৯
আশ্চর্য চরিত্র! অত্যন্ত দুঃখের কথা, তাঁর প্রামাণিক জীবনী নেই!
ধাত্রী গ্রামের গুরু ভট্টাচার্য বংশীয় পণ্ডিত। মনে হয়, সমকালীন নবদ্বীপের পণ্ডিতনিচয়ের মধ্যে বয়োজেষ্ঠ। পিতার নাম অভয়রাম তর্কভূষণ। পিতা তাঁকে ভর্তি করে দিয়ে গেলেন তৎকালীন নবদ্বীপের সর্বপ্রধান নৈয়ায়িক রামনারায়ণ তর্কপঞ্চাননের গুরুকুল চতুষ্পাঠীতে।
এখানে বোধহয় ‘চতুষ্পাঠী’ শব্দটির কিছু পরিচয় দিয়ে রাখা ভাল। ‘চতুঃ’ শব্দটি চারি বেদের দ্যোতক। অর্থাৎ যে বিদ্যায়তনে চতুর্বেদের চর্চা হয়। যে আমলের কথা, তখন যাবতীয় শাস্ত্রের অধ্যয়ন-অধ্যাপনের ব্যবস্থা হত চতুষ্পাঠীতে বা টোলে। অর্থাৎ চতুর্বেদের অধ্যয়ন-প্রস্তুতি—ষড়ঙ্গ (শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ) এবং ষড়দর্শন (সাংখ্য, ন্যায়, বৈশেষিক, যোগ, পূর্ব ও উত্তর মীমাংসা)। ছাত্ররা গুরুগৃহেই বাস করত! এক-এক টোলে দু-চারটি ছাত্র। গুরুপত্নী তাদের জন্য রন্ধন করতেন। কোন কোন সম্পন্ন গুরু এজন্য শিষ্যদের কাছ থেকে ‘সিধা’ নিতেন না—তাঁরা বিদ্যাদানের পুণ্য সঞ্চয় করতেন। অধিকাংশই শিষ্যদের কাছ থেকে প্রণামী পেতেন। কখনো বা ভূস্বামী এই ব্যয়ভার বহন করেন। যেমন মহাপণ্ডিত শঙ্কর তর্কবাগীশের চতুষ্পাঠী। অতি বৃহৎ আয়োজন। প্রকাণ্ড চণ্ডীমণ্ডপ, আটচালা ঘর। চারি দিকে টানা বারান্দা। এক এক দিকে এক এক আয়োজন : ব্যাকরণ, কাব্য, ন্যায়। তর্কবাগীশের চতুষ্পাঠীর বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্ররা যারা নব্যন্যায় বা বেদান্ত অধ্যয়ন করছে, তারা সেই বারান্দায় পঠন-পাঠনের তত্ত্বতালাশ নেয়। শঙ্কর স্বয়ং সেখানে গিয়ে তদারকি করেন। তিনি নিজে অধ্যাপনা করেন আটচালার ভিতরের ঘরখানিতে। নব্যন্যায় অথবা বেদান্ত। বিস্তৃত প্রাঙ্গণ ঘিরে সারি সারি ছাত্রাবাস। কিছু দূরে রন্ধনশালা, ভাণ্ডাবঘর। পাচক-ভৃত্য-দ্বারপাল। দৈনিক দুই-তিনশ কলাপাতার প্রয়োজন হয়। সে এক এলাহী কাণ্ড। ছোটমাপের আবাসিক মহাবিদ্যালয় যেন। সমস্ত ব্যয়ভার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের।
রামনাথ তাঁর সহাধ্যায়ীদলের মধ্যে ছিলেন সর্বাপেক্ষা মেধাবী। তিনিও গুরুর আশীর্বাদ আধা-আধি সফল করতে পেরেছিলেন। শেষ পরীক্ষায় আশ্চর্য কৃতিত্ব দেখিয়ে পঞ্চানন-গুরুকুল থেকে উপাধি লাভ করলেন: ‘তর্কসিদ্ধান্ত।’ গুরুকে প্রণাম করার সময় তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন : জ্ঞান ও সত্যনিষ্ঠায় তুমি বাগদেবীর আশীর্বাদ লাভ করবে; বিদ্যোৎসাহী রাজার অনুগ্রহে লক্ষ্মীর স্নেহধন্য হবে!
আশীর্বাদের শেষাংশ সার্থক করতে পারেননি ‘বুনো রামনাথ’।
উপাধিলাভের পর সে-আমলে কর্মসন্ধানে শিক্ষিত বেকারদের পথে পথে ঘুরতে হত না। উপাধিপত্রটি বগলদাবা করে সরাসরি চলে যেত রাজার কাছে। লাভ করত নিষ্কর ভূমি, টোল-নির্মাণের ব্যয়ভার। খুলে বসত একটি নতুন চতুষ্পাঠী। নবদ্বীপের গণনাতীত টোলের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটত বিনা আয়াসে। রামনাথের সহাধ্যায়ীরা সেভাবে সহজে জীবন শুরু করে দিলেন। উপযুক্ত, উপার্জনক্ষম নব্যপণ্ডিতদলের অভিভাবক সমীপে আনাগোনা শুরু করল ঘটকের দল।
গোল বাধল রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের বেলায়। দুটি হেতুতে।
এক : তিনি রাজানুগ্রহ গ্রহণ করবেন না।
দুই.: তিনি অকৃতদার নন, সংসারী!
ছাত্রাবস্থাতেই নিতান্ত কিশোর বয়সে একটি বালিকার পাণিগ্রহণ করেছিলেন।
তোমরা আমাকে মার্জনা কর, দিদিভাই! অক্ষমতার কথা অকপটে স্বীকার করছি। জানি, কথাশিল্পী হিসাবে দারুণ একটা রোমান্টিক খণ্ডকাহিনী পরিবেশনের সুযোগ হারাচ্ছি। কী করব? কল্পনায় ঐ অবিশ্বাস্য ঘটনাটি কিছুতেই ধরতে পারছি না। খুলেই বলি :
অনুরূপ ‘পাপকার্যটি’ করেছিলেন আলোচ্য শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবি : ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। ছাত্রাবস্থায় অভিভাবকদের সম্মতি ব্যতিরেকে একটি নোলক-পরা বালিকার সিঁথিমূলে একে দিয়েছিলেন সিন্দুরবিন্দু। ইতিহাস শুধু বলছে—ঘটনাটা তেজপুর নামক গ্রামে, বালিকাবধূর নাম : ‘রাধা’; তার পিতৃদেবের নাম : ‘কেশরকুনী আচার্য।’ ব্যস্! এছাড়া আর কোন তথ্য ইতিহাসের স্মরণে নেই। কবি তাঁর কাব্যে নিজেকে ‘রাধানাথ’ বলে উল্লেখ না করলে কবিপ্রিয়ার নামটাও আমরা জানতে পারতাম না। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘অমাবস্যার গান’-এ কল্পনায় সে ঘটনার বিস্তার করেননি। কেন করেননি জানি না। তাই পাদপূরণ করতে আমি এখানে কিছু ‘গপ্পো’ ফেঁদেছি—ঐ বাগদেবীর যৌথ আরাধনার কল্পিত কাহিনী। কিন্তু এবার, রামনাথের বেলায় কোন উদ্ভট কল্পনার আঁকশি বাড়িয়ে ঐ অবিশ্বাস্য নিষিদ্ধ ফলটির নাগাল পাচ্ছি না। যে চরিত্রটির রেখাচিত্র আঁকতে বসেছি সেই আত্মভোলা, গ্রন্থকীট, ভিন্ন জগতের অ-রোমান্টিক পণ্ডিতটি যে কী করে এমন একটা কেরামতি কিশোর বয়সে দেখিয়েছিলেন তা আমার আন্দাজের বাইরে। এ. এমন একটা জটিল ব্যাপার যা কথাসাহিত্যিকের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব কাণ্ড-কারখানা ঘটানোর হিম্মৎ শুধু সেই অলক্ষ্য নাট্যকারের—যিনি কারও তোয়াক্কা করেন না। যিনি অনায়াসে বলতে পারেন : গদাধরও সারদামণিকে বিবাহ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন!
আমি শুধু তোমাদের মেনে নিতে বলব—ইতিহাস-পরিবেশিত তথ্যটা। অষ্টাদশ বর্ষীয় কিশোর পণ্ডিত তাঁর চতুর্দশ বর্ষীয়া সহধর্মিণীকে নিয়ে সংসার পাতবেন। চতুষ্পাঠী খুলে বসবেন। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি নাই। সহাধ্যায়ীরা যেভাবে সহজ সমাধান করল, তাও পারলেন না, অর্থাৎ রাজানুগ্রহ হাত পেতে গ্রহণ করতে।
তবু যাহোক ব্যবস্থা হল। কারণ তুরুপের টেক্কাখানা ছিল অজান্তেই ওঁর হাতে। যে দু-তিনটি মেধাবী ছাত্রকে নিয়ে শুরু করলেন তারাই হয়ে উঠল ওঁর স্বনির্বাচিত বিজ্ঞাপনদাতা : দারুণ পড়ান উনি! কাশী-মিথিলার কথা জানি না; কিন্তু নবদ্বীপে এমনটি নেই। বিশ্বাস না হয় একদিন আসিস। শুনে যাস্ তাঁর অধ্যাপন-পদ্ধতি।
গুটিগুটি অন্যান্য চতুষ্পাঠীর ছাত্রদল এসে বসত। চুপচাপ শুনত। তারা ভর্তি হতে চাইত ওঁর টোলে’। রামনাথ স্বীকৃত হতে পারতেন না। আর্থিক অসচ্ছলতা। ছাত্রেরা বলত—আমরা প্রণামী দেব আপনাকে।
অকফলা সমেত ঘনঘন নড়ে উঠত পণ্ডিতের মুণ্ডিত মস্তক। তা কি হয়? বিদ্যা ‘বিক্রয়’ করতে নেই! শুধু ‘দান’ করতে হয়! তোমরা এস, বস, শোন। যদি কোন ‘অনুপপত্তি’ থাকে অসঙ্কোচে সমাধান জেনে নিও। কিন্তু কোনক্রমেই কোন প্রতিদান দেবার চেষ্টা কর না।
অনতিবিলম্বেই প্রখ্যাত হয়ে পড়েন রামনাথ—আদর্শ শিক্ষক হিসাবে।
যে দু-তিনটি ছাত্রকে আশ্রয় দিয়েছেন তাদের আহার্য-ব্যয় নিজেই বহন করেন। কী করে করেন তা ঈশ্বর জানেন!
ছাত্ররা বাধ্য হয়ে রাজী হয়। তারা নিজগৃহে আহারান্তে ছুটে আসে ওঁর কাছে। সারাদিন পঠন-পাঠন করে সন্ধ্যায় স্বগৃহে ফিরে যায়। তাতে আপত্তি নেই পণ্ডিতের।
এই আদর্শ শিক্ষকের চতুষ্পাঠীতে শিক্ষাদানের পদ্ধতিটি নানা কারণে বিচিত্র। একটি কথা তো আগেই বলেছি—অবৈতনিক শিক্ষা দান।
সেটা অভূতপূর্ব নয়। অনেক সঙ্গতিসম্পন্ন অধ্যাপক বিনাবেতনে নিজব্যয়ে গুরুগৃহে শিষ্যদের ভরণপোষণ করতেন। তাঁরা নির্লোভ এবং বিদ্যাদানকে পুণ্যকার্য মনে করতেন! সুতরাং রামনাথের সে কাজটা দুঃসাহসিক হতে পারে, অশ্রুতপূৰ্ব নয়।
অভূতপূর্ব যে কাণ্ডটা করলেন তা—দুর্বিনীত ছাত্রদের শাস্তিদানের ব্যবস্থা
তাহলে গোবিন্দ রায়ের বিচিত্র অভিজ্ঞতাটা শোনাই :
পরবর্তী জমানার—রাজা শিবচন্দ্রের আমলের প্রখ্যাত নৈয়ায়িক গোবিন্দচন্দ্র ন্যায়তীর্থের বাল্যকালের এক বিচিত্র স্মৃতিচারণ। কী নিদারুণ শাস্তি, পেয়েছিলেন তিনি গুরু রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের কাছে।
সেটা চৈত্রমাসের শেষাশেষি। চৈত্র শুক্লা একাদশী তিথি। প্রায় মাসখানেকের জন্য কৃষ্ণনগরে একটি বিখ্যাত মেলা হয়, অন্তত হত : বারো দোল। নদীয়ারাজ্যের বিভিন্ন মন্দির থেকে দোলায় চাপিয়ে আনা হয় দ্বাদশটি কৃষ্ণ-রাধার মূর্তি। বারোটি বিগ্রহের এক সঙ্গে ‘দোল’ হয়। কেউ যুগলে, কেউ একাকী, কেউ বা নাড়ুগোপাল। তাঁর একটি বিগ্রহের বিষয়ে কৃষ্ণনগরে প্রচলিত আছে একটি অলৌকিক উপকথা : মদনমোহন! কিন্তু সে-কথা এখন থাক। পরে বলব, রাজা নবকৃষ্ণের প্রসঙ্গে। আমি ভুলে গেলে তোমরা আমাকে মনে করিয়ে দিও, দিদি!
হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম—বৃদ্ধ বয়সে গোবিন্দচন্দ্র ন্যায়তীর্থ তাঁর শিষ্যদের জানিয়েছিলেন, কীভাবে তিনি রামনাথের কাছে শাস্তি লাভ করেন।
‘বারোদোল’ উপলক্ষ্যে পরপর তিন দিন চতুষ্পাঠীতে অনধ্যায়। টোলে ছুটি থাকলে রামনাথ নির্দেশ দিতেন স্বগৃহে প্রতিটি ছাত্র কিছু কিছু পাঠাভ্যাস করবে। আজকের দিনের পরিভাষায় যাকে ‘হোমটাস্ক’ বলে আর কী। বারোদোলের মেলার হুল্লোড়ে বালক গোবিন্দ পড়ায় হাঁকি দিয়েছিলেন। অবকাশ-অন্তে গুরু রামনাথ যখন পড়া ধরলেন তখন কিছুই বলতে পারলেন না। মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস নাই, জিজ্ঞাসিত হয়ে স্বীকার করলেন—তাঁর বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়নি। সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য যে পাঠাভ্যাসে মন দিতে পারেননি, তা নয়। স্বীকার করলেন, অন্যায় করেছেন। গুরু জানতে চাইলেন, তুমি তাহলে মেনে নিচ্ছ যে, তোমার শাস্তি প্রাপ্য? গোবিন্দ নতমস্তকে সে কথা মেনে নিলেন। তখন রামনাথ বললেন, তাহলে তোমার গুরুপত্নীকে ডেকে নিয়ে এস, বাবা।
অনতিবিলম্বে পণ্ডিতগৃহিণী—তাঁর নামটা পাইনি—এসে দ্বারপ্রান্তে দণ্ডায়মানা হলেন। রামনাথ বললেন, শোন। আজ আমার উপবাস। গোবিন্দের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে আমাকে।
গৃহিণী জানতে চান, সমস্ত দিন?
—শুধু আজ নয়, হয়তো কালও। দেখি, ওর কতক্ষণ লাগে। যাও বাবা গোবিন্দ, বাড়ি যাও। পাঠাভ্যাস হয়ে গেলে এসে আমাকে জানিও!
গৃহিণী আবাসিক ছাত্র তিনজনকে বললেন, তোমরা কী করবে? কাঁচা ফলার? উনি উপবাস করবেন, ফলে আমারও উপবাস! তোমরা কাঁচা ফলার করলে আজ অরন্ধনের ব্যবস্থাই করি।
ওদের মুখপাত্র বললে, সে কী মা! আপনারা উপবাসী থাকবেন, আর আমরা কাঁচা ফলার করব? তা হয় না।
হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে গোবিন্দ বাড়ি ফিরে গেল। বলাবাহুল্য, সেদিন নাওয়া-খাওয়া হল না তার। সমস্ত দিন পাঠাভ্যাস করে তিনদিনের পড়া একদিনে আয়ত্ত করে সন্ধ্যায় ফিরে এল চতুষ্পাঠীতে। রামনাথ গৃহিণীকে ডেকে বললেন, উনুনে আগুন দাও। দু-মুঠো চাল বেশি নিও। গোবিন্দ বেচারির মুখখানাও শুকিয়ে গেছে! ও বোধহয় নাওয়া-খাওয়ার সময় পায়নি। না কী রে?
গোবিন্দ মুখ লুকিয়ে হাসে। বাহুল্য বোধে প্রশ্নটার জবাব দেয় না।
বেত্রদণ্ড—যা নাকি সে-আমলে ছিল টোলের এক আবশ্যিক উপাদান, তার প্রয়োজন হয়নি কখনো এই চতুষ্পাঠীতে। পাছে গুরু-গুর্বী অনশন শুরু করে দেন তাই ছাত্রদল চোখে রেডির তেল দিয়ে রাত জেগে পাঠাভ্যাস করত।
ভৈরব মজুমদারের শাস্তিটা ছিল আরও নির্মম। তাকে বহিষ্কার দণ্ড দিয়েছিলেন! আজকের ভাষায় যাকে বলে ‘রাটিকেট’ করা। আর কোনদিন মুখদর্শন করেননি প্রিয় ছাত্রের। বেচারী ভৈরব। তার উপাধিলাভ করা আর হয়নি। বিতাড়িত হয়ে অন্য কোন অধ্যাপকের চতুষ্পাঠীতে গিয়ে ভর্তি হতে পারেনি। ভৈরবের অপরাধটা ছিল হিমালয়াস্তিক। পাঠে অবহেলা তবু ক্ষমা করা যায়, কিন্তু চৌর্যাপরাধ? ব্রাহ্মণ সন্তান! গুরুগৃহে চুরি! না, তার ক্ষমা নাই!
ভৈরব ধর্মী গৃহের সন্তান। দুধ-ঘি-ননী তার নিত্যবরাদ্দ। আবাসিক তিনটি সহাধ্যায়ীকে বেগুনপোড়া অথবা শাকান্ন গ্রহণ করতে দেখে মনে দুঃখ হত। লক্ষ্য করে দেখত—তাদের উদরপূর্তি হয়নি, তবু ‘ব্যাঘ্র-ঝম্পনে’ গুরুপত্নীকে বাধা দিত : ‘আর দেবেন না মা! পারব না! তারা যে জানে, শিষ্যদের আহারান্তে গুরু-গুর্বী মধ্যাহ্নআহারে বসবেন—আর জানে, তাঁদের দুজনের জন্য হাঁড়িতে কতটুকু পড়ে আছে!
ভৈরব চুরি করতে শুরু করল!
লুকিয়ে পেট-কোঁচড়ে নিয়ে আসত চাউল। নিজেদের বাড়ি থেকে। গুরুপত্নী নদীতে জল আনতে গেলে নিপুণ হস্তলাঘবতায় তাঁর রান্নঘরে ঢুকে বেতের টুকরিতে মিশিয়ে দিত চুরি করে আনা চাউল।
গুরু-গুর্বী টের পেতেন না। বিস্মিত হতেন।
পণ্ডিতমশাই অন্নগ্রহণকালে বাক-সংযম করে থাকেন। আচমনের পরে গৃহিণীর সঙ্গে এ নিয়ে হয়তো কিছু আলাপচারিও হত। আড়াল থেকে শুনে ভৈরব মনে মনে হাসত
ইতিপূর্বে রামনাথ পণ্ডিত-মশাইকে ‘অ-রোমান্টিক’ বলেছি। তা বলে তিনি ‘অরসিক’ ছিলেন না মোটেই। সময়-সময় দিব্যি রসিকতা করতেন। বলতেন, গুরুভোজনের পর মুখশুদ্ধি করা বিধেয়! কই গো করঙ্কধারিণী! পান-গুবাক-কপূরের খুঞ্চিটা নিয়ে এস!
পণ্ডিতজায়া মুখে আঁচলচাপা দিয়ে নারকেলের মালায় করে নিয়ে আসতেন তাঁর মুখশুদ্ধির সামান্য আয়োজন—দু-চার টুকরা হরীতকী! তিনিও হয়তো রসিকতা করে বলেন, খুব গুরুভোজন হয়ে গেল বুঝি আজ? হজমী দেব?
–হল না? সেই যাকে বলে—“ওরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা, গাইক ঘিত্তা, দুগ্ধ সজুক্তা/মৌইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা, দিজ্জই কান্তা খা (ই) পুনবন্তা।”
পণ্ডিতগৃহিণী অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, কতদিন বলেছি যে, ঐ দেবভাষা বুঝি না?
—না, না গিন্নি! এ সংস্কৃত নয়—খাঁটি বাঙলা।
–বাঙলা? কিছু তো বোঝা যাচ্ছে না?
–বোঝ-না-বোঝ এ চলিত বাঙলা। চর্যাপদের। প্রাকৃত পৈঙ্গল। এ ভাষাতেই গৌড়জন কথা বলত চার-পাঁচ’শ বছর পূর্বে। শ্লোকটির অর্থ হল “কদলীপত্রে গরম ভাত, গাওয়া ঘি, সঙ্গে দুধ, মৌরলা মাছের ঝোল এবং নালিতা শাক যে গৃহিণী নিত্য পরিবেশনে সক্ষম তাঁর ভর্তা পুণ্যবান।—এতে আর সন্দেহ কী?
—আপনার গিন্নি বুঝি আপনাকে তাই নিত্যি পরিবেশন করে?
—না, তা নয়। তবে কী জান? মূল পদটি ‘অন্ন’। অন্নের বর্ণনায় নৈষধচরিতের কবি বলছেন, “পরিবেশিত অন্ন হইতে ধূম নির্গত হইতেছে, তাহার প্রত্যেকটি দানা অভগ্ন, একটি হইতে অপরটি বিচ্ছিন্ন”—অর্থাৎ ঐ তোমরা যাকে বল, ‘ঝরঝরে ভাত’,—”সে-অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু, সুশুভ্র, সুচিক্কণ এবং সৌরভ-গৌরবাশ্রিত”! বুঝলে? আমি হাট থেকে নিয়ে আসি বোরোধানের আকাড়া লাল-চাল, আর তোমার শাঁখাপরা হাতের পরশমণির ছোয়ায় তা থেকে নির্গত হয় গোবিন্দভোগ চাউলের সৌরভগৌরব!
ভরব মনে মনে হাসত। এঁরা বৈষ্ণব নন, নিরামিষাশী নন; কিন্তু বাড়িতে মাছ আসে মাসে দুদিন। কৃষ্ণপক্ষে এক দিন, শুক্লপক্ষে একদিন। পণ্ডিত গৃহিণীর এ বিলাসিতাটুকু বরদাস্ত করতে বাধ্য হয়েছেন। কী করা যাবে? স্ত্রীজাতীর সংস্কার! দুটি একাদশী তিথিতে মেধো-মালো যা-হোক দুটো মাছ ফেলে দিয়ে যায় : মৌরলা, খলিসা, সরপুঁটি, চাঁদা।
জীমূতবাহনের মতে শামুক, কাঁকড়া, হাঁস, দাত্যূহ পক্ষীর মতো বাণ-বোয়াল ব্রাহ্মণের অভক্ষ্য। কিন্তু বৃহদ্ধর্মপুরাণ বলেছেন, সৎব্রাহ্মণও অন্নসেবাকালে গ্রহণ করতে পারেন, রোহিত, ইল্লিস, শফরী, কাতল ও সকুল-মৎস। কিন্তু যে ব্রাহ্মণ রাজানুগ্রহ অথবা শিষ্যদের প্রণামী গ্রহণ করতে অক্ষম, তাঁর পক্ষে কী কী মৎস, কী উপায়ে ভক্ষ্য তা কোন সংহিতা বা পুরাণে লেখা নেই। ফলে ওঁরা ব্যয়-সঙ্কোচ আর সংস্কারের একটা মাঝামাঝি রক্ষা করেছেন : “পক্ষে এক, ষন্নাসে বারো/তারপর যত কমাতে পারো!’
তারপর একদিন।
তস্করের মানসিকতাও ক্রমবর্ধমানধর্মী : ‘হবিষা কৃষ্ণবর্তেব’[১]। তার সাহস বেড়ে যায়। গুবীর টুকরিতে ছিল দুটি বেগুন। পরদিন সকালে দেখা গেল গণ্ডা পুরেছে। হংসীতে আণ্ডা দেয়, পাঠশালায় ছাত্ররা ‘গণ্ডায় আণ্ডা’ দেয় তা বলে বার্তাকু আণ্ডা পাড়বে টুকরিতে! ব্রাহ্মণী ওই অলৌকিক ঘটনাটি বিবৃত করলেন পাণ্ডিতকে। অধীত বিদ্যার বাহির-জগতের সংবাদ উনি তেমন কিছু রাখতেন না—কিন্তু উদ্ভিদবিদ্যা সম্বন্ধে এ সামান্য জ্ঞানটুকু ছিল : বেগুন ‘গাছে ফলে! খেতের টুকরিতে তার বংশবৃদ্ধি অপ্রাকৃত ঘটনা! পণ্ডিত শিষ্যবর্গের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে বসলেন।
[১. অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলে যেমন হয়।]
‘হস্তলাঘবতা’ আয়ত্ত করতে শিখেছে আর ‘অনৃতভাষণ’ অভ্যাস করেনি! দোষ তো একা ভৈরবের নয়, গুরুও যে দায়ী। মিছেকথা বলা শেখাতে পারেননি। নতমস্তকে স্বীকার করল। তৎক্ষণাৎ বহিষ্কারদণ্ড!
ভৈরব মজুমদার কোন উপাধিলাভ করতে পারেনি। যে বেত্রদণ্ড চতুষ্পাঠীতে দেখেনি, তাই দেখল পিতৃদেবের হস্তে। না, নিজবাটিতে চুরি করার অপরাধে নয়—বহিষ্কারদণ্ড লাভের পর যখন সে প্রত্যাখ্যান করল দ্বিতীয় কোন চতুষ্পাঠীতে ভর্তি হতে! বাপ অভিশাপ দিল, থাক! বামুনের ছেলে, মুখ্যু হয়েই থাক!
তাও সে থাকেনি। উপাধি লাভ না করলেও পরবর্তী জমানার লব্ধপ্রতিষ্ঠ ভূস্বামী ভৈরব মজুমদার অশিক্ষিত ছিলেন না আদৌ। ভাগবৎ তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। পড়াশুনা তিনি করেছিলেন। কোনও চতুষ্পাঠীতে নয়। একলব্যের একান্ত সাধনা!
গুরু রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের এক জোড়া বাতিল-খড়মকে সাক্ষী রেখে!
চোখের জলে ভাসতে ভাসতে অপুত্রক গুরুপত্নী সেটি উপহার দিয়েছিলেন হতভাগ্যকে। চতুষ্পাঠী গৃহটি এতই ক্ষুদ্রায়তন যে বিদ্যাদানের আয়োজন করতে হয়েছিল সংলগ্ন উদ্যানে। সেটিও ক্ষুদ্র।
ক্ষুদ্র। ফলে সেখানেও স্থানাভাব দেখা দিল। তদ্ভিন্ন—শহুরে পরিবেশে—ক্রমাগত কোলাহল-শোভাযাত্রা-সংকীর্তন—এতে বাগদেবীর আরাধনায় ব্যাত ঘটে। শহরে খাদ্যদ্রব্যও দুর্মূল্য। রামনাথ সিদ্ধান্তে এলেন—সব তর্কের শেষ সিদ্ধান্ত : অরণ্যচারী হয়ে যাবেন সস্ত্রীক। বানপ্রস্থ! জলাঙ্গীর ধারে,
পান্তু শশক, হা ক্রৌঞ্চবকদের প্রতিবেশী হয়ে যাবেন। সেখানে কোলাহল নাই—মৌনপাদপের অশ্রুত সামগান, বনফুলের স্নিগ্ধ সৌরভ—প্রকৃতির নিবিড় অঞ্চলের ‘শান্তিনিকেতনে আশ্রয় নেবেন এবার। উপনিষদের ঢঙে।
নবদ্বীপ-শহরপ্রান্তে, জলাঙ্গীর ধারে—সেই যেখানে আরণ্যক ধ্যানমগ্নতা থমকে দাঁড়িয়েছে শহুরে পরিবেশের জৌলুষ দেখে, সেই সীমান্ত-রেখাটা অতিক্রম করে নির্জনতার কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে একটি কুটির নির্মাণ করলেন। বাঁশ-দড়ি-খড়, মাটির দেওয়াল, মাটির নিকানো মেঝে ঘরামি লাগানোর সঙ্গতি নাই। শিষ্যদের সাহায্যে স্বয়ং নির্মাণ করলেন একটি পর্ণকুটির। শহুরে টোল থেকে গো-গাড়িতে নিয়ে যেতে হল ঘর-গেরস্থালীর যাবতীয় সরঞ্জাম। তার বৃকোদর-অংশ শুধু হাতে লেখা পুঁথি। গৃহিণী নিত্য শোনেন—গৃহ শেষ হয়ে এসেছে। জানতে চান: কেমন বাড়ি হল গো?
পণ্ডিত কৌতুক করে বলেন, রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজপ্রাসাদের বর্ণনাটা মনে আছে, গিন্নি-ও কালিদাসের বর্ণনায়? শোন বলি :
“চলৎ কাষ্ঠং গলৎকুড্যমুত্তানতৃণ সঞ্চয়ম্।
গণ্ডুপদার্থিমণ্ডূকাকীর্ণং জীৰ্ণং মম।।”[১]
[১. কাঠের খুঁটি নড়বড় করে, মাটির দেওয়াল গলে গলে পড়ে, চালের খড় একটু হাওয়াতেই উড়ে পালায়, আর কেঁচোর সন্ধানে উদগ্রীব ব্যাঙের সমাবেশে আমার জীর্ণ গৃহ আকীর্ণ।]
গৃহিণী বলেন, সাদা বাঙলায় তার মানে কী হল?
—সেটা স্বচক্ষে গিয়ে দেখতে হবে।
শিষ্যরা প্রমাদ গনে। এতটা পথ তাদের প্রতিদিন যাতায়াত করতে হবে? উপায় নাই। গুরুগৃহে বাস করার প্রশ্নই ওঠে না; আবার ওঁকে ত্যাগ করে অন্য কোন চতুষ্পাঠীতে যেতে পারে না। কিন্তু একথা ওঁকে কে বোঝাবে?
কথাটা কানে গেল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের। খোঁজ খবর নিলেন তিনি। বিভিন্ন টোলের বিশ-পঞ্চাশটি ছাত্রের গোপন এজাহার নেওয়া হল। সর্ববাদীসম্মত মত : রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের সমতুল্য পণ্ডিত-তথা-শিক্ষক নবদ্বীপে দ্বিতীয় নাই। মহারাজ। অতঃপর তাঁর কিশোর জ্যেষ্ঠপুত্রকে আদেশ দিলেন ঐ অরণ্যপ্রান্তে গিয়ে রামনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাঁকে অনুরোধ করতে, তিনি যেন নবদ্বীপধামে এসে তাঁর চতুষ্পাঠী খুলে বসেন। যাবতীয় ব্যয়ভার রাজসরকারের। অযাচিত বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। il
শঙ্কর তর্কবাগীশ তখন সেখানে উপস্থিত। বললেন, বাবা শিবচন্দ্র, মনে রেখ, উনি অত্যন্ত অভিমানী; সেজন্যই স্বয়ং উপযাচক হয়ে রাজদরবারে আসেননি।
কৃষ্ণচন্দ্র বলেন, সে তো বটেই! উপযাচক আমি। তাই তাঁর ভদ্রাসনে যুবরাজকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। গরজ আমার। নবদ্বীপরাজ্যে বিদ্যাচর্চার প্রসার।
শিবচন্দ্র উভয়কে প্রণাম করে বিদায় নিচ্ছিলেন। রাজা তাঁকে আবার ফিরে ডাকলেন। উপদেশ দিলেন, শোন বাবা, আর একটি কথা বলি। তর্কসিদ্ধান্ত অস্বীকৃত হলে গোপনে তাঁর ব্রাহ্মণীর সঙ্গে সাক্ষাত করে তাঁকে অনুরোধ কর।
শিবচন্দ্র প্রস্থান করার পর শঙ্কর তর্কবাগীশের দিকে ফিরে রাজা বাম চক্ষুটি মুদ্রিত করে বললেন, কোন কোন পণ্ডিতের কাছে রাজাদেশের অপেক্ষা অর্ধাঙ্গিনীর আদেশ অধিক পরিমাণে ফলপ্রসূ।
শঙ্কর সহাস্যে বলেন, জানি মহারাজ!
মহারাজও ফিরিয়ে দেন সহাস্য জবাব,—আপনি তো জানবেনই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। থেকে!
শিবচন্দ্র অশ্বপৃষ্ঠে উপনীত হলেন রামনাথের চতুষ্পাঠীতে।
আরণ্যক পরিবেশ। মহামৌন পাদপের সারি রুদ্ধশ্বাসে শোনে তর্কসিদ্ধান্তের তত্ত্বকথা। দশ-পনেরটি শিষ্য গুরুকে ঘিরে বসে আছে। অশ্বারোহী রাজপুরুষ কিছু দূরে অশ্ব থেকে অবতরণ করলেন। পদব্রজে এগিয়ে আসেন। প্রণাম করলেন তর্কসিদ্ধান্তকে। তিনি ভ্রূক্ষেপ ও করলেন না। প্রায় একদণ্ডকাল শিবচন্দ্র ছাত্রদলের পিছনে বসে শুনে গেলেন। বিন্দুবিসর্গ বোধগম্য হল না। পাঠ সমাপ্ত হলে শিষ্যদল তাঁকে প্রণাম করে একে একে বিদায় হল। শিবচন্দ্ৰ পুনরায় অগ্রসর হয়ে আসেন। দ্বিতীয়বার প্রণাম করলেন ব্রাহ্মণকে। এতক্ষণে নজর হল। বললেন, “কে বাবা তুমি? কী চাও?
—আজ্ঞে আমার নাম শ্রী শিবচন্দ্র। ঠাকুরের নাম শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র রায়। নদীয়াধিপতি তিনি।
শেষ শব্দটা বোধহয় কানে যায়নি। বলেন, কোন গুরুকুলের?
—আজ্ঞে আমার পিতৃদেব নবদ্বীপাধিপতি, স্বয়ং রাজা শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র রায়!
—অ! বুঝেছি। তা কী চাও বাবা?
শিবচন্দ্র বুঝে নিয়েছেন, এঁকে নবদ্বীপ বা কৃষ্ণনগরে সমূলে উৎপাটন করে নিয়ে যাওয়া বোধহয় সম্ভবপর হবে না। সহজতর সমাধান, যদি পণ্ডিত স্বীকৃত হন, এই আরণ্যক পরিবেশেই একটা বৃহত্তর চতুষ্পাঠী নির্মাণে।যেমন বৃহৎ চতুষ্পাঠী আছে শঙ্কর তর্কবাগীশের। পাশাপাশি ছাত্রাবাস—প্রকাণ্ড চণ্ডীমণ্ডপ! আরণ্যক মহাবিদ্যালয়! বললেন, বাবামশাই আপনার কথা শুনেছেন। আপনি এই আরণ্যক পরিবেশেই সারস্বত-সাধনা করে যেতে চান। এ তো আনন্দের কথা। কিন্তু বহু শিষ্য আপনার চতুষ্পাঠীতে স্থান পেতে চায়। আমাকে তাই পাঠিয়েছেন আপনার অনুপপত্তি-বিদূরণ মানসে!
‘অর্থসাহায্য’ কথাটা স্থূল। শিবচন্দ্র তাই একটি গালভারি সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেছেন—’অনুপপত্তি’ অর্থাৎ অভাব, আর্থিক অনটন।
দুর্ভাগ্যবশত ঐ নঞতৎপুরুষ সমাসটির দ্বিতীয় একটি অর্থ আছে : অসংগতি, অমীমাংসা, প্রমাণাভাব।
সরল ব্রাহ্মণ ঐ দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করে বললেন, না বাবা! আমি চারিখণ্ড চিন্তামণি শাস্ত্রের উৎপত্তি করেছি: এখন তো কোন অনুপপত্তি দেখছি না!
নানানভাবে চেষ্টা করেও ঐ মহাপণ্ডিতের ‘নিরেট মাথায়’ সহজ কথাটা প্রবেশ করানো গেল না। পণ্ডিত বুঝতেই পারলেন না, রাজপুত্র রাজাদেশে এসেছেন তাঁকে অর্থসাহায্য করতে। নিরুপায় শিবচন্দ্র তারপরে প্রণাম করতে গেলেন সেই মহিলাটিকে! তিনি সহজেই বুঝলেন। প্রত্যুত্তরে বললেন, মহারাজকে বল, তাঁর ধারণাটি ভ্রান্ত। আমাদের সত্যই কোনও অভাব নাই। এখানে খুব ভাল ওল হয়। তাছাড়া ঐ যে তেতুঁল গাছটি দেখছ বাবা, ওর তেঁতুল পর্যাপ্ত হয়। উনি ওল-ভাত অথবা তিন্তিড়ী পত্রের ব্যঞ্জন দিয়ে পরমানন্দে অন্নগ্রহণ করেন। মহারাজ অহেতুক মনঃকষ্টে আছেন। এ তো শহর নয়, এখানে সত্যই কোনও অভাব নাই!
পুত্রের মুখে এই বার্তা শুনে সেটা অবিশ্বাস্য মনে হল রাজমহিষীর—স্বামীস্ত্রীর মধ্যে একটা পাগল হয়। এ যে জোড়া-পাগল! নিজের হিত বোঝে না?
অভিমানে লেগেছিল কৃষ্ণচন্দ্রেরও। পরাজয় স্বীকার করা তাঁর ধাতে নেই। উপযাচক হয়ে রাজপুত্রকে প্রেরণ করলেন, অথচ ব্রাহ্মণ তা প্রত্যাখান করল! কীসের এত দম্ভ তার?
রানীকে প্রশ্ন করেন, যাবে? দেখতে?
—ওমা! এ কী বলছেন? আমি কেমন করে যাব?
—কেন? পাকিতে।
—আমি গিয়ে কী দেখব সেই এঁদো জঙ্গলে?
—জোড়া-পাগল বাস্তবে হয় কি না।