কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

সোঞাই – ১৮

১৮

দেবীপক্ষের পঞ্চমীতিথি।

আগামীকাল মহাপূজার শুরু। মহাষষ্ঠী। ঘরে ঘরে চঞ্চলতা। জমিদার বাড়ির সম্মুখে প্রতি বছরের মতো এবারও মেলা বসেছে। শুধু এ গ্রামে নয়, এ-অঞ্চলেই ঐ একখানি মাত্র দুর্গাপূজা। গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষ তিন দিনের মধ্যে অন্তত একদিন এসে মায়ের চরণে প্রণাম করে যাবে। সমস্ত দিন দামোদরের সমান্তরালে চলতে থাকবে গো-গাড়ির সারি। ঐ চওড়া রাস্তাটাই দামোদরের বাঁধ। বাঁধ ঠিক নয়, রাস্তাটা জলস্ফীতির বাধা হয়ে কিছুটা মহড়া নেয়, এই আর কী। মাঝে মাঝেই জমিদারবাড়ি থেকে পেল্লাদ আর কেষ্টা বায়েনের যুগলবন্দী ঢাকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে: গুড়-গুড়-গুড়—ধিতাং ধিতাং!

পুজো এখনো শুরু হয়নি। কিন্তু বায়েনদের যেন আর তর সইছে না। ছেলে-বুড়োর মনের তালে তালে তাদের ঢাকের কাঠি-জোড়াও খেয়ালে বে-খেয়ালে নেচে উঠছে।

রূপেন্দ্র এ-কদিন আর রুগী দেখতে যাবেন না, নেহাৎ প্রয়োজন না হলে। জগুঠাকরুণ আর কাতু সাত-সকালে উঠে ও বাড়ি চলে গেছে। ও-বাড়ি বলতে জমিদার বাড়ি। কত কাজ! পুজার যোগান দেওয়া, গুড় জ্বাল দেওয়া, ভোগ,আনন্দ-নাডু পাকানো। পাঁচবাড়ির এয়োরা না করলে কে করবে?

মেঘের দল আকাশে ভেসে চলেছে।

রূপেন্দ্র দাওয়ায় বসে বসে প্রাকৃতিক শোভা দেখছেন। শারদীয়ার প্রাক্কালে পল্লীবাঙলার রূপ। শিউলি গাছ তলাটা ফুলে-ফুলে সাদা। সোনাগলানো রোদ। আকাশ নির্মেঘ। পুঞ্জ পুঞ্জ শুভ্র সেকালে এই সময়েই রাজা মহারাজারা দিগ্বিজয়ে বার হয়ে পড়তেন। সওদাগরের দল যাত্রা করত সমুদ্রের পথে, ‘বদর-বদর’ বলে। দামোদরের কিনার বেয়ে—নদী আর শাহী সড়কের মাঝখানের অপ্রশস্ত কিন্তু অতি দীর্ঘ এলাকাটা এখন সাদায় সাদা–কাশফুলের ঘন জঙ্গলে।

নজর পড়ল সামনের চালাখানায়। যে ঘরখানায় আশ্রয় নিয়েছিল রূপনগরের সেই মেয়েটি আর তার পাতানো মাসি। তারা এখন নেই। নতুন কোন রুগী আসেনি। আরোগ্যশালার তিনখানি ঘরই খালি। না, কুসুমমঞ্জরী রূপনগরে ফিরে যায়নি। সে বর্তমানে আছে ভাঙ্গুড়ীবাড়ি। ঐ পুজোবাড়িতে।

কাটোয়া-ঘাটে পিতৃতর্পণ সেরে ব্রজেন্দ্রনারায়ণ ফিরে এসেছেন দিন-চারেক আগে। মহালয়ার পরদিন এসেই সমস্ত বিবরণ শুনেছেন। বলেছিলেন, লোকটা সম্ভবত ফাঁকা হুমকি দিয়ে গেছে। রূপনগরের মোহন্ত মাহারাজের এখন শিরে সংক্রান্তি। এখন সে ঐ জাতের মূর্খামি করবে না। আগে দেখবে, ভাস্কর পণ্ডিতের ঘোড়াটা আড়াইচালে কোন দিকে যায়—মুর্শিদাবাদ না বর্ধমান। যতক্ষণ না ভাস্কর পণ্ডিত চাল দিচ্ছেন ততক্ষণ প্রেমদাস বাবাজীর দান নেই। তাঁকে প্রতীক্ষা করতে হবে। এই হচ্ছে খেলার আইন।

না, ভীম বা ঈশান সর্দারের ব্যবহারে তিনি ক্ষুব্ধ হননি। বলেছিলেন, তাঁর মোহভঙ্গ হয়ে গেছে। রূপনগরের মোহন্ত মহারাজকে স্বপক্ষে রাখার প্রচেষ্টা নিরর্থক। শুধু দাঁইহাটিতে ভাস্কর পণ্ডিত নয়, রূপনগরের মোহন্ত মহারাজের সঙ্গেও তিনি সাক্ষাৎ করে এসেছেন।

স্বচক্ষে দেখে পূর্বমত দৃঢ়তর হয়েছে ভাদুড়ী মহাশয়ের ভাস্কর পণ্ডিত লোকটা অতিশয় ধূর্ত, নির্মম, নীতিহীন ও অর্থলোলুপ। নিজে হয় তো কামুক নয়, কিন্তু সৈন্যদলের নারী নির্যাতনের বীভৎসতা তার জ্ঞাতসারে।

ব্রজেন্দ্রর অনুমান—ভাস্করের সৈন্য-সংখ্যা আন্দাজ বিশ সহস্র। তার ভিতর অন্তত এক হাজার বন্দুকধারী। বাদবাকির অস্ত্র—তরবারি ও ভল্লা। অশ্বপৃষ্ঠে যখন অগ্রসর হয় তখন পিঠে থাকে ঢাল, কোমরবন্দে তরবারি, বাম হাতে ঘোড়ার লাগাম, দক্ষিণ হস্তে ভল্ল। সৈন্যদলে হাতি নাই, কামানও নাই। তেমনি পদাতিকও নাই। বিশ হাজার সৈন্য তো বিশ হাজার অশ্ব। তাই ওরা প্রভঞ্জনগতি; তাই ওরা দুর্বার। আজ এখানে তো কাল সেখানে। তুলনায় নবাব আলিবর্দীর সমর বাহিনী শ্লথগতি। একাধিক রণহস্তী। তারা দ্রুতগতি, কিন্তু গো-শকটে বাহিত হয় কামান। বহু সৈন্য অগ্রসর হয় পদব্রজে। ভাস্করের তেইশজন সেনা-নায়ক। প্রত্যেকের সৈন্যসংখ্যা নির্দিষ্ট, সুচিহ্নিত। মুহূর্ত মধ্যে নির্দেশ পেয়ে গোটা বাহিনী চার পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে রওনা হয়ে পড়ে। আবার হয়তো দুদিন পরে নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হয়। নবাবী বাহিনী সেভাবে সুশৃঙ্খলবদ্ধ নয়। তারা স্থির করে উঠতে পারে না বর্গীদের সহসা-বিভক্ত কোন দলটিকে অনুসরণ করবে। তাই বৃদ্ধ নবাব গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বর্গী সৈন্যকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কোন ক্ষুদ্র দলে ভাস্কর স্বয়ং আছেন তা বুঝে উঠতে পারেন না।

ব্রজেন্দ্রনারায়ণ যখন ভাস্কর পণ্ডিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান তখন সেই মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ তাঁকে সাদর সম্ভাষণে আপ্যায়ন করেন। বর্ধমানরাজের দূত যেন বর্ধমানরাজ স্বয়ং! কথাবার্তায় তিনি বোঝাতে চাইলেন যে, তিনি এসেছেন যবন নিধনের ব্রত নিয়ে। আলিবর্দী চৌথ প্রদানে স্বীকৃত হোন বা না হোন, ভাস্কর সংকল্পচ্যুত হবেন না—সে সংকল্প নবাব আলিবর্দীকে গদিচ্যুত করে কোনও উপযুক্ত হিন্দু রাজাকে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা। যে দুরাত্মা মহাপূজায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে সদ্-ব্রাহ্মণকে অষ্টমীতে প্রতিমা বিসর্জন দিতে বাধ্য করে, তার কোন ক্ষমা নাই! পরবর্তী নবাব? যিনি ভাস্কর পণ্ডিতকে ঐ যবন-নিধন কার্যে সম্যক সহায়তা করবেন। তিনি কে, ভাস্কর জানেন না—মা ভবানীর ইচ্ছা। নদীয়ারাজ হতে পারেন, বর্ধমানরাজ তিলকচাঁদও হতে পারেন। ব্রজেন্দ্র জাত-’বারিন্দির’। বৈষয়িক বুদ্ধিতে মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণের কাছে হারবার পাত্র নন। তিনি বর্ধমান-মহারাজের তরফে ভাস্কররাম পহুরে শ্রীকৃষ্ণের দশম অবতাররূপে নমস্কার করে এসেছেন। শ্রীজয়দেবকৃত দশাবতার স্তোত্রটি শুনিয়ে দিয়ে এসেছেন—যার দশম অবতারম্লেচ্ছান মূর্ছয়তে’”সম্ভবামি’ হবেন বলে প্রতিশ্রুত। কথা দিয়েছিলেন পণ্ডিতজীর কী কী ‘হিঞ্ছা’, কোন্ কোন্ উদ্যোগ, তা বর্ধমানরাজকে সবিস্তারে জানিয়ে দেবেন। তা তিনি দিয়েছেন। কাটোয়া থেকে ফেরার পথেই পড়ে শহর বর্ধমান। যেখানে তিলকচাদকে সব কথা জানিয়ে এসেছেন। এবং একথাও বলতে ভোলেননি যে, বাকচাতুর্যে তাঁকে আশ্বস্ত করে সেই ধূর্ত ব্রাহ্মণের পক্ষে অতর্কিতে বর্ধমান রাজ্যটি আক্রমণ করা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। তার মূল লক্ষ্য—অর্থ সম্পদ।

ব্রজেন্দ্রর সন্দেহ হয়েছিল ভাস্করের শিবিরে কী যেন একটা কর্মচঞ্চলতা। শিবিরে কী যেন একটা কর্মচঞ্চলতা। দাঁইহাটির শিবির গুটিয়ে দুই একদিনের মধ্যেই তিনি কোথাও চলে যাবেন। আত্মগোপন না অতর্কিত আক্রমণ তা বুঝে উঠতে পারেননি। আক্রমণ হলে লক্ষ্যস্থল কোনটি? বর্ধমানরাজের রাজপ্রাসাদ, নদীয়ারাজের কৃষ্ণনগরের প্রাসাদ, অথবা খাশ মুর্শিদাবাদ? সম্ভবত কলকাতার দিকে অভিযান করবে না সে। সংবাদ

পেয়েছে, ইংরাজ স্থপতি যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়েছে—পরিখা খনন—‘মারাঠা ডিচ’ এবং প্রতিটি প্রবেশদ্বারে কামান সংস্থাপন। তবে প্রথমেই মুর্শিদাবাদ অভিযান করবে না। তার পূর্বে দু-একটি ছোট-খাট রাজভাণ্ডার তাকে লুটে নিতে হবে—বর্গী সৈন্যদলকে সন্তুষ্ট করতে, তাদের লোভের আগুনে ইন্ধন জোগাতে। যাতে নবাবী তোষাখানা আক্রমণের সময় সবাই মরণপণ লড়ে।

বর্ধমানে রাজকার্য সমাধা করে রওনা হয়েছিলেন উত্তর-পশ্চিম মুখো। পথে গুশকরা, আউসগ্রাম মৌজা। তারপর অজয়ের তীরে ইলামবাজার। অদূরে ‘কবিরাজ’ জয়দেবের স্মৃতিবিজড়িত কেন্দুবিশ্ব ও কদমখণ্ডির ঘাট। তার উত্তরে ধর্মমঙ্গলের কালের অসীম শক্তিশালী ইছাই ঘোষ-এর গড়। গোপভূমের মহা শক্তি উপাসক। আজ অরণ্যভূমির কাছে মাথা নত করেছে তাঁর শ্যামরূপার গড়—ইটের স্তূপ যেন পাহাড় হয়ে পড়ে আছে। ‘ইছাই” সম্ভবত ‘ঈশ্বর’ শব্দের অপভ্রংশ। যেটাকে আজ সকলে শ্যামরূপার গড় বলে, ওটাই এককালে ছিল ঈশ্বর ঘোষের মহা সমৃদ্ধিশালী রাজধানী ঢেক্কুর বা ঢেকুর। কোন কালে? পাল রাজাদের আমলে তো বটেই। হয়তো বিগ্রহপালের সময়ে। তার অর্থ সাত-সাতটি শতাব্দী পার হয়ে গেছে—রাঢ়খণ্ডের কোনও ভূস্বামী প্রয়োজন বোধ করেননি সেই স্তূপের ইট দিয়ে নতুন একটি গড় গড়ে তুলতে, অজয়ের কিনার ঘেঁষে—বৈদেশিক শত্রুকে প্রতিহত করতে। বৈদেশিক শত্রুরা যে মাঝে মাঝে অতর্কিতে আসে, ষাঁড়াবাড়ির বানের মতো—না, ভুল হল, ভাদ্রের বানের মতো তা নির্দিষ্ট সময়ের ‘ব্যবধান আসে না, আসে অনিয়মিত—ভূমিকম্পের মতো। কিন্তু আসে। শুধু হিন্দুস্থানের নয়, বাঙলার ইতিহাসেও পৌনঃপুনিকতায় এ ঐতিহাসিক সত্যটি ক্লান্তিকর! তবু সাত শতাব্দীর ভিতর কোন ক্ষমতাশালী নৃপতি রাঢ়খণ্ডে আর দ্বিতীয় কেল্লা নির্মাণ করেননি। বোধকরি তাঁদের আশা ছিল—তাদের শাসনকালে এ দুর্দৈব ঘটবে না। ঘটলেও উৎকোচে বশীভূত করতে পারবেন বিদেশী দস্যুদের। সেই মূল্যই দিয়েছে বাঙালী সাম্প্রতিক মগ, পর্তুগীজ আর হার্মাদদের আক্রমণে, এখন দিচ্ছে বর্গীদের

শুধু অর্থ নয়, দিতে হয়েছে ইমান আর ইজ্জৎ!

নৌকা থেকে শ্যামরূপার পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপ দেখতে দেখতে সে কথাই মনে হচ্ছিল ব্রজেন্দ্রনারায়ণের।

আরও দাগা পেলেন রূপনগরে উপনীত হয়ে।

বিদেশী মহারাষ্ট্রীয় দস্যুসর্দার তাঁকে যে সম্মানটুকু দিয়েছিল রূপনগরে মোহন্ত মহারাজ সেটুকুও দিলেন না। লোকটা স্থবির। স্থূলকায়—ব্রজেন্দ্র অপেক্ষা অন্তত দশ বৎসরের বড়। ব্যভিচারে বিকৃততনু। নারীসংসর্গের হয়তো ক্ষমতাই নাই—কিন্তু লালসার তৃপ্তি হয়নি আজও।

সর্বক্ষণ সে ঐ এক কথাই বলে গেল—কোন সাহসে ব্রজেন্দ্রনারায়ণের তালুকভুক্ত এক অকালপক্ক কবিরাজ তাঁর রাইরানীকে এভাবে আটকে রাখে? তিনি এক সপ্তাহমাত্র সময় দিচ্ছেন ভাদুড়ীমশাইকে। তার ভিতর যদি বন্দিনী ফিরে না আসে তাহলে সোঞাই গ্রামখানিকে রাঢ়ভূমের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হবে!

বর্গীদের প্রসঙ্গ দু-তিনবার তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রেমদাস বাবাজী কর্ণপাত করেননি। বলেছেন, আপনারা নিজ নিজ ঘর সামলান ভাদুড়ীমশাই—আমাকে পরামর্শ দিতে আসবেন না। অপরিসীম দার্ঢ্যে বলেছিলেন, সেই মারাঠী ব্রাহ্মণকুলাঙ্গারটির সঙ্গে দেখা হতে বলবেন, রূপনগর অধিকার করার দুর্মতি হলে যেন তার পিতার নামটি একটি ভুজপত্রে লিখে নিয়ে আসে—জীবিত ফিরে যাবার সৌভাগ্য হলে সেটি তার প্রয়োজন হবে।

ব্রজেন্দ্রনারায়ণের মনে পড়ে গিয়েছিল সেই অজ্ঞাত উর্দুকবির বয়েটি :

“ইধর গৌড় মেঁ হরতরফ অন্ধেরা।
কি থা গিয়ান গুণকা লড়াইয়াসে ডরা।“

—এদিকে যুদ্ধভীত বঙ্গভূমের চর্তুদিকে থেকে ঘনিয়ে এসেছে নীরন্ধ্র অন্ধকার।

বেলা তখন দ্বিপ্রহর। হঠাৎ মনে হল দূর-বহুদূর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে : ডুম-ডুম্, ডুম্-ডুম্, ডুম-ডুম্!

উঠে পড়লেন রূপেন্দ্র। কান খাড়া করে শুনলেন। না, ভুল শোনেননি তিনি। শব্দটা আসছে ঈশান কোণ থেকে—অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিক থেকে। সম্ভবত দামোদরের ওপারে অবস্থিত পীরপুর গ্রামের দামামা। ছুটে বেরিয়ে এলেন বাইরে। ষষ্ঠীচরণ এড়োএড়ি ভাবে দৌড়ে মাঠটা পার হচ্ছিল। তাকে প্রশ্ন করলেন, কিসের শব্দ রে ষষ্ঠি?

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে লোকটা। বলে, বর্গীর হাঙ্গামা মনে লাগে। ঘাট পানে যাই, ঠাউর। আপনেও আসেন।

দামোদরের দক্ষিণপারে এই সোঞাই গ্রাম। বর্গীদের বর্তমান অবস্থান—যদি দাঁইহাটিই হয়—তাহলে দামোদরের ওপারে। নদীর ওপার থেকে তাদের আক্রমণের আশঙ্কাটা বেশি। সেজন্য প্রতিরোধ পরিষদ নদীতীরের দিকটাই অধিকতর সুরক্ষিত করেছে। শঙ্খধ্বনি বা দামামার সঙ্কেতমাত্র যে যার কাজে লেগে যাবে—বিনা নির্দেশে। অতর্কিত আক্রমণে যথাযথ আদেশ দেবার সময় থাকে না। তাই সবরকম দায়িত্ব বিভাগ আগেভাগে করা আছে।

রূপেন্দ্র উড়নিটা দড়ি থেকে টেনে নিয়ে নগ্ন গাত্র আবরিত করলেন। খড়ম-জোড়া খুলেই রাখলেন। প্রয়োজনে যাতে দৌড়াতে পারেন। নগ্নপদেই সুবিধা। সদরে শিকলটা তুলে দিয়ে দ্রুতপদে রওনা দিলেন দামোদরের ঘাটের দিকে। বাড়ির মেয়েরা পূজাবাড়ি।

ততক্ষণে দামোদরের কিনার ঘেঁষা বিভিন্ন পল্লী থেকে ভেসে আসতে শুরু করেছে শঙ্খধ্বনি। মাঝে একবার শোনা গেল নদীর ওপার থেকে : আ-বা-বা-বা-বা!

—জেগে আছি। সবাই জেগে আছি। তোমরাও সজাগ হও!

লক্ষ্য হল, সদর দোরে শিকল তুলে দিয়ে এ-বাড়ি ও বাড়ির পুরললনার দল দ্রুতপদে মাঠ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে ভাদুড়ী-বাড়ির দিকে। এটাও পূর্ব-পরিকল্পনা মতো। পূজা মণ্ডপে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে চিড়া আর গুড়। তাছাড়া বিরাট চৌবাচ্চায় পানীয় জল। প্রয়োজনে দু-তিন দিন সারা গ্রামের শিশু-নারী ও বৃদ্ধর। সে বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেও তারা অনাহারে থাকবে না।

অধিকাংশ বাড়িই পর্ণকুটির—দাহ্য। বর্গীরা সবার আগে চালায় ধরিয়ে দেয় আগুন। আতঙ্কতাড়িত অর্ধদগ্ধ নরনারী বার হয়ে এলেই পড়ে বর্গী ডাকাতদের খপ্পরে। তারা বেছে নেবার সুযোগ পায়—কাকে হত্যা করবে, কাকে জিইয়ে রাখবে ভিন্নতর মৃত্যুর স্বাদ দিতে। জমিদারবাড়ি পাকা-ইটের। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সৌধ শীর্ষে ইন্দ্রকোষের ব্যবস্থাপনা, যার আড়ালে আত্মগোপন করে ধানুকী সৈনিক আক্রমণকারীদের মহড়া নিতে পারে। অধিকাংশ গৃহস্থ তার মূল্যবান যা কিছু—অলঙ্কার বা নগদ সঞ্চয় আগেভাগেই মাটির ভিতর পুঁতে রেখেছে! মুহূর্তমধ্যে দোরে শিকল দিয়ে জমিদারবাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা পাকা।

রূপেন্দ্র যখন দামোদরের তীরে এসে পৌঁছালেন তখন সেখানে অনেক মানুষের জটলা। তাঁর মতো কেউ খালি হাতে আসেনি। যা হোক একটা অস্ত্র এনেছে—নিদেন তেলপাকা লাঠিগাছ।

দামোদরের মূল স্রোত এখন এ-পাড় ঘেঁষে। এপাড় ভাঙছে, ওপারে চড়া পড়ছে। এদিকে বরাবর খাড়া পাড়, শুধু পারানি ঘাটের কাছে প্রায় তিনশ হাত নদ-কিনার সমতল। সেখানেই ‘নৌকা বাঁধার আয়োজন, পারানি ঘাট, স্নানঘাট। তুলনায় ওপাড়ে অনেকটা শুধু বালি আর বালি।

শোনা গেল, অনেকেই বর্গী বাহিনীকে দেখেছে। অশ্বারোহী—কিন্তু একটি রণহস্তীও আছে। ব্রজেন্দ্রের সংগৃহীত সংবাদ অনুসারে বর্গীদের এক্তিয়ারে হাতি ছিল না। সম্ভবত ইতিমধ্যে অন্য কোন যুদ্ধবাহিনীর কাছ থেকে সেটি ছিনিয়ে নিয়েছে। অথবা রণহস্তীসহ আরও কিছু বর্গী সৈন্য আবির্ভূত হয়েছে নাগপুরের দিক থেকে

রূপেন্দ্র তাদের দেখতে পেলেন না। তারা নাকি পুব দিক থেকে নদের কিনার ঘেঁষে দল বেঁধে আসছিল। বীরপুর থেকে দামামার শব্দ হতেই ঘাটের মাঝি-মাল্লারা সচকিত হয়ে ওঠে। তারা ‘কুক্’ দিয়ে দুঃসংবাদটা জানিয়ে দেয় সবাইকে। তৎক্ষণাৎ সবাই নোঙর তুলে নৌকাগুলি জলে ভাসায়। সারিবদ্ধ নৌকা চলে আসে এ-পারে। অশ্বারোহী বাহিনী যখন ওদিকের পারানি-ঘাটে এসে পৌঁছায় তখন সে ঘাট জনমানবহীন। একখানিও নৌকা নাই। দামোদর এখনো টইটম্বুর। ওরা বাধ্য হয়ে ফিরে যায়—যে পথে এসেছিল, সেই পথে।

সমস্ত বিবরণটা শুনে লক্ষ্মণ বাগ্দী বললে, ই কথাটা তো মানতে লারলেম। শালারা সমুখবাগে না যায়ে পিছু হটলেক কেনে গো?

যুগী ডোম রুখে ওঠে, মুই কি মিছা কতা বলিছি? শুধাও কেনে রতনেরে, রহিমচাচারে, বড়খোকারে।

লক্ষ্মণ সর্দার বলে, সি কথাটো লয় রে যগন, মিছা কতা বুলার কতা বলি নাই। শুন কেনে-

লক্ষ্মণের বিশ্লেষণটা ভেবে দেখার :

বর্গী সৈন্যদল যে-পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে গেল কেন? ওরা পশ্চিমমুখো আসছিল—তাহলে তাদের লক্ষ্যস্থল সেদিকেই। নদের ওপার থেকে জমিদার বাড়ির দোতলা অংশটা অথবা মন্দিরচূড়া দেখতে পায়। নিশ্চয় তখন স্থির করে এপারে এসে এ গ্রামটা লুট করলে মন্দ হয় না। পাকা ইমারৎ আর মন্দির দেখে তারা বুঝতে পেরেছিল এটি একটি সমৃদ্ধশালী গ্রাম। লুট করলে মেহন্নত পোষাবে। তারপর ঘাটে এসে দেখে একখানিও নৌকা নাই। নদীতে এখন অনেক জল। হাতি না ডুবলেও ঘোড়ার পক্ষে ডুব জল। ঘোড়া অবশ্য সাঁতার দিতে পারে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই বলেছে বর্গী সৈন্যদের পিঠে বাধা ছিল বন্দুক। সাঁতরে নদী পার হতে হলে বারুদ ভিজে যাবে। ফলে তারা পার হবার কোন পথ দেখেনি। এ পর্যন্ত বোঝা শক্ত নয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবার কথা? যে পথে চলেছিল সে পথেই এগিয়ে যাওয়া। এ গ্রামটি লুট করার আশা ত্যাগ করে। তা তারা করেনি। তারা ফিরে গেছে। কেন?

হয়তো ভাঁটির দিকে, অর্থাৎ পুবদিকে—যেদিকে গেছে, সে দিকে কোন ঘাটে নৌকা দেখে এসেছে। ফুল্লরা গায়ে, কিংবা রতনহাটি মৌজার কোন ঘাটে গেছে সেই নৌকাগুলি লুট করে আনতে। সোঞাই গাঁ-খানাকে অব্যাহতি দিতে ওদের মন চাইছে না।

ভীমা বাগ্‌দী বললে, লখাই, তু একটো ঘোড়া লিয়ে দেখি আয় পেরথমে। শালারা কোন বাগে গেল।

আদেশমাত্র লক্ষ্মণ ডোম অশ্বপৃষ্ঠে জোরকদম পূর্বাভিমুখে ছুটে চলল। নদের এ পাড় বরাবর—দামোদরের বাঁধ ধরে।

প্রায় আধঘন্টা বাদে সে ফিরে এল। সংগৃহীত সংবাদ দাখিল করল সেনাপতিকে—ভীমাকে।

না, বর্গী সৈন্যদল রতনহাটী পর্যন্ত ফিরে যায়নি। ফুল্লরাঘাটেও কোনও নৌকা ছিল না। যে খানকয় জেলে ডিঙি ছিল তারাও দামামার শব্দ শুনে এপারে চলে এসেছিল। বর্গী সৈন্য থানা গেড়েছে ঐ ফুল্লরা গাঁয়ে। নিতান্ত নিঃস্ব অন্ত্যজপল্লী। বায়েনপল্লী। পাঁচ বাড়ি লুট করলেও হয়তো এক ধামা মুড়ি জুটবে না। তবে যৌবনবতী কিছু পাওয়া যেতে পারে। সে চেষ্টা তারা করেনি। হয়তো এ বিষয়ে তারা ক্লান্ত। ফুল্লরা গাঁয়ের কোন ঘরের চালায় আগুন দেয়নি। তারা ঝপাঝপ শুধু কলাগাছ কাটছে!

ফুল্লরা গায়ে বিরাট বড় কলা-বাগান। কলা বিক্রয় করা ওদের বাড়তি রোজগারের ধান্দায়। সোঞাই গাঁয়ে কোনও উৎসব হলে কলাপাতার সন্ধানে যেতে হয় ফুল্লরায়। সেই গাছগুলি ওরা কেটে শুইয়ে দিচ্ছে। কেন গো? মানুষের মাথার বদলে কলাগাছ কাটা?

ওরা ভেলা বানাবে। ভেলায় চড়ে দামোদরে পাড়ি দেবে। সোঞাইকে ছেড়ে যেতে ওদের মন সরছে না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে এল ওরা। নদের কিনার ধরে এগিয়ে গেল উজানে, সোঞাইয়ের পারানি ঘাট অতিক্রম করে। বড় বড় কলাগাছ বহন করে। উজান থেকে ভেলা ভাসাতে হবে। যাতে লগি মেরে অগ্রসর হবার সময় স্রোতের টানে ভেলা এসে ভেড়ে এপারের এই সমতল পারানি ‘ঘাটে।

রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, ওরা বর্গীই তো?

তারাপ্রসন্ন জবাব দেন, হ্যাঁ। নবাবী সৈন্য নয়। সবাই হিন্দু। দাড়িওয়ালা মুখ নজরে পড়ছে না বিশেষ। পোশাকও সব হিন্দুর।

ভীমা বাগ্দী তার দলবল নিয়ে এগিয়ে গেল এপার বরাবর—ঐ বর্গীদলের অনুসরণে। আরও ঘণ্টাখানেক অতিক্রান্ত হল ওদের ভেলা বেঁধে তৈরী হতে। ইতিমধ্যে ব্রজেন্দ্র বার দুই দূত পাঠিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। প্রাণপ্রতিষ্ঠা যদিও হয়নি তবু দুর্গা গাঙ্গুলী পূজা মণ্ডপে ঐ মূর্তির সামনেই জপে বসেছেন। তাঁর ধর্মপত্নীটি আসন্নপ্রসবা—চিন্তা তো হওয়ার কথাই। শুধু দুর্গা আর নন্দেরই নয়। অধিকাংশ গৃহস্থের পুরললনার দল সাময়িক আশ্রয় নিয়েছেন জমিদার বাড়ি। প্রধান সিংহদরোজার মাথায় চওড়া প্রাচীরে পূর্বেই নির্মিত হয়ে আছে একটা প্রকাণ্ড উনান। জোগাড় করা আছে কাঠ, হাণ্ডায় জল। ঠিক প্রবেশদ্বারের মাথাতেই ফুটতে থাকবে গরম জল। আক্রমণকারীদের মস্তকে যাতে বর্ষণ করা যায় ফুটন্ত জল—অতিথিদের জন্য পাদোদকের পরিবর্তে ‘মস্তকোদকের’ আয়োজন।

ওপারে ওরা যেখানে ভেলা বাঁধার আয়োজন করছে তার বিপরীতে এপারে ঘন কাশবন। সাদা সাদা ফুলে এখন আকীর্ণ। কাশ ঝোপের ঘন প্রাচীর এই পারানিঘাট তক্—প্রায় পাঁচশ হাত দৈর্ঘ্যের

ভীমা তার প্রতিরোধের যে পরিকল্পনাটি মেলে ধরলো তাতে অবাক হয়ে গেলেন রূপেন্দ্র। ঐ অন্ত্যজ বাগ্দী সর্দারের বংশে কারও অক্ষর পরিচয় নেই। দশ পনের বছর ধরে নিবারণ চক্কোতির খাশ জমিতে বেগার দিয়েও কেন যে তার ঋণমুক্তি হল না—এই সুদকষা অঙ্কটা তার মাথায় ঢোকে না। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তার মাথা যে কি পরিমাণ পাকা, তার একটা প্রমাণ দিল। তার বিচিত্র ভাষায় সে বুঝিয়ে দিল। ওরা দুটো কলার ভেলা বানাচ্ছে। এক একটায় দশজন করে অশ্বারোহী উঠতে পারবে। তার মানে জোড়া-ভেলা এপারে এলে এক কুড়ি সুম্বুন্দির পো এ পারে নামবে। শুভঙ্করী অঙ্ক না-জেনেও ভীমা বলে দিল—তার অর্থ, ওদের শতখানেক সৈন্য পার করতে ‘আনজাদ’ পাঁচ বার জোড়া-ভেলা পারাপার করতে হবে।। ভীমার অনুমান শত-খানেক বন্দুকধারী এপারে না আসা পর্যন্ত ওরা আক্রমণ করবে না। পারানি ঘাটে বন্দুক উচিয়ে প্রতীক্ষা করবে। কেষ্টা-বায়েন তার শাঙ্করভাষ্য দাখিল করে :

—বোয়েছেন। তার মানে হল গে, শালারা মোদের উপর ঝাঁপায়ে পড়বে সঝে নাগাদ জোড়া ভেলা পার করতি আজাদ এক দণ্ড সময় নাগবে। বোয়েছেন?

ঈশান-সর্দার বলে, ইটা তো ভাল ববস্থা খুড়ো। পেরথম ক্ষেপ নামলেই আমরা সেই এক কুড়ির উপর ঝাঁপায়ে পড়ব।

—না রে ঈশেন! ঐ গতিটি করবি না। মোদের হাতে তীরধনুক, সুম্বুন্দির পো-দের হাতে বন্দুক!

—থাইলে?

—বলি শুন!

ভীমা বাঙলা হরফ চেনে না, কিন্তু দামোদরকে চেনে। ঐ নদে নৌকা বাওয়াই তার উপজীবিকা। বুঝিয়ে বলে, ভেলাগুলান শালারা উপারে ক্যামনে’ নে-যাবে তাই ক দিনি?

একটিই উপায়। ভেলা দুটি ঐ বিশজন সৈনিককে নামিয়ে দেবার পর এপারের কিনার ঘেঁষে আধক্রোশ উজানে টেনে নিয়ে যেতে হবে। সেখান থেকে ভেলা ভাসালে তবেই ওরা পৌঁছাবে পরপারের নির্দিষ্ট ঘাটে। না হলে স্রোতের টানে ভেলা বহুদূর ভাঁটিতে ভেসে যাবে। ভীমার রণকৌশল—প্রথম খেপ সৈন্য অবতরণকালে কোনও বাধা দেওয়া হবে না। শুধু আড়াল থেকে অসহায় আর্তনাদ করে ওদের উৎসাহ যোগাতে হবে। যারা নৌকা থেকে নামবে তারা বন্দুক উঁচিয়ে প্রতীক্ষা করবে। জনমানবকে দেখতে পাবে না। কিন্তু তারা এগিয়েও আসবে না। এরপর নিশ্চয় পাঁচ-সাত জন গুণ টেনে ঐ ভেলা জোড়াকে টেনে নিয়ে যাবে উজানে। তারা ঐ প্রথম খেপ সৈন্যদলের দৃষ্টির আড়ালে এলেই আক্রান্ত হবে ভীমার ধানুকী সৈনিকদের বাণে! সম্মুখ যুদ্ধ নয়। কারণ গুণটানা মানুষগুলোও অনিবার্যভাবে হবে বন্দুকধারী। তাদের আক্রমণ করতে হবে কাশঝোপের আড়াল থেকে। তীরবিদ্ধ করে। গুণটানা ঐ পাঁচ-সাত জনকে ঘায়েল করতে পারলেই হাতে আসবে পাঁচ-সাতটা বন্দুক। তখন ঐ জোড়া ভেলাকে টেনে নিয়ে চুপটি করে বসে থাক।

এপারে এককুড়ি স্যাঙাৎ, ও-পারে অনারা। এখন তোমাদের দান! দাও, কী চাল দিবে দাও!

লক্ষ্মণ বলে, ক্যান? ত্যাখন আমরা ই-পারের ঐ এককুড়ি সুম্বুন্দির উপর ঝাঁপায়ে পড়ব! কী দরকার? থাক না শালারা বইস্যা! তামাম রাত! প্যাটের ভিংরি টুইটুইটে জমাট বাঁধুক। কাল ভোরের কুঁকরো ডাকলি বুলব অনে: ‘বাবারা। আইস্য! ঘাটে বন্দুক র্যাখ্যা আগায়ে আস’–মুণ্ডুর উপর হাত তুইল্যা। আমরায় আনন্দ-লাড়’ বানায়ে রাখছি!

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঐ দুর্ধর্ষ লোকটার এই বেপরোয়া রসিকতায় সব কটা দৈত্য অট্টহাস্য করে ওঠে।

কিন্তু বর্গী সেনাপতিও দক্ষ-দাবাড়ু।

রণকৌশলের প্রথম চালেই ওঠসাই কিস্তির ফাঁদে পড়ে যাওয়া তাঁর ধাতে নেই। ভীমার নৌকার চালটা তিনি বুঝে ফেললেন। গজ দিয়ে সে পথে চাপা দিলেন।

প্রথম ভেলা-জোড়া যখন রওনা দিল—ঠিকই ‘আনজাদ’ করেছে ভীমা—দশদুকুনে বিশজন বন্দুকধারীকে নিয়ে, তখন গজরাজও ধীর গতিতে নেমে এলেন দামোদরের বুকে! প্রকাণ্ড রণহস্তী। দাঁতাল। মদ্দা। তার গজকুম্ভে মাহুত। হাওদায় মাত্র একজন যোদ্ধা। মাথায় মস্ত উষ্ণীষ—বোধকরি বর্গীসেনাপতি স্বয়ং!

অর্থাৎ এপারে পৌঁছে ভেলা-জোড়াকে উজানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ওরা করবে হাতি দিয়ে। কাশ ঝোপের আড়াল থেকে তীরবিদ্ধ করে ঐ গজদানবকে বিচলিত করা সম্ভব নয়। আর প্রয়োজনে মাহুত নির্মমভাবে চালিয়ে দেবে হাতিটাকে ঐ কাশঝোপের দিকে। বন্দুকের নিশানা থেকে কাশ ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করতে পার—কিন্তু হস্তিপদদলিত হওয়া রুখবে কী ভাবে?

ভীমার মুখটা কালো হয়ে গেল। বললে, শালারা বুড়বক নয় রে ঈশেন! ফন্দিটা বদলাতে হবেক!

—কী করবা কও?

তৎক্ষণাৎ ভীমা বাগদি তার সৈন্যদলকে সাজালো নতুন ছন্দে। জনা-পঞ্চাশ ধানুকীকে লুকিয়ে ফেলল কাশঝোপের একটা নির্দিষ্ট অংশে। এবার তার জ্যামিতি, গতিবিদ্যা আর ঔদস্থিতিবিদ্যার কঠিন অঙ্ক! এপারের কোন বিন্দু থেকে ভেলার দূরত্ব সর্বনিম্ন হবে—যখন সে দুটি এসে পৌঁছাবে তীরন্দাজদের নাগালের ভিতর! নির্দেশ দিল—ভেলা দুটি তিনপো জলপথ অতিক্রম করলেই সে ‘কুক’ দেবে। আর তৎক্ষণাৎ পঞ্চাশজন তীরন্দাজ এক যোগে ঐ ভাসমান ভেলার সৈনিকদের উপর তীরনিক্ষেপ করবে। ওরাও নিশ্চয় তৎক্ষণাৎ বন্দুক দাগবে। আগ্নেয়াস্ত্র বনাম তীরধনুক! অসম যুদ্ধ! তা হোক—এরা থাকবে শারদলক্ষ্মীর অঞ্চলের আড়ালে—কাশঝোপের অন্তরালে; আর ওরা ভরা দামোদরের উলঙ্গ উচ্ছ্বাসে টালমাটাল। ওরা আত্মগোপনের কোনও সুযোগ পাবে না। এই অসমযুদ্ধের ভাগ্য নির্ভর করবে এদের টিপ-এর উপর। এলেমের উপর!

ঈশান বললে, খুড়ো! সবারে বলি দাও—ঐ বড় সুম্বুন্দির এক্তিয়ার আমার! অরে টিপ করি বেহুদ্দো যান বাণ নষ্ট না করে!

ঈশান সর্দার গাঁয়ের শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ। শুধু সোঞাই নয়, পঞ্চগ্রামের। বছর বছর বীরাষ্টমীতে সে নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে প্রতিযোগিতার আসরে। উড়ন্ত হংসপাতির যে-কোন একটাকে বলে বলে নামাতে পারে! তার দাবী সবাই এক কথায় মেনে নিল। গজারূঢ় সেনাপতির মাথা নেবার অধিকার ওর। মাঝখানে সন্তরণরত গজরাজ, দুপাশে দুটি ভেলা। ওরা তিল তিল করে এগিয়ে আসছে।

থাবা-গাড়া চিতাবাঘের মতো দম ধরে বসে আছে ভীমা বাগদি। ঘন কাশঝোপের আড়ালে। নিঃসাড়ে লক্ষ্য করছে ভেলা দুটোকে। তিলতিল করে সে দুটো এগিয়ে আসছে এপারে। কোণাকুণি। উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণপুবে, দামোদরের স্রোতধারার সঙ্গে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ রচনা করে। দুটি ভেলায় প্রায় বিশজন বর্গী সৈনিক। কেউই অশ্বারূঢ় নয়। ঘোড়াগুলোর লাগাম ধরে দাড়িয়ে আছে কয়েকজন। বাকিরা বন্দুক উঁচিয়ে নিশানা স্থির করেছে ঐ কাশঝোপটার দিকেই। ওরাও গতিবিদ্যা আর ঔদস্থিতিবিদ্যায় বোধকরি ওয়াকিবহাল। জানে, দিগন্তব্যাপী কাশঝোপের ঠিক কোন অংশটায় তীরন্দাজদের ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা। কাশঝোপ এতই নিস্পন্দ যে, তীরন্দাজদের প্রায় নাকের ডগায় এসে বসল একঝাক জলপিপি।

এসে গেছে! নাগালের মধ্যে! কিন্তু সবার সীমানা সমান নয়। ঈশানের বাণ যে দূরত্বে লক্ষ্যবস্তুকে বিদ্ধ করতে পারে, অনেকের তীর অত দূরে পৌঁছাবেই না। জ্যা-আকর্ষণ করার দৈহিক ক্ষমতা তো সবার সমান নয়। এইবার…এইবার!

ভীমা মুখটা নিচু করে। জমি সই-সই। ডানহাতের তালুটা মুখে চাপা দিয়ে ধ্বনি দিতে গেল : আ-বা-বা-বাবা!

দেওয়া হল না।

কারণ ঠিক সেই মুহূর্তেই স্তব্ধ দিগন্ত কাঁপিয়ে ধ্বনিত হল একটা বিকট শব্দ! জলের কিনারে সব চেয়ে উঁচু তালগাছের মাথা থেকে! শিঙার শব্দ!

বেষ্টা-বায়েনের সাবধানবাণী!

উদারা-মুদারা নয়, বোধকরি ‘তারা’-য়! সামাল ভাইসব!—শিরে সংক্রান্তি! বোয়েছেন?

তৎক্ষণাৎ ভেলার সৈনিকদের লক্ষ্যমুখ বদল হল। একসঙ্গে পাঁচসাতটা বন্দুক হয়ে গেল ঊর্ধ্বমুখ। তালগাছের মাথাটা তাদের লক্ষ্য! গর্জন করে উঠল বেশ কয়েকটি বন্দুক—প্রায় একসঙ্গে!

অন্তত একটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি।

ভাদ্রের পাকাতালটির মতো বেষ্টা-বায়েনের মৃতদেহ ছুটে এল ধরিত্রীকে শেষ আলিঙ্গন করতে! আশ্চর্য! বাদক নিষ্পন্দ—অথচ তার শিঙার শব্দটা তখনো থামেনি। গাছ-গাছালিতে এতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে তার শিঙার প্রতিধ্বনি!

জান দিয়ে বেষ্টা-বায়েন কিন্তু একাই এই অসম যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিল। কারণ একযোগে অতগুলি গাদা বন্দুকের প্রতিঘাতে ভেলা দুটি আবার টলোমলো। দ্রুতহস্তে সৈনিকেরা বন্দুকের নলে বারুদ ঠেছে। ভীমা বাগদি ফিরেও দেখল না বেষ্টা বায়েনের দিকে। পরমুহূর্তেই শুনিয়ে দিল সমরধ্বনি।

একঝাঁক তীর ছুটে গেল ভেলার দিকে!

দুটি ভেলায় মিলিয়ে জনা-সাতেক আহত! দু-একটি অশ্বও। তাদের দাপাদাপিতে দুটি ভেলাই কাত হয়ে গেল। প্রাণধারণের তাড়নায় লাগাম ছাড়িয়ে আতঙ্কিত আহত অশ্বগুলি ঝাঁপ খেয়ে পড়ল জলে। তবু দু-এক জন বন্দুক ছুঁড়ল। বেসামাল নৌকায় তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেল।

আবার এক ঝাঁক তীর ছুটে গেল ভেলা দুটোর দিকে।

ঘুরে পড়ল আরও দুজন। বাকিরা দিশেহারা। ঝপাঝপ তারা লাফিয়ে পড়ল জলে। অশ্বগুলি, যে কটি তখনও খাড়া ছিল, তারাও।

তিনচারটি মৃতদেহকে দেখা গেল—স্রোতের টানে ভেসে চলেছে ভাঁটির দিকে। বাদবাকি সৈনিকেরা সাঁতার কেটে ফিরে যাচ্ছে ওপারে। অশ্বগুলি কিন্তু তাদের অনুসরণ করল না। প্রাণধারণের জৈবিক প্রবৃত্তি। এপার অনেক কাছে, ও পার বহুদূর। সব চেয়ে নিরাপদ স্থান ঐ পারানি ঘাট–বাদ বাকি খাড়া পাড়। ঘোড়াগুলো একে একে উঠে এল পারানি ঘাটে। সেটা জনমানবহীন।

হাতিটা?

সেটাও সাঁতার দিয়ে এসে উঠল এপারে। স্নানঘাটে। আর তার মাহুত? সেই সেনাপতি?

মাহুতটার কী হয়েছে কেউ দেখেনি। বোধকরি সেও সাঁতরে চলে গেছে ওপারের নিরাপদ আশ্রয়ে।

তাহলে সেই গজারূঢ় বর্গী সেনানায়ক?

ঈশান তার ডান হাতখানা বাড়িয়ে বললে,—হু-ই দেখ কেনে?

হ্যাঁ, এখনো দেখা যাচ্ছে। দামোদর তাকে নাচাতে নাচাতে নিয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। সেখানে একদিন ভোজ খাবে কামট-কুমির।

ভেলা দুটোও ভেসে চলেছে সেনানায়কের সাথে সাথে।

দুপারেই নেমে এল স্তব্ধতা। ঈশান এবার এগিয়ে এল। বলিষ্ঠ দুহাতে বেষ্টা বায়েনের মৃতদেহটা তুলে নিয়ে তাকে গালমন্দ করতে থাকে : তুর মাতা খারাপ হয়ি গেল কেনে বেষ্টাদা! কেনে বাজাই দিলি শিঙাটো? বুদ্ধু কাঁহাকা!

সে-কথার জবাব দিতে দৈত্যের মতো মানুষটার গলা কেঁপে গেল। ভীমা বললে, গালি দিস্ নারে ঈশেন! বেষ্টা শিঙা বাজাই দিলেক তুদের জান দিতে! নাইলে তুর-আমার লাশ পাড় থাকত ইখানে!

মর্মান্তিক সত্য! শিঙার শব্দে সে সব কয়টা বন্দুকধারীকে বিচলিত করেছে। লক্ষ্যমুখ ঘুরিয়ে দয়েছে তাদের!

বেষ্টা আজ শহীদ!

দুপারেই নেমে এল স্তব্ধতা। ওরা দ্বিতীয়বার আর এই দুরন্ত দামোদরকে অতিক্রম করার দুঃসাহস দেখালো না। আর ভেলাই বা কোথায়? সমস্ত দিন দু-পারে দুই দল নিশ্চুপ বসে রইল। কেউ নতুন চাল দিল না।

সন্ধ্যার ঝোঁকে দেখা গেল পুবদিক থেকে ধুলো উড়িয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে আসছে একজনমাত্র ঘোড়সওয়ার। দামোদরের ওপার দিয়ে। সম্ভবত সংবাদবহ, মূল বাহিনীর বর্গী নর্দারের কোন জরুরী আদেশ জারী করতে হয়তো। ওপারে একটা চঞ্চলতা—ছোট ছোট দলে টপদলে কী-যেন শলা পরামর্শ হচ্ছে। তারপর ওরা সিদ্ধান্তে এল। অশ্বারোহণ করল সবাই। একটি হাতি, কিছু ঘোড়া আর কিছু সৈনিককে হারিয়ে তারা নতমস্তকে ফিরে গেল পুবমুখো—যে পথ বেয়ে তারা সগৌরবে এসেছিল সকালবেলা।

ব্যাপারটা কিছুই বোঝা গেল না। আন্দাজে মনে হল, ওদের প্রত্যাবর্তনের নির্দেশই পাঠিয়েছেন মূল সেনাধ্যক্ষ—হয়তো স্বয়ং ভাস্কর-পণ্ডিত। ভীমা বাগদির চ্যালাচামুণ্ডার দল উল্লাসে জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে। সে কলরোল থামলে ভীমা বললে, শালাদের বিশ্বাস নাই রে, লখা। অখনই লাফাস না।

বাকিটা বলতে হল না। লক্ষ্মণ জবাবে বললে, হ, বোঝছি। দেইখ্যা আসি।

ঘোড়ায় উঠল সে। বর্গী-বাহিনীর সমান্তরালে সে এপাড়ের সড়ক ধরে পুবমুখো চলল—দেখে আসতে, ওরা সত্যিই ফিরে গেল, নাকি এ ওদের আর একটা চাল!

এক প্রহর রাতে সে ফিরে এসে জানালো, না ওরা সত্যিই ফিরে গেছে। তবু ভীমা রাত্রে নদীতীরে কিছু প্রহরার ব্যবস্থা করল। তারপর তার নিজস্ব ডিঙি নৌকাটার বাঁধন খুলতে খুলতে ভাইপোকে বললে, ঈশেন, অরে নে আয়। ফুল্লরায় যাতি হবে। সে-আবাগী পথ চায়ি বসি আছে।

সে-আবাগী! যমুনা! বেষ্টা বায়েনের ঘর-ওয়ালী। তিনটি সন্তানের জননী। ওরা থাকে ঐ ফুল্লরা গাঁয়ে। সাত-সকালে বছরকার দিনে দুটো পাত্তা মুখে দিয়ে তার সেই মরদ শিঙা বগলে গ্রাম ছেড়ে এ-পারে এসেছে। তারপর সারাটা দিন বোধকরি হতভাগিনী ঘর-বার করেছে—মরদটা এখনো ফেরে না কেনে?

বেষ্টাকে ওরা শুইয়ে দিল ভীমার ডিঙি নৌকায়। প্রহ্লাদ বায়েন—বায়েন পাড়ার মোড়ল—বসল তার মাথাটা কোলে নিয়ে। দশ-বিশটা মাঝি-মাল্লা শবানুগমন করল। সবার আগে বেষ্টাকে নিয়ে যেতে হবে ফুল্লরা গাঁয়ে। যার ধন তার কাছে পৌঁছে দিতে।

রূপেন্দ্র নতমস্তকে ফিরে এলেন বাড়িতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *