কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৫

প্রথম প্রহরের শিবাধ্বনি হতে ভোলা দুটি আসন পেতে দিল রান্নাঘরে। ভাত, ডাল, ব্যঞ্জন, জল-পাত্র, দুটি রেকাবিতে লবণ, গন্ধলেবু, পাপড় ভাজা, কিন্তু অন্নপাত্র দুটি শূন্য। রূপেন্দ্র আচমন করে আসনে বসলেন। ভারতচন্দ্র স্পর্শ বাঁচিয়ে উবুড়-করা অন্নপাত্রটি নিয়ে এসে দুজনের পাতে ভাত বেড়ে দিলেন। আসনে বসতে যাবেন, ধমক দিল ভোলা, উদের মতো চোখ নাকি গো তোমার? হাঁড়ির ভিৎরি আলুসেদ্ধ আছেন, তা বার করতি হবেনি?

ভারতচন্দ্র কথা বাড়ান না। হাঁড়ির তলদেশ হাতড়ে হাতা দিয়ে তুলে আনলেন আলু সিদ্ধ।

আহারের শেষ পর্যায়ে দুটি রেকাবিতে এক জোড়া করে কী একটা বিচিত্র মিষ্টান্ন নামিয়ে রাখল ভোলা। রূপেন্দ্র দেখলেন তাকিয়ে—মিষ্টান্নের গড়নটি মৃদঙ্গের মতো, অচেনা—মুখে দিয়ে দেখলেন অতি সুস্বাদু। অনেকটা পানতুয়ার মতো; কিন্তু কিছু পার্থক্যও আছে। আহারকালে তিনি বাকসংযম করেন। আচমনান্তে বলেন, মিষ্টান্নটি তো বড় অদ্ভুত। কী নাম এর?

ভারতচন্দ্র বলেন, সে কি! এ মিষ্টান্ন তোমার অপরিচিত? বর্ধমানে কখনো যাওনি?

—কেন যাব না? কতবার গেছি। সেখানকার বিখ্যাত মিষ্টান্ন তো সীতাভোগ আর মিহিদানা।

—সম্প্রতি এটিও যুক্ত হয়েছে। সে এক মজার গল্প। এর নাম: ‘ল্যাংচা!

—’ল্যাংচা’? এ যে কাব্য-নায়িকার নাম “বিদ্যা-র বদলে ‘পাঁচি’! এমন অদ্ভুত নাম কেন?

—তাহলে সেই মজার কিস্সাটা শোন :

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের একটি কন্যার বিবাহ হয়েছিল—কয়েক বছর আগে—বর্ধমান রাজার এক পুত্রের সঙ্গে। বিবাহের কয়েক বছর পরে মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়। কিছুই তার মুখে রোচে না। তার শাশুড়ী—বর্ধমান মহিষী—নানান সুখাদ্য নিয়ে আসেন; কিন্তু পুত্রবধূ শুধু মাথা নাড়ে। একদিন তিনি জনান্তিকে বৌমাকে চেপে ধরেন, বল মা, তোমার কী খেতে ইচ্ছে করছে?

বালিকাবধূ নতনেত্রে বলেছিল : ল্যাংচা!

ল্যাংচা? খাদ্যদ্রব্য? রানীমা আকাশ থেকে পড়েন! জানতে চান, সেটা কী?

মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। বালিকাবধূ কিছুতেই আর কিছু বলে না। পরদিন তার স্বামী জনান্তিকে মাকে জানায় ‘ল্যাংচা’ কোন খাদ্যদ্রব্যের নাম নয়। তবে বাপের বাড়িতে থাকতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে ঐ বালিকাবধূ কী একটা মিষ্টান্ন খেয়েছে। তার নামটা ভুলে গেছে। যে তৈরী করত তার একটা পা খোঁড়া! সেই ল্যাংচা-মেঠাইওয়ালার সেই বিশেষ মিষ্টান্নটি আস্বাদনের সাধ হয়েছে আসন্নপ্রসবার। কথাটা সে মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। জানাজানি হলে বেচারি নিদারুণ লজ্জা পাবে।

রাজমহিষী গোপনে সংবাদটা জ্ঞাপন করলেন বর্ধমানরাজকে। তৎক্ষণাৎ এক বিশ্বস্ত অশ্বারোহী দ্রুতগতি ঘোড়া ছোটালেন নদীয়ার দিকে—রাজাবাহাদুরের জরুরী এবং গোপনপত্ৰ নিয়ে। অনতিবিলম্বেই বন্দী করে আনা হল সেই খঞ্জ ময়রাকে। কৃষ্ণচন্দের অনুমতিক্রমে বর্ধমানরাজ সেই খঞ্জকে শহর বর্ধমানের পুবে চারক্রোশ দূরে বড়শূল গ্রামে একটি ভূসম্পত্তি দান করলেন। ঘর ছাইয়ে দিলেন। লেংচা-বিশারদ প্রতিষ্ঠা পেল। দোকান দিল বাদশাহী সড়কের উপর শক্তিগড় গ্রামে—বড়শূল থেকে আধক্রোশ দূরত্বে। প্রত্যহ তার ভিয়েন থেকে একমণ করে সেই বিচিত্র মিষ্টান্ন সরবরাহ হতে থাকে বর্ধমান রাজপ্রাসাদে।

খঞ্জ মিষ্টান্ন-বিশারদ সবই পেল—জমি-জেরেত, ঘর-দোকান—খোয়ালো মাত্র একটি জিনিস তার আবিষ্কৃত মিষ্টান্নের আদিম নামটা।

সেটা হয়ে গেল : ল্যাংচা!

এঁটো তুলে ভোলা এবার নৈশ আহার সারতে বসেছে। তার আগে তামাক দিয়ে এসেছে কবিকে। দুই বন্ধু জমিয়ে বসেছেন আবার ভারতের ঘরে। সুযোগ বুঝে রূপেন্দ্রনাথ বলেন, আমার একটা সমস্যা আছে, কবি। কী কর্তব্য, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ভেবে-চিন্তে একটা সমাধান বাংলাও তো।

ভারত বলেন, সমস্যাটা আগে শুনি?

রূপেন্দ্র বিস্তারিতভাবে জানালেন কাত্যায়নী সংক্রান্ত সমস্যাটার কথা। নবমবর্ষে তাঁর ভগিনীটির গৌরীদান হয়েছিল। ‘পাত্রের নাম গঙ্গাচরণ, পিতার নাম “ বিষ্ণুচরণ চট্টোপাধ্যায়। গোয়াড়ি-গাঁয়ের নেদের-পাড়ায়। তারপর এই দীর্ঘ সাত-আট বছর জামাতা বাবাজীবন না-পাত্তা। কৃষ্ণনগরে রুগী দেখতে আসার পূর্বে রূপেন্দ্র স্থির করেছিলেন জামাই-বাড়ির খোঁজ করে ব্যাপারটা জানবেন। কিন্তু কাতুর মা—ওঁর পিসিমা, যাত্রামূহূর্তে কঠিন দিব্যি দিয়ে বসেছেন। এসব দিব্যি-দিলেশ রূপেন্দ্র মানেন না—এগুলিকে কুসংস্কার বলেই গণ্য করেন। কিন্তু পিসিমা যখন হেতুটা জানালেন তখন থমকে যেতে হল তাঁকে। রূপেন্দ্র বুঝে উঠতে পারছেন না, এ ক্ষেত্রে কী তাঁর করণীয়।

আদ্যন্ত সব কথা শুনে ভারতচন্দ্র বললেন, আমি তোমার পিসিমাতা ঠাকুরানীর সঙ্গে একমত, রূপেন্দ্রনাথ। ‘যঃ ধ্রুবানি পরিত্যাজ্য…’! তোমার ভগিনী, তার বয়স এখন ষোলো-সতের, সে রঙিন শাড়ি পরছে, মাছ-ভাত খাচ্ছে। স্বামীসুখ-বঞ্চিতা, কিন্তু সধবা। আমার আশঙ্কা—সংবাদ নিতে গেলে সুসংবাদ পাওয়ার সম্ভাবনা এক-কড়া, দুঃসংবাদের উনিশ-কড়া! জীবিত থাকলে, সে ইতিমধ্যে নিশ্চয় পার্বণী আদায় করতে তোমার ভদ্রাসনে যেত।

রূপেন্দ্র চিন্তিতমুখে বলেন, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কি আমার উচিত নয় …

—না। ও কথাটা বল না!—সোজা হয়ে বসলেন কবি। হুঁকোটা নামিয়ে রেখে বলেন, যতক্ষণ খবর না পাচ্ছ ততক্ষণ ধরে নাও সে সন্ন্যাসী হয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরছে! দেখ রূপেন্দ্র—ঐ হতভাগীগুলোকে আমরা কী দিয়েছি? সমাজ কী দিয়েছে? কেন অহেতুক খুঁচিয়ে ঘা করছ?

রূপেন্দ্রর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। বলেন, তা ঠিক! কী জান ভারত? আমি এসব শাস্ত্র নির্দেশ-ফির্দেশ মানি না। বিবেকের নির্দেশে চলি। স্থির করেছিলাম—খবর নেব। যদি জানতে পারি খবর শুভ নয়, তাহলে স্রেফ্‌ গোপন করে যাব!

ভারতচন্দ্র সবিস্ময়ে বলেন, তুমি মনে কর না তাতে তোমার পাপ স্পর্শাবে?

—না! করি না! নয় বছর বয়সে গৌরীদান হয়েছিল হতভাগীর। স্বামীর চেহারাটা সে আদৌ মনে করতে পারে না। সেই অদেখা, অচেনা একটা মানুষ—যে স্বামীর কর্তব্য করেনি—একমুঠি খেতে দেওয়া তো দূরের কথা—সাত বছরের ভিতর একবার এসে জিজ্ঞেস্ করতে পারেনি—’কেমন আছ?’—সে ওর বাকি জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করবে? স্বামীসুখ না পাক, সে তো এয়োস্ত্রীর মর্যাদা পাচ্ছে!

অনেকক্ষণ ভারতচন্দ্র কোন কথা বললেন না। তাঁর মনে হল—রূপেন্দ্র যা বলছে তার ভিতর যুক্তি নেই একথা স্বীকার করতে বাধে, কিন্তু তা কি মেনে নেওয়া যায়? তিনি নিজে পারতেন? প্রশ্ন করেন, তাহলে সে পথেই কেন গেলে না ভাই?

—সাহস পেলাম!

—তবেই দেখ! সংস্কার থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না

—না, না, না! সে-কথা বলিনি! কাতু যে বুঝে ফেলেছিল আমার মতলব। সোজা বললে, তুই পারবি না দাদা! তোর মুখ দেখেই আমি বুঝে ফেলব! তুই লুকাতে পারবি না!—কথাটা মিথ্যা নয় ভারত! বোনটাকে আমি সত্যিই বড় ভালবাসি! হয়তো ফিরে গিয়ে আমি চোখের জল রুখতে পারতাম না!

ভারতচন্দ্র উঠে পড়েন। বলেন, তোমার ভগিনীটি বুদ্ধিমতী! ঠিকই বলেছে সে! তুমি খোঁজ নিতে যেও না রূপেন্দ্র! শাস্ত্র বলেছেন—’অশুভস্য কালহরণম্।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *