী উটকো আপদ! আনন্দময়ীতলায় বসে ‘গয়ারাম’ ভিক্ষা করছে তাতে মায়ের কী? সে তো আর ‘গঙ্গাচরণ’ নয়!

গঙ্গাচরণের দিকে একটি নগদ সিক্কা টাকা বাড়িয়ে ধরে বলে, বুঝতেই পারছ, আমার ভগিনীটির পরলোকপ্রাপ্তি ঘটেছে। তোমাকে আমাদের আর কোন প্রয়োজন নেই। যেখানে বসে ভিক্ষা করছিলে সেখানেই ফিরে যাও। নাও ধর।

গঙ্গাচরণ হাতদুটি জোড় করে বললে, আর যে তা পারি না, বড়দা!

—বড়দা! একটি চড়ে তোমার নাম ভুলিয়ে দেব! হারামজাদা! আমি রায়মশাই! যা দূর হ!

কোণঠাসা হতে হতে এমন একটা অবস্থা আসে যখন নিরীহ অবোলা জীবও রুখে দাঁড়ায়। প্রত্যাঘাত করতে চায়। গঙ্গাচরণও বোধকরি সহ্যের সেই সীমান্তে পৌঁছেছিল। সারাজীবন সে জামাই-আদরে অভ্যস্ত—আজ মাস-কয়েক সে নিঃস্ব, ভিক্ষাজীবী, পঙ্গু। তাও মেনে নিয়েছিল। তারপর হঠাৎ ঐ বৃদ্ধার সস্নেহ সহানুভূতিতে সে বোধহয় আশার একটা ক্ষীণ রশ্মি দেখতে পেয়ে অন্য জাতের মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। রসিকলালের কথাটা তাই তার সহ্য হল না। বললে, তাড়িয়ে দিলে আর কী করব? ফিরেই যাব—তবে আনন্দময়ীতলায় যে ফিরে গিয়ে বসবে সে নাম-ভুলে-যাওয়া গয়ারাম নয়! সাবেক গঙ্গাচরণ! রায়বাড়ির জামাই।

আর সহ্য হল না রসিকলালের। ছুটে এসে ঠাশ্ করে একটা প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিল। একটা পায়ে দেহভার রক্ষা করতে হয়। গঙ্গাচরণ ভারসাম্য হারালো। হুমড়ি খেয়ে উল্টে পড়ল মার্বেলের মেঝেতে। রসিকলাল গর্জে ওঠে, হারামজাদা! তুই যা ভাবছিস্ তা হবে না। তার আগে তোকে কেটে খড়ের জলে ভাসিয়ে দেব।

পাঁচ আঙুলের দাগ ফুটে উঠেছে গালে। চোখ দুটো ভরে এসেছে জলে। ভূশয্যা থেকে উঠে বসে। যুক্তকরে এবার যে কথাটা বললে তাতে কোন শেষ নেই, কোন প্রত্যাঘাত নেই—তা ওর অন্তর-নিঙরানো আর্তি : তাই দিন, বড়দা! বিশ্বাস করুন—আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে দেখেছি। পারিনি। সাহসে কুলায়নি! অন্তত সেটুকু উগ্গারই করুন! হাজার হোক, এক-কালে তো আপনার বোনাই ছিলাম!

রসিকলাল থমকে গেল! ওর কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল, যাতে ঐ পাকামাথার বৈষয়িক মানুষটাও কোন জবাব খুঁজে পেল না।

মা বললেন, না! ও থাকবে। এ বাড়িতেই। ঐ আস্তাবলের একটেরে। গয়ারাম হিসাবেই। ওকে ভিক্ষা করতে দেব না আমি! কিছুই তো চায় না বেচারি! মাথার উপর ছাদ, আর দু বেলা দু-মুঠো…

—না! তা হয় না!—বৈষয়িক বুদ্ধি ফিরে এসেছে এতক্ষণে। বললে, তুমি বুঝতে পারছ না মা, তাতে নানান রকম বিপদ! কথাটা জানাজানি হয়ে যাবেই! হারামজাদাটাকে তাড়াতে হবে!

মা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ছোটখুকি নেই বলেই এতবড় কথাটা তুই বলতে পারলি, বড়খোকা! কিন্তু আমার কথার নড়চড় হয় না, তা তো তুই জানিস! আমি ওকে আশ্রয় দেব। দেখি, তুই কী করতে পারিস!

সেই থেকে গঙ্গাচরণ—না, গঙ্গাচরণ নয়, গয়ারাম, বাড়ির আস্তাবলের এক কোণায় পড়ে আছে। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে সে। মায়ের মাথাটা হেঁট হতে দেয়নি। পরিচয় গোপন আছে তার—অন্তত তার নিজের তাই বিশ্বাস।

বাস্তবে তা নেই। অনেকেই জানে। গোপন রাখে। রসিকলাল উলোর এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভূস্বামী। তেজারতি কারবার তার। হাতে মাথা কাটতে পারে। মুখরোচক কিস্সাটা তাই কেউ আলোচনা করে না। সুখে থাকতে কে আর ভূতের কিল খেতে চায়? খবরটা বাইরের লোক না জানলে ভারতচন্দ্র সে খবরটা সংগ্রহ করতে পারতেন না। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঐ ধুরন্ধর গুপ্তচর দুদিনেই ওঁকে আসল খবরটা জানাতে পেরেছিল : নেদেরপাড়ার গঙ্গাচরণ এখন উলোয় থাকে—রায়মশায়ের আস্তাবলে। এখন তার নাম : গয়ারাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *