কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

সোঞাই – ১২

১২

দিনকতক পরের কথা। সূর্য এখন তুলারাশিতে। পিতৃপক্ষ চলছে। দামোদর এখন কানায়- কানায় ভরা। তার ভরাভাদ্রের জলস্ফীতি অবদমিত। মাঠে-ঘাটে থকথকে কাদা এখনো শুকিয়ে ওঠেনি, তবে প্রখর মেঘভাঙা রৌদ্রে তা ক্রমে ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে পলিমাটির আস্তরণে। দামোদরের বার্ষিক দান। আকাশে মানসযাত্রী হংস বলাকার মতো সাদা মেঘের সম্ভার; তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দামোদরের পাড় ঘেঁষে কাশফুলের দিগন্ত ছোঁয়ার আকুলতা। সকালবেলায় শিউলীতলায় শিশিরবিন্দুর উপর হলুদ-সাদার নক্‌শা।

আজকাল আরও প্রত্যুষে নিদ্রাভঙ্গ হয় ওঁর। স্নানান্তে তর্পণে কিছুটা সময় যায়। পিতৃপুরুষকে জল দিয়ে রোগী দেখতে বের হন। সেদিনও গ্রামান্তরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। সূর্যোদয় মুহূর্ত। হঠাৎ কাত্যায়নী এঘরে এসে বললে, একবার বাইরে এস দাদা। ভিন্‌গা থেকে একটা গো-গাড়িতে করে কারা যেন এসেছেন। মনে হয়, ঘরানা-ঘরের রোগী। মহিলাই হবেন। ঘেরাটোপ পর্দা। সঙ্গে পাইক-বরকন্দাজ।

রূপেন্দ্র বাইরে এসে দেখেন, অদূরে একটি গো-শকট অপেক্ষা করছে। টাপর তোলা, পর্দা ঘেরা। বোধ করি পর্দানসীন কোন মহিলা। মুসলমান হওয়াই সম্ভব—পর্দার নিশ্ছিদ্রতা সে রকমই ইঙ্গিত করছে। তবে সৌখিন লোকের গো-যান। বলদের শিং রঙ করা, গলায় কড়ির মালা, ঝকঝকে পিতলের ঘণ্টা। একজন অশ্বারোহীও রয়েছে তার কাছাকাছি। আরও দুজন বরকন্দাজ। ওঁকে বার হয়ে আসতে দেখে অশ্বারোহী অবতরণ করল। বলিষ্ঠগঠন সৈনিকশ্রেণীর লোক। তার সাজ-পোশাক হিন্দুর। খাটো কুর্তা, কোমরবন্ধে তরবারি, কিন্তু কপালে চন্দন-তিলক। লোকটা ওঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে নিবেদন করে, প্রাতঃপ্রণাম কবিরাজ মশাই। আমরা আসছি রূপনগর থেকে—মোহান্ত মহারাজের গড় থেকে।

—কোন, মোহান্ত মহারাজ?

—রূপনগরে তো একজনই মোহন্ত মহারাজ আছেন, প্রভু—প্রভুপাদ শ্রীমন্ মহারাজ প্রেমদাস গোঁসাইজীর পাট থেকে।

নামটা সুপরিচিত। প্রেমদাস গোস্বামী গোটা রাঢ়খণ্ডে সুপরিচিত। রূপনগরের স্বনামধন্য সিদ্ধপুরুষ। অসীম তাঁর ক্ষমতা—ইহলোক পরলোকে। বাসিদ্ধ বৈষ্ণব সাধক। তাঁর পাট দামোদরের উত্তরে, বস্তুত অজয়ের তীরে। কেন্দুবিশ্বের কাছাকাছি। রূপনগর বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের। আউল, বাউল, নেড়ানেড়ি প্রভৃতি। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও আছে, তবে মুসলমান নেই। গ্রামটি বর্ধমান রাজসরকারের এক্তিয়ারভুক্ত ভূখণ্ডে নয়। সুবাদার হাতেম আলির রাজ্যে। প্রেমদাস গোঁসাই ও অঞ্চলের শুধু ধর্মীয় নেতা নন, রাজনৈতিক ক্ষমতাও তাঁর যথেষ্ট। তার আখড়াটি বাস্তবে পরিখাবেষ্টিত একটি গড়। সচরাচর কোন ধর্মীয় নেতাকে এ জাতীয় গড় নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয় না—বিশেষ, হিন্দু ধর্মের কোন নেতাকে। হাতেম আলিও দিতেন না—দিতে বাধ্য হয়েছেন! সেদিক থেকে প্রেমদাস বাবাজী একটি ব্যতিক্রম। শুধু বেতনভুক লাঠিয়াল নয়, তাঁর বন্দুকধারী অশ্বারোহী সৈন্যও আছে।

রূপেন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন, গাড়িতে কে আছেন?

সৈনিকটি তার আঙরাখা থেকে একটি পত্র বাহির করে স্পর্শ বাঁচিয়ে সেটি নামিয়ে রাখে ব্রাহ্মণের পদপ্রান্তে।

পত্রলেখক স্বয়ং প্রেমদাস গোস্বামী।

বৈষ্ণবজনোচিত বিনয় প্রকাশ করে তিনি সোঞাই গ্রামনিবাসী মহামহিমার্ণব শ্রীল শ্রীযুক্ত রূপেন্দ্রনাথ ধন্বন্তরি মহাশয় বরাবর এই আর্জিটি পেশ করেছেন। দেবনাগরী হরফে, ব্রজভাষায় : “রাধাগোবিন্দজী আপনার অশেষ মঙ্গল বিধান করুন। পরে জানাই, এক অনাথাকে _আপনার পদপ্রান্তে প্রেরণ করিলাম। এস্থলে নানাবিধ পূজা অৰ্চনা যাগযজ্ঞাদি করিয়াও হতভাগিনীকে নিরাময় করা যায় নাই। অথচ ঐ হতভাগিনী ভাগ্যবতীই আগামী রাসপূর্ণিমায় রাইরানী হইবার জন্য দৈবনির্বাচিতা। তাহার মুহুর্মুহু মূৰ্চ্ছা হইতেছে। হেতু নির্ধারণ করা যায় নাই। সময় নিতান্তই অল্প। এই সিদ্ধপীঠের আবহমানকালের প্রথায় যাহাতে ব্যত্যয় না হয় তাই আপনার শরণাপন্ন হইতেছি। পত্রবাহকের মাধ্যমে অবিলম্বে আমাকে জ্ঞাত করাইবেন এস্থলে বিকল্প ব্যবস্থার কোনও প্রয়োজন আছে কিনা।

বিনয়াবনম্র গোবিন্দচরণাশ্রিত ইতি প্রেমদাস গোঁসাই।”

পত্রটি বার দুই পাঠ করেও তার মর্মোদ্ধার করতে পারলেন না। ‘রাইরানী’ কাকে বলে, ওঁদের আবহমানকালের প্রথাটিই বা কী, জানা নেই। বিকল্প ব্যবস্থা বলতে কী ইঙ্গিত করা হয়েছে? সম্ভবত সৈনিকটি সে কথা জানে। কিন্তু তাকে সেসব প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয় না। মূল তথ্যটা অনুধাবন করতে অসুবিধা হল না। গোযানে একটি নারী আছে, সে অসুস্থা। সর্বাগ্রে তাঁকে দেখা দরকার।

তিনি ঘেরাটোপ গো-শকটের নিকটে অগ্রসর হয়ে এলেন। পর্দার বাহিরে দণ্ডায়মান হয়ে বললেন, আমি চিকিৎসক। ভিতরে কে আছেন?

পর্দা সরিয়ে একটি প্রৌঢ়া নেমে এলেন। গৌরবর্ণ, নাকে রসকলি। ব্রাহ্মণকে প্রণাম করে বললেন, আপনিই ধন্নন্তরিবাবা?

—আমার নাম রূপেন্দ্রনাথ দেবশর্মা। আমি পেশায় চিকিৎসক। রোগিণীকে দেখতে চাই।

—দেখুন বাবা, আসুন।

প্রৌঢ়া আচ্ছাদনের এক প্রান্ত তুলে ধরলেন।

ভিতরে একটি শয্যা পাতা। একটি তরুণী শায়িতা। তার চোখ দুটি নিমীলিত। হয় নিদ্রাগতা অথবা জ্ঞানহীনা। রূপেন্দ্রনাথ একটি ধাক্কা খেলেন মনে মনে। রোপপাণ্ডুর মুখ, ঘনকৃষ্ণ কেশপাশ ঈষৎ পিঙ্গল—বোধকরি দীর্ঘদিন রুক্ষ্ম থাকায়। রক্তশূন্য। তবু অপরূপ সুন্দরী সে। শায়িতা দুর্গাপ্রতিমা! ওর ভ্রমধ্যে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখতে থাকেন। চন্দ্রগ্রহণের পূর্বে যেমন একটি ধূসর ছায়াপাতের আসন্নতায় পূর্ণচন্দ্রের দীপ্তি ম্লান হয়ে যায়, এখানেও যেন তেমনি এক মৃত্যুশীতল সম্ভাবনা। অচৈতন্যার শীর্ণ দক্ষিণহস্তটি তুলে নিলেন। নিমীলত নেত্রে দীর্ঘ সময় তার নাড়ির গতি পরীক্ষা করলেন। জ্বরতাপে দেহ যেন পুড়ে যাচ্ছে। নাড়ির গতি অতি ক্ষীণ। মৃত্যু তিলতিল করে এগিয়ে আসতে চাইছে, সপ্তদশীর জীবনীশক্তি তাকে বাধা দিচ্ছে। কে হারে, কে জেতে!

অচৈতন্যার মণিবন্ধ ত্যাগ করে সেটি দেহের পাশে নামিয়ে রাখার পরে সৈনিকটি প্রশ্ন করল, কোন্ গৃহে ওকে স্থান দেওয়া হবে কবিরাজ মশাই? আপনি অনুমতি দিলে আমি পাঁজাকোলা করে শুইয়ে দিতে পারি।

রূপেন্দ্র বললেন, না। ওর সে সহ্যক্ষমতা বর্তমানে নাই। কোনক্রমেই ওকে এখন স্থানান্তরিতা করা যাবে না। তোমরা এক কাজ কর। বলদজোড়া খুলে দাও। ধীরে ধীরে গো-শকটটিকে ঐ তেতুঁলবটের ছায়ায় নিয়ে যাও। দুদিকে ঠেকো দিয়ে ওর শয্যাটি ভূমির সমান্তরালে রাখার ব্যবস্থা কর। এভাবেই ওকে সমস্ত দিন রাখতে হবে। দেখ, যেন রৌদ্রতাপ, ওর গায়ে না লাগে।

প্রৌঢ়া আকুলভাবে প্রশ্ন করেন, বাঁচবে তো বাবা?

সে কথার জবাব না দিয়ে রূপেন্দ্রনাথ প্রতিপ্রশ্ন করেন, মেয়েটি আপনার কে হয়?

—আমাকে তুমিই বলবেন, বাবা। ওর সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক কিছু নেই। আমি মোহন্ত-মহারাজের সেবাদাসী ছিলাম।

—ছিলেন? এখন নন?

প্রৌঢ়া কী জানি কেন লজ্জা পেলেন। বলেন, তাঁর ‘দাসী’ তো বটেই, আর দাসীর ধম্মোই হচ্ছে ‘সেবা’ করা। কিন্তু ও বাঁচবে তো?

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, আমি চিকিৎসক, দৈবজ্ঞ নই, মা। আমাদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস রাখতে হয়—রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে। ঔষধ পাঠিয়ে দিচ্ছি। তরল পানীয়। প্রতি আধঘন্টা পর পর পাঁচ ফোঁটা করে ওর মুখে দেবেন।

—‘আধঘণ্টা’ কাকে বলে বাবা?

—ধরুন একদণ্ড কাল। আপনাকে একটি বালুকা ঘড়িও পাঠিয়ে দিচ্ছি। কীভাবে ‘দণ্ডকাল’ বিচার করতে হবে, তা আমার ভগিনী আপনাকে শিখিয়ে দেবে। সেও আপনাকে সাহায্য করবে।

গো-শকটটিকে বৃক্ষের ছায়ায় নিয়ে যাওয়া হল। কাত্যায়নী এল প্রৌঢ়া পরিচারিকাটিকে সাহায্য করতে। সিক্ত বস্ত্রখণ্ড রোগিণীর ললাটে বারে বারে দেওয়া হচ্ছিল—জ্বরতাপ খুব বেশি থাকায়। জ্ঞান ফিরে এলে রোগিণী মধুমিশ্রিত দুগ্ধ পান করতে পারে—আর কিছু নয়। প্রৌঢ়ার মধ্যাহ্ন আহারের আয়োজন হল ব্রাহ্মণবাড়িতে। রূপেন্দ্রনাথ সেই বরকন্দাজটিকে প্রশ্ন করলেন, তোমরা কজন এখন কী করবে? এখানে মধ্যাহ্ন আহার সেরে রূপনগরে ফিরে যাবে?

লোকটা বললে, আপনি তো এখনো পত্রের উত্তর আমাকে দেননি, কবিরাজমশাই?

—দেখতেই তো পাচ্ছ রোগিণীর অবস্থা। ওর জ্ঞান হোক। তারপর পত্র লেখার প্রশ্ন

উঠবে।

—তাহলে, এই সোঞাই গাঁয়েই আমাদের আপাতত থেকে যেতে হবে। যতদিন না ওর ভালোমন্দ কিছু হয়। তবে আপনার চিন্তার কিছু নাই। মোহন্ত মহারাজ আপনাদের জমিদার- মশাইকেও একটি পত্র দিয়েছেন। আশা করি তাঁর অতিথিশালায় আমাদের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

—রূপেন্দ্রনাথ স্পষ্টবক্তা। বললেন, ‘মন্দ’ অবশ্য যে কোন মুহূর্তেই হতে পারে; কিন্তু ‘ভালো’ হতে ওর পক্ষকাল সময় লাগবেই।

—তাহলে পক্ষকালই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

—তোমাদের ইচ্ছা।

যাবতীয় ব্যবস্থা করে তিনি রুগী দেখতে বার হয়ে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *