কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৪

১৪

—মহা ধুমধামে জগদ্ধাত্রী পূজা সমাপ্ত হয়ে গেল।

জগদ্ধাত্রী পূজা বঙ্গদেশে প্রচলিত ছিল না এতদিন। নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই তার প্রবর্তক। তাঁরই আমলে তা ছড়িয়ে পড়ে ফরাসডাঙায়। দু-আড়াইশ বছর পরে আজও শুধু ঐ দুটি জনপদে- কৃষ্ণনগর আর চন্দননগরে, জগদ্ধাত্রী পূজার ব্যাপক আয়োজন।

এ পূজার প্রবর্তন নিয়ে একটি কাহিনী প্রচলিত—

নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সাড়ম্বরে দুর্গা পূজা করতেন—বংশানুক্রমিক শারদীয়া দুর্গোৎসব। একবার তিনি নবাবের রাজস্ব; আবওয়াব প্রভৃতি সময় মতো দিতে পারেননি। তাতে নাকি নবাব আলিবর্দী কৃষ্ণচন্দ্রকে কারারুদ্ধ করেন মহাপূজার ঠিক প্রাক্কালে। তাঁর আশা ছিল, বাৎসরিক পূজা থেকে বঞ্চিত হবার আশঙ্কায় রাজা স্বীকৃত হবেন। বাস্তবে হলেনও তাই। ব্রাহ্মণের মৌখিক প্রতিশ্রুতি পেয়ে আলিবর্দী হুকুম দিলেন তাঁকে মুক্ত করে দিতে। বন্দী আবদ্ধ ছিলেন মুঙ্গেরের কারাগারে। নৌকাযোগে তিনি সময়মতো কৃষ্ণনগরের রাজবাটিতে উপনীত হতে পারলেন না। অগ্রদ্বীপের রুকুনপুর ঘাটে যখন পৌঁছালেন তখন দেখতে পেলেন নবমীর সন্ধ্যা নেমেছে। বিজয়া দশমীর ঢাকের বোল শোনা যাচ্ছে! অগ্রদ্বীপ প্রাচীন নবদ্বীপের অন্তর্গত একটি পল্লী। এই সেই রুকুনপুরের অভিশপ্ত ঘাট, যেখানে শ্রীচৈতন্যদেব বৃন্দাবন-যাত্রার সময় আহারান্তে সেবক গোবিন্দ ঘোষের কাছ থেকে মুখশুদ্ধি চেয়েছিলেন, আর গোবিন্দ পূর্বদিনের সঞ্চিত একখণ্ড হরিতকী তার প্রভুকে দেওয়ার অপরাধে বৃন্দাবনতীর্থে যাওয়ার অধিকার হারায়। আজ সেই ঘাটে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র হারালেন মাতৃপূজার অধিকার! কৃষ্ণনগর থেকে জলপথে মাত্র দশ-পনের ক্রোশ দূরে। নিদারুণ হতাশায় ভেঙে পড়লেন রাজা। অস্নাত অভুক্ত ব্রাহ্মণ নৈরাশ্যের অবসাদে নৌকার ভিতরেই ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই রাত্রে তিনি এক বিচিত্র স্বপ্ন দেখলেন—

একটি অপূর্ব সুন্দরী কিশোরী বালিকা এসে যেন দাঁড়িয়েছে তাঁর শিয়রের কাছে। বলছে, মহারাজ, অনশনে প্রাণ দিও না। ওঠ! গঙ্গাজল পান কর।

রাজা ঘুমের মধ্যেই যেন উঠে বসলেন। বললেন, তুমি কে? কেন বলছ আমাকে এই অনশন-ব্রত ভঙ্গ করতে?

কিশোরী বলে, আমাকে চিনতে পারলি না? আমার কথা ভাবতে ভাবতেই তো ঘুমিয়ে পড়েছিলি? আমি পৃথিবী—’পৃথিব্যহং জগদ্ধাত্রী মদ্‌রূপং মৃন্ময়াত্ত্বিদম্’।

বিস্মিত রাজা বলেন, আমি তোমাকে চিনি না! না, আমি তোমার কথা চিন্তা করতে করতে শয়ন করিনি। তুমি তো আমার কন্যার মতো—তিনি আমার মা!

—তিনিই আমি, আমিই তিনি!

এ-কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কিশোরী পরিবর্তিতা হয়ে গেলেন অপরূপা এক মাতৃমূর্তিতে। দুর্গার মতো ইনিও সিংহস্কন্ধ-সমারূঢ়া, তাঁরই মতো দিব্য বিভা, হাস্যময়ী, নানালঙ্কার — ভূষিতা,—কিন্তু দশভুজা নন, চতুর্ভুজা। দুই বাম হস্তে শঙ্খ ও ধনুক এবং দুই দক্ষিণ করে চক্র ও পঞ্চবাণ। রক্তাম্বর পরিহিতা, তাঁর কণ্ঠে রত্নোপবীতের পরিবর্তে সর্পযজ্ঞোপবীত।

মা বললেন, শ্রীরামচন্দ্রের আহ্বানে অকালবোধনে স্বীকৃতা হয়েছিলাম। আজ তেমনি আবার তোর দুর্দশা দেখে স্বীকৃতা হচ্ছি—আগামী শুক্লা নবমী তিথিতে তুই পূজার আয়োজন কর। আমি আসব, এই রূপেই আসব! তোর হাত থেকে অঞ্জলি গ্রহণ করব।

তৎক্ষণাৎ নিদ্রাভঙ্গ হল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের। নৌকার গলুই থেকে বাহিরে বার হয়ে এসে দেখলেন, ঘাটে দশভুজার বিসর্জন হচ্ছে। আজ বিজয়া দশমী।

সংস্কৃতজ্ঞ রাজার মনে পড়ে গেল : বিসর্জন বি পূর্বক সৃজ্ ধাতু অনট!

‘বিসর্জন’ অর্থে বিশেষরূপে জন্ম গ্রহণ করা! ধাতুটা’সৃজ্! মা দশভুজা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—চতুর্ভুজারূপে তিনি আগামী শুক্লা নবমীতে তাঁর রাজবাটিতে আবির্ভূতা হবেন। ঐ যে ঘাটে প্রতিমা বিসর্জনের আয়োজন হচ্ছে ওর মন্ত্রটা : ‘পুনরাগমনায় চ’!

প্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করে পণ্ডিতদের আহ্বান করলেন। স্বপ্নদৃষ্ট মাতৃমূর্তির সবিশেষ বর্ণনা কাউকে বললেন না; শুধু জানতে চাইলেন ‘জগদ্ধাত্রী-দেবীর পূজাবিধি কী? কেমন সে মূর্তি? কোথায় তাঁর পূজা-প্রকরণ পাওয়া যাবে?

বড় বড় তান্ত্রিক পণ্ডিতেরা অধোবদন হলেন। শুধু শঙ্কর তর্কবাগীশ বললেন, মহারাজ! ‘জগদ্ধাত্রী’-দেবীর উল্লেখ আমি ‘কালিকাপুরাণ’ পুঁথিতে পেয়েছি। ঐ মন্ত্রটি আছে সেই পুরাণে : ‘পৃথিব্যহং জগদ্ধাত্রী মদ্‌রূপং মৃন্ময়ত্ত্বিদম্’। ঐ মূর্তিতে ঁমা, সেবার আবির্ভূতা হয়েছিলেন স্বয়ং জনকরাজার কাছে। কিন্তু তাঁর ধ্যানমন্ত্র কী, তা আমি : জানি না।

সে-সময় রাজসভায় উপস্থিত ছিলেন এক দক্ষিণ দেশীয় পণ্ডিত। তিনি জানালেন, সিংহাধিরূঢ়া দেবীমূর্তির পূজা দাক্ষিণাত্যের কোথাও কোথাও প্রচলিত আছে বটে কিন্তু তাঁর ধ্যানমন্ত্র কী—তা জানেন না। মহারাজ বললেন, দাক্ষিণাত্যে হোক বা না হোক, আমি ঐরূপেই মাতৃপূজা করব, আগামী শুক্লা নবমীতে।

ঘূর্ণীর মৃৎ-ভাস্কর বলে, কিন্তু আমরা যে অমন মূর্তি কখনো দেখিনি মহারাজ! নিখুঁত বর্ণনা না জানলে কেমন করে গড়ব?

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ধ্যানে-পাওয়া জগদ্ধাত্রী-মূর্তি

অগত্যা মহারাজকে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে হল শহরপ্রান্তে—সেই আরণ্যক পর্ণকুটীরে। জগদ্ধাত্রীর ধ্যানমন্ত্র কী হতে পারে? পারলে হয়তো ঐ অরণ্যচারীই বলতে পারবেন।

রাজার মুখে সমস্ত বিবরণ শুনে রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত পদ্মাসনে ধ্যানে বসলেন। তারপর এক সময় নিমীলিতনেত্রে পণ্ডিত স্বগতোক্তির মতো মন্ত্রোচ্চারণ করলেন—সেটাই জগদ্ধাত্রীর ধ্যানমন্ত্র : ‘সিংহস্কন্ধ সমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাং চতুর্ভুজাং মহাদেবীম্‌ নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।’

আশ্চর্য! মায়ের যে রূপ তিনি স্বপ্নে দেখেছেন—যার বর্ণনা কারও কাছে করেননি, তর্কসিদ্ধান্তের কাছেও নয়, সেই দেবীর হুবহু রূপবর্ণনা ধ্যানযোগে লাভ করেছেন বুনো রামনাথ : সিংহের পিঠে—নানা আভরণ ভূষিতা চতুর্ভুজা এই মহাদেবীর কণ্ঠে সর্পের যজ্ঞোপবীত।

ফরাসডাঙ্গার ফরাসী সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ছিল গভীর সৌহার্দ্য। ইন্দ্রনারায়ণ সকল বৃত্তান্ত শুনে তাঁর ফরাসডাঙাতেও পর বৎসর এই পূজায় আয়োজন করেন। কারও কারও মতে রাজা কৃষ্ণনগরের এই পূজা প্রবর্তন করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে। অর্থাৎ আমাদের কাহিনীর কিছু পরে। তা হোক, কাহিনীর অনুরোধে সে মত আমরা মানতে পারিনি।

রাজবাড়ির ঠাকুর-দালানে যে দেবীমূর্তি তাতে বাস্তবতা অপেক্ষা ভাবরূপের ব্যঞ্জনা অধিক। ঘূর্ণীর মৃৎশিল্পী বাস্তবতার হদ্দমুদ্দ করতে জানে। রেকাবিতে মাটির এলাচ-লবঙ্গ দিলে অতিথি ভুল করে মুখে ফেলে দেয়! কিন্তু এখানে সেই বাস্তবতা নাই। এমনকি পদতলের সিংহটিকে দেখেও মনে হয়—শিল্পী যখন ‘ইউনিকর্ন’ চেনে না, তখন কি সে সিংহ গড়তে গিয়ে ভুলে ঘোড়া গড়ে ফেলেছে?

জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষে বিরাট মেলার আয়োজন হয় রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে। শত শত বিপণী। নানান অঞ্চলের ব্যাপারীরা আসে বেসাতি নিয়ে। একদিনের পূজা। পরদিন বিসর্জনেরই বা কী সমারোহ। পঞ্চাশ-জোড়া ঢাকি মায়ের শোভাযাত্রার সম্মুখে ঢাক বাজাতে বাজাতে ছুটে চলে : “গুড়-গুড়-গুড় ঢ্যাং! ঐ আসছে/রাজার ঠাকুর/ড্যাং-ড্যাং-ড্যাং/ড্যাং সু…”

পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে সেই বিচিত্র ধ্বনিটা এ বৃদ্ধের কানে লেগে আছে! তাই বিশ্বাস করতে মন চায়—দু-আড়াই শ বছর আগেও ঢাকির বোল ছিল ঐ রকমই।

রূপেন্দ্রনাথকে সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন ভারতচন্দ্র। তাঁর কানে-কানে বললেন, ভোলাকে দু-চার কপর্দক পার্বণী দাও! সেটাই প্রথা। আমিও দিয়েছি।

রূপেন্দ্রের জানা ছিল না। তিনি তৎক্ষণাৎ ভোলাকে ডেকে নগদ একটি টাকাই পাৰ্বণী দিলেন। ভোলা ওঁকে প্রণাম করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *