কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

সোঞাই – ৩

পশ্চিমাকাশের দিকে একবার দৃপাত করে মৌলবী-সাহেব বললেন, শাম-ওয়ক্ত হয়ে গেল : নাকি?

—না। সূর্য মেঘে ঢাকা পড়েছে। সূর্যাস্তের এখনও বাকি আছে। আপনার নামাজের সময় হয়নি।

—তা হোক। আজ এই পর্যন্তই থাক। আপনার গৃহে একজন মেহমান আসছেন, মনে হচ্ছে।

পুঁথিপত্র বেঁধে নিতে থাকেন মৌলভী-সাব

কথা হচ্ছিল `রূপেন্দ্রনাথের দাওয়ায়। প্রত্যেক দিন অপরাহ্নে মৌলবীসাহেব আসেন ওঁকে আরবী-ফার্সী শেখাতে। রূপেন্দ্ৰনাথ বর্ধমানের একজন প্রতিষ্ঠাবান মুসলমান

ভেষগাচার্যের কাছে হাকিমী-বিদ্যা শিখতে ইচ্ছুক। তার পূর্বে ঐ দুটি ভাষা গ্রামে বসেই আয়ত্ত করতে চান। পীরপুরের মৌলভীসা’ব এ দায়িত্বটা গ্রহণ করেছেন। প্রত্যহ পড়ন্ত-বেলায় তিনি আসেন—জুম্মাবার বাদে—সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে ওঁদের ভাষাশিক্ষার আসর। তার পর জগুঠাকরুণ কিছু ফলমূল—বাতাসা নিয়ে আসেন, একগলা ঘোমটা টেনে। মৌলভীসাব পদ্মদীঘিতে অজু সেরে নামাজ পড়েন, তারপর ঐ দেবতার প্রসাদটুকু মুখে ফেলে বিদায় নেন। দামোদর পার হয়ে পীরপুরের দিকে।

মেহমানের উল্লেখে রূপেন্দ্রনাথ মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, ঠিকই। নন্দদুলাল চাটুজ্জে। বিচিত্র পোশাক তাঁর। পরিধানে যদিচ ধুতি, কাছা-কোঁচা দেওয়া, তবু তার উপর ঘাগরা জাতীয় একটি অতি সূক্ষ্ম আবরণ, মধ্যদেশে রজ্জুবদ্ধ। ঊর্ধ্বাঙ্গে পুরোহাতা বেনিয়ান। কণ্ঠে একটি মুক্তার মালা। মাথায় শামলা, যদিচ পশ্চাদ্দেশে শামলার বাইরে বার হয়ে আছে দীর্ঘ শিখার প্রান্তদেশ। তার শেষপ্রান্তে একটি অপরাজিতা অনুবিদ্ধ। তাঁর পিছন পিছন তালপাতার ছাতা ধরে আসছিল দোবেজি—ওঁর দেহরক্ষী-তথা-খিদমদ্‌গার। রোদ নেই এই সন্ধ্যাকাশে, বৃষ্টিও নেই। তবু আনুষ্ঠানিকভাবে ছত্রধারী অনুগমন করছে।

রূপেন্দ্রনাথ মাদুর ছেড়ে উঠে দাড়ান। মৌলবীসাবও দ্রুতহস্তে মাদুরটা গুটিয়ে নেন। দাওয়া থেকে নিচে নেমে দাঁড়ান। রূপেন্দ্রনাথ সবিনয়ে যুক্তকরে বলেন, আসুন, আসুন, চাটুজ্জে কাকা। মৌলবী-সাবও মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, আদাব।

দোবেজি ছাতা নিয়ে অন্তরালে সরে যায়।

নন্দ বলেন, ‘আসুন, আসুন, মুখে তো বলছ রূপেন, কিন্তু যাই কী করে?

তর্জনী-সঙ্কেতে দাওয়ার দিকে কী-যেন দেখালেন। রূপেন্দ্রনাথ বুঝে উঠতে পারেন না। তালপাতায় বোনা মাদুর—যা বিছিয়ে ওঁরা দুজনে এতক্ষণ বিদ্যাচর্চা করছিলেন, স্পর্শদোষ বাঁচাতে সেটা তো মৌলবী-সাব ইতিপূর্বেই অপসারণ করেছেন। তাহলে? রূপেন্দ্রনাথ না বুঝলেও মৌলবী-সাব বুঝে ফেলেছেন, ‘মাফি কিয়া যায়’ বলে তিনি একপাশে সরে গেলেন। তাঁর ছায়াটিও যেন লজ্জা পেল; অনুগমন করল কায়ার। গৃহস্বামীকে বললেন, কাল আবার একই সময়ে আসব।

দুজনকেই আদাব জানিয়ে বড় বড় পা ফেলে তিনি ঘাটের দিকে রওনা হয়ে যান।

এতক্ষণে সমস্যাটার পূরণ হল। অস্তাচলগামী সূর্যের আলোয় ঐ যবনের ছায়াটা দীর্ঘায়ত হয়ে পড়েছিল দাওয়ায়।

পাদুকা ত্যাগ করে নন্দ চাটুজ্জে উঠে এলেন দাওয়ার উপর। রূপেন্দ্র প্রণাম করার উদ্যোগ করতেই এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলেন, দূর থেকেই পেন্নাম কর বাবাজি, এই অবেলায় আর ছান করতে পারব না।

রূপেন্দ্র যবনের সঙ্গে একাসনে বসেছিলেন এতক্ষণ। একটা চৌপায়া টেনে নিয়ে নন্দ বসলেন। রূপেন্দ্র বসে পড়েন নিকানো দাওয়ায়। বৃদ্ধ বললেন, তুমি মায়ের ইচ্ছায় গাঁয়ে ফিরে এসেছ। খুবই আনন্দের কথা। রোজই ভাবি এসে দেখা করে যাব, সময় করে উঠতে পারি না।

রূপেন্দ্র কুণ্ঠিত হয়ে বলেন, আমারই যাওয়া উচিত ছিল, কাকা, কিন্তু…

নন্দ কথা ঘোরালেন। প্রশ্ন করেন, উটি কে এয়েছিল? পীরপুরের কলিম-মোল্লা নয়?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। মৌলভী কলিমুদ্দীন। ওঁর কাছে আমি আরবী-ফারসী শিক্ষা করি।

—খুব ভাল কথা বাবা, খুবই আনন্দের কথা। এই অংবং-ভাষার জমানা গেছে। এখন উন্নতি করতে হলে ম্লেছভাষা শিখতেই হবে। একটু রপ্ত করে নাও, তারপর বড়কর্তাকে ধরপাকড় করে তোমাকে আমি মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেব। নবাব সায়েবের দরবারে ‘বড়কর্তা’ যে নরেশ দত্ত এটুকু বুঝলেন রূপেন্দ্র। মুর্শিদাবাদের দরবারে রুজি-রোজগারের বাসনা যে তাঁর আদৌ নাই, একথা জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না। তিনিও প্রসঙ্গান্তরে চলে এলেন, খুড়িমারা ভাল আছেন? বাড়ির আর সবাই?

—তা পরের মুখে ঝাল খাবে কেন বাবা? সে তো তোমার নিজের বাড়ি। সৌরীনদা ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের মতো। বলতে গেলে একই পরিবার। তুমি বরাবর বিদেশে ছিলে বলেই …..

ইতিমধ্যে জগুঠাকরুণ এসে দাঁড়িয়েছেন ভিতরের দরজার সামনে। পরনে থান, মাথায় আধো-ঘোমটা। সেখান থেকেই বলেন, কী সৌভাগ্য! চাটুজ্জে ঠাকুরপোর পদধূলি পড়ল আজ এ বাস্তুতে! বসুন, আমি একটু বেলের পানা আর নৈবেদ্যের কুচোকাচা কিছু নিয়ে আসি।

নন্দ হাত দুটি জোড় করে বলেন, ও-কথা বলবেন না জগু-দিদি। প্রসাদ গ্রহণ করতে পারছি ‘না—এ-কথা মুখে’ উরুশ্চারণ করাও পাপ! কিন্তু সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, মানে

জগুঠাকরুণ বলে ওঠেন, বুঝেছি! তা মতির মায়ের বাতের ব্যথাটা এখন কেমন আছে?

—ও তো তার বাকি জীবনের সাথী হয়ে রইল, দিদি। হরিমতি যদি মায়ের দায়িত্বটা নিতে না পারত তাহলে সংসারটা ভেসে যেত।

—মতি? সে তো নেহাৎ বাচ্ছা! কত বয়স হল তার?

নন্দ হাসলেন। বলেন, কুলীনের ঘরের অরক্ষণীয়ার বয়সের কেউ হিসাব রাখে, দিদি? তবে গৌরীদানের বয়স যে আর নেই তা তো আপনিও জানেন। একপক্ষে এ ভালই হয়েছ। আমার তো আরও তিনটি কন্যা আছে। গৌরীদানের পুণ্য পরেও অর্জন করতে পারব। কিন্তু হরিমতি আমার সংসারে না থাকলে সব ভেসে যেত! দারুণ বুদ্ধিমতী! সবদিকে তার নজর। জানেনই তো, দৈনিক আমার বাড়িতে দু-বেলায় দেড়কুড়ি পাতা পড়ে। হরিমতির মা তো দেখা-শোনা করতে পারে না, সব ব্যবস্থা ঐ হরিমতির। এদিকে সংসার, ওদিকে মায়ের সেবা, আবার ঁমায়ের নিত্যপূজার যোগান। আমি অবাক হয়ে ভাবি—কেমন করে মেয়েটা এমন দশভুজা হয়ে উঠল? সবই সেই ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা! তারা—তারা—মা!

জগু-ঠাকরুণ মনে মনে হাসছিলেন। চাটুজ্জে-বাড়ির হক হদিস্ তাঁর অজানা নয়। নন্দ-চাটুজ্জের তিন তিনটি পত্নী। সংসারের যাবতীয় দায়ঝক্কি ওঁর নিঃসন্তানা বড় বউয়ের স্বামীর অধিকার হারিয়ে সেই সন্তানবঞ্চিতা সংসারটিকেই আঁকড়ে ধরেছেন। উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন—অথবা কে-জানে হয়তো বিবাহিতযুগের ঊষাকালের স্মৃতিচারণে তাঁর অবকাশ কাটে। মেজবৌ—হরিমতির মা—বাতে পঙ্গু। পড়ে আছে সংসারের একপ্রান্তে। নন্দ চাটুজ্জের নয়নের মণি এখন তৃতীয়পক্ষ। সে ঐ কাতুর চেয়ে দু-এক বছরের বড় হবে হয় তো। কী উদ্দেশ্যে বড় মেয়েটির গুণগানে আজ চাটুজ্জে মশাই চতুর্মুখ ব্রহ্মা সেজেছেন তা বুঝতে বাকি থাকে না। কথা ঘোরাতে বলেন, আপনি এসে পড়েছেন, ভালই হল, অমাবস্যার পারণ কি কাল না পরশু?

—কালই দিদি। আর সেজন্যই তো আসতে হল। মঙ্গলবারে অমাবস্যা পড়েছে; তাই মায়ের পূজার সামান্য আয়োজন করেছি। পূজা তো সারারাত ধরে, পশু রুপো-বাবা দ্বিপ্রহরে আমার ওখানে মহাপ্রসাদ পেয়ে আসবে। মাত্র দ্বাদশটি ব্রাহ্মণ সেবা করব। তার ভিতর একজন আমাদের রূপেন। আপনাকে অনুমতি দিতে হল, দিদি।

জগুঠাকরুণ আড়-চোখে একবার ভাইপোকে দেখে নিয়ে বলেন, আমার অনুমতি আবার কিসের? ওকেই বলুন?

—ওকে তো বলবই। তবু আপনি যখন আছেন মাথার উপর…তা, বাবা রূপেন, তুমি আসবে। কেমন? ‘গুতির বামুন’, যেন অন্যথা না হয়।

রূপেন্দ্রনাথ যুক্তকরে বলে ওঠেন, আপনার ভদ্রাসনে পাত পাতব এ তো আমার সৌভাগ্য; কিন্তু এবার আমাকে মাপ করতে হবে, কাকা। অন্য কোন দিন….

ভ্রুকুঞ্চিত হল নন্দ চাটুজ্জের। প্রশ্ন করেন, কেন, বলত?

—সৎ শাক্ত ব্রাহ্মণ আপনি অনায়াসেই গ্রামে জোগাড় করতে পারবেন। আমি পেশায় কবিরাজ—কেউ ডাকতে এলে ‘যাব না’ বলতে পারব না তো। আপনি ‘গুতির বামুন’ বললেন কি না—

—বেশ, না হয় আমি তোমাকে ‘গুতির বামুন’ হওয়ার বিড়ম্বনা থেকে অব্যাহতি দিলাম। রুগী-পত্তরের ঝামেলা মিটিয়ে নিশ্চয় যাবে, কথা দাও?

রূপেন্দ্রনাথ তখনও যুক্তকর। বলেন, এবার থাক, কাকা।

পুনরায় ভ্রুকুঞ্চিত হল নন্দর। বললেন, তোমার বাবা, তোমার ঠাকুর্দা দুজনেই ছিলেন শাক্ত। তুমি কি বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছ?

—আজ্ঞে না। দীক্ষা আমি গ্রহণ করিনি।

—তাহলে? আপত্তিটা কিসের?

রূপেন্দ্র ইতস্তত করে বললেন, দেখতেই তো পেলেন, আমি আচার-বিচার ঠিক মতো মানি না। মায়ের পূজার আয়োজন করেছেন, সেখানে আমার না যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। কোথায় ছোঁওয়া-ছুঁয়ি হয়ে যাবে।

নন্দ দৃঢ়স্বরে বলেন, যাবে না। আমি গঙ্গা-জল ছিটিয়ে দেব তোমার মাথায়। তবে একথাও বলি, রূপেন—ঐ মোছলমানের সঙ্গে এক মাদুরে ভর সন্ধ্যেবেলায় তোমার ওভাবে বসাটা ঠিক নয়। মোছলমানদের ভাষা শিখছ ভাল কথা—ওটা না আয়ত্ত হলে নবার সরকারে পাত্তা পাবে না। দলিল দস্তাবেজ সবই ঐ যাবনিক ভাষায়। কিন্তু তাই বলে একাসনে বসা…তুমি এক কাজ কর। কলিম মোল্লা এলে ঐ তেঁতুলবটের ছায়ায় গিয়ে দুজনে বস। মহামতি বিদুর একবার ধম্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন যে, ভূমিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আসন! বুঝলে না বাবা?—

রূপেন্দ্রনাথ বুঝলেন। ‘ধর্ম’ শব্দটা ‘উরুশ্চারণ’ পর্যন্ত যিনি করতে পারেন না, মহাভারতটাও যিনি পড়েননি—ভাসা-ভাসা শুনেছেন, তিনিই আজ সমাজপতি!

—আজ, উঠি। কেষ্টপক্ষের রাত। এখনি সব আঁধার হয়ে যাবে।—তাহলে ঐ কথাই রইল। যত বেলাই হক, রুগীপত্তর সব মিটিয়ে তুমি দুপুরে আমার ওখানে আসবে। বিকাল হয়ে যায়, তাই সই! কেমন?

গাত্রোত্থান করলেন এবার। রূপেন্দ্রও উঠে দাঁড়ান। মৃদুভাষে বলেন, আমি তো আগেই বলেছি কাকা—কিছু বাধা আছে। পরে একদিন আপনার বাড়িতে অন্নগ্রহণ করে আসব।

নন্দ স্পষ্টতই বিরক্ত। ওর একগুঁয়েমিতে। কী ভেবেছে ছোকরা? ওঁর নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ধন্য করে দিচ্ছে? সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, বাধা আছে তা বলেছ, কিন্তু ‘বাধাটা’ কী, তা তো বলনি। তুমি শাক্তবংশের সন্তান, মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে বোষ্টমও হওনি! তাহলে এই জেদাজেদির অর্থ কী?

জগুঠাকরুণ দাঁড়িয়ে আছেন তখনো। অন্দরমহলের দ্বারদেশে। ভ্রাতুষ্পুত্রের এই একগুঁয়েমির অর্থটা তিনিও প্রণিধান করতে পারছেন না। হতভাগাটা কী ভাবছে? চাটুজ্জে বাড়িতে নিমন্ত্রণ রাখতে গেলে ওরা জোর করে ঐ হরিমতিকে সাতপাক ঘুরিয়ে দেবে? সে এখনো নীরব আছে দেখে তিনি বলে ওঠেন, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি যান ভাই। আমি ওকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে পাঠিয়ে দেব। আর নেহাৎ না যায় তো নাই গেল, ও তো আর ‘গুতির বামুন’ থাকছে না!

নন্দদুলাল নিজেকে অপমানিত বোধ করেন। করার কথাও। ঐ একফোঁটা ছোকরা ভেবেছে কী? গম্ভীর হয়ে বলেন, না, দিদি। ব্যাপারটা অত সহজে মিটবে না। আমি এই সোঞাই গাঁয়ের সমাজপতি। আমাকে জেনে যেতে হবে। দু-পাতা সমস্কৃত পড়ে ও এমন দিগ্গজ পণ্ডিত হল কী করে যে, আমার বাড়ির নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে? মায়ের প্রসাদ মুখে দেব না বলে!

জগুঠাকরুণ শিহরিতা হয়ে ওঠেন। এ কোথা থেকে কী হতে বসেছে! নন্দ চাটুজ্জে এ গাঁয়ের মাথা। ইচ্ছে করলে হাতে মাথা কাটতে পারেন। সত্যই তো! এভাবে মানী লোকটাকে অপমান করার কী অর্থ? বজ্রগম্ভীর স্বরে ডাকেন, রুপো!

রূপেন্দ্রনাথ এখনো যুক্তকর! শান্তস্বরে বলেন, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন কাকা! আপনার নিমন্ত্রণ আমি প্রত্যাখান করিনি। কেন করব? আপনি আমার পরমপূজ্য—সোঞাই গ্রামের সমাজপতি। ভবিষ্যতে যেদিন ডাকবেন, ‘আমি আপনার বাড়িতে পাত পেড়ে খেয়ে আসব।

—কেন? ভবিষ্যৎ কেন? কেন পশু নয়?

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, সে-কথা থাক না, কাকা!

—না! থাকবে না! আমাকে জেনে যেতে হবে! আমার জ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন। কেন থাকবে?

—কথাটা অপ্রিয়। অহেতুক আপনাকে আঘাত দিতে চাই না বলে। আপনার ধর্ম আপনার, আমার ধর্ম আমার। কী প্রয়োজন বিরোধের সৃষ্টি করে?

নন্দ চাটুজ্জে প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। তিক্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন, তোমার বাবা কিন্তু এমন মিন্‌মিন্ করতেন না রূপেন। সত্যিকথা মাথা খাড়া রেখে বলবার হিম্মৎ ছিল তাঁর। তোমার ঠাকুদ্দাও ছিলেন স্পষ্টবক্তা। সেই বংশের ছেলে হয়ে তুমি যে সত্যিকথা বলতে ভির্মি খাও—সেই বাড়ুজ্জেবংশের ভিটেয় দাঁড়িয়ে—

রূপেন্দ্রনাথের চোখ দুটি জ্বলে ওঠে। বলেন, থাক! ‘মায়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্ নীতির নির্দেশেই এতক্ষণ আপনাকে দাগা দিতে চাইনি। কিন্তু আপনি আমাকে বাধ্য করলেন। তাই বলছি, আমি ‘মহাপ্রসাদ’ গ্রহণ করি না।

বজ্রাহত হয়ে গেলেন নন্দদুলাল!

বেশ কিছুটা সময় লাগল তাঁর স্বাভাবিক হতে। তারপর পাশে ফিরে দেখলেন জগুঠাণও দারুমূর্তিতে রূপান্তরিতা। নন্দ তাঁকে বললেন, একটু আগে আপনার ভাইপোকে বলছিলুম, পায়ে হাত দে পেন্নামটা করিসনি রূপেন, এই অবেলায় ছান করলে শরীর খারাপ হবে। তা আপনার ভাইপো এই বুড়ো মানুষটাকে ভরসন্ধ্যে বেলায় ছানটা করিয়েই ছাড়ল। যে কথা এইমাত্র শুনলুম, তারপর ছান না করে তো বাড়ির চৌকাঠ মাড়াতে পারব না!

জগুঠাকরুণ সে-কথার জবাব না দিয়ে ভাইপোকেই প্রশ্ন করেন, এত বড় কথাটা তুই বলি? শাক্ত বংশের সন্তান হয়ে? কিন্তু কেন, কেন, কেন?

রূপেন্দ্রনাথ এখনো যুক্তকর। শান্তকণ্ঠে বলেন, সময়মতো তা আপনাকে বুঝিয়ে বলব, পিসিমা। অনেক সময় লাগবে।

নন্দ চাটুজ্জে চৌপায়াটা আবার টেনে নেন। বসে পড়েন। ইতিমধ্যে পিলসুজের উপর প্রদীপটা বসিয়ে কাত্যায়নী এসেছিল একবার। হাওয়া বাঁচিয়ে কপাটের আড়ালে প্রদীপটা রেখে সেও কাঠ হয়ে অপেক্ষা করছে। দাদাকে সে ভালবাসে, শ্রদ্ধাও করে, কিছু না বুঝেও। কথোপকথন সব কিছুই কানে গেছে তার। নন্দ বললেন, যদি সারারাতও লাগে তবু ব্যাখ্যাটা আমাকে শুনে যেতে হবে। বল? তুমি আমিষ আহার কর না?

—করি। খাদ্য-খাদকের এই সম্পর্ক জীবজগতে অনস্বীকার্য! এমন একটা ব্যবস্থাপনা কেন যে করেছেন দিন-দুনিয়ার মালিক, তা জানি না। তাই মৎস্য ও মাংস দুইই আমি ভক্ষণ করে থাকি। তবে মাংসের ক্ষেত্রে ঐ যাকে আপনার বলেন ‘বৃথা মাংস’ শুধু তাই আহার করি। নৈতিক কারণে আপনারা যাকে বলেন ‘মহাপ্রসাদ’

—থাক! বারে বারে একই কথা বলতে হবে না। কিন্তু কেন?

রূপেন্দ্রও বসে পড়েছেন ভূশয্যায়। বলেন, বেশ, শুনুন। শক্তি উপাসনা এই ভারত ভূখণ্ডে অতি প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত। ত্রিবেণীতে থাকতেই আমি গুরুদেবের সংগ্রহে অনেক শাক্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি। মধ্যযুগে রচিত তারাতন্ত্র, তারা-রহস্য, রুদ্র-যামল-তন্ত্র, চীনাচার- প্রয়োগবিধি ইত্যাদি পুঁথি রচনার বহু বহু পূর্বযুগ থেকেই শক্তিপূজার আয়োজন ছিল। আদিযুগে পশুবলির ব্যবস্থা ছিল না। আদিযুগের শক্তি উপাসকেরা নির্দেশ দিতেন, মায়ের বেদীর সম্মুখে যূপকাষ্ঠে বলি দিতে হবে অন্তরের ষড়রিপুকে—কাম, ক্রোধ লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য! ক্রমে ঐ ষড়রিপুকে বলিদানের প্রতীক হিসাবে একটি ছাগশিশুকে বলিদানের আয়োজন হল। চীনাচারের প্রভাবে ক্রমশ শাক্ত পণ্ডিতেরা বিস্মৃত হয়ে গেলেন—মূল উদ্দেশ্যটা কী ছিল! ষড়রিপুকে নয়, ঐ ছাগশিশুকে হত্যা করার মধ্যেই তাঁরা মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করলেন! পঞ্চ মকারের পঙ্ককুণ্ডে ভেসে গেল তাঁদের শুভবুদ্ধি—ব্যভিচারের বন্যায়…

—ব্যস! থাক! তোমার ঔদ্ধত্যেরও একটা সীমা থাকা উচিত!—উঠে দাঁড়ালেন নন্দ! রূপেন্দ্রনাথ মনের আবেগে কথা বলে যাচ্ছিলেন। এতক্ষণে নজর হল, বৃদ্ধ দু-হাতে দুই কান চাপা দিয়ে ধর্মব্যাখ্যা শুনছিলেন!

ওঁরা দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে যাবার পর হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন জগুঠাক্রণ, কী পেয়েছিস্ তুই! হতভাগা, বাঁদর। যা মুখে আসে তাই বলবি?

রূপেন্দ্রনাথ ম্লান হেসে বলেন, বলতে তো আমি চাইনি, পিসি। আপনিই তো বাধ্য করলেন। আর তাছাড়া এই ভাল হল! ওঁরাও যে দেখছেন! শুনছেন!

কৃষ্ণাচতুর্দশীর নৈশাকাশের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে দেখান। এই ভদ্রাসনের পূর্বপুরুষদের অবশ্য দেখা গেল না। তবে সন্ধ্যাকাশে ফুটে উঠেছে সপ্তর্ষি। অত্রি-অঙ্গিরা-পুলহ-পুলস্ত…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *