২২
কথায় বলে, স্ত্রীভাগ্যে ধন। ওঁর ভাগ্যে এখনো স্ত্রীধন-লাভ ঘটেনি; সম্বন্ধটা পাকা হয়েছে মাত্র। তবু বড় জাতের একটা লাভের সূচনা হয়ে গেল আকস্মিকভাবে।
প্রস্তাবটা নিয়ে এসেছেন স্বয়ং দুর্গাচরণ। নন্দভায়া ইতিমধ্যে অনেকবার কান ভাঙাতে চেয়েছে, উনি নিজেও বিরক্ত এইসব ছেলে-ছোকরার অশাস্ত্রীয় আচার-বিচারে। তা হোক, মাথা গরম করার মানুষ উনি নন। নির্বিঘ্নে ‘পুন্নাম’ নরক থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা পাকা-হওয়া ইস্তক উনি কাউকে চটাবেন না—গ্রহাচার্য, গুণীন, রাসু দাই বা ধন্বন্তরি।
ঝষধ্বজ দত্ত নবদ্বীপের একজন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী। টাকার কুমির। কী-একটা দুরারোধ্য ব্যাধিতে আজ বছরখানেক ভুগছেন। শান্তি-স্বস্ত্যেন, যজ্ঞ, এবং হাকিমী-কোবরেজি চিকিৎসা হয়েছে। উপশম তো হয়ইনি—ব্যাধির প্রকোপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে। ঋষধ্বজ তন্তুবায়জাত শিল্পের আড়তদার—মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতার বাজারে তাঁর প্রতিপত্তি। দুর্গাচরণের সঙ্গে ব্যবসায়িক সূত্রে আবদ্ধ। গাঙ্গুলী-মশায়ের কাছে সোঞাই গ্রামের ধন্বন্তরির অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনে তিনি লোক পাঠিয়ে দিয়েছেন। কবিরেজমশাই যদি অবিলম্বে নবদ্বীপে পদধূলি দিতে স্বীকৃত হন তাহলে তাঁর যথোপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হবে!
গাঙ্গুলী-মশাই রূপেন্দ্রর কর্ণমূলে নিবেদন করলেন, শোন ভায়া! রাহাখরচ বাবদে পাঁচটি আকবরী মোহর দাবী করেছি আমি—তোমাকে না শুধিয়েই। আর যদি নিরাময় করে দিতে পার, তাহলে বৌমার জন্য একটি দশভরির রত্নহার! বল, কম করে বলেছি?
—বৌমা! বৌমা কে?
—আহাহা! খবরটা কি আমরা জানি না নাকি? আজ কার্তিকের সতের তারিখ। যাতায়াতে সাতদিন। ইদিকে বিয়ের ব্যবস্থা আমরাই করব। সৌরীনদা নেই, আমরাই তো তোমার পিতৃস্থানীয়, না কী বল?
নবদ্বীপ! ভাগীরথী-জলাঙ্গীর সঙ্গমস্থলে ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে এই মহাতীর্থ! এখানেই বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেনের তীর্থাবাস আক্রমণ করেছিল বিধর্মী মহম্মদ বিন বতিয়ারের অশ্বারোহী বাহিনী। বঙ্গলক্ষ্মী অস্তমিত হয়েছিলেন ঐ নবদ্বীপের গঙ্গায়। সমগ্র ভারতাত্মার ধারক এই নবদ্বীপ। সেনযুগে নবদ্বীপ-বিদ্বৎসমাজের জ্যোতিষ্ক ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ জলায়ুধ, পশুপতি, শূলপাণি, উদয়নাচার্য, আব্দিহোধ যোগী। এখানেই আবির্ভূত হয়েছিলেন প্রাক্চৈতন্য যুগে—বাসুদেব সার্বভৌম, অদ্বৈতাচার্য, চিন্তামণি-দীধিতি প্রণেতা ও গৌতমসূত্রের ভাষ্যকার নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি, স্মার্ত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য। বঙ্গদেশের সাকারকালী মূর্তির প্রবর্তক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এই নবদ্বীপে বসেই সচেষ্ট হয়েছিলেন তান্ত্রিক ব্যভিচার থেকে দেশকে রক্ষা করতে—রচনা করেছিলেন প্রামাণিক তান্ত্রিক নিবন্ধ-সংবলিত ‘তন্ত্রসার গ্রন্থ; যা পাঠ করে রূপেন্দ্র প্রণিধান করেছেন ‘বলি’-র কী অর্থ! এখানেই জ্যোতিষ-শাস্ত্রজ্ঞ হৃদয়ানন্দ বিদ্যার্ণব রচনা করেছিলেন ‘জ্যোতিঃসারসংগ্রহ’। ‘শব্দশক্তি-প্রকাশিকা’ প্রণেতা ‘জগদ্গুরু’ জগদীশ তর্কালঙ্কার এই নবদ্বীপেই প্রসিদ্ধিলাভ করেন। তারপর নিমাই পণ্ডিতের কীর্তিকাহিনীর তো কথাই নেই—
—কী হল রূপেন্দ্র? তুমি স্বীকৃত হলে তো? তাকে কী বলব? নাকি আর কিছু দরদস্তুর করব?
রূপেন্দ্র সহাস্যে বলেন, না, খুড়ো! নবদ্বীপ আমি স্বচক্ষে দেখিনি আজও। এ এক দুর্লভ সুযোগ হয়ে গেল। নিশ্চয় যাব।
মনে মনে বললেন—ঐ তামসিক বৃদ্ধ তার অর্থ বুঝবে না বলে—সংসার-জীবনে প্রবেশের ঊষালগ্নে নবদ্বীপের পদধূলি ললাটে লেপন করার এ সৌভাগ্য তাঁর দুর্লভ প্রাপ্তি।
শুনে বেজার হলেন জগুপিসি : এ আবার কী অসৈরন কতা! বিয়ের দিন স্থির হয়ে গেলে আর যে নৌকায় চাপতে নেই! শাস্তরে বারণ।
রূপেন্দ্র পোঁটলা-পুঁটলি বাঁধছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন, আপনি কিছু চিন্তা করবেন না পিসিমা—নৌকায় আমি যাচ্ছি না—শাস্ত্রে বারণ আছে, তা জানি!
—তাহলে?
—মনুসংহিতায় আছে “ইতরতাপশতানি যথেচ্ছয়া বিতর তানি সহে চতুরানন।”
—তার মানে?
—তার মানে, নৌকার পরিবর্তে চতুর ব্যক্তি অশ্বারোহণে যথেচ্ছা গমন করতে পারে, চতুরানন, মানে ব্রহ্মা তা ‘সহে’, অথাৎ সহ্য করেন। আমি ঘোড়ায় যাচ্ছি!
জগুপিসি বলেন, কী জানি বাপু! আমার কেমন সন্দ’ হচ্ছে! শিরোমণি মশাইকে আগে একবার শুধিয়ে দৈখি।
রূপেন্দ্র খাড়া হয়ে দাঁড়ান। বলেন, পিসিমা! কুটুম্ব বলতে আমার একজনই আছে। এই দুর্লভ সুযোগ যখন পেয়েছি তখন নিজে গিয়ে তাকে নিমন্ত্রণ করে আসব। সে জন্যই যাচ্ছি নবদ্বীপ।
জগুপিসি আকাশ থেকে পড়েন। বলেন, মানে? নবদ্বীপে কে তোর কুটুম?
—নবদ্বীপ থেকে গো-আড়ি গা মাত্র ছয় ক্রোশ!
কাত্যায়নী দাঁড়িয়ে ছিল অদূরে। হাত বাড়িয়ে সে চৌকাঠটা ধরল।
মুহূর্ত বিলম্ব হল জগু ঠাকরুণের প্রত্যুত্তর করতে। কন্যা এবং ভ্রাতুষ্পুত্রের দিকে পর্যায়ক্রমে দেখে নিয়ে একটি মাত্র শব্দে নিদান হাঁকলেন : না! :
—না? না কেন? এমন আনন্দের দিনেও তার খোঁজ নেব না?
জগুপিসি চোখে আঁচল দিলেন।
রূপেন্দ্র এগিয়ে এসে একখানি হাত রাখলেন তাঁর পিঠে: পিসিমা?
অশ্রুআর্দ্র মুখখানি তুলে জগু পিসি কথা বলতে গেলেন। ঠোঁট দুটি থরথর করে কেঁপে উঠল। তবু বলতে পারলেন কথাটা : আর ফিরে এসে যদি বলিস্ ঐ আবাগী বৌমারে বরণ করতে পারবেনি? ওর মাছভাত খাওয়া ঘুচেছে?
কাত্যায়নী আর সংযত করতে পারল না নিজেকে। একটা আর্ত শব্দ বার হয়ে এল তার কণ্ঠ থেকে। বোধহয় ‘মা—‘ বলতে চেয়েছিল, শোনালো একটা জান্তব আর্তনাদের মতো : ‘আ―!’
সে বসে পড়েছে ভূশয্যাতেই।
জগুপিসি হু-হু করে কেঁদে ফেললেন। তার মধ্যেই বলে ওঠেন, আমি দিব্যি দিয়ে রাখলাম- রুপো! যাচ্ছিস যা—কিন্তু সে বাঁদরটার খোঁজ নিতে পারবিনি কিন্তু! আমার মাথার দিব্যি রইল!
রূপেন্দ্রনাথ নিথর হয়ে দড়িয়ে থাকেন। এতদিন কেন যে পিসিমা ওঁকে গো-আড়ি গায়ে খোঁজ নিতে নিষেধ করেছিলেন তা প্রণিধান করলেন। কথাটা মিথ্যা নয়! এমন মর্মান্তিক সম্ভাবনার কথা তাঁর মনে পড়েনি!
জগু ঠাকরুণ পূজায় বসেছেন দেখে কাতু ঘনিয়ে এল। ওঁকে আড়ালে টেনে এনে বললে, না দাদা, তুমি যা মতলব করেছ, তা করতে যেও না!
—মতলব করেছি! কী মতলব করেছি আমি?
—আমি জানি। তুমি শাস্তর মান না, দিব্যি দিলেও মান না—তুমি একটা কালাপাহাড়! তুমি খোঁজ নিতে যেওনা গো-আড়ি গায়ে। যা ভাবছ তা হবে না। তুমি ধরা পড়ে যাবে!
—ধরা পড়ে যাব! কার কাছে?
—আমার কাছে! তুমি ভেবেছ—জেনে আসবে, কিন্তু তেমন-তেমন খবর থাকলে তা চেপে যাবে! পারবে না। তোমার মুখ দেখেই আমি বুঝে ফেলব! কী দরকার খুঁচিয়ে ঘা করার? যা হবার নয় তা হবে না! মা ঠিকই বলেছেন—এখন ও বিষয়ে কোন খোঁজ খবর নিতে যেও না। আমি এই তো বেশ আছি!
—ঠিক আছে। তাই যখন তোর ইচ্ছে!
কাতু এবার অন্য জাতের প্রশ্ন করে, আচ্ছা, এ লোকটার অমন অদ্ভুত নাম কেন? ঝষধ্বজ! এমন নাম বাপের জন্মে শুনিনি। তার মানে কী?
রূপেন্দ্র বললেন, ‘ঋষ’ মানে ‘মীন’, মাছ। শব্দটা বহুব্রীহি সমাস। তার অর্থ ‘ঋষ ধবজ যাহার’।
—তারই বা মানে কী?
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল রূপেন্দ্রের। বললেন, কী করে তোকে বোঝাই! তুই যে কুলীন ব্রাহ্মণের জীবনকাব্যে উপেক্ষিতা! ‘মীনধ্বজ’কে তুই যে চিনিস না!
কাত্যায়নী ভুল বুঝল। তার নিরক্ষরতার প্রতি এটা একটা ব্যঙ্গ মনে করে বলে, আমাদের তো হল না। বৌরানীকে বরং শিখিও-জেঠামশায়ের মতো!
বেচারী কাত্যায়নী!