১
সূর্য এখন কুম্ভরাশিতে।
রূপেন্দ্রনাথ সস্ত্রীক এসেছেন শহর বর্ধমানে। কুসুমমঞ্জরী এখনো নববধূই। মাত্ৰ দুইমাস পূর্বে বিবাহ হয়েছে তাদের। যে আমলের কথা, তখন ‘মধুচন্দ্রমা’ শব্দটা অভিধানে ছিল না। বাঙলা ভাষার অভিধান তখনো জন্মায়নি, সংস্কৃততেও শব্দটার ব্যবহার নাই। বিবাহের অব্যবহিত পরে এই সস্ত্রীক দেশভ্রমণের তিনটি হেতু। কোনটি মুখ্য তা নির্ণয় করা কঠিন। যেটি স্বীকার করে নেওয়া শোভন, সেটিকেই সর্বাগ্রে লিপিবদ্ধ করি :
যেভাবে দুর্গাচরণ একদিন বিবাহের ঠিক পূর্বে রূপেন্দ্রের কাছে নিয়ে এসেছিলেন নবদ্বীপ পরিদর্শনের প্রস্তাব, প্রায় অনুরূপ প্রস্তাব নিয়ে একদিন হাজির হলেন নন্দদুলাল চাটুজ্জে। তাঁর বড়কর্তা, অর্থাৎ নগেন্দ্রনাথ দত্ত-মশাই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, ভেষগাচার্য যেন একবার তাঁর ভদ্রাসনে পদধূলি দেন। বর্ধমানে।
নগেন্দ্রনাথ বর্ধমানের একজন অত্যন্ত ধনী গৃহস্থ। বর্ধমানভুক্তির প্রধান ইজারাদার। রাজ-সরকার কর্তৃক নিয়োজিত রাজস্ব আদায়ের দালাল। বিশাল এলাকায় তাঁর কর্মক্ষেত্র। নন্দ-খুড়ো তাঁর তরফে সোঞাই গ্রাম-সংলগ্ন পঞ্চগ্রামের উপ-ইজারাদার। নগেন্দ্রের বয়স অনুমান পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। সম্প্রতি তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রীর মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। শহর বর্ধমানের কবিরাজ এবং হাকিমের দল হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বলাবাহুল্য তার পূর্বে ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবচ, শান্তি-স্বস্ত্যয়নের যাবতীয় পর্যায় পাড়ি দেওয়া হয়েছে। তাঁর প্রথমা স্ত্রী স্বর্গলাভ করেছেন বছর-দুয়েক—তিন-চারটি সন্তান রেখে। ছোটটি নেহাৎ দুগ্ধপোষ্য না হলেও বালকমাত্র। তাই বাধ্য হয়ে দত্তমশাইকে এই দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করতে হয়েছে। কিন্তু কী দুর্দৈব, বৎসরখানেকের ভিতরেই নববধূর মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা গেল। দত্তজা নিতান্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত খরচ করতে পিছপাও নন। নন্দখুড়োর মুখে ভেষগাচার্যের অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনে, এই প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।
রূপেন্দ্রনাথ এককথাতেই সম্মত হয়ে গেলেন।
তাঁর ইচ্ছা ছিলই—বিবাহের পর একবার ত্রিবেণী যাবেন। গুরুদেবকে সস্ত্রীক প্রণাম করে আসবেন। তাছাড়া মঞ্জুকে নিয়ে নবদ্বীপ, শান্তিপুরে তীর্থ সেরে আসবেন। ভারতচন্দ্রের কাছে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আরও একটা হেতু ছিল। সেটি বেদনাবহ এবং কৌতুকের।
রূপেন্দ্রনাথের ভদ্রাসনে একটিই শয়নকক্ষ। যে কক্ষে পূর্বযুগে শয়ন করতেন ওঁর পিতৃদেব—সৌরীন্দ্রনাথ। ইদানীং সেটি ছিল জগুঠাকরুণ আর কাতুর যৌথ অধিকারে। রূপেন্দ্র রাত্রিবাস করতেন বার-বাড়িতে, যা সেকালে ছিল চতুষ্পাঠী, বর্তমানে গৌরবে ওঁর বৈঠকখানা এ-ছাড়া প্রাঙ্গণ অতিক্রম করে আরও দুটি ছোট ছোট একচালা আছে—ঠাকুরঘর এবং পাকশালা। রূপেন্দ্রের বিবাহের প্রায় সমসময়েই কাতুর জন্য একটি পৃথক কামরার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। জগুঠাকরুণের সঙ্গে রাত্রিবাস করা আর তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। সম্ভবপর হয়তো, বাঞ্ছনীয় না। গঙ্গাচরণ রুগী হিসাবেই এসে আশ্রয় নিয়েছিল বটে, কিন্তু এতদিনে তাকে চিনে ফেলেছে সবাই। জগুঠাকরুণ বাস্তুচ্যুত হয়েও উচ্ছ্বসিত! মেয়ে-জামাইকে এক সাথে পাবেন, এ আশা ছিল না তাঁর।
তা যেন হল, কিন্তু এই ‘ঠাঁই-নাই” ভদ্রাসনে দু-জোড়া নবদম্পতির রাত্রিযাপনের কী আয়োজন করা যায়? স্বীকার্য, কাত্যায়নীর বিবাহ হয়েছে পূর্বদশকে; কিন্তু নারীজন্ম যে তার সার্থক হয়েছে এই সপ্তাহেই। জগুপিসি একটা সহজ সমাধান দাখিল করতে গিয়ে ভাইপোর কাছে ধমক খেয়েছেন। আরোগ্য-নিকেতনের জনশূন্য কক্ষগুলির সঙ্গে এ সমস্যার সম্পর্ক নাকি বায়স ও পক্কশ্রীফলের।
বৈঠকখানা ঘরটি বার-মহলে, বে-আব্রু, ফলে সমস্যাটার সমাধান হয়নি
তোমরা যদি বল,’বাপু হে লেখক! তোমার ঐ নলচের আড়াল দেওয়ায় কিছুই ঢাকা পড়ছে না। যা বোঝার তা আমরা ঠিকই বুঝতে পেরেছি! ‘মধুচন্দ্রমা’ শব্দটা অভিধানে থাক না থাক, যুগলে গুরুপ্রণাম করার অছিলাটা যতই তীব্র হোক, আমরা বুঝে নিয়েছি, কোনটা মুখ্য হেতু—তাহলে আমি প্রতিবাদ করব। আমার বিরুদ্ধ-যুক্তিটাও শোন, তারপর রায় দিও। তাই যদি হবে, তবে রূপেন্দ্র কেন জগু-পিসিমাকে বলবেন, আপনিও চলুন না পিসিমা, তীর্থ-দর্শন করে আসবেন?
পিসিমাই রাজি হননি। বোধকরি তাঁর আশঙ্কা ছিল, গঙ্গাচরণ দুনিয়ার মায়া কাটিয়েছে। সে আর কোনদিন ফিরে আসবে না। কাতু মুখপুড়ির হাতে ঐ যে শাখা-খাড় বজায় আছে তার হেতু—নিদারুণ দুঃসংবাদটা এ গাঁয়ে এখনো এসে পৌঁছায়নি। মেয়ে-জামাই পেয়ে তাঁর তীর্থদর্শনের বাসনাটা উপে গেছে।
এবার তোমরাই বল : মধুচন্দ্রমায় কেউ বুড়ি পিসিকে সঙ্গী হতে ডাকে?
জীবন ওঁর রুগীদের দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়েছে।
রূপেন্দ্রর বিবাহও এক এলাহী কাণ্ড!
ভেষগাচার্য বৈদ্যবিদায় গ্রহণ করেননি। ব্রজেন্দ্রনারায়ণ আরোগ্যনিকেতন বানিয়ে দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর মন ভরেনি। এবার তাঁর পালিতা কন্যার বিবাহে তিনি যদি এলাহী কাণ্ড করেন, তাহলে রূপেন্দ্রর কী বলার থাকতে পারে?
ফুলশয্যার রাত্রে ঘটল একটি কৌতুকের ঘটনা। এটাও বেদনাবহ!
রূপেন্দ্রর ভদ্রাসনে সেই একমাত্র শয়নকক্ষেই জোড়াপালঙ্কে ফুলশয্যার আয়োজন কাত্যায়নী, মৃন্ময়ী আরও পাড়ার পাঁচ এয়ো এসে ফুলে-ফুলে সাজিয়েছে ঘরখানা। কনেকে সাজিয়েছে কাতু, বরকে মীনু। নির্দ্বিধায়। গালে-কপালে চন্দন-ফোঁটা নেব না বললে শুনছে কে? পাকস্পর্শ আর ফুলশয্যা একই দিনে। নিমন্ত্রিতদের বিদায় করতে করতে রাত প্রায় তৃতীয় যামের দিকে ঢলে পড়তে চলেছে।
সব মিটিয়ে রূপেন্দ্র যখন শয়ন করতে এলেন তখন বাঁড়ুজ্জেবাড়ি নিস্তব্ধ। নিমন্ত্রিতরা ফিরে গেছে যে-যার বাড়ি। জগু-পিসি শুয়ে পড়েছেন। গঙ্গাচরণও। কাতুকে কোথাও দেখতে পেলেন না। একাই প্রবেশ করলেন শয়নকক্ষে। পাঁলঙ্কের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন।
বালার্ক-রক্তিম বিক্রমপুরী খাসা-মসলিন, ঊর্ধ্বাঙ্গের উচ্ছ্বাস দৃঢ়নিবদ্ধ কঞ্চলিকায় সংহত, স্তবকিত জলদ-সম্ভারের মতো কবরীগুচ্ছে পুষ্পস্তবক অনুবিদ্ধ। সীমন্তের মধ্যভাগে সৌভাগ্যস্মারক রক্তিমাভা। অলক্তকরাগরঞ্জিত রাতুল চরণে কলহংসকণ্ঠনিঃস্বনমধুর নূপুর
রূপেন্দ্র সেদিকে এক পদ অগ্রসর হতেই মেয়েটি মুখ তুলে তাকায়। চম্পকাঙ্গুলি স্পর্শ করায় ওষ্ঠাধরে। রূপেন্দ্র বিস্মিত। ‘তখনই নজর হল, নববধূ তর্জনীসঙ্কেতে কী যেন দেখাচ্ছে। পরমুহূর্তেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কক্ষের অপরপ্রান্তে স্তূপাকার করা কিছু শয্যাদ্রব্য—লেপ-তোষক-কম্বল-বালিশ। তার একটি পুঁটুলি সন্দেহজনক। বোঝা গেল, কেন এতক্ষণ কাতুকে খুঁজে পাননি।
ধরা পড়ে বেচারি নিতান্ত অপ্রস্তুত। রূপেন্দ্র বলেন, তুই এখানে! ওদিকে গঙ্গা তোকে সারা বাড়ি গোরু-খোজা খুঁজছে।
কাতু বলে, বৌরানী ধরিয়ে না দিলে দেখতাম-
কী দেখত, তা আর বলে না।
রূপেন্দ্র ওকে বিতাড়িত করে ফিরে এলেন। কক্ষদ্বার অর্গলবদ্ধ করতে ভোলেননি।
এবার পালঙ্ক থেকে অবতরণ করল নববধূ। গলায় আঁচল দিয়ে নামিয়ে রাখে একটি সলজ্জ প্রণাম। রূপেন্দ্র ওকে বাহুমূল ধরে তুলে ধরেন। বলেন, সারাদিন খুব ধকল গেছে, নয়? খুব ঘুম পেয়েছে তো?
নববধূ শিরশ্চালনে নেতিবাচক গ্রীবাভঙ্গি করে। আর তাতেই, কী জানি কেন, লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়।
রূপেন্দ্র ওকে পালঙ্কে বসিয়ে দেন। বলেন, সেই জিনিসটা কোথায়? সেই সেদিন যেটা তোমাকে দিয়েছিলাম?
মঞ্জুরী নতমস্তকে বললে, সে কথা আজ নয়।
বটেই তো! আজ সব মধুময়। ‘বিষ’-এর প্রসঙ্গ আজ নয়। এই ‘মধুনক্তম্’-এ ও-কথা তোলাই উচিত হয়নি তাঁর। তবে নাকি পেশায় কবিরাজ, নিরাপত্তার কথাটা তুচ্ছ করতে পারেন না। এবার প্রসঙ্গান্তরে আসেন, এই একপক্ষকালে কী বিচিত্রভাবে বদলে গেল তোমার জীবনটা!
নববধূ নতনেত্রে বললে, সে তো আপনারও!
তা বটে! সংসারে জড়িয়ে পড়লেন। বলেন, সম্প্রতি নদীয়া গিয়েছিলাম। শুনেছ?
—শুনেছি! সোনার গৌরাঙ্গ দেখে এসেছেন?
রূপেন্দ্র তখনই জানালেন না যে, তা তিনি দেখেননি। যুগলে দেখবেন বলে। বরং বলেন, তুমি আমাকে ‘আপনি’ বলছ কেন? এতদিন যা বলেছ, বলেছ; কিন্তু অগ্নিসাক্ষী করে যখন তোমাকে সহধর্মিণী করেছি …..
—আপনি কতবড় পণ্ডিত!
—তোমার কাছে কি সেটাই আমার পরিচয়?
মুখটা লাল হয়ে ওঠে। মাথা নেড়ে নেতিবাচক ভঙ্গি করে।
—তাহলে? আমাকে ‘তুমি’ই বলবে। অন্তত নির্জনে। বড়-মা যেমন বলেন।
হয়তো এটা ওর অজ্ঞাত তথ্য। রূপেন্দ্র সেটা কীভাবে জেনেছেন তাও জানতে চাইল না। দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বলে, সে আমি পারব না। কিছুতেই না! আপনি কত বড়!
—ও! কিছুতেই পারবেন না! তাহলে আর কী উপায়? আমি বিশ্বাস করি, সব বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর সমান অধিকার। ঠিক আছে, জোর-জবরদস্তি করা আমার স্বভাব নয়। আপনি আমাকে তাহলে ‘আপনি’ বলেই কথা বলবেন।
কুসুমুঞ্জরী অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, আপনি অমন করছেন কেন? আমার কী দোষ হল?
—কেমন করছি? আপনার দোষ হয়েছে, তা তো বলিনি।
—না, মানে আপনি আমাকে ‘আপনি’ বলে কথা বলছেন কেন?
–সে কথাই তো বলছি এতক্ষণ। দাম্পত্যজীবনে স্বামী-স্ত্রীকে থাকতে হবে একই সমতলে। আপনি যখন আমার সমতলে নামতে পারছেন না, তখন আমিই আপনার সমতলে উঠে আসি।
এবার দৃঢ়ভাবে মেয়েটি বলল, ছি ছি! তা কিছুতেই হবে না! আপনি আমাকে ‘আপনি’ বললে – …. না, না, সে কিছুতেই হবে না।
রূপেন্দ্র ছদ্ম গাম্ভীর্যে বলেন, তাহলে তো একটিই বিকল্প—বাক্যালাপ বন্ধ করা। আজকের এই শুভরাত্রে সেটাই কি আপনার প্রস্তাব?
কুসুমমঞ্জরীর প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম। মাথা নিচু করে বলে, বেশ, আপনি যেভাবে বলতে বলছেন সেভাবেই বলব ….
—’আপনি যেভাবে বলতে বলছেন!’ —আপনার পূজ্যপাদ পরমপতি কীভাবে বলতে আদেশ দিয়েছেন?
দুহাতে মুখ ঢেকে কুসুমমঞ্জরী বললে, তুমি ভারী ‘ই—য়ে’!
—‘কিয়ে’?—রূপেন্দ্র এবার ওকে দুই বাহুমূল ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করলেন। এটা বোধকরি প্রত্যাশিত। নববধূর দেহ কেমন যেন শিথিল হয়ে যায়, চোখ দুটি আবেশে মুদে আসে। রূপেন্দ্র ঐ চুম্বনভূষিতার দিকে মুখটা নামিয়ে আনার মুহূর্তেই বাধা!
পালঙ্কের নিচে থেকে ভেসে এল এক অস্ফুট আর্তনাদ!
চমকিত রূপেন্দ্র এক লাফে নেমে পড়েন পালঙ্ক থেকে। ঘৃত-প্রদীপটা জ্বলছিল পিলসুজের উপর। সেটি হাতে তুলে নিয়ে পালঙ্কের নিচে দৃষ্টিপাত করলেন।
অপ্রত্যাশিত দৃশ্য। বাক্স-পেটরার অন্তরালে মৃন্ময়ী বসে ছিল ঘাড় গুঁজে, এতক্ষণে প্ৰায় শুয়েই পড়েছে।
দুজনে কোনক্রমে বার করে আনলেন উৎসবসজ্জিতা সীমন্তিনীকে। যন্ত্রণায় যেন বিকৃত হয়ে গেছে মীনু। রূপেন্দ্র ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করেন, কী হয়েছে মীনু? যন্ত্রণা হচ্ছে?
—হুঁ!
কোথায়? পেটে?
গ্রীবাভঙ্গিতে স্বীকার করে।
কী অন্যায়! কী অপরিসীম অন্যায়! কৌতুকের একটা সীমা থাকবে তো? পূর্ণগর্ভা একটি রমণী—প্রথম সন্তানবতী হতে চলেছে—ঐ সঙ্কীর্ণ স্থানে …
রূপেন্দ্র মুহূর্তে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। তিলমাত্র ইতস্তত করলেন না। এ মূহূর্তে তিনি বর নন, পুরুষ নন, ভেষগাচার্য! নির্দ্বিধায় একটি হাত রাখলেন ওর যূথিপুষ্পঅনুবিদ্ধ কবরীগুচ্ছে, অপর হাত জানুদ্বয়ের নিচে। অবলীলাক্রমে ভূশয্যা থেকে উঠিয়ে তাকে শুইয়ে দিলেন পালঙ্কে!
ছি, ছি, ছি! কেন মৃত্যু হল না সেই মুহূর্তে? যে ফুলশ্যে সে সারাটা দিন ধরে সাজিয়েছে তার উপরেই তাকে কোলপাঁজা করে শুইয়ে দিলেন সোনাদা। আর তাঁর মঞ্জু পালঙ্ক থেকে নেমে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যেন বিতারিতা দুয়োরানী! মৃত্যু না হক, জ্ঞান হারালো না কেন? কিন্তু জ্ঞান হারালে কি প্রতিবর্তী প্রেরণায় সেও আলিঙ্গনাবদ্ধ করে ধরত ঐ সোনার গৌরাঙ্গকে!
কোনক্রমে বললে, না-না-না! আমাকে নামিয়ে দিন! এ বিছানায় আমার শুতে নেই!—চুপ কর তুমি! কথা বল না।
কুসুম অস্ফুটে বলে, দোর খুলে দেখব? ঠাকুরঝিকে ডেকে আনব?
—না! আগে আমাকে বুঝে নিতে দাও!
এ কী! এ কী! এ কী করছে সোনাদা? ওর কি মায়া, মমতা, হায়া কায়া কিচ্ছু নেই? রূপেন্দ্র তিলমাত্র ইতস্তত করলেন না। রোগিণীকে শুইয়ে দিয়েছেন। সবার আগে জানতে হবে গর্ভস্থ ভ্রূণের হৃদ্স্পন্দন শোনা যাচ্ছে কি না—তার কিছু ক্ষতি হয়েছে কি না। তাঁর সেই আজব যন্ত্রটা এই মুহূর্তে কোথায় আছে জানেন না। উৎসবগৃহে সবকিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে।
দু-হাতের দশটি আঙুলে—যেন এ-কাজে কতই অভ্যস্ত—উন্মোচন করে দিলেন ঐ পরস্ত্রীর নীবিবন্ধের গ্রন্থী। অনায়াসে অনাবৃত করে দিলেন শায়িতা মেয়েটির উদরদেশ। শাড়িটা নামিয়ে দিলেন অনেকটা—কুসুমমঞ্জরীর দৃষ্টির সম্মুখে—প্রায় সেই সঙ্গোপন উপত্যকায়, যাকে কালিদাস বলেছেন, “নতনাভিরন্ধ্রং ররাজ তন্বী নবরোম রাজি। নীবীমতিক্রম্য সিতেতরস্য…”
মৃন্ময়ী বাধা দিতে পারল না। সে যেন পাথরপ্রতিমা! কণ্ঠে তার স্বর ফুটল না। রূপেন্দ্র সেই অনাবৃত নিম্ন-উদরে চেপে ধরলেন তাঁর কান। গাভীর গলকম্বলে হস্তস্পর্শ করলে তার দেহ যেভাবে থরথর করে কেঁপে ওঠে সেভাবেই কাঁপতে থাকে মৃন্ময়ীর রোমাঞ্চিত বিবশ তনুদেহ।
অনেক-অনেকক্ষণ পরে রূপেন্দ্র মাথাটা তুললেন। শাড়িটা টেনে দিলেন স্বস্থানে। বললেন, একদম নড়াচড়া করবে না। বাচ্চাটা ঠিক আছে।
হাসবে না কাঁদবে মৃন্ময়ী ভেবে পেল না। লজ্জা, বেদনা, আনন্দ কোন অনুভূতি কাকে ছাপিয়ে উঠেছে তা যেন ওর বোধসীমার বাহিরে! রূপেন্দ্র নববধূকে বললেন, ঐ কলসীতে জল আছে। ওর মুখে-চোখে ছিটিয়ে দাও। আমি দেখছি, কাতুকে ডেকে আনতে হবে।
রুদ্ধদ্বার খুলে দিয়েই দেখেন, সেখানে কাতু আর শোভারানী। ঘরের ভিতর তাকিয়ে দেখে কাত্যায়নী সশঙ্ক কণ্ঠে বলে, কী হয়েছে দাদা?
তোরা খুব অন্যায় করেছিস! ওকে কি এখন ঐ ভাবে পালঙ্কের তলায় ঢুকিয়ে দিতে হয়? ভাগ্যক্রমে হয়নি কিছু, কিন্তু হতে পারত।
—মীনু কি …. ওকে কি …..
—না! ওকে ঠাঁইনাড়া করা চলবে না। যেমন আছে তেমনই থাক। মীনু আর মঞ্জু পালঙ্কে শোবে। আমার জন্য একটা মাদুর নিয়ে আয়।
কাতু মাথা ঝাঁকিয়ে দৃঢ়স্বরে বলে, তা হয় না! কিছুতেই না! মা টের পেলে …
রূপেন্দ্রনাথ চাপা গর্জন করে ওঠেন, ধেড়ে বয়সে মার খাবি? যা বলছি কর। ওকে ঠাঁইনাড়া করা চলবেনা তিন-চার ঘণ্টা।
তারপর শোভারানীর দিকে ফিরে প্রশ্ন করেন, বাড়িতে কী বলে এসেছ? কতরাত্রে ফিরবে? পাকি আছে?
—না! বাবা-মশাই জানেন, আমরা কাল সকালে ফিরে যাব। তখনই পাল্কি আসবে।
—ঠিক আছে। শোন! তুইও শোন্ কাতু আজ রাত্রে এ ঘটনার কথা যেন কাকপক্ষীতে টের না পায়। আমরা তিনজনেই থাকব এ ঘরে। আমাকে একটা মাদুর এনে দে শুধু।
শোভা জানতে চায়, ছোট-মার কিছু হয়নি তো? ওঁর পেটের ….
—না। হতে পারত, হয়নি। হতে পারে, এখনো নড়াচড়া করলে-
মৃন্ময়ী দুটি হাত জোড় করে বললে, রুপোদা, আপনার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে ছেড়ে দিন … এ আমি পারব না, কিছুতেই পারব না!
রূপেন্দ্রকে প্রত্যুত্তর করতে হল না। তাঁর পাশ থেকে শোভারানীই তাঁর হয়ে জবাব দিল। সে জবাব ক্ষুরধার—কেটে কেটে বসে : পারবেন, ছোট-মা! এমন নরম ফুলশেযে একটা রাত কাটাতে পারবেন না? পারবেন। আর মাদুরেরই বা কী দরকার? এড়োএড়ি করে শুলে সোনাদা দুজনকে দুপাশে নিয়েই পালঙ্কে শুতে পারবেন।
সহজ-সরল সমাধান! অশোভন বা অশালীন কোন বক্রোক্তি নেই!
কিন্তু মৃন্ময়ী যেন একেবারে সাদা হয়ে গেল। বিকৃত হয়ে গেল মুখটা। দাঁত দিয়ে নিচেকার ঠোঁটটা এত জোরে কামড়ে ধরেছে যে, রক্ত ফুটে ওঠার উপক্রম।
রূপেন্দ্র বলেন, কী হল? আবার যন্ত্রণা শুরু হল? পেটে?
কী জবাব দেবে হতভাগী? উদরদেশে নয়, অপরিসীম যন্ত্রণাটা যে ওর বুকে। শোভারানী জেনে-বুঝে দু-পায়ে মাড়িয়ে দিয়ে গেল ওর হৃৎপিণ্ডটা। সরল সমাধানের অছিলায় গরল উদগীরণ!
তা বটে! ভুলটা রূপেন্দ্রনাথের। ভুলের মাশুল দিতে হবে বৈকি! ফুলশেযের রাতে সবার আগে যে নববধূর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন একটি নিষিদ্ধ বস্তু! সেটাই এতক্ষণে ফেরত দিল : শোভারানী।
কিন্তু কার বিরুদ্ধে এই বিষোদ্গার? কুলীনঘরের ঐ অরক্ষণীয়া কাকে দংশন করতে চায়? নববধূ না ছোট-মা? অথবা কে জানে, হয়তো তার মূল লক্ষ্য ছোট-মার ঐ আদরের ‘সোনাদা’–সেই আগুনবরণ ছেলেটা যে, চোখে না দেখেই নাকচ করেছিল এক অরক্ষণীয়াকে, চিরকুমার থাকার অছিলায়!