কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

কাশীধাম – ১

স্থান, কাল আর পাত্র।

প্রথমেই চিহ্নিত করে নেওয়া যাক।

স্থান : সেই যেখানে নাকি ভূমিকম্প হয় না—বাবা ঁবিশ্বনাথের ত্রিশূলপ্রান্তে চিহ্নিত মহানগরী কাশীধাম।

কাল : 1696 শকাব্দ; সংবৎ : 1831—অর্থাৎ ফেরঙ্গমতে 1774 খ্রীষ্টাব্দ। সূর্য কুম্ভরাশিতে, তিথি কৃষ্ণা নবমী। হিসাব মতো ফরাসী দেশে ব্যাস্টিল দুর্গের পতন হতে যেমন পনের বছর বাকি, তেমনি পলাশীর যুদ্ধ সতের বছর অতীতের ঘটনা। কোম্পানির রাজত্ব সবে শিকড় গেড়ে বসছে। ইংলন্ডে তখন তৃতীয় জর্জ সিংহাসনে আসীন। রাজা রামমোহন রায় মাত্র দুই বৎসরের শিশু।

পাত্র : না, পাত্র নয়, পাত্রী। কিন্তু তাঁর কথা পরে আসবে। আপাতত যার প্রসঙ্গ দিয়ে কাহিনী শুরু হচ্ছে তার নাম সুখিয়া—মহামহিম কাশীরাজ সরকারের বেতনভুক ‘হসিসিয়ূন’—সাদা-বাঙলায়—গুপ্তচর, প্রয়োজনে যাকে গুপ্তহত্যার কাজে নিয়োগ করা চলে।

তিনতলা পাষাণ-হর্ম্য। গঙ্গাতীর। অসিঘাটের কাছাকাছি। আদ্যন্ত চুনা-পাথরে চুন-সুরকির মশলায় গাঁথা। দেখলে মনে হয় না এটা প্রমোদভবন, যেন—দুর্গ! এ অট্টালিকার পরিচয়’অসিঘাটের বাগানবাড়ি’। জনহীন, নির্বান্ধব পাষাণপুরী সারাটি দিন ঝিমায়। সন্ধ্যা সমাগমে তার নিদ্রাভঙ্গ হয়। তখন শোনা যায় কিছু কলগুঞ্জন। রাজকার্যে ক্লান্ত-তনু রাজাসাহেবের শুভাগমন ঘটে। বাগানের মালি ছুটে এসে সেলাম করে, ঘোড়ার লাগামটা ধরে। রাজাসাহেব ময়ূরপঙ্খী-নাগরা মমশিয়ে সোপান বেয়ে উঠে যান ফাঁকা ছাদে। আসে কিছু বয়স্য, আর আসে কিংখাবে-মোড়া পালকি চেপে নৃত্যগীত-পটিয়সী কিছু বেহেস্তের হুরী।

সেটাই হচ্ছে সুখিয়ার চিন্তার কারণ।

প্রয়োজনে সে রাজাসাহেবের শয়নকক্ষে বিনা-এত্তেলায় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়তে পারে—সে অধিকার তার আছে—যদি তেমন-তেমন গোপন সংবাদ লুকানো থাকে তার আস্তিনের তলায়। রাজারানীর মিলন-মুহূর্তটাকে খাখান্ করে সে জানলা দিয়ে ঢুকে পড়তে পারে, যদি তার কুর্তার জেব্‌-এ লুকানো থাকে রাজহত্যার গোপন ষড়যন্ত্রের বার্তা। কিন্তু আজ সে যে খবরটি সংগ্রহ করে এনেছে তা চমকপ্রদ হলেও রাজাসাহেবের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িত নয়—শুধু তাঁর একটা কৌতূহল চরিতার্থ করতে। এ সময় রাজাসাহেবের সান্ধ্য-বিনোদনে ব্যাঘাত ঘটানো উচিত হবে কিনা ঠাওর করে উঠতে পারে না।

অশ্বপৃষ্ঠে ওকে এগিয়ে আসতে দেখে লোহার-শিক দেওয়া বিরাট ফটকটা খুলে গেল। দ্বাররক্ষক ওকে চেনে। প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে অশ্বটিকে রজ্জুবদ্ধ করল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। প্রমোদ-প্রাসাদে কোথাও আলো জ্বলছে না। শুধু খোলা ছাদে কিছু স্তিমিত আলোকরশ্মি। একটু কান করে শোনার চেষ্টা করল—না, তবলা বা ঘুঙুরের শব্দ উঠছে না। বাগানেও নেই কোনো কিংখাবে-মোড়া পালকি। তার মানে, নাচনেওয়ালীরা এখনো এসে পৌঁছায়নি। কিন্তু রাজাসাহেবের ঘোড়াটাকে দেখা যাচ্ছে।

নজরে পড়ে সিঁড়ির ও প্রান্তে রামলগন বসে সিদ্ধি খুঁটছে। রামলগন রাজাসাহেবের দেহরক্ষী—মহিষাসুরের মতো চেহারা। ঈয়া পাকানো মৌচ, ঈয়া বুকের পাটা-—লাঠিয়াল-দলের সর্দার। ছেদিলাল শিলাপটে পেস্তাবাদাম জাতীয় কী যেন পিষছে।

সুখিয়া সেদিকে এগিয়ে আসে। বলে, রাম-রাম লগনজী, ক্যা হালচাল?

রামলগন একবার চোখ তুলে তাকায়। জবাব দেয় না।

রাজসন্দর্শনে যাবার আগে একটি অনিবার্য প্রশ্ন থাকে। সেটা জেনে যাওয়াই প্রথা। গরজ বড় বালাই। সুখিয়া জানতে চায় : রাজাসাহেবের মেজাজ শরীফ?

এবারও প্রত্যুত্তর করল না সর্দার-লেঠেল।

সুখিয়া প্রশ্ন করে, উপর যাঁউ?

—তোহার মর্জি!

বোঝা গেল, রাজাসাহেবের মেজাজ যেমনই থাক, তাঁর খাশ দেহরক্ষীটির মেজাজ তিরিক্ষে। সুখিয়া পেশায় গুপ্তচর, রাজ্যের যাবতীয় তথ্যের হক-হদিস্ তার নখদর্পণে। তার জানা আছে, কী হেতুতে রামলগনের মেজাজ এতটা বিগড়ে আছে।

তা তো হতেই পারে। রামলগনের স্বহস্তে বানানো ‘সিদ্ধির সুখ্যাতি তামাম কাশীধামে সুবিদিত—দশাশ্বমেধ ঘাটের মেঠাইওয়ালা তেওয়ারিজীর ‘জিলাইবী’ অথবা দড়িয়া-কা-পোলের ভুঁজাওয়ালার পিস্তা-কা-হালুয়ার মতো—’যো খায়া বহু পস্তায়া, যো নহী খায়া বহুভি পস্তায়া। অনেকের ধারণা—ঐ সিদ্ধির সিদ্ধিতেই রামলগন সর্দার-লেঠেলের পদে উন্নীত। না হলে ঈশান কৈবর্তের নোকরি-খতমের পরে এই বারাণসীধামে কি ‘পালওয়ানে’র আকাল পড়েছিল? কিন্তু রাজাসাহেব ইদানীং আর সিদ্ধির নেশায় মৌজ করেন না। বেশ কিছুদিন প্রয়াগ ক্যান্টনমেন্টে বাস করে যখন কাশীতে ফিরে এলেন তখন দেখা গেল তাঁর নেশাটিরও বদল হয়েছে। রাজারাজড়ার ব্যাপার—শয্যাসঙ্গিনীর মতো ওঁদের মাঝে মাঝে নেশারও বদল করতে হয়। ওঁর এখন ধারণা হয়েছে—সিদ্ধি-ভাঙ হচ্ছে নাবালকের আর গঞ্জিকা নাঙ্গা ফকিরের নেশা। বর্তমানে তিনি নাকি কী এক আজীব বিলাইতির মহব্বতে মাতোয়ারা—সুখিয়া বাপের জন্মে তার নাম শোনেনি—’শ্যামপিন’, না কী যেন নাম। আকবরী মোহর দিয়ে তা রাজাসাহেব আমদানি করেন ফেরঙ্গ ক্যান্টনমেন্ট থেকে।

তা রাজাসাহেবের অমৃতে অরুচি হতে পারে, রামলগনের তো সেটা হয়নি। সে তার তিনপুরুষের সিদ্ধিকে ত্যাগ করতে পারে না। ইদানীং বেচারি গ্যাটের কড়ি গচ্চা দিয়ে নেশার যোগান দেয়। পারতপক্ষে রাজাসাহেবের সামনে আসে না আজকাল। সেই যেদিন ভাঙের ভাঁড়টা রাজাসাহেব ওর মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মেরেছিলেন তার পর থেকে।

সুখিয়া এসব বৃত্তান্ত জানে। তাই বলে, আমার জন্যেও এক লোটা ‘অরিৎ’ বানিও ভাই রামলগন। আমি তো রাজকাজে দেশ-বিদেশ ঘুরি—তোমার সিদ্ধির সুখ্যাতি দেখছি ইদানীং কাশীর বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।

খুশি হল রামলগন। বলে, সে সব ফেরার পথে হবে। তুমি যাও, ছাদে চলে যাও। ফেরার সময় মহাবীরজীর পরসাদ পেয়ে যেও। লেকিন এগো বাৎ শুনিহ সুখিয়া ভেইয়া—এক লোটা পী’লে তিন দিন তোমার নিদ্ টুটবে না। যতটুকু পরসাদ তোমার সহ্য হবে তা আমি নিজে হাতে মেপে দেব। সমঝা? যাও! উপর যাও!

—নাচনেওয়ালী কসবিরা এসে পৌঁছায়নি তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ছাদে আছেন কে কে?

—কবিজী আছেন, আড্ডাধারী ঔর বটু।

তিনজনই সুপরিচিত। রাজাসাহেবের তিন অন্তরঙ্গ ইয়ার দোস্ত। কবিজী, অর্থাৎ কাব্যতীর্থ ব্রাহ্মণ, রাজা-সাহেবের চেয়ে না হোক দশ বছরের বড়। তবু তিনি বয়স্যপদে বহাল। কারণ নবরসের প্রথম রসটিতে তাঁর দিল সর্বদাই টুবুটুবু—ঘনরসে পান্তুয়ার মতো। কাঁচা খিস্তিকে সুচারুরূপে কাব্যরস মণ্ডিত করার দুর্লভ প্রতিভা তাঁর এক্তিয়ারে। কাব্য আর খিস্তির ফারাকটা বোঝা যায় না। আড্ডাধারী রাজা সাহেবের ঘুন্সিযুগের বন্ধু। অর্থাৎ যে আমলে মাজায় কষি দেবারও প্রয়োজন ছিল না—স্রেফ ঘুসি। রাজা-সাহেবের উত্থান-পতনের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছেন। ছায়ার মতো তাঁর পিছন পিছন ঘোরেন। কুপরামর্শের যোগান দিয়ে চলেন ক্রমাগত।

তৃতীয় ব্যক্তি বটু। বামন। প্রাক্তন রাজামশায়ের বিদূষক। সচরাচর বিদষকের পদ লাভ করে পৈতাধারী বামুন। বটুকেশ্বর প্রামাণিক। অতি ধূর্ত লোক। প্রাক্তন কাশীনরেশ বলবন্ত সিং-এর গঙ্গাপ্রাপ্তির পর রাজ-সরকারের খোল-নলচে আদ্যন্ত পালটে গেছে। সেনাপতি বজ্রধর দেশত্যাগী, রাজপুরোহিত ‘গঙ্গারাম মিশ্র অপসারিত, মন্ত্রী বেপাত্তা। রাজার লাঠিয়াল-সর্দার ঈশান কৈবর্তকে সপরিবারে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল—কোনক্রমে সে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। তার বউটাই শুধু পুড়ে মারা যায়। বোধকরি এতদিনে সে তার পিতৃভূমি বঙ্গাল-মুলুকে ফিরে গেছে—কারণ তার ডাকাতির খবর আর ইদানীং পাওয়া যাচ্ছে না। যা বদলায় নি তা : বিদূষক! একমাত্র ব্যতিক্রম তাই বটুকেশ্বর প্রামাণিক! ভাঁড়ামোর পারদর্শিতায় সে কর্মচ্যুত হয়নি।

সিঁড়ি বেয়ে, ছাদে পৌঁছে সুখিয়া আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। ভারী পর্দার ফাঁকে একটা চোখ লাগিয়ে সে ওদিককার অবস্থাটা সমঝে নিতে চায়।

ফাল্গুনের শেষাশেষি। দিব্যি ফুরফুরে গঙ্গার হাওয়া। ছাদে প্রকাণ্ড গদি বিছানো! তার উপর জাজিম। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মখমলে মোড়া খানকতক কামদার তাকিয়া। রাজাসাহেব অর্ধশয়ান। তাঁর হাতে আলবোলার ফরসি। সামনে মোরাদাবাদী কাজ-করা ধাতবপাত্রের উপর বিলাইতির বোতল আর পানপাত্র। একপাশে রাখা আছে কিছু বাদ্যযন্ত্র। একটা রূপার রেকাবিতে অপর্যাপ্ত জুঁই ফুল। বয়স্য তিনজন রাজাসাহেবকে ঘিরে। নর্তকীরা এখনো এসে পৌঁছায়নি।

—কৌন? কৌন হ্যায়?—সবার আগে বটুকের নজর পড়েছে ভারী পর্দার নিচে একজোড়া নাগরাপরা পা। পর্দা সরিয়ে সুখিয়া ছাদে উঠে আসে। আভূমি নত হয়ে কুর্নিশ করে। লোকটা ধূর্ত—সাবেক রাজামশায়কে সে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করত। এখন কুর্নিশের কায়দা রপ্ত করেছে। জানে, রাজাসাহেবের ঐসব মোগলাই কেতা মনপসন্দ।

রাজাসাহেব উর্দু-মেশানো হিন্দুস্থানীতে বললেন, ও! তুই! খবর নিয়ে এসেছিস?

—জী সরকার। লেকিন খবরটা তো তেমন জরুরী নয়, এখনি হুজুরের দিল বিগড়ে দিতে চাই না। ওয়ার্না কাল সুবে আপনার খিদমতে…

হুঙ্কার দিয়ে;ওঠেন রাজাসাহেব, হারামজাদা! কোন ব্যাপারটা জরুরী তা বিচার করব আমি! সমঝ গয়ে? বেতমিজ, গিদ্ধড়! তুই হুকুমের খিদ্‌মদ্‌গার। যা হুকুম হবে সিরেফ তামিল করে যাবি! বল, কী জেনে এসেছিস? জগু পণ্ডিত যা বলেছে তা সচ্?

যুক্তকর গরুড়পক্ষীর মতো সুখিয়া দাঁড়িয়ে থাকে। বয়স্যের অধিকারে আড্ডাধারী রাজাসাহেবকে সস্নেহ ধমক দেয়, তোমার যেমন কাণ্ড, রাজাসাহেব! সুখিয়া হারামজাদা কি জানে—জগুয়া কী অভিযোগ করে গেছে? র’স, আমি জেরা করছি। অ্যাই সুখিয়া, তুই নিজে চোখে বিদ্যালঙ্কারকে দেখে এসেছিস?

—জী সরকার!

—কী করছিল র‍্যা? ছাত্তর ঠেঙাচ্ছিল?

সুখিয়া ইতস্তত করে। না, কোন ছাত্রকে প্রহার করতে দেখেনি। স্বীকার করল সে কথা। সে শুধু দেখে এসেছে—বিদ্যালঙ্কার তাঁর চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনা করছিলেন।

—ঐ হল! তারেই বলে ছাত্তর ঠ্যাঙানো! এখন বল দিনি—ওর ছাত্তরদের বয়স কত হবে? দশ, পনের, বিশ, বাইশ?

—জী হাঁ। যেয়াদা ভি হো সক্‌তা।

—আর বিদ্যালঙ্কারের বয়স?

সুখিয়া মাথা চুলকায়। কী জবাব দেবে ঠাওর করে উঠতে পারে না।

—আন্দাজে বল্ হারামজাদা! বিশ-পঁচিশ? নাকি ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ?

—ঐসিনই হো সক্‌তা।

কাব্যতীর্থ অট্টহাস্য করে ওঠে, বাঃ! বাঃ! তুই যে সমদর্শী হয়ে উঠলি রে সুখিয়া—সদন্নে বা কদন্নে বা লোষ্ট্রে বা কাঞ্চনে তথা’। অ্যাঁ? কাঁচা-মিঠে ‘কিশোরী রসাল’ আর

শ্রোণীভারাদলসগমনা ‘পক্ক পনস’ তোর চোখে এক?

আড্ডাধারী ওসব চটুলতায় বিচলিত না হয়ে প্রশ্ন করে, কী দেখলি বল? বিদ্যালঙ্কারের মাথা কামানো? টিকি দেখলি?

—জী।

বটুকেশ্বর উপর-পড়া হয়ে জানতে চায়, কত বড় টিকি দেখলি বল? দু’ চার আঙুল? বিঘৎখানেক? নাকি দেড় হাত?

সুখিয়া সকলের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে দেখে। বটু বিদূষক। প্রথা বলে, তার প্রতি কথাতেই হেসে উঠতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তার কথায় কেউই এখন হাসছে না। সুখিয়ার মনে হল, প্রশ্নটা রসিকতা নয়, জবাবের অপেক্ষা রাখে। বলে, এনা বড়া হোগা শায়েদ!

হাতের মুদ্রায় বিদ্যালঙ্কারের অর্কফলার দৈর্ঘ্যটা বোঝাবার চেষ্টা করে।

আড্ডাধারী জানতে চায়, বিদ্যালঙ্কারের পরিধানে কী দেখলি? ধুতি পিরান?

—জী!

কাব্যতীর্থ প্রচণ্ড ধমক লাগায়, কী তখন থেকে শুধু ‘জী-জী’ করছিস্। বলি, তুই কি ‘জুজু’ দেখে এলি? ঠিক করে বল্ বেটা : পিরান না কামিজ, নাকি কুর্তা? অথবা ফতুয়া?

সুখিয়ার সব কিছু গুলিয়ে যায়। ঐ চারটি অঙ্গাবরণ পুরুষে ঊর্ধ্বাঙ্গে পরিধান করে এটুকুই জানা আছে; তাদের পার্থক্যটা ঠিক কী, তা ওর জ্ঞানসীমার বাইরে। স্বীকার করল সে কথা।

কাব্যতীর্থ এবার অন্বয়-ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে, ‘পিরান’ হচ্ছে ঢিলে-ঢালা জামা—যা ভবিষ্যতে বিবর্তিত হবে পাঞ্জাবিতে; ‘কামিজ’ হচ্ছে ‘শার্ট’-এর আদিমরূপ; ‘কুর্তা হচ্ছে ফেরঙ্গ সৈনিকদের অঙ্গাবরণ—আঁটো-জামা। আর ফতুয়া—হাতকাটা গ্রীষ্মের পোশাক।

এবার সুখিয়া নিবেদন করে—সেক্ষেত্রে বিদ্যালঙ্কারের গায়ে যে জামাটা দেখে এসেছে তাকে ‘পিরানই’ বলা উচিত।

কাব্যতীর্থ আরও গভীরে প্রবেশ করতে চায়, আর পিরানের তলায়?

সুখিয়া হালে পানি পায় না।

—বলি, পিরানের তলায় কী দেখলি, বল?

সুখিয়া নির্বাক!

—বল্ হারামজাদা! পিরানের নিচে কী আছে তা দেখেছিলি? চোখে বা হাত চালিয়ে? এবারেও কেউ হাসছে না। কী বিড়ম্বনা! কোনটা রসিকতা আর কোনটা প্রশ্ন বোঝা ভার। সুখিয়া মাথা নেড়ে জানায়, সে কথা ও জানে না!

কাব্যতীর্থ এবার ন্যায়তীর্থ হয়ে উঠতে চায়। প্রত্যক্ষ প্রমাণ, আনুমানিক প্রমাণ, ‘আনুভূতিক’ প্রমাণ! প্রশ্ন করে, তবে তুই কেমন করে বুঝলি বাপধন, যে তুই ন্যায্য সেই হটী বিদ্যালঙ্কারকেই দেখে এসেছিস? আর কোনও টুলো পণ্ডিতকে নয়?

—সবাই তো বললে, উনিই বিদ্যালঙ্কার!

—মানছি! সেটা তো অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ। কিন্তু পিরানটা তুলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ না পাওয়া ইস্তক তুই কী করে বুঝলি যে, সে স্ত্রীলোক? কামানো মাথায় চুট্‌কি দেখে?

এবারেও কেউ হাসছে না। এমন একটা অশ্লীল ইঙ্গিতে। সুখিয়া জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই রইল।

—তার মানে তুই বলতে চাস্ যে, পিরানের উপর থেকেই মর্মভেদী দৃষ্টিতে সেটা আন্দাজ করতে পারছিলি! কেমন?

এবারও সুখিয়া মেদিনীনিবদ্ধদৃষ্টি।

—কিরে ব্যাটা? তোর বাক্যি হরে গেল যে! তা উপর থেকে কী সমঝে নিলি তাই না হয় খুলে বল—বদরী, দাড়িম্ব, নাকি বাবা বিশ্বনাথের যা মনপসন্দ : যুগল পঙ্কবিশ্ব?

এতক্ষণে রাজাসাহেব কথা বলে ওঠেন। কাব্যতীর্থকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, অ্যাই সুখিয়া, তুই শুধু বল—ঠিক লোককে দেখে এসেছিস্ তো?

—জী হুজুর, গরিবপরবর!

ধমক খেয়েও কাব্যতীর্থ ক্ষান্ত হল না। লোকটা জানে, কাব্যালোচনার নচের আড়ালে ক্রমাগত আদিরস পরিবেশনের জন্যই সে রাজসরকার থেকে বৃত্তিভোগী। বললে, ব্যাপারটা কিন্তু প্রমাণ হল না, রাজাসাহেব।

রাজাসাহেব হাত নাড়লেন। মক্ষিকাবিতাড়নমুদ্রা। সুখিয়া মুক্তি পেল। খানদানি মোগলাই কায়দায় তিনবার কুর্নিশ করে তিনপা পিছু হটে পর্দার ওপাশে অন্তর্হিত হল।

আড্ডাধারী বুঝে নিয়েছে রাজাসাহেবের মন এখন অন্য দিকে। কাব্যতীর্থের চটুলতায় তাঁর মন নেই। আড়চোখে তাঁর দিকে একনজর দেখে নিয়ে বলে, জগৎ পণ্ডিত তো তাহলে মিছে কথা বলেনি! এতদূর দুঃসাহস! একজন স্ত্রীলোক কাশীধামে এসে চতুষ্পাঠী খুলে বসেছে! পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে ছাত্তর ঠ্যাঙাচ্ছে।

রাজা সাহেব বলেন, কাব্যতীর্থ! চ্যাঙড়ামি কর না। ভেবে চিন্তে বল তো—তোমার জ্ঞানমতে এমন ঘটনা কাশীধামে ইতিপূর্বে ঘটেছে?

কাব্যতীর্থ এবার নিজেকে সামলে নেয়। গম্ভীর হয়ে প্রত্যুত্তর করে, আজ্ঞে না, রাজা-সাহেব! এমন বিচিত্র কথা আমি জীবনে শুনিনি!

—শুধু ‘বিচিত্র’ নয়! অসামাজিক! অশাস্ত্রীয়!

—তা তো বটেই। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘স্ত্রীষু দুষ্টাষু’ হলে ‘বর্ণসঙ্কর’ জন্মগ্রহণ করে। স্ত্রীলোকের দুষ্টামি কদাচ সহ্য করতে নেই। সুখিয়ার কথায় মনে হল মেয়েটি পূর্ণ- যৌবনা। কোন সাহসে সে প্রকাশ্যে পুরুষের বেশে, মাথা কামিয়ে, টিকি রেখে চতুষ্পাঠী খুলে বসে? মনুর সুনির্দিষ্ট বিধান আছে—স্ত্রীলোক শুধু সন্তানের জন্ম দেবে, তাদের স্তনদান করবে, লালন-পালন করবে, স্বামীর পদসেবা করবে …

বটুকেশ্বরও বুঝে নিয়েছে। এ আসরে ভাঁড়ামি চলবে না। বললে, শুনেছি সে বিধবা। নিঃসন্তান!

—তাহলে তার সহমরণে যাবার কথা। না হলে অন্তঃপুরের চতুঃসীমায় লুক্কায়িত থাকা! রাজাসাহেব জানতে চান, কোন দেশের লেড়কি? তৈলঙ্গী?

—আজ্ঞে না। শুনেছি বঙ্গদেশের। রাঢ়খণ্ডের। ব্রাহ্মণ কন্যা। বালবিধবা …

—বামুনের মেয়ে? বিধবা! সহমরণে যায়নি?

—যায়নি যে, তা তো দেখাই যাচ্ছে।

—কতদিন হল সে টোল খুলে বসেছে?

—প্রায় ছয় মাস!

—ছয় মাস! দোষ তোমাদের! আমি রাজকার্যে এলাহাবাদে ছিলাম। তোমরা কোনও ব্যবস্থা নাওনি! আমি ফিরে আসার পরেও কিছু জানাওনি। নেহাৎ জগাপণ্ডিত দরবার করতে এসেছিল তাই এতবড় অনাচারটা আমার গোচরে এল।

আড্ডাধারী এক কথায় অভিযোগটা মেনে নেয়। বলে, তা ঠিক। আমাদের খবর নেওয়া উচিত ছিল তোমাকে জানানো উচিত ছিল। যাক, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন বল, কী কর্তব্য?

রাজাসাহেব বলেন, তোমরাই আমার পরামর্শদাতা। প্রথমে তোমাদের অভিমতগুলো শুনি। কাব্যতীর্থ কী বল? কী শাস্তি দেওয়া উচিত বিদ্যালঙ্কারকে?

কাব্যতীর্থ বলে, শূদ্র আর স্ত্রীলোকের বেদপাঠের অধিকার নাই। শ্রীরামচন্দ্র প্রথমটির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তা শম্বুক উপাখ্যানে বাল্মীকি আমাদের শুনিয়ে গেছেন। দ্বিতীয়টির বিষয়ে কাশীনরেশ কী ব্যবস্থা নেন তাই আমরা এখন দেখব।

—আর আড্ডাধারী? তোমার অভিমত?

—না, রাজাসাহেব। আমি কাব্যতীর্থের সঙ্গে একমত নই। কাব্যতীর্থ স্পষ্ট ইঙ্গিত করেছে—শিরশ্ছেদ! তোমার শুভানুধ্যায়ী হিসাবে আমার পরামর্শ—অতটা বাড়াবাড়ি কর না!

—কেন?

—শম্বুক গোপনে বেদাভ্যাস করছিল। এ মেয়েটি করছে প্রকাশ্যে। কাশীর পণ্ডিতসমাজ তাকে ‘বিদ্যালঙ্কার’ উপাধি প্রদান করেছেন। এতবড় উপাধি আর কোনও স্ত্রীলোক কখনো পেয়েছে বলে আমি তো শুনিনি। না বয়স্য—শিরশ্ছেদ করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আমি বলি—ওকে লঘুতর শাস্তি দাও। মাথা মুড়িয়ে, ঘোল ঢেলে, উল্টোগাধায় চড়িয়ে কাশীরাজ্যর সীমানার বাইরে বার করে দাও। কী বল বটু?

বটু তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে, আজ্ঞে না! তাতে আমার ঘোরতর আপত্তি! প্রথম কথা, অপরাধী শিখাবাদে মাথাটা নিজেই মুড়িয়ে রেখেছে। দ্বিতীয়ত তক্র অতি উপাদেয় পানীয়, অপচয় করা ঠিক নয়। তৃতীয়ত উল্টো গাধা? শাটিকের[১] বদলে শাটিকা[২] গাত্রাবরণী, চোলিকার পরিবর্তে পিরান, কুঞ্চিত কেশদামের বদলে ন্যাড়ামুণ্ডি—মহারাজ, উল্টোগাধার আর বাকিটা কী!

[১ শাটিক—পুরুষদের পরিধেয় বস্ত্র = ধুতি। ২ শাটিকা—রমণীদের পরিধেয় বস্ত্র = শাড়ি]

অড্ডাধারী বলে, তা বটে! এবার রাজা-সাহেবের অন্তিম ফতোয়াটা শোনা যাক।

রাজাসাহেব সোজা হয়ে বসেন। বলেন, রসিকতা নয়, আড্ডাধারী। এ একটি অত্যন্ত গুরুতর বিষয়। রাজশক্তি সচেতন না হলে সমাজে পাপ প্রবেশ করে। অপরাধ একা হটী বিদ্যালঙ্কার করেনি—করেছে কাশীর ঐ তথাকথিত পণ্ডিত-মূর্খরা! যারা ওকে চতুষ্পাঠী খুলে এই ধাষ্টামো দেখানোর পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে। অত্যন্ত নির্মমভাবে আমাকে শাস্তি দিতে হবে! যাতে এ জাতীয় বেলেল্লাপনা আর কোন স্ত্রীলোক ভবিষ্যতে দেখাবার সাহস না পায়!

—তার মানে মৃতুদণ্ড?

—না! তার চেয়েও কঠিনতর দণ্ড! সময়ে তা জানতে পারবে তোমরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *